সামাজিক আয়তন ও পরিসরের দিক দিয়ে, পৃথিবীতে যত ধর্ম ও সভ্যতার আবির্ভাব হয়েছে ইসলাম সে সবের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে একক ও অনন্য। ইসলাম দুনিয়ার অন্যান্য ধর্ম থেকে আলাদাভাবে দ্বীনকে জীবনের মূল বিষয় বলে গণ্য করে। দেশকালের মূল বিষয়বস্তু ইতিহাসের মূল প্রক্রিয়া বলে গণ্য করে ইসলাম তাকে নির্দোষ, কল্যাণকর এবং নিজ গুণেই বাঞ্ছনীয় ঘোষণা করে- যদি তা সুন্দর ও উৎকৃষ্টভাবে করা হয়, তবে এসবই হচ্ছে নেক কাজ ও সৎকর্মপরায়ণতা; এবং এসবই অপবিত্র, অন্যায়, অসদাচরণ, যদি তা করা হয় বিপরীতভাবে। এ কারণে ইসলাম নিজেকে দেশকালের সমস্ত কিছুর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক মনে করে এবং সমগ্র মানবজাতিসহ গোটা ইতিহাসকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। প্রকৃতি থেকে আগত বা তার সঙ্গে যা সম্পর্কিত তা নির্দোষ, কল্যাণকর এবং আপনাতে বাঞ্ছনীয়। প্রকৃতি বা জগতের নিন্দার উপর নেককাজ বা নৈতিকতার ভিত্তি হতে পারে না।
ইসলাম চায় প্রকৃতি থেকে লভ্য সমস্ত কিছুই মানুষ অর্জনের চেষ্টা করবে, সে খাবে, পান করবে, সে গৃহবাস করবে, আরাম-আয়েশ ভোগ করবে, পৃথিবীকে একটা উদ্যানে পরিণত করবে, দাম্পত্য মিলন উপভোগ করবে। জীবনের সমস্ত উত্তম জিনিস উপভোগ করবে। বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটাবে। শিখবে, জ্ঞান অর্জন করবে, প্রকৃতিকে ব্যবহার করবে, পরস্পর সহযোগিতা করবে। সংক্ষেপে এই সমস্ত কাজই সে করবে, কিন্তু করবে ন্যায়সঙ্গতভাবে, মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে, চুরি ও অন্যকে শোষণ না করে; নিজের প্রতি, প্রতিবেশীর প্রতি, প্রকৃতির প্রতি এবং ইতিহাসের প্রতি অবিচার না করে। প্রকৃতপক্ষে এ কারণেই ইসলাম মানুষকে খলিফা বলে। এ সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হচ্ছে আল্লাহর অভিপ্রায়ের পরিপূরণ ও রূপায়ণ।
এর পরিণাম স্বরূপ আমরা দেখতে পাব ইসলাম উপরে উল্লেখিত লক্ষ্যগুলোকে সকল মানুষের সাধারণ লক্ষ্য, তাদের মৌলিক মানবাধিকার বলে গণ্য করে এবং এগুলোর নিশ্চয়তা বিধান করতে চায়। এই লক্ষ্যের উপর ইসলাম তার সমাজতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেছে। কেবল এই লক্ষ্য, আদৌ বাস্তবায়িত হলেই, ইসলামের মত সমাজব্যবস্থা আবশ্যক। যদি স্বীকার করে নেওয়া হয় যে, মানুষের সংঘ বা সমাজ হচ্ছে প্রকৃতিগত, ইসলাম তার সঙ্গে যুক্ত করে আবশ্যকতার গুণ। দেশকালের পরিসরে ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা এবং তার পরিতৃপ্তি, উম্মাহ বা দারুস সালাম (শান্তিনিকেতন) এর সঙ্গে দ্বীন ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা কেবল অতি গুরুত্বপূর্ণ নয়, চূড়ান্তও বটে। ইসলামী আইনের একটি ক্ষুদ্র অংশই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং উপাসনা ও নেহাত ব্যক্তিগত নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত।’ ইসলামী আইনের বৃহত্তর অংশের সম্পর্ক হচ্ছে সমাজব্যবস্থার সঙ্গে। এমন কি, আইনের ব্যক্তিগত দিকগুলো, যার বিষয়বস্তু উপাসনার আচার অনুষ্ঠান এবং খোদ আচার অনুষ্ঠানসমূহ ইসলামে এতটা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক আয়তন অর্জন করে যে, সেই পরিসরের অস্বীকৃতি বা দুর্বলতা সেগুলোকেই কার্যত অসিদ্ধ করে দেয়। যাকাত এবং হজ্জের মত কোন কোন রীতি বা আচার-অনুষ্ঠান তাদের প্রকৃতি এবং পরিণামের দিক দিয়ে স্পষ্টতই সামাজিক ধরনের। সালাত এবং সাওমের মত অন্য প্রথাগুলোর সমাজমুখীতা এর চেয়ে সামান্য কম। কিন্তু সকল মুসলমান একথা স্বীকার করেন, যে প্রার্থনার দ্বারা উপাসকের ‘মন্দ প্রবণতার নিবৃত্তি’ বুঝায়না, তা অসিদ্ধ। এবং হজ্জযাত্রীর জন্য, যে হজ্জ সামাজিক কল্যাণ বহন করেনা, তা অসম্পূর্ণ। ইসলামের হৃদপিন্ড হচ্ছে সমাজব্যবস্থা এবং তার স্থান, ব্যক্তিগত জীবনের পূর্বে বা অগ্রে। আসলে ইসলাম ব্যক্তিগত অবস্থানকে সামাজিক অবস্থানের প্রাক শর্ত মনে করে এবং মনে করে মানব চরিত্র অবগুন্ঠিতই থেকে যায়, যদি তা সীমিত থাকে ব্যক্তিগতের উপর এবং ব্যক্তিত্বের গন্ডি অতিক্রম করে, সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ না হয়। যে সকল ধর্ম ব্যক্তিকেন্দ্রিক গুণাবলি কর্ষণ করে, ইসলাম সেগুলোর সঙ্গে একমত এবং মনে করে, এ সব গুণাবলি (আল্লাহর ভীতি, ঈমান, হৃদয়ের পবিত্রতা, নম্রতা, কল্যাণ বদান্যতার প্রকাশ করে, প্রেম ও অঙ্গীকার) সম্পূর্ণই আবশ্যক; আসলে ইসলাম এ সকল সৎগুণ ও ন্যায়নিষ্ঠ সৎকর্মকে ধর্মপরায়ণতার অপরিহার্য শর্ত বলে গণ্য করে, কিন্তু এ সমস্তকে এবং এগুলোর অনুসরণকে শূন্য গর্ব বলে জ্ঞান করে, যদি না এ সবের চর্চা যারা করে তারা সমাজের অন্য মানুষের মঙ্গল ও কল্যাণ বৃদ্ধি করে।
ক. ভারতীয় ধর্মগুলো থেকে স্বতন্ত্র
কতকগুলো ধর্মে, বিশেষ করে, উপনষিদীয় হিন্দু ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম জগতকে পাপ গণ্য করে এবং জগতের অস্বীকৃতিকেই পরিত্রাণ বা পরম সুখ বলে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ জগত থেকে মুক্ত হতে পারলেই পরিত্রাণ লাভ ও মহাসুখ ঘটে। অধিকন্তু এই ধর্মগুলো পরিত্রাণকে একটি ব্যক্তিক বা ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে দাবি করে। কারণ তারা পরিত্রাণের সংজ্ঞা দেয়, চৈতন্যের বা উপলব্ধির পরিভাষায়, যা কেবল ব্যক্তিগতভাবেই অর্জিত হতে পারে। জগতের উন্নয়ন এবং সে কারণে তার সম্প্রসারণ, জগতে অন্তর্নিহিত বস্তুকেন্দ্রিক প্রক্রিয়াকে গভীরতর করার জন্য জগতের সঙ্গে নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া হচ্ছে পাপ। উদ্দেশ্য যখন এর সম্পূর্ণ বিপরীত, কেবল তখনই
জগতের সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ককে স্বীকার করা হয়, অর্থাৎ পৃথিবীর কবল থেকে এবং এর ‘কর্ম’ থেকে পূর্ণ মুক্তি অর্জন ঘটে, তাই (নিজেকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচিয়ে রাখার আইন বা বিধান) হিন্দু ধর্মে কেবল মাত্র কর্তার ক্ষেত্রে, অথবা বৌদ্ধ মতবাদে কর্তা ও অন্যদের জন্য এবং সে কারণে মিশনারী কর্মতৎপর ব্যক্তিদের বেলায়-উভয় ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত আয়তনটি কেবল আদি ব্যাপারই নয়, বরং নৈতিকতা ও পরিত্রাণের সমগ্র প্রক্রিয়াটি এ নিয়েই গঠিত। পক্ষান্তরে, মানুষের সামাজিক কর্মকান্ড একটা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই হউক, মূলত পাপ বা মন্দ, কেননা প্রকৃতিগতভাবে তা জগতের স্থায়িত্ব বা সমৃদ্ধি চায়। অর্থাৎ জৈবতাত্ত্বিক, বৈষয়িক,
অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবন- সংক্ষেপে জগতের স্থায়িত্ব ও সমৃদ্ধি তার লক্ষ্য। হিন্দুরা যদি একটা সমাজব্যবস্থার বিকাশ সাধন করে থাকে, একটা রাষ্ট্র, একটা সাম্রাজ্য, একটা সভ্যতা এবং এখন পর্যন্ত বিদ্যমান একটা বিশিষ্ট মানবসম্প্রদায় সৃষ্টি করে থাকে, তা তারা করেছে উপনিষদীয় দৃষ্টিভঙ্গি বর্জন করে। যদি তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যে তাদের সমাজব্যবস্থা স্বীকৃতি পেয়ে থাকে, তা পেয়েছে যা অনিবার্যতার সঙ্গে আপোস করে। ইহা এমন একটি স্বীকৃতি যা না মানা বা গ্রহণ না করাই বরং ব্রাহ্মণের পক্ষে শ্রেয়।
পক্ষান্তরে, দৃষ্টান্তস্বরূপ বৌদ্ধরা অশোকের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও প্রয়াস মেনে নিতে ও তার প্রতি ইতিবাচক সমর্থন দিতে পেরেছে। পৃথিবী থেকে বাঞ্ছিত সুখ অর্জনে অন্যদের সাহায্য করার জন্য এক্ষেত্রে বুদ্ধসংঘ নামে একটা সমাজব্যবস্থা গঠন করেছে, যা হচ্ছে পরিত্রাণকামী সন্ন্যাসী বা
ব্যক্তিদের প্রথম সম্প্রদায়।”
খ. ইহুদী মতবাদ থেকে ভিন্নতা
এই দৃশ্য বা পরিসরের অন্য প্রান্তে, যা ভারতীয় ধর্মবোধ থেকে সম্পূর্ণ বৈপরীত্যের দিক থেকে কম নয়, রয়েছে হিব্রুদের বিষয়টি, তারা নিজেদেরকে যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছে এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে তাদের স্বপ্ন যেভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে তাতে করে, মানবজাতি থেকে তারা হচ্ছে একটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী। তারা হচ্ছে খোদার ‘পুত্র এবং কন্যা’, স্রষ্টার সঙ্গে তাদের বিশেষ সম্পর্কের কারণে বাকি সকলের থেকে তারা স্বতন্ত্র। ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত আইন কেবল তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অন্যদের নয়; এই বিধান আদেশ নিষেধের মাধ্যমে যে সমাজব্যবস্থাকে তুলে ধরে, তার অধিকারী কেবল ইহুদীরাই। তাদের ধর্ম ছিল একটি ট্রাইব (Tribe) কেন্দ্রিক ধর্ম, যাতে ভাল-মন্দ পাপ-পুণ্যের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে একটি ট্রাইব বা জনগোষ্ঠীর হিত এবং ক্ষতির পরিভাষায়। তাদের সমাজব্যবস্থার ছিল একটি জৈবতাত্বিক ভিত্তি।
কেবল জন্মগত ইহুদীরাই ইহুদী এবং ইহুদী ধর্মে ধর্মান্তর গ্রহণ কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং তা রাখতে হবে একটি ন্যূনতম পর্যায়ে। এ হচ্ছে জাহিলিয়ার রেসিজম, বংশ বা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ববোধ, যার মধ্যে মূল্যের কোন চর্চা নেই, মুরুয়াহ (সাহস, বীরত্ব, মহানুভবতা) নেই, যা এর মূলগত মন্দ প্রকৃতি বা পাপকে লাঘব করতে পারে। কারণ হিব্রু ইতিহাস, যা তাওরাত কর্তৃক আদর্শায়িত বা সহজ কথায় পবিত্রিকৃত, প্রত্যাদেশ দ্বারা এবং অন্যান্য সেসব সাহিত্য যা নিয়ে ওল্ড টেস্টামেন্ট গঠিত, এবং যেভাবে তা সাধারণভাবে জ্ঞাত, তা হচ্ছে ঐসব মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত মূল্যবোধে পরিপূর্ণ। এক্ষেত্রে হিব্রু এবং তাদের বংশধর ইহুদীদের বেলায়, সম্মান অথবা ন্যায়বিচারের যে কোন মূল্যে, ট্রাইবের উর্ধ্বতন বা অব্যাহত অস্তিত্বই হচ্ছে লক্ষ্য। নেক কর্ম বা নৈতিকতার যে কোন মূল্যে রেস বা বংশের উর্ধ্বতন বা অব্যাহত অস্তিত্বই হচ্ছে বাঞ্ছনীয়। এমনকি, ইসরাইলের নিজ সামাজিক আইনের মধ্যে তা পবিত্রতম, যেমন অগত্যা নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে যৌন সংসর্গ এবং ব্যভিচারও অলংঘনীয় নয়, যখন ‘ইব্রাহীমের বংশধারার নিরবচ্ছিন্নতা বিপন্ন হওয়ার প্রশ্ন উঠে।’
গ. খ্রিষ্টানধর্ম থেকে পার্থক্য
খ্রীষ্টধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে এই মারাত্মক নৃতত্ত্বকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে যা হযরত ঈসার সময়ে নিষ্প্রাণ আইনসর্বস্বতায় ফসিলিকৃত হয়ে উঠেছিল। অপরিহার্যভাবেই হযরত ঈসার আহ্বান ছিল বিশ্বমুখী এবং ব্যক্তি অভিমুখী বা অন্তমুখী। ইহুদীদের জাতিগত কুল-গৌরবের মন্দ পরিণাম সম্পর্কে ঈসা এতটাই সচেতন ছিলেন যে, তাঁর আত্মীয়রা, ‘যেহেতু তাঁরই আত্মীয়, এজন্য অধিক পাবার দাবিদার’ এমন ইঙ্গিত মাত্রেই তিনি ক্রুদ্ধ হতেন। ঈসার এই আহ্বান যা সারবত্তার দিক দিয়ে সম্পূর্ণরূপে নৈতিকতাভিত্তিক (কেননা তার খোদা এবং কিতাব আর ইহুদীদের খোদা এবং কিতাব মূলতই অভিন্ন); তা পরিণত হতে পারতো একটি স্থায়ী আন্দোলনে যাতে ইহুদীদের বাড়াবাড়িগুলো সংশোধন হতে পারতো, যদি এর অনুসারীরা সেমিটিক অর্থাৎ ফিলিস্তিনী এবং তাদের পড়শীদের মধ্যে সীমিত থাকতো। কিন্তু গ্রীকদের দ্বারা গৃহীত হবার ফলে ঈসার এই দাওয়াত নতুন একটি ‘রহস্য ধর্মে রূপান্তরিত হয়। সেমাইটদের লোকোত্তর খোদা হয়ে উঠলেন ত্রিত্ববাদের মধ্যে এক ‘পিতা’, যে ত্রয়ীর দ্বিতীয় জনকে নির্মাণ করা হয়েছে মিত্র এবং এডোনিসের প্রতিকৃতিতে, যে মৃত্যুবরণ করে আবার বেঁচে উঠে, আবেগ মুক্তি বা মোক্ষণের মাধ্যমে পরিত্রাণ এনে দেবার জন্য।
যীশুর অন্তর্মুখীনতার পরিণয় বন্ধন ছিল বস্তুর প্রতি অসুস্থ ঘৃণার সঙ্গে যা বুদ্ধিসর্বস্ব জ্ঞানতত্ত্বের একটি বৈশিষ্ট্য, পরিণয় বন্ধন ছিল সমগ্র রাজনৈতিক জীবন তথা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সামগ্রিক নিন্দাবাদে ইহুদী ট্রাইবেলিস্ট রাজনীতির প্রতি তার সংশয়ী দৃষ্টিভঙ্গির সহিত। মুক্ত নাগরিকদের দাস সমাজ থেকে পৃথকীকরণ এবং মুক্ত নাগরিকদের সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক নপুংসকতা ছিল চর্চা বা ধর্ম থেকে রাষ্ট্রের পৃথকীকরণের সূচনা। খ্রিষ্টান চার্চ বা ধর্ম রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করে, এবং এক সময়ে দুই তরবারীর তত্ত্ব সাধারণভাবে গৃহীত হয় একটি রাজনৈতিক থিওরী হিসেবে, কিন্তু তা ছিল আদি খ্রিষ্টানবিবেকের পরিপন্থী। এই বিবেকের বিদ্রোহ ঘটে লুথারের মাধ্যমে এবং চার্চকে আবার নিয়ে বন্দী করা হয় সেই খাঁচার মধ্যে, যা চার্চের প্রথম দিকের মতবাদ নির্মাণ করেছিল তার চারপাশে। আজ কদাচিৎই কোন খ্রিষ্টানধর্মানুসারী মধ্যযুগের থিওরিকে গ্রহণ করে। কদাচিৎ কোন খ্রিষ্টানরাজী হবে রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মকে একটি অংশ দিতে, দূর থেকে সমালোচনা করার অধিকার দেওয়া ছাড়া।
বর্তমানে খ্রিষ্টানধর্মের কোন সমাজ বিষয়ক থিওরী নেই। দেশকাল এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার নিন্দা, প্রত্যেকটি জাগতিক কর্মকান্ড, এমনকি খোদ সমাজ ব্যবস্থাকে অসার এবং পরিত্রাণ লাভের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক গণ্য করায় খ্রিষ্টানধর্মে কোন থিওরীর অবকাশ নেই। সমাজব্যবস্থাকে অপরিহার্য পাপ বলে গণ্য করা ছাড়া, কল্যাণ-বিধানের বাইরে দাঁড়িয়ে, এমনকি তার জাগতিক অস্তিত্বে খ্রিষ্টানধর্ম যতটুকু সংশ্লিষ্ট (ঈসার শরীর হিসেবে এর বাহ্য অস্তিত্ব যা এই পৃথিবীর নয়, কিংবা এ পৃথিবীতে নেই) তাতে করে খ্রিষ্টানধর্ম হচ্ছে একটি অস্থায়ী প্রতিষেধক, যেখানে দান- দক্ষিণা এবং বিশ্বাস হচ্ছে দৈনন্দিন বিধান। কিন্তু এতে প্রোগ্রাম ভিত্তিক কর্মকান্ড অথবা আইন কানুনের জন্য প্রয়াসের কোন মূল্য নেই, যেখানে ইতিহাস নিজেই অপ্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বহীন। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, শিল্প বিল্পবের সময় থেকে ইউরোপে এবং উত্তর আমেরিকায় খ্রিষ্টানচিন্তাবিদরা খ্রিষ্টানধর্মের নামে ক্রমবর্ধমান হারে সামাজিক ন্যায়বিচারের উচ্চতর ব্যবস্থার জন্য পরিকল্পনা আহ্বান করেছেন এবং তা কার্যকর করেছেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের এ সমস্ত কর্ম, জগতবিমুখতা থেকে খ্রিষ্টানধর্মকে নড়াতে পারেনি। দারিদ্র বিমোচনের জন্য আবশ্যক এবং অত্যন্ত হিতকর হলেও, কিংবা বুদ্ধিভিত্তিক দিক দিয়ে একটি নৈতিকতা ও ন্যায়পরায়ণতাবোধ সঞ্চারিত করার প্রয়াস সত্বেও তাদের কর্মকান্ড অসার প্রমাণিত হয়েছে। যা বিশ্বাসে মৌলিক সূত্রগুলোর সংস্কারের জন্য প্রয়োজন, তা সাধনের জন্য আজ পর্যন্ত কদাচিৎ কেউ দুঃসাহস করেছে- যেমন আল্লাহর প্রকৃতি, সৃষ্টির লক্ষ্য, মানুষের প্রকৃতি ও গন্তব্য। যত দিন না তা করা হয়েছে ততদিন খ্রিষ্টান চিন্তাধারা স্ববিরোধীই থেকে যাবে, সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নীলনকশা নিয়ে তারা যতই অগ্রসর হোক-না-কেন।
ঘ. আধুনিক সেক্যুলারিজম থেকে ভিন্নতা
স্পষ্টতই ইসলামী সমাজব্যবস্থা হচ্ছে আধুনিক সেক্যুলারিজমের (ধর্মহীন নিরপেক্ষতা) সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্তমান ধর্ম নিরপেক্ষতা চায় ধর্মের সম্ভাব্য সকল নিয়ন্ত্রণ থেকে সমাজের পাবলিক বা রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকান্ডকে দূরে রাখতে। পাশ্চাত্য জগতে সেক্যুলারিজমের ইতিহাসে যা দেখা যায়, তার প্রধান যুক্তি হচ্ছে ধর্ম অন্য সকলের উপর সমাজের একটি অংশ বা চার্চের একটি কায়েমী স্বার্থ, যেহেতু চার্চের অভ্যন্তরীণ গঠন এবং তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কর্তৃত্ববাদী, যাতে ব্যক্তিস্বাধীনতা উপেক্ষিত, এবং যেহেতু তাতে সমগ্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব নেই, তাই চার্চ কর্তৃক রাষ্ট্রীয় ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ নির্ধারণ অত্যাচারের সামিল, একটি গ্রুপ বা দল কর্তৃক জাতির শোষণ এবং দমনের একটি প্রকার। পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রে যুক্তিটি নিশ্চয়ই সত্য, যেখানে প্রাথমিক চার্চ জনসংখ্যার কেবল একটি অংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে, সেখানে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান মতবাদ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিরোধী কর্তৃত্ববাদী শক্তিরূপে এবং জনগণের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গড়ে তুলে কায়েমী স্বার্থ। বহু শতাব্দী ধরে ক্যাথলিক চার্চ যেহেতু ইউরোপে সবচেয়ে বেশী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তির অধিকারী ছিল সেকারণে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির যে কোন আন্দোলন স্বভাবতই চার্চের বিরুদ্ধে একটি সংগ্রামের রূপ নেয়।
অধিকতর সাম্প্রতিককালে, সেক্যুলারিজম বলছে, ধর্ম থেকে উদ্ভূত মূল্যবোধসমূহের দ্বারা রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ নির্ধারণের বিরোধীতা তার লক্ষ্য। কেননা, উৎস হিসেবে পাশ্চাত্য ধর্মকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে গণ্য করে।” দাবি করা হয়, এই উৎস হচ্ছে অযৌক্তিক কৃসংস্কারপূর্ণ এবং নির্বিচারী। বলাবাহুল্য, এই সব অভিযোগের প্রতি মানুষ সহানুভূতিশীল তখনই হতে পারে, যখন অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয় খ্রিষ্টানধর্ম এবং সেই সব ধর্মের বিরুদ্ধে যেসব মতবাদের ভিত্তি হচ্ছে অন্ধবিশ্বাস অথবা সেই সব ধর্মের বিরুদ্ধে ইতিহাসের নির্দিষ্ট কোন কোন যুগে যাদের অবক্ষয় ঘটেছে। কিন্তু এসব অভিযোগ সেই সব ধর্মের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, যেগুলো স্বভাবসংগত অর্থাৎ যৌক্তিক ধর্ম, তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার অধিকারী যা যুক্তি বিচারের মানদন্ডের সার্বজনীন বৈধতা স্বীকার করে। অথবা সেই সব ধর্মের ক্ষেত্রেও তা অপ্রসাঙ্গিক যেগুলো তাদের স্থবিরতা ও অবক্ষয়ের যুগ অতিক্রম করার প্রয়াস পায় সব প্রস্তাবনাবাক্যের প্রতি সমালোচনার আলোকে যৌক্তিক আবেদন জানিয়ে, সকল প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধ যে সব প্রেমিসের অন্তর্গত। অবশ্য বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেক্যুলারিজমের অনুসরণ করা হয় অগভীর যুক্তিতে। তাদের যুক্তি এই যে, বিজ্ঞানের যুগ সেক্যুলারিজমের বাস্তবতাবাদ ও প্রগতির সঙ্গে অভিন্ন মনে করে। অথচ ধর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে, ধর্ম সেক্যুলারিজমের বিপরীত মূল্যবোধসমূহ জারি করে, আর এটি এমন একটা দাবী যার অবস্থান সত্য থেকে চূড়ান্ত দূরত্বে। প্রকৃতপক্ষে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই এই দাবীটি হচ্ছে কপটতামূলক, কেননা কোন সমাজ দাবী করতে পারেনা যে, কোন মূল্যবোধের সাহায্য ছাড়াই তার ক্রিয়াকান্ড নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়, বা এমন সব মূল্যবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা তার নিজ ধর্মের উত্তরাধিকার থেকে মোটেই অর্জিত নয়।
অনুবাদঃ অধ্যাপক শাহেদ আলী।