টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান; যুক্তি যেখানে গল্প, সংলাপ সেখানে নায়ক

বিচারব্যবস্থায় জুরিসিস্টেম একটি আদি-প্রক্রিয়া। এথেন্সে ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দেও জুরির অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। অবশ্য আধুনিক জুরিসিস্টেমের সূচনা হয় ১২ শতকের মাঝামাঝি, তখন ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় হেনরির রাজত্ব চলছিল। এখনো পৃথিবীর অনেক জায়গায় বিচারকার্যে জুরিসিস্টেমের ব্যবহার করা হয়। সিডনি লুমেটের ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’ এমন একটি চলচ্চিত্র, যেটি আপনাকে জুরিসিস্টেম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিবে। সাদাকালো আলোকচিত্রের যুগে তৈরি  হওয়া এই সিনেমা হীরক জয়ন্তী পার করার পরও অবস্থান করছে শ্রেষ্ঠের শীর্ষ তালিকায়।

‘কোর্টরুম ড্রামা’ এই ধারাটি বর্তমান সিনে জগতে ব্যাপক আলোচিত। বিশেষ করে উপমহাদেশের ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে। কিন্তু এই ধারা উদ্ভাবন হয়েছে আজ থেকে ৬৫ বছর আগে অস্কার বিজয়ী মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা সিডনি লুমেট এর হাত ধরে। লুমেট তার ক্যারিয়ার জুড়ে সৃষ্টি করেছেন অনেক কালজয়ী সিনেমা। কিন্তু ১৯৫৭ সালে মুক্তি পাওয়া  তার প্রথম সিনেমা ‘১২ অ্যাংরি ম্যান’ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সিনেমা গুলোর একটি হয়ে উঠেছে। ‘১২ অ্যাংরি ম্যান’-এর এই অসম্ভব সফলতার পর বছর কয়েক এর মধ্যেই এই ধারায় নির্মিত হয়েছে ‘এনাটমি অফ মার্ডার’, ‘জাজমেন্ট এট নুরেমর্বাগ’-এর মতো জনপ্রিয় সব সিনেমা।

ছবির শুরুতে দেখা যায় ১৮ বছর বয়সের একটি ছেলে পিতৃহত্যার দায়ে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার কেসে অভিযুক্ত। আদালতে সব সাক্ষ্য-প্রমাণই তার বিপক্ষে। জাজ জুররদের ওপর দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। ছেলেটির জীবন চলে যায় জুররদের হাতে। এখন জুরররা তিনটি কাজ করতে পারে।

 

এক, ছেলেটিকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে, যার ফল ইলেক্ট্রিক চেয়ারে বসিয়ে তাকে হত্যা করা হবে।

দুই, তারা তাকে সর্বসম্মতভাবে নির্দোষ সাব্যস্ত করতে পারে।

তিন, তারা সর্বসম্মত না হতে পারলে ‘হাঙ জুরি’ করতে পারে, যার ফলে হয়তো পরে আবার অন্য কোনো জুরি বোর্ডকে মামলাটির ফয়সালার দায়িত্ব দেওয়া হবে।

খুব সাদামাটাভাবে শুরু হওয়া সিনেমাটির দৃশ্যপট এরপর পদার্পণ করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষে। মুভির রান টাইম ৯৬ মিনিটের ৯৩ মিনিটই ওই চারদেয়ালের কক্ষে যেখানে ছেলেটির জীবন-মৃত্যু সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে এবং ১২ জন জুরর এর ১১ জনই শুরুতে মতামত জানিয়ে দেয় ছেলেটি তার পিতার হত্যাকারী কিন্তু নিয়ম অনুসারে ১২ জনকে এক মতে আসতে হবে তাহলেই বিচারকার্য সম্পন্ন হবে। একমাত্র ৮ নাম্বার জুরর প্রথমবারের মতো বলেন, ছেলেটি নির্দোষও হতে পারে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আগে বিস্তর আলোচনা করা আমাদের কর্তব্য।

এখান থেকেই শুরু হয় মতভেদ। যেখানে কিনা সকল প্রমাণ শুরুতে স্পষ্ট করছিল ছেলেটি দোষী, সেখানে বাস্তববাদী ও মানবিক যুক্তি স্থাপন করছিলেন ৮ নাম্বার জুরর। আর এই চরিত্রে অভিনয় করে কিংবদন্তীর আখ্যান লিখেছেন অভিনেতা ‘হেনরি ফন্ডা’।  তিনি তার বিচক্ষণ ভঙ্গিমা দিয়ে চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন অনন্য মাত্রায়। মেধা, মানবিকতা দিয়ে চিন্তা করার যোগ্যতা ছিল এই চরিত্রে। যার প্রেক্ষিতে বাকি ১১ জন কে এই ১ জন এর দেওয়া যুক্তিতে সম্মতি দিতে হয় এবং ছেলেটি নির্দোষ এই মতামতে একাত্মতা পোষণ করতে হয়। কীভাবে একজন ব্যক্তি কিছু সময়ের ব্যবধানে ১১ জন এর অভিব্যক্তি পাল্টে দিল সেটিই সিনেমার মূল আকর্ষণ।

মুভিতে প্রখর যুক্তিবোধসম্পন্ন ন্যায়বান মানুষও যেমন দেখা যায়, সেই সাথে চোখে পড়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন অবিবেচককে। দেখতে পাই সন্তানের ভালবাসাবঞ্চিত পিতার বুক ফাটা কান্না অথবা প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের বুদ্ধির ঝিলিক। হুট করে রেগে যাওয়া মানুষ যেমন আছে তেমনি আছে মাথা ঠাণ্ডা করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ। আছে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিত্ব আবার অন্যদিকে আছে জ্ঞানপাপী! মুভিতে দেখানো হয়েছে কেমন করে গুটিয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব একটু সাহায্য পেলেই জেগে উঠতে পারে, আবার আপাত দৃষ্টিতে ব্যক্তিত্ববান ও দায়িত্ববান মানুষ কীভাবে রূপান্তরিত হয় নিচুশ্রেণির অমানুষে। প্রতিটি মানুষের আবরণে লুকিয়ে থাকা এই আসল মানুষটি শুধু তখনি বেরিয়ে আসে যখন সে নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেয়। তার মনন, তার মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এই দোষ কিংবা গুন গুলোই। আর এই ব্যপারটিই অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে মুভিটিতে।

টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান এ যে ১২ জন জুরর অভিনয় করেছেন, তারা সবাই দুর্দান্ত। ১২টি ব্যতিক্রমী চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে এবং চরিত্রের ভেতর রসায়ন সৃষ্টিতে সবটুকু উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকের ভেতরের দ্বন্দ্বে একসময় এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একজন আরেকজনকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেয়। কিন্তু এই হত্যার হুমকিই হয়ে ওঠে ছেলেটিকে বাঁচানোর একটি অস্ত্র। অতিশয় বোদ্ধা বা বাচাল লোককে মানুষ কীভাবে দেখে, তাও একটি অসাধারণ দৃশ্যে চিত্রায়িত করেছেন পরিচালক সিডনি লুমেট। এককথায় একজন ফুটবল কোচ, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী, স্টক ব্রোকার, বেসবল ভক্ত, ঘর সজ্জাকারক, বিক্রেতা, স্থপতি, বৃদ্ধ, গ্যারেজ মালিক, ঘড়ি প্রস্তুতকারক, বিজ্ঞাপন নির্মাতা যখন একই কক্ষে একটি সিদ্ধান্ত নিতে ব্রত হয়, তখন তারা কে কী রকম আচরণ করতে পারে, তা প্রকাশিত হয়েছে খুব সূক্ষ্মভাবে।

মুভির সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গাটি ছিল ‘সংলাপ’।

সিনেমার প্রেক্ষাপট অনুসারে সংলাপগুলো ছিল একেকটি ট্রেডমার্ক। যুক্তির ক্ষমতাকে অনন্যভাবে উপস্থাপন করার জন্য ‘সিডনি লুমেট’ সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত হয়েছেন।

পরিচালক সিনেমায় কক্ষটিকে দারুণভাবে ব্যবহার করেছেন। বৈদ্যুতিক ফ্যান, জানালা, টেবিল, চেয়ার, চুরুটদানি সবকিছুই যেন সিনেমাটিতে অভিনয় করেছে। একজন পুত্রহারা বাবার ক্রোধ বার বার ফিরে এসেছে সেই কক্ষে। ব্যক্তিগত ক্রোধ ও অহমিকার পরীক্ষায় শেষপর্যন্ত সবাই উতরে যায়। কিন্তু এই উতরে যাওয়াটা সহজ ব্যপার ছিল না। এক্ষেত্রে একটি ছুরি, একটি ম্যাপ এবং বৃদ্ধটির অভিজ্ঞতা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে ৮ নাম্বার জুরর হেনরি ফন্ডা ছিলেন এক কথায় অনবদ্য! গভীর সংলাপ গুলোকে তিনি বাস্তবে জীবন দিয়েছিলেন। আর ৩ নাম্বার জুরর এর চরিত্রে অভিনয় করা ‘লি জে কব্স’-এর অভিনয় ছিল সবচেয়ে ভিন্নধর্মী এবং চ্যালেঞ্জিং। নিজ সন্তানের সাথে সম্পর্কের কলহে পুড়তে থাকা মানুষটি শেষে ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায় এবং ‘ছেলেটি দোষী নয়’ এই মতামতে সর্বশেষ ভোটটি ছিল তার।

৫০’শ-এর দশকে নির্মিত হওয়া টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান একটি মিথিকাল মেটাফোর, যেটি সময়ের বিবর্তনে আমাদের ভাবনাকে করেছে আরও বিস্তৃত। আজকের মুভি ওয়ার্ল্ড এ নাম্বার গেইমকে (বাজেট এবং আয়) পুঁজি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে বড় বড় প্রোডাকশন হাউজগুলো।

প্রভাবশালীদের সৃষ্টি করা এই নাম্বার গেইম এর বিপরীতে সবচেয়ে বড় উপস্থাপন হলো ‘টুয়েলভ অ্যাংরি ম্যান’-এর চিত্রনাট্য, যেটি প্রমাণ করে শুধুমাত্র সংলাপ আর বাস্তববাদী স্ক্রিনপ্লে দিয়েই ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মুভির তালিকায় থাকা যায় যুগের পর যুগ….।

২১০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of আইনুদ্দিন সাফওয়ান

আইনুদ্দিন সাফওয়ান

পড়াশোনা ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এ, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে। দীর্ঘদিন যাবৎ সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি করছেন। সিনেমা, শিল্প এবং রাজনীতির প্রতি আগ্রহের জায়গা থেকে ডিজিটাল ফর্মে ফিল্ম নিয়ে গবেষণা এবং বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের বাস্তবতাকে গণমানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য কাজ করছেন।
Picture of আইনুদ্দিন সাফওয়ান

আইনুদ্দিন সাফওয়ান

পড়াশোনা ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এ, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগে। দীর্ঘদিন যাবৎ সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা ও লেখালেখি করছেন। সিনেমা, শিল্প এবং রাজনীতির প্রতি আগ্রহের জায়গা থেকে ডিজিটাল ফর্মে ফিল্ম নিয়ে গবেষণা এবং বাংলাদেশে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের বাস্তবতাকে গণমানুষের জন্য প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্য কাজ করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top