মুসলিম সমাজে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন

ইসলামের মহানবী শতধা-বিচ্ছিন্ন আরব সমাজে শান্তির বাণী নিয়ে আবির্ভূত হন। তাঁর বাণী প্রধানত ছিলো ধর্মীয়; সাত শতকের আরব সমাজে প্রচলিত চরম জগত-সর্বস্ব দৃষ্টিভংগির পটভূমিতেই তাকে পর্যালোচনা করতে হবে। এ সমাজে আরবদের জীবনে যা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয়, তা হলো এই হীন জড়বাদকে সক্রিয়ভাবে বাধা দান করে তাদের জীবনে একটা আধ্যাত্ববাদী দৃষ্টিভংগির সৃষ্টি করা। জগত-সর্বস্ব ও ঐশী তথা জড় ও আধ্যাত্ববাদী দৃষ্টিভংগির মধ্যে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর নবুওয়তের অভীষ্ট লক্ষ্য। এই পটভূমিকে সামনে রেখে চিন্তা করলেই চরম জগত সর্বস্বতার বিরুদ্ধে আলকুরআনের অভিমতের সত্যকার মর্ম উপলব্ধি করা যেতে পারে হতাশাবাদীদের ন্যায় সংসারের চরম অনিত্যতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে জাগতিক জীবনকে অপরিহার্য আপদ (Necessary evil) মনে করে একে ব্যাখ্যা করা চলে না।

যা হোক, এ সময়ে সমাজের অধিকতর বাস্তবমনা ব্যক্তিগণ ধর্মীয় ভিত্তির পরিবর্তে সুবিধা-অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতেই জীবনের সামগ্রিক কার্যক্রম পরিচালনার স্বাধীনতা ভোগ করে। খুলাফায়ে রাশেদার পরবর্তী ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস, মুসলিম সমাজের ধর্মনেতার কাঠামো এবং মুসলিম জাতির অর্থনৈতিক উন্নতির প্রতি ক্ষেত্রেই একথা সমভাবেই সত্য। ইসলামী চিন্তাবিদরা সকলেই এ বিষয়ে একমত এবং জোরের সাথেই ঘোষণা করেন যে, ইসলামের প্রারম্ভিক নীতি অনুসরণের মাধ্যমে এর কিছুই সংঘটিত হয়নি। তবে এ কথার দ্বারা, যে সব নিষ্ঠাবান মুসলিম তাদের জাগতিক জীবনের সমস্যাবলী সমাধানের জন্য ইসলামের আদর্শ অনুসরণ ও প্রয়োগে সচেষ্ট ছিলেন, তাদের সৎ প্রচেষ্টাকে কোন দিক দিয়ে খাটো করা হয় না, বরং বলতে হয় যে, সম্ভবত সময়, পরিস্থিতি, পরিবেশ, আঞ্চলিক কারণাদি এবং ব্যক্তিগত অনুরাগ-বিরাগই নীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বের এই হের-ফের তথা নীতি পরিবর্তনের নিয়ামক হিসাবে কাজ করে। ফলে, ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ইসলামের নীতিসমূহকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস এই যে, বিশ্বে প্রায় সর্বত্রই মুসলিম সমাজে আজ বিরাজমান রয়েছে রাজতন্ত্র (মালিক, আমীর ও সুলতান), ঘৃণাজনক সামাজিক ভেদাভেদ (আরব ও অনারব এবং আশরাফ ও আতরাফের মধ্যে) এবং অবমানিতা নারীত্বের (অবরোধ ও বহুবিবাহের কবলিত হয়ে) প্রকট প্রাচুর্য। আমাদের পণ্ডিতগণকে মুসলিম সমাজের এ পরিবর্তন সকল দিক দিয়ে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে এবং বিভিন্নমুখী সামাজিক সমস্যাবলীর সমাধান নির্ণয় করতে হবে। এ প্রবন্ধে আমি মুসলিম সমাজের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক জীবনে যে পরিবর্তন দেখা দেয়, তারই পর্যালোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি।

 

সর্বশক্তিমান স্রষ্টা এবং বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নব-দীক্ষিত মুসলিম সমাজ তাদের বৈষয়িক জীবনে দুটি বিপ্লবী ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়- তার একটি যাকাত (যা সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে) ও অন্যটি রীবা (যা সম্পদকে দূষিত করে)। যাকাত পরিগণিত হতো সমাজের সাধারণ কল্যাণে ব্যক্তির বৈষয়িক ত্যাগ হিসেবে। পক্ষান্তরে, রীবাকে মনে করা হতো মানুষের দূরাবস্থার পরিপূর্ণ সুযোগ নিয়ে সঞ্চিত অর্থের সাহায্যে মুনাফা লুঠবার মানসিকতার অভিব্যক্তি এবং তাই সমাজ-বিরোধী বলে তা ছিল নিষিদ্ধ। প্রথম দিকে যাকাত ছিল রাষ্ট্রীয় রাজস্বের প্রধান উৎস এবং তা ব্যয়িত হতো অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রদের অভাব মোচনের জন্যে। এ বাধ্যতামূলক দান কখন কিভাবে প্রবর্তিত হলো, তার হার এবং অন্যান্য বিস্তারিত বিষয়াদির গুরুত্ব প্রাথমিক নয়। এ ব্যবস্থার নীতি হচ্ছে এই যে, সমাজের সম্পদশালী ও স্বচ্ছল ব্যক্তিবর্গ সবাই মিলে অপেক্ষাকৃত কম সুযোগ-সুবিধার অধিকারী ব্যক্তিদের নিরাপত্তার জন্যে দায়ী থাকবে। যাকাত খামখেয়ালীভাবে প্রদত্ত দান নয়, সমাজ জীবনে ভারসাম্য বিধানের একটি পরিকল্পনা ইসলামী অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্যায় রূপ লাভ করে হযরত উমর আল-ফারুকের জামানায়। এ সময়ে রাজস্বের নয়া খাত সৃষ্টি হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় তহবিলে ধনী মুসলিমদের দান যাকাত ছাড়াও খুমুস্ (যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ) এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিকট থেকে খারাজ ও জিজিয়া এ সময়ে রাজস্বের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়। ফলে, রাষ্ট্রের আয় আশাতীত পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

মুসলিম রাজধানীগুলোতে কারাভার পর কারাভাঁ বোঝাই যুদ্ধলব্ধ সম্পদ এসে জমা হতে থাকে রাসূলে করীম (সা)-এর প্রাথমিক যুগের সাহাবা এবং ইসলাম সম্পর্কে তাঁরই নিকট থেকে সরাসরি শিক্ষা গ্রহণের সৌভাগ্যে ভাগ্যবান হযরত উমর (রা) কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কায়েমের এক পরীক্ষা শুরু করেন তাঁর অর্থনৈতিক মৌল-ভিত্তি এই ছিলো যে, খলীফার হেফাযতে যে বায়তুল মাল বা রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠিত হবে, রাষ্ট্রের ধনী-গরীব, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা প্রত্যেকটি নাগরিকেরই তাতে হিসসা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় আয় নাগরিকদের মধ্যে নিয়মিত বন্টনের ব্যাপারে এটা সারা দুনিয়ায় অন্যতম পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা। আরবেরা যতদিন একটি মুজাহিদ জাতি ছিল, যতদিন বিজিত জাতিগুলোর জনসাধারণকে আপন আপন শান্তিপূর্ণ জীবনোপায় অবলম্বনের অধিকার দেওয়া হয় এবং যতদিন বিজাতীয়গণ কর্তৃক ব্যাপক হারে ইসলাম গ্রহণ মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষে একটি সমস্যা হয়ে না দাঁড়ায়, ততদিন উমরের এ ব্যবস্থা ফলপ্রসূ ছিল।

 

এ সময়ে আমরা ইসলামী অর্থনৈতিক ক্রমোন্নতির দুটি পর্যায়ের সাক্ষাত পাই। একটি রাসূলে আকরাম (সা)-এর প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে, অপরটি হযরত উমর ফারুকের খিলাফতে। এ দুটি পর্যায়ে পরীক্ষামূলক ব্যবস্থাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদেরকে ইসলামী অর্থনীতির আওতা ও পরিধি সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। রাসূলে করীম (সা)-এর আমলে অপেক্ষাকৃত ধনী মুসলিমেরা সমাজের সাধারণ কল্যাণে স্বেচ্ছায় তাদের সম্পদ দান করতেন ও যাকাত প্রদান করা ছিল নিম্নতম সামাজিক বাধ্যবাধকতা; কিন্তু তাঁদের অনেকেই সোৎসাহে আরও অধিক দান করতেন। হযরত আবূ বকর, হযরত উসমান এবং প্রখ্যাত আনসার সাহাবীরা তাঁদের সাধ্যমত সবকিছুই সমাজের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করেন। এ সময়ে রাষ্ট্রীয় তহবিল বলে কিছুই ছিল না, প্রত্যেকেই অন্য সবার জন্যে তথা সমাজের জন্যে সমভাবে অনুভব করতেন। তবে, আইনে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সপক্ষে কঠোর বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল।

 

হযরত উমর ফারুক (রা)-এর সময়ে এ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হয় এবং বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত রাজস্বে রাষ্ট্রীয় তহবিল ফেঁপে ওঠে। ফলে, আরবীয় ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব প্রাচুর্য দেখা দেয়। উমর নিয়মিত আয়-ব্যয়ের একটি বিধি-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সামগ্রিকভাবে সমাজের কল্যাণ সাধনের মূলনীতি অব্যাহত রেখে মহানবীর সাথে কার কি সম্পর্ক, কে কত আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় কার অবদান কি, তারই ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় তহবিলের অর্থে প্রত্যেকের হিসসা নির্ণীত হতো। অবস্থাপন্ন মুসলিমেরা আগের মতই রাষ্ট্রীয় তহবিলে তাদের যাকাত দিতে থাকেন। এই ইসলামী রাষ্ট্রে কোন নাগরিক রাষ্ট্রীয় তহবিলে কোনরূপ রাজস্ব হিসেবে কোন অর্থ প্রদান করুক বা না-ই করুক, যেহেতু কর কেবল ধনীদেরই দেয়, প্রত্যেক নাগরিকই রাষ্ট্রীয় তহবিল হতে আনুপাতিক হারে একটা নির্দিষ্ট হিসসা লাভ করতো। বায়তুল মাল ছিল মুসলিম সমাজের যৌথ সম্পত্তি এবং তাদেরই তরফ থেকে খলীফা শুধু একজন ভাতাভোগী হিসেবে সে তহবিলের হেফাযত করতেন

 

মুসলিমদের অর্থনৈতিক ক্রমোন্নতির পরবর্তী ধারা প্রাথমিক যুগের ঐতিহ্য বর্জন করে বিভিন্নতর খাতে প্রবাহিত হয়। রাজতন্ত্র ও শাহানশাহীই প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায় এবং কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রের ধারণায় পরিপূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে। উমাইয়া এবং পরবর্তীকালে আব্বাসীয় শাসনকর্তাগণের শাসন ছিল বংশগত রাজতন্ত্র; তাঁদের সকলেই কাজ করেছেন নিজের অথবা নিজ বংশের কল্যাণে। শাহানশাহীর উৎকর্ষের সাথে সাথে তাকে কেন্দ্র করে একটি ভূম্যাধিকারী অভিজাত শ্রেণী গড়ে উঠে। এমনকি, গোড়ার দিকে হযরত উসমানের খিলাফতের সময়ে ‘আরবরা আরবের বাইরে ভূসম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে না’ – হযরত উমরের এ নির্দেশ লংঘন করে মক্কা ও মদীনার একটি বিরাট অভিজাত গোষ্ঠী কৃষ্ণা ও বসরাতে ভূসম্পত্তির অধিকারী হয়ে বসতি স্থাপন করে। খলীফা তাদের আল-হিজাজের সম্পত্তি বর্জনের শর্তে এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। এখান থেকেই নব-দীক্ষিত অন-আরব মুসলিম (মাওয়ালী) সমাজের সাথে স্বার্থ-সংঘর্ষে লিপ্ত ভূম্যাধিকারী আরব অভিজাত শ্রেণীর বিকাশ শুরু হয়; কেননা, হযরত উমর প্রবর্তিত আইন অনুসারে এসব ভূসম্পত্তির জন্যে রাষ্ট্রীয় তহবিলের কোনরূপ কর দিতে তাঁরা বাধ্য ছিলেন না।

 

পক্ষান্তরে, তাদের শান-শওকতময় প্রাসাদরাজি, অগণিত ক্রীতদাসের ভীড়, ঘোড়া, উট, গরু ও দুম্বা-মেষের বহর, বিলাস-বসনের প্রাচুর্য এবং সমাজ-জীবনে নৈতিকতাবিরোধী ক্রিয়া-কলাপের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং তার দরুন মহানবীর ঘনিষ্ঠ সাহাবাদের অনেকে দারুণভাবে মর্মাহত হয়ে পড়েন। এ ব্যাপারে হযরত আবূ যর গাফফারীর কাহিনী একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাসুদীর বর্ণনা অনুযায়ী, সেনাপতি জুবায়েরের এক হাজার দাস-দাসী এবং এক হাজার ঘোড়া ছিল। সবগুলো প্রধান প্রধান শহরেই তার প্রাসাদ ছিল। তার ইরাকস্থ ভূ-সম্পত্তিরই দৈনিক আয় ছিল এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা। আবদুর রহমান এক হাজার উট ও দশ হাজার ভেড়ার মালিক ছিলেন এবং মৃত্যুকালে চার লক্ষ দীনার মূল্যের সম্পত্তি রেখে যান। যায়েদ বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ-রৌপ্য এবং দশ হাজার দীনার মূল্যের সম্পত্তি রেখে ইন্তিকাল করেন। কুরাইশ বংশীয় অভিজাতেরা মক্কা ও মদীনায় বিরাট বিরাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সুতরাং হযরত উসমান (রা)-এর খিলাফত আমলেই মুসলিম সমাজে পুঁজিবাদী কাঠামো কায়েম হতে আরম্ভ করে এবং জীবনের এই সর্বমুখী জড়বাদী দৃষ্টিভংগির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তোলেন হযরত আবু যর গাফফারী আবু যর গাফফারী ইসলামের আদর্শবিরোধী বিলাসবহুল জীবন যাপনের অভ্যাসের তীব্র ভাষায় নিন্দা করেন

 

সিরিয়া সফরকালে তিনি আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত ব্যাখ্যা করেন-

يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَرْتُمْ لأَنْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ

“তোমাদের এই স্বর্ণ, রৌপ্য একদিন দোযখের আগুনে তপ্ত-লাল করে তোমাদের ললাট, পৃষ্ঠ ও পার্শ্বদেশে তা দিয়ে ছাপ মারা হবে। অতএব হে অপব্যয়ীরা, তোমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় খাদ্যের সংস্থান রেখে অবশিষ্ট অর্থ দান-খয়রাতে (সদকা) ব্যয় করো, অন্যথায় তোমাদের ভাগ্য সেদিন দুঃখ ভারাক্রান্ত হবে।” (৯:৩৫)

তাঁর এ ঘোষণা শুনে গরীব জনসাধারণ এবং এতে যাদের ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশংকা ছিল না, তারা তাঁকে কেন্দ্র করে ধনীদের সম্পদের হিস্সা পাবার স্বপ্ন দেখতে লাগল। হযরত আবু যর (রা) দামেশকে উপস্থিত হয়ে সুলতান মুয়াবিয়ার সাথে আলোচনায় প্রবৃত্ত হন এবং নিম্নলিখিতভাবে যুক্তি পেশ করেন-

“আপনারা বলছেন যে, সম্পদের মালিক রাব্বুল আলামীন এবং একথা বলেও আপনারা জনসাধারণকে সে সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন। কেননা, আল্লাহ সকল সম্পদ তাঁর বান্দাদের ভোগের জন্যই তো দান করেছেন।” জওয়াবে মুয়াবিয়া বলেন, “আমরা সকলেই কি আল্লাহর বান্দা, সম্পদ তো সকলের কাছেই রয়েছে; সুতরাং তা আমার দৃষ্টিতে অতিশয়, কাজেই আপনি চলে যেতে পারেন।”

মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে তিনি নির্ভীক কণ্ঠে ধনীদের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালাতে লাগলেন এবং খলীফা উসমান (রা)-এর নিকট দাবী জানালেন তাদেরকে সম্পদ বন্টনে বাধ্য করতে। উসমান (রা) তাঁকে জানালেন যে, এসব লোকেরা যখন যাকাত দেয়, তখন তাদেরকে আর কোন ত্যাগ স্বীকারে তিনি বাধ্য করতে পারেন না। তাঁর প্রচারে দেশব্যাপী বিশৃংখলা ও অরাজকতা দেখা দেবার আশংকায় উসমান (রা) তাঁকে আল-রাবাদার নির্জন মরু এলাকায় নির্বাসিত করেন এবং সেখানেই এ ঘটনার দু’ বছর পরে চরম অভাব-অনটন ও দারিদ্রের মাঝে তিনি ইন্তিকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই মুসলিম সমাজে পুঁজিবাদী কাঠামো কায়েমের বিরুদ্ধে যে সক্রিয় রক্ষণশীল বাঁধার প্রাচীর ছিল, তারও অবলুপ্তি ঘটল।

 

উমাইয়া যুগে সামগ্রিক অর্থনৈতিক ধারণাই পাল্টে গেল। খিলাফত পরিণত হলো মুল্ক তথা রাজ্যে এবং মুসলিম সমাজের সাধারণ তহবিল বায়তুল মাল পর্যবসিত হলো শাসক সুলতানের ব্যক্তিগত তহবিলে। আরব ও অন-আরবদের মধ্যে সামাজিক ভেদ-বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠল এবং মাওয়ালী অর্থাৎ অন-আরব মুসলিমেরা আরব ভূম্যাধিকারীদের মতই করভারের দায় থেকে রেহাই চাইল। কোন আরব আরবের বাইরে ভূ-সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবে না- এ মর্মে হযরত উমর-প্রবর্তিত যে আইন ছিল, ক্রমশই তা উপেক্ষিত হতে লাগলো; পক্ষান্তরে ভূ-সম্পত্তির অধিকারী আরব অভিজাতেরা ভূ-সম্পত্তি বাবদ কর দানের দায়মুক্ত থাকায় রাষ্ট্র ন্যায়সংগত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতে লাগলো। এমতাবস্থায় মাওয়ালীদেরকেও এ দায় থেকে রেহাই দিলে রাজস্বের পরিমাণ আরো হ্রাস পেতো এবং রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামোই ভেঙ্গে পড়তো। আবদুল মালিক ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সকল নবদীক্ষিত মুসলিমদেরকেই তারা আগে যেরূপ ভূমি-রাজস্ব দিয়ে আসছিল, তা নিয়মিত প্রদান করতে বাধ্য করলো। এ কর আদায়ের ব্যাপরটি মানবিক মর্যাদার প্রশ্ন: ইসলাম কি তাদেরকে আরবদের সমান অধিকার দান করে নি? ভূমি-রাজস্বের সমস্যাটির একদিন সমাধান হয়ে যেতো, যেমনটি হয়েছিল বহুদিন পর এই নীতি অনুসরণ করে যে, ভূম্যাধিকারী হলেই আরব-অনআরব নির্বিশেষে প্রত্যেককেই কর দিতে হবে; কিন্তু পরিস্থিতিকে যা অধিকতর খারাপের দিকে নিয়ে যায়, তা হলো ভেদ-বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অন-আরবদের মনের ধূমায়িত বিক্ষোভ। এমনকি, যুদ্ধ-ক্ষেত্রেও তাদেরকে অশ্বারোহণ করতে দেয়া হতো না- তাদেরকে যুদ্ধ করতে হতো পদাতিক সৈনিক হিসেবে। তারা বেতন পেতো, কিন্তু কোনরূপ নিয়মিত ভাতা পেতো না। একজন আরব যদিও ইচ্ছা করলেই কোন অন-আরব মেয়েকে বিয়ে করতে পারতো, কোন অন-আরবের পক্ষে কোন আরব মেয়েকে বিয়ে করার কথা চিন্তা করাও সংশ্লিষ্ট আরব-পরিবারকে অপমান করার শামিল বলে বিবেচিত হতো। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের এই ভেদ-বৈষম্য থেকে যে ব্যাপক আন্দোলন জন্ম নেয়, ক্রমে ক্রমে তা বৈপ্লবিক রূপ পরিগ্রহ করে এবং তার প্রবল স্রোতে আরব-আভিজাত্যের কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেসে যায়।

আব্বাসীয় যুগে এই সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত শ্রেণীই রাষ্ট্রীয় শাসন-যন্ত্রের নিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের আর্থিক কাঠামো পূর্বের মতোই পুঁজিবাদী প্রকৃতির রয়ে যায়। আব্বাসীয় যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। পূর্ববর্তী সময়ের যুদ্ধকালীন অর্থনীতি এ সময়ে শান্তিকালীন অর্থনীতির রূপ পরিগ্রহ করায় ব্যবসায়ী, লগ্নীকার, জায়গীরদার প্রভৃতিই সত্যিকার অর্থে সমাজপতি হয়ে দাঁড়ায়। এ বংশীয় প্রথম যুগের সুযোগ্য সুলতানেরা প্রদেশগুলোর উপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন; কিন্তু পরবর্তী সুলতানেরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তাঁদের পক্ষে শাহী শান-শওকত বজায় রাখা ও সেনাবাহিনীকে বেতন দেওয়াই অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ-জীবনে মানুষে-মানুষে আর্থিক অসাম্য দেখা দিয়েছিল, এটাই শুধু নয়, সমগ্র রাষ্ট্রই অনেক সময়ে লগ্নীকার, জায়গীরদার ও ছোট ছোট গোষ্ঠীপতিদের নেহায়েত করুণার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়। অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রদের অভিভাবক হিসেবে ও কল্যাণধর্মী রাষ্ট্ররূপে ইসলামী রাষ্ট্রের ধারণাও সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয়।

 

এ সময়ে অর্থনৈতিক অব্যবস্থার দরুণ যে সকল বাহ্যিক বিপ্লব ও আভ্যন্তরীণ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়, তা দেখাবার জন্যে আরো দু’টি নজীর পেশ করা যেতে পারে। তার প্রথমটি হচ্ছে যাঁজ বিদ্রোহ। হযরত আলী (রা)-এর খান্দানের দাবীদার আলী ইবনে মুহাম্মদ নামক ব্যক্তির নেতৃত্বে চালিত এ বিদ্রোহের মুকাবিলায় রাষ্ট্রকে পনেরো বছর ভীতির মধ্যে অতিবাহিত করতে হয়েছে। নিম্ন ফোরাত অঞ্চলের সোনা-খনিতে অমানুষিক পরিবেশের মধ্যে কর্মরত নিগ্রো ক্রীতদাসদের মুক্তির দাবীতে এ বিদ্রোহ পরিচালিত হয়।

আর দ্বিতীয় নজীর হচ্ছে কারমেতিয়া ও আততায়ীদের আন্দোলন। হামদান কারমাতের নেতৃত্বে পরিচালিত এ আন্দোলন ইরাকের চাষী ও শ্রমিকদের দ্রুত সমর্থন লাভ করে এবং পরিণতিতে তারা অনেকটা কমিউনিজমেরই অনুরূপ (নারী ও সম্পত্তির উপর সামাজিক যৌথ অধিকার) বিধি-ব্যবস্থা-সম্বলিত একটি গোপন সমিতি গঠন করে। এরূপ ধারণা করা হয়ে থাকে যে, তারা পুরোপুরি সংগঠিত হবার পূর্বে যাঁজ বিদ্রোহের সাথে জড়িত ছিল। ৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তারা পারস্য উপসাগরের পশ্চিম উপকূলে একটি রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠা করে এবং এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বহুদিন পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোর জন্য ভীতিপ্রদ ছিল। হাসান ইবনে সা’বার নেতৃত্বে পরবর্তীকালে অনুরূপ একটি আন্দোলন গড়ে উঠে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ভক্তদেরকে ধর্মান্ধতার জাল থেকে মুক্ত করে অজ্ঞেয়তাবাদের পথে পরিচালিত করা। নিয়ামুল মুল্কের হত্যা থেকে শুরু করে এ হাশিশিউনেরা (আততায়ীরা) ব্যাপক গোপন হত্যার মাধ্যমে সমগ্র মুসলিম জাহানে ত্রাসের সঞ্চার করে এবং ইসলামের রাজনৈতিক দেহে পচনশীল ক্ষত সৃষ্টিকারকের ভূমিকায় কাজ করে। তিন চার শতাব্দী ধরে নিরবচ্ছিন্ন গতিতে গড়ে ওঠা পুঁজিবাদের অন্যতম নজীর। এসব আন্দোলনের সরাসরি লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক, কিন্তু সাধারণ পন্থায় সেগুলোই সাফল্য অর্জন অসম্ভব বিবেচিত হওয়ায় চরম পন্থা অনুসৃত হয় এসব আন্দোলনের ধুম্রজালে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলো সম্পূর্ণভাবে দৃষ্টির বাইরে চলে যায় এবং ‘উদর-সর্বস্বতার ধর্ম’ ইসলামের পৃষ্ঠদেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে ছুরিকাঘাত করতে থাকে।

 

অনুবাদঃ ইবনে আসাদ।

৭৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক । ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top