৫৪,১৪১ বর্গমাইল এলাকার পূর্ব বাংলায় ৫,০৮, ৪০২৩ জন লোকের বাস। মোট জনসংখ্য শতকরা ৭৭ ভাগই মুসলমান। এছাড়া রয়েছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ই সংখ্যায় অধিক। প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ৭৭৪ জন। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র বা বিভিন্ন শাখা নদীগুলোর অববাহিকার গ্রামাঞ্চলে বাস করে। আর কিছু লোক বাস করে সীমান্তের উত্তর-পূর্ব এলাকার পাহাড়িয়া অঞ্চলে। পূর্ববাংলার মানুষের প্রধান জীবিকা হলো কৃষিকাজ, পশুপালন বা মৎস্য শিকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রধানত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাস। এছাড়া এ দেশে আছে কিছু স্বদেশী খ্রিস্টান এবং সাঁওতাল, চাকমা, মনিপুরী, হাজং ও গারোদের মতো আদিবাসী। এখানে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের রয়েছে সহাবস্থান। সারা দেশে শুধুমাত্র হিন্দু বা শুধুমাত্র মুসলমান গ্রাম কদাচিৎ দেখা যায়। মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ ও পাঠানরা দাবি করে যে তারা এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে এই পাক-ভারত উপমহাদেশে এসেছে। চট্টগ্রামের কিছু অধিবাসীদের দাবি তাদের শরীরে বইছে আরবদের রক্ত। হিন্দু সম্প্রদায়ে ব্রাহ্মণদের দাবি তারা পুরোপুরি আর্য বংশোদ্ভূত। যদিও সামাজিক আচার-আচরণ ও রীতিনীতিতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তবে সাধারণভাবে বলা যায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে এ দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে অনেক সাদৃশ্য। সাধারণ হিন্দু বা সাধারণ মুসলমান, ব্রাহ্মণ বা অব্রাহ্মণদের মধ্যে নৃতাত্ত্বিকভাবে আসলেই কোনো পার্থক্য আছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
এদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিচার করলে দেখা যায় যে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্যরা পশ্চিম থেকে পাক-ভারত উপমহাদেশে আসে। পশ্চিমে তারা ইরানীদের এক জাতি ছিল। কিন্তু এখানে এসে তারা অনার্যদের বাস করতে দেখে, যারা হয়তো আগে পশ্চিম ও অস্ট্রো এশীয় দ্রাবিঢ় ছিল। আর্যরা পূর্ব বাংলায় বিস্তার লাভের শেষভাগে মোঙ্গলীয় জাতির তিব্বতীয়-বর্মীরা পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে।
আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে আর্যরা উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে প্রবেশ করে। বাংলা ভাষার উপর মুন্ডাদের যে প্রভাব আছে তা আমি ‘বাংলার মুন্ডা’ নামক প্রবন্ধে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। পূর্ববাংলার ভাষাগত উচ্চারণ এটাই নির্দেশ করে যে তাদের ভাষায় তিব্বতীয় বর্মীদের প্রভাব রয়েছে। আর্যদের বিশুদ্ধ তালব্য ধ্বনি তালব্য-দত্ত ধ্বনিতে রপান্তরিত হয়েছে। যেমন আর্যদের ঘ, ধ, ভ এর উচ্চারণ হয়েছে গ, দ, ব। এছাড়া প্রতিবেশী তিব্বতীয় –বর্মীদের ভাষার কিছু শব্দ পূর্ব পাকিস্তানের ত্রিপুরা ও চট্টগ্রামের ভাষায় চলে এসেছে। অস্ট্রো-এশীয় লোকেরাই সম্ভবত বাংলার গণমানুষের ভিত্তিমূল। তবে একথা নিশ্চিন্তে বলা যায় যে, বাঙালীদের জীবনে আর্যদের সংস্কৃতির ছাপ সুস্পষ্ট বিদ্যমান। যেমন বাংলার বহুল ব্যবহৃত শব্দ কুড়ি (বিশ) একটি মুন্ডা শব্দ। সোরবোন-এর অধ্যাপক ডাইলুপ্তি দেখিয়েছেন যে সংস্কৃত শব্দ ময়ূরা (ময়ূর), কাদালি (কাঁচাকলা), তামবুলা (পান), আলা (লাউ) অস্ট্রো-এশীয় ভাষা থেকে এসেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এস, কে, চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে, চাউল শব্দটা অস্ট্রো-এশীয়দের কাছ থেকে ধার করা। এমনকি বাঙালিদের ভাত-মাছ খাওয়ার অভ্যাসটাও এসেছে এই আদিবাসীদের কাছ থেকে। ধারণা করা হয়, ঢেঁকি ও ডোঙ্গা তাদেরই আবিষ্কার। বাংলার কিছু লোকগাথা, লোকনৃত্য ও লোকগীতির মূল উৎসও অস্ট্রো-এশীয়রা। কেউ কেউ বেদোত্তর হিন্দুধর্মে এর প্রভাব ইঙ্গিত করেন। ধারণা করা হয় যে, বিবাহিত হিন্দু মহিলাদের সিথিতে সিঁদুর ও হাতে শাখা পরার প্রচলনও এই অনার্যদের কাছ থেকে এসেছে। ১৩০০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা প্রায় সমগ্র পূর্ববাংলা জয় করে নেয়। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে পাঠান রাজা দাউদ শাহকে পরাজিত করে সম্রাট আকবর বাংলা জয় করেন। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে সমগ্র পূর্ববাংলা মুঘল শাসনাধীনে চলে আসে। মুঘলদের বিজয়ের কিছুদিন আগে পর্তুগীজরা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এদেশে এসেছিল। মুঘল শাসনামলে আসে ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসী বণিক সম্প্রদায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রকৃতপক্ষে বাংলার শাসক হয়।
মুসলিম শাসনামলে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি ও উৎকর্ষ মুসলমান শাসক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উৎসাহের ফসল। গৌরের সিকান্দার শাহ্ (১৩৫৭-৯৩ খ্রি:) ছিলেন বাংলার মধ্যযুগের প্রাথমিক কবি চন্ডিদাসের পৃষ্ঠপোষক। সিকান্দার শাহের পুত্র ও উত্তরাধিকার গিয়াসউদ্দীন আযম শাহের (১৩৯৩ – ১৪১০ খ্রি:) সময় শাহ্ মোহাম্মদ সগীর খ্যাতি লাভ করেন। সম্ভবত গৌরের শাসক জালালউদ্দীন মুহাম্মদ শাহের (১৪১৮-৩১ খ্রি:) নির্দেশে কৃত্তিবাস রামায়ণের বাংলা অনুবাদ করেন। ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ নামে ভগবত পুরাণ থেকে মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণের জীবনী বাংলায় অনুবাদ করেন। শামসুদ্দীন ইউসুফ খান (১৪৭৪-৮১ খ্রি:) তাকে ‘গুণরাজ খান’ পদবীতে ভূষিত করেন। গৌরের রাজা হুসাইন শাহের (১৪১৩-১৫১৯ খৃ:) সেনাপতি পরাগল খানের নির্দেশে কবিন্দ্র পরমেশ্বর মহাভারতের বাংলা অনুবাদ করেন। মুসলমান শাসক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষের জন্য পৃষ্ঠপোষকতার এই ধরনের বহু দৃষ্টান্ত বিদ্যমান, যদিও তাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিল ফার্সি। মুসলিম শাসনামলে বাংলা ভাষায় ফার্সি, আরবি ও তুর্কী অনেক শব্দের ব্যবহার আরম্ভ হয়। কখনো কখনো এও দেখা যায় যে, পুরনো দেশী শব্দের পরিবর্তে ফার্সি শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন- দেশী শব্দ বুহিত, কুকরা, সাসারু, মাজা, ধলা ইত্যাদির পরিবর্তে যথাক্রমে ফার্সি শব্দ জাহাজ, মোরগ, খরগোশ, কোমর, সাদা ইত্যাদি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ রকম প্রায় দুই হাজারের বেশি শব্দ বাংলা ভাষায় আছে যা বাংলার সাধারণ হিন্দু ও মুসলমানদের দ্বারা ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলার শব্দভাণ্ডারে ফার্সি শব্দের প্রভাব ছাড়াও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিন্দুরাও মুসলমানদের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এমনকি ধর্মীয় ক্ষেত্রেও কিছু প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ভারতের মিশ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের নামটিও মুসলমানদের কাছ থেকে পাওয়া। তাদের পোশাক ছিল সিল্ক বা সুতির ধুতি ও গুড়নি (পরবর্তীতে যাকে চাদর বলা হতো)। তারা গরুর চামড়ার তৈরি জুতা পরতো না, কারণ তাদের কাছে গরু ছিল পবিত্র প্রাণী। মুসলিম শাসনামলে হিন্দুরা জামা ও জুতা পরিধান করা শুরু করে। তারা তাদের উদর পুর্তি করত পোলাও, কোরমা, কোফতা ইত্যাদি ফার্সি খাবার দ্বারা। ইসলামের প্রভাবে কেবল অস্পৃশ্যতার গ্লানিই দূর হয়নি, বিভিন্ন সংস্কারকদেরও আবির্ভাব ঘটেছে। হিন্দুরা এখনও মুসলিম শাসন প্রদত্ত খান, সরকার, সারখেল, মালিক, মজুমদার, তরফদার, সাহা ইত্যাদি পদবিগুলো নামের সাথে ব্যবহার করে আসছে।
সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে মুঘল শাসনামলে উর্দুভাষার প্রভাবে বাংলার মুসলমানরা অনেক উর্দু ও হিন্দি শব্দ ব্যবহার শুরু করে। যেমন- চাচা, চাচী, ফুপি, ফুপা, নানা, নানী, বকরী, ফুট ইত্যাদি। এইসব শব্দের আবির্ভাব বাংলা ভাষায় নতুন এক ধরনের প্রবর্তন করে, যাকে বলা হতো দো-ভাষী বাংলা। এই নতুন ভাষায় কিছু মুসলমান এবং হিন্দু কবি লেখকরা বাংলা সাহিত্য রচনা করেন। যাকে বলা হতো পুঁথি সাহিত্য। মুর্শিদকুলী খান (১৭১৭-২৭ খ্রিঃ) থেকে শুরু করে বাংলার মুঘল সুবেদারগণ শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। যদিও হানাফি মতাবলম্বীরা শিয়াদের অনুকরণে মহররম উৎসব পালন করত। অনেকে তাদের নামের সাথে আলী, হাসান, হোসাইন ইত্যাদি জুড়ে দিতে থাকে। যেমন- মুহাম্মদ আলী, মাহমুদ হাসান, আহমদ হোসাইন ইত্যাদি। আরবি ও ফার্সি শব্দের সংমিশ্রণেও নাম দেখা যায়। যেমন আফতাব (ফার্সি) উদ্দীন (আরবি), মাহতাব (ফার্সি) উদ্দীন, পানা (ফার্সি) উল্লাহ্ (আরবি) ইত্যাদি। এমনকি বিশুদ্ধ ফার্সি নামও দুষ্প্রাপ্য নয়। যেমন- রুস্তম, বাহারাম, কায়কোবাদ, খোশরু, পারভেজ, জামসেদ, খোদাবক্স ইত্যাদি। একজন মুসলমান আল্লাহর পরিবর্তে ঈশ্বর বা ভগবান কখনও ব্যবহার করতো না। কিন্তু তারা নির্দ্বিধায় ফার্সি শব্দ খোদা ব্যবহার করছে। এমনকি পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের সকল ভাষায় কিছু বিশুদ্ধ আরবি শব্দের পরিবর্তে ফার্সি শব্দ ব্যবহার শুরু হয়। যেমন- আরবি শব্দ রাসূল, সালাত, সাওম, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদির পরিবর্তে তারা পয়গম্বর, নামাজ, রোজা, বেহেশত দোজখ ইত্যাদি ব্যবহার শুরু করল। ফলশ্রুতিতে মুসলমানদের সংস্কৃতি শুধুমাত্র বাঙালিদের সংস্কৃতিতেই সীমাবদ্ধ রইল না; পুরো পাক-ভারত উপমহাদেশের সংস্কৃতি পরিণত হলো পারস্য, আরবীয় ও ভারতীয়দের সংস্কৃতিতে। মুঘলদের চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি এই মিশ্র সংস্কৃতির একটি জ্বাজল্য দৃষ্টান্ত।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সম্রাটের সনদ অনুযায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার প্রকৃত শাসক হয়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এখানে স্বদেশীয় ভাষার মধ্যে বাংলাও শিক্ষা দেয়া হতো। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় সূচিত হয়। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজিকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করা হয়। জনসাধারণের জীবনে লাগে পশ্চিমা হাওয়া। স্টিমার ও রেলগাড়ির প্রচলন এই উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে করে দেয় সহজতর। ইংরেজি পোশাক, আচার-আচরণ ও রীতিনীতি এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে অনুপ্রবেশ করে। অনেক ইংরেজি শব্দ স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় স্থান করে নেয়। ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য প্রায় দু’শ পর্তুগীজ শব্দ বাংলায় গৃহীত হয়েছে। ঠিক একই কারণে কিছু ওলন্দাজ ও ফরাসি শব্দও বাংলা ভাষায় আসে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরও এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইংরেজিই চলতে থাকে। ইংরেজিকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বাতিলের চিন্তা চললেও, এই ভাষা স্কুল ও কলেজের শিক্ষার জন্য অন্যতম আবশ্যিক ভাষা হিসেবে বহাল থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতি যে এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলবে তার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এতক্ষণ যা আলোচনা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। যেমন- অস্ট্রো-এশিয়ান, তিব্বতীয়-বর্মী, ইন্দো-আর্য, আরবীয়, পারস্য, তুর্কী, পর্তুগীজ ও ইংরেজ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি নতুন বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। যা কালক্রমে আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। কিন্তু পাকিস্তানের দু’টি অংশ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, ধর্ম ছাড়া এক হতে পারবে কিনা তা বলা মুশকিল।
বিভিন্ন জাতি বা ভাষার সংমিশ্রণ ছাড়াও প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যত ধর্মের লোকের সমাগম এখানে হয়েছে, তারও একটা প্রভাব এ অঞ্চলের সংস্কৃতির ওপর রয়েছে। আর্যদের আগমনের পূর্বে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ধর্ম ছিল সর্বপ্রাণবাদ। আর্যরাই এখানে ব্রাহ্মণ্যবাদের স্রষ্টা। আদিবাসীদের একটা বৃহৎ অংশ এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করে এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এরপর আসে জৈন ও বৌদ্ধধর্ম। জৈন ধর্ম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। কালক্রমে বৌদ্ধধর্ম এ স্থান দখল করে। পাল রাজবংশের রাজত্বকালে (৮ম থেকে ১২শ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত) প্রায় সমগ্র বাংলার সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চন্দ্র, দেব ও খাজা রাজবংশও বৌদ্ধ ছিল। পাল বংশের বিলুপ্তির সময় সেন রাজবংশ বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও পালদের পরাস্ত করে ক্ষমতা দখল করে। সেন রাজারা সংস্কৃত ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তারা বাংলায় হিন্দু ধর্ম পুনর্জ্জীবিত করেন। ১২০১ খ্রিস্টাব্দে রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে মুসলমানরা পশ্চিম-বাংলা জয় করে।
প্রচলিত আছে যে, মুসলিম বিজয়ের পূর্বেও সাধকগণ বাংলায় ইসলাম প্রচার করতেন। অষ্টম বা নবম শতাব্দীতে আরব বণিকরাই যে প্রথম চট্টগ্রাম বন্দরে ইসলাম প্রচার করে তাও অসম্ভব নয়। ইসলামের সাম্যতা ও ভ্রাতৃত্বে আকৃষ্ট হয়ে অনেক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও সীমিত সংখ্যক হিন্দুরা ইসলাম গ্রহণ করে। ষোড়শ শতকে পর্তুগীজ মিশনারীদের দ্বারা প্রথম খ্রিস্টীয় ধর্মের উৎপত্তি হয়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বৃটিশ কর্তৃক বাংলা জয়ের সাথে সাথে খ্রিস্টান মিশনারিদের কর্মতৎপরতা বেশ বৃদ্ধি পায়। অসংখ্য হিন্দু, বিশেষ করে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পূর্ব বাংলা ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায়। এখন আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের এই দুই অংশের মুসলমানগণ ইসলামের বন্ধনে আরও দৃঢ়ভাবে স্থাপিত হবে। ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও এর দ্বারা প্রভাবিত ও উপকৃত হওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।
____________________
মূল: ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
অনুবাদ : সেলিনা ইয়াসমিন