সংস্কৃতি চিন্তা দেশ ও জাতিসত্তার ভিত্তিতে

ল্যাটিন শব্দ Cultura থেকে এবং এই শব্দ থেকে  Culture শব্দটি উদ্ভূত যার অর্থ কর্ষণ বা Cultivation তথা চাষ বা ভূমিকর্ষণের মাধ্যমে ফসল বোনার উপযুক্ততা অর্জন করে জমি তেমনি কৰ্ষিত মনের ফলিত রূপই সংস্কৃতি। Culture শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ সংস্কৃতি বা বৃষ্টি। সংস্কৃতি শব্দের সম+কৃ+ক্তি-এ ব্যুৎপত্তির মধ্যে খুঁজে পাই সংস্কার প্রচেষ্টা। আবার বৃষ্টি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে কর্ষণ বা উৎকর্ষের ভাব। সংস্কৃতির আরবি প্রতিশব্দ হিসেবে তাহযীব ও তমদ্দুন বা তামাদ্দুন শব্দ দু’টি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মুদন বা মাদানুন থেকে এসেছে মাদানিয়াত। মাদানিয়াত থেকে এসেছে তমদ্দুন বা তামাদ্দুন। মাদানিয়াত শব্দের অর্থ হচ্ছে নাগরিক বোধ-নগর জীবনের মার্জিত বা পরিচ্ছন্ন সভ্যতা। আবার ‘তাহযীব’ শব্দের মূল খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় ‘হযব’, হাযাবা বা হাযযবা যার অর্থ হচ্ছে কেটে সমান করা। বাগানের সারিবদ্ধ গাছ বা ঘাসের বাড়তি সবকিছুকে মালি যেমন মেশিন দিয়ে কেটে-ছেঁটে সুদৃশ্য করে রাখে ঠিক তেমনিভাবে মানব জীবনের অসদাচরণ ও অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডকে বাদ দিলে মানুষের সমষ্টি ‘জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। সুন্দর সব সময় সুদৃশ্য ও কাঙ্ক্ষিত। আর দেখতে যা সুন্দর তাই পরিচ্ছন্ন, তাই পরিশীলিত; তাই তাহযীব। এ অর্থে মানুষের পরিশীলিত জীবন ধারাই সংস্কৃতি।

উপরোক্ত বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শুধু নাচ গান ও বিচিত্রানুষ্ঠানের বিশেষ কর্মকাণ্ডকে সংস্কৃতি বলে না। বরং মানব জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের ফলিত রূপকে বলা হয় সংস্কৃতি। তবে মানব জীবনের সব কাজই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয় না। এই মুহূর্তে রানা প্লাজার পাশে অথবা ঝিগাতলতার মোড়ে একটি ছিনতাই হয়ে গেল অথবা একটি হত্যাকাণ্ড-এটি সংস্কৃতির অংশ হবে না। বছর তিনেক আগে থার্টিফার্স্ট নাইটে সেই মেয়েটির যে দুরবস্থা, দুর্যোগ ও জিল্লতী কোনো রুচিশীল মানুষই তা পছন্দ করতে পারে না। এটি মানব কর্মকাণ্ডের দুষ্টক্ষত। এটিও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত নয়। আর তাছাড়া থার্টিফার্স্ট নাইটের সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নয়। এটি বিজাতীয় সংস্কৃতি। অনেকে সংস্কৃতিকে ফুলের সৌন্দর্য ও সৌরভের সাথে তুলনা করেছেন। আসলে মনুষ্যত্বের বিকাশের মধ্য দিয়ে একটি মানব সমাজে যে সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয় তার সমষ্টিগত ফলিত রূপকেই সংস্কৃতি বলে। সংস্কৃতিকে মুদ্রণ কাজের সাথে তুলনা করা যায়। কোনো পাণ্ডুলিপি কম্পোজ করার পর তিন থেকে পাঁচ বার প্রুফ দেখে যখন পেটি মুদ্রণের জন্য প্লেটে রূপান্তরিত হয় তখন আর তাতে ভুল থাকে না। এভাবে মানৰ জীবনের ভুল-প্রাপ্তি, দুষ্টক্ষত প্রভৃতিকে বাদ দিলে যা থাকে তা হচ্ছে মানুষের সাজানো গোছানো বা পরিশীলিত ও পরিশ্রুত জীবন ধারা। এরই নাম সংস্কৃতি।

১৯৮২ সালের ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সম্মেলন সংস্কৃতির যে ব্যাখ্যা দেয় তা নিম্নরূপ :

“ব্যাপকতর অর্থে সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জাতির অথবা সামাজিক গোত্রের বিশিষ্টার্থক আত্মিক, বস্তুগত, বুদ্ধিগত এবং আবেগগত চিন্তা এবং কর্মধারার প্রকাশ। শিল্প ও সাহিত্যই একটি মাত্র সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত বস্তু নয়, মানুষের জীবন ধারাও সংস্কৃতির অঙ্গ। মানুষের অধিকার, মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসও সংস্কৃতির অঙ্গ।

সংস্কৃতি মানুষকে নিজের সম্পর্কে চিন্তা করার অধিকার এবং ক্ষমতা প্রদান করে। আমরা যে বিশেষভাবে যুক্তিবাদী মানুষ যে মানুষের বিচারবুদ্ধি আছে এবং ন্যায়ের প্রতি আনুগত্য আছে তা আমরা অনুভব করতে পারি সংস্কৃতির মাধ্যমে । সংস্কৃতির মাধ্যমেই আমরা মূল্য নিরূপণ করি এবং ভালো-মন্দের মধ্যে নির্বাচন করতে শিখি। সংস্কৃতির মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে, আত্মসচেতন হয়, নিজের অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে বোধ জন্মে, নিজের কর্মকান্ড সম্পর্কে বোধ জন্মে, নিজের কর্মকান্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শেখে, অনবরত নিজের সীমা অতিক্রম করে দক্ষতা অর্জন করে।”

মানুষের সমাজ, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি একই সঙ্গে বিকশিত হয়। মানুষের শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদি শিক্ষা ও সভ্যতাকে সূর্য মনে করা যায় তা হলে তার কিরণকে বলতে হয় সংস্কৃতি। একটি ডায়মন্ড বা হীরক খণ্ডকে যদি সভ্যতা বলা যায় তা হলে তার দ্যুতিকে বলতে হবে সংস্কৃতি। মানুষ নিজেকে অনবরত সৃষ্টি করে চলেছে। এই সৃষ্টির কাজে মানবিকতা সম্পৃক্ত পাশবিকতা পরিত্যাজ্য। এখানে মানুষের জীবনাদর্শ অত্যন্ত এর ভূমিকায় অবতীর্ণ। মানুষের জীবনাদর্শ অর্থাৎ ধর্ম মানুষের জীবনের অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করে আর বাদবাকি অংশে ভৌগোলিক বা স্থানীয় পরিবেশ এবং ভাষা প্রভাব বিস্তার করে থাকে

মানুষের জীবনকে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়, একটি হচ্ছে ব্যষ্টি বা ব্যক্তিগত জীবন আর অন্যটি হচ্ছে সামষ্টিক বা সমষ্টিগত জীবন। গতিশীল মানব জীবনে ব্যক্তি সমাজের উপর আবার সমাজ ব্যক্তির উপর অবিরত প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সমষ্টিগত জীবনের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক- পরিবার, সমাজ, পাড়া, মহল্লা, অঞ্চল, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তা বিস্তৃত। মানুষের অনবরত সৃষ্টি কর্মের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে থাকে- এ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন, পরিবর্ধনও সম্পৃক্ত। মানুষের শিক্ষা, সভ্যতা, জীবন ও সংস্কৃতির বিকাশে তার জীবন দর্শনই তাকে অনবরত গতিশীল করে রেখেছে। এই গতিশীলতা মানেই হচ্ছে অনবরত সৃষ্টি করে চলা। এখানে শিক্ষার ভূমিকা অত্যন্ত প্রবল। শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে, সঠিকভাবে জীবনাদর্শের ধারণা দেয়, বহুবিধ জ্ঞান ও দক্ষতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা দান করে, দৃষ্টিকে সম্প্রসারিত করে এবং মানুষের জীবন গঠনে সার্বিকভাবে সহযোগিতা দান করে জীবনের আলো ও অন্ধকারের পরিচয় স্পষ্টতর করে। এখানেই জীবনাদর্শ মানুষকে জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধের দ্বারা সত্যিকারের মানুষে পরিণত করে। আর এই মানুষই যখন অনবরত সৃষ্টি কর্মে ব্যাপৃত হয় তখনই হয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্য।

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভৌগোলিক বা স্থানীয় পরিবেশ ও ভাষা এবং জীবনাদর্শ মানবজীবনে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রভাব জীবনাদর্শের। ভৌগোলিক কারণে আমাদের প্রধান খাদ্য মাছ, ভাত ও ডাল, অধিকাংশ মানুষের পোশাক লুঙ্গি বা তহবন্দ, শার্ট ও পাঞ্জাবী। আমাদের গ্রামবাংলায় অধিকাংশ ঘর-বাড়ি ছনের বা মাটির তৈরি। জীবিকার প্রধান কাজ কৃষি-মাটির সোঁদা গন্ধ; ফসল বোনা ও তোলার আনন্দে আমাদের জীবন ভরপুর। জারি, সারি ও ভাটিয়ালী গানে আমরা কখনো আনন্দে বিভোর আবার কখনো বেদনামন্ডিত হয়ে উঠি। 

একটি দেশ বা জাতির জীবনে ভাষার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভাষা মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনার বাহন। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও এই দুই ভূখণ্ডের ভাষায় শব্দ চয়ন ও ভাষার বাণীভঙ্গির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তারা বলে প্রয়াত, আমরা বলি মরহুম । তারা বলে জলযোগ, আমরা বলি নাস্তা। তারা বলে পূজা-অর্চনা, আমরা বলি এবাদত-বন্দেগী। আমরা বলি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, তারা বলে বন্দেমাতরম। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি আদান-প্রদান, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, দেশে-দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিব্যাপ্ত। এই আদান-প্রদান থেকে কেউই মুক্ত থাকতে পারে না। তবে এই আদান প্রদানের ক্ষেত্রে জীবনাদর্শই মানুষকে সচেতন করে দেয় কোনটি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি গ্রহণযোগ্য নয়। হিন্দুসম্প্রদায়ের তরল খাবার কাসুন্দি মুসলিম সম্প্রদায় গ্রহণ করেছে কিন্তু কচ্ছপ বা কাছিম মুসলমানদের জন্য হালাল নয়, তাই বর্জনীয়। আবার মুসলিম সম্প্রদায়ের মোরগ মোসাল্লাম, কোর্মা-পোলাও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রহণ করেছে। তাই বলে তাদের ধর্মে কেষ্টর জীব গরু খাদ্য হিসেবে তাদের জন্য বৈধ নয়, বিধায় বর্জনীয়। হিন্দু মহিলা মাথায় সিঁদুর পরে হাতে শাখা পরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানাদি শুরু করে। মুসলমানরা এটা কখনো করতে পারে না। এভাবে সংস্কৃতির বিকাশে ও সংরক্ষণে গ্রহণ-বর্জনের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। 

উপরোক্ত আলোচনায় সাধারণভাবে সংস্কৃতি বলতে কি বোঝায় তা খানিকটা স্পষ্ট হয়েছে বলা যায়। প্রসঙ্গত এখন ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন।

ইসলামকে সংজ্ঞায়িত করে বলা যায় : Islam is not mere a relegion, it is only the complete and comprehansive code of life. অর্থাৎ ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, এটা একমাত্র পরিপূর্ণ ও ব্যাপক জীবনবিধান।

মরহুম সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী বলেন :

“ইসলামী সংস্কৃতি পৃথিবীতে একটি নির্ভুল সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় । গড়ে ভুলতে চায় একটি সৎ পবিত্র জনসমাজ (Society)… সে চায় সমাজের লোকদের মধ্যে সততা, বিশ্বস্ততা, সচ্চরিত্র, আত্মানুশীলন, সত্যপ্রীতি, আত্মসংযম, সংগঠন, বদান্যতা, উদার দৃষ্টি, আত্মসম্ভ্রম, নম্রতা, উচ্চাভিলাস, সৎসাহস, আত্মত্যাগ, কর্তব্যবোধ, দৃঢ়চিত্ততা, বীর্যবত্তা, আত্মতৃপ্তি, আনুগত্য, আইনানুবর্তিতা প্রভৃতি উৎকৃষ্ট গুণরাজি সৃষ্টি করতে। “

এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার ইসলামী সংস্কৃতি মুসলিম শাসক হলেই বিকশিত হয় না। শুধুমাত্র মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রই হলো ইসলামী সংস্কৃতির মডেল। এর সাথে চার খলিফার খিলাফতকাল এবং পঞ্চম খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজের শাসনকালকে ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি বলা যায়। সে কাল থেকে আজ পর্যন্ত বহু মুসলিম রাজা বাদশাহ এবং বর্তমানের গণতান্ত্রিক অনেক রাষ্ট্র প্রধান মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাদের শাসনামলে ইসলামী সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশ ঘটেনি। মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রীর কবরের উপর নির্মাণ করলেন বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম সুদৃশ্য তাজমহল। সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করতে হয়, তবে জনগণের টাকায় শুধুমাত্র মুগ্ধ করে এমন একটি ইমারত নির্মাণ না করে তিনি যদি মমতাজ বেগমের ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ তার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতেন এবং সেখানে যদি সাধারণ জ্ঞান বিজ্ঞানের সমন্বয়ে ইসলামী জ্ঞানচর্চা করা হতো তাহলে সেটি হতো ইসলামী সংস্কৃতির নিদর্শন। 

তাজমহল নিছক মুসলিম সংস্কৃতি হয়ে মুখথুবড়ে পড়ে আছে যা মানব কল্যাণের কোনো কাজেই আসছে না। ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশে সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে ঈমান, যাকে বৃক্ষের বীজের সাথে তুলনা করা যায়। একজন মানুষ যখন আল্লাহ এবং তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ঈমান আনে এবং সে অনুযায়ী চিন্তা ও কর্মে তৎপরতা চালায়, তখনি ইসলামরূপ বিকাশমান বৃক্ষটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। তাকওয়া বা খোদাভীতি এটিকে অনবরত আত্মসমীক্ষা ও আত্মমূল্যায়নের দ্বারা পরিশীলিত ও পরিশুদ্ধ করে। ইহসানের পর্যায়ে মানুষ ও তার সমাজ এক উচ্চতর পর্যায়ে সমাসীন হয় যাকে হযরত রাবেয়া বসরীর প্রার্থনা থেকে অনুধাবন করা সম্ভব। হযরত রাবেয়া বসরী মোনাজাত করছেন, হে আল্লাহ, আমি যদি তোমাকে দোজখের ভয়ে স্মরণ করে থাকি তাহলে তুমি আমাকে দোজখেই নিক্ষেপ করো। আর যদি বেহেশতের লোভে তোমার এবাদত করে থাকি তাহলে তুমি আমাকে বেহেশত থেকে বঞ্চিত করো। সুগভীর ভালাবাসা ও একনিষ্ঠতার মধ্যদিয়ে কোনো কাজে পাগল পারা হওয়ার নামই ইহসানের পর্যায়।

মহান আল্লাহ মানুষের জন্য ইসলামী জীবনাদর্শকে মনোনীত করেছেন। আর এই জীবনাদর্শের অনুশীলনে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ঈমান, তাকওয়া ও ইহসানের এক একটি পর্যায় অতিক্রম করে মানুষ ইনসানে কামিলে পরিণত হয় তখন ইসলামী সংস্কৃতির সুফল উপলব্ধি করা যায় । একটি মুসলিম প্রধান দেশে ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশই স্বাভাবিক। 

ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক নীতিমালা এবং ১৯৮৮ সালে গঠিত বাংলাদেশ জাতীয় সংস্কৃতি কমিশন-এর রিপোর্ট দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, একটি দেশের সংস্কৃতি চিহ্নিত করার জন্য জাতিসত্তা, ধর্ম বা জীবনাদর্শ, ভাষা ও ভৌগোলিক বা স্থানীয় পরিবেশকে গুরুত্ব দেয়া অত্যাবশ্যক। আমাদের জাতিসত্তার প্রশ্নটি অত্যন্ত জটিল হলেও এর সমাধান জটিল নয়। ব্যক্তি সম্পর্কে একজন মানুষ বিভিন্ন সম্বন্ধে অন্যের সাথে সম্পর্কিত। তেমনি বাংলাদেশের একজন নাগরিক ভাষার দিক থেকে বাঙালি, ধর্মের দিক থেকে মুসলমান বা হিন্দু বা খ্রিস্টান অথবা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ভুক্ত। আর রাষ্ট্রের দিক থেকে আমরা বাংলাদেশী। তারপরও বলা যায়, এদেশের জনসংখ্যার ৯০ ভাগ মুসলমান বাদ-বাকি ১০ ভাগ অমুসলিম। কাজেই এদেশের জাতিসত্তা গণতান্ত্রিক রায়ে মুসলিম জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে আশঙ্কা ও উদ্বেগের কিছু নেই। মহানবী (সা.) মদীনায় যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তাতে অংশগ্রহণ করেছিল ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক পূজারী ও মুসলমান জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ। এই সংবিধান ছিল পৃথিবীর প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র যা মানবিক আদর্শে রচিত ও সুবিন্যস্ত। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য বহন করে মদীনা রাষ্ট্রে অমুসলিমগণ সমস্ত অধিকার যেভাবে ভোগ করেছে নিজ জীবনাদর্শের রাষ্ট্রে তার অধিক ভোগ করার দৃষ্টাস্ত আজ পর্যন্ত দেখা যায় না। অতএব, বাংলাদেশের জাতিসত্তার ক্ষেত্রে মুসলিম জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর। এমন রাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন হিন্দু শিক্ষার্থীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় একজন হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষকের ব্যবস্থা থাকবে, যেখানে পঞ্চাশ জন মুসলিম শিক্ষার্থীর জন্য ওই একই ব্যবস্থা । মাত্র একজন শিক্ষার্থী এই অজুহাতে তাকে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা অমানবিক। এ ধরনের অমানবিকতা ইসলামী রাষ্ট্রে থাকতে পারে না। 

এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এদেশে বাঙালি সংস্কৃতির নামে যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায় তা তো অনেকটা সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহীর মতো মিশ্র ধর্মাদর্শ- যাকে মানব রচিত বলা যায় । ভাষা সংস্কৃতির একটি বড় উপাদান হলেও ভাষার ভিত্তিতে জাতি গঠিত হয় না। এর প্রমাণ, ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গে মোট বাংলাভাষীর শতকরা চল্লিশ ভাগ বসবাস করে। তারা কিন্তু বাঙালি হতে চায় না, ভারতীয় পরিচয়ে তারা স্বস্তিবোধ করে। বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘বাঙালির উৎপত্তি’ শিরোনামের প্রবন্ধে বাংলাভাষী মানুষকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। তা হচ্ছে আর্য হিন্দু, অনার্য হিন্দু, আর্য-অনার্য মিশ্রিত হিন্দু এবং বাংলাভাষী মুসলমান। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী হিন্দুরা যেমন বাংলাদেশী হতে চায় না তেমনি বাংলাদেশের মানুষেরাও ভারতীয় হতে ইচ্ছুক নয়।

শুধুমাত্র ভাষার ভিত্তিতে পৃথিবীর কোথাও জাতি গঠন হয়নি। জাতি গঠনে ভাষা, ধর্ম ও দেশ মিলিতভাবে যে মানসিকতা সৃষ্টি করেছে তার ভিত্তিতে আমরা বাংলাদেশী। গণতান্ত্রিক রায়ে এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বিধায় মুসলিম জাতিসত্তাই এদেশের সবকিছুর নিয়ামক।

অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি আমাদের দেশে উপ-সংস্কৃতির মর্যাদায় বিকশিত হয়ে মূল সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে সহ অবস্থান করবে। 

১১২২ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top