. উম্মাহকে বাদ দিয়ে ইসলামের অস্তিত্ব নেই

আল্লাহ তায়ালা আদেশ করছেন “তোমাদের মধ্যে এক উম্মাহ্ হোক যে আহ্বান করবে কল্যাণের দিকে, পুণ্যকর্মের নির্দেশ দেবে এবং মন্দকর্ম নিষেধ করবে। যারা তা করে তারাই সফলকাম” (পবিত্র কুরআন ৩: ১০৪)। স্পষ্টতই মুসলমানরা আদিষ্ট হয়েছে নিজেদেরকে উম্মাহক্তে পরিণত করতে অর্থাৎ একটি সামাজিক সংস্থারূপে গঠিত হতে- একটি বিশেষ পন্থায়। আল কোরআনের পাঠ আমাদের দেয় এমন আদেশ নির্দেশের ‘ইল্লাহ’ বা ইল্লাত (প্রয়োজনীয় যুক্তি), অর্থাৎ ‘কল্যাণের দিকে আহ্বান এবং পুণ্যকর্মের তাকিদ দিতে ও মন্দকর্ম বারণ করতে।” অবশ্য এই ইল্লাহ হচ্ছে একমাত্র চূড়ান্ত কারণ বা পরম লক্ষ্য, উম্মাহ্ যা সাধন করবে। এর চাইতে একটি নিম্নতরো চূড়ান্ত কারণ বা যুক্তি (এবং সে কারণে নিমিত্তস্বরূপ কারণ) হচ্ছে এই সত্য বা বাস্ত বতা যে, উম্মাহ্ই কল্যাণের দিকে আহ্বান এবং পুণ্যকর্মের নির্দেশ ও মন্দ কর্মের নিষেধ সম্ভব করে তোলে। উম্মাহ্ হচ্ছে মুসলিমের অধিকার ও কর্তব্যের উৎস এবং এ সংস্থার বা সংগঠনের মধ্যেই এসব অধিকার অর্জন ও কর্তব্য সম্ভব হতে পারে।

মহানবী (সা.) এই বিধান দিয়েছেন, “কোনো দেশে বা স্থানে তিনজন মুসলমান থাকতে পারেনা, তাদের মধ্যে একজনকে ইমাম বা নেতা নির্বাচন না করে। যেহেতু তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে অধিকারসমূহ সংরক্ষণ, আল্লাহর নির্দেশাবলী কার্যকরকরণ, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, হুদুদ বা আইনের সীমা বাস্তবায়ন এবং এ পৃথিবীতে এ অন্যজগতের সুখ শান্তি পরিপূরণ, তাই তাদের জন্য নিজেদেরকে একটি উম্মাহ্ বা একটি সুসংবদ্ধ সমাজে সংগঠিত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই- যে উম্মাহর থাকবে নিজস্ব সরকার

কেউ কেউ আপত্তি উত্থাপন করে বলতে পারেন, ব্যক্তিগত মূল্যসমূহের বাস্তবায়নের জন্য উম্মাহ্ আবশ্যক নয়। পক্ষান্তরে তারা এ দাবী প্রবলভাবে করতে পারে যে, মূল্য যেহেতু তখনই সর্বোচ্চ যখন তা গোপণ থাকে, তাই সমাজ এ ধরনের রূপায়ণকে নষ্ট করে দেয়। মুসলিম হিসেবে আমাদের জবাব এই যে, এ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে একটি খৃষ্টান দৃষ্টিভঙ্গি। নিশ্চয়ই ইসলাম বক্তিগত মূল্যসমূহের তাগিদ দেয়, সমষ্টিগতভাবে যে মূল্যগুলোকে বলা হয় ইখলাস, (নিয়্যত, সিদক, ইবতিগা, ওয়াজহু আল্লাহ, তুহুর, আমানত ইত্যাদি), কিন্তু সমভাবেই ইসলাম সন্যাসব্রতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে (কুরআন ৫৬: ২৭)। এর অনন্যতা এখানেই যে, ইসলাম দাবী করে, কোনো ইখলাসই বিশ্বাসযোগ্য নয়, যদি না দেশ ও কালের মধ্যে তা দৃষ্টিগ্রাহ্য কর্মরূপে প্রতিভাত হয় এবং সেই সঙ্গে সমগ্র সমাজের উপর তা ইসলামের তাগিদে রূপান্তরিত হয়। খ্রীষ্টান ধর্মে সমাজ ও রাষ্ট্র হচ্ছে সীজারের এলাকা (মসিহ ২২: ২৭, মার্ক ১২: ১৭, লুক ২০: ২৫), লিখিত সুসমাচারের শ্লোকের উপর ভিত্তি করে খৃষ্টান ধর্ম ঐতিহ্যগতভাবে এই বিশ্বাস করে এসেছে। সমাজের ক্ষেত্রে যাতে প্রাসঙ্গিক এবং ব্যবহার্য হতে পারে এজন্য খৃষ্টান নীতি-দর্শনের পরিসর বৃদ্ধির জন্য জোরে শোরে চেষ্টা শুরু হয় রিফর্মেশনের পরে থেকে এবং ক্যালভিনের মতবাদকে ধরে নেওয়া হয় আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে। কিন্তু এসবই সংখ্যাগুরু লোকজনের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং কখনো তা বিশ্বাসের অংশ হতে পারেনি, কেবলমাত্র তাদের নিজস্ব দলীয় মতবাদের অনুসারীদের দৃষ্টিতে ছাড়া। ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পর যখন মানুষের উপর শোষণ, নির্মমতা ও অধঃপতনের চূড়ান্ত স্তরে উপনীত হলো, কেবল তখনি খৃষ্টান বিবেক জাগ্রত হয়, সামাজিক সম্পর্কে ও জন আইনের রূপায়ণের সঙ্গে খৃষ্টের প্রাসঙ্গিকতা সম্প্রসারিত করার জন্য। কেবলমাত্র গত বিশ, ত্রিশ বছরের মধ্যেই এবং প্রধানত রেসিজম, কম্যুনিজম এবং দুটি বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ার ফলেই এই উদ্যোগ তখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠে। তা সত্বেও খৃষ্টান মন-মানসিকতা সরাসরি উম্মাহ্-সদৃশ একটি খৃষ্টান নীতি শাস্ত্রকে স্বীকার করে নেয়নি। যেখানে রাজনৈতিক ও সামাজিক পর্যায়ে খৃষ্টের আবশ্যিকতা অনুভূত হয় সেখানেও খৃষ্টের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে এ দাবী দ্ব্যর্থবোধক, কেননা, এ দাবী মতে, খৃষ্ট হচ্ছেন, পৃথিবীতে সিজারগণ যা করেন তার বিপরীত। এ কখনো সিজারগণের কি করা উচিত সে বিষয়ে খৃষ্টকে কিছুই বলতে দেখেনা।

ইসলামের সমস্ত কিছুই আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং সবকিছুই ধর্মীয় নির্দেশের পরিসরের মধ্যে পড়ে। বস্তুত: উম্মাহ্ হচ্ছে সকল পুণ্যকর্ম ও নৈতিকতার অপরিহার্য শর্ত। এজন্যই আল্লাহ মুমিনদের বর্ণনা করেছেন “সেই সব নারী ও পুরুষরূপে যারা একে অন্যের রক্ষক- যারা একে অন্যকে সৎকর্মের নির্দেশ দেয় এবং মন্দকর্মে নিষেধ করে” (পবিত্র কুরআন ৯:৭১)। আরো সরাসরি তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন সৎকাজে এবং পুণ্য অর্জনে একে অন্যের সঙ্গে সহযোগিতা করতে (পবিত্র কুরআন ৫:৩)। অপরপক্ষে আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দেন মন্দকর্মে একমত না হতে এবং পরস্পরের বিরোধীতা করতে, অপরাধ বর্জন ও আগ্রাসন বন্ধের জন্য (পবিত্র কুরআন ৫:৩)। শিক্ষামূলকভাবে তিনি সেই সব লোককে, অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন, যারা তাদের মধ্যে, যে সব মন্দকর্ম চলছিলো একে অপরকে তা নিষেধ করেনি (কুরআন ৫:৭৯)। এজন্যই মহানবী (সা.) বলেছেন, “যেখানে মানুষ, যারা একটি মন্দকর্ম অনুষ্ঠিত হতে দেখে এবং তা পরিবর্তনের জন্য কোনো চেষ্টা করেনা- আল্লাহ তাদের উপর শাস্তি নাযিল করবেন।” এবং তিনি এ যুক্তিতে তার বিচারের ব্যাখ্যা করেছেন যে, পাপ বা মন্দ কর্ম যখন গোপনে করা হয়, তা যে মন্দকর্ম করে, কেবল তারই ক্ষতি করে, কিন্তু যখন তা প্রকাশ্যে করে এবং কেউ তা নিষেধ করে না, তখন তা সকলেরই ক্ষতি করে

উম্মাহর আরো যৌক্তিকতা পাওয়া যেতে পারে, নীতিশাস্ত্রীয় চেতনা এবং ব্যক্তিগত নীতিদর্শনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে। প্রথমটি থেকে এ তথ্য উদঘাটিত হয় যে, নৈতিক নির্দেশ হচ্ছে এমন একটি জিনিস যা কেবলমাত্র নৈতিকতার অধিকারী কারক বা কর্তা, প্রকৃতি ও অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের আওতার মধ্যে অবস্থান করে এবং তার নিজের জীবন যাপন করে, কেবলমাত্র তার থেকেই তা পাওয়া যেতে পারে, তার মধ্যেই ব্যবহৃত হতে পারে এবং কেবলমাত্র তার পটভূমিকাতেই তার মানে হতে পারে। আল্লাহর খেদমত হচ্ছে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবাস্তবায়ন এবং ঐশী অভিপ্রায় যেহেতু সেই সব মূল্য বা মৌলনীতি, যা সবকিছুকে মূল্যবান করে তোলে, তাই এ থেকে এ সিদ্ধান্ত সূচিত হয় যে, মানুষকে যদি আল্লাহর বন্দেগী করতে হয় তাকে অবশ্যই আন্তঃমানবিক সম্পর্কের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, যার মাধ্যমেই কেবল নৈতিক মূল্যগুলোর বাস্তব রূপদান সম্ভব। ঠিক যেমন উপযোগী কিছুই মূল্যসমূহের বাস্তব রূপদানের জন্য দেশকালে চৌহদ্দিভুক্ত পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কহীন একটি দেহ বিমুক্ত আত্মার আবশ্যকতা-অর্থহীন, ঠিক তেমনি নৈতিকতার বাস্তবায়ন মানুষের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য, বন্ধুত্ব, বিবাহ, পড়শী, জাগতিক দ্রব্যাদির উৎপাদন ও ভোগ, যুদ্ধ ও শান্তি, বিচার ও রায়, মিশন ও শিক্ষা, অবকাশ ও নান্দনিক উপভোগ ভ্রাতৃসম্পর্কের ব্যাপারে অন্য মানুষের সাথে সম্পর্কহীন একজন গৃহত্যাগী, সাধু সন্যাসীর কাছে প্রত্যশা করা যায় না। নৈতিক মূল্যগুলো হচ্ছে একটি অতিক্রমী-দিব্য অবস্থায় কতগুলো আদর্শ সার নির্যাস মাত্র, যদিনা সেগুলো এধরনের আন্তঃমানবিক সম্পর্কের মধ্যে বাস্তবে রূপায়িত হয়। নৈতিকতার পূর্বেই এসব সম্পর্ক স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং এগুলোকে বাদ দিয়ে নৈতিকতা অসম্ভব। এই সব সম্পর্কের প্রত্যেকটি অস্বীকৃতি বা প্রত্যাহারের মানে হচ্ছে এর প্রাসঙ্গিক মূল্যটি, অর্থাৎ যে মূল্যের সঙ্গে ঐ সম্পর্ক হচ্ছে ভিত্তিমূল বা বাহক, তাতেই অবাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ। একজন ব্যক্তি, সন্যাসী বা সাধু, যে নির্জন জীবন যাপন করে, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তার ভিত্তি হচ্ছে মূল্যের এলাকার অবচ্ছেদনের উপর। কেননা এ জীবন পরিচালিত হয় এ নীতির দ্বারা যে, সচেতনতা বা কর্তার খোদ-আত্মা যে মূল্যগুলোর বাহন, দৃষ্টান্তস্বরূপ তার অনন্যতা ও নির্জনতা, কেবল এগুলো নিয়েই মূল্যের জগতে গঠিত, অথবা এসবই হচ্ছে সর্বোচ্চ মূল্যবোধ, যার স্বার্থে অন্য সব মূল্য লংঘন করা যায়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে অন্যান্য মূল্যের অস্তিত্ব বিষয়ে সুস্পষ্ট অন্ধতা, একটা জবরদস্তি মূল্যগত ও দ্বৈতবাদ বা বর্জনকর মতবাদ। শেষোক্তটি হচ্ছে অন্যান্য মূল্যের প্রকৃত চালিকা শক্তি সম্পর্কে সংবেদনশীলতা, তাদের স্তরবিন্যাস সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত, প্রকৃতপক্ষে যা মূল্যতাত্ত্বিক চূড়ান্ততারই অস্বীকৃতি। এতে বিষয়ের কিছু নেই যে, নিঃসঙ্গ প্রতিটি মানুষ, বিখ্যাত সাধু সন্যাসীগণ এবং ইতিহাস বিশ্রুত সন্যাসীগণ সকলেই কঠোর, অসংযমী এবং প্রায়শঃ নির্দয় জীবন যাপন করেছেন

যখনই ব্যক্তিক অর্থে নৈতিক পরিসরের সংজ্ঞা দেওয়া হয়, এর অনিবার্য পরিণতি ঘটে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদে, যার যৌক্তিক সমাপ্তি ঘটে আত্মপ্রচারে। কারণ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে অবশ্যই তা নির্ভর করবে নৈতিক কর্তার অভ্যন্তরীণ নির্ধারণসমূহ বা উপাদানগুলোর উপর, যার বিচারক কেবল তার নিজের বিবেকই হতে পারে। নৈতিক ব্যক্তি বা এজেন্ট কামনা করতে পারে সর্বোচ্চ এবং মহত্তম পরার্থবাদী আদর্শ। ইচ্ছা যে কারণে নৈতিক হয়ে উঠে তা ধারণার দিক দিয়ে ইচ্ছাকৃত উপাদানটির মহত্ব বা পরার্থপরতা নয়, বরং ইচ্ছা করতে গিয়ে তার নিজের বৃত্তি যেভাবে ব্যক্ত হয়েছে তার উপরই তা নির্ভর করে তার ব্যক্তিগত যে অভ্যন্তরীণ প্রতিজ্ঞা নৈতিকতা গঠন করে, তার এই অগ্রাধিকার বা সংকীর্ণ বৈশিষ্ট্যই তাকে করে তোলে আত্মপ্রচারশীল, সর্বক্ষণ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। যদি এ দাবী করা হয় যে, নিজেকে নিয়ে আবিষ্টতার মূলেও রয়েছে পরার্থপরতার প্রবর্তনা, যেমন দেখা যায় আত্মঈপ্সিত দৃষ্টান্তের মধ্যে, একথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, যেহেতু নৈতিক এজেন্টের আচরণ যতই প্রকৃতি এবং অন্য মানুষের সঙ্গে বেশী করে সংশ্লিষ্ট হবে, ততই তার নিজের কিংবা মানবজাতির আচরণ সম্পর্কে, যে দৃষ্টান্তের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়, জড়িত না হয়ে সেই দৃষ্টান্ত অর্জনের প্রবণতা দেখা যাবে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে সকল যুগের এবং জাতির দরবেশ এবং সংসারবিরাগী সাধুসন্তদের নৈতিক অভ্যন্তরীণ প্রতিজ্ঞার দৃষ্টিান্ত হচ্ছে এই সব দরবেশ ও সাধুসন্ত, যাদের মধ্যে দেখা যায় পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার নৈতিকতার দ্বারা জগৎ বিমুখতা, জগৎ বর্জন ও দেহকে নিগ্রহর। এটি সাধারণ জ্ঞানের বিষয় যে, ইসলাম একটি ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের ধর্ম, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ধর্ম, প্রাত্যহিক এবং অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের জালের মধ্যে অবস্থান করে, একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং পরস্পর প্রভাবিত হয়, অন্য মানুষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং অন্যেরাও তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে বাদ দিয়ে ইসলাম সম্ভব নয়। বস্তুতপক্ষে মহানবীর (সা.) মশহুর উক্তি, “ধর্ম হচ্ছে অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক, ব্যবহারের বিষয়”, হচ্ছে এ পৃথিবীতে অন্য মানুষদের বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হবার ইসলামী প্রবণতার প্রকাশক। আমরা ইতিপূর্বে যেরূপ উল্লেখ করেছি, সমাজের জন্য ‘হাই ইবনে ইয়াকজানের’ এই আকুতি প্রকাশিত হয়েছে, সত্য আবিষ্কারের পর এবং ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের মাধ্যমে, সম্ভাব্য তার সকল সুখ ও আনন্দ লাভের পর

 

. এক এবং একমাত্র উম্মাহ্

আল্লাহ বলেছেন, “তোমাদের এই উম্মাহ্ একটি মাত্র উম্মাহ্” (কুরআনুল করিম ২১: ২৯, ২৩: ৫৩)। এই ঘোষণার দ্বারা আল্লাহ বলতে চেয়েছেন, মুমিনদের থাকবে একটি মাত্র উদ্দেশ্য, একটি ভিত্তিপ্রস্তরস্বরূপ মূল্যমান যা, তাদের সমস্ত কর্মপ্রায়াসকে স্থাপন করে একটি সর্বপরিবৃত তাৎপর্যের অধীনে, যা হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত। উম্মাহ্- এক এবং সবসময়ই তা একই থাকবে, কেননা আল্লাহ এক এবং তার ইবাদত এক ও অবিভাজ্য। কুরআন এবং মহানবীর সুন্নায় লিপিবদ্ধ এবং শরীয়ায় বাস্তবরূপে প্রতিফলিত, মানব জাতির জন্য আল্লাহর অভিপ্রায় সকল স্থানে এবং সকল সময়ে এক এবং অভিন্ন। তার অভিপ্রায় হচ্ছে সকল মানুষের জন্য এবং তার দৃষ্টিতে সকল মানুষ হচ্ছে সম্পূর্ণ সমান। তিনি বিশেষ কোন ব্যক্তি বা জাতির কাছ থেকে কম বা বেশী প্রত্যাশা করেন না, যা তিনি প্রত্যাশা করেন অন্য সকলের কাছে থেকে। তাই উম্মাহর এই একত্ব হচ্ছে ধর্মীয় এবং নৈতিক; জৈবিক, ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ভাষাগত বা সাংস্কৃতিক নয়। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) ইহুদীদেরকে একটি উম্মাহ্ বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও তারা মুসলমানদের সঙ্গে একই অঞ্চলে বসবাস করতো এবং একই রাজনৈতিক, ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক গ্রুপের অন্তর্গত ছিলো। যেহেতু তাদের আদর্শ ধর্মীয় এবং নৈতিক উভয়েই পৃথক, সে কারণে তিনি তাদেরকে একটি উম্মাহ্ বলে গণ্য করতেন। ইসলাম জীববিদ্যা, ভূগোল, রাজনীতি, ভাষা অথবা সংস্কৃতির ভিত্তিতে কোন উম্মাহ্ স্বীকার করেনা, কেবল ধর্মের ভিত্তিতে উম্মাহ্ স্বীকার করে। এজন্য আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে সুপরিচিত ন্যাশান, জাতিগোষ্ঠী (race) রাষ্ট্র, মহাদেশ- এই স্তরবিন্যাসগুলো ইসলামে স্বীকৃত নয়।

 

একথা বলার তাৎপর্য এ নয় যে, উম্মাত্র ধর্মীয় ঐক্য এধরনের ভিন্নতর ঐক্যগুলোর দ্বারা কার্যকর করা যায় না বা এগুলো পরিপূরক হিসেবে কাজ করেনা। স্থান ও ভূগোলের ঐক্য, ভাষা এবং সংস্কৃতির ঐক্য, জৈবিক জন্ম এবং জনগোষ্ঠীর ঐক্য, ধর্মীয় ঐক্যের সহায়তা করতে পারে এবং কার্যত করেও থাকে। “ইসলামী আইনের একটি মূলনীতি হচ্ছে ঘনিষ্ঠতর আত্মীয় স্বজনেরা, মানুষের সৎকর্মে অধিকতর হকদার।” ইসলাম বলতে চায় যে, ধর্মীয় এবং নৈতিক উপাদানকে ডিঙিয়ে ব্যক্তি মুসলমান বা মুসলিম গ্রুপের আচরণ কিছুতেই দৈহিক নৈকট্যের দ্বারা নির্ধারিত হতে দেওয়া হবেনা। আল্লাহ বলেছেন, “আমি সকলকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ এবং এক রমণী থেকে এবং তোমাদেরকে ভিন্ন গোত্র ও জাতিতে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে ভাই-ভাই হিসেবে মেলামেশা করতে পার। তোমাদের মধ্যে সেই হবে মহত্তম যে সবচেয়ে পুণ্যবান (কুরআনুল করীম ৪০: ১৩)। স্পষ্টতই দৈহিক নৈকট্যের স্থান, সৎগুণ ও নেক কর্মের নীচে, নৈতিক যোগ্যতা এবং ব্যক্তিগত মেধার তুলনায় এর স্থান গৌণ, মূখ্য নয়।

তাই উম্মাহ্ জন্ম, ভূগোল এবং ভাষার বিষয় নয়। এগুলো হচ্ছে মানুষের ইচ্ছা- নিরপেক্ষ এবং তজ্জন্য অপরিহার্য। একটি ধর্মীয় এবং ভ্রাতৃসমাজ হিসেবে উম্মাহ্ হচ্ছে ব্যক্তিবর্গের একটি স্বাধীন জামাত, যার লক্ষ্য, তাদের নিজেদের জন্য এবং মানব জাতির মধ্যে সকল মূল্যের জগত বাস্তবায়ন, যা ঐতিহ্যিক ইসলামী পরিভাষায়, “উভয় বাসস্থানে সুখ ও শান্তি, এ জীবনে এবং পরজীবনে।” মানুষ একটি অন্ধ সুযোগে উম্মাহর মধ্যে জন্মগ্রহণ করেনা, বরং একটি বুদ্ধিমান যুক্তিবাদী সত্ত্বা হিসেবে তার উম্মাহকে সে বেছে নেয় এবং তাতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়। উম্মাহ্ একটি সম্প্রদায় নয়, একটি সমাজ; প্রকৃতিগতভাবে ইহা একটি সম্প্রদায় নয়, বরং স্বেচ্ছায় গঠিত একটি সম্প্রদায়, একটি সমাজ।

ঠিক প্রথম হিজরার পরে ইসলামী আন্দোলন যখন শুরু হল, সে সময়ে সম্প্রদায়ের সহজ রূপ, গোত্র এবং সাম্রাজ্য, যা জাতিগোষ্ঠী, ভাষা সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উপর স্থাপিত একটি রাজনৈতিক সমাজ, তার অস্তিত্ব ছিল এবং এগুলোর তরক্কি হচ্ছিল, ইসলাম উভয়কেই ধাক্কা দিয়ে ধূলিসাৎ করে। ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করে একটি বিশুদ্ধ সমাজ, ধর্মীয় ও নৈতিক বিধানের অধীনে একটি বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব এবং তাতে যোগদানের জন্য গোটা মানবজাতিকে আহ্বান করে। মানুষের সামাজিক ইতিহাসে এটি ছিল, এখনো রয়েছে মহত্তম নবধারা। এটা সত্য যে, সম্পূর্ণভাবে ধর্ম এবং নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে খৃষ্টান ধর্ম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে খৃষ্টানত্বের জন্য অপরিহার্য ধর্মীয় এবং নৈতিক উপাদানকে পর্যবসিত করা হয়েছে ন্যূনতম বিন্দুতে; অর্থাৎ ধর্মের অনির্বচনীয় পরীক্ষামূলক সাধনা এবং ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের বিশুদ্ধতম নৈতিকতায়। এ উভয়ই ব্যক্তিগত, গোপন বা অভ্যন্তরীণ এবং এর সম্পাদন, বিচার ও মূল্যায়নের জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে ব্যক্তির বিবেক বুদ্ধির উপর এবং যে মুহূর্তে একে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ্য, সার্বজনিক বা সমাজভিত্তিক উপাদান অর্পণ করা হল, সে মুহূর্তেই রাজত্ব ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো এবং অংশত তা ফিরে গেল, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে স্থাপিত প্রাচীনতর সামাজরূপে। খৃষ্টান ধর্মের প্রথম দিকের বিভাগগুলো, যা ঘটেছিল নাইসিয়া এবং কেলসিডনে, প্রধানতই তা সংশ্লিষ্ট ছিল উচ্চতর মাত্রায়, এক দিকে সেমেটিক অন্যদিকে সাধারণ মানুষের গ্রীক, দল উপদলবাজীর মধ্যে। একইরূপে, ১০৫৮ খ্রীষ্টিয় শতকের মহামতবিভেদ ছিল প্রাচ্য বনাম প্রতীচ্যের মধ্যে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ষোল শতকের সংস্কার আন্দোলনে জার্মান, ইংরেজ, ফরাসী, ইতালীয়, ও ডাচদের জাতিগত প্রবণতাগুলোই, ব্যক্তিগতভাবে মনস্ত ত্বের দিক দিয়ে বিব্রত ক্যাথলিক সন্যাসী লুথার তাঁর আশ্রম গুরুদের কাছে যে ৯৫টি থিসিস উপস্থাপন করেছিলেন, সেগুলোর ফল নির্ধারণ করেছিল

 

তাই ইসলামে উম্মাহর অভ্যন্তরে কোনো ধর্মীয় বিভেদ এবং কোনো নৈতিক স্বাধীনতা বা বিভাগ বৈধ নয়। উম্মাহর ধর্ম থেকে বিছিন্নতাও বেদাআত, কারণ ধর্মীয় ও নৈতিক অর্থে উম্মাহ্ হচ্ছে সন্দেহাতীত ভাবেই একটি এক শিলায় তৈরী স্তম্ভের মত ব্যবস্থা। এর বিপরীত কিছুতে বিশ্বাসের মানেই হচ্ছে এমন সব ধর্ম পালন ও এমন সব নৈতিক নীতি অনুসরণ যা ইসলাম থেকে ভিন্ন, স্পষ্টতঃই তা অযৌক্তিক এবং হাস্যকর। অধিকন্তু ইসলামের অভ্যন্তরে ধর্মীয় নৈতিক বিভিন্নতা অনুমোদন করার মানেই হচ্ছে তাওহীদকে পরিত্যাগ করা, যে তাওহীদ হচ্ছে সকল সত্য জ্ঞানের একত্বের মূলনীতি। এ হবে সত্যের প্রতি দুটি ভিন্ন দাবীর সহাবস্থান অনুমোদন করার নামান্তর। এই বিচার মোটেই যৌক্তিক নয়, কেননা এখানে যে সমস্যাটি বিরাজ করছে তা দাবী এবং প্রতিদাবীর সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা নয়, বরং সেতুবন্ধের মত বুদ্ধির সাহায্যে সত্যের অধিগম্যতার সম্ভাব্যতা মেনে নেওয়া, যার অর্থে দাবী এবং প্রতিদাবীর মধ্যে বিরোধের সমাধান হতে পারে এবং বিভিন্নতা দূর করা যেতে পারে। নিশ্চিতভাবে ইসলাম পরমসত্যের বহুত্বের বিরোধী, সত্য সম্পর্কে মতের বিভিন্নতার বিরোধী নয়। ইসলামের দাবী অনুসারে মতামত হতে হবে দায়িত্বশীল। ইসলাম নিজের পথ নির্ধারণে এ দায়িত্ব পালনের জন্য ইজমার ব্যবস্থা করেছে (ঐক্যমতের ব্যবস্থা করেছে)। ইসলামী আইন শাস্ত্রে উম্মাহর প্রত্যেকটি ঐক্যমতকে সৃজনশীল উদ্ভাবনশীল ব্যাখ্যাতা কর্তৃক লংঘন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তৎসঙ্গে ইসলাম এ বিধানও দিয়েছে যে, ব্যাখ্যাকারকে এর জন্য উম্মাহর ঐকমত্য চাইতে হবে, অন্যথায় তা বেদাআত হিসেবে প্রত্যাখ্যাত হবে।

যাহোক, ধর্মীয় নৈতিক দিক দিয়ে উম্মাহ্ এক, একথা বলার তাৎপর্য এ নয় যে, উম্মাহ্ কোনো প্রশাসনিক বিভাগ স্বীকার করেনা। বস্তুত দক্ষতার প্রয়োজনে ও স্বার্থে, উম্মাহর মধ্যে যতগুলো প্রশাসনিক বিভাগ প্রয়োজন উম্মাহর অভ্যন্তরে ততগুলো বিভাগই  সম্ভব। শাফেয়ী মাযহাব রমাজানের প্রথম দিন নির্ধারণের জন্য ঈদুল ফিতর এর দিন নির্ণয়ের জন্য, এবং যাকাত তহবিলের বিতরণের জন্য ২৪ ফার্সাখ এর ইউনিট (১৯২ কিলোমিটার) স্বীকার করে। আজ সংগতভাবেই এ যুক্তি উত্থাপন করা যেতে পারে যে, যোগাযোগ টেকনোলোজিতে অসাধারণ উন্নতির ফলে সারা পৃথিবী একটি মাত্র প্রদেশ হয়ে উঠেছে। যাহোক জনপ্রশাসন কেবলমাত্র যোগাযোগের একটি বিষয় নয়। বলা যেতে পারে দক্ষতা ও সেবার দাবী অনুসারে উম্মাহ্ অবশ্যই বিভাজ্য।

এটা লক্ষ্য করতে হবে যে, উম্মাহর একটি বিভাগের মধ্যে প্রশাসনিক স্বায়ত্বশাসন সেই বিভাগকে আইন প্রণয়নের স্বায়ত্বশাসন দান করেনা। ইসলামে আইন প্রণয়ন একটি পূর্ণাঙ্গ ফিকাহ বা শরীয়ত দ্বারা শাসিত। এই পদ্ধতিতে সাধারণ নীতিমালাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের প্রয়োগ থেকে। সাধারণ নীতিমালার মধ্যে কোন পরিবর্তন স্বীকার করা হয়না, কারণ এ নীতিমালা আল্লাহ কর্তৃক জারীকৃত এবং যুক্তিগ্রাহ্য। মানুষের সৃজনশীলতার প্রয়োজন সেখানেই হয় যেখানে একটি নীতি বা মূল্যকে আচরণের নির্দিষ্ট মূর্ত নির্দেশে রূপদানের প্রয়োজন হয়। যাকে বলা যায় আইনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা দানের প্রয়োজন হয়, এবং প্রয়োজন হয় সেই সব নির্দেশনা পালন ও কার্যকর করণের। কেবলমাত্র মহানবীর (সা.) প্রদত্ত নির্দেশই আদর্শ, অবশ্য পালনীয়। ঐশী নির্দেশ অনুসারে তা ঘোষিত হয়েছে, “নবীর সুন্নাহর মধ্যে যে কেউ আল্লাহর সাহায্য চায়, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর আদর্শ (৩৩: ২১)।” অন্য সকলের জন্য প্রদত্ত ব্যবস্থা নির্দেশই হচ্ছে একটি মানবিক প্রয়াস, যাকে কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ হতে হবে এবং উম্মাহর ঐক্যমতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

উম্মাহর যে কোন প্রশাসনিক বিভাগের সৃজনধর্মী প্রয়াস, তার নির্দেশনার ক্ষেত্রেই হোক অথবা কার্যকারণের বেলায়ই হোক তা ইসলামিক আইনে একটি তর্কের বিষয়; এই আইনের বৈধতা সম্পর্কে পৃথিবীর মুসলমানদের প্রত্যয়ী করে অথবা মুসলিম বিশ্বের জনমত যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে, এবং বিতর্কের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন তা বর্জন বা পরিবর্তন করে এই প্রয়াসকে সার্বজনীনতা দান হচ্ছে প্রশাসনিক বিভাগের দায়িত্ব১০

আমাদের কালকে বাদ দিলে, উম্মাহ্ তো সমগ্র ইতিহাসকালে ছিল একটি মাত্র শিলার দ্বারা তৈরী স্তম্ভের মত একটি ঐক্য; কেননা সব সময়ই তা এক বা অভিন্ন ইসলামী আইন দ্বারা শাসিত হয়েছে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে কেবলমাত্র খোলাফায়ে রাশেদীন এবং উমাইয়া আমলে (১০-১৩১ হিজরা/৬৩২-৭৪৯ খ্রীষ্টিয় সন) উম্মাহ্ ঐক্যবদ্ধ ছিল, একটি অধি-রাজত্বের অধীনে, এর ইতিহাসের বাকি সময়টুকুতে ১২০০ বছরেরও অধিক কালের মধ্যে উম্মাহ্ বিভক্ত হয়ে পড়েছে বহু রাজনৈতিক বিভাগে; কিন্তু আইনের একত্ব ছিল তার চেয়ে দৃঢ়তর। এই আইন মুসলিম বিশ্বকে দিয়েছে তার বিভিন্ন অনুষ্ঠান, তার নৈতিক, ভিত্তি, এর জীবনে, এবং সংস্কৃতির রীতি ও ভঙ্গি, সকল জনগোষ্ঠী ও সংস্কৃতির মুসলমানদেরকে এই আইন এক এবং অভিন্ন আদর্শে শিক্ষাদান করেছে এবং একই আদর্শে নিবেদিত একটি ভ্রাতৃ সমাজের মধ্যে তাদেরকে সংহত করেছে। ইসলামী আইনের অভিন্নতা ও একত্ব, ইসলামের ইতিহাসের চৌদ্দশ’ বছরের খণ্ডন ও বিচ্ছিনতার আশংকা মোকাবেলা করেছে সাফল্যের সঙ্গে, তৎসঙ্গে বৈদেশিক শক্তির বিজয়কেও ঠেকিয়েছে। যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা যেতে পারে, বিশ্বব্যাপী মুসলিম ঐক্যের সর্বাগ্রবর্তী শক্তি এবং মেরুদন্ড উভয়ই হচ্ছে শরীয়ত, এই সত্য ও বাস্তবতাই উম্মাহকে করে তুলে একটি বিশ্বজনীন ভ্রাতৃসমাজ, যেখানে সকল মানুষই হচ্ছে তার সদস্য, মূলত জন্মগতভাবে এবং কার্যত এই আইন বিশ্ব ভ্রাতৃসমাজে প্রবেশ করার স্বাধীন ব্যক্তিগত নৈতিক সিদ্ধান্তের বদৌলতে১১

 

 

. উম্মাহগত ঐক্য সংহতির প্রকৃতি

. সর্বব্যাপকত্ব

এটা আশা করা যায় যে, ইসলাম যে জীবনের একটি সামগ্রিক সর্বব্যাপক ব্যবস্থা ও পদ্ধতি তা প্রমাণের কোন আবশ্যকতা নেই। ইসলাম পৃথিবীকে পবিত্র-অপবিত্র, পাক-নাপাক এই দুই ভাগে ভাগ করেনা, জীবনকে ধর্মীয় এবং ধর্ম নিরপেক্ষ বলে স্বতন্ত্র গণ্য করেনা। মানুষকে পৌরোহিত্য ও পৌরোহিত্য-বহির্ভূত শ্রেণীতে পৃথক গন্ডীভূক্ত করেনা। ইসলাম এ সকল বিভাগকে কৃত্রিম, অস্বাভাবিক, অযৌক্তিক গণ্য করে। ইতিহাসের বিচারে এ সমস্তই অমুসলিম ট্রাডিসনের আওতাভুক্ত, খৃষ্টান ট্রাডিসনের অংশ ইস্পেরিয়াল রোমের সর্বশ্রেষ্ঠ সেবাদাস খৃষ্টান ধর্মের ট্রাডিশন। আর এই ইম্পেরিয়াল রোমেই খৃষ্টান ধর্মের জন্ম হয় ও তার অবয়ব নির্মিত হয়।

বস্তুতঃ ধর্ম দর্শনের সঙ্গে ইসলাম প্রাসঙ্গিক অর্থাৎ পরাবিদ্যার সর্বোচ্চ নীতিমালার সঙ্গে যেমন ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান, তেমনি তা ব্যক্তিগত প্রাত্যহিক জীবনের ছোটখাট খুটিনাটির ক্ষেত্রেও তা প্রাসঙ্গিক। পবিত্র কুরআনেই আমরা সত্ত্বার দ্বৈতরূপের স্বীকৃতি পাঠ করি: বাস্তব সৃষ্টি এবং সীমাতিক্রমী স্রষ্টা, প্রকৃতি এবং মানবভাগ্য, মানুষের স্বাধীনতা এবং দায়িত্ব সকল সৃষ্টির কারকত্ব, নিমিত্তত্ব এবং নমনীয়তা, বিশ্বজগতের নিয়ম শৃংখলাবদ্ধতা, সত্য ও মূল্যের একত্ব, এবং একই ভাবে আমরা পাঠ করি, অভিবাদনের জবাবে উৎকৃষ্টতর অভিবাদনের আদেশ (কুরআন ৪: ৮৫), কোন গৃহে প্রবেশের আগে, প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার (কুরআন ২৪: ২৬-২৮), অন্যদের চিৎকার না করে মোলায়েম ভাষায় সম্বোধনের, (কুরআন ৩১: ১৯)।

কুরআন এবং সুন্নাহ মিলিতভাবে আচার-আচরণ, রাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিক নীতিমালা এবং সমাজপদ্ধতির একটি পরিপূর্ণ ব্যবস্থা আমাদেরকে দিয়েছে। এটা সত্য যে, কুরআন আমাদেরকে সকল খুঁটিনাটি দেয়নি, কিন্তু দিয়েছে সকল মৌলনীতি এবং দৃষ্টান্ত হিসেবে কিছু খুঁটিনাটি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোন একটি বিষয়ে মর্মকে সুষ্পষ্ট করে তোলার জন্য, অন্য ব্যাপারের চাইতে বেশী খুঁটিনাটি দেওয়া হয়েছে এবং সুন্নাহও তাই করেছে। কিন্তু ইসলামের পবিত্র গ্রন্থের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আল্লাহ তায়ালা কিংবা তার নবী (সা.) যে সব খুঁটিনাটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেননি, সেগুলোর বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা ও বিশেষ রূপদানের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে মুসলমানদের উপর। নিশ্চয়ই মুসলমানরা যোগ্যতার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করেছে এবং সামগ্রিক আইন ব্যবস্থা বিশদরূপ তৈরী করেছে মানুষের ইতিহাসে, তেমনটি যা আর কোথাও হয়নি১২। এই সামগ্রিক ব্যাপকত্বের তাত্ত্বিক ভিত্তি এই স্বতঃসিদ্ধ যে, মানুষের প্রত্যেকটি কর্মের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, কোন না কোন মূল্যের সম্ভাবনা, যেহেতু উম্মাহর লক্ষ্য হচ্ছে এই মূল্যের বাস্তবায়ন, তা থেকে এই সিদ্ধান্ত সূচিত হয় যে, যেখানেই এই বাস্তবায়নের সম্ভাবনা দৃশ্যমান হয়ে উঠবে, সেখানেই উম্মাহ্ তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টিত হবে। এর তাৎপর্য এই যে, মানুষের প্রত্যেকটি কর্মকান্ডের ব্যাপারে উম্মাহর কিছু না কিছু বক্তব্য থাকবেই। যেহেতু ইসলামী আইন এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক, তাই উম্মাহর কোন প্রশাসনিক বা বিচার বিষয়ক পরিসরের বাইরে কোন কার্যই পড়েনা।

 

. বৈষয়িকতা বা অন্তঃস্থিত বিষয়াদি

যে কোন একত্বের সামগ্রিক প্রকৃতি, আনুষ্ঠানিক বা বিমূর্ত হতে পারে। বস্তুত, ব্যাপকতা যত বেশী হবে, একত্ব ততই বেশী শরীরী হয়ে থাকে। এবং একটি সমগ্র ধর্ম বা বিশ্বদৃষ্টি কিংবা নীতিমালাকে কয়েকটি বিমূর্ত শব্দের মধ্যে পুরে দেওয়া যেতে পারে-যা সবকিছু বোঝাতে গিয়ে কিছুই বুঝায় না। ইসলামের সামগ্রিক ব্যাপকত্ব বৈষয়িকতা বা উপাদানকে বর্জন করে অর্জিত হয়নি। পক্ষান্তরে, এর মোকাবেলায় দাঁড় করিয়েছে নিরেট উপাদান অর্থাৎ নীতিসম্মত প্রতিটি বাঞ্ছিত বিষয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট আইনগত ব্যবস্থা ও নির্দেশ এবং যেখানে বিষয়টি আইনের বহির্ভূত সেখানে দিয়েছে মানুষের কর্মকান্ডের প্রত্যেকটি এলাকা ও কর্মের দিশারী হিসেবে বিশেষ মূলনীতি (dicta)।

উপাদান বা আধেয় বর্জিত সামগ্রিকত্বের দৃষ্টান্ত বহু। হিন্দু অনুধ্যানী চিন্তাবিদ সূর্য্যের নীচে এবং সূর্য্যকে ছাড়িয়ে সমস্ত কিছুই বোঝান ‘ওম’ শব্দ দ্বারা; আমাদের সুফী অনুধ্যানী অনুরূপভাবে ‘হু’ শব্দ দ্বারা তা ব্যক্ত করেন। দার্শনিকদের জন্য সমস্ত কিছু বোঝায় এমন একটি ফর্মুলার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া একটি আকর্ষণীয় ব্যাপার। অবশ্য দুঃখজনক সত্য এই যে, এ রকম এক স্বর বা ধ্বনি বিশিষ্ট মূল পরিভাষার প্রভাবে মানুষ, পুণ্যময় আধ্যাত্মিকতা থেকে শুরু করে সকল প্রকার পাপকর্ম এবং পৌত্তলিকতার পথে বিচরণ করেছে। হিন্দু এবং সুফী উভয়ই জানে এই পরিভাষা এধরনের বিচ্যুতি থামাবার শক্তি রাখে না। একইভাবে, যেখানে হযরত ঈসার প্রাথমিক লক্ষ্যই ছিল শিলীভূত নিষ্প্রাণ আইন সর্বস্বতা ভেঙ্গে ফেলা, অর্থাৎ ইহুদীদের আক্ষরিকতার উৎসাদন, সেখানে তাঁর শিষ্যরা যা স্থির করল তা মূলত নৈতিক এবং ঐশিক অন্তর্দৃষ্টিকে একটি পরম পদ্ধতিতে সঞ্চারিত করার প্রয়াস, যেখানে সমস্ত নৈতিকতাই অন্তর্গত মানসিক বিষয়। হিন্দুর পরাতাত্ত্বিক একমাত্র বুলি ‘ওম’ স্থলে খৃষ্টানরা প্রতিষ্ঠিত করল লাভ বা প্রেম, যে নৈতিক শ্রেণীতে পড়ে সমস্ত কিছুই। অগাষ্টিনের “আল্লাহকে ভালবাস এবং তোমরা যা ইচ্ছা কর” হয়ে দাঁড়াল সকলের জন্য এক হিতোপদেশ, যা যে কোন ব্যক্তি, যে কোন উদ্দেশ্যের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য ব্যবহার করতে পারে।

আমাদের অবশ্যই এ বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ হচ্ছেন ধর্মের একজন চমৎকার ইতিহাসবিদ, যিনি ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো জানেন এবং ধর্মের ত্রুটিগুলো প্রত্যক্ষ করেন। যার প্রমাণ মেলে কুরআনুল করিমের বহু আয়াতে। এজন্য এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ইসলাম, যার আবির্ভাব হয়েছে ঐতিহাসিক ধর্মগুলোর সংস্কাররূপে, তাতে আল্লাহ আমাদেরকে কেবল এক বা একাধিক সাধারণ নীতি দান করেন নাই, বরং দিয়েছেন নৈতিকতার নির্দিষ্ট বিষয়স্বরূপ উপাদান বা আধেয় এবং বিশেষ আদেশ ও নিষেধ, যেখানে বিশেষ উপাদান বা আধেয় অনুপস্থিত সেখানে ইসলামের বিধান হচ্ছে অনুসন্ধান করে তা বের করা এবং প্রতিষ্ঠিত করা মানুষের কর্তব্য।

স্পষ্টতই ইসলাম যেহেতু সামগ্রিক, এবং উপাদান বা আধেয়ের ধারক, তাই ইসলাম হচ্ছে এক শিলায় নির্মিত বিশাল স্তম্ভের মতই একক। এর লক্ষ্য হচ্ছে খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি বিষয়ে সম্পূর্ণ একটি পদ্ধতি গড়ে তোলা, যাতে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবন হবে নিয়ন্ত্রিত। অমুসলমানরা শরীয়ার সমালোচনা করেন, কারণ শরীয়াহ হচ্ছে সম্পূর্ণ (অর্থাৎ সামগ্রিক)১৩। তাঁরা ঠিকই বলে থাকেন, ইসলামের সামগ্রিকত্ব এবং আধেয়ত্ব এক সন্দেহাতীত বাস্তবতা, কিন্তু এর মধ্যেই রয়েছে ইসলাম ধর্মের বৈশিষ্ট্য, এর অনন্যতা ও মূল্যও।

 

. গতিশীলতা

সংজ্ঞার দিক দিয়ে মনোলিথিক ব্যবস্থা হচ্ছে বর্জনধর্মী একটা ব্যবস্থা, যা চার দিক থেকে আবদ্ধ এবং বিদেশী অপরিচিত বা নতুন সকল উপাদানের ক্ষেত্রে রুদ্ধদ্বার, কোন কিছুকেই গ্রহণ করতে বা বুকে স্থান দিতে রাজী নয়। এই হচ্ছে প্রাচ্যবিদের শরীয়ার সামগ্রিকত্ব ও উপাদানের যে সমালোচনা করে থাকেন তার সারমর্ম। তারা বলে থাকেন, শরীয়াহ তার ইতিহাসের একটি একমাত্র প্রকৃত মহৎ মুহূর্তেই, অর্থাৎ যখন তা তার পূর্ণতায় পৌছেছিল তখনই, একটি পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণ পদ্ধতি হিসেবে, তার লক্ষ্যে উপনীত হয়েছিল। যখন এই শীর্ষ বিন্দুতে সে পৌছল তখনই শুরু হয় অবক্ষয়, তার নিম্নগতি, কারণ এর মধ্যে নিজেকে বার বার পুনর্জীবিত করার যে শাশ্বত চরিত্র রয়েছে তাকে তা অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু মনোলিথিক পদ্ধতি নতুন নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বদলাতে পারেনা এবং এজন্য তা অবশ্যই নতুন প্রবর্তনার বিরোধিতা করতে বাধ্য হবে এবং প্রত্যেকটি পরিবর্তনাই হচ্ছে ‘বেদায়াত’, এটিও একটি বৈধ সমালোচনা; কিন্তু সে সমালোচনা শরীয়ার সমালোচনা নয়, মুসলিম ফকীহ ও তাদের অনুসরণকারীদের সমালোচনা; যাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবেই শরীয়ার বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। আসলে আমাদের মধ্যযুগের পূর্বপুরুষগণই ইসলামকে এই পথে তুলে দিয়েছিলেন। তারা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দেন, এবং ঘোষণা করেন, প্রথম ইজমা হবে সালাফের ইজমা, (সালাফ মানে আদি প্রজন্ম), অর্থাৎ সাহাবাদের ইজমা, নবীর সহচরদের ইজমা, যাতে করে কোন বেদায়াত প্রবর্তিত হতে না পারে। আজ আমরা তাদের সময়ের প্রয়োজন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারি এবং তাদেরকে ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু আজকের মুসলমানদের জন্য তাদের দৃষ্টান্তের অনুসরণ হাস্যকর।

ফিকাহ্-উসুলের যে সব পন্ডিত মধ্যযুগে শরীয়াহ-এর স্পষ্ট রূপদান করেছিলেন এবং তাকে উন্নীত করেছিলেন পূর্ণতার সর্বোচ্চ স্তরে তারা এর মধ্যে আইনের স্বয়ংক্রিয় নবরূপ অর্জনের সূক্ষ্মতম যন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করতে যত্নবান ছিলেন১৪। তারা মুসলমানদের দিয়েছিলেন সহীহ আইন এবং তার সঙ্গে দিয়েছিলেন তাকে নতুন রূপদানের প্রতিষ্ঠান ও উপায়সমূহ, এবং তা যতোটা সহীহ ছিল তার চাইতে তাকে আরো নিখুঁত করতে অথবা সকল সময় ও সকল কালের জন্য আইনের এই সম্পূর্ণতা প্রাসঙ্গিকভাবে যাতে কার্যকর হতে পারে তা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন। আধুনিক কালে স্বল্প কয়েকটি প্রয়াস ছাড়া মুসলমানরা শরীয়াহ-এর নবায়নের এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটির কোন ব্যবহারই করেনি (অর্থাৎ ইজতিহাদ, কিয়াস, ইজমা, ইসতিহসান, আল মাসালিহ, আল মুরসালাহ ইত্যাদি)। সেই যন্ত্রটির বিশ্লেষণের স্থান এটি নয়, তবে যে তত্ত্বগত বুনিয়াদের উপর তা দাঁড়িয়ে আছে তা অবশ্যই বিচার করে দেখতে হবে।

ইসলাম হচ্ছে সোনালী মধ্যপন্থার ধর্ম: “এবং এভাবে আমি তোমাদেরকে (মুসলমানদেরকে) করেছি উত্তম মধ্যপন্থী উম্মাহ যাতে তোমরা মানবজাতির জন্য হতে পার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত এবং রাসূল হতে পারেন তোমাদের জন্য প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত” (কুরআন ২: ১৪৩)। এই নীতি বিশেষ এবং নির্বিশেষ, বিশ্বজনীন এবং নির্দিষ্ট বিশেষিতেক ও উপাদানপূর্ণ, মনোলিথিক, এবং বহুমুখী, ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং বিশেষাত্মক উভয়ই, এবং ইহাই এর শক্তি। ইসলাম আমাদেরকে দিয়েছে সাধারণ আইন এবং তার সঙ্গে আমাদেরকে অনুমতি দিয়েছে যেখানে প্রয়োজন সেখানে তা ভঙ্গ করতে। অর্থাৎ যখন সাধারণ আইনে বিধৃত একটি মূল্যকে অনুসরণের ফলে, একটি উচ্চতর মূল্য লংঘিত হয়, চুরি, নরহত্যা, শূকর মাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে কুরআনের নির্দেশমালা, সালাত, রোজা, পিতামাতার জন্য সম্মান, এমনকি হজ্জ সম্পর্কে কুরআনের বিধানসমূহ এসবই এবং আরো বেশী ক্ষেত্রে লংঘন করা যেতে পারে, যখন এই আদেশ নির্দেশের পালন একটি উচ্চতর ইসলামী মূল্যকে লংঘন করে অথবা এধরনের মূল্যের বাস্তবায়নকে বিঘ্নিত করে। কেবলমাত্র যে নীতিটির ক্ষেত্রে ইসলামে কোন ব্যতিক্রম নেই, তা হচ্ছে তাওহীদ। “আল্লাহ শিরকের অপরাধ কখনো ক্ষমা করেননা, কিন্তু যাকে ইচ্ছা তিনি এর চাইতে কম গুরুতর যে কোন পাপ ক্ষমা করে দেন” (কুরআন ৪: ৪৭)। ইসলামের আদেশ- নির্দেশের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের অবকাশের মধ্যেই রয়েছে ইসলামের গতিশীলতা। যদি বিগত শতকগুলোতে মুসলমানরা এই চাবিগুলো ব্যবহার না করে নিজেদেরকে বদ্ধ ঘরে আবদ্ধ করে রেখে থাকে, এ জন্য কেবল মুসলমানদেরকেই অপরাধী সাব্যস্ত করতে হবে, আর কাউকে নয়। এছাড়া আর কোনো নীতিই চূড়ান্ত ও অলংঘনীয় নয়, ইসলাম হচ্ছে ভারসাম্যের ধর্ম। যেমন তা শিল্পের ক্ষেত্রে, সাহিত্যসহ এর সকল শিল্পের বেলায় যা গড়ে উঠেছে তাওয়াজুন (ভারসাম্য) এর এই নীতির উপর, তার খোদ মূল্যতত্বই হচ্ছে পরস্পরবিরোধী দুটি মূল্যের সূক্ষ্ম মিশ্রণের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য স্থাপন। ইবনে তাইমিয়া কি সুন্দর করেইনা তাঁর আল সিয়াসা আল শরীয়াতে বলেছেন “ইসলাম হচ্ছে আল্লাহর মনোনীত ধর্ম, যে বেশী করে এবং যে কম করে, তাদের মধ্য স্থলে যার অবস্থান।” এই গুণটিই নিজেকে দ্বীনিউল ফিতরাত (আল্লাহর দ্বীন, স্বভাব ও যুক্তির দ্বীন, ভারসাম্যের দ্বীন এবং সোনালী মধ্যপন্থা) বলে দাবী করার যোগ্যতা দান করে ইসলামকে। ইসলামের এই তাওয়াজুন তথা ভারসাম্য সোনালী মধ্যপন্থা এবং গতিশীলতার একটি অতুলনীয় অভিব্যক্তি।

আমরা দেখতে পাই, রাসূলুল্লাহর (সা.) জবাবে যখন, ইসলামের একটি উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কিছু সংখ্যক লোক তাঁকে বলেছিলো, “এখন থেকে আমরা আমাদের জীবনের প্রত্যেকটি দিন রোজা রাখবো, সরারাত বন্দেগী করবো এবং আমরা কখনো আমাদের স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করবোনা” মহানবী তখন বললেন, “কিন্তু আমিতো বছরের কিছু সংখ্যক দিনে রোজা রাখবো, বাকি দিনগুলোতে খাওয়া দাওয়া করবো। আমি ইবাদত করবো এবং নিদ্রাও যাব, এবং আমি স্ত্রীলোকদের বিবাহ করবো, যারা আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে চাইবে না তারা আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবেনা।” তালিকা করা যায়না এমন বহুসংখ্যক আয়াতে কুরআন আমাদেরকে বলেছে, সেই সব মূল্যগত উপাদানের মোকাবেলায় যুক্তিগ্রাহ্য কান্ডজ্ঞান হিসেবে ইসলামের সারমর্ম- যে উপাদানগুলোর মধ্যে কল্যাণ এবং অকল্যাণ উভয়েরই সমান সম্ভাবনা, পৃথিবীর সকল শুভ বস্তুই এর মধ্যে পড়ে১৫। কুরআন এরমাত্র কয়েকটি উল্লেখ করেছে “যেমন রমণী, শিশু, স্বর্ণ-রৌপ্য, অশ্বরাজি, গৃহপালিত জীবজন্তু এবং ক্ষেত খামার।” এবং এভাবে মানবমনে পৃথিবীর সঙ্গে যে সবের সম্পর্ক তখন ছিলো এবং এখনো সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট রয়েছে, সেগুলোকে একত্রিত করেছে (৩: ১৪)। বহু সংখ্যক আয়াতে এগুলো অমঙ্গলকর বলে ঘোষিত হয়েছে এবং মুসলমানদেরকে এসব সম্পর্কে হুশিয়ার করে দিয়েছে। অথচ (৭: ৩১) আয়াতে এগুলো ঘোষিত হয়েছে কল্যাণকররূপে এবং এসব অর্জনের জন্য মুসলামনদের প্রয়াসকে সমর্থন করা হয়েছে। মূল নিয়ামক নীতিটি দেওয়া হয়েছে (৯:২৫) আয়াতে, যেখানে তিরস্কার করা হয়েছে ভ্রান্ত শ্রেণীবিভাগকে, আল্লাহ ও তাঁর নবীর উপর এ শ্রেণীবিভাগকে, মানুষ কর্তৃক প্রাধান্য দানে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মনিয়োগের উপরে। স্পষ্টতই সোনালী মধ্যপন্থার মানে হচ্ছে দুটি অ-মূল্যের মধ্যবর্তী পন্থা; কিন্তু তা এক এবং অভিন্ন মূল্যের অনুসরণের ক্ষেত্রেও একটি ভারসাম্য যার মধ্যে সমন্বয় ঘটে, অন্য সকল মূল্যের নয়, যা প্রত্যেকটিকে দেয় তার যথোচিত প্রাপ্য১৬

 

. আঙ্গিকতা

উম্মাহর ঐক্য হচ্ছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গময় একটি জীবদেহের ঐক্যের মত; অর্থাৎ উম্মাহ্ হচ্ছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গময় একটি দেহের মত যার প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে অন্যের সঙ্গে এবং সমগ্রের উপর পরস্পর ও আলাদা আলাদাভাবে নির্ভরশীল। একটি অঙ্গ যখন নিজের কাজ করে, তখন তা যেমন অন্যান্য অঙ্গের জন্যও কাজ করে, তেমনি তা নিজের প্রয়োজনে সমগ্রের জন্যও কাজ করে। উহা যখন নিজের কাজ করে, তখন ইহা বিভিন্ন অঙ্গের প্রত্যেকের জন্য কাজ করে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সফলকাম বলে বর্ণনা করেছেন, “যাদের সম্পদে তারা অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতের অধিকার স্বীকার করে” (৫:১৯)। এবং মহানবীর উম্মতদের বর্ণনা করেন এভাবে যে “তারা অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে কঠোর, কিন্তু নিজেদের বেলায় একে অন্যের প্রতি কোমল ও দয়ালু; এ এমন একটি ভ্রাতৃসমাজ যাতে আল্লাহকে কেন্দ্র করে একে অন্যের প্রতি পারস্পরিক ভালবাসার দ্বারা তাদের হৃদয় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে” (৪৮:২৯)। মহানবী (সা.) মোক্ষম কথা বলেছিলেন, যখন তিনি উম্মাহকে বর্ণনা করেন “একটি সুস্থিত সংহত ইমারতরূপে, মজবুত ইমারতরূপে, যার প্রত্যেকটি অংশ অন্য সকল অংশকে ধরে রাখে, মজবুত করে এবং তাকে তুলনা করেন একটি দেহের সঙ্গে যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে সমস্ত দেহই নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে কাতর হয়।” উম্মাহকে একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গময় জীবন্ত দেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, এই শেষ হাদীসটিতে, যা সম্ভবত ইসলামী সমাজের সবচেয়ে যথোচিত বর্ণনা। অঙ্গ প্রত্যঙ্গময় দেহ হচ্ছে জীবন্ত এবং বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ নিয়ে এর অস্তিত্ব হচ্ছে এর সত্যিকার জীবন। অর্থাৎ সমগ্র দেহকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যেঙ্গের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সমগ্র কর্তৃক অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলোর নিরবচ্ছিন্ন লালন পালনের মধ্যেই এই জীবন্ত দেহের জীবন নিহিত। অঙ্গময়তা বা আঙ্গিকতা জীবনের কেবল একটি গুণমাত্র নয়, বরং এটিই জীবন। উম্মাহ্ যদি এই বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে অন্যকিছু হতে চায়, তাহলে তা আবার ফিরে যাবে মরুভূমির ইসলাম-পূর্ব গোত্রবাদে। এমনকি সেই ব্যবস্থাও গোত্রের অঙ্গময়তার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, কারণ এই অঙ্গময়তা বাদ দিয়ে এর অস্তিত্ব সম্ভব ছিলনা; গোত্রের এ ধারণাকে কেবলমাত্র সম্প্রসারিত করা হয়েছে যাতে সমগ্র মানবজাতি তার আওতায় আসতে পারে। তাই এই অঙ্গময়তাকে বা উম্মাহর প্রয়োজনকে অস্বীকার করার মানেই হচ্ছে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বকে শুভ মনে করা। এমনভাবে তাদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন বলে মনে করা, যার ফলে, কেবল যে ইসলামই অসম্ভব হয়ে পড়ে তা নয়, বরং সমভাবে সভ্যতা, প্রকৃত প্রস্তাবে মানুষের জীবনই অসম্ভব এবং অচিন্ত্যনীয় হয়ে দাঁড়ায়।

পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি করা যেতে পারে, কারণ এই নির্ভরশীলতাকে বাড়িয়ে এমন একটি বিন্দুতে পৌঁছুনো যেতে পারে, যেখানে একটি বৃহত্তর অঙ্গ বা যন্ত্রের চাকার কেবল একটি খাঁজ বা দাঁতে পরিণত করা যেতে পারে মানব ব্যক্তিকে, যাতে সেই খাঁজে, তথা ব্যক্তির নিজের বিকাশে আত্মপূর্ণতা এবং সুখের কোন অবকাশই থাকেনা। গোত্র প্রাধান্যের মানেই হউক কিংবা নগর, জাতি অথবা বিশ্বসম্প্রদায়ের জমানাই হউক, রেজিমেন্টেশন এবং যৌথখামার ও মালিকানা প্রথার অভিশাপ সব সময়ই মানুষের চেতনায় একটি দুর্বহ পাষাণ ভারের মত চেপে বসেছে। এখানেও আবার ইসলাম তাওয়াজুন অর্থাৎ সোনালী মধ্যপন্থার ব্যবস্থা দিয়েছে এবং তা ব্যক্তি ও গ্রুপ উভয়েরই সাফল্য অর্জনের লক্ষ্য বলে ঘোষিত হয়েছে। খ্রীষ্টান ধর্মের চূড়ান্ত ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদ এবং ইহুদী ধর্ম ও ইসলাম-পূর্ব চূড়ান্ত গোত্রবাদের মধ্যে ইসলাম প্রকৃত প্রস্তাবে একটি মধ্যবর্তী অবস্থান গ্রহণ করে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সুবিস্তৃত পরিসরের মধ্যে, মধ্যবর্তী স্থলে উভয় মূল্যের অবস্থিতি ঘোষণা করে এবং সেই পরিসরের শেষ প্রান্তের অ-মূল্যকে অস্বীকার করে।

 

. সম্ভাবনা

উপরে বর্ণিত এধরনের একটি উম্মাহ্ যে কেবলই সম্ভব তা নয়, বলতে গেলে এই হচ্ছে ইতিহাসের সফলতার একমাত্র শর্ত। এই উম্মাহর নীতির কোন না কোনটিকে বাস্তবায়িত না করে কোন সমাজ এবং কোন ধর্মই, কোন গোত্র এবং কোন রাষ্ট্রই, কোন সাম্রাজ্য এবং কোন ইতিহাসই কখনো সৃষ্টি হয়নি, বা সফল হয়নি। উম্মাহর মৌলনীতি যত বেশী অনুসৃত হয়েছে তত বেশী এবং তত স্থায়ী হয়েছে এই বাস্তবায়ন। উম্মাহর আদর্শ যত কম অনুসৃত হয়েছে, সাফল্য হয়েছে তত বেশী সাময়িক বা ব্যর্থতা হয়েছে তত বেশী বৃহৎ। এমনকি খোদ শয়তানের সাফল্যের জন্য উম্মাহর নীতিমালা একটি নিশ্চয়তা, যদিও তা সাময়িক। যদি শয়তান এবং তার বাহিনী উম্মাহর আদর্শের প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করে সে এবং তার বাহিনী অবশ্যই সফল হবে, যদিও মানবজাতির ইতিহাসে তাদের সাফল্য চূড়ান্ত বা সিদ্ধান্তমূলক হতে পারেনা। জায়নবাদীরা যেমন সফল, ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলা, যাদের অধীনে স্পেনীয়রা আমাদেরকে বহিষ্কার করেছিল তারাও সফল, স্পেন থেকে তারা এবং ব্রিটিশ, ফরাসী, ইতালীয়, ডাচ ইত্যাদি যারা আমাদের দেশকে আমাদের ভূমিকে কলোনী বানিয়েছিল, এমনকি হিংস্র তাতাররা যারা লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছিল এবং আমাদের মহত্তম এবং বৃহত্তম নগরীগুলোকে ভষ্মীভূত করেছিল, তারা সকলেই সফল হয়েছিল, কারণ, তারা ছিল বা রয়েছে অধিকতর উম্মাহপন্থী, অতীতের কিংবা বর্তমান কালের মুসলমানদের থেকে অনেক বেশী। এখানেই আমাদের দুর্বলতা, আধুনিক সাহিত্যে বারবার এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, “এর কারণ কি? যখন কোন মুসলমান ‘ওয়া ইসলামা’ বলে চিৎকার করে, কেউই সাড়া দেয়না?” এর জবাব হচ্ছে আমাদের মধ্যে উম্মাহর অনুপস্থিতি, উম্মাহ্ ব্যবস্থার ধারা এবং মৌলনীতিগুলোকে পূরণ করার ব্যাপারে আমাদের ব্যর্থতা।

কাজেই, অনিবার্য প্রশ্নটি হচ্ছে এই, কি করে আমরা মুসলমানদের মধ্যে উম্মাহর আদর্শ সৃষ্টি করবো? উম্মাহ্ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান ধরে নিয়ে এবং উম্মাহর শিক্ষা তথা ইসলামী আদর্শ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান রয়েছে একথা স্বীকার করে নিয়ে আমরা বাস্তব প্রশ্নটির মোকাবেলা করতে পারি। উম্মাহর লক্ষ্যকে ক্রমান্বয়ে কি করে আমরা কার্যকর ও প্রসারিত করতে পারি, প্রশ্নটি যতই বাস্তব হউক, এই প্রশ্নের উপরই সুফীগণ তাদের সমস্ত প্রতিভাকে নিঃশেষ করেছিলেন চূড়ান্ত লক্ষ্য বিস্মৃত হয়ে। ইবনে বা’জা এদের এই ভুল ধরতে পেরে লিখেছিলেন গবেষণা-মূলক গ্রন্থ ‘রিসালাত তাদবির আল মোতাওয়াহদ’ যার জন্য, চিন্তাধারার ইতিহাসবিদ হিসেবে আমরা উদ্ভাবন করতে পারি একটি পরিভাষার “সমাজভিত্তিক সুফীবাদ”। আধুনিক কালে সেনুসিয়াহ আন্দোলন এই ধরনের উম্মাহভিত্তিক সুফীবাদের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছেছিল।

দুই, মুসলমানের মধ্যে উম্মাহর সামগ্রিক একাত্মতাবোধ, কী করে আমি সৃষ্টি করতে পারি, সে প্রশ্ন তো আসলে দু’জনের মধ্যে কী করে আমি একটি রাসায়নিক মিলন সৃষ্টি করতে পারি, তা জিজ্ঞাসা করা। এধরনের রাসায়নিক সম্পর্কের ফলই হচ্ছে ‘তাহাবুব’ (পারস্পরিক ভালবাসা) ‘আত্ তাওয়াসী’ ওয়া আততানাহী’ (পরামর্শদান) ‘আততায়াখী’ (ভ্রাতৃসম্পর্ক স্থাপন) আততাওয়াউন (সহযোগিতা) আততায়ালুমস (শিক্ষাদান) আততাজাউয (মেলামেশা), আত্ তাওয়াসী (শান্তনাদান), আত্ তাসাদুক ওয়া তাত্তানউস (বন্ধুকরণ), কী ধরনের ক্রিয়া এবং নিষ্ক্রীয়তা, বাস্তবতা অথবা অবাস্তবতা, কর্মতৎপরতা অথবা নিষ্কর্মতা, উম্মতের এই বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে, যা একবার অস্তিত্বে এলেই, এই মূল্যগুলো সূচিত হবে এবং এভাবে উম্মাহর জন্ম হবে। সংক্ষেপে দুই বা ততোদিক ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিভাবে এই পারস্পরিক ভালবাসা সৃষ্টি করা যেতে পারে, ইহাই প্রশ্ন। মানুষের মধ্যে এ রূপান্তর সৃষ্টি করা মানুষের কাজ নয়, বরং আল্লাহর দায়িত্ব, কুরআনের শতাধিক আয়াতে যা ঘোষিত হয়েছে১৭, কারণ শ্রেয়র দিকে যে কোন রূপান্তর ও উম্মতের ধারণার দিকে যে কোন উন্মুখতার তিনিই হচ্ছেন গ্রন্থকার। এক্ষেত্রে মানুষ যা করতে পারে, তা হচ্ছে তার প্রস্তাবনার সামর্থ্য অর্থাৎ বাস্তব ও বৈষয়িক প্রেক্ষিত সৃষ্টি করা, যার মধ্যে ঐশী উদ্যোগ কার্যকর হতে পারে। ইহা নিশ্চয়ই সম্ভব যে, ঐশী কর্মের জন্য এধরনের মানসিক প্রস্তুতি কখনো কোন ফল উৎপাদন নাও করতে পারে। কিন্তু একথা সেক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেখানে মানবিক উদ্যোগ হচ্ছে স্পর্ধিত, অবজ্ঞাপূর্ণ এবং নিজের সমৃন্ধে অযথাই অতি আস্থাবান, কিন্তু যখন এই উদ্যোগ মিশ্রিত হয় ঐশী ক্ষমতার বিনীত স্বীকৃতির সঙ্গে, তখন তা সফল না হয়ে পারেনা। অন্যথায় যে কোন মানবিক ক্রিয়ার জন্য ঐশী আদেশ অসার হয়ে পড়ে এবং একইভাবে তা হয়ে দাঁড়ায় অহংকৃত।

 

আমরা তাহলে আমাদের প্রশ্নটিকে নতুন করে গঠন করতে পারি। ঐশী উদ্যোগের জন্য কি বিশেষ কর্ম বা পরিস্থিতি, বস্তুগত প্রেক্ষিত বা পটভূমিকা হতে পারে? এখানে একমাত্র সম্ভাব্য জবাব এই যে, এই মানুষগুলো একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হবে- আল্লাহকে স্বীকার করবে এবং একত্রে তার ইবাদত করবে, যুগ্মভাবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সন্ধান করবে, একত্রে স্পর্শগ্রাহ্য সুনির্দিষ্ট ফলের জন্য কাজ করা ও তা অর্জন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে খাওয়া দাওয়া উৎসব করা, উপভোগ করা এবং নিজেদের মধ্যে বিয়ে-শাদী করা। যদি এই কাজগুলো সম্পাদিত হয় অকপটে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যতাড়িত না হয়ে, তাহলে এ বিশ্বাস নিশ্চয়ই করা যায় যে, এগুলো সৃষ্টি করবে উম্মাহর বন্ধন। অন্য কোন পন্থায়ই এ বন্ধন সৃষ্টি করবেনা। অনুমেয় যে স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় পর্যায়ে ইসলামী সমাজের বৈঠক ও জলসাগুলোর পদক্ষেপ এই লক্ষ্যেই; বিশ্বব্যাপী ইসলামী সংঘ, সমিতি ও কেন্দ্রগুলোর জুমার জামাতগুলোও তা-ই। অবশ্য এখন পর্যন্ত এসবই খন্ডিত, অনিয়মিত, বিরল, অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত এবং অসম্পূর্ণ। আমরা এখন পর্যন্ত যা করতে পেরেছি তার চাইতে অনেক বেশী করা আমাদের জন্য আবশ্যক অর্থাৎ উম্মাহর জলসা ও জামাতগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান।

এই উদ্দেশ্যে এই পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে যে, যে কোনো মুসলিম যে নিজেকে নেতৃত্বের জন্য সম্ভাবনাপূর্ণ মনে করে, যে ইসলামের প্রতি এমন একটি অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে গণ্য করে, যা তার ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক স্বার্থকে অতিক্রম করে যায়, সে একজন আমিল হবে। (একজন প্রতিষ্ঠাতা, একজন সংগঠক urwah wuhqa এর নেতা [১০ জন বয়স্ক মুসলমানের একটি জামাত, যাতে তার পরিবারের লোকজনও থাকবে।] একটি urwah wuhqa এর একটি উদ্দেশ্য এবং একটি শর্তই হচ্ছে ইসলাম। আমেল ১০ জন সদস্যকে চিহ্নিত ও আহ্বান করে, সে এই ১০ জনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য একে অন্যের মধ্যে যোগাযোগের এবং নিজেদের ও উম্মাহর বৃহত্তর সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমিল তার নিজের উরুয়াতে শুক্রবারের মাগরিবের জামাতের ব্যবস্থা করে যেখানে তিন থেকে চার ঘন্টা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রশিক্ষণ চলে। অপরিহার্যভাবেই এই সান্ধ্যজামাতের অন্তর্ভুক্ত থাকে এশার সালাতের জামাত, কুরআনের কিছু অংশের পঠন, ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বিষয় আলোচিত হয় এবং শেষ পর্যায়ে কিছু খাবার ব্যবস্থা করা হয় ও সামাজিক আদান প্রদান হয়। এই চারটি আইটেমই সম্পূর্ণ আবশ্যক। কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে তার মধ্যে যেন কোন কাঠিন্য এবং একঘেঁয়েমী না থাকে। কুরআন তেলাওয়াত, ইসলামী জ্ঞানের অনুশীলন, খাদ্য এবং সামাজিক আদান-প্রদান এই শেষোক্ত তিনটি আইটেম আনুষ্ঠানিক সালাত বাদ দিলে, হতে পারে অসংখ্য রকমে বৈচিত্র্যপূর্ণ। যত শীঘ্র সুবিধাজনক এবং সম্ভব সান্ধ্যজামাত অনুষ্ঠিত হবে অপর একজন সদস্যের গৃহে। এভাবে প্রত্যেক সদস্যের বাড়ীতে সান্ধ্যজামাত অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সবচেয়ে ভাল হয় যখন একটি নির্দিষ্ট উরুয়ার প্রত্যেক সদস্যের বাড়ীতে পর্যায়ক্রমে সান্ধ্যজামাত অনুষ্ঠিত হয়।

উরুয়ার সদস্য নির্বাচন করতে গিয়ে আমিলকে অবশ্যই তার নিজের বাড়ী থেকে সদস্যের বাড়ীর দূরত্ব বিবেচনা করতে হবে। ইসলামে ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক মিল জাতীয় ও গোত্রগত পটভূমিকা এবং সংস্কৃতির স্তর বৈষম্যের কোন ভিত্তি হতে পারেনা। ইসলামী সমাজের একটি শক্তি ছিল এবং সবসময় শক্তি হবে এই বৈশিষ্ট্য যে, এ সমাজ একটি উন্মুক্ত সমাজ, বহুগোষ্ঠীর সমাজ, সংস্কৃতিগতভাবে বৈচিত্রমুখী, রং-কানা, এবং প্রজন্মগত বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত। সান্ধ্য জামাতে বয়স্ক সদস্যদের মতই শিশুগণ এবং পিতামহ ও পিতামহীরা হবে আবশ্যিক অংশ। যেখানে অনীহা, আলস্য, অবাধ্যতা, মতবিরোধ বা বিরুদ্ধতা দেখা দেয়, তা সান্ধ্যজামাত সম্পর্কেই হউক বা নগরী, রাষ্ট্র অথবা জাতীয় পর্যায়ে মুসলিম কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে হউক, সেখানে আমিলের আপন ন্যায়বোধ, তার উৎসাহ, সান্তনা, উদ্যোগ, নেতৃত্ব ব্যক্তিগত দায়িত্বের উপরই একমাত্র নির্ভর করে।

উরুয়া-ভ্রাতৃসমাজগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি প্রাপ্তির সঙ্গে প্রয়োজন হবে সেগুলোকে সংগঠিত করা, তাদের প্রয়োজনগুলোর পরিকল্পনা তৈরী করা এবং সেই সব প্রয়োজন পূরণ করা। একের অভিজ্ঞতায় শরীক হবে অন্যেরা এবং মেধা, তথ্য, প্রভাব, আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং নেতৃত্বের সাধারণ মুসলিম ভাণ্ডারে কমবেশী সময়ের ব্যবধানে অবশ্যই গঠন করবে সমগ্রভাবে ইসলামী আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। এখানে পৌছেই আন্দোলন গ্রহণ করতে পারে নেতৃত্বের বিশাল বোঝা, আমিলদের জন্য বিভিন্ন সময়ে সেমিনার সংগঠন করতে হবে যাতে করে তারা একে অন্যের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতায় শরীক হতে এবং অধিকতর সফলভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য তারা প্রশিক্ষিত হতে পারে। একটি ভৌগোলিক ইউনিটের অন্তর্গত ইসলামী নেতৃত্ব উরুয়ার জন্য দিতে পারে একটি “সপ্তাহের জন্য মুদ্রিত পাঠ”, যাতে কুরআনের অংশ থাকবে নির্দিষ্ট-যাতে করে নির্বাচিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে ইসলামের একটি পদ্ধতিবদ্ধ রূপ প্রতিফলিত হবে এবং তৎসঙ্গে সর্বত্র মুসলমানদের জীবন যে সব ঘটনায় আক্রান্ত তার মোবাবেলার ইঙ্গিত থাকবে।

উরুয়ার সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে এবং আন্দোলন যতই বিস্তৃত হতে থাকে ততই নতুনতর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন হবে। দশটি ‘উরুয়া’ মিলে হবে একটি ‘উমরা’, দশটি উমরা নিয়ে গঠিত হবে একটি ‘জারিয়া’ এবং দশটি জাবিয়া নিয়ে একটি ‘জামাত’। সংগঠনের এই প্রত্যেকটি পর্যায়ে একটি প্রশাসনিক অঙ্গসংগঠন প্রতিষ্ঠিত হবে সংশ্লিষ্ট উরুয়াগুলোর আঞ্চলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণের জন্য। যা সংগঠন করতে হবে তা অস্তিত্বে আসার পরই সংগঠন এবং কাঠামো নির্মাণ করতে হবে। আমাদের অলসভাবে ব্লাকবোর্ডের উপর কাঠামো তৈরি করলে চলবেনা বরং লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে করে কাঠামোগুলো গড়ে উঠে ক্রমবর্ধমান বাস্তবতা থেকে। সর্বত্রই আমাদেরকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে হবে যে, কি করে এ বাস্ত বতাগুলো সৃষ্টি করা যায়। পুনরাবৃত্তিস্বরূপ উত্তর এই যে, প্রত্যেক মুসলমানকে তার সহযাত্রী মুসলমানদের সঙ্গে নির্দোষ কাজগুলো করতে হবে- সকলের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইবাদতের ক্রিয়াকলাপে, নিরবচ্ছিন্নভাবে ইসলামী শিক্ষার অনুশীলনে এবং কল্যাণের বিস্তারে ও মন্দের প্রতিরোধে (আল আমর বিল মারুফ ওয়া আল নাহি আন আল মুনকার)।

 

 

টীকা:

১. আমরা আমাদের রসূলগণকে পাঠিয়েছি, প্রয়োজনীয় প্রমাণসহ। আমরা তাদের প্রতি নাযিল করেছি কিতাব এবং দিয়েছি মিজান (ন্যায় বিচারের তৌলদন্ড) যাতে করে মানুষ পৃথিবীতে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আমরা তাদেরকে দিয়েছি লৌহ যা বিশাল বিশ ক্ষমতার একটি হাতিয়ার, যাতে করে তার দ্বারা মানুষের প্রতি তার ফায়দা কার্যকর হতে পারে এবং যারা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সহায়তা করতে ইচ্ছুক এবং তারা রসূলগণকে তা করতে পারে। আল্লাহ সর্ব শক্তিমান এবং উচ্চতম মর্যাদার অধিকারী (৫৭: ২৫)। হে মোহাম্মদ, আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি কিতাব, সত্য সহকারে যাতে তুমি তার প্রত্যাদিষ্ট-ন্যায়দন্ড অনুসারে মানুষের প্রতি ন্যায় বিচার করতে পার (৪৫: ১০) … এবং তাদের মধ্যে বিচার কর, যে মোহাম্মদ, তোমার প্রতি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার সাহায্যে এবং তাদের কুসংস্কার অনুসরণ করনা (৫: ৪৯)।

২. Barth, Against the Stream pp. 29-31.

৩. Ismail ibn Kathir Tafsir al Quran al Azim (Beirut: Dar al Ma ‘rifah, 1388/1969) s.v Quran 5: 79, vol. 2, pp 83-84

৪. William James. The Variety of Religious Experience (New York: Mentor Books, New American Library, 1953) pp. 269 ff pp 276 ff.

৫. অথবা বরং ‘ধর্ম হচ্ছে অন্যকে ভাল কাজ করার পরামর্শ দান।” N. Atiyah in A Source Book in Medeval

৬. Ibn Tufayl, Havy ibn Yaqzan tr. Goorge Political Philosophy, ed Ralph Lerner and Muhsin Mahdi (Glenceo II: The Free Press 1936).

৭. Al aqrabun awla bt al ma’ruf, এটি হচ্ছে আইন প্রণয়নের একটি সাধারণ নীতি।

৮. Henry Bettenson -এর ডকুমেন্টস গ্রন্থটি চার্চের আইডিয়েশনাল ইতিহাসের খুটিনাটির জন্য পড়তে পারেন।

৯. Abd al Rahman al jaziri: Al Fiqh ala al Mahab al Arba’ ah (Cairo: Al Matalaah al Tijariah al Kubra, n.v) Beginning of Remadan And Shawwal vol. 1 pp 584-85.

১০. ইহাই একমাত্র পথ বলে মনে হয়, যাতে করে গতিশীল এবং সৃজনধর্মীয় ইসতিহাদের সমন্বয় সাধিত হতে পারে একই রকম বাঞ্চনীয় একমত ও ঐক্যমতের লক্ষ্যের সঙ্গে। এ দুটি মূল্যমানই ইসলামের বিশ্বদৃষ্টির এবং এর আদর্শ পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।

১১. এখানে শরীয়াহ-এর অখ ভূমিকা এবং সোলোনের আইনের মধ্যে একটি সমান্তরাল রেখা টানা যেতে পারে। সোলোনের এই আইন ঈজিয়ান সাগরের চারদিকে বসবাসকারী ছড়ানো ছিটানো গ্রীকদেরকে একই সাংস্কৃতিক ঐক্যের মধ্যে আনয়ন করেছিল।

১২. ইসলামী আইনের দুটি চূড়ান্ত উৎস হচ্ছে কুরআন এবং সুন্নাহ। বিশাল সুপরিসর শরীয়াহ এর বিধি ব্যবস্থার অবয়বের মধ্যে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক নৈতিকতার সকল অঞ্চলই পড়ে। স্পষ্টতই দুটি মূল উৎসের কোনটির সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে ইসলামের কোন বিধি ব্যবস্থাই বৈধ বলে গণ্য হবেনা

১৩. William Mac Neil. The Rise of the West (Chicago University Press. 1964) s.v “The Shariah”

১৪. Self-renewal যন্ত্রটি খুঁটিনাটির জন্য পড়া যেতে পারে উসুল আল ফিকাহর উপর যে কোন পাঠ্য পুস্তকে, আল ইসতিহাদ, আল কিয়াস, আল ইসতিহসান, আল মাসালিহ, আল মুরসালাহ লাহ, শিরোনামের অধীনে তোমরা কৃপণ হয়োনা, বদ্ধমুষ্টি হয়োনা এবং অমিতব্যয়ী হয়োনা, যেন তোমরা তোমাদের সমস্ত সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে তোমরা নিজেরাই না সর্বহারা হয়ে পড় (১৭: ২৯)।

১৫. কৃপণতা ও অতি বদান্যতা বা আতিশৈয্যের মধ্যবর্তী সোনালী পন্থার উপর ইসলামের উচ্চকণ্ঠ গুরুত্বের ঘোষণা মেলে আল কুরআনে (১৭: ২৯)।

১৬. See the Phenomental nalysis of Contradictory Values in Nicolary Hartaman. Ethics Abyev Stanton Coin (New York Macxmillan 1932) vol. 2. section 2

১৭. উপরে উল্লেখিত শব্দগুলো যে সব আয়াতের অন্তর্গত তার জন্য পড়ুন মোহাম্মদ বারাকাত রচিত Al Murshid ila Ayat al Quran al Karim (Cairo Al Malataba al Hashimyah 1957)

 

অনুবাদঃ অধ্যাপক শাহেদ আলী

৪১৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।
Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top