আয়াসোফিয়া, মানব সভ্যতার ইতিহাস, ধর্ম ও সভ্যতা সমূহের ইতিহাস এবং একই সাথে ইসলাম ও তুরস্কের ইতিহাসের দিক থেকে ঐতিহাসিক এক মর্যাদার দাবিদার। এই কারণে দীর্ঘ ৮৬ বছর বিরতির পর এই ঐতিহাসিক স্থানটির পুনরায় তার আসল প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়ায়, পুনরায় মু’মিনদের সিজদায় স্থলে পরিণত হওয়ায়, প্রত্যাশিত ভাবেই প্রাচ্য ও প্রতীচ্য সহ সমগ্র দুনিয়ায় অনেক বড় একটি প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করেছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিস্থান সমূহ আলাদা আলাদাভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। রাজনৈতিক বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া ভিন্ন একটি বিষয় হওয়ায় আমি সেই বিষয়ের উপর কোন আলোচনা করতে চাই না।

তবে বিশেষ ভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের পাশাপাশি অর্থোডক্স এবং ক্যাথোলিকরা তাদের নিজস্ব  দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থোডক্স বিশ্বের নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কেউ যখন এটাকে মধ্যযুগে  ফিরে যাওয়া বলে অভিহিত করছেন তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ এটাকে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মধ্যকার নতুন সংঘাত বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ আবার এটাকে ধর্মীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন। ক্যাথলিকদের আধ্যাত্মিক নেতা, পোপ ফ্রান্সিস ১২ জুলাই এক বিবৃতিতে বলেন, “ আমার বিবেক আমাকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে, আয়াসোফিয়ার কথা চিন্তা করছি এবং অনেক ব্যথা অনুভব করছি”। এই সকল প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি কম হলেও কিছু পজিটিভ বক্তব্যও এসেছে।

এই সকল প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে আমাদের মনের অজান্তেই কিছু প্রশ্ন জেগে উঠে।

  • আয়া সোফিয়া মধ্য যুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে নবযুগের সঞ্চারের জন্য ওসিলা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই আয়াসোফিয়া দীর্ঘ ৫০০ শত বছর ইসলামের ইবাদতগাহ হিসেবে মূলত তার মূলে ফিরে গিয়েছিল, তাহলে কেন এমন একটি বিষয়কে মধ্য যুগে ফিরে যাওয়া বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
  • এর ভেতরে এক আল্লাহর ইবাদত করাকে কেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে নতুন একটি সংঘাতের সূচনা বিন্দু হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে?
  • মিউজিয়াম থেকে পুনরায় ইবাদতগাহে রূপান্তর করা কোন অর্থে ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করছে?
  • এই অসাধারণ আয়া সোফিয়াকে পায়ে মাড়ানো ট্যুরিজমের স্থান থেকে মুক্ত করে মু’মিনদের পবিত্র কপাল রাখার একটি জায়গায় রূপান্তর করাটা কেন পোপ ফ্রান্সিসকে ব্যথিত করেছে?

পাঁচশত বছর ধরে যে স্থানটি মসজিদ হিসেবে ছিল সেই মসজিদকে  কেন জাদুঘরে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেটাকে সবাই পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য আজকের সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পাশ্চাত্য থেকে আজ যে প্রতিক্রিয়া আসছে সেগুলোর শক্তিশালী কোন ভিত্তি নেই। তবে যারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তাদের দৃষ্টিকোণকে বিবেচনায় নিলে এই বিষয়কে একটি মাত্রা পর্যন্ত বুঝা সম্ভব। 

তবে, আমাদের যেই বিষয়টি বুঝতে সবচেয়ে বেশী কষ্ট হচ্ছে সেটি হল পাশ্চাত্যের চেয়েও বেশী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে মুসলিম বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি! যাদের প্রতিক্রিয়ার ভাষা পাশ্চাত্যের চেয়েও বেশী ধারালো!! যে অবস্থায় কিংবা যে দৃষ্টিকোণ থেকেই হোক না কেন এটি আমাদের মাথায় ধরছে না, মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি কেন এমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন?? এটা বুঝা সম্ভব নয়। আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, এই সকল প্রতিক্রিয়া এবং বিবৃতি দিয়েছে কোন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি নয়, আলেমগণ এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহ! আরো একটি দুঃখজনক বিষয় হল, রাজনীতিবিদগণের নিজস্ব রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক অনুযোগ ও অভিযোগ সমূহ কোন কোন আলেমদেরকে দিয়ে বলানো। বিশেষ করে ঐতিহাসিকভাবে জ্ঞানের পতাকাবাহী হিসেবে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি লাভকারী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আলেমগণের বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া ও বক্তব্য সমূহ; মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান, শক্তি এবং ক্ষমতার মধ্যকার সম্পর্কের  ক্ষেত্রে জ্ঞানের মর্যাদা ও সম্মান এর অবস্থান কোথায় এসে উপনীত হয়েছে সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এটা খুবই হতাশাজনক। আজহারের কোন কোন শিক্ষক তো বলেই ফেলেছেন আয়া সোফিয়াকে আত্মসাৎ করা হয়েছে। আত্মসাত কৃত ইবাদতগাহে নামাজ আদায় করা জায়েজ নয়। ইতিহাস, দ্বীন, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে ন্যূনতমও জ্ঞান এদের নেই। যদি থাকত তাহলে তারা এ ধরণের মূর্খতাসুলভ কথা বলতেন না। তাদের এই ধরণের কথা বার্তা তাদের অবস্থানকে আমাদের সামনে পরিষ্কার করেছে।

এই সকল কারণে এই বিতর্ক নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য থেকে আসা কিছু কিছু প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য আমাদের আজকের এই আলোচনায় ইসলামী সভ্যতায় ইবাদত গাহের বিধান এবং এ বিধানের মূলনীতি এবং আইন কানুন সম্পর্কে আলোচনা করব।

সম্মানিত ভাই ও বোনেরা,

ইবাদত গাহের বিধান, ইসলামের জন্য নির্দিষ্ট। আমাদের দ্বীনের সবচেয়ে গৌরবজনক বিষয় সমূহের মধ্যে একটি। এই বিধানের (আইনের) সবচেয়ে মৌলিক মূলনীতি হল, ইবাদতগাহ সমূহের অস্পৃশ্যতা। যা আমাদের সভ্যতায় মাসুনিয়াতু মা’বাদ তথা ইবাদত গাহের অস্পৃশ্যতা (untouchable ) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে শাসকদের কারণে এর ব্যাত্যয় ঘটলেও ইসলামী সভ্যতায় অন্যান্য অনেক সভ্যতার বিপরীতে আবশ্যকীয়তা সমূহের বাহিরে [যা ব্যতিক্রম] অন্য ধর্মের ইবাদতগাহ সমূহে কখনোই স্পর্শও করা হয়নি। যুদ্ধ পরিস্থিতি কিংবা শান্তি যে অবস্থায়ই হোক না কেন মুসলমানগণ তাদের চুক্তির দাবি অনুযায়ী, একটি আইনের অধীনে ইবাদত গাহের অস্পৃশ্যতা (untouchable ) কে সব সময় নিরাপত্তার অধীনে নিয়ে এসেছে। সেইগুলোকে ধারাহিকতা দান করেছে এবং যে যেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী তার সেই বিশ্বাসের আলোকে সে যেন স্বাধীন ভাবে ইবাদত করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা দিয়েছে।

তবে মাঝে মধ্যে জনগণের ইসলাম গ্রহণ করার ফলে অথবা দল বেঁধে অন্য তাদের অন্য স্থানে চলে যাওয়ার ফলে কিংবা মাঝে মধ্যে ব্যতিক্রম কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া স্থান সমূহকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। কিন্তু চৌদ্দশত বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও মুসলিম দেশগুলোর বড় বড় শহরগুলোতে হাজার হাজার সিনাগগ, গির্জা, প্যাগোডা ও মন্দির রয়েছে। এগুলোকে ইসলামী সভ্যতার ‘ইবাদত গাহের অস্পৃশ্যতা (untouchability)’ র জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে। আমরা যদি আন্দালুসিয়াকে বিশ্লেষণ করি তাহলে ইসলামী সভ্যতার এই মূলনীতির হাকীকতকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারব। যেই আন্দালুসিয়াতে মুসলমানগণ দীর্ঘ ৮ শত বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল, আজ সেখানে কি অবস্থা? আমরা যে সেখানে কত কিছু হারিয়েছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। এ কারণে ইসলামের বিজয়াভিযান সমূহকে ক্রুসেডারদের দখল এবং মোঙ্গলদের আক্রমণের সাথে তুলনা করা অনেক বড় একটি ভুল।

মহাগ্রন্থ আল কোরআন যেমন কোন ইবাদতগাহের বিনাশ বা ধ্বংসকে ইলাহি ইচ্ছার বিরোধী বলে সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছে। একটি আয়াতে অন্য ধর্মের ইবাদতগাহের নাম সমূহকেও উল্লেখ করে এই হাকীকতকে এইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,

وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا

অর্থঃযদি আল্লাহ লোকদেরকে একের মাধ্যমে অন্যকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে যেখানে আল্লাহর নাম বেশী করে উচ্চারণ করা হয় সেসব আশ্রম, গীর্জা, ইবাদাতখানা ও মসজিদ ধ্বংস করে দেয়া হতো৷” (সূরা হজ্জ-৪০)

রাসুলে আকরাম (সঃ) ও কোরআনের আলোকে ইবাদতগাহের হুকুম সমূহকে নিজে বাস্তবায়িত করেছেন এবং সাহাবীদেরকে দিয়ে বাস্তবায়িত করিয়েছেন। নাজরানের খৃষ্টানদের সাথে রাসূলে আকরাম (সঃ) যে চুক্তি করেছিলেন, সেই চুক্তিটি হল ইবাদতগাহের যে হুকুম বা বিধান রয়েছে সেই হুকুমের প্রথম বাস্তবায়ন। রাসূল (সঃ) সেই চুক্তিতে নাজরানবাসীকে তাদের গির্জা ও আশ্রম সমূহের এবং পাদ্রীদের কেন্দ্রস্থল সমূহকে রক্ষা করার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তাদের ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদেরকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। খায়বারকে যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় করার পরেও ইয়াহুদিদের ইবাদতের স্থান সমূহকে স্পর্শও করেননি। যে সকল সৈন্যকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, অন্য ধর্মের ইবাদতগাহ সমূহকে ধ্বংস করবে না, সেই সকল ইবাদতগাহে ইবাদতরত রূহবানদেরকে স্পর্শও করবে না।

রাসূল (সঃ) এর পরে ইবাদতগাহের বিধানের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ দেখিয়েছেন হযরত উমর (রাঃ)। ইসলামের অনেক অনেক বড় বড় বিজয়াভিযান তার সময়ে পরিচালিত হয়েছিল।

হযরত উমর (রাঃ) বাইতুল মাকদিসকে শান্তির মাধ্যমে বিজয় করার কারণে Church of the Holy Sepulchre কে মসজিদে রুপান্তর করা তো দূরে থাকুক “ আমি যদি এখানে নামাজ আদায় করি তাহলে আমার পরের মুসলমানগণ এটাকে মসজিদে রূপান্তর করবে” এই কথা বলে এই চার্চের ভেতরে তিনি নামাজ পর্যন্ত আদায় করেননি। একই উমর (রাঃ) যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়কৃত শাম, ইরাক, ইরানের মত অন্যান্য অঞ্চলের শহরের সবচেয়ে বড় সিম্বলিক ইবাদতগাহ সমূহকে মসজিদে রূপান্তর করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি। ইবাদতগাহ সমূহের অস্পৃশ্যতাকে খুব সতর্কতার সাথে বাস্তবায়ন করেছেন; শামের পূর্ব ফ্রন্টকে যুদ্ধের মাধ্যমে এবং পশ্চিম ফ্রন্টকে শান্তির মাধ্যমে বিজয় করেছেন বলে হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) এর নামে নির্মিত আযিয ইউহান্না গির্জার পূর্ব পাশের অর্ধেককে মসজিদ এবং পশ্চিম পাশের অর্ধেককে গির্জা হিসেবে যৌথভাবে ব্যবহার করার জন্য খুলে দেন।

হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) খলিফা হলে ইউহান্না গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করতে চান, কিন্তু খৃষ্টানদের বিরোধিতার কারণে তিনি এই সিধান্ত থেকে ফিরে আসেন। আব্দুল মালিক বিন মারওয়ান এই জন্য খৃষ্টানদেরকে অনেক অর্থ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু তাদের ১৪ টি গির্জা থাকার পরেও তাদের এই প্রস্তাবকে গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে খলিফা ওয়ালিদ জোরপূর্বক তাদের এই গির্জাকে ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেন। হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযিয খলিফা হলে খৃষ্টানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ইসলামী সভ্যতার ইবাদতগাহের হুকুমকে বাস্তবায়ন করেন এবং মসজিদে রূপান্তরকৃত ও অন্তর্ভুক্তকৃত চার্চ (গির্জা) সমূহকে পুনঃরায় খ্রিস্টানদেরকে ফিরিয়ে দেন।  

ইসলামী চিন্তায় বিভিন্ন ধারা ও বিভিন্ন বিশ্লেষণ থাকলেও ইসলামের ফিকহের মক্তব সমূহ, কোরআন ও সুন্নত কর্তৃক নির্ধারিত বিধান অনুসারে ‘ইবাদতগাহের অস্পৃশ্যতা (untouchability)’ র ব্যপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। সেগুলোকে রক্ষা করা এবং নতুন করে নির্মাণের ব্যপারে চিন্তাগত দিক থেকে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।

আব্বাসী খলিফা হারুনুর রশিদ, তার প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফকে যিম্মিদের গির্জা ও আশ্রম সমূহের হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে ইমাম আবু ইউসুফ, খুলাফায়ে রাশিদীনের সময়কাল থেকে উদাহরণ দিয়ে  ‘ইবাদত গাহের অস্পৃশ্যতা (untouchability)’ র বিষয়টি খলিফাকে জানিয়ে দেন।

ইসলামী সভ্যতায় ইবাদতগাহের বিধান হল যদি শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে কোন অঞ্চল বিজিত হয় তাহলে সেখানের ‘ইবাদত গাহের অস্পৃশ্যতা (untouchable)’র কোন ধরণের ব্যতিক্রম নেই। এই জন্য মুসলমানগণ শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে যে সকল অঞ্চল বিজয় করেছে সেই সকল অঞ্চলের কোন ইবাদতগাহকে স্পর্শও করেনি। যুদ্ধের মাধ্যমে যে সকল অঞ্চলে বিজয় করেছে সেই সকল অঞ্চলের ইবাদতের স্থান সমূহও অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য করার পাশাপাশি এই সকল বিষয়ে কিছু কিছু ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়েছে। এর আলোকে যুদ্ধের মাধ্যমে বিজিত শহরের সিম্বলিক অর্থবহনকারী সবচেয়ে বড় ইবাদতগাহ সমূহকে ধর্মীয় ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে অথবা সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে মসজিদে রূপান্তর করণ, একটি আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। শামের উমাইয়া মসজিদ, কর্ডোভা মসজিদ, এবং আয়াসোফিয়া মসজিদ এর অন্যতম উদাহরণ। মুসলমানগণ যে সকল অঞ্চলকে যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় করেছেন সেই সকল অঞ্চলে এই বিধানকে মানার ক্ষেত্রে দৃঢ় সংকল্প ছিলেন। এই বিধানের ক্ষেত্রে বিন্দু পরিমাণ আপোষ করেননি। যেমন একটু আগেও বলা হয়েছে, শামকে যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় করলে সেখানের ১৪টি গির্জার মধ্যে শুধুমাত্র সিম্বলিক গুরুত্বের অধিকারী ইউহান্না গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করেছিলেন। অন্য ১৩ টি তে স্পর্শও করেননি।

এখানে যে বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে সেই বিষয়টি হল, মসজিদে রূপান্তর করার বিষয়টি, যেমনটা ধারণা করা হয়ে থাকে তলোয়ারের মাধ্যমে নয় আইনের মাধ্যমে এবং পারস্পারিক চুক্তির মাধ্যমে করা হয়েছে। মুসলমানগণ যে সকল অঞ্চলকে বিজয় করেছেন সেই সকল অঞ্চলে ইবাদতগাহ সমূহকে মসজিদে রুপান্তরের বিষয়টি মুতলাকভাবে পারস্পারিক চুক্তির মাধ্যমে করেছেন। জোর করে কিংবা তলোয়ারের ভয় দেখিয়ে নয় আইনের মাধ্যমে এই বিষয়টির নিষ্পত্তি করেছেন।

মুসলমানগণ তাদের শাসনাধীন অঞ্চলগুলোতে ইবাদতগাহ সমূহের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র অস্পৃশ্যতার নীতিই অবলম্বন করেননি। একই সাথে এই স্থান সমূহকে রক্ষণাবেক্ষণকেউ অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। খুব বেশী দরকার না হলে এই সকল স্থাপনায় হাত লাগাননি। এর আসল সৌন্দর্যকে রক্ষার ব্যপারে অনেক যত্নবান ছিলেন, এই সকল ইবাদতগাহের মেরামতের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সাহায্যও দিয়েছেন। যেমন মসজিদে রূপান্তরকৃত ইবাদতগাহ সমূহকে কিবালামুখী করার মত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের ক্ষেত্রেও যতটুকু প্রয়োজন এই সকল ইবাদতগাহের স্থাপনায় ততটুকুই পরিবর্তন আনা হয়েছিল। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ), ইসলামের ইতিহাসের প্রথম দিকে মাদায়েনকে বিজয় করে কিসরার রাজ প্রসাদকে মসজিদে রূপান্তর করেন। কিন্তু এর ভেতরে প্লাসটারের তৈরি ফিগার সমূহে স্পর্শও করেননি। এমনকি এগুলো দুইশত বছর পর্যন্ত সেই ভাবেই মজবুত অবস্থায় টিকে ছিল। ইরানের এসতাখর শহরে অবস্থিত অগ্নিপূজার একটি স্থানকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়, কিন্তু পিলারে অঙ্কিত ছবি সমূহে হাতও লাগাননি। যেমনটি আয়াসোফিয়ার কিবলার দিকে অঙ্কিত দুই একটি ছবি ছাড়া আজ পর্যন্ত কোন একটি ছবিতেও হাত দেওয়া হয়নি। মুসলমানগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফুসতাত, বসরা, বাগদাদের মত শহর সমূহেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রজাদের জন্য ইবাদতগাহ নির্মাণ করেন।

উরফায় অবস্থিত গির্জা খৃষ্টান প্রজাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে উমাইয়াগণ নির্মাণ করে দেন। আব্বাসী খলিফাদের মধ্যে হারুনুর রশীদ এবং আমীনের সময়ে অনেক গির্জা নির্মাণে রাষ্ট্রীয় ভাবে সাহায্য দেওয়া হয় এবং অনেক গির্জাকে মেরামত করা হয়।

অনেক প্রাচীন সময়ে নির্মাণ হওয়ার পরেও আয়াসোফিয়া এখনো প্রথম দ্বীনের মত দণ্ডায়মান। হযরত পয়গাম্বর (সঃ) এর সময়কাল থেকে নিয়ে ইস্তানবুলের বিজয় পর্যন্ত ইসলামী সভ্যতার, ইসলামী ফিকহ কর্তৃক ইবাদতগাহের বিধান সম্পর্কিত উদ্ভাবিত মূলনীতির সবচেয়ে অনুপম বাস্তবায়ন হয়েছে আয়াসোফিয়ায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে এরকম আর কোন উপমা কোন ইবাদতগাহের ক্ষেত্রে নেই। একটি সভ্যতার অপর একটি সভ্যতা থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত একটি ইবাদাতগাহকে কিভাবে রক্ষা করতে এর অনুপম উপমা হল এই আয়া সোফিয়া।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, এই প্রাচীন ইবাদতগাহের নির্মাতাগণ সকল কিছুকে শুন্য থেকে সৃষ্টিকারী এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য নির্মাণ করেছিলেন। সকল ঐতিহাসিকগণ এই বিষয়ে একমত। মূলত এই মহান উদ্দেশ্য, মহান সেনানায়ক রাসূল (সঃ) যে সুসংবাদে ধন্য সেনাপতি সুলতান মুহাম্মাদ আল ফাতিহ ১৪৫৩ সালে ইস্তানবুল বিজয়ের মধ্য দিয়ে কোন প্রকার বিরতি না দিয়ে বিগত  শতাব্দীর প্রারম্ভকাল পর্যন্ত জারী ছিল।

সুলতান ,মুহাম্মাদ আল ফাতিহ, ইস্তানবুল বিজয় করার অব্যবহিত পরেই তার প্রচারিত আমান নামার  (নিরাপত্তানামা) মাধ্যমে ইস্তানবুলে বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরকে তাদের বিশ্বাসে, ইবাদতে এবং জীবনযাপনের ক্ষেত্রে স্বাধীন ঘোষণা করেন। “ আমরা আমাদেরকে যেভাবে রক্ষা করি তোমাদেরও সেইভাবেই রক্ষা করব” এই ঘোষনা দিয়ে তাদের ইবাদতগাহ সহ তাদের জান মালের নিরাপত্তা দেন। কিন্তু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া, উপরে উল্লেখিত মহান উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে আয়াসোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করে সেটাকে কিয়ামত পর্যন্ত ইসলামের একটি ইবাদতগাহ হিসেবে উম্মাহর কাছে আমানত দেন। এটি মসজিদ হিসেবেই টিকে থাকতে হবে এই শর্তে তিনি আয়াসোফিয়াকে ওয়াকফ করে দেন। ওয়াকফের আইন বিশ্বজনীন। নতুন, পুরাতন, উসমানী, রিপাবলিক বলে কিছু নেই। ওয়াকফ  ওয়াকফই। এই আইন পরিবর্তন করার অধিকার কারো নেই।

বিজয়ের পূর্বের সময়ে মাঝে মধ্যে এই স্থাপনাটি আভ্যন্তরীণভাবেই কয়েকবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। কিন্তু আমাদের জাতি এই অনুপম ইবাদতগাহটিকে অত্যন্ত যত্নের সাথে সংরক্ষণ করেছে। নাম পর্যন্ত পরিবর্তন করার প্রয়োজনবোধ করেননি! মিমার সিনান এই স্থাপনায়  তাওহীদের প্রতীক মিনার সংযোজন করেন এবং শত শত বছর ধরে মু’মিনদের দ্বারা মহান প্রভু আল্লাহকে দেওয়া সিজদা সমূহ এই স্থাপনার প্রথম প্রতিষ্ঠাতাদের মহান উদ্দেশ্যকে সঞ্জীবন করে রেখেছিল এবং এই স্থাপনার ইবাদতগাহের মর্যাদাকে ধরে রেখেছিল।

এই অসাধারণ স্থাপনাটিকে সব সময়ে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। কিবলার দিককার দুইটি ফিগার ছাড়া ভেতরের অন্যান্য ফ্রেস্ক, মোজাইক এবং স্থিরচিত্র সমূহতে আধুনিক সময়ের আগপর্যন্ত হাত দেওয়া হয়নি। কাদিযাদেলি আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত এই সকল বিষয় নিয়ে কোন প্রকার আলোচনা পর্যন্ত কেউ তুলেনি। আওলিয়া চেলেবি কর্তৃক কয়েক শতাব্দী পরে লেখা সেয়াহাত নামায় আয়াসোফিয়ার প্রতিটি ছবিকে নিজে দেখে সেগুলোর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। মেরামত করার সময় শিল্প এবং ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট সমূহের প্রতি খেয়াল রেখে তদনুযায়ী উপকরণ ব্যবহার করেন। আর এই সকল মেরামত কাজ তদারকি করেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সেরা স্থপতিগণ।

আয়াসোফিয়া শুধুমাত্র একটি মসজিদই ছিল না, এটাকে কেন্দ্র করে এর আশে পাশে ফিকহ, ইলমূল কালাম, গণিত ও এস্ট্রনমি নিয়ে অনেক বড় বড় জ্ঞানের কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। জ্ঞান ও হিকমাহর কেন্দ্রস্থল হিসেবে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ শতাব্দী পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।

প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে ১৯৩৪ সালে মেরামতের করার কারণ দেখিয়ে আয়াসোফিয়াকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে অন্য একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আয়াসোফিয়াকে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। এই সিদ্ধান্ত ছিল একই সাথে ইবাদতগাহের বিধান এবং ওয়াকফ আইনের বিরোধী একটি সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তটি উম্মাহকে দারুণ ভাবে ব্যথিত করেছিল।

সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে যখন আয়া সোফিয়াকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন থেকে পাশ্চাত্যসহ আরও অনেক জায়গায় লেখালেখি ও আলাপ আলোচনা শুরু হয় যে যে গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করা হচ্ছে। তাদের এই দাবী মোটেও সঠিক নয়। আয়াসোফিয়া দীর্ঘ পাঁচশত বছর ধরে মসজিদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল, তাই এটাকে পুনরায় জাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। এই বিষয়টি আমাদের বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন। গির্জা থেকে মসজিদ নয় বরং যাদুঘর থেকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছে। এছাড়াও আয়াসোফিয়াকে ইসলামের একটি ইবাদতগাহ হিসেবে নতুন করে ইবাদতের জন্য খুলে দেওয়াটাকে বিশ্বব্যাপী সংকট সৃষ্টি করবে এবং মুসলমানদের এই ন্যায্য দাবিটি সম্ভাব্য আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃসভ্যতার সংঘাতের সংকেত হিসেবে দেখা ভূল। যে সভ্যতা তার উন্মেষকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত সবসময় সকল ধর্ম ও বর্ণের লোকদেরকে  তাদের ধর্ম কর্ম পালনে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছে তারা এই বিষয়টিকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে।

দীর্ঘ ৮৬ বছর ধরে যে স্থানটি থেকে মুসলমানদেরকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল সেটিকে পুনঃরায় ইবাদতের জন্য খুলে দেওয়ায় সমগ্র উম্মাহ যে পরিমাণে খুশি হয়েছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের সকলের জন্য আনন্দের। আমাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ধারা সমূহ আয়াসোফিয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে এবং এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।

আমাদের অন্যান্য ইবাদতগাহের মত আয়াসোফিয়াও শুধুমাত্র প্রশান্ত আত্মার মু’মিনদের জন্য নয়, সকল ধর্মের সকল মানুষের জন্য সব সময় খোলা থাকবে। আয়াসোফিয়ায় যারা যিয়ারতের জন্য এসে থাকেন তাদেরকে মেহমানদারীর জন্য আমাদের সভ্যতার সন্তানরা সব সময় প্রস্তুত এবং এটা সব সময় তারা তাদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণও দিয়েছেন।

এই সকল কারণে আয়াসোফিয়াকে পুনঃরায় ইবাদতের জন্য খুলে দেওয়া নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটি পদক্ষেপ। আমাদের জাতি এবং সমগ্র উম্মাহর আবেগ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য এই সিদ্ধান্তটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

আমি আমার কথা শেষ করার পূর্বে বলতে চাই যে,

মু’মিনদের উপর আয়াসোফিয়ার হক্ব নতুন করে শুরু হচ্ছে। আয়াসোফিয়ার সবচেয়ে বড় হক্ব একে পুনরায় মসজিদ হিসেবে শুরু করার মাধ্যমে শুরু হল। শুধুমাত্র আয়াসোফিয়াকে অফিসিয়ালি খুলে দেওয়ার মাধ্যমেই আমাদের উপর আয়া সোফিয়ার হক্ব আদায় হবে না। আমরা যদি এই সকল কাজকেই যথেষ্ট মনে করি তাহলে আমাদের হাজার হাজার মসজিদের সাথে শুধুমাত্র আয়াসোফিয়া যুক্ত হবে আর কিছু না। আমরা যদি আমাদের উপর আয়াসোফিয়ার হক্বকে আদায় করতে চাই তাহলে আমাদের উচিত হবে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই মিলে ইখলাসে সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সেখানে আদায় করা। আয়াসোফিয়াকে শুধুমাত্র একটি ইবাদতগাহ হিসেবে নয় জ্ঞান, হিকমা, ওয়াহদাত (একতা) এর স্থানে পরিণত করতে পারি তাহলে এর আসল হক্ব আদায় করা হবে। এই হক্বকে কেবলমাত্র মিহরাব থেকে ইখলাস ও আন্তরিকতা, মিম্বার থেকে জ্ঞান ও হিকমত, কুরসি থেকে আখলাক ও আদালত এর প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে, মিনার থেকে হক্ব, হাকীকত এবং রহমতের দিকে আহবান করার মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব। আমরা যদি এই সকল কাজ করতে পারি তাহলে আয়াসোফিয়া সত্যি তখন খুশি হবে। খোলে দেওয়াটাই মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হল কিয়ামত পর্যন্ত এর রূহকে জাগ্রত করে রাখা এবং একে আবাদ করা। আমরা যদি তাকে ইহইয়া ও ইমার করতে পারি তাহলে সেও আমাদেরকে অবশ্যই পুনর্জাগরণের রূহ অর্জনে সাহায্য করবে।

সমগ্র উম্মাহর জন্য মোবারক হোক।

আমাদের ইবাদতগাহ সমূহের মত আমাদের অন্তর সমূহও আবাদ হোক।

মহান আল্লাহ আয়াসোফিয়ার মত আমাদেরকেও আমাদের মূলে ফিরে যাওয়ার তওফিক দান করুন।

আমীন।

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

১১২৬ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top