জ্ঞান ও সভ্যতার পুনর্জাগরণে যুবকদের ভূমিকা

الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام علي اشرف الانبياء والمرسلين سيدنا محمد وعلي اله واصحابه اجمعين اللهم علمنا بما ينفعنا وانفعنا بما علمتنا انك انت العليم الحكيم اللهم زدنا علما و فهما والحقنا بالصالحين يا معلم ابراهيم علمنا يا مفهم سليمان فهمنا يا مصبر ايوب صبرناواخر دعونا عن الحمد لله رب العالمين

প্রথমেই সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বাংলাদেশ থেকে আয়োজিত এমন একটি প্রোগ্রাম আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য। বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে যে সকল ভাই-বোনেরা আমাদেরকে শুনছেন সবাইকে সাদর অভিবাদন জানাচ্ছি – আসসলামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ ।

আজ সমগ্র বিশ্ব মানবতা এক ভয়াবহ সংকটের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত করছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহামারী যা আজ গোটা বিশ্বকে পরিগ্রহ করেছে তার ভয়াবহতা থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যেন বাংলাদেশ ও তুরস্কসহ সমগ্র মানবতাকে হেফাজত করেন সেই দোয়ার মাধ্যমে শুরু করছি। রাসূল (স.) একটি হাদীসে ইরশাদ করেন- ‘যারা জ্ঞানার্জন করে সেইসকল শিক্ষার্থীদের জন্য ফেরেশতারা নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেয়। আমি দোয়া করছি আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন যেন আপনাদেরকেও তাঁর ফেরেশতাদের ডানা পরিবেষ্টনের মধ্য দিয়ে অসীম রহমতের চাদরে আবৃত করে নেন।

আজ গোটা বিশ্বমানবতা যার জন্য অধীর আগ্রহে প্রত্যহ গুনছে তা হচ্ছে ‘ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ’। আজকে আমি সেই পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে মুসলমান যুবকদের কি করণীয় তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

সমগ্র মানবতা সাধারণত যে ধরণের বড় বড় সংকটের মুখোমুখি হয়ে থাকে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক সংকট, মহামারী দূর্যোগ ইত্যাদি। কিন্তু মানবতার প্রেক্ষিতে সবচেয়ে ভয়ংকরতম সংকট হচ্ছে মানুষ যখন তার স্বীয় জীবনের ‘অর্থবহতা’কেই (Meaning) হারিয়ে ফেলে।

মানুষ আজ তার জীবনোদ্দেশ্য, স্ব-সৃষ্টির মাহাত্ম্য থেকে পুরোপুরি বিস্মৃত হয়ে গেছে। আর যারা এই উদ্দেশ্য ও সৃষ্টির মাহাত্ম্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে তারা মূলত ‘বুরহান’ কেই হারিয়ে বসে। ফলস্বরূপ তারা আত্ম-বিস্মৃত হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি গভীর সংকটে আবদ্ধ হয়ে যায়। যারা বুরহান তথা দলীলকে হারিয়ে ফেলে তারা বুহরান তথা সংকটের মধ্যে নিপতিত হয়। তবে এখানে বুরহান (দলীল) বলতে বোঝানো হচ্ছে আল্লাহ রব্বুল আ’লামিন কর্তৃক প্রদত্ত ওহীর কম্পাস (নির্দেশনা) এবং রাসূল (স.) এর প্রদর্শিত জীবনধারা।

আজকে আমাদেরকে দুইটি বিষয়কে সংরক্ষণ করতে হবে। যথাঃ

১. ইনসান

২. ঈমান

আজ মানুষকে একটি ‘উপাদান’ (Object) -এ রূপান্তরিত করার কারণে বিশ্বমানবতা থেকে সত্যিকার ‘ইনসানিয়্যাত’ হারিয়ে যাচ্ছে।

ইনসান (মানুষ) কোন উপাদান নয় বরং ইনসান (মানুষ) হচ্ছে ‘আয়াত’ তথা নিদর্শন। আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে উপাদান থেকে অবমুক্ত করে আয়াতের পর্যায়ে উন্নীত করা। মানুষকে যখন আজ যত্রতত্র বিক্রয়যোগ্য একটি পণ্যাকারে উপস্থাপন করা হয়েছে তার প্রত্যুত্তরে আমাদের সর্বোচ্চ দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেকটি মানুষকে এই হীন অবস্থা থেকে উদ্ধার করে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত একজন মহান ‘খলিফা’র মর্যাদায় ভূষিত করা এবং সেই অবস্থানে তাকে পৌঁছে দেওয়া।

আজকে মানুষকে শুধুমাত্র পরিসংখ্যানের একেকটি ডাটা হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে অথচ প্রত্যেকটি মানুষই সর্বদা, সর্বত্র ইলাহি নাফখা (হাকীকত) বহন করে চলা এক মহা-নিদর্শন।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মানুষের ত্রিস্তরের বর্ণনা এসেছে। যথা-

  • বাশারিয়্যাত
  • আদামিয়্যাত
  • ইনসানিয়্যাত

বাশারিয়্যাত হচ্ছে মানবের বহিঃআকৃতি, রক্ত ও মাংস ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত যা মূলত সৃষ্টির আদি উপকরণ তথা কাদামাটি ও পানিকে বুঝিয়ে থাকে। আর আদামিয়্যাত হচ্ছে বাশারিয়্যাতের পরবর্তী ধাপ যা আদমকে ইলাহি নাফখার (রূহ ফুকে দেওয়ার) মাধ্যমে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে খিলাফত লাভের যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে মানুষ বাশার থেকে আদমে রূপান্তরিত হয়েছে। আর আদম (আ.) যখন পৃথিবীতে আগমন করে খিলাফত ও ইমারাতের দায়িত্ব পুরোপুরি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন তখন তারা ইনসানিয়্যাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। বাশারিয়্যাত থেকে আদামিয়্যাতে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন ইলাহি নাফখার। সমভাবে আদামিয়্যাত থেকে ইনসানিয়্যাতে পরিণত হওয়ার জন্য আবশ্যক হচ্ছে মৌলিক-ধর্মীয়-মূল্যবোধ তথা আখলাক সম্পন্ন হওয়া।

যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-    وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ

আর দ্বিতীয় যে অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য আদামিয়্যাত থেকে ইনসানিয়্যাতে রূপান্তরিত করে তা হচ্ছে ‘ইলম’।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلْأَسْمَآءَ كُلَّهَا

অন্যত্র রব্বুল আ’লামিন বলেন- عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ

সুতরাং মানুষ আদামিয়্যাত থেকে ইলম ও আখলাকের মাধ্যমে ইনসানিয়্যাতের স্তরে আসীন হয়ে থাকে।

আমরা যদি সুরা ত্বীনের দিকে লক্ষ্য করি, সেখানে বিবৃত হয়েছে ‘নিশ্চয়ই আমি মানবকে সৃষ্টি করেছি সর্বোত্তম আকৃতিতে(احسن تقويم)। এখানে সর্বোত্তম ‘আকৃতি’ বলতে শুধু বাহ্যিক অবয়বকেই বোঝানো হয়নি। কারণ এই আয়াতের ধারাবাহিকতায় পরবর্তী যে আয়াতের প্রসঙ্গ এসেছে সেখানে اسفل سافلين দ্বারা সর্বনিম্ন পর্যায় উল্লেখিত হয়েছে। তাই এর বিপরীতক্রমে احسن تقويم এর অর্থ হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের উৎকর্ষ সাধন। এখানে তাকভিম শব্দটি মানুষের সম্মান, মর্যাদা এবং উচ্চ আখলাককে বুঝিয়ে থাকে। অর্থাৎ তাকভিম শব্দের মাধ্যমে ভালো ও মন্দের, সুন্দর ও অসুন্দরের এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা তথা মৌলিক আখলাকীয় উৎকর্ষতাকে বোঝানো হয়েছে।

আজকে গোটা মানবজাতি যে অর্থহীনতার (Meaningless) ভয়াবহ সংকটে উপনীত হয়েছে তা থেকে একমাত্র এবং কেবলমাত্র ইসলামই পারে বিশ্বমানবতাকে পুনরুদ্ধার করতে।

আর আবহমান বিশ্বমঞ্চে এই ইসলামকে যৌক্তিক ও কার্যকর পন্থায় তুলে ধরার গুরুদায়িত্ব বরাবরই মুসলিম যুবাদলের উপর অর্পিত । এইক্ষেত্রে তাদের দুটি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে।

১. ইলম, হিকমত ও চিন্তার মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরা। যেমন আল্লাহ বলেন-

ادْعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ ۖ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ ۚ

এই আয়াত বা এই ধরণের আয়াতগুলোকে পর্যালোচনা করলে আমরা উপলদ্ধি করতে পারি যে, বিশ্ববাসীর নিকট ইসলামকে তুলে ধরার অন্যতম প্রধান একটি পদ্ধতি হচ্ছে ইলম, হিকমাহ ও চিন্তা।

এখন আমি সবার কাছে কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই, আমরা মুসলিমরা কি সত্যিই আজ সেই ইলম, হিকমাহ ও চিন্তার অধিকারী হতে পেরেছি? সকল মানুষকে তাদের স্ব স্ব ভাষায় ইসলামের আদালত, মারহামাত ও ইসলামের সৌন্দর্য স্ফুটিত করার যোগ্যতা কি আদৌ আমরা অর্জন করতে পেরেছি? অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে এখনো হ্যাঁ বলতে পারি না।

আজ আমরা বিশ্বমানবতার সমীপে তাদের নিজস্ব ভাষায় ইসলামের সুমহান অনুপম আদর্শকে তুলে ধরতে অসমর্থ্য হয়ে পড়েছি। উপরন্তু আমাদের কাছে যে জ্ঞান সংরক্ষিত রয়েছে তা মুসলিম দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ জাহেলিয়্যাতকেই দূরীভূত করার জন্যও যথেষ্ট নয়। আজ এই ক্রান্তিলগ্নে প্রত্যেকটি যুবকের দায়িত্ব হচ্ছে যুগসমস্যাকে উপলদ্ধি করে মানবতাকে পুনর্জাগরিত করার জন্য ‘ইসলামী জ্ঞান-দর্শন’ দ্বারা নিজেদের সুসজ্জিত করা।

গত অধিবেশনে আমি যেমনটি উল্লেখ করেছিলাম যে, আমাদেরকে তাওহীদুল উলুমের (জ্ঞানের একত্ব তথা সামগ্রিকতা) অধিকারী হতে হবে। অর্থাৎ জ্ঞানের মধ্যে কোন বিভাজন সৃষ্টি করা যাবে না। কাওনী জ্ঞানের (সৃষ্টিতত্ত্ব) সাথে ওহীভিত্তিক জ্ঞানের কোন পার্থক্য করা চলবেনা। বরং সকল জ্ঞানকে একত্র করে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথের দিকে, কেন্দ্রের দিকে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।

ইমাম গাজ্জালী (রহ.) তার ‘ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন’ বইয়ের ভূমিকায় বলেছেন যে, জ্ঞান মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থাৎ জ্ঞানেরও মৃত্যু সংঘটিত হয়। এমনকি এই কারণে তিনি তার বইয়ের নামকরণই করেছেন ‘ইহইয়াউল উলুমুদ্দীন’। সেখানে তিনি ইসলামী জ্ঞান ও অনৈসলামী জ্ঞানকে আলোচ্য করে বইয়ের এরূপ নামকরণ করেননি, বরঞ্চ দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞানের পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে সামনে রেখেই তিনি এরূপ নামকরণ করেছেন।

তিনি বইটির ভূমিকায় বলেন, জ্ঞান আজ মৃত্যুবরণ করেছে শুধু তিনটি বিষয় ব্যতীত। যথা-

প্রথমটি হল, فتوي حكومة تستعين به القضاة  অর্থাৎ, সরকারী ফতোয়া সমূহ আর কাজী (বিচারকগণ) ও এই সরকারী ফতোয়াসমূহের আলোকে আমল করে থাকে।

দ্বিতীয়টি হল, الي الغلبة و الافحام  او جدل يتدرع به طالب المباهاة অর্থাৎ, অন্যের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য জ্ঞানকে জাহির করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারকারী গণ।

তৃতীয়টি হল, الوعظ المزخرف يتوسل به الواعظ إلي استدراج العوام অর্থাৎ,

সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার জন্য ওয়ায়েজিনদের চমকপ্রদ ওয়াজসমূহ। আমাদের ইতিহাসে কুসসাস বা কিসসাকাহিনী বর্ণনাকারীগণ সব সময়ই ছিলেন। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, আজও পৃথিবীতে এই তিনটি বিষয় সমভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

একদিক থেকে সরকারি ফতোয়া অপরদিকে আলেমদের মধ্যকার অর্থহীন বিতর্কসমূহ, অন্যদিকে কল্পকাহিনীমূলক ওয়াজ বর্তমান সময়ে নিত্যনৈমত্তিক একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আজকে আমরা যেই জ্ঞানের অধিকারী তা মুসলিমদের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিষ্পন্ন করতে পারছেনা। উপরন্তু আজকে আমরা ওহীর উপর ভিত্তি করেই বিভাজিত হয়ে যাচ্ছি। কেউ হচ্ছি আহলে হাদীস, আহলে কোরআন আবার কেউ হচ্ছি দেওবন্দী, বেরেলভি, সালাফি, সুফী ইত্যাদি। তবে এই বিভাজন থেকে আমাদেরকে উদ্ধার করতে পারবে ইলম, হিকমাহ, শক্তিশালী মেথডোলোজি তথা উসূল।

আমি মনে করি বিশ্বমানবতাকে অর্থহীনতার সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সামনে ২টি কর্মপন্থা রয়েছেঃ

  • ইলম ও হিকমতের মাধ্যমে; আজ বিশ্বমানবতা যে সংকটের মধ্যে উপনীত হয়েছে তা কেবলমাত্র ইলম ও হিকমতের মাধ্যমে সমাধান করতে পারি এবং বিশ্বমানবতার নিকট উপস্থাপন করতে পারি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা আজ সেই অবস্থায় নেই। একই সাথে আমাদের নিকট সঞ্চিত জ্ঞান মুসলিম দেশসমূহের মূর্খতাকে নিরসনের ক্ষেত্রে এবং মুসলিমদের মধ্যকার তাফরিকাত বা দলাদলি নিরসনের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ নয়। সেক্ষেত্রে আজকে প্রতিটি যুবকের দায়িত্ব হচ্ছে যেমনটি রাসূল (স.) বলেন- شاب نشا في عبادة الله অর্থাৎ আল্লাহর উপর ইমান আছে এমন প্রত্যেকটি যুবকের কর্তব্য হচ্ছে সে নিজেকে জ্ঞানের দ্বারা সুসজ্জিত করবে। বিশ্ববাসীর সামনে একজন আলেম হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে। তাদের অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা যুবকরা ইলম, ফিকির তথা চিন্তা এবং মূল্যবোধ সৃষ্টি করবে।

আমাদের প্রজন্ম আপনাদের প্রজন্মের সামনে পরিপূর্ণভাবে ইলম ও হিকমতকে তুলে ধরতে পারেনি। আপনারাও যেন একই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি না করেন সে জন্য আগে থেকেই নিজেদেরকে জ্ঞান-সজ্জিত করে পরবর্তী প্রজন্মের নিকট ইলম ও হিকমতকে যথাযথভাবে পৌঁছে দিন।

  • ইসলামকে বিশ্বমানবতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দ্বিতীয় কর্মপন্থা হচ্ছে ইখলাস, আমলে সালিহ ও আখলাক। বাস্তবিকভাবে এটি প্রথম কর্মপন্থা থেকেও আরো বেশি শক্তিশালী ও অধিক প্রভাবক। ইসলামকে জ্ঞানের মাধ্যমে তাবলীগ (প্রচার) করার পূর্বে আখলাকের মাধ্যমে তাবলীগ তথা প্রচার করতে হয়। গোটা দুনিয়াবাসীর নিকট ইসলাম প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে আলেম বা দরবেশের চেয়ে ব্যবসায়ীরাই অধিক ভূমিকা পালন করেছে। কারণ যারা সাদিক (সৎ) ব্যবসায়ী তারা ইসলামের পূর্বে হালাল এবং আখলাককে সে অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ ইসলামের বিধান সম্পর্কিত জ্ঞান প্রসারের পূর্বে ঈমান ও সুমহান আখলাককে দিগ্ববিদিক বহন করে ছড়িয়ে দিয়েছেন ।

এখন যদি আমরা দ্বিতীয় প্রশ্ন করি যে, আজকে কি আমরা মুসলিম হিসেবে আমাদের আখলাকী অবস্থান ও আখলাকী বৈশিষ্ট্য দ্বারা দেশের জনগণের নিকট ইসলামকে উপস্থাপন করতে পেরেছি? মুসলিম বলতে আমাদের মাথায় প্রথমত কি উদয় হয়? সেই মানুষটিকে অবশ্যই আদিল (ন্যায়পরায়ণ), আখলাক সম্পন্ন হওয়া, মুত্তাকী, ফাদিল (মর্যাদাপূর্ণ) হতে হবে। রাসূল (স.) অনেক হাদীসে বলেছেন যে, ‘দ্বীন হচ্ছে উত্তম আখলাক’, ‘আমি উত্তম আখলাককে পরিপূর্ণ করার জন্য এসেছি’।

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আজ মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে আখলাকী বৈশিষ্ট্যের চেয়ে আখলাকবিহীনতার আধিক্য দেখা যায়। এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে।

প্রথমত আমরা দ্বীন ও আখলাককে পরস্পর থেকে পৃথক করে ফেলি। এটা মোটেও সঠিক নয়। দ্বীন হচ্ছে আখলাক এবং আখলাকই হচ্ছে দ্বীন।

দ্বিতীয়ত আমরা কোরআনুল কারীমকে যেভাবে একটি ইবাদত ও আহকামের বই হিসেবে দেখে থাকি, সেভাবে কোরআনকে আখলাকের একটি বই হিসেবে দেখি না, পড়িও না।

তৃতীয়ত আমরা রাসূল (স.) এর হাদীস ও সীরাত গ্রন্থকে যতুটুকু আহকাম ও ইবাদতের জন্য পড়ে থাকি ততুটুকু গুরুত্ব দিয়ে আখলাকের উৎস হিসেবে বিবেচনা করি না, দেখি না কিংবা পড়িনা।

চতুর্থত আমরা ইবাদত এবং আখলাকের মধ্যে পার্থক্য করে থাকি, ঈমান ও আমলের মধ্যে পার্থক্য করে থাকি এবং তাকওয়া ও আখলাকের মধ্যেও বিভাজন করে থাকি। এটাও সঠিক নয়। কারণ ইবাদত হচ্ছে আখলাকের উসিলা (মাধ্যম) আর আখলাক হচ্ছে ইবাদাতের উদ্দেশ্য। নামাজ হচ্ছে সবচেয়ে বড় ইবাদাত, মুমিনের মিরাজ স্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত রাখে’। রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাকওয়া অর্জন । এজন্য আমরা রোজা রেখে থাকি। কিন্তু তাকওয়া শুধু নফল ইবাদতের নাম নয়। তাকওয়া হচ্ছে সমগ্র মহাবিশ্বকে রহমতের দৃষ্টিতে দেখা। তাকওয়া হচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের স্ত্রী, আমাদের সন্তান-সন্তুতিদের সাথে মারহামাতের (ভালোবাসা) সম্পর্ক স্থাপন করা। তাকওয়া শব্দটি কুরআনে দুইশরও বেশিবার এসেছে। যার মধ্যে ৯০ ভাগ এসেছে আখলাক সম্পর্কিত আর বাকি মাত্র ১০ ভাগ এসেছে ইবাদত সংক্রান্ত বিষয়ে। এছাড়া আমাদের সামগ্রিক আচার-আচরণ যা আখলাকবিশিষ্ট হওয়ার অপরিহার্য দাবি রাখে সেই মহান মূল্যবোধকে আমরা আজ হারিয়ে ফেলেছি। মূল্যবোধের ক্রমধারাকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আমরা ‘উদ্দেশ্য’ সম্পর্কিত মূল্যবোধের সাথে ‘মাধ্যমগত’ মূল্যবোধকে একীভূত করে ফেলেছি।

এই বিষয়ে কা’বা শরীফের একটি ঘটনাকে আমি উদাহরণ হিসেবে পেশ করতে চাই। হজ্বের সময় হাজরে আসওয়াদে চুমু দেয়া সুন্নত। রাসূল (স.) এর ওফাতের পর হযরত ওমর (রা.) হাজরে আসওয়াদকে লক্ষ্য করে বলেন;

أَنَّكَ حَجَرٌ لَا تَضُرُّ وَلَا تَنْفَعُ وَلَوْلَا أَنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ

“তুমি একটি পাথরমাত্র; না তোমার কোন উপকারিতা আছে আর না কোন অপকারিতা। কিন্তু রাসূল (স.) তোমাকে চুম্বন করেছেন বলেই আমিও তোমাকে চুম্বন করছি”।

এজন্য যারা কাবাকে তাওয়াফ করে তাদের জন্য হাজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা একটি নববী সুন্নত। কিন্তু সেই হাজরে আসওয়াদকে চুমু দেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের পা দিয়ে মাড়িয়ে, ধাক্কা দিয়ে অগ্রসর হয়ে, শারীরিক শক্তি দিয়ে অপরকে আহত করে, নারী-শিশুদের আহত করে কষ্ট দিয়ে অগ্রসর হয়ে অনেকে ভেবে থাকে যে তিনি অনেক সওয়াব অর্জন করেছেন। কেবল একটি সুন্নতকে আদায় করার জন্য আমরা নির্দ্বিধায় মানুষকে কষ্ট দেওয়ার মতো স্পষ্ট হারামে লিপ্ত হচ্ছি। মূলত উদ্দেশ্যগত মূল্যবোধের সাথে পদ্ধতিগত মূল্যবোধের মিশ্রণের ফলেই এমন সমস্যা তৈরী হচ্ছে।

তিরমিযি শরীফে বর্ণিত আছে, রাসূল (স.) একদিন হাজরে আসওয়াদের দিকে লক্ষ্য করে বললেনঃ

“তুমি কতই না উত্তম, তোমার ঘ্রাণ কতই না মিষ্ট, কিন্তু সেই আল্লাহর শপথ যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তোমার চেয়েও মুমিনের ক্বালব অত্যাধিক মর্যাদাসম্পন্ন”।

আর এখান থেকেই ইলহাম (চিন্তার উপাদান) নিয়ে মাওলানা জালালউদ্দীন রূমী ও মাওলানা জামী বলেনঃ

– “কবা, সেতো আজরের পুত্র ইবরাহীমের তৈরী করা একটি বি’না (নির্মাণশৈলী)। তবে মুমিনের ক্বলব, সেতো মহান আল্লাহ তায়ালার তৈরী করা একটি অস্তিত্বশীল সৃষ্টি।”

মুসলিম বিশ্বে আখলাক ও দ্বীনকে মিশ্রিত না করার পেছনে দায়ী হচ্ছে ফিতরাত ও হাকিকতকে পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। আখলাক শুধু কিতাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় মানব-ফিতরাতের (স্বজ্ঞাগত প্রবৃত্তির) অন্তরেও আল্লাহ তায়ালা আখলাককে সমুন্নত করেছেন। ‘খালক’ আর ‘খুলক’এর মধ্যে কোন পার্থক্য করার কোন অধিকার আমাদের নেই। ‘খালক’ মূলত মানুষের বহিঃসত্তাকে নির্দেশ করে যেখানে ‘খুলক’ মানবের অন্তঃসত্তা ও আধ্যাত্মিকতাকে ইঙ্গিত করে।

রাসূল (স.) আয়না দেখার সময়ে একটি দোয়া পড়তেন, اللَّهُمَّ كَمَا حَسَّنْتَ خَلْقِي فَحَسِّنْ خُلُقِي অর্থাৎ- ‘আল্লাহ, যেমনিভাবে তুমি আমার খালককে সুন্দর করেছ; তেমন আমার খুলককেও সুন্দর করে দাও’।

আজকের আলোচনাকে যদি সংক্ষেপ করি তাহলে;

১. আজকে গোটা মানবজাতি অর্থহীনতার এক ভয়াবহ সংকটে নিমজ্জিত ।

২. আজ গোটা মানবজাতি যে আদালত, অর্থবহতা ও মূল্যবোধকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে তা শুধু ইসলামের সুমহান আদর্শের মধ্যেই একমাত্র ও পুরোপুরি অন্তর্নিহিত।

আর গোটা বিশ্বজনতার সম্মুখে ইসলামকে যৌক্তিক ও কার্যকরভাবে তুলে ধরার মহান দায়িত্ব কেবলমাত্র মুসলিম যুবকদের উপরেই অর্পিত।

এই ক্ষেত্রে বিশ্বমানবতার কাছে দুটি কর্মপন্থায় এই কাজটি সম্পাদন করতে হবে ।

প্রথমতজ্ঞানের (ইলম) পুণর্জাগরণের মাধ্যমে

দ্বিতীয়ত আখলাককে জীবনে প্রতিফলিত করার মাধ্যমে।

কিন্তু আমরা এর কোনটিরই যোগ্যতা আজও লাভ করতে পারিনি। ইলম ও আখলাকের চরম ঘাটতি থেকে আজও আমরা বের হয়ে আসতে পারিনি। আমাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থা একদিকে যেমন মুসলিমদের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসন করতে যথেষ্ট নয় আবার আমাদের আখলাকী ভিত্তিও আজ জাতিকে মূল্যবোধের সংকট থেকে উত্তরণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

হে যুবক ভাইয়েরা,

যাদের অন্তর এখনো ঈমানের আলোয় প্রজ্জ্বল, যে সকল যুবকেরা বাংলাদেশ ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে শুনছেন তাদের প্রতি আমি আজ একটি আহ্বান রেখে সমাপ্ত করতে চাই, আজ আমাদের বিশ্বব্যাপী দুইটি আন্দোলনের ডাক দিতে হবে।

  • জ্ঞানের আন্দোলন
  • আখলাকের আন্দোলন

এমনভাবে বিশ্বজনীন জ্ঞানের আন্দোলনের যাত্রা শুরু করতে হবে যেন পৃথিবীর কোথাও জাহেলিয়াতের (মূর্খতা) অস্তিত্ব না থাকতে পারে। এই সার্বজনীন জ্ঞানের আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা কোরআনুল কারীমের আয়াত ও মহাবিশ্বের আয়াতের (নিদর্শন) মধ্যে কোন পার্থক্য সূচিত করবো না। বিশেষত আকলী ও নাকলী, দুনিয়া ও আখেরাত, গায়েবী ও শাহিদী, পুরাতন ও নতুন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ইত্যাদির মধ্যে অনুপম মেলবন্ধন ঘটাতে হবে, একটি ঐক্য (তাওহীদুল উলুম) স্থাপন করতে হবে।

আর যখন বাংলাদেশসহ সকল দেশের আলেমরা এই সামগ্রিকতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন তখন তারা ঈমান ও ইসলাম নিয়ে নিরর্থক ঝগড়ায় লিপ্ত হবেন না। যদি প্রকৃতই মুসলিমরা এরূপ করতে করতে সক্ষম হয় তাহলে আর আহলে হাদিস ,আহলে কোরআন, সুফি, দেওবন্দি, বেরেলভি এধরণের কোন বিভাজন আর অবশিষ্ট থাকবেনা। তখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে মুসলিমরা নির্বিশেষে আল্লাহর আদেশ তথা ‘তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাও’ এই মূলনীতি অনুযায়ী ঐশী ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। তবেই আলেমদের অর্জিত জ্ঞানভাণ্ডার  দ্বারা আফ্রিকা, আমেরিকাসহ গোটা দুনিয়াবাসী উপকৃত হতে পারবে।

আজ দ্বিতীয় যে আন্দোলন আমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী ও অবধারিত হয়ে পরেছে তা হচ্ছে আখলাকের আন্দোলন। এই প্রেক্ষীতে আমাদেরকে একইসাথে নাযারি আখলাক (থিওরীরিক আখলাক) ও বাস্তবিক আখলাকের মধ্যে পরিপূর্ণ সমন্বয় করতে হবে। যে সকল অঞ্চলসমূহে ঈমান (বিশ্বাস) রয়েছে সে সকল অঞ্চলে আমান(নিরাপত্তা) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মুসলিম বিশ্বে সালাম (শান্তি) স্থাপন করতে হবে। ইস্তাম্বুল, ইসলামাবাদ ও বাংলাদেশের মানুষদের আন্তঃসম্পর্ক এই ভ্রাতৃত্ববোধের উপর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের আখলাকের ভিত্তি এমন পর্যায়ের শক্তিশালী ও সুদৃঢ় হতে হবে যাতে আখলাকবিহীন লোকেরা আমাদের থেকে আখলাক শিক্ষাগ্রহণ ও নিজেরাও আখলাক সম্পন্ন হতে পারে।

মনে রাখবে, এই দুটি আন্দোলন কেবল একদল অদম্য সাহসী যুবারাই শুরু করতে পারে । আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি, একঝাঁক ইস্পাত-দৃঢ় মুসলিম যুবারাই পারবে এই আন্দোলনদ্বয়ের পথে যাত্রারম্ভ করতে এবং স্বল্প সময়েই লক্ষ্যপানে উপনীত হতে। এইক্ষেত্রে আল্লামা ইকবালের সেই বাণীটির পুনরাবৃত্তি করাই যথেষ্ট হবে যে, ‘তোমরা যখন কোরআন পড়বে তখন তা এমনভাবে পড়বে যেন মনে হয় সেসময়েই তোমাদের উপর আল-কোরআন নাজিল হচ্ছে’। রাসূল (স.) এর সীরাতকে আমাদের বাস্তব জীবনে পূর্ণ প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে প্রতিটি মুসলিম যুবককেই এককেজন জীবন্ত সীরাতে রূপান্তরিত হতে হবে। তবেই এই ক্রান্তিলগ্নের অবসান ঘটানো সম্ভব।

মনে রাখবে, আল্লাহ তায়ালা সকল নবী-রাসূলকে যুবকদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত করেছেন। সকল নবীগণের আসহাবেরাও যুবকদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত। রাসূল (স.) এর হাতে ইসলামী সভ্যতার সর্বপ্রথম জ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মিত হয় আরকাম (রা.) এর ঘরে। আর সেই দারুল আরকাম প্রতিষ্ঠা হওয়ার সময় আরকামের বয়স ছিল মাত্র আঠার বছর।

সকল সাহাবীদের সম্পর্কে আমাদের মানসপটে যে পূর্বানুমান দৃশ্য কাজ করে যেমন সকল সাহাবীরাই সাধারণত বয়স্ক ধরণের হবে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত একটি চিন্তা। এমনকি আবু বকর (রা.) পর্যন্ত রাসূল (স.) এর চেয়ে দুই বছরের ছোট ছিলেন। আমি আগেও বলেছি যে, ইসলামি সভ্যতার সকল বড় বড় মহান আলেমরা সবাই যুবকবয়সী ছিলেন। ইমাম গাজ্জালী মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তিনি তার এই ছোট্ট জীবনে সমগ্র মানবতাকে প্রভাবান্বিত করতে বাধ্য এমন সংখ্যক মৌলিক জ্ঞানচর্চা ও গ্রন্থ রচনা করে গেছেন।

আজ মুসলিম বিশ্বে যত আলেম উলামা রয়েছে তাদেরকে যদি এক পাল্লায় আর ইমাম গাজ্জালীকে আরেক পাল্লায় রাখা হয় তবে উভয়ের মধ্যে কোন পাল্লা ভারি হবে তা নিয়ে সহজেই বিতর্কের অবকাশ সৃষ্টি হতে পারে। আপনাদের পঠিত রিয়াদুস সালেহিনের প্রণেতা ইমাম নববী যখন হাদীসের শ্রেণীবিন্যাস করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর।

ইমাম গাজ্জালীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি এই স্বল্প সময়ে কিভাবে এত বেশি কাজ করতে সমর্থ হয়েছেন? জবাবে তিনি বলেন- আমি আল্লাহর কাছে সময়ের মধ্যে সময় চেয়েছিলাম তাই আল্লাহ তায়লা আমাকে সময়ের মধ্যে সময় দান করেছেন।

প্রিয় যুবক ভাইয়েরা,

আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সময়ের মধ্যেও সময় দান করুন। জীবনটা খুবই স্বল্প কিন্তু আমাদের কাজ খুবই বিস্তর। এমতাবস্থায় আমাদের সবাইকে একত্রে দুটি ইহইয়ার (পুনর্জাগরণ) আন্দোলন শুরু করতে হবে। একটি হচ্ছে ইলমি তথা জ্ঞান ও চিন্তাগত ইহইয়া আর অপরটি হচ্ছে আখলাকী ও আমলি ইহইয়া।

এইজন্য সর্বপ্রথম আমাদের সবাইকে সুস্থ-মস্তিষ্কে বৈজ্ঞানিক চিত্তে আমাদের কাজ ও কর্মপদ্ধতির একটি মানচিত্র নির্ধারণ করতে হবে। আপনারা এই দুটি বিষয় বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশ ও ভারত নয় বরং গোটা মুসলিম উম্মাহকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন ইনশাআল্লাহ।

তবে সাবধান!

কখনোই হতাশ হবেন না। ‘আমার দ্বারা কিছু সম্ভব নয়’ কখনোই এমন কথা বলবেন না। কারণ মুসলিমরা কখনোই হতাশাগ্রস্ত হতে পারে না। আপনারা যে এই পুনর্জাগরণের আন্দোলন করতে সক্ষম সেই সামর্থ্য স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা আপনাদের ঈমানের ভিতরে প্রবাহমান করে দিয়েছেন। এই সম্ভাবনা কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের মধ্যে নিবিষ্ট রয়েছে। এই অপার সম্ভাবনা রাসূলে কারীম (স.) এর হাদীসের মধ্যে বিবৃত হয়েছে। এই অসীম সম্ভাবনার দ্বার ইসলামী সভ্যতার রেখে যাওয়া সুবিশাল মহান মিরাসের (উত্তরাধিকার) ভিতরে নিহিত রয়েছে। সবসময় মানসপটে লালন করতে হবে যে, “আর তোমরাই চিরবিজয়ী; যদি তোমরা বিশ্বাসী হতে পার’।

মহান আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সবাইকে এই দুটি আন্দোলন শুরু করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার তৌফিক দান করুন (আমিন)। আমাদেরকেও তোমাদের অনুগামী হওয়ার তৌফিক আল্লাহ তায়ালা দান করুন। আমাকে ধৈর্য সহকারে শোনার জন্য আপনাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ তায়ালা আপনাদের সবার উপরে সন্তুষ্ট হন।

_

প্রশ্নোত্তর পর্বঃ

প্রশ্ন

. হোজা(উস্তাজ) আমি আপনার গত ক্লাসে উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আপনি তাওহীদুল উলুমের কথা বলেছিলেন। আমি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ি কিভাবে এই তাওহীদুল উলুমের অধিকারী হতে পারি?

সায়েম মুহাইমিন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

উত্তরঃ আমরা আগে একটা ক্লাস করেছি এই বিষয়ে যারা এই দারসটা দেখেননি তারা ঐ দারসটা পুনরায় দেখে নিতে পারেন। প্রথমত তিনটি বিষয়কে বুঝিয়ে থাকে এই জ্ঞান সমূহকে একে অপরের থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়।

  • ওহী,
  • ইনসান,
  • মহাবিশ্ব,

যদি শুধুমাত্র ওহীর সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান- হাদীস, তাফসীর, কালাম পড়ি। আর যদি মানুষের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান এবং মহাবিশ্বের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান যদি না পড়ি তাহলে আজকে আমাদের যে অবস্থা তা থেকে কখনো বের হওয়া সম্ভব না। এই জন্য মানুষ সম্পর্কিত (সোশ্যাল সাইন্স) সম্পর্কিত যত জ্ঞান আছে সেগুলো আমাদেরকে পড়তে হবে। কোরআন এই সম্পর্কে কি বলেছে সে আলোকে যেন আমরা কথা বলতে পারি।

মহাবিশ্ব সম্পর্কিত যে জ্ঞান এটাও আমাদেরকে ভালো করে শিখতে হবে যেন আমরা কাওনী তথা মহাবিশ্ব সম্পর্কিত আয়াতের সাথে ওহীর যে আয়াত তার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি।

আমি আপনাদেরকে ছোট একটি উদাহরণ দিতে চাই। আমি যখন দিয়ানেতের (Diyanet) প্রেসিডেন্ট ছিলাম তখন সারাবিশ্বে রোজা একদিনে কেন আমরা শুরু করতে পারি না সে সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। হাজীরা যখন আরাফাতে থাকে তখন অন্য জায়গার মুসলমানরা ঈদ করে। এই ইখতিলাফের কারণ কি? এই ইখতিলাফের কারণ হচ্ছে তানজীলী আয়াত তথা কুরআনের আয়াত এবং তাকবীনী আয়াত তথা মহাবিশ্বের আয়াতগুলোকে একীভূত করতে না পারা।

মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন চন্দ্র এবং সূর্যের মাঝে একটি হিসাব ঠিক করে দিয়েছেন। জ্ঞানগত দিক থেকে এই হিসাব এখন খুবই সুস্পষ্ট ও নির্দিষ্ট। সেই হিসাবের আলোকে আজ থেকে ১০০ বছর পরেও কোনদিন কোথায় কোন সময় সূর্য উঠবে সেটাও বের করা যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মুসলমানরা এই দুইটাকে একীভূত করতে না পারার কারণে এত বড় ইবাদত সমূহ আমরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পালন করি। এটা শুধু ছোট্ট একটা উদাহরণ মাত্র।

আমরা ওহীর জ্ঞানে যেরকম অগ্রগামী একইভাবে মানুষ সম্পর্কিত এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কিত জ্ঞানেও অগ্রগামী হতে হবে। তাফসীর যতটা দ্বীনি জ্ঞান, গণিতও ততটাই দ্বীনি জ্ঞান। একটি মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তানজীলী তথা কুরআনের আয়াত সমূহের তাফসীর করে এবং আরেকটি তাকবীনী জ্ঞান তথা মহাবিশ্ব স্থাপিত আয়াত সমূহের তাফসীর করে।

এই কারণে আপনারা যারা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েন, সোশ্যাল সাইন্সে পড়েন, এমনকি থিওলজিতে পড়েন তাদের উচিত নিজেদের জ্ঞানকে একে অপরের সাথে শেয়ার করা। যদি আমরা এটা করতে সক্ষম না হই তবে আমরা বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সম্পকিত জ্ঞান এবং মানুষ সম্পর্কিত জ্ঞানসমূহের ব্যাপারে অন্যরা আমাদেরকে যতটুকু শিক্ষা দিবে আমরা ততটুকুই শিখতে পারবো।

. সম্মানিত হোজা, আমরা আপনার নতুন প্রকাশিত বইটি পড়েছি । সেখানে আপনি একটি বিষয় উল্লেখ করেছেন, সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব। সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন?

বিস্তারিত যদি বুঝিয়ে বলতেন।

– আকবর হোসেন। শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

উত্তরঃ আমি এই ক্লাসের শুরতেই বলেছি মুসলমানদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব বা সভ্যতার যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তা হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যকার যে বিতর্ক যে সমস্যা সেটা। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আমরা বিতর্কে লিপ্ত। যেমন, আমি নতুন একটা তথ্য জেনেছি বাংলাদেশে আমিন জোরে বলবে না আস্তে বলবে সেটা নিয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়। এমনকি ছোট এই বিতর্ক থেকে সৃষ্ট সমস্যার কারণে একজন মানুষ নিহত হয়েছেন। পৃথিবীর সকল মুসলমান যদি সূরা ফাতিহার পরে আমিন না বলে এটার জন্য যে গুনাহ হবে, তা ঐ মানুষকে হত্যা করার জন্য যে গুনাহ হবে তার তুলনায় কিছুই না।

আমাদের একটা ছোট এবং একই সাথে আরেকটি বড় পরিচয় আছে। আমাদের একটি বড় সম্পৃক্ততা আছে আবার একটি ছোট সম্পৃক্ততাও আছে। একটি গোত্রের সাথে যে সম্পৃক্ততা এটা হচ্ছে একটি ছোট সম্পৃক্ততা। একটি দেশের সাথে যে সম্পৃক্ততা সেটা হচ্ছে একটি ছোট সম্পৃক্ততা। কোন একটি মাজহাবের সাথে যে সম্পৃক্ততা তা হচ্ছে একটি ছোট সম্পৃক্ততা। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পৃক্ততা হচ্ছে ইসলাম এবং সমগ্র উম্মতের সাথে সম্পৃক্ততা।

এই ছোট ছোট সম্পৃক্ততা যখন বড় বড় সম্পৃক্ততা বা সম্পর্ককে অতিক্রম করে চলে যায় তখনই সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। বিশেষ করে এই ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে আলেমগণ এবং উস্তাদগণ অর্থহীনভাবে বিতর্কে লিপ্ত থাকেন। যদি সেই সকল বিতর্কসমূহের দিকে তাকিয়ে দেখেন তবে দেখতে পাবেন ঐসকল বিতর্ক আমাদের ঈমানকে বৃদ্ধি করে না। ঐসকল বিতর্কসমূহ আমাদের জ্ঞানকেও বৃদ্ধি করে না। ঐসকল বিতর্ক আমাদের আখলাককেও সুন্দর করে না। সাবধান এইসকল বিতর্কে কখনই কোন পক্ষ অবলম্বন করবে না। এসকল বিতর্কের দিকে ফিরেও তাকানোর প্রয়োজন নেই। এসকল বিতর্ককে গণনায় ধরারও প্রয়োজন নেই। এগুলো আমাদের সময় ও শ্রমকে নষ্ট করে। একটু আগে যেটা বলেছি আমাদের ইলমী এবং আখলাকী যে আন্দোলন সেটার পথে বাঁধার সৃষ্টি করবে। তাই আপনাদের দুনিয়াকে কোন ব্যক্তির উপর দাঁড় করাবেন না।

চিরস্থায়ী হাকিকত সমূহ ফানী বা ক্ষণস্থায়ী ব্যক্তির উপর স্থাপন করা যায় না।

. সম্মানিত উস্তাজ, আমরা যতটুকু উপলব্ধি করতে পারলাম। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের স্কলারদের চিন্তা ও সামগ্রিকতার যে পরিধি সে তুলনায় তুর্ক অঞ্চলের স্কলারদের চিন্তার সামগ্রিকতা অনেক বেশি বিস্তৃত।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বন্ধুদের সাথে যখন আমরা কথা বলি বা আমাদের দেশের মেধাবী শ্রেণির সাথে যখন কথা বলি তখন দেখা যায় যে তারা বিভিন্ন আরব স্কলার বা অন্যান্য ভাষাভাষী বিভিন্ন স্কলারদের চিনলেও তুর্ক অঞ্চলের স্কলারদের চিনেনা! আবার যাদেরকেও চিনে সবাইকে জাতীয়তাবাদী ট্যাগ দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।

যেহেতু আপনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন, রাষ্ট্রীয় বড় পদে ছিলেন। উক্ত অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ স্কলার এবং আলেমদের চিন্তাকে প্রসারিত করতে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে কোন ভূমিকা রাখা হচ্ছে না কেনো? বা এ-ব্যাপারে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দেওয়ার কারণ কী?

-হাফিজুর রহমান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

উত্তরঃ এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা এখনও আপনাদের সাথে একত্রিত হয়ে নিজেদেরকে তুলে ধরতে পারিনি। কারণ আমরা অনেক কঠিন সময় পার করেছি। ঐসময়ে আমাদের সাথে উম্মাহর কোন সম্পর্কই ছিলো না। আপনাদেরকে আমার একটা স্মৃতি বলি এতে আপনারা একটু মজা পাবেন।

আমি ১৯৮৯ সালে কায়রো তে গিয়েছিলাম। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একদল ছাত্র আমার চারপাশে এসে জড়ো হয়। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে আপনি কোন দেশ থেকে এসেছেন? আমি জবাব দিলাম তুরস্ক থেকে এসেছি। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে তুরস্কের কত ভাগ মুসলমান? আমি জবাবে বললাম শতকরা ৯৯ ভাগ। তারা প্রথমে আমাকে বিশ্বাস করেনি। এরপর তারা আমাকে জিজ্ঞেস করলো তুরস্কে কি আজান দেওয়া হয়? পরে আমি তাদের জবাবে বলি, তুরস্কে নব্বই হাজার মসজিদ আছে এবং প্রতিটি মসজিদে দিনে পাঁচবার করে আযান হয়। তারা এটাও বিশ্বাস করেনি। এরপর তারা আমাকে বলে দেখি তো তুমি সূরা ফাতিহা পড়তে পারো কিনা?

আমিও তাদেরকে বলি পড়বো। তবে একশর্তে, আমিও পড়বো তোমরাও পড়বে। আর প্রত্যেকটা তাজবিদগত ভুলের কারণে একটা করে থাপ্পড় দেওয়া হবে। তারা রাজী হলো। আমিও শুরু করে যখন মালিক ইয়াও মিদ্দীন পর্যন্ত আসলাম তখন তারা বললো থামো থামো। আমরা এভাবে তিলাওয়াত করতে পারবো না বরঞ্চ আমাদেরকে উলটো অনেক বেশি থাপ্পড় খেতে হবে।

আপনাদের সাথে কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা শেয়ার করি। তুর্কিতে খিলাফতের পতনের পর যখন বড় বড় সংস্কার সমূহ হয়, তখন বিশেষ করে বৃটিশরা সহ বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এক্ষেত্রে সাহায্য করার পাশাপাশি দুনিয়াতে ছড়িয়ে দেয় যে, তুরস্ক ইসলাম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

তুরুস্কের ইসলামী চিন্তাধারার তিনটি উৎস রয়েছে।

একটি হচ্ছে মাওয়ারাউন নাহার (মধ্য এশিয়া)। অর্থ্যাৎ ইসলাম আরব দেশসমূহ থেকে মাওয়ারাউন নাহর অঞ্চলে যায় এবং সেখান থেকে ইসলাম আনাতলিয়ায় বা এশিয়া মাইনরে (বর্তমান তুরস্ক) আসে। মাওয়ারাউন নাহরের দিকে যদি তাকাই তবে দেখতে পাই সেখানে ইমাম আবু হানিফা আছে আবার ইবনে সিনাও আছে। ইমাম বুখারিও আছে আবার ইমাম ফারাবীও আছে, ইমাম সারাখসিও আছে আবার শায়েখে নাকশীবন্দীও আছে। অর্থ্যাৎ মাওয়ারাউন নাহার অঞ্চলটি আমাদের জ্ঞানের যে তাওহীদ তার অনুপম একটি উপমা।

দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে সালজুকি নিজামীয়া মাদ্রাসা সমূহ।

আর তৃতীয় অভিজ্ঞতা হচ্ছে উসমানী খিলাফতের অভিজ্ঞতা। এরপরেও আমাদের যে জায়গায় থাকার কথা আমরা সেই জায়গায় নেই। তবে আমাদের থেকে বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশ থেকে আমাদের নেয়ার মতো অনেক কিছু রয়েছে। আমরা আপনাদের অঞ্চল থেকে সেই পঞ্চাশের দশক থেকে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী, আল্লামা ইকবাল, মাওলানা মওদূদীকে অনুবাদ করে পড়ছি। কিন্তু তুরস্ক থেকে আপনাদের বাংলা ভাষায় কয়টা অনুবাদ হয়েছে? অথচ এমন অনেক বই রয়েছে যেগুলো অনুবাদ হওয়া দরকার। আশার দিক হচ্ছে এখন কিছু কিছু অনুবাদ হচ্ছে।

. আসসালামু আলাইকুম

সম্মানিত হোজা,

আমাদের দেশে ইসলামপন্থীদের ধরা যায় বড় ৪ টি ধারা গড়ে উঠেছে। একটি দেওবন্দী ধারা। আরেকটি বেরলভি ধারা। আরেকটি জামায়াতে ইসলামী ধারা। আরেকটি আহলে হাদীস ধারা।

এদের সবারই আলাদা আলাদা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, মক্তব রয়েছে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি সিলেবাস ও পাঠদান পদ্ধতি সবার একই। এবং এসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আমরা যারা বেড়ে উঠেছি, তারা কোনভাবেই বিশ্বজনীন চিন্তা, উসূল এবং মেথডলজির আলোকে ইসলামী সভ্যতাকে পর্যালোচনা করা এবং বর্তমান সময়ের সমস্যা ও ভবিষ্যতের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য যোগ্য হয়ে উঠছি না। আর এ-বিষয়টি আমরা সবচেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করেছি আপনার উসূলের ধারা ও অন্যান্য যেসকল বক্তব্য অনূদিত হয়েছে সেগুলো পড়ার মাধ্যমে। সম্মানিত হোজা, এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী হতে পারে? আমরা কিভাবে যোগ্য হয়ে উঠতে পারি? আমরা কিভাবে সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মত আলেম হিসেবে গড়ে উঠতে পারি?

দ্বিতীয়ত প্রশ্ন হচ্ছে, এসকল শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসগুলো কেনো এধরনের একই জায়গায় অবস্থান করছে? বাহ্যিকভাবে আমরা অনেক সংঘর্ষ দেখতে পাই কিন্তু চিন্তা এবং দর্শনের ক্ষেত্রে সবাই প্রায় একই অর্থাৎ যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সক্ষমতা কেউ রাখছে না। এর কি কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে?

-আবু বকর আল মারুফ, তামীরুল মিল্লাত

উত্তরঃ প্রথমত এই দেওবন্দী, বেরলভি বা এরকম আরো যে ধারাগুলো আছে এগুলো প্রতিটি এক একটি স্কুল অফ থট। আমরা যদি এই সকল স্কুল সমূহের শিঁকড়ের অনুসন্ধান করি তাহলে দেখতে পাই যে তারা ভারতীয় উপমহাদেশে সেসকল কাজ করেছে ঐতিহাসিক আন্দোলন করেছে সেগুলো অসাধারণ। এসকল ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে কোরআন, হাদীস এবং এই সম্পর্কিত জ্ঞানকে সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে অবদান রাখায় মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন।

এই ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, এই সকল স্কুলগুলো কখনো কখনো একটি স্বতন্ত্র মাজহাব কিংবা দ্বীনে পরিণত হয়ে যাওয়া। এমনকি মানুষের উপরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া, মসজিদসমূহকে আলাদা করে ফেলা। এটা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আমি লাহোরে দেওবন্দী ও বেরলভী দুইটা ধারার সবচেয়ে বড় নেতাদের সঙ্গে বসে কথা বলেছি। আপনারা দুইজনই বলেন যে আলহামদুলিল্লাহ আমরা মুসলমান। আপনারা দুইজনই আহলে সুন্নাত। আপনারা দুইজনই হানাফি। আপনারা দুইজনই যেকোনো ভাবে হোক তাসাউফের নিকটবর্তী। তাহলে আপনাদের মধ্যকার পার্থক্য কি?

ইখতিলাফ কেন?

পরবর্তীতে তাদের সাথে আলোচনা করার এক পর্যায়ে আলোচনা গিয়ে ঠেকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি শারীরিকভাবে জীবিত নাকি মৃত।

এর উপর ভিত্তি করে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে যে বিভাজন। এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বড়রা এসকল সংকীর্ণ জায়গায় ঢুকে পড়ায় নিজেদের সম্মানের কারণে হয়ত এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। তবে আপনারা যারা যুবক আছেন, দয়া করে এইসকল সংকীর্ণ জায়গা থেকে বেরিয়ে আসুন।

ইখতিলাফ স্বাভাবিক একটি বিষয়। কারণ মানুষের প্রকৃতি, আয়াতের প্রকৃতি, আকলের প্রকৃতি এবং আবহাওয়া বা পরিবেশের প্রকৃতি ভিন্নতা দাবী করে থাকে। একারণে রাসূল (স.) এর সাহাবীগণও ইখতিলাফ করেছিলেন। তবে একথা মনে রাখতে হবে, ইখতিলাফ এবং খিলাফ ভিন্ন দুটি বিষয়। অন্যদিকে আছে নিযা, আছে শিক্বাক। রাসূল (স.) বলেছেন- নিযা নেই, শিক্বাক নেই, তাফরিকাত নেই তবে ইখতিলাফ রয়েছে। আর ইখতিলাফ যদি আখলাকের উপযোগী করে করা হয় তবে তা রহমত।

ইসলামী সভ্যতায় ‘ইখতিলাফের আখলাক’ নামক একটি পরিভাষা রয়েছে। এ বিষয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। যদি বাংলা ভাষা না থাকে তবে আপনাদের কাছে আমার পরামর্শ সেই বইসমূহ ঠেকে কিছু অনুবাদ করে নিন।

অনতিবিলম্বে আমাদেরকে একটি ইখতিলাফের আখলাক প্রতিষ্ঠিত করে ইখতিলাফকে নিযা, শিক্বাক ও খিলাফে পরিণত হওয়ার পথকে রুদ্ধ করতে হবে। কেননা নিযা ও শিক্বাক হারাম। তাফরিকাও হারাম। কারণ এটা আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ- “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্তভাবে আকড়ে ধরো এবং একে অপর হতে পৃথক হয়ো না”।

বিশেষ করে একেক ফিরকা একে অপরকে তাকফীর করা অনেক বড় একটি সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে আহলে সুন্নতের আলেমরা “আহলে কিবলা” নামক পরিভাষা সৃষ্টি করেছেন। ইমাম আবু হানীফা ফিকহুল আকবরে বলেন- “যারা আল্লাহর কুর’আনের উপর ঈমান এনেছে সেটার তাফসীরের কারণে কাউকে তাকফীর করা যাবে না”। তাকফীরিবাদ জাতীয়তাবাদের (বর্ণবাদ) মতোই বড় একটি গুনাহ। আপনাদের দেশের আলেম ও উস্তাজদেরকে আমার সালাম বলবেন। কেউ যেন ইখতিলাফের কারণে একে অপরকে তাকফীর না করেন।

আহলে হাদীসের ভাইদের ইসলামকে দেখার ব্যাপারে কিছু সমস্যা আছে। এটা আজকে নতুন কোন বিষয় নয়। যখন তাঁরা ইমাম আবু হানীফাকে ইসলামের সীমার বাহিরে দেখেছেন সেখানে তখনও এই সমস্যা ছিল। রায় এবং ইজতিহাদকে অস্বীকার যখন করতো তখনও এই সমস্যা ছিল। তাঁরা রায়কে হও নিজের মনঃপূত কথাবার্তা মনে করত। এরপরও যদি কোন ভাই বলে যে, ‘আমি আমার জীবনকে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের আলোকে গড়তে চাই তাতে কোন সমস্যা নেই। তার স্থান আমাদের মাথার উপরে’।

তবে সে যদি বলে এটাই হচ্ছে মুতলাক হাকীকত, এটাই আমার দ্বীন, যারা এর বাহিরে যাবে তারা দ্বীনের বাহিরে চলে যাবে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। যে কেউ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বলে ঈমান আনে তাঁরা সকলেই আমাদের ভাই এতে কোন সন্দেহ নেই ।

একইভাবে আহলে কোরআন এটাও ভারতে সৃষ্টি হয়েছে। সুন্নতবিহীন আহলে কোরআন হতে পারে না, সুন্নাত ছাড়া ইসলাম হতে পারে না। সুন্নাত হচ্ছে এমন একটি ঘর যেখানে কোরআন নাযিল হয়েছে। ঘরকে যদি ধ্বংস করে দেওয়া হয় তাহলে কোরআনকেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এই সকল বিষয়কে অতিক্রম করার জন্য আলেমগণ ইলমুল উসূলের বিকাশ ঘটান। সেখানে চারটি দলিল সুস্পষ্ট এবং এদের একটা  ধারাক্রম আছে। এগুলো হলো কিতাব, সুন্নত, ইজমা ও কিয়াস। এছাড়াও আরও অন্যান্য। এরপরে সেখানে মাসলাহাত আছে, ওরফ আছে, ইসতিহান আছে ইসতিসলাহ আছে ইসতিসহাব আছে, সাদ্দে – যারা-ই আছে  এছাড়াও আরো অনেকগুলো পরিভাষা আছে।

আপনারা যারা যুবক আছেন তারা যদি এইসকল বিষয়কে সামগ্রিক আকারে দেখতে পারেন তবে আপনারা এই সকল বিষয়ের উপরে উঠতে পারবেন। উপরোক্ত পার্থক্যসমূহ কোন ইখতিলাফ নয় এটা হচ্ছে ফিতনা। আর ফিতনাকে দূরীভূত করা হচ্ছে ওয়াজিব। দুই ভাইয়ের মধ্যকার প্রবেশকৃত তাফরিকা হচ্ছে ফিতনা।

অবশ্য এটা আমি আগেও বলেছি ব্রিটেনের বার্মিংহামে আমি জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছি। তারা আমাদেরকে বলে ওমুক জায়গায় দুইটা মসজিদ আছে। সেখানে গিয়ে দেখি একই রাস্তায় দুইটা মসজিদ এবং দরজা দুটো পাশাপাশি। একটির দেওয়ালে লেখা আহলে কোরআন আর আরেকটির দেওয়ালে লেখা আহলে হাদীস। যদি আমার ফতোয়া দেওয়ার মতো ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি ফতোয়া দিতাম দুটি মসজিদের একটিতেও নামাজ পড়া জায়েজ নাই। এজন্য প্রিয় ভাইয়েরা এধরণের ইখতিলাফকে আমাদের অতিক্রম করতে হবে। এগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে হবে।

. আমার প্রশ্ন হচ্ছে ইসলাম কি মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে নিষেধ করে? আমি নিজে একজন ভুক্তভোগী। আমি আলিম পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়ার পর আমার পরিবার থেকে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। আমাকে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। এখন বিভিন্ন হাদীস শুনে পরিবার থেকে মাদ্রাসায় পড়াশোনাও বন্ধ করিয়ে দিয়েছে। এখন আমাকে বাসায় গৃহশিক্ষক রেখে পড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে এটাই সালফে সালেহীনদের নীতি। সব মিলিয়ে আমার মতের কোন প্রাধাণ্য দেওয়া হচ্ছে না। বিশ্বায়নের এই যুগে এটা দিয়ে কি আদৌও একজন ভালো আলেম হওয়া সম্ভব কি? এই ব্যাপারে ইসলামের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কি?

– সাদিয়া আক্তার

উত্তরঃ রাসূলে আকরাম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় হিজরত করলেন তখন মদিনাকে একটা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারী এবং পুরুষরা একত্রে উপকৃত হয়। হযরত আয়েশা (রা.) উম্মতের সবচেয়ে বড় আলিমে রূপান্তরিত হন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে পরবর্তীতে আরব সমাজের বিভিন্ন ধরণের সংস্কৃতি ইসলামের শিক্ষার উপর প্রাধন্য বিস্তার করে ইসলামের শিক্ষাকে অতিক্রম করে যায়। এমনকি দুঃখজনক হলেও সত্য যে ‘তোমরা নারীদের পড়ালেখার শিক্ষা দিওনা এমন একটি কথাকে হাদীস বলে আল্লাহ রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়’। এটা খুবই দুঃখজনক বিষয়। অবশ্যই একজন মুসলিম মহিলার জ্ঞানার্জেন ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে।

বিশেষ করে নিজের লজ্জাশীলতা, পর্দাকে ভালোভাবে রক্ষা করা ইত্যাদি। তবে আত্মসম্মানও লজ্জাবোধের কথা শুধুমাত্র নারীদের জন্য বলা হয়নি। পুরুষদের লজ্জাহীনতা যেরকম নারীদের লজ্জাহীনতাও একই রকম। ফলশ্রুতিতে কিছু কারণ দেখিয়ে মুসলিম উম্মাহর মায়েদেরকে মূর্খ রাখা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়।

যদি পরিবেশ না থাকে তবে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। মুসলিম উম্মাহ কখনো এক পাখা দিয়ে উড়তে পারে না। মুসলিম নারী এবং পুরুষ একে অপরের ওয়ালী তথা রক্ষক। তারা একত্রে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে। একজন মুসলিম নারীকে গৃহে বন্দী করে রাখা বা পড়ার সুযোগ না দেওয়ায় নারীদের জ্ঞানগত ও পরিবেশগত যে সমস্যা হয়ে থাকে তা অনেকাংশেই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এমনকি আমাদের অপছন্দনীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নারীদের চাইতেও তাদের পরিণতি অনেক সময় অনেকাংশে খারাপ হয়ে থাকে।

. আমরা যারা অবিবাহিত তরুণী আমাদের অনেকের ক্ষেত্রেই বিবাহ নিয়ে কথাবার্তা চললে দেখা যাচ্ছে স্বামীর বাধ্য থাকতে হবে বুঝায় এরকম হাদীসগুলোকেই সামনে আনা হয় এবং এই ব্যাপারে বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি এবং একটা সম্মানজনক পেশার মাধ্যমে উপার্জনের সক্ষমতা রাখি। সেক্ষেত্রে যদি আমরা উপার্জন করে পরিবারকে সহায়তা করি। তবে এই উপার্জন করা কি ইসলাম বহির্ভূত হবে?

দ্বিতীয়ত আমরা যে ধরনের ছেলেদের পছন্দ করি না সে ধরনের ছেলেদের সাথে যদি বিবাহ দেওয়া হয় এবং সে ব্যাপারে বলা হয় পিতা মাতার আদেশ শোনা ফরজ। সেক্ষেত্রে আমাদের কি করণীয় হতে পারে? কিন্তু আমরা ভিন্ন চিন্তাকে লালন করে এমন কারো সাথে বিয়ে হোক তা কোন ভাবেই চাই না। এই ক্ষেত্রে পিতা মাতার আদেশ ও জীবন সঙ্গী বাঁচার মাঝে আমরা কি ভাবে ভারসাম্য করবো?

আফিফা জান্নাত, বুয়েট

উত্তরঃ দুঃখজনক হলেও সত্য যে ঘরের ভিতরে নারী এবং পুরুষ, স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হবে এই সম্পর্কে খুবই চরমপন্থা বা চরমপন্থার দিকে নিয়ে যাবে এমন বিষয় রচনা করা হয়েছে। একটি বড় মূলনীতি আছে যে স্রষ্টার অবাধ্য হয়ে সৃষ্টির আনুগত্য করা যাবে না। আমি এই দুইটি বিষয়কে একত্রিত করে একটি বিষয় বলতে চাই সেটা হচ্ছে নিকাহ অর্থ্যাৎ আকদ বা চুক্তি এর তিনটি পর্যায় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে,

  • আহদ
  • আকদ
  • মিসাক

নিকাহ হচ্ছে আহদ তথা একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে একসাথে থাকার বিষয়ে একে অপরকে কথা দিয়ে থাকে। আহদ এবং মুয়াহাদা হওয়ার ক্ষেত্রে আখলাকী বিভিন্ন দায়িত্ব রয়েছে।

অর্থ্যাৎ একজন মানুষ যখন আরেকজন মানুষকে কথা দেয় তখন তা আখলাকী। একজন আরেকজনকে আঘাত করে বলতে পারবে না, একজন আরেক জনের উপর মানসিকভাবে চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না, একজন আরেকজনের হৃদয় ভাঙতে পারবে না।

নিকাহ একই সাথে আকদ বা চুক্তি। নিকাহ দুইজন মানুষকে আইনগতভাবে একত্রিত করে। আগেরটাতে ছিল আখলাক। আর এটাতে আইন চলে এসেছে। এখানে কেউ কারোর আইন বা বিধানকে ভঙ্গ করতে পারে না। একজন আরেকজনকে গোলাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না, গোলামের দৃষ্টিতে দেখতে পারবে না। যেমন, আমাদের ওয়াজের বিভিন্ন কিতাবে বিভিন্ন কথা লেখা আছে এগুলো সব ভ্রান্ত, জাল। এগুলোর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই।

যেমন- “একদিন এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলে আমি বাহিরে যাচ্ছি যতদিন না আমি আসি ততোদিন তুমি ঘর থেকে বের হতে পারবে না। একথা বলে সে চলে গিয়েছে। পরবর্তীতে তার নিচের তলায় তার বাবা মা অসুস্থ অবস্থায় ছিল। এই অবস্থায় ঐ নারী রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো- তারা অসুস্থ, আমি কি তাদের সেবা করতে পারবো? জবাবে তিনি নাকি বলেছেন, তুমি যদি তোমার স্বামীর কথা শোন তবে সেটা উত্তম হবে।” এটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও জাল। এটা কখনোই ইসলামের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে না। একজন নারী স্বামীর অনুমতি ছাড়া তার অসুস্থ বাবা মায়ের সেবা করতে পারবে না এটা কে বলতে পারে? এটা ইসলামে কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন নারী একজন পুরুষকে কখনো ভালো কাজ থেকে বিরত রাখতে পারবে না। এমনকি নারী যদি ব্যবসা করে তাহলে সে ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাকে বাঁধা দেওয়া যাবে না। নারীদের উপার্জন নারীদের জন্য, পুরুষদের উপার্জন পুরুষদের জন্য। তাদের প্রত্যেকের উপার্জন প্রত্যেকের জন্য।

এখানে و اَخَذْنَا مِنْهُمْ مِّیْثَاقًا غَلِیْظًا নারীরা পুরুষদের থেকে যে মিসাক নিয়ে থাকে এই মিসাক বা চুক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও অনেক ভারসম্পন্ন একটি চুক্তি। আর মিছাক হচ্ছে আহিদ এবং আকদ দুইটাকে পরিগ্রহকারী একটি পরিভাষা।

কুরআনে মিসাক শব্দটি ৩ টি স্থানে এসেছে। একটি হচ্ছে ক্বালু বালা। আমরা আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে যে কথা দিয়েছি।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে পয়গম্বরগণ আল্লাহ রব্বুল আলামীনকে যে মিসাক বা ওয়াদা দিয়েছেন তাঁরা মানুষকে আল্লাহর দ্বীনকে বুঝাবেন। মানুষের মাঝে আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করবেন।

তৃতীয়টি হচ্ছে নারী এবং পুরুষের পরস্পরকে একত্রে সংসার করার যে কঠিন কথা দিয়ে থাকেন তা। এই মিসাক, এই আহদ, এই আকদ, কোন গোলামীর চুক্তি না।

দ্বিতীয় প্রশ্নের ক্ষেত্রে প্রথম কথা হচ্ছে ইকরাহ বা অপছন্দনীয়তা নিয়ে কখনো নিকাহ (বিবাহ) হয় না। সাহাবীদের মধ্যে বারিরাহ এবং মুগিসের একটি ঘটনা আছে। বারিরাহ যখন মুগিসকে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন মুগিস বারিরাহ থেকে পৃথক হতে চাননি। এ বিষয়ে মুগিস রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে অভিযোগ করে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারিরাহকে ডেকে বললেন তুমি তোমার স্বামী থেকে পৃথক হয়ো না।

বারিরাহও রাসূল (স.) কে পাল্টা প্রশ্ন করেন এটা কি আল্লাহর রাসূল হিসেবে আমাকে আদেশ দিচ্ছেন? নাকি আমাদের মাঝে মধ্যস্থতা করছেন?

রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে বললেন, “না আমি আদেশ করছি না। আমি তোমাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করছি।” (এতোটাই মূল্যবান নারীদের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব মতামত)।

সাহাবীদের মধ্যে আরেকজন নিজের মেয়েকে তার চাচাতো ভাইয়ের কাছে জোর বিয়ে দিতে চাইলে। কিন্তু তাঁর মেয়ে এই ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের কাছে অভিযোগ দিলেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাবাকে ডেকে পাঠালেন, তাঁকে বললেন, তুমি জোর করে তোমার মেয়েকে কারো কাছে বিয়ে দিতে পারবে না। তাঁর বাবাও বললেন, ঠিক আছে ইয়া রাসূল্লাহ।

তখন ঐ মেয়ে রাসূল্লাহকে বলেন – এবার আমার বাবা আমাকে যার কাছে বিয়ে দিতে চান আমি তাকেই বিয়ে করবো। রাসূল্লাহ তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন- তুমি যখন তোমার বাবা যার কাছে বিয়ে দিবে তাকেই বিয়ে করবে তখন আমার কাছে অভিযোগ করলে কেন? ঐ মেয়ে জবাবে বলে, বাবাগণ যেন তাদের দায়িত্ব এবং তাদের কতটুকু ক্ষমতা রয়েছে তা যেন বুঝতে পারেন এজন্য আমি আপনার কাছে এসে অভিযোগ দিয়েছি যেন সকল বাবাগণ শিক্ষা নিতে পারে।” এজন্য আমাদের উচিত হবে মাকাসিদের বিষয়কে সামনে রেখে এইসকল বিষয়কে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।

আল্লাহ আমাদের সময়কে কবুল করুন। আমিন।

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

১৪২৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top