গোটা জাতীয় কালচারের ইমারত সাহিত্য। অতএব সাহিত্যিকরা সে কালচারের আর্কিটেক্ট। উপরে বর্ণিত জাতীয় কৃষ্টির বিভিন্ন রূপকে যুগোপযোগী করিয়া পুনর্জীবিত করিতে হইলে সাধক চিন্তা-নায়ক সাহিত্যিকদেরই তা করিতে হইবে।
এই আসল কাজেই কিন্তু আমরা আজও আত্ম-অচেতন পরানুকারী রহিয়া গিয়াছি। চরম দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা যে পরানুকারী তা বুঝিতে পারিতেছি না। মনের এই গোলামিকে আমরা উদার প্রগতিশীলতা ও বিশ্বজনীনতা ধরিয়া নিয়া গর্ববোধ করিতেছি। এই মানসিক দাসত্বের মোহ আমাদিগকে কাটাইয়া উঠিতে হইবে। স্বকীয়তা ও গুণগ্রাহিতার, আত্ম-সম্মান ও গুণীর সম্মানের, উদারতা ও হীনমন্যতার পার্থক্য বুঝিতে ও তাদের সীমারেখা চিনিতে হইবে।
মানুষের আত্মমর্যাদাবোধই তার কালচারের প্রাণ। তার আত্মবিশ্বাসই ওর শক্তি। এই দুইটা যাদের নাই, কালচারের ব্যাপারে তারা পরগাছা মাত্র। কালচার-প্রীতি দেশাত্মবোধ ও বাপ-মা ভক্তির মতই ইমোশনের বস্তু, যুক্তিবাদ ও দর্শন-বিজ্ঞানের ব্যাপার নয়। কিন্তু কালচার-প্রীতির এ ইমোশন সহজাত নয়, অর্জিত। বেহালার তারে আঘাত করিয়া যেমন সুর আনিতে হয়, তেমনি হৃদয়ের তারে আঘাত করিয়া এই ইমোশন আনিতে হয়। কবি-সাহিত্যিকরাই সে সুর-শিল্পী।
নিজের মর্যাদা মানে যে পরের অমর্যাদা নয়, অপরের অমর্যাদা করিয়া কেউ যে মর্যাদাবান হয় না, পরকে অভদ্র বলা যে ভদ্রলোকের খাসিয়ত নয়, পরকে তাচ্ছিল্য করার মানে যে আত্মবিশ্বাস নয়, জাতির অন্তরে এই সূক্ষ্ম শালীনতাবোধ সৃষ্টির দায়িত্বও কবি-সাহিত্যিকের। এটা তারাই পারে। আর কেউ না।
এই সুর-শিল্পীরা যদি নেশা খাইয়া আত্মভোলা হয়, তবেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ চাবুক মারিয়া তাদেরে আত্মস্থ করে। সম্প্রতি পাক-ভারত যুদ্ধ আমাদের কৃষ্টি জীবনে তাই করিয়াছে। আমরা শুধু নিজের কালচারই ভুলিয়া থাকি নাই, নিজের দেশকে পর্যন্ত ভুলিয়া ছিলাম। দেশের মাটি ও তার নদ-নদী, তার সবুজ মাঠ, পাখির গান, মাতৃভূমির সন্তান ও তাদের মুখের বুলি, তাদের সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা আমাদের কবি-প্রাণে স্পন্দন জাগাইতে এবং লেখকের কলমে গতি যোগাইতে পারে নাই।
আমরা কলিকাতার কৃষ্টি পশ্চিম-বাংলার পরিবেশ ও শান্তি-নিকেতনের রচনাভংগি নকল করিয়া সুখী ও বিদগ্ধ হইতেছিলাম। রবীন্দ্রনাথকে আমাদের জাতীয় কবি আখ্যা দিয়া রবীন্দ্র-সংগীতের সাগরে ডুব পাড়িতেছিলাম।
কাজেই আমাদের প্রকাশকরা পশ্চিম-বাংলার পুস্তক রিপ্রিন্ট করিয়া, বিক্রেতারা তা বেচিয়া এবং পাঠকরা তা গো-গ্রাসে গিলিয়া পাক-বাংলাকে পশ্চিম-বাংলার কৃষ্টিক উপনিবেশ, তার্ষিক সীমান্ত প্রদেশ ও সাহিত্যিক বজায় করিয়া রাখিয়াছেন। আর আমাদের কবি সাহিত্যিকরা রাস্তার পাশে দাঁড়াইয়া অসহায় দর্শকের মতই এই বেচা-কেনা দেখিতেছিলেন।
ঘুম-ভাংগা দামামা
এমন সময় যুদ্ধের দামামা বাজিয়া উঠিল। আমাদের তন্দ্রা-টুটিল সরকার কয়েক শ্রেণীর রবীন্দ্র-সংগীত বন্ধ ও পশ্চিম-বাংলার বই-পুস্তক ও ছায়াছবি নিষিদ্ধ করিলেন। তবেই আমাদের জ্ঞান হইল। আমাদের রেডিও-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে গানে- কবিতায় ছায়াছবিতে দেশাত্মবোধ ও কৃষ্টিক স্বকীয়তা ঝংকৃত হইতে লাগিল।
দেশের জাগরণের পক্ষে এটা নবযুগ, কালচারের দিক হতে এটা সুবেহসাদেক, কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের জন্য এটা গৌরবের কথা নয়। এই গুণে আমরা সরকারী হস্তক্ষেপকে সাহিত্যিক রেজিমেন্টেশন বলিতে পারি না। যুদ্ধ-বিগ্রহের মতো বিপর্যয় দরকার হয় জনগণের সমবেত চেতনা উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য। কবি-সাহিত্যিকদের জন্য তার দরকার হইবে কেন? তাঁরা যে চিন্তা-নায়ক। দূরে দেখা যে তাঁদের পবিত্র দায়িত্ব। পশ্চিম-বাংলা যে আমাদের দেশ নয়, কলিকাতার কৃষ্টির সাহিত্য যে আমাদের কৃষ্টি-সাহিত্য নয়, শান্তিনিকেতনী ভাষা যে আমার ভাষা নয়, এই সূক্ষ্ম তত্ত্ব হৃদয়ংগম করিতে জনগণের সময় লাগিতে পারে, কিন্তু চিন্তানায়কদের লাগিবে কেন?
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি হইয়াও পাক-বাংলার জাতীয় কবি নন? বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার পর এটা রাষ্ট্রীয় সত্য হইয়াছে নিশ্চয়ই। কিন্তু বিভাগ-পূর্ব বাংলাতেও এটা সাহিত্যিক সত্য ছিল। পাকিস্তান হওয়ার তিন বছর আগে ১৯৪৪ সালে কলিকাতার বুকে দাঁড়াইয়া এক সভাপতির ভাষণে আমি বলিয়াছিলাম “বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব ভারতীয় বিশ্বে কতবার শারদীয়া পূজায় ‘আনন্দময়ী মা’ এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ মোহররমের চাঁদ উঠেনি।”
বিশ্ব-কবি বনাম জাতীয় কবি
এটা-বিশ্ব-কবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি অশ্রদ্ধা-অসম্মানের কথা নয়। সত্য কথা। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি হইয়াও বাংলার জাতীয় কবি নন। বাংলার জাতীয় কবি নন তিনি এই সহজ কারণে যে বাংলায় কোনও ‘জাতি’ নাই। আছে শুধু হিন্দু-মুসলমান দুইটা সম্প্রদায়। তিনি বাংলার জাতীয় কৃষ্টির প্রতীক নন এই সহজ কারণে, যে এখানে কোনও জাতীয় কৃষ্টিই নাই। এখানে আছে দুইটা কৃষ্টি: একটা বাংগালী হিন্দু-কৃষ্টি অপরটি বাংগালী মুসলিম-কৃষ্টি। সমগ্র বাংলায় মেজরিটি ছিল মুসলমান। মেজরিটি দেশবাসীর সাথে নাড়ীর যোগ না থাকিলে কেউ জাতীয় কবি হইতে পারেন না। বিশ্বের কাছে তিনি যত বড়ই হউন। এটা পশ্চিম-বাংলার কৃষ্টি- সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞাও নয়। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-কবি হিসাবে আমাদের নমস্য। সর্ব অবস্থায় তা থাকিবেন। যুদ্ধেও থাকিবেন, শান্তিতেও থাকিবেন। এই খানেই সীমা-রেখার সূক্ষ্ম জ্ঞানের প্রয়োজন। ভারতের সংগে যুদ্ধ বাধিলেই রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা নিষিদ্ধ হইবে এটাও যেমন দূষণীয়; শান্তি হইলেই রবীন্দ্র-পূজা শুরু হইবে এটাও তেমনি দূষণীয়।
পশ্চিম-বাংলার সাহিত্য উন্নত সাহিত্য হিসাবে নিশ্চই আমাদের অনুকরণীয়; কিন্তু তা আমাদের নিজের সাহিত্য নয়। অমন মোহ যদি থাকে তবে তা ঝাড়িয়া ফেলিতে হইবে। আমাদিগকে অবিলম্বে আমাদের নিজস্ব জাতীয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টির রিডিস্কভারি করিতে হইবে আমাদের নিজের দেশে। পাক-বাংলার গত সাতশ’ বছরের ইতিহাস আবার পড়িতে হইবে নতুন জাতির মন লইয়া। সে রিডিসকভারির রূপায়ণেই আমাদের জাতীয় সাহিত্য রচিত হইবে নয়া যিন্দিগির বাণী বহন করিয়া। বাংগালী হিন্দুর রেনেসাঁ যুগের মতো আমাদের মধ্যেও বাংগালী মুসলিম রেনেসাঁর বংকিম- রবীন্দ্র ও রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের জন্ম হইতে হইবে।
রিভাইভ্যাল নয়, রেনেসাঁ
তরুণরা ভুল বুঝিবেন না। এটা পিছন ডাক নয়। এটা সামনে চলার আহ্বান। রিভাইভ্যাল নয়, রেনেসাঁ। – এটা বাদশাহি আমলে বা খিলাফত যুগে ফিরিয়া যাওয়ার পরামর্শ নয়। ওটা হইবে অবাস্তব। ভ্রান্ত মরীচিকা। দুনিয়া আজ প্রগতি ও সাধনার পথে অনেক-অনেক দূর আগাইয়া গিয়াছে। আমাদেরও সে প্রগতির নাগাল ধরিতে হইবে। তার শরিক হইতে হইবে। কাজেই গতি হইবে আমাদের অতিদ্রুত। আমাদের কালচারকেও আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক হইতে হইবে। এটা ফিউডাল যুগ নয়, গণতন্ত্রের যুগ। আমাদের কালচারকেও তাই গণ-ভিত্তিক হইতে হইবে। এটা কৃষি-যুগ নয়, এটা শিল্প-যুগ। কাজেই জনগণও আজ আর শুধু কৃষক নয়, তারা মিল-মজুরও বটে। শিল্পও আর শুধু আর্বান ইন্ডাস্ট্রী নয়, রুরাল ইণ্ডাস্ত্রীও তার শক্তিশালী শরিক। কালচারের ধারক যে পল্লীগ্রাম, তাও আর আগের পল্লী নাই। শহর ও পল্লীর ব্যবধান দ্রুত সংকীর্ণ হইতেছে। কালচার ও সিভিলিয়েশনের মধ্যে তাই নতুন করিয়া সমঝোতা হইতেছে। পাক-বাংলার কৃষ্টিক রেনেসাঁ হইবে এই পরিবেশে। সে কৃষ্টি-সাহিত্যের ইমারত গড়িয়া উঠিবে আধুনিক মাল-মসলাতেই। তার বুনিয়াদ হইবে পাক-বাংলার মাটিতে। রূপ-রস-গন্ধে হইবে তা অপূর্ব। সে কৃষ্টি-সাহিত্য রূপে হইবে বাংগালী, রসে হইবে তা মুসলিম, আর গন্ধে হইবে তা বিশ্বজনীন।