সমগ্র মানবসভ্যতার জন্যই পর্দা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। মানুষ তাঁর জাগতিক ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত থাকার কারণে সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে নিয়ে তাঁর শরীর আবৃত করে রাখার বিষয়টিকে মৌলিক একটি ব্যাপার হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ কারণে কিছু কিছু আদিম উপজাতি ছাড়া সমগ্র ইতিহাসকাল ধরে, সকল সংস্কৃতিতে, সকল সভ্যতায় এবং সকল আখলাকী ব্যবস্থায় মানুষের জন্য মূল বিষয় হল নিজেকে আবৃত করে রাখা। মানুষ, তাঁর শরীরকে আবহওয়ার বিরূপ প্রভাব থেকে কিংবা ঠাণ্ডা ও গরম থেকে রক্ষা করার জন্যই নয় একই সাথে আধ্যাত্মিক একটি মূল্যবোধকে সামনে রেখে নিজেকে আবৃত করে থাকে।

সমগ্র ইতিহাসকাল ধরে মানবসভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ পোশাক পরিচ্ছদের দিকে আরও বেশি গুরুত্বারোপ করেছে। সকলেই জানেন যে, আজ থেকে একশত বছর পূর্বেও নারীরা খ্রিষ্টান কিংবা ইয়াহুদী, যে ধর্মেরই হোক না কেন মুসলমান নারীদের মত তারাও পর্দা করত। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে শিল্প বিপ্লবের সাথে সাথে সকল ক্ষেত্রের মত এই ক্ষেত্রেও মানবতা অনেক বড় একটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আধুনিক সময়ে পর্দাকে এতটা প্রান্তিকীকরণ করা হয়েছে, যা জীবনের সাথে সম্পর্কহীন একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। একদিকে পর্দাকে তুচ্ছ ও প্রান্তিক বিষয় হিসেবে দেখানো হয়েছে আর অপর দিকে শরীর প্রদর্শনকে আকর্ষণীয় ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে দেখানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, আধুনিক সময়ে শোষণের একটি ক্ষেত্রে হিসেবে মানুষের শরীরকে বেঁছে নেওয়া হয়েছে। নারী, পুরুষ কিংবা শিশু সকলের শরীরকেই যথেচ্ছাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৫০ সালের দিকে শুরু হওয়া যৌন বিপ্লবের মাধ্যমে শরীরকে মালিকানাধীন একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা শুরু হয়। যা পরবর্তীতে শরীরকে একটি পণ্যে রূপান্তরিত করে এবং শরীর প্রদর্শন ফ্যাশনে পরিণত হয়। পরবর্তীতে ‘ফ্যাশন’, ‘স্বাধীনতা’ কিংবা সর্বজনীনতার নামে বিভিন্ন পন্থায় মানুষের সামনে এই যৌনতাকে তুলে ধরার ফলে সমগ্র দুনিয়াজুড়ে মানবতা আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সমস্যার সম্মুখীন।

ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে নতুন ভার্চুয়াল স্ক্রিন সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এই সভ্যতায় বিনোদন কেন্দ্রিক একটি ভিজ্যুয়াল ইদরাক প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। এই সভ্যতায় মানুষ; তাঁর নিজের সাথে, অন্যদের সাথে এবং মহাবিশ্বের সাথে সম্পর্ককে হাকীকতের উপর ভিত্তি করে নয় বরং চিত্র ও ছবির উপর ভিত্তি করে গড়ে তুলেছে। এই সভ্যতায় আকলের বদলে চোখ-ই হয়ে উঠেছে সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। একই এই সভ্যতার বড় কাজ হল, চিন্তা করার বদলে দেখা। অর্থাৎ এই ভার্চুয়াল স্ক্রিন সভ্যতা  আকলের উপর চোখকে এবং চিন্তা করার বদলে দেখাকে প্রাধান্য দিয়েছে। আর এই সভ্যতায় ‘চোখ’ নাজার ও মুশাহাদা (অবলোকন) – এর উপাদান হওয়ার পরিবর্তে কামনা-বাসনা ও শাহওয়াতের উপাদানে পরিণত হয়েছে। আর এই বিষয়টি পর্দার ফিতরাতী, দ্বীনী, আধ্যাত্মিক ও মেটাফিজিক্যাল অর্থকে হারিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে এবং ইলাহী উদ্দেশ্যকে বিলীন হওয়ার ক্ষেত্রে এমনকি আখলাকী ভিত্তি থেকেও সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। ভিজুয়াল ইদরাকের আধিপত্য এমন অনেক গায়রে আখলাকী বিষয়কে দৃশ্যায়িত করেছে যা আমাদের কল্পনারও অতীত। ভিজ্যুয়াল ইদরাকের আধিপত্য মানুষকে পণ্যরূপে উপস্থাপন করে তার গোপনীয়তাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। এমন অনেক ক্ষেত্র তৈরি করেছে যা মানুষকে সাময়িক কিছু আনন্দ দেয়, এবং তাকানোকে শাহাওয়াতে এবং দেখাকে কামনায় পরিণত করেছে। ভিজ্যুয়াল ইদরাকের আধিপত্য আকলের ইদরাককে দুর্বল করেছে, এবং কলবের ইদরাককে মৃত্যুঝুকিতে ফেলে দিয়েছে।

 

শুধুমাত্র ইসলামের অপরিবর্তনীয় ও শাশ্বত নীতিমালাসমূহ মানুষকে আবৃত হওয়ার দিকে আহবান জানিয়ে আধুনিকতা, বিশ্বায়ন ও ডিজিটালাইজশন কর্তৃক ছুড়ে এই সকল চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় মহাপর্বতের ন্যায় এসে দাঁড়িয়েছে। ইসলামের এই মূলনীতিগুলো চাচ্ছে মানুষকে হায়া ও সতীত্বের দিকে ফিরিয়ে আনতে। তবে আধুনিকতা, বিশ্বায়ন এবং ডিজিটালাইজেশন কর্তৃক সৃষ্ট চাপের পাশাপাশি নিম্নোক্ত কারণসমূহও এই একই সমস্যাকে আরও বেশী ঘনীভূত করেছে।

  • ১। আধুনিক সময়ে এসে নারী ও পর্দার বিষয়কে ইসলামের মূলনীতির আলোকে সঠিকভাবে বিনির্মাণ করতে ব্যর্থ হওয়া।
  • ২। মুসলমানদের নিকটে পর্দার হিকমত ও দর্শনকে ভালোভাবে তুলে ধরতে না পারা এবং এই ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করা।
  • ৩। পর্দাকে যেন শুধুমাত্র নারীদের জন্যই আবশ্যক এই ধারণার ব্যাপক প্রসার।
  • ৪। পর্দার ব্যাপারে পুরুষদের প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গি।
  • ৫। কখনো কখনো পর্দাকে নারীদের সামাজিক জীবনে অংশগ্রহণের একটি বিষয় হিসেবে না নিয়ে বরং সেটাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার একটি বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা।
  • ৬। নারীদের পর্দার পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হিজাবকে পরিত্যাগ করা এবং হিজাব ত্যাগ করাকে ব্যক্তিস্বাধীনতা হিসেবে উপস্থাপন করা।
  • ৭। হিজাব পরিধানকারী নারীদেরকে ইসলামের প্রতিনিধি রূপে তুলে ধরে তাঁদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা।

উপর যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, এই সকল বিষয়সমূহ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে পর্দার বিষয়টিকে আরও কঠিন করে ফেলেছে। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঘটে যাওয়া এই সকল সমস্যাসমূহ আসলে শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, একই সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাও। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে ধর্ম এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত হয়েছে। আর এই বিষয়টি হিজাবের বিষয়টির রূহ ও মাকসাদকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে প্রভাবিত করেছে এবং পর্দার আধ্যাত্মিক, রূহী এবং মেটাফিজিক্যাল ভিত্তিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

এই সকল বিষয়কে সামনে রেখে আমি ইসলামের পর্দা দর্শন এবং নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গি  এই বিষয়ে কিছু চিন্তা আপনাদের নিকটে পেশ করতে চাই।

ইসলামের সকল বিষয়কে নারীদেরকে কেন্দ্র করে আলোচিত হওয়ার ফলে আল্লাহর নারী বান্দাদের উপর যে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এই বিষয় সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। এই কারণে পর্দার বিষয়টিকে নারী কিংবা পুরুষকে কেন্দ্র করে নয়, বরং এই বিষয়টিকে আমি ‘মানুষ’ এর উপর ভিত্তি করে আলোচনা করতে চাই এবং আমি সুস্পষ্ট করতে চাই যে এই বিষয়টি শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের সাথে সম্পর্কিত বিষয় নয়। একই সাথে আমি এই বিষয়টিও তুলে ধরতে চাই যে পর্দার বিষয়টি অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক অর্থবোধক।

পর্দার বিষয়টিকে পাঁচটি দিক থেকে বিবেচনা করে পাঁচটি দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করানোর চেষ্টা করব। সেগুলো হলোঃ

  • ১. পর্দার ব্যাপারে ফিতরাতী দৃষ্টিকোণ  অর্থাৎ পর্দার স্বয়ং মানুষের সাথে সম্পর্কিত দিক।
  • ২. পর্দার ব্যাপারে কালামী দৃষ্টিকোণ অর্থাৎ মানুষের সাথে তার রবের সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্দা।
  • ৩. পর্দার ব্যাপারে ফিকহী দৃষ্টিকোণ, অর্থাৎ মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্দা ।
  • ৪. পর্দার ব্যাপারে আখলাকী দৃষ্টিকোণ , অর্থাৎ পর্দার নৈতিক দিক।
  • ৫. পর্দার ব্যাপারে নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ, অর্থাৎ পর্দার সৌন্দর্যগত, শোভাগত এবং চারিত্রিক দিক।

 

পর্দার ব্যাপারে ফিতরাতী দৃষ্টিকোণ

পর্দার বিষয়টি নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই ফিতরাতী একটি বিষয়। ফিতরাত হলো, সৃষ্টিগতভাবে মানুষকে দেওয়া মূল্যবোধের এক রত্নভাণ্ডারের নাম। অন্য কথায়, জন্মগতভাবে মানুষের মধ্যে আপলোডকৃত ইলাহী এক সফটওয়্যারের নাম হলো ফিতরাত। আবৃত করে রাখা, আদব, হায়া ও সতীত্বের মত অনুভূতিসমূহ মূলত এই মেমোরির মধ্যে তথা ইলাহী সফটওয়্যারের মধ্যে রক্ষিত মূল্যবোধ থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে। নিজের গোপনীয়তাকে রক্ষা করে যে ভালো, সঠিক ও সুন্দর এবং শরীর প্রদর্শন করা যে খারাপ, কুৎসিত ও ভুল,  এই সকল বিষয়সমূহ মানুষের এই মূল্যবোধের ভাণ্ডারের মধ্যে মওজুদ রয়েছে।

পর্দার ফিতরাতী দৃষ্টিকোণের সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যাকে আমরা কোরআনে কারীমে বর্ণিত হযরত আদম ও হযরত হাওয়ার কিসসার মধ্যে দেখতে পাই।[1]  এই কিসসা অনুসারে হযরত আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তায়ালা তাঁদেরকে সকল ধরণের নিয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাতে রাখেন এবং  তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন; ‘হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর। কিন্তু এ বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, হলে তোমরা অত্যাচারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ কিন্তু শয়তান তাঁদেরকে প্রতারিত করে এবং তাঁদের গোপনাঙ্গকে একে অপরের নিকটে উন্মুক্ত করার জন্য তাঁদেরকে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলে, “তোমাদের রব যে, তোমাদের এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করেছেন তার পেছনে এ ছাড়া আর কোন কারণই নেই যে, পাছে তোমরা ফেরেশতা হয়ে যাও অথবা তোমরা চিরন্তন জীবনের অধিকারী হয়ে পড়ো”। শয়তান কসম খেয়ে তাঁদেরকে বলে যে, “ আমি নিঃসন্দেহে তোমাদের কল্যাণকামী”। এই ভাবে আদম ও হাওয়া উভয়কেই প্রতারিত করতে সক্ষম হয় এবং নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার সাথে সাথে লজ্জাস্থান পরস্পরের সামনে খুলে যায়। অতপর তাঁরা নিজেদের লজ্জাস্থানকে আবৃত করার জন্য জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থানকে ঢাকার চেষ্টা চালায়। এমতাবস্থায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি কি তোমাদের এ গাছটির কাছে যেতে নিষেধ করিনি এবং তোমাদের বলিনি যে ,শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু”?  তাঁরাও বলে উঠে, “হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি৷ এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো, এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো ৷” কোরআনে কারীম এই কিসসাকে এই নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে শেষ করেছে,

 

يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا ۖ وَلِبَاسُ التَّقْوَىٰ ذَٰلِكَ خَيْرٌ ۚ ذَٰلِكَ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ

অর্থাৎ, হে বনী আদম! অবশ্যই আমরা তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি, তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকা ও বেশ-ভূষার জন্য। আর তাকওয়ার পোষাক, এটাই সর্বোত্তম। এটা আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহের অন্যতম, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।[2]

এ কিসসা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে বাশারিয়্যাত থেকে আদামিয়্যাতের দিকে এবং আদামিয়্যাত থেকে ইনসানিয়্যাতের দিকে যাত্রাকালে মানুষ সর্বপ্রথম যে বিষয়টিকে উপলব্ধি করে সেটা হল মানুষের ফিতরাতের মধ্যকার আবৃত করার বিষয়টি। আর বিষয়টি না শুধু নারীর জন্য আর না শুধু পুরুষের জন্য। আবৃত করার বিষয়টি নারী ও পুরষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই প্রযোজ্য একটি বিষয়।

আর আলোকে এই কথা বলা যায় যে, পর্দার বিষয়টি আসমানী একটি নিয়ামত। আবৃত করার বিষয়টি মানুষের জন্য একটি তাকওয়া অর্থাৎ রক্ষা করা, পরিশুদ্ধ করা, সুন্দর করা ও ইজ্জত সম্পন্ন করার একটি বিষয় হিসেবে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অন্যতম একটি নিয়ামত। এ নিয়ামতটি আমাদেরকে ইহসানের চেতনা দান করে এবং যেন আমরা সর্বদায় আল্লাহকে দেখছি এমন ভাবে আচরণ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে। আর এটা কেবলমাত্র তাকওয়ার পোশাক পরিধান করার মাধ্যমেই সম্ভব।

আর তাকওয়ার পোশাক কেবলমাত্র বাহ্যিক একটি পোশাক-ই নয়। তাকওয়ার পোশাক হল, মানুষকে স্বয়ং তার নিজের প্রতি, সৃষ্টিজগত ও রবের প্রতি দায়িত্ববান করে তোলা। আর এই দায়িত্ববোধ বাহ্যিক পোশাককে অর্থবহতা দান করে, পর্দার মধ্যে রূহ প্রদান করে এবং সকল প্রকার পর্দার চূড়া হলো এ দায়িত্ববোধ। তাকওয়ার পোশাক বিহীন শরীর রসকষবিহীন একটি অবয়ব ছাড়া আর অন্য কিছু নয়।

 

পর্দার ব্যাপারে কালামী দৃষ্টিকোণ

অনেকেই ধারণা করেন যে, পর্দা শুধুমাত্র মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিংবা নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ককে নিরূপণকারী একটি বিষয়। আসলে ব্যাপারটি এমন নয়। পর্দার একই সাথে আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে নিরূপণকারী একটি দিকও রয়েছে। কেননা মানুষ  ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক শুধুমাত্র খালেক-মাখলুক কিংবা রুবুবিয়্যাত-উলুহিয়্যাত- এর সম্পর্কই নয়। আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার এই সম্পর্ক একই সাথে শাহিদ-মাশহুদেরও সম্পর্ক। এ সম্পর্কের দাবি অনুযায়ী মানুষ সর্বদা আল্লাহকে স্মরণে রেখে পথ চলে। কোরআনে কারিমে এই সম্পর্ককে নিম্নোক্তভাবে  তুলে ধরা হয়েছেঃ

اَیَحۡسَبُ اَنۡ لَّمۡ یَرَهٗۤ اَحَدٌ

অর্থাৎ, সে কি ধারণা করে যে, তাকে কেহই দেখছেনা?[3]

وَ هُوَ مَعَکُمۡ اَیۡنَ مَا کُنۡتُمۡ ؕ

তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন। [4]

فَاَیۡنَمَا تُوَلُّوۡا فَثَمَّ وَجۡهُ اللّٰهِ

তোমরা যে দিকেই মুখ ফিরাও সেই দিকেই আল্লাহকে পাবে।[5]

শুধু তাই নয় শাহিদ ও মাশহুদের এই সম্পর্ক একটি মিসাক (শাহাদাতের মিসাক) এর উপর নির্ভর করে। এই মিসাকের আলোকে মানুষ তার সৃষ্টির পূর্বেও আলমে আরওয়াহ/রূহের জগতে তাঁর রবের একত্বে ও মহত্বে স্বাক্ষ্য প্রদান করেছে। কোরআনের ভাষ্যমতে,

وَ اَشۡهَدَهُمۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ ۚ اَلَسۡتُ بِرَبِّکُمۡ ؕ قَالُوۡا بَلٰی ۚۛ شَهِدۡنَا

অর্থাৎ, আর তাদেরকেই সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ; এ ব্যাপারে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’[6]

আর সৃষ্টির পরে দুনিয়াতে এসেও মানুষ তাঁর মহান প্রভুর নাম, আয়াত, সিফাত ও নিয়ামতসমূহকে অবলোকন করছে। আল্লাহ তায়ালাও তাঁর বান্দার সকল অবস্থা, কাজ, নিয়ত ও গোপন বিষয়ের সাক্ষী। “ وَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ شَهِیۡدٌ /আর আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ের প্রত্যক্ষদর্শী”।[7] যার কারণে পর্দা শুধুমাত্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ‘আমার চোখে’ কিংবা বাহিরের ‘অন্যদের চোখে’ কেমন লাগলো এর সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়-ই নয়, আমার রব আমাকে কেমন দেখছেন এর সাথেও এই বিষয়টি সম্পর্কিত। কেননা কোন দৃষ্টি-ই মহান প্রভুর দৃষ্টির চেয়ে অধিক মূল্যবান নয়। কলবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দরজা হলো চোখ। এ চোখকে যারা রক্ষা করতে পারবে তাঁরা আল্লাহর নজরগাহ হিসেবে আখ্যায়িত কলবকেও রক্ষা করতে পারবে। হাদীসে যেমনটা বর্ণিত হয়েছে; “إِنَّ اللهَ تعالى لَا ينظرُ إلى صُوَرِكُمْ وَأمْوالِكُمْ ، ولكنْ إِنَّما ينظرُ إلى قلوبِكم وأعمالِكم / নিশ্চয় আল্লাহ দৃষ্টি দিবেন না তোমাদের শরীর এবং তোমাদের আকৃতির দিকে, বরং দৃষ্টি দিবেন তোমাদের অন্তর ও তোমাদের কর্মসমূহের দিকে”।

এখানে আমাদের মনে এমন একটি প্রশ্নের উদ্রেক হতে পারেঃ “ অগণিত গ্যালাক্সির স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা আমার পোশাক-আশাক কিংবা চুলের স্টাইলের দিকে কেনই বা নজর দিবেন?” এখানে মূল বিষয়টি আসলে পোশাক-আশাক কিংবা চুল দাঁড়ির সাথে সম্পর্কিত নয়। এখানে মূল বিষয়টি আসলে মানুষকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও হিকমতের সাথে সম্পর্কিত। কেননা মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য ও হিকমত সম্পর্কে অবহিত করেছেন এবং তাঁদের ফিতরাতের মধ্যে যে মূল্যবোধ দিয়েছেন সেই মূল্যবোধের দাবির আলোকে বসবাস করতে বলেছেন। তাঁরা তাঁদের রবের উপর ঈমান আনবে কি আনবে না এটা তাঁদের স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। পর্দা ও শরীরকে আবৃত করে রাখার বিষয়টিও মহান প্রভুর পক্ষ থেকে মানুষের নিকট চাওয়া সেই সকল মূল্যবোধসমূহের মধ্যকার একটি । মূলত, পর্দার বিষয়টিকে শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের জন্য সীমাবদ্ধ একটি বিষয় বলে ধারণা করার কারণে অনেকেই এই ধরণের প্রশ্ন করে থাকেন। অনেকেই আবার আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে পর্দাকে শুধুমাত্র নারীদের একটি দায়িত্ব হিসেবে দেখে থাকেন। বিশেষ করে আধুনিক সময়ে পর্দাকে বাহ্যিক একটি বিষয় হিসেবে উত্থাপন করে একে আদর্শিক একটি  সংঘর্ষের বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। যা খুবই বিপদজনক একটি দৃষ্টিভঙ্গী। অথচ পর্দা আদর্শিক (Ideological) কোন প্রতীক নয়; পর্দা হল বিশ্বাস, ইজ্জত-আব্রু ও সম্মানের প্রতীক। ফিতরাত, ইজ্জত, সতীত্ব, ব্যক্তিত্ব ও ইস্তিকামাতের বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশের নাম হল পর্দা। এর আলোকে পর্দা আদবকে সজ্জিত করে এবং মানুষকে পরিশুদ্ধ একটি রূহের মাধ্যমে বসবাস করতে সাহায্য করে। পর্দা নিভপ্ল একটি আলামত কিংবা কোন প্রতীক নয়, পর্দা হল একটি আয়াত। প্রতীক হল জাগতিক ও শারীরিক একটি বিষয় অপরদিকে আয়াত হলো আধ্যাত্মিক ও রূহী একটি বিষয়!

 

পর্দার ব্যাপারে ফিকহী দৃষ্টিকোণ 

আমাদের অধিকাংশ আলেম-ই পর্দার প্রকৃতি ও সীমানাকে, শুধুমাত্র নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়ে আওরাত ও ফিতনার উপর ভিত্তি করে বিনির্মাণ করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কোরআন ও সুন্নতের নির্ধারিত সীমাকে অতিক্রম করে আঞ্চলিক ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কিত বিষয়কে দ্বীনি বিধানের সাথে সম্পর্কিত করে দেওয়া হয়েছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, পর্দার ব্যাপারে পুরুষদের অসামঞ্জস্যতাকে বৈধতাদানকারী, পুরুষদেরকে কেন্দ্রে রেখে পর্দার ব্যাপারে যে দৃষ্টিভঙ্গি  দাঁড় করানো হয়েছে সেটা ধর্মীয় নয় বরং সাংস্কৃতিক। পর্দাকে যদি শুধুমাত্র আওরাত[8] ও ফিতনা নামক পরিভাষাদ্বয় এর উপর ভিত্তি করে পর্যালোচনা করা হয় তাহলে,

  • ১। পর্দাকে কেবলমাত্র নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ককে বিন্যস্তকারী একটি বিষয় হিসেবে দেখা হবে।
  • ২। পুরুষরা যেন ফেতনায় পতিত না হয় এই কারণে নারীদেরকে পর্দা করার আদেশ করা হয়েছে, এমন একটি ধারণা তৈরি হবে। অথচ এরকম চিন্তা ইলাহী হিকমতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
  • ৩। পর্দার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বাহ্যিক বিষয় সমূহকেই আবশ্যকীয় বলে পালন করা হবে এবং পর্দার রূহকে উপেক্ষা করা হবে।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে প্রথমে পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,

قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنِیۡنَ یَغُضُّوۡا مِنۡ اَبۡصَارِهِمۡ وَ یَحۡفَظُوۡا فُرُوۡجَهُمۡ

অর্থাৎ, মুমিন পুরুষদেরকে বল, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের সতীত্বের হেফাযত করবে। [9]

পুরুষদের পরে নারীদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

وَ قُلۡ لِّلۡمُؤۡمِنٰتِ یَغۡضُضۡنَ مِنۡ اَبۡصَارِهِنَّ وَ یَحۡفَظۡنَ فُرُوۡجَهُنَّ

অর্থাৎ, আর মুমিন নারীদেরকে বল, যেন তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের সতীত্বের হেফাযত করে।[10]

এই সকল আয়াতকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে পর্দার বিষয়টি শুধুমাত্র নারীদের জন্যই নয় পুরুষদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ তায়ালা নারী ও পুরুষ একে অপরকে পরস্পরের জন্য পর্দা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মহান প্রভুর ভাষায়, “ هُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّهُنَّ / তারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদ”। [11]

খাজানের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফ তাঁর কোরআনে কারীমের আয়াতের নূরের আলোকে খাতুন  নামক গ্রন্থে বলেন, ““আমাদের আলেমগণ পর্দা সংক্রান্ত সকল বিধানসমূহকে ‘ফিতনার ভয়’- এর মত ধারণামূলক একটি হিকমতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করার কারণে এ বিধানসমূহ কখনো কখনো এমনভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে নারীগণ সূর্যের নূর থেকে জ্ঞানের আলো পর্যন্ত অনেক বিষয় থেকেই বঞ্চিত হয়েছে। অথচ, জ্ঞান ও ঈমানের আলো কখনো ফিতনা হতে পারেনা। যদি ফিতনা থেকেই থাকে তা থাকার সম্ভাবনা পুরুষদের চোখে, অন্তরে ও ভাষায়। তাই ফিতনা থেকে যদি নিষ্কৃতি পেতেই হয়, তবে পুরুষদের চোখে নিকাব, কলবে আদব এবং মুখে লাগাম লাগানোই হবে মোক্ষম তদবীর।

এ কারণে সকল আসমানী দ্বীন কর্তৃক গৃহীত পর্দাকে কেবল ফিতনার সাথে সম্পর্কিত করার অধিকার কারোর-ই নেই। কেননা ইসলাম আনীত পর্দার বিধানটি শুধুমাত্র নারীদের মুখমণ্ডল ও শরীরের সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়-ই নয়, একই সাথে তা তাঁদের সম্মান-মর্যাদা ও অধিকারের সাথেও সম্পর্কিত। পর্দাকে কখনোই “ আওরাতের পর্দা” হিসেবে আদেশ করা হয়নি। পর্দাকে সম্মানের প্রতীক, ইসমাতের চাদর এবং সম্মানের ইহরাম হিসেবে ফরজ করা হয়েছে। ঘরের মধ্যে নারীরা যে অংশে অবস্থান করেন সেই অংশকে হেরেম বলার কারণ হল হুরমাত বা  সম্মানের কারণে। কাবাকে যে উদ্দেশ্যে হারাম বলা হয়ে থাকে, নারীরা যে ঘরে অবস্থান করে সেই ঘরকেও এজন্যই হারাম বা হারেম বলা হয়ে থাকে”।

সংক্ষেপে বলতে গেলে উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহ মতে ইসলামের পর্দার বিষয়টি সকলের জন্যই আবশ্যকীয়। যা নারী ও পুরুষ উভয়কেই পরিগ্রহ করে থাকে। হায়া ও সতীত্বকে রক্ষা করা এবং এ চেতনাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব শুধুমাত্র নারীদের-ই নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের উপরেই এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে যে পার্থক্য সেটা পর্দার সীমা ও পরিসীমার সাথে সম্পর্কিত। যেমনটা আয়াতের ধারাবাহিকতায় এসেছে, “  وَ لۡیَضۡرِبۡنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوۡبِهِنَّ / তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে”।[12] এ আদেশের মাধ্যমে হিজাবকে নারীদের জন্য পর্দার একটি পরিপূরক বিষয় হিসেবে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

পর্দার ব্যাপারে যে ফিকহী দৃষ্টিকোণ রয়েছে তাঁর মধ্যে অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ণ একটি বিষয় হল মানুষ ও তাঁর শরীরের মধ্যকার সম্পর্ক। প্রথমত আমি বলতে চাই যে, মানুষ ও তাঁর শরীরের মধ্যকার যে সম্পর্ক, তা মালিকানার কোন সম্পর্ক নয়। এই সম্পর্ক হল আমানতের সম্পর্ক। আধুনিক সময়ে আমরা একটি কথা অনেক বেশী শুনে থাকি, সে কথাটি হলো, “ শরীর আমার এটাকে ইচ্ছামত ব্যবহার করার অধিকারও আমার”। এটাকে অনেক সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে  ব্যক্তি স্বাধীনতা হিসেবে পেশ করা হয়ে থাকে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানুষের সাথে তাঁর রবের যে মিসাক (চুক্তি) তাঁর মধ্যে অন্যতম একটি হলো আমানতের চুক্তি (মিসাক)। এ মিসাক বা চুক্তি অনুযায়ী সকল কিছুকেই মানুষের নিকটে আমানত হিসেবে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বজগতের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক সেই সম্পর্ক প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা মালিকানার সম্পর্ক নয়। মানুষের সাথে মহাবিশ্বের যে সম্পর্ক সে সম্পর্ক হলো আমানতের সম্পর্ক। ফলশ্রুতিতে শরীর আমাদের মালিকানাধীন কোন বিষয় নয়, আমাদের নিকট আমানত।

এ মিসাকের  (চুক্তি) মাধ্যমে আমরা সাক্ষ্য দিয়ে থাকি যে আমরা আমাদের শরীরের উপর আধিপত্য ও প্রভুত্ব কায়েম করব না। আমরা বুঝতে পারব যে, “ শরীর আমার এটাকে ইচ্ছামত ব্যবহার করার অধিকারও আমার”, এ কথা বলার অধিকার আমাকে দেওয়া হয়নি। আমি উপলব্ধি করতে পারব যে, আমি আমাকে অন্যের সামনে একটি পণ্য হিসেবে তুলে ধরতে পারি না। এই মিসাক আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, আমার শরীর হল আমার নিকট রাখা একটি আমানত এবং কোন অবস্থাতেই আমি এই আমানতের খেয়ানত করতে পারি না। যেমনটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে বলেছেন,

 “ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَخُوۡنُوا اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ وَ تَخُوۡنُوۡۤا اَمٰنٰتِکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ

তোমরা জেনে বুঝে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করো না, আর যে বিষয়ে তোমরা আমানাত প্রাপ্ত হয়েছ তাতেও বিশ্বাস ভঙ্গ করো না”। [13]

পর্দার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অপর একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি হলো, পর্দাকে এমনভাবে তুলে ধরা যা নারীদেরকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই ক্ষেত্রে “ নারীদের আওয়াজ হলো আওরাত, তাঁদের মুখমণ্ডল ও হাত-পা হলো আওরাত” এ ধরণের আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাবের বিষয়টি লক্ষ্যনীয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে , “وَ لَا یُبۡدِیۡنَ زِیۡنَتَهُنَّ اِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَا / তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে” এই কথা বলার পরেও, এবং রাসূলুল্লাহ (স) হযরত আবু বকরের (রা) কন্যা, হযরত আসমার (রা) উপর ভিত্তি করে নারীদের পর্দার সীমানাকে উম্মতের সামনে সুস্পষ্ট করে দেওয়ার পরেও[14] বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলে কিছু কিছু আঞ্চলিক পোশাকের উপর ভিত্তি করে জনপরিসরে নারীদের উপস্থিতি ও অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দেওয়ার মত প্রান্তিক চিন্তাকে মেনে নেওয়া হয়েছে। অথচ নারীদেরকে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী রেখে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা পর্দার উদ্দেশ্য নয়। পর্দার উদ্দেশ্য হলো নারীগণ যেন নিরাপত্তা ও শালীনতার সাথে সমাজের সকল স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এবং নর ও নারী উভয়ের জন্যই এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যেখানে তাঁরা মানবিক মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে কাজ করতে পারবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভালো কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ করা এবং দ্বীনের রহমত ও হিকমতকে প্রচারের দায়িত্ব নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়কেই দিয়েছেন। মহান প্রভুর ভাষায়ঃ

وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ۘ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ یُطِیۡعُوۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ ؕ اُولٰٓئِکَ سَیَرۡحَمُهُمُ اللّٰهُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ

অর্থাৎ “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা নামাজ আদায় করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে।আল্লাহ শীঘ্রই এদের উপর দয়া (মারহামাত) করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

পর্দার ব্যাপারে আখলাকী দৃষ্টিভঙ্গী

প্রথমত এই বিষয়টি সুস্পষ্ট করা প্রয়োজন যে, দ্বীন ইসলামে আখলাক ফিতরাতের থেকে, কালাম কিংবা ফিকহ থেকে আলাদা বিভাগে অবস্থানকারী কোন বিষয় নয়। জোর দিয়ে বলতে চাই যে, “ কোন কিছু  আখলাকী” এর অর্থ মোটেই এই নয় যে তা ঐচ্ছিক একটি বিষয়”। কোন কিছু আখলাকী এর অর্থ হলো, তা আবশ্যক একটি বিষয়। যারা আখলাককে ‘হলেও চলবে না হলেও চলবে’ এমন একটি বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন তাঁরা মূলত দ্বীনের মধ্যে আখলাকের অবস্থানকে নির্ণয় করতে পারেন না। কেননা ইসলামে আখলাক পরিপূর্ণতাদানকারী কোন বিষয় নয়, আখলাকের বিষয়টি অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়। অনুরূপভাবে একথা বলাও সম্ভবপর নয় যে, দ্বীন ও আখলাক আলাদা আলাদা বিষয়। দ্বীন থেকে আখলাককে আলাদা করে ফেলার অর্থ হল, স্বয়ং দ্বীনকেই আলাদা করে ফেলা। দ্বীন ও আখলাক যেমন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ অনুরূপভাবে দ্বীনের আহকাম কেও আখলাক থেকে স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করা যায় না। কেননা, “ الاخلاق عقل الأحكام / আখলাক হলো, আহকামের আকল”।  পর্দার আখলাকী ভিত্তি হলো হায়া। আমরা অনেকেই মনে করে থাকি যে, হায়া মানে হল লজ্জাশীলতা, আসলে তা নয়। হায়ার অর্থ আরও অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। হায়া ও হায়াত একই উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে। হায়ার অপর নাম হল হায়াত। হায়া অনেকটা তাকওয়ার মত আল্লাহর প্রতি দায়িত্বানুভূতির চেতনা। হায়া স্বয়ং কল্যাণ।[15] হায়া হল কুল্লি একটি আখলাক। কুৎসিত, অসুন্দর ও  বিষয় থেকে বিরত থাকা এবং ভাল, সুন্দর ও সঠিককে মেনে চলার নাম হল হায়া। হায়া হল এমন এক চেতনার নাম, যে চেতনা আমাদেরকে খারাপের দিকে ধাবিত হওয়া থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহ যে আমাদের সব কিছুই দেখছেন এ বিষয়কে স্মরণ করিয়ে দিবে। অপরদিকে পর্দা ও হিজাব মানুষের হায়াকে লালিত করে। আর রূহ এখান থেকে উপকৃত হয়ে থাকে। রূহ হল পানির মত। যে পাত্রে যায় এই পাত্রের-ই আকার ধারণ করে।

রাসূলে আকরাম  (স) একটি হাদীসে হায়াকে, ইসলামের মূল আখলাক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর ভাষায়, “ إنَّ لِكُلِّ دينٍ خُلُقًا، وإنَّ خُلُقَ الإسلامِ الحياءُ / প্রতিটি দ্বীনের-ই মৌলিক একটি আখলাক রয়েছে। ইসলামের মূল আখলাক হল হায়া”।[16] এর আলোকে হায়া শুধুমাত্র একটি মূল্যবোধের নাম নয়। হায়া হল মূল্যবোধ উৎপাদনকারী কুল্লি একটি আখলাকের নাম।

রাসূল (স) হায়া ও ঈমানকে একে অপরের থেকে আলাদা কোন বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেননি। তিনি বলেন,

الحياء شعبة من الإيمان

অর্থঃ হায়া হলো ঈমানের একটি শাখা।[17]

الحياء من الإيمان

অর্থঃ হায়া হলো ঈমানের অংশ।[18]

الحياءُ والإيمانُ قرناءُ جميعًا فإذا رُفِع أحدُهما رُفِع الآخرُ

অর্থঃ ঈমান ও হায়া হলো ভাইয়ের মত। একটি চলে গেলে অপরটিও চলে যায়।[19]

রাসূলে করীম (সঃ) হায়াকে অন্য একটি হাদীসে সকল পয়গাম্বর কর্তৃক আনীত অভিন্ন একটি মূল্যবোধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

إِنَّ مِمَّا أَدْرَكَ النَّاسُ مِنْ كَلَامِ النُّبُوَّةِ الْأُولَى: إِذَا لَمْ تَسْتَحى فاصنعْ مَا شئْتَ

অর্থাৎ, সমগ্র মানবতা, প্রথম দিন থেকে এমন একটি কথা জানেন যে কথার ব্যাপারে সকল পয়গাম্বর ঐকমত্য পোষণ করেছেন সেটা হলো, যদি হায়া না থাকে তাহলে যা ইচ্ছা তাই করতে পার।[20]

৫। পর্দার ব্যাপারে নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ

দ্বীনের প্রতিটি হুকুমের-ই নান্দনিক বা সৌন্দর্যগত একটি দিক রয়েছে। ইসলামের প্রতিটি বিধানের ক্ষেত্রেই আল্লাহর জামাল নামের একটি প্রতিফলন দেখা যায়। একজন ব্যক্তি যখন শাহাদাতের চেতনার অধিকারী হয় তখন সে এমন এক অস্তিত্বের প্রতি ঈমান আনে যা তাঁকে প্রতিমুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করছে। আখলাকী মূল্যবোধ ও দ্বীনের বিধানসমূহকে শুধুমাত্র কামাল (পরিপূরক) হিসেবেই নয়; জামাল হিসেবেও দেখে থাকে এবং এই জামাল মানুষের মধ্যে জ্ঞান, হিকমত, মারেফত ও মুহাব্বতে রূপান্তরিত হয়।

পর্দার দায়িত্ব শুধুমাত্র শরীরকে ঢেকে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পর্দার একই সাথে নান্দনিক ও সৌন্দর্যগত একটি দিক রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, “ قَدۡ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکُمۡ لِبَاسًا یُّوَارِیۡ سَوۡاٰتِکُمۡ وَ رِیۡشًا / আমি তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করার ও শোভা বর্ধনের জন্য তোমাদের পোশাক পরিচ্ছদের উপকরণ অবতীর্ণ করেছি”। এই আয়াতের দিকে তাকালে দেখা যায় মানুষের জন্য পর্দার একই সাথে  সৌন্দর্যগত একটি দিকও রয়েছে। আয়াতে উল্লেখিত رِیۡشً/রিশ শব্দের শাব্দিক অর্থ হল পাখির পালক। কোরআনের ভাষায় রিশ দ্বারা সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার সর্বোচ্চ চূড়া বুঝানো হয়ে থাকে। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযীর ভাষায়, رِیۡشً/রিশ হল পর্দার সৌন্দর্যগত দিক। অর্থাৎ رِیۡشً/রিশ যিনাতেরও উপরের একটি সৌন্দর্যকে বুঝিয়ে থাকে। তবে কোরআনে রিশ শুধুমাত্র বাহ্যিক সৌন্দর্যকেই নয়, আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যকেও ব্যক্ত করে থাকে। অপর একটি আয়াতে মহান রব কাবা ঘরকে উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফকারী জাহেলী সমাজকে এই অবস্থা থেকে বিরত রাখার জন্য বলেছেন, “یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ خُذُوۡا زِیۡنَتَکُمۡ عِنۡدَ کُلِّ مَسۡجِدٍ / হে আদম সন্তান! মসজিদে যাওয়ার সময় সাজসজ্জা করো”। [21] এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখাকে লঙ্ঘন না করা। তাছাড়া এখানে নির্দিষ্ট কোন অবয়ব কিংবা পোশাকের কথা বলা হয়নি। অন্যথায় আবহাওয়া ও সংস্কৃতির ভিন্নতার কারণে পোশাক আশাকে ভিন্নতা একটি রহমত স্বরূপ। ইসলাম পোশাকে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন পোশাক বা ধরণ চাপিয়ে দেয়নি। ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখাকে মেনে চলার পরও যদি কেউ কারোর উপর পোশাকের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন ধরণকে চাপিয়ে দেয়, তাহলে সেটা হবে এই রহমতকে লঙ্ঘন করার শামিল।

আল্লামা ত্বহা আব্দুর রহমানের ভাষায় দুই ধরণের সৌন্দর্য রয়েছে। একটি হল ভেনাসী সৌন্দর্য অপরটি হলো ইউসুফী সৌন্দর্য

ভেনাসী সৌন্দর্য, তার নামকে তিনি রোমের পৌরাণিক কাহিনীতে ( Roman Mythology)[22] আলোচিত প্রেম, সৌন্দর্য ও কামনার দেবী ভেনাস থেকে নিয়েছেন। আর সেটা গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে (Greek Mythology) আলোচিত আফ্রোদিতি থেকে এসেছে। এটার দ্বারা শুধুমাত্র শারীরিক ও বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বুঝানো হয়ে থাকে। আর এর উৎস হলো জাগতিক আবেগ ও অনুভূতি। এটা শুধুমাত্র আবেগকে উদ্বেলিত করে থাকে, প্রভাবিত করে, কিন্তু প্রতারণামূলক। মানুষকে বস্তুগত জগৎ বাহ্যিকতার মধ্যে বন্দী করে ফেলে

অপরটি হল ইউসুফী সৌন্দর্য এই সৌন্দর্যের নামকে তিনি হযরত ইউসুফ (আ) থেকে নিয়েছেন। ইউসুফী সৌন্দর্যের ভিত্তি হল, শারীরিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি রূহী সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্যের মধ্যে আনন্দের চেয়ে চোখের নূর ও কালবের প্রশান্তি রয়েছে। এই সৌন্দর্য শুধুমাত্র বাসারকেই (দৃষ্টিকেই) নয়, বাসিরাতকেও (দূরদৃষ্টি) উদ্দেশ্য করে কথা বলে। প্রভাবিত করে কিন্তু প্রতারিত করে না। মানুষকে সুন্দর ও নান্দনিকতার দিকে পরিচালিত করে। হাদীসের ভাষ্য মতে, “إنَّ اللهَ جميلٌ يُحبُّ الجمالَ / আল্লাহ তায়ালা সুন্দর তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন”।[23]

সাহিত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ব্যাখ্যানুসারে হযরত ইউসুফের তিনটি পোশাক পর্দার তিনটি ধরণ ও তিন বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করে থাকে।

প্রথমটি হল মিথ্যাবাদী পোশাক। ‘ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে’ এই কথা বলার জন্য ইউসুফ (আ) এর ভাইয়েরা তাঁদের বাবার নিকট রক্তমাখা যে পোশাক নিয়ে যায় এই পোশাক। “ وَ جَآءُوۡ عَلٰی قَمِیۡصِهٖ بِدَمٍ کَذِبٍ ؕ / আর তারা তার জামায় মিথ্যা রক্ত লাগিয়ে নিয়ে এসেছিল”।[24]

দ্বিতীয় পোশাক হলো, ছেঁড়া পোশাক কিন্তু সেই শার্ট সামনে থেকে নয়, বরং পেছন থেকে ছেঁড়া ছিলো। সে পোশাক ছিলো এমন পোশাক যা তাঁর পরিধানকারীকে ফিতনা থেকে রক্ষা করে হায়া’র দিকে ধাবিত করেছিলো। “وَ اِنۡ کَانَ قَمِیۡصُهٗ قُدَّ مِنۡ دُبُرٍ فَکَذَبَتۡ وَ هُوَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ  / আর তার জামা যদি পেছন থেকে ছেঁড়া হয় তাহলে সে (মহিলা) মিথ্যা বলেছে এবং সে (পুরুষ) হচ্ছে সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত”।[25]

তৃতীয় পোশাক হলো, অন্ধ চোখকে উন্মীলিতকারী পোশাক। এ পোশাকের আধ্যাত্মিক একটি ঘ্রাণ ও সুন্দর একটি দিক রয়েছে। যা চোখকে খুলে দেয় এবং বাসিরাতকে (দূরদৃষ্টি) বৃদ্ধি করে। এর ঘ্রাণ এমনকি হযরত ইয়াকুবের অন্ধ হয়ে যাওয়া চক্ষুকে খোলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়েছিলো। আর এটা হল এমন জামা যা চক্ষুকে উম্মুক্ত করে দেয় এবং বাসিরাতকে লালিত করে। “اِذۡهَبُوۡا بِقَمِیۡصِیۡ هٰذَا فَاَلۡقُوۡهُ عَلٰی وَجۡهِ اَبِیۡ یَاۡتِ بَصِیۡرًا / তোমরা আমার এ জামাটি নিয়ে যাও, অতঃপর সেটি আমার পিতার চেহারায় স্পর্শ করাও। এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন”। [26]

 

প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি জানি যে সকল বিষয়ের মত পর্দা নিয়েও তোমাদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। আর এর পেছনে অনেক অভ্যন্তরীণ ও বহির্গত কারণ রয়েছে সেটাও আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে নয়। আমাদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা ও পর্যালোচনাসমূহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের এই সকল জেরা ও জিজ্ঞাসাসমূহ যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং আমাদেরকে আমাদের রবের দিকে ধাবিত করে। অন্যথায় এসকল জিজ্ঞাসা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ বিশৃঙ্খলা ছাড়া আর অন্য কোনকিছু বয়ে আনবে না। যেসকল আত্মজিজ্ঞাসা ও বিশ্লেষণ আমাদের মূল্যবোধকে বিনাশ করে দেয় তা সঠিক কোন জিজ্ঞাসা বা বিশ্লেষণ হতে পারে না।

হিজাব কিংবা পর্দাকে ছেড়ে দেওয়া শুধুমাত্র হিজাব ও পর্দাকে ছেড়ে দেওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। কেননা পর্দা হলো মহান প্রভুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধার একটি বহিঃপ্রকাশ। পর্দা মানুষকে তার অবস্থান সম্পর্কে  সচেতন করে তুলে এবং মানুষকে মর্যাদাপূর্ণ একটি জীবনধারা অর্জনে সাহায্য করে। আর এ ক্ষেত্রে শুধু পর্দা করলে কিংবা হিজাব পরিধান করলেই হবে না, আমি কেন পর্দা করি, কেন হিজাব পড়ি এই বিষয়কে কোরআনের আলোকে জানতে হবে এবং আল্লাহর আখলাককে আখলাকাসম্পন্ন হতে হবে। আমরা যদি এই চেতনাকে ধারণ পর্দা করতে পারি তখন-ই কেবলমাত্র আমাদের নিজেদেরকে ইস্তেকামাতের পথে দৃঢ় রাখতে পারবো।

সমাজবিজ্ঞানে হাবিটাস (Habitus) নামে একটি পরিভাষা রয়েছে। হাবিটাস (Habitus)  ব্যক্তির আচরণকে প্রভাবিতকারী এবং আমরা যে সমাজে বসবাসকরী সেই সামাজিক জীবন। বিগত শতাব্দী পর্যন্ত  হাবিটাস (Habitus) ছিল পর্দার প্রভাবাধীন, অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ-ই পর্দা করত। কিন্তু আধুনিকতার প্রভাবে এই হাবিটাস (Habitus)- এ পরিবর্তন এসেছে এবং মানুষ পর্দাকে পরিত্যাগ করে শরীর প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আমি জানি আমাদের তরুণ-তরুণীরা স্বাধীনতাকে অনেক বেশী পছন্দ করে। তবে নফসের নিকট আত্মসমর্পণ করার নাম স্বাধীনতা নয়। অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠদের অনুসরণ করে জনপ্রিয় সংস্কৃতির আলোকে মেনে  জীবন পরিচালনা করাকেও স্বাধীনতা বলে না। সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা হলো, আমাদের উপর বৈশ্বিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া এই সকল হাবিটাস (Habitus)- এর নিকটে আত্মসমর্পণ না করা

 

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

 

তথ্যসূত্রঃ

[1] সূরা আরাফ, ১৯-২৩।

[2] আরাফ, ২৬।

[3] বালাদ, ৭

[4] হাদিদ, ৪

[5] বাকারা, ১১৫।

[6] আরাফ, ১৭২।

[7] বুরুজ, ৭।

[8] আওরাত বলতে আমাদের ভাষায় মেয়েলোক বা নারী জাতি বুঝায়। কিন্ত আরবী ভাষায় এর মানে হয় বাধা ও বিপদের জায়গা এবং যে জিনিসের খুলে য়াওয়া মানুষের জন্য লজ্জার ব্যাপার এবং যার প্রকাশ হয়ে পড়া তার জন্য অস্বস্তিকর হয় এমন জিনিসের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া কোন জিনিসের অসংরক্ষিত হওয়া অর্থেও এর ব্যবহার হয়। (অনুবাদক)

[9] নূর, ৩০।

[10] নূর, ৩১।

[11] বাকারা, ১৮৭।

[12] সূরা নূর, ৩১।

[13] আনফাল, ২৭।

[14] আবু দাউদ, লিবাস, ৩১।

[15] মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, ৩৭।

[16] ইবনে মাজা, যুহুদ, ১৭।

[17] মুসলিম, ঈমান, ৫৮; নাসাঈ, ঈমান, ১৬।

[18] মুসলিম, ঈমান, ৫৯।

[19] হাকিম, মুসতাদরাক, ৫৮।

[20] বুখারী, আদব, ৭৮।

[21] আরাফ, ৩১।

[22] Venus is a Roman goddess, whose functions encompass love, beauty, desire, sex, fertility, prosperity, and victory. In Roman mythology, she was the ancestor of the Roman people through her son, Aeneas, who survived the fall of Troy and fled to Italy. Julius Caesar claimed her as his ancestor. Venus was central to many religious festivals and was revered in Roman religion under numerous cult titles. (অনুবাদক)

[23] মুসলিম, ঈমান, ১৪৭।

[24] ইউসুফ, ১৮।

[25] ইউসুফ,২৭ ।

[26] ইউসুফ,৯৩ ।

৩৩৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top