খোদাহীন-ধর্মহীন নীতিদর্শনের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আমরা বলে এসেছি যে, প্রাচীন গ্রীসের নীতিদার্শনিক কিংবা বর্তমান ইউরোপ-আমেরিকার নীতিবিজ্ঞানী—যাঁরাই হোন, তাঁদের জন্যে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এই যে, তাঁরা বিশ্বস্রষ্টার জারী করা বিশ্ব-প্রকৃতিতে বিরাজিত ও সদা কার্যরত নিয়মের অধ্যয়ন ও গবেষণায় যতই ব্যতিব্যস্ত হোন না কেন, মানুষের জন্য বিশ্বস্রষ্টার নাযিল করা আইন-বিধান অধ্যয়ন ও অনুধাবনে তাঁরা কিছুমাত্র আগ্রহী নন। এ কারণে যে সব জটিল ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে বিবেক-বুদ্ধি সম্পূর্ণ অকেজো প্রমাণিত, সেই সব ক্ষেত্রেও তাঁরা অনুরূপতা (Analogy) ও তত্ত্বানুসন্ধানের (Investigation, searching) তীর অন্ধভাবে নিক্ষেপ করে প্রকৃত সত্য পথের সন্ধান করতে সচেষ্ট। এরই ফলে মানুষের নৈতিকতার (Ethics) গোটা ব্যাপারটিই অর্থহীন ও নিষ্ফল তর্ক-বিতর্কে পরিণত হয়েছে। তার দ্বারা মৌলিক প্রশ্নের জবার পাওয়া বা আসল সমস্যার সমাধান হওয়া একেবারেই সম্ভব হয়নি। মানবতার ইতিহাস অধ্যয়নের মাধ্যমে আমরা নিঃসন্দেহে জানতে পারি যে, আল্লাহর নাযিল করা ওহী ও বিধান ছাড়া বিশ্ব-মানবতার নৈতিক সমস্যার কোন সমাধান কোন কালেই পাওয়া যায়নি, নৈতিকতা সংক্রান্ত কোন প্রশ্নের নির্ভুল জবাব দেয়া আর কারোর পক্ষেই সম্ভব হয়নি। বর্তমানে মানবতা যে পরিমণ্ডলে জীবন অতিবাহিত করছে, তার পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনাও আমাদেরকে বলে দিচ্ছে, এই সমস্যাটির সমাধানে এই প্রশ্নটির জবাব পেতে মানুষের কোন চেষ্টাই সফলতা লাভ করতে পারছে না। এ দুনিয়া বস্তুগত দিক দিয়ে যত উন্নতিই লাভ করছে, নৈতিকতার দিক দিয়ে ততই ভাঙন ও বিপর্যয়ের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বস্তুগত উন্নতি ও নৈতিক অধঃপতন, দৈহিক বিবর্তন ও অধঃপতন বর্তমান আণবিক যুগের একটা বিশেষত্ব – একটা নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, একালের ইউরোপ-আমেরিকার চিন্তাবিদ দার্শনিকগণ সর্বাত্মক নৈতিক বিপর্যয় লক্ষ্য করে কেঁপে উঠেছেন, নৈতিক মহাধ্বংস নামতে দেখে উচ্চ কণ্ঠে সাবধান বাণী উচ্চারণ করছেন। কিন্তু নৈতিক পুনর্জাগরণে অপরিহার্য আল্লাহর নাযিল-করা বিধান পর্যন্ত তাঁরা এখনো পৌঁছতে পারেননি। ইদানিং বহু ইউরোপীয় মনীষী-চিন্তাবিদ ও বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক কুরআনের বহু সূক্ষ্ম তত্ত্বের সাথে পরিচিত হতে পেরে হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখে স্তম্ভিত হচ্ছেন এবং অকৃত্রিম বিশ্বাস নিয়ে দ্বীন ইসলাম গ্রহণ করছেন, একথায় কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যাপারটি এখনও ব্যাপক ও সাধারণ রূপ পরিগ্রহ করেনি; হয়ত-বা সেদিন খুব একটা দূরেও নয়।

আজ একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিশ্ব-মানবতার উচ্চতর ও মহত্তর লক্ষ্য যে নতুন সভ্যতার প্রতিষ্ঠা, তা একমাত্র কুরআন উপস্থাপিত নীতিদর্শনে (Ethical view of the Quran)-এর ভিত্তিতেই সম্ভব। কিন্তু বর্তমান দুনিয়ার নেতৃত্ব কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ যদি এই জীবন-উৎসের সাথে পরিচিত না হয়ে থাকেন, কিংবা সেদিকে লক্ষ্য নিবন্ধ না করে থাকেন, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী তারাই যারা এখানে সেই মহান জীবন-উৎসের বড় ‘আমানতদার’। কেননা তারাই সে উৎসের প্রতি ঈমানদার হওয়ার ও তাকে সকল মানবীয় সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে মৌখিকভাবে দাবি করছে। কুরআনের প্রতি ঈমানদার হওয়ার দাবিদার এই জনগোষ্ঠী যদি দুনিয়ার কোন একটি ক্ষুদ্র ভু-খণ্ডে ও কুরআনী নীতিদর্শনের পূর্ণাঙ্গ বাস্তব রূপ দেখিয়ে দিতে সমর্থ হয়, তা হলে সমগ্র বিশ্ব মেনে নিতে বাধ্য হবে যে, মানুষের সকল প্রকার নৈতিক রোগ-ব্যাধি ও বিপর্যয়ের প্রকৃত প্রতিষেধক এবং আত্মিক ও আধ্যাত্মিক জটিলতার প্রতিবিধান কেবলমাত্র তা-ই হতে পারে, যা কুরআন মজীদ পেশ করেছে। তারা এও অকপটে স্বীকার করত যে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ পবিত্র মানব সমাজ কেবল কুরআনের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হতে পারে এবং নৈতিক মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া কেবল তখনই সম্ভবপর। আমরা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে চাই, কোন মেধা-সম্পন্ন ব্যক্তি যদি কেবলমাত্র জ্ঞানগত তত্ত্ব হিসেবেও (Theoritically) কুরআন উপস্থাপিত নীতিদর্শনকে বুঝে নেন, তাহলেও তিনি তাকেই এতৎসংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার একমাত্র ও চূড়ান্ত সমাধান মেনে নিতে বাধ্য হবেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই আমরা এখানে কুরআনের নীতিদর্শন পেশ করতে চাচ্ছি।

নীতিদর্শনের প্রাথমিক সূত্র:

আমরা সর্বপ্রথম দেখতে চাই, কুরআন বিষয়টির সূচনা কোনখান থেকে করেছে এবং তার দৃষ্টিতে নীতিদর্শনের প্রথম সূত্র কি?

বস্তুত যে কোন সমস্যার প্রাথমিক সূত্র না পাওয়া পর্যন্ত নির্ভুলভাবে তার সমাধান বের করা কখনই সম্ভব হতে পারে না। দার্শনিকগণ কেবলমাত্র বিবেক-বুদ্ধির কুঞ্চিকা দিয়ে নৈতিক সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করেছেন; এটা যে মস্ত বড় ভুল, তা আমরা আগেই দেখিয়েছি। তাদের আর একটি বড় ভুল হল, সমস্যার মৌল উৎসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে মধ্যখান থেকে তার সমাধান বের করতে চেষ্টানুবর্তী হওয়া। সমস্যার মৌল উৎসের সন্ধান করাকে হয়ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়নি কিংবা তার সন্ধান করাই তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু কুরআন মজীদ মানুষের শুধু নৈতিকতাই নয়, তার যাবতীয় সমস্যার মৌল উৎসের সন্ধান দিয়েছে এবং সেই দৃষ্টিতেই তার প্রতিটির নির্ভুল সমাধান একের পর এক উপস্থাপন করেছে।

মানুষের জীবনটা কি, তার জন্মের উদ্দেশ্য কি, তার জীবনের লক্ষ্য কি, এই দুনিয়ায় তার অবস্থান কোথায় মানুষের সম্মুখে এগুলিই সর্বপ্রথম উপস্থিত প্রশ্ন এবং এই প্রশ্ন সমূহের নির্ভুল জবাবই হচ্ছে যাবতীয় জটিলতার প্রাথমিক সূত্র। এই জবাব সম্বলিত জ্ঞানই মানুষের জানার প্রাথমিক এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই জ্ঞান অর্জন না করা পর্যন্ত মানব জীবনের কোন সমস্যা অনুধাবন করা সম্ভব নয় – সম্ভব নয় তার সমাধান জানতে পারা। কেবলমাত্র মানবীয় বিবেক-বুদ্ধির দ্বারা উল্লেখিত প্রশ্নাবলির জবাব নির্ধারণ করা কোনক্রমেই সম্ভব হতে পারে না। অথচ দার্শনিক-বৈজ্ঞানিকগণ কেবলমাত্র এ উপায়ই ঐসব প্রশ্নের জবাব পেতে চেষ্টা করেছেন। আর এ কারণেই মানব জীবনের অন্যান্য সমস্যার ন্যায় নৈতিকতার সমস্যাটিও সম্পূর্ণ অমীমাংসিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

আল্লাহর নাযিল করা কুরআন মজীদ এসব প্রশ্নের সঠিক-নির্ভুল ও সুস্পষ্ট জবাব পেশ করেছে। সে জবাবের দ্বারা সকল সমস্যার –নৈতিক সমস্যারও সমাধান এমনভাবে হয়ে যায় যে, তাতে মন ও মগজ পূর্ণ স্বস্তি পরম সান্ত্বনা লাভ করে।

কুরআন প্রদত্ত জবাবে মন ও মগজ পরম সান্ত্বনা ও স্বস্তি লাভ করে প্রধানত দুটি কারণে। একটি এই যে, এ জবাব কোন মানুষের মনগড়া আজগুবী বা ভিত্তিহীন কথা নয়। এটা স্বয়ং সেই মহান সত্তার, যিনি সমগ্র বিশ্বলোক ও মানুষের একমাত্র স্রষ্টা। শুধু স্রষ্টাই নন, তাঁর অলৌকিক বুদ্ধিমত্তা ও অতুলনীয় জ্ঞান দ্বারাই এই বিশ্ব-ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্বলোকের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে যারাই আল্লাহকে বিশ্বাস করে ও মানে, তাঁর আপন সৃষ্টিকুল সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান যে কেবল তাঁরই থাকতে পারে-রয়েছেও, তা মেনে নিতে তাদের কোন দ্বিধা-সংকোচ থাকার কথা নয়। তিনি তাঁর সৃষ্ট প্রজাতিসমূহের অবস্থান ও সে সবের সৃষ্টি-উদ্দেশ্য বলে দেয়ার সবচাইতে বেশী অধিকারী, এটা অস্বীকার করা তাদের পক্ষে কি করে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে? কোন যন্ত্রের নির্মাতা তার নির্মাণ-কৌশল, তার নির্মাণ-উদ্দেশ্য এবং তার অংশগুলির যথার্থ অবস্থান নির্ধারণ করবে ও সকলকে তা জানিয়ে দিবে, এ-ই তো স্বাভাবিক এবং তা কিছুমাত্র দুর্বোধ্য নয়। আল্লাহ্-ই এই বিশ্বলোকের স্রষ্টা ও নির্মাতা। এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব তিনি ছাড়া আর কে দিতে পারে ?

মহান আল্লাহর জানিয়ে দেয়া জবাব আমরা কুরআন মজীদের মাধ্যমেই জানতে পারি। সে জবাব হল :

মানুষের এই জীবনটা কেবল আল্লাহর দান। তিনি মানুষকে এই জীবন দিয়েছেন আমানত স্বরূপ। এ দান চিরদিনের জন্য নয়, সাময়িক – একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্তকার জন্যে মাত্র। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তিনি তা ফিরিয়ে নিবেন। এই জীবনদানের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষ এই গোটা পরিসরে কেবল আল্লাহ্‌কে নিজের একমাত্র মা’বুদ মালিক ও সার্বভৌম মানবে এবং সকল কাজে, নিজেকে কেবল তাঁরই বান্দাহ, অনুসারী ও আনুগত্যকারী প্রমাণ করবে।

এই জগতে তার অবস্থান- সে আল্লাহর বান্দাহ, আল্লাহর খলীফা। সে এখানকার কোন কিছুরই মালিক নয়, তার নিজের জীবন ও সত্তা এবং শক্তি-সামর্থ্যেরও নয়। অতএব সে তার হৃদয়-মন-মগজ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা শুধু তা-ই করবে যা করতে তার আসল মালিক, মনিব ও সার্বভৌম বলেছেন। যা করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন, যা করতে তিনি নিষেধ করেছেন। অথবা যা করলে তার বান্দাহ ও অনুগত হওয়ার মর্যাদা বিনষ্ট হয়, তা সে কখনই করবে না।

এই দুনিয়ায় মানুষের মর্যাদা কি, তার অবস্থান কোথায় মানুষের নৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য তার জীবন-লক্ষ্য নির্ধারণ সহ এসব প্রশ্নের নিষ্পত্তি একান্তই অপরিহার্য। কেননা জীবন লক্ষ্য ও অবস্থানে পার্থক্য ঘটলে নৈতিকতার ব্যাপারে বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে পড়ে। এমন কি মানবীয় কাজের ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ হওয়া, ‘নেক’ বা ‘বদ’ হওয়া সম্পূর্ণরূপে এরই ওপর নির্ভর করে। একটা রূপক কথার দ্বারা দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। আমার নিকট দশটি টাকা রয়েছে। এই টাকার ব্যাপারে আমার অবস্থ কি, অবস্থান কোথায়, তা নির্ধারণ করতে হবে সর্বপ্রথম। এক্ষেত্রে আমার মাত্র দুটি অবস্থা হতে পারে।

প্রথমত, আমি তার স্বাধীন ও ইচ্ছাধিকারী মালিক। সেজন্য আমাকে কারোর নিকট হিসেব দেয়ার বা জবাবদিহি করার বাধ্যবাধকতা নেই।

আর দ্বিতীয়ত, তার প্রকৃত মালিক আমি নই, অন্য কেউ। সে আমাকে এই টাকা কতিপয় শর্তের ভিত্তিতে দিয়েছে ব্যয় ও ব্যবহার করার জন্যে। শেষ পর্যন্ত এ টাকার ব্যয় ব্যবহার সম্পর্কে তার নিকট আমাকে হিসেবেও দিতে হবে, জবাবদিহিও করতে হবে।

প্রথমোক্ত অবস্থায় দশ টাকা দিয়ে আমি যা-ই করি না কেন, তার পূর্ণ স্বাধীনতা আমার রয়েছে। আমি তার হিসাব কারোর নিকট দিতে বাধ্য নই; যেভাবে ও যে কাজে ইচ্ছা আমি ব্যয় করব, সে ব্যাপারে কারোরই কিছু বলবার নেই।

আর দ্বিতীয় অবস্থা টাকার আসল মালিকের আরোপিত শর্তসমূহের কোন একটি শর্তও যদি আমি লংঘন করি, তাহলে আমাকে চুক্তি ভংগকারী ও বিশ্বাস লংঘনকারী সাব্যস্ত করা হবে, লোকের নিকট আমি খারাপভাবে চিত্রিত হব এবং আমাকে মন্দ বলা হবে। সেজন্য আমাকে কোন শাস্তি দিলেও আমার কিছুই বলবার থাকবে না। তখন আমি হব খিয়ানতকারী।

দুটি অবস্থার যে বিশ্লেষণ দেয়া হল, যে রূপ পরিণতির কথা বলা হল তা অকাট্য—এটা নিঃসন্দেহ। এই উপমাটি মানুষের গোটা জীবনের কার্যাবলীর ওপর প্রয়োগ করলেই ‘ভালো’ ও ‘মন্দ’, ‘নেক’ ও ‘বদ’, চরিত্র ও চরিত্রহীনতা — এর তত্ত্ব উদঘাটিত হতে পারে। মানুষের বৈষয়িক জীবনের নিগূঢ় রহস্য ও জীবন উদ্দেশ্য ও অবস্থান সম্পর্কে—এই যা কিছু বলা হল, কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে তা-ই সুস্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে সেদিকে ইংগিত করা হচ্ছে।

খিলাফত:

কুরআনের সূরা আল-বাকারার ৪র্থ রুকূর আয়াতসমূহে এই দুনিয়ায় মানুষকে ‘খলীফা’ বানানোর কথা বলা হয়েছে। কয়েকটি আয়াতের অনুবাদ নিম্নরূপ :

‘অতঃপর সেই সময়ের কথা স্মরণ কর, যখন তোমার রব্ব ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা নিয়োগকারী। তারা বললঃ আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করবেন, যে সেখানকার শৃংখলা-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করবে ও রক্তপাত ঘটাবে? আপনার তা’রীফ-প্রশংসা সহকারে তস্বীহ্ এবং আপনার পবিত্রতা মহানত্ব তো আমরাই প্রকাশ করছি। (আল্লাহ) বললেনঃ তোমরা যা জানো না, আমি তা জানি।

এর পর আল্লাহ্ আদমকে সমস্ত জিনিসের পুরোপুরি নাম শিক্ষা দিলেন। পরে সেগুলিকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেনঃ

তোমাদের ভাবনাটাই যদি সত্য হয় (যে, খলীফা নিয়োগে শৃংখলা-ব্যবস্থা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে) তা হলে তোমরা এই জিনিসগুলির নাম আমাকে জানাও। তারা বললে : অসম্পূর্ণতা ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত তো আপনার সত্তা। আমরা তো শুধু ততটুকুই জানি, যতটুকু আপনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে সব কিছুর জ্ঞান ও বুঝ-এর অধিকারী আপনি ছাড়া কেউ নয়। পরে আল্লাহ্ আদমকে বললেনঃ তুমি ওদের এসবের নাম জানিয়ে দাও। সে যখন তাদেরকে সমস্ত নাম বলে দিল, তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সমস্ত নিগুঢ় তত্ত্ব জানি যা তোমাদের নিকট প্রচ্ছন্ন। তোমরা যা কিছু প্রকাশ কর তা-ও আমি জানি আর তা-ও যা তোমরা গোপন রাখ।

পরে আমরা যখন ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমের জন্য অবনত হও, তখন সকলেই অবনত হল; কিন্তু ইবলীস, সে অমান্য করল। স্বীয় বড়ত্বের অহংকারে পড়ে গেল ও কাফিরদের দলে শামিল হল।

উদ্ধৃত আয়াতসমূহ থেকে কয়েকটি বিষয় আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথমত, মানব প্রজাতি সৃষ্ট হয়েছে এই পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা হিসেবে। (খলীফা বানানোর ঘোষণা দেয়ার পর তিনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন, সমস্ত মানুষ এই আদমেরই বংশধর।) ক্ষুদ্র গ্রহ এই পৃথিবীকে আবাদকরণ ও এর ব্যবস্থাপনা পরিচালনের উদ্দেশ্যে তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। এই লক্ষ্যে আল্লাহ্ খিলাফত তথা প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব দিয়ে মানুষকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন, এবং এ কারণে তিনি অপর কোন সৃষ্টিকেই এ মর্যাদা দান করেন নি; বরং তাঁর সর্বাধিক নিকটবর্তী সৃষ্টি ফেরেশতাদেরকেও মানুষের সম্মুখে সিজদাবনত হতে বাধ্য করেছেন। বস্তুত সমগ্র সৃষ্টিলোককে তিনি এই মানুষের জন্যই নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন। কেননা তারা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বশীল সত্তা। অপর দিকে তিনি মানুষকে একথাও জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা এখানকার বাদশাহ বা সম্রাট কিংবা রাজাধিরাজ নও, বরং তোমরা বিশ্বলোক সম্রাটের কর্মচারী মাত্র। তোমরা এখানকার সার্বভৌম নও, সার্বভৌমের অর্পিত দায়িত্ব পালনকারী।

দ্বিতীয়ত আয়াতের কথাগুলি থেকে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ্ মানুষকে যে ‘ইলম’ (জ্ঞান) দিয়েছেন তার স্বরূপ ফেরেশতাদের দেয়া ‘ইলম’-এর মতো নয়। স্পষ্টত মনে হয় ফেরেশতাদেরকে তিনি প্রত্যেকের কর্মক্ষেত্র ও কর্মের স্বরূপ পর্যায়ের আংশিক ইলম দিয়েছেন আর তাদের বিপরীত মানুষকে দেয়া হয়েছে ব্যাপক ও সমষ্টিগত জ্ঞান। মানুষকে যেখানে আল্লাহর প্রতিনিধি করে পাঠানো হয়েছে, সেখানকার সমস্ত বিভাগ সংক্রান্ত কিছু-না-কিছু জ্ঞান তাকে দেয়া হয়েছে। ঠিক এ কারণেই পরীক্ষায় আদম ফেরেশতাদের ওপর উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন এবং ফেরেশতাদেরকে বাধ্য হতে হল নিজেদের অজ্ঞানতার কথা অকপটে স্বীকার করে নিতে। প্রসংগত এখানে একটি প্রশ্নের জবাব দেয়া আবশ্যক মনে হয়। প্রশ্নটি হচ্ছে, আদম (আ)-কে যে ‘ইলম’ দেয়া হয়েছিল, ফেরেশতাদের সম্মুখে তার প্রদর্শনীর কি প্রয়োজন ছিল?

এর জবাবে বলা যেতে পারে, যেহেতু একটু পরেই আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আ)-এর উদ্দেশ্যে সিজদা করার নির্দেশ দিতে যাচ্ছিলেন, এ কারণে এই নির্দেশ দানের প্রাক্কালে আদম (আ)-এর বিশেষত্ব ও মর্যাদাশীলতা কার্যত প্রমাণ করার প্রয়োজন ছিল বলেই তা করানো হয়েছে, যেন ফেরেশতাগণ সর্বান্তঃকরণে বুঝে-শুনে আদম (আ)-এর সম্মুখে অবনত হতে পারেন। সেই সঙ্গে যার উদ্দেশ্যে তারা নতি স্বীকার করছে তাঁর জ্ঞান-বিদ্যা যে তাদের তুলনায় বেশী এবং মর্যাদার দিক দিয়েও তিনি অনেক ঊর্ধ্বে এটা তাঁরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।

বস্তুত দুনিয়ায় আল্লাহর খলীফা হিসেবে দায়িত্ব পালনে আদম (আ)-কে ফেরেশতাদের সহায়তা সহযোগিতা করতে হবে এবং তাতে আদম (আ)-এর অধীনতা করা একান্তই জরুরী হয়ে পড়বে। আর আদম (আ) ফেরেশতাদের নিকট থেকে এই অধীনতা ও আনুগত্য পাওয়ার যোগ্যও বটে।

বনী আদম সম্পর্কে ফেরেশতাদের এই কথোপকথনের একটা বিবরণ নবী করীম (স)-এর নিকট থেকে ও পাওয়া গেছে। তা থেকেও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে ফেরেশতাদের ওপর অধিক মর্যাদা দিয়েছেন। হাদীসটি এই :

হযরত জাবির (রা) সূত্রে বর্ণিত, রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ্ তা’আলা যখন আদম ও আদম বংশকে সৃষ্টি করলেন, তখন ফেরেশতাগণ বললেন : হে রব্ব! আপনি ওদেরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, ওরা পানাহার করে, বিয়ে শাদী করে, জন্তুর পিঠে সওয়ার হয়। অতএব আপনি ওদের জন্য দুনিয়াকে নির্দিষ্ট করে দিন এবং আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিন পরকালকে। জবাবে আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ আমি যাকে নিজ হস্তে বানিয়েছি এবং তাতে নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দিয়েছি তার মান-মর্যাদা আমি তার সমান করব না যার অবস্থা এই যে, আমি বললাম হয়ে যা, আর অমনি হয়ে গেল। (মিশকাত-বায়হাকী)

‘হাদীসটির তাৎপর্য হচ্ছে, ফেরেশতারা মানুষ সম্পর্কে আল্লাহর নিকট বললেনঃ তারা যখন দুনিয়ার সুখ-শান্তি ভোগ করছে, আর আমরা দুনিয়া থেকে কোন সুখই গ্রহণ করছি না, তখন দুনিয়াটা ওদের জন্য হওয়া উচিত আর পরকালটা কেবল আমাদের জন্যে।

কিন্তু জবাবে আল্লাহ্ মানুষ ও ফেরেশতাদের সৃষ্টি-প্রক্রিয়ায় নিহিত পার্থক্যকে সুস্পষ্ট করে দিলেন। ফলে উভয়ের মধ্যকার মর্যাদাগত পার্থক্যটা স্পষ্টত প্রকাশিত হল। “নিজ হস্তে নির্মাণ ও তাতে রূহ ফুঁকে দেয়া শুধু সৃষ্টিকর্মের বিশেষ ব্যবস্থাপনা এবং সৃষ্টিটির মান-মর্যাদা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই বলা। সৃষ্টিকর্মের বিশেষ ব্যবস্থাপনা প্রমাণ করে যে, মানুষ কোন সাধারণ বা নগণ্য সৃষ্টি নয়। তাকে যে গুণাবলী দেয়া হয়েছে তা খোদায়ী গুণাবলীর প্রতিবিম্ব। আর আকৃতিগত ও ভাবগত এবং ইন্দ্রিয়গত ও বিবেক-বুদ্ধিগত পূর্ণত্বের যে ব্যাপকতা মানুষকে দান করা হয়েছে, তা ফেরেশতাদের দেয়া হয়নি। এ দ্বারা সম্ভবত একে বুঝানো হয়েছে যে, এই সত্তা যদি আল্লাহর আনুগত্য করে তা হলে ইহকাল-পরকাল উভয়ই তার জন্যে হবে। আর এই সত্তার মাথায় খিলাফতের মুকুট পরিয়ে তার পরীক্ষা সুসম্পন্ন করার জন্যেই এই সমগ্র বিশ্বলোক ও বস্তুজগতের সমস্ত তৎপরতা পরিচালিত হচ্ছে। এই পরীক্ষার ফলাফল যথার্থভাবে প্রকাশের জন্যেই পরকালের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

ফেরেশতাদের ওপর আদমের সর্বমুখী মর্যাদা এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর এর ফলেই ফেরেশতাগণ সানন্দে আদমের সম্মুখে অবনত হয়ে গেলেন। উদ্ধৃত আয়াতসমূহ থেকে এও সুস্পষ্ট হয় যে, খিলাফত তথা প্রতিনিধিত্বের পরীক্ষায় একটি চিরন্তন দুশমনও মানুষের সাথে নিরন্তরভাবে লেগে আছে। মানুষকে আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা ও খিলাফতের দায়িত্ব পালনে প্রবলভাবে বাধাদান ও মানুষকে আল্লাহদ্রোহী বানানোর চেষ্টায় সে পূর্ণ শক্তিতে আত্মনিয়োগ করে আছে। এ এক অকারণ শত্রুতা, মানুষ কোনদিনই তার সাথে শত্রুতামূলক কোন আচরণ কখনই করেনি। এতৎসত্ত্বেও ইবলীস-শয়তান আত্ম-অহংকারে স্ফীত ও মানুষের সাথে হিংসার আগুনে প্রতি মুহূর্ত দগ্ধ হচ্ছে। মানুষকেও তারই মত খোদাদ্রোহী ও অভিশপ্ত বানানোর জন্যই তার এই অব্যাহত চেষ্টা ও প্রচেষ্টা। কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও এই সব তত্ত্ব ইশারা-ইংগিতে পেশ করা হয়েছে।

এ আলোচনা থেকে এই বিশ্বলোক ও পৃথিবীতে মানুষের মর্যাদা ও দায়িত্বের ব্যাপারটি স্পষ্টত প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। এক্ষণে মানুষের বৈষয়িক জীবনের নিগূঢ় তত্ত্ব এবং তার জীবন-উদ্দেশ্য বুঝতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবু এই প্রসঙ্গটি কুরআনের আলোকে অধ্যয়ন করাই বাঞ্ছনীয়। আমরা সেই আলোচনা এখানে পেশ করছি।

১৫১০ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা ! এ শতকে যে ক'জন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন-দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাদের অন্যতম । এই ক্ষণজন্ম পুরুষ ১৩২৫ সনের ৬ মাঘ (১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারী) সোমবার, বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালী থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্রােন্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৩৮ সালে তিনি শীর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্ৰী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার জ্ঞানগর্ভ রচনাবলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এ ভূখণ্ডে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দােলন শুরু করেন এবং সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরলসভাবে এর নেতৃত্ব দেন ।বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত তীর প্রায় ৬০টিরও বেশি। অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার কালেমা তাইয়েবা, ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা', 'মহাসত্যের সন্ধানে', 'বিজ্ঞান ও জীবন বিধান', 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, "আজকের চিন্তাধারা', "পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত", "ইসলামের অর্থনীতি’, ‘ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন', 'সূদমুক্ত। অর্থনীতি’, ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম', 'নারী', 'পরিবার ও শিরক ও তাওহীদ”, “আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত', "আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকারী', ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী দাওয়াত’, ‘ইসলামী শরীয়াতের উৎস', 'অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’, ‘অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম’, ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ইসলামে জিহাদ', 'হাদীস শরীফ (তিন খণ্ড) ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে তার অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তার কোনো জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রয়েছে মওলানা মওদূদী। (রহ:)-এর বিখ্যাত তফসীর তাফহীমুল কুরআন', আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী'-কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান (দুই খণ্ড) ও ইসলামে হালাল হারামের বিধান', মুহাম্মদ কুতুবের বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত' এবং ইমাম আবু বকর আল-জাসসাসের ঐতিহাসিক তফসীর ‘আহকামুল কুরআন' । তার অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৬০টিরও উর্ধে। মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অন্তর্গত। ফিকহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সূচিত “আল-কুরআনে অর্থনীতি' এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকল্পেরও সদস্য ছিলেন। প্রথমোক্ত প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধ৷ তাঁরই রচিত। শেষোক্ত প্রকল্পের অধীনে তাঁর রচিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও ইতিহাস দর্শন' নামক গ্রন্থটি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় । মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ণ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন, একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশী। ইসলামী মহাসম্মেলন, ১৯৮০ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই যুগস্রষ্টা মনীষী ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর) a দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সন্নিধ্যে চলে গেছেন। (ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)
Picture of মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা ! এ শতকে যে ক'জন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন-দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাদের অন্যতম । এই ক্ষণজন্ম পুরুষ ১৩২৫ সনের ৬ মাঘ (১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারী) সোমবার, বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালী থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্রােন্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৩৮ সালে তিনি শীর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্ৰী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার জ্ঞানগর্ভ রচনাবলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এ ভূখণ্ডে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দােলন শুরু করেন এবং সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরলসভাবে এর নেতৃত্ব দেন ।বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত তীর প্রায় ৬০টিরও বেশি। অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার কালেমা তাইয়েবা, ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা', 'মহাসত্যের সন্ধানে', 'বিজ্ঞান ও জীবন বিধান', 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, "আজকের চিন্তাধারা', "পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত", "ইসলামের অর্থনীতি’, ‘ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন', 'সূদমুক্ত। অর্থনীতি’, ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম', 'নারী', 'পরিবার ও শিরক ও তাওহীদ”, “আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত', "আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকারী', ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী দাওয়াত’, ‘ইসলামী শরীয়াতের উৎস', 'অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’, ‘অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম’, ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ইসলামে জিহাদ', 'হাদীস শরীফ (তিন খণ্ড) ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে তার অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তার কোনো জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রয়েছে মওলানা মওদূদী। (রহ:)-এর বিখ্যাত তফসীর তাফহীমুল কুরআন', আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী'-কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান (দুই খণ্ড) ও ইসলামে হালাল হারামের বিধান', মুহাম্মদ কুতুবের বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত' এবং ইমাম আবু বকর আল-জাসসাসের ঐতিহাসিক তফসীর ‘আহকামুল কুরআন' । তার অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৬০টিরও উর্ধে। মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অন্তর্গত। ফিকহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সূচিত “আল-কুরআনে অর্থনীতি' এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকল্পেরও সদস্য ছিলেন। প্রথমোক্ত প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধ৷ তাঁরই রচিত। শেষোক্ত প্রকল্পের অধীনে তাঁর রচিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও ইতিহাস দর্শন' নামক গ্রন্থটি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় । মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ণ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন, একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশী। ইসলামী মহাসম্মেলন, ১৯৮০ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই যুগস্রষ্টা মনীষী ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর) a দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সন্নিধ্যে চলে গেছেন। (ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top