এক.
আরবী ভাষায় একটা কথা আছে, উকুলুন না-সি আ’লা কদরি যামানিহিম। যার অর্থ অনেকটা এমন হয় যে, সময় ও পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতেই একজন মানুষের আকল ও বুদ্ধিমত্তা বিকশিত হয়। জীবন চলার পথের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেমন একেবারে স্বাভাবিকভাবেই এই কথাটি সত্য, সুদূর অতীত থেকেই দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তেমনি এই কথাটি সত্য। অতএব, কোনো একজন ব্যক্তি যখন অতীতকে কলমের ডগায় ফুটিয়ে তুলবেন, তখন সেই ব্যক্তির আশপাশ এবং তার চিন্তাভাবনা অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে তিনি যদি উদার মনের হন তাহলে এক দৃষ্টিকোণ থেকে অতীতকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করবেন, আর যদি তার পূর্বের সকল ধর্ম ও মতের উপর সঠিক ও স্বচ্ছ ধারণা না থাকে তাহলে তিনি একপেশে ইতিহাস চর্চা করবেন।
উপমহাদেশের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এই কথাটি একেবারে পুরোপুরি সত্য। উপমহাদেশের ইতিহাসে মুসলিমদের আগমনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। মুসলিম আগমনের পূর্বের ইতিহাসের চেয়ে পরবর্তী ইতিহাস শতগুণে সমৃদ্ধশালী। কিন্তু, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও ইতিহাস চর্চায় এই সমৃদ্ধশীল ইতিহাস বরাবরই কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে।
মুসলিমদের সমৃদ্ধশীল ইতিহাস হারিয়ে যাবার কারণ অন্য কোনো কিছু নয়, বরং ভারতীয় দাদাবাবুদের একপেশে ইতিহাস চর্চা, যা বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রসারের সাথেসাথে কলকাতার বর্ণহিন্দুদের ইতিহাস চর্চাও আমাদের মাঝে প্রবেশ করে। কারণ, ভারতের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে তারা ধরেই নেয় যে, ভারতের ইতিহাসের অর্থই হচ্ছে হিন্দুদের ইতিহাস, এখানে মুসলিমদের ঠাঁই দেওয়া উচিত না; কারণ মুসলিমরা বহিরাগত আর তারা আর্য। অবাক করার বিষয় হলো, বঙ্গভঙ্গ রদের বিপরীতে বাংলার মুসলিমদেরকে দেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য রমেশচন্দ্র মজুমদার স্বয়ং ঢাকার মাটিতে বসেই এই ধারার ইতিহাস চর্চা করেছেন।
দুই.
এইযে, ইতিহাস চর্চার এই ধারা, এর সূচনাটা করে দিয়েছে ইংরেজরা। ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজমের সবচেয়ে বহুল প্রসিদ্ধ নীতি—‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসিকে ব্রিটিশরা সমগ্র বিশ্বেই বাস্তবায়ন করেছে। আজকের ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার শুরুটা তারা এই নীতির উপর ভিত্তি করেই করেছিলো। ভারতীয় উপমহাদেশকে শাসন করার জন্য তারাই হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের সূচনা করেছিলো। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেছে তাদের ব্রিটিশ বুদ্ধিকে। আর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের সূচনা করতে তারা ব্যবহার করেছে ইতিহাসকে, ঠিক যেমনভাবে মিশরীয়দেরকে অতীতের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে উসমানীয় এবং আরবদের থেকে আলাদা করেছিলো।
উপমহাদেশের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই কাজটা করেছে ম্যাক্স মুলার। ম্যাক্স মুলার প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, ইরান থেকে আর্যদের একটি দল ইউরোপে গিয়েছিলো, যারাই সেসময় সমগ্র পৃথিবীতে বাণিজ্য করছিলো। আরেকটি দল ভারতীয় উপমহাদেশে চলে আসে, তারাই পরবর্তীতে হিন্দু হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আর মুসলিমরা এই ভূমির কেউ না, মাত্র কয়েকশ বছর আগে বাহির থেকে এসে হিন্দুদের উপর চেপে বসেছে। যদিও আজকের আধুনিক ইতিহাসবেত্তারা ম্যাক্স মুলারের এই তত্ত্বকে তথ্য-প্রমাণ দিয়েই খণ্ডন করেছেন।
ম্যাক্স মুলারের এমন তত্ত্বের পাশাপাশি ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠা করে দ্যা এশিয়াটিক সোসাইটি-র মতো প্রতিষ্ঠান। এখান থেকেই প্রকাশিত হওয়া প্রথমদিকের একটি গ্রন্থ হচ্ছে কর্নেল জেমস টড-এর অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অফ রাজস্থান। এখানে রাজস্থানের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে মুসলিমদেরকে শত্রু ও বহিরাগত এবং হিন্দুদেরকে স্থানীয় ও নায়ক হিসেবে তুলে ধরেছে ব্রিটিশরা। এরপর, ওরিয়েন্টালিজমের মাধ্যমে ‘হিন্দু’ পরিভাষাকে ভারতের মাটিতে একেবারে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে তারা। পরবর্তীতে, রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম হিন্দুত্ববাদকে প্রতিষ্ঠা করেন ধর্মীয় ছায়ার করতলে।
বঙ্কিমচন্দ্র তার উপন্যাসগুলোতে সারাটা জীবনভর মুসলিমদেরকে শত্রু ও খলনায়ক বানিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো রবীন্দ্রনাথ মুসলিমদের উপর এতোটা কঠোর না হলেও মুসলিমদেরকে সবসময়ই তার উপন্যাসে নিচু জাতের মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। জন ক্লার্ক মার্শম্যানের হিস্টোরি অব বেঙ্গল বইয়ে তিনি যতোটা না মুসলিমদের সমালোচনা করেছেন, তারচেয়ে শতগুণে বেশি মুসলিমদের অপমান করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই বইয়ের অনুবাদ করতে গিয়ে। নীহাররঞ্জন রায়ের দৃষ্টিতে তো মুসলিমরা কোনো স্থানই পায়নি।
এরপর গত শতকে এসে বাংলার ভূমিতে বসেই বাংলার মুসলমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েও রমেশচন্দ্র মজুমদার ভারতের ইতিহাসকে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করেছেন। অথচ, তিনিই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী তৈরির পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেন এবং সূর্যসেন, প্রীতিলদা এবং লীলানাগদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে রীতিমতো উৎসাহ দিতে থাকেন। আর পরবর্তীতে গিয়ে তার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যান যদুনাথ সরকার। যদুনাথ সরকার তো পলাশীর পতনে রীতিমতো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, তিনি এটাকে ভারতীয় উপমহাদেশের নতুন সূর্যোদয় বলেও অভিহিত করেছেন। এমনকি, মুসলিমদের পতনকে তিনি বাংলার রেনেসাঁ পর্যন্ত বলেছেন।
অনেকে আবার একধাপ এগিয়ে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, উপমহাদেশের ভূমিতে জনসংখ্যার অনুপাতে অতি সামান্য এই মুসলিমরা দীর্ঘ ৫০০ বছর শাসন করার কারণ এটাই যে, নিম্নবর্গের হিন্দুরা গণহারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। এখানে শুধু নিম্নবর্গীয় হিন্দুরাই মুসলিম হয়েছে, উচ্চবর্গের কোনো হিন্দুই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। আর যদিও-বা উচ্চবর্গের কোনো হিন্দুই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেও থাকে, তা ছিলো খুবই কম অথবা মুসলিম শাসকরা স্থানীয় নারীদের জোরজবরদস্তি করে বিবাহ করায় তারা মুসলিম হয়েছে।
আর এই ইতিহাসবেত্তারা এটাও বলেন যে, যেহেতু হিন্দুরা না বুঝেই মুসলিম হয়েছে, তাই তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও ইসলামের বিধিবিধান পালনের চেয়ে পূর্বের ধর্মের সংস্কৃতিই বেশি পালন করতো। আর এভাবেই ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান একটা সময় হারিয়ে যেতে শুরু করে এবং আবারো পূর্বের মতোই ভারতীয় সংস্কৃতি বা হিন্দুদের সংস্কৃতি প্রাধান্য লাভ করতে শুরু করে। আর এই তত্ত্বের অন্যতম একজন ধ্বজাধারী হলেন অসীম রায়।
এখানে অবাক করার বিষয় হলো, ইসলাম ও মুসলিমদের উপর এমন অপবাদ চাপিয়ে দেওয়া এই তত্ত্বের ধ্বজাধারীরা একদিকে যেমন হিন্দু, অন্যদিকে আবার হিন্দু না হলেও তারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালী জাতীয়তাবাদের একান্ত ও একনিষ্ঠ ভক্ত।
যাইহোক, এই ধারার ইতিহাসের আলোকে কয়েকটি বিষয় সামনে আসে। যেমন,
- ১. মুসলিমরা বহিরাগত এবং স্থানীয়দের শত্রু;
- ২. হিন্দুরা স্থানীয় ও ভারতের মহানায়ক;
- ৩. ভারতের ইতিহাস বলতেই মূলত হিন্দুদের ইতিহাস;
- ৪. নিম্নবর্গের হিন্দুরাই শুধু মুসলিম হয়েছে, তা-ও না বুঝে;
- ৫. কালের গর্ভে ইসলাম হারিয়ে গিয়ে ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে একাত্মতা পোষণ করেছে।
তিন.
কিন্তু, প্রকৃত ইতিহাস কি আসলেও তাই বলে?
ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজমের এমন বিকৃত ইতিহাস এবং হিন্দুত্ববাদের এমন একপেশে ইতিহাসের বিপরীতে মুসলিম জাতিসত্তা নিয়ে কলম ধরা ইতিহাসবেত্তা যে নেই, বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। বরং, ডক্টর মো. মোহর আলী এবং এম. এ. রহিম মুসলিম জাতিসত্তার ক্ষেত্রে অনন্য দু’টি নাম।
দীর্ঘ ১০ বছরের গবেষণার ফসল হিসেবে ডক্টর মো. মোহর আলী চার খণ্ডের বৃহদাকার যে হিস্টোরি অব মুসলিম বেঙ্গল বইটি লিখেছেন, তা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সভ্যতার এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায়। যদুনাথ সরকার যেমন শুধু সময়ের ধারাবাহিক ঘটনাকে তুলে ধরেছেন, ডক্টর মো. মোহর আলী তার সম্পূর্ণ উল্টোপথে হেঁটেছেন। অতীতের শিলালিপি, সরকারি সনদ, ফরমান, গেজেট এবং বাংলা, ইংরেজি আরবী ও ফারসি ভাষার সাহায্য নিয়ে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনামূলক ইতিহাস বর্ণনা করেছেন তিনি। ডক্টর মো. মোহর আলী তার গ্রন্থে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, উত্তর ভারতের উপর মুসলিম বাংলার যে প্রভাব ছিলো, তা মুসলিম বাংলার অনন্য উচ্চতার পরিচয় তুলে ধরে।
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে মুসলিম ইতিহাস বিলুপ্ত করণের যে প্রচেষ্টা চালানো হয় এবং ইসলামকে হিন্দু ধর্মের মাঝে হারিয়ে যাওয়া একটা ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা হয়, ডক্টর মো. মোহর আলী সেখানেও গবেষণা ও পর্যালোচনা করে এই মতাদর্শের বিপরীতে হাঁটেন। আর এমনটা হবেই না কেন? অসীম রায়ের মতো কেউ যদি ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েই এমন বিকৃত ইতিহাস লেখে যে, ইসলাম হিন্দুধর্মের মাঝে হারিয়ে গেছে অথবা হিন্দুরা মুসলিমদের আখলাকে প্রভাবিত না হয়ে বরং হুজুগের কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে, তাহলে বলতেই হয় যে, সে ইতিহাসবেত্তা ইসলাম সম্পর্কে সঠিকটা না জেনেই ইসলামের ইতিহাস লেখতে কলম ধরেছে।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদের পক্ষে কলম ধরা আরেকজন অগ্রসেনানী হলেন মোহাম্মদ আব্দুর রহিম। বাংলার মুসলিম ইতিহাসের ক্ষেত্রে বস্তুনিরপেক্ষ ও যুক্তিবাদী ধারার সূচনা করেন তিনি। বাংলার মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে তিনি দীর্ঘসময় গবেষণা করেন। এসব গবেষণা থেকেই তিনি মুসলিম আমলের উপর দুই খণ্ডের ‘বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস’ গ্রন্থ লেখেন, যা আজও ভারতীয় ইতিহাসের মৌলিক ধারার অন্যতম একটি গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত।
বাংলার ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, বাংলা ভাষা এবং মুসলিম ও ভারতীয় সংস্কৃতি-র বিষয়গুলোকে সামনে রেখে মুসলিমদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেন মোহাম্মদ আব্দুর রহিম। ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হয়ে যাওয়া, মুসলিমদের স্বাতন্ত্র্য না থাকা এবং মুসলিমদের বহিরাগত হওয়া নিয়ে যে বিকৃত ইতিহাস চর্চা হয় আমাদের দেশে, ‘বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস’ বইয়ের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এই অধ্যাপক প্রমাণ সহকারে তা খণ্ডন করার চেষ্টা করেন।
ডক্টর মো. মোহর আলী এবং এম. এ. রহিম-এর পাশাপাশি মুসলিম জাতিসত্তা নিয়ে যারা কাজ করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুইজন হলেন আবদুল করিম এবং ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার অব বাংলাদেশ স্টাডিজ’ থেকে মোঘল আমলে বাংলার মুসলমানদের ইতিহাসের উপরেই পাঁচ খণ্ডের বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এই সিদ্ধান্ত নেবার পেছনে অন্যতম একটি মূল কারণ এটাই ছিলো যে, যদুনাথ সরকারের সম্পাদিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হওয়া হিস্টোরি অব বেঙ্গল বইয়ের ভুলভ্রান্তির বিপরীতে স্বচ্ছ ইতিহাস তুলে ধরা।
আর বর্তমান সময়ে এসে আমাদের মুসলিম ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন এমন দুইজন ব্যক্তি হলেন এবনে গোলাম সামাদ এবং সরদার আবদুর রহমান। বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনায় বখতিয়ার খিলজির অবদান এবং নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সৃষ্ট বিকৃত ইতিহাসের বিপরীতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সরদার আবদুর রহমান। অন্যদিকে, ব্রিটিশদের অর্থায়নে সৃষ্ট হিন্দুদের আর্যতত্ত্ব, মুসলিমদের বহিরাগত তত্ত্ব এবং নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের মুসলিম হবার তত্ত্বের মতো বিকৃত ইতিহাসের ধারাকে বেশ যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে খণ্ডানোর চেষ্টা করেছেন এবনে গোলাম সামাদ। এছাড়াও রয়েছেন, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, ফাহমিদ-উর-রহমান এবং ফয়েজ আলম—সহ আরো অনেক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব।
চার.
এইযে, সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিপরীতমুখী ইতিহাসের দু’টি ধারার সৃষ্টি হওয়া—এটিই আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে উপলব্ধি করায় যে, দীর্ঘ সময় ধরে ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজমের প্রভাবে বিকৃত এবং একপেশে ইতিহাসের যে ধারাটি প্রচলিত হয়ে আছে, তার বিপরীতে কলম ধরা প্রত্যেক ইতিহাসবেত্তারই একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। ব্রিটিশরা যদি এমন বিকৃত ইতিহাস তৈরির পেছনে অর্থায়ন না-ই করতো, তাহলে হয়তো আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাসটাই ভিন্নরকম হতো; অথবা বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সামাজিক সম্প্রীতির ইতিহাসটাও অনন্যমাত্রা লাভ করতো।
পৌনে দুইশ বছর ধরে ব্রিটিশরা যে ধারা তৈরি করে দিয়ে গেছে, তার বিপরীতে মাত্র ৫০-৬০ বছরের গবেষণামূলক কার্যক্রম সত্যিকারার্থেই খুব একটা বেশি সময় নয়। তার উপর আবার রয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়া বুদ্ধিজীবী নামক একটি সমাজ, যারা বাংলার ভূমিতে বসবাস করেই মুসলিম জাতিসত্তাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে সিদ্ধহস্ত।
আর এর পাশাপাশি রয়েছে আমাদের অসচেতনতা এবং অজ্ঞতা। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে ডক্টর মো. মোহর আলী, মোহাম্মদ আব্দুর রহিম, আবদুল করিম এবং ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক—এর মতো ইতিহাসবেত্তারা যে পরিশ্রম করে গিয়েছেন, তার যথাযথ মর্যাদা দিতে আমরা বরাবরই অপারগতা প্রকাশ করে আসছি। এমনকি, আমাদের তরুণ প্রজন্মের নিকট যেনো এসব নাম একেবারেই অপরিচিত। তার বিপরীতে বরং রমেশচন্দ্র মজুমদার, যদুনাথ সরকার এবং অসীম রায়েরাই যেনো বহুল পরিচিত।
অতএব, জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে সময় এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশের সমগ্র ইতিহাসকে নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন করার। সময় এসেছে ব্রিটিশ কলোনিয়ালিজম এবং ব্রিটিশ একাডেমিয়ার প্রভাবে সৃষ্ট বিকৃত ইতিহাসকে ছুঁড়ে ফেলার। সময় এসেছে বাংলাদেশী মুসলিম জাতিসত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব পূরণ করার।
তাই, বাংলার মুসলিমদের মাঝে উম্মাহ চেতনাকে সমুন্নত করা এবং মুসলিম জাতিসত্তার আত্মপরিচয়কে পুনর্জাগরিত করার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মাঝে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দেবার এখনই উপযুক্ত সময়। কেননা, কোনো একটি জাতির সঠিক ইতিহাসই সেই জাতির জাতিসত্তাকে অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরে, তাদের আত্মপরিচয়কে বুলন্দ করে এবং তাদের মাঝে অবিনশ্বর আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে।