তৌহীদ দ্বারা বুঝায় আল্লাহতত্ত্বকে তত্ত্ববিজ্ঞানের দিক দিয়ে প্রকৃতি সমগ্র রাজ্য থেকে আলাদাকরণ, যা কিছু সৃষ্টিতে বিদ্যমান, সৃষ্টি থেকে আগত, তাই সৃষ্টি, অতীন্দ্রিয় নয় এবং দেশকালের বিধানের অধীন, কোন অর্থে এর কোন কিছু খোদা বা খোদা-সদৃশ হতে পারেনা, বিশেষ করে তত্ত্ববিজ্ঞানের দিক দিয়ে, যা একেশ্বরবাদের সারমর্ম হিসেবে তৌহীদ অস্বীকার করে। আল্লাহ সম্পূর্ণভাবে সৃষ্টি থেকে স্বতন্ত্র, সমগ্রভাবেই প্রকৃতি থেকে পৃথক এবং সে কারণেই ইন্দ্রিয়াতীত তিনি, একমাত্র ইন্দ্রিয়াতীত সত্ত্বা। তৌহীদ আরো দাবী করে, কোন কিছু তার মত নয়। এবং সে কারণে সৃষ্টিতে কোন কিছু তার সদৃশ বা প্রতীক হতে পারেনা, কোন কিছুই তার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে সংজ্ঞার দিক দিয়ে আল্লাহর কোন প্রতীক অসম্ভব। আল্লাহ হচ্ছেন তিনি, যার সম্পর্কে কোন নন্দনতাত্ত্বিক ইন্দ্রয়গত কোন দিব্যজ্ঞানই সম্ভব নয়।

নন্দনতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার দ্বারা বুঝায় ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে উপলব্ধির সাহায্যে একটি প্রাক-সিদ্ধ এবং সে কারণে, অতীন্দ্রিয় প্রকৃতি-অতিক্রান্ত উপলব্ধি, যার সারনির্যাস দৃষ্টি-বিষয়ের নমুনা নীতি হিসেবে কাজ করে- এ হচ্ছে যা হওয়া উচিত তারই বিষয়। দৃষ্ট বস্তুটি তার সার নির্যাসের যতই নিকটবর্তী হবে ততই হবে অধিকতর সুন্দর।

তৃণলতা, জীবজন্তু এবং বিশেষ করে মানুষের প্রাণময় প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাই হচ্ছে সুন্দর, যা প্রাকসিদ্ধ সারসত্ত্বার সম্ভাব্য অনুরূপ হয়, যাতে করে বিচারক্ষম প্রত্যেকেরই এ দাবীর অধিকার থাকবে যে, নান্দনিক বিষয় বা বস্তুটিতে প্রকৃতি নিজেকে ব্যক্ত করেছে তেজস্বিতার সঙ্গে, পরিষ্কারভাবে। সুন্দর বস্তু হচ্ছে তাই, প্রকৃতি যা বলতে চায়, যা সে বলে থাকে, কদাচিৎ কখনো তার হাজারো এক ত্রুটির মধ্যে শিল্পকলা হচ্ছে প্রকৃতির মধ্যে প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে যাওয়া, সেই সারসত্ত্বাকে আবিস্কার করার এবং তাকে দৃশ্যরূপে প্রকাশ করার প্রক্রিয়া স্পষ্টতই, শিল্প সৃষ্ট- প্রকৃতির অনুকরণ নয়, যে সব বস্তুর প্রাকৃতিক-বাস্তবতা সম্পূর্ণ সেগুলোর ইন্দ্রিয়নির্ভর রূপ সৃষ্টি শিল্প নয়। পরিচয় প্রমাণ করবার জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন ও ডকুমেন্টেশনের জন্য ফটোগ্রাফিক চিত্ররূপ, যা বিষয়টি যেভাবে বিদ্যমান সেভাবেই তার ছবি তোলে, তা মূল্যবান হতে পারে। শিল্প হচ্ছে প্রকৃতির মধ্যে সেই সারসত্ত্বার পঠন, যা প্রকৃতির অতীত এবং সারসত্ত্বাটিকে তার যথাযথ একটি দৃশ্যরূপ দান করা

 

এ পর্যন্ত যেভাবে সংজ্ঞা দান করা হয়েছে এবং বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তাতে শিল্প হচ্ছে অপরিহার্যভাবেই প্রকৃতির মধ্যে তারই ধারণা করা যা প্রকৃতির অন্তগর্ত নয়। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে যা সম্পর্কিত নয়, তা ইন্দ্রিয়াতীত এবং যা দিব্য, কেবল তাই এই মর্যাদা লাভের যোগ্য। অধিকন্ত প্রাকসিদ্ধ সারসত্ত্বা, যা নন্দনতাত্ত্বিক উপলব্ধির বিষয়, তা যেহেতু আদর্শসূলভ এবং সুন্দর, সে কারণে মানুষের আবেগ অনুভূতি এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণেই মানুষ সুন্দরকে ভালবাসে এবং সুন্দরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যখন তারা মানুষের প্রকৃতিতে সুন্দরকে প্রত্যক্ষ করে, তখন প্রাকসিদ্ধ প্রকৃতির অতীত সারসত্ত্বা হয়ে ওঠে মানবিকতা, যা ইন্দ্রিয়াতীত, মাত্রায় আদর্শরূপ পরিগ্রহণ করে। একেই গ্রীকরা বলতো apotheosis অর্থাৎ ঐশী সত্তার মধ্যে মানবিকতার প্রতিস্থাপন। মানুষ এ ধরনের রূপান্তরিত মানুষের বিশেষ করে মান্য করে এবং তাদেরকে দেব দেবী বলে গণ্য করে। আধুনিক পাশ্চাত্যের লোকেরা মেটাফিজিক্স বা তত্ত্বশাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন উপাস্যের প্রতি অতি সামান্যই সহনশীল কিন্তু নীতিশাস্ত্র এবং আচরণের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের লোকেরা মানুষের প্রবৃত্তি প্রবণতাগুলোকে আদর্শের রূপ দিতে গিয়ে যে সব দেবদেবী সৃষ্টি করে সেগুলোই প্রকৃতপক্ষে তার কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে

এই হচ্ছে ব্যাখ্যা, কেন দৃশ্যরূপে ভাস্কর্যে এবং কল্পনায়, তার কারো ও নাটকে প্রাচীন গ্রীকরা মানবিক উপকরণসমূহ তার গুণাবলী অথবা তার প্রবৃত্তিগুলোর প্রতীক প্রাচীন গ্রীসের শিল্পকর্মে সর্বোচ্চ নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়াস হিসেবে গৃহীত হয়েছিলো। তারা যে সব বিষয়ের, যেমন ঈশ্বরের প্রতিরূপ সৃষ্টি করেছিল, সেগুলো সুন্দর ছিলো একারণে যে মানব প্রকৃতি যা হওয়া উচিত, সেগুলো ছিলো তারই আদর্শরূপ। তাদের সৌন্দর্য অন্য দেবতাদের সঙ্গে তাদের অন্তর্গত বিরোধ গোপন করতোনা, সত্যিকার অর্থে এ কারণে যে, প্রত্যেকেই ছিলো প্রকৃতির একটি প্রকৃত বিষয়, যাকে তারা ঐশীরূপে তথা অতিপ্রাকৃত স্তরে চূড়ান্তরূপ দিয়েছিলো

রোমেই কেবল গ্রীক অবক্ষয়ের নাট্যমঞ্চ, গ্রীক ভাস্কর্য শিল্পের অবনতি ঘটে রাজা বাদশাদের বাস্তববাদী অভিজ্ঞতামূলক, বাস্তভিত্তিক প্রতিকৃতিতে। অবশ্য তখনো তা সম্ভব হতোনা সম্রাটকে দেবতায় পরিণত না করে। গ্রীকে যেখানে শত শত বছর ধরে এই থিওরীটি তার বিশুদ্ধরূপে বিদ্যমান ছিল- যেখানে ভাস্কর্য শিল্পের পাশাপাশি নাট্যশিল্প বিকশিত হয় প্রকৃতপক্ষে দেবতাদের মধ্যকার শাশ্বত পারস্পরিক দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত করার জন্য, একসারি ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে, যাতে চরিত্রগুলো ছিলা জড়িত। সামগ্রিক উদ্দেশ্য ছিল- তাদের ব্যক্তি চরিত্রগুলো উন্মোচিত করা, দর্শকরা যাদেরকে মানবিক, অতিমাত্রায় মানুষ্যজনোচিত জানতো- অবশ্য তা ছিলো বিপুল আনন্দের উৎস। তাদের চোখের সামনে উৎঘাটিত নাটকের ঘটনাগুলো পরিণতি যদি ঘটতো ট্রাজিক সমাপ্তিতে, তা অপরিহার্য এবং তাদের চরিত্রের অন্তর্গত বলে গণ্য হত। এর অনিবার্যতায় ফুলের একটি দংশন দূর হয় এবং কেতারসিসের মাধ্যমে তারা অনৈতিক কাজকর্ম ও প্রচেষ্টার জন্য তারা যে অপরাধবোধ করতো তার অবসান ঘটাতে সাহায্য করতো। এজন্যই, গ্রীকে উদ্ভাসিত পূর্ণতা-সাধিত্ব ট্রাজেডিশিল্প ছিলো সাহিত্যশিল্পের শীর্ষ বিন্দু এবং সকল মানববিদ্যারও। এক বিরল সত্যভাষণের মাধ্যমে প্রাচ্যবিদ ফনগ্রুনেবোম্ বলেছেন, ইসলামে প্রতিমাধর্মী শিল্পকলা ভাস্কর্য চিত্র এবং নাটক নেই, কারণ ইসলামে প্রকৃতিতে কোন দেবদেবীর অবতারের অবকাশ নেই, অথবা প্রকৃতিতে অন্তবর্তী কোন দেবদেবীর ধারণা থেকে মুক্ত ইসলাম। যে সব দেবদেবী পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত অথবা মন্দের সঙ্গে দ্বন্দ্বেজড়িত, ফনগুনোবোম এটিকে ইসলামের একটি নিন্দাবাদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যদিও আসলে ইহা ইসলামের একটি পরম বৈশিষ্ট্য। এ হচ্ছে ইসলামের একটি একক গৌরব যে ইসলাম পৌত্তলিকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, অর্থাৎ সৃষ্টিকে স্রষ্টারূপে গণ্য করার প্রমাণ থেকে ইসলাম মুক্ত।

তাওহীদ শৈল্পিক সৃজনশীলতার বিরোধী নয়; সৌন্দর্য উপভোগেরও বিরোধী নয় পক্ষান্তরে তাওহীদ সৌন্দর্যকে পবিত্র গণ্য করে এবং তার পৃষ্ঠপোষকতা উৎকর্ষ সাধন করে তাওহীদ কেবলমাত্র আল্লাহতে এবং ওহীর বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে প্রকাশিত তার অভিপ্রায় বা তার শব্দের মধ্যে পরম সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই দৃষ্টিভঙ্গির উপযোগী নতুন সৃষ্টিতে তাওহীদ উম্মুখ। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, এই আশ্রয়বাক্য থেকে শুরু করে মুসলিম শিল্পী বিষয়ে প্রত্যয়দৃপ্ত যে, প্রকৃতির যা কিছুই রূপায়িত করেছে, তাকেই শৈলীবদ্ধ করেছে অর্থাৎ শৈলীবদ্ধ করার মাধ্যমে তাকে সে যথাসম্ভব নিসর্গ বা প্রকৃতি থেকে বিযুক্ত করেছে। বলতে কি, প্রকৃতির বিষয় বা বস্তু প্রকৃতি থেকে এতদূর বিচ্ছিন্ন করা হল যে, তা প্রায় সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে উঠলো। শিল্পীর হাতে শৈলীবদ্ধতা ছিল একটি নৈতিবাচক যন্ত্র, যার মাধ্যমে সে প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক বস্তু এমনকি খোদ সৃষ্টির প্রতি ব্যক্ত করেছে তার ‘না’ বা অস্বীকৃতি। প্রাকৃতিকতাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখান করে মুসলিম শিল্পী দৃশ্যরূপে প্রকাশ করে শাহাদার নেতিবাচক দিকটি, অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। মুসলিম শিল্পীর এই শাহাদাই আসলে তার প্রকৃতিতে ইন্দ্রিয়াতীততার অস্বীকৃতির সমার্থক

 

মুসলিম শিল্পী এখানেই থেমে গেলেন না। তার সৃজনশীলতার মুক্তি তখনই ঘটলো, যখন তাঁর এই চৈতন্য হল যে আল্লাহকে প্রকৃতির কোন মুর্তিতে প্রকাশ করা এককথা এবং এ ধরনের মূর্তিতে তা প্রকাশ অসম্ভব, তা বলা ভিন্ন কথা। আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালাকে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, এই উপলব্ধি হচ্ছে মানুষের জন্য মহত্তম নান্দনিক লক্ষ্য, আল্লাহ তায়ালা নিঃশর্ত চরম পরম ও মহিমাময়। সৃষ্টির কোন কিছুর দ্বারা যে তাকে প্রকাশ করা যায় না এই সিদ্ধান্তের অর্থই আল্লাহর পরমত্ব ও মহিমাময়তাকে অতিশয় গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। কল্পনায় তাকে সৃষ্টির সমস্ত কিছু থেকে পৃথকরূপে দেখার অর্থই হচ্ছে তাকে সুন্দররূপে দেখা, সুন্দর অন্য যে কোন বিষয় বা বস্তু থেকে স্বতন্ত্ররূপে দেখা। ঐশী অনির্বচনীয়তা হচ্ছে, একটি ঐশীগুণ যার অর্থ হচ্ছে অন্তহীনতা, পরমতা, চূড়ান্ততা বা নিঃশর্ততা, অপরিমেয়তা, অসীম বা অনন্ত- সকল অর্থেই অনির্বচনীয়

ইসলামী চিন্তাধারায়, চিন্তার এই ধারা অনুসারে মুসলিমশিল্পী আবিস্কার করেছে অলংকরণ শিল্প এবং তাকে রূপান্তরিত করেছে লতাপাতা, ডালপালা, সর্পিল কারুকার্যময় নক্সায়, আর এটি এমন একটি non-devolopmental নক্সা যা সম্প্রসারিত হয়েছে সকল দিকে অনন্ত অভিমুখে। এই শিল্প যাকে বলা হয় এরাবেক্স যা টেক্সটাইল, ধাতু, পুষ্পাধার, প্রাচীন, সিলিং, স্তম্ভ, জানালা, বা বইয়ের একটি পৃষ্ঠা ইত্যাদি-প্রকৃতির যেকোন বস্তুকেই তা অলংকৃত করে, তাকেই রূপান্তরিত করে নির্ভর, স্বচ্ছ, ভাসমান প্যাটার্নে, যা অন্তহীনতার অভিমুখে সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির বিষয় প্রকৃতি নিজে নয়-বরং তা হচ্ছে “transubstantiated”, এতে কেবল একটি দৃষ্টিক্ষেত্র হয়ে উঠে। নান্দনিকতার দিক দিয়ে এরাবেক্স শিল্পরূপের মাধ্যমে নিঃসর্গের বস্তু হয়ে উঠে অনন্তের দিকে একটি জানাল। একে যখন অনন্তের ইশারা হিসেবে দেখা হয় তখন ইন্দ্রিয়াতীততার একটি মানে স্পষ্ট হয়ে উঠে- নেতিবাচকভাবে প্রদত্ত হলেও একমাত্র মানেই, যা ইন্দ্রিয়গত রূপায়ণ এবং ইনটুইশনের পক্ষে অর্জন সম্ভব

এতেই আমরা ব্যাখ্যা পাই কেন মুসলমানরা যে শিল্প সৃষ্টি করেছেন তার প্রায় সবটাই বিমূর্ত, এমনকি, যেখানে লতাপাতা, জীবজন্তু এবং মানুষের প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেও আর্টিষ্ট এগুলোকে যথেষ্ঠভাবে শৈলী রূপ দিয়েছে, এরা যে প্রকৃত কোন সৃষ্ট বস্তু নয়, তা প্রকাশ করার জন্যএকথা অস্বীকার করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কোন অতীন্দ্রিয় সারসত্ত্বা বাস করছে এই প্রয়াসে মুসলিম শিল্পী সাহায্য পেয়েছে, তার ভাষাগত এবং সাহিত্যিক উত্তরাধিকার থেকে। একই উদ্দেশ্যে সে আরবী বর্ণমালা এভাবে বিকাশ সাধন করেছে যাতে করে তা হয়ে ওঠে একটি অন্তহীন এরাবেক্স শিল্পকলা, যার প্রসার ঘটেছে ক্যালিগ্রাফারের পছন্দমত যে কোন দিকে, অপরিবর্তনীয়ভাবে; মুসলিম স্থপতিদের বেলায় একই কথা সত্য, যার ইমারত হচ্ছে তার সম্মুখভাগ, এলিভেশন, স্কাইলাইন এবং মেঝে পরিকল্পনার দিক দিয়ে একটি এরাবেক্স শিল্পকলা। ভূগোল বা নৃতত্ত্বের দিক দিয়ে মুসলিম আর্টিষ্টরা যত পৃথকই হোক, যাদের বিশ্বদৃষ্টি ইসলামের বিশ্বদৃষ্টি, সেই সকল শিল্পীরই একটি সাধারণ বিভাজক হচ্ছে তাওহীদ

 

. নন্দনতত্ত্বে ইসলামের বন্ধন মুক্তি

কোন কিছুই, যা প্রাকৃতিক বস্তু নয়, তা ঐশী সত্ত্বাকে প্রকাশ করার একটি মাধ্যম হতে পারে না, এর দ্বারা সাধারণত এ সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা হয়না যে, প্রকৃতির একটি বস্তু সেই সত্যকে প্রকাশের একটি বাহন হতে পারে- অর্থাৎ এই সত্যটিকে যে ঐশী সত্ত্বা আসলেই অসীম এবং অনির্বচনীয়। ঐশী সত্ত্বা অনির্বচনীয় বলেই তাকে প্রকাশ না করা এক কথা এবং এই সূত্রের অন্তর্গত সত্যকে প্রকাশ করা আরেক কথা। স্বীকৃতভাবেই, আল্লাহ যে ইন্দ্রিয়ের দিক দিয়ে অনির্বচনীয় এই সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ তা যে কোন শিল্পীর কল্পনাকে বিহ্বল করে দেয়। কিন্তু ইহা অসম্ভব নয়। বস্তুত এখানেই ইসলামের শৈল্পিক প্রতিভা বিজয়ী বন্ধন- মুক্তি অর্জন করে। আমরা দেখেছি, প্রাচীন নিকটপ্রাচ্য যে ষ্টাইলাইজেশন সুপরিচিত ছিলো এবং যার অনুশীলন হতো, তাকে আলেকজান্ডার এবং তাঁর উত্তরসূরীগণ কর্তৃক আরোপিত হেলেনিয় প্রকৃতিবাদের প্রতিক্রিয়ায় পূর্ণতার একটি নতুন স্তরে উন্নীত করে। এখন, খ্রীষ্টান ছদ্মাবরণ স্বরূপ হেলিনিজমের মোকাবেলা করতে গিয়ে ইসলামে নন্দনতাত্ত্বিক প্রয়াসের ক্ষেত্রে সেমেটিক প্রক্রিয়া হল একই রকম প্রবল, যেমন প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখা গেল ধর্মতাত্ত্বিক প্রয়াসের ক্ষেত্রে। হযরত ঈসার ঐশ্বরিকতা ইসলাম যে প্রবলতার সঙ্গে প্রত্যাখান করে তার তুল্য প্রত্যাখান হচ্ছে প্রকৃতির সৌন্দর্যতাত্ত্বিক রূপায়ণে প্রকৃতিবাদের অস্বীকৃতি এবং ইসলাম তা সমাধা করেছে ষ্টাইলাইজেশনকে উৎসাহিত করে। একটি শৈল্পিক লতা পাতা বা ফুল প্রকৃতির একটি বাস্তব বস্তুর বর্গের কেচার মাত্র, যাকে বলা যায় অপ্রকৃত। মনে হয় শিল্পী তা অংকন করতে গিয়ে প্রকৃতিকে অস্বীকার করে, অ-প্রকৃতিত্ব অর্থাৎ প্রকৃতিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রত্যাখান প্রকাশের এটি একটি উপযুক্ত হাতিয়ার হতে পারেনা। অবশ্য এককভাবে বিচার করলে শৈলীরূপ লতাপাতা বা ফুল প্রকৃতির বহির্ভূতকেই প্রকাশ করে। কিন্তু স্বতন্ত্ররূপে এতে এই ইঙ্গিতই মিলে যে, বস্তুটির মধ্যে প্রকৃতির মৃত্যুই একটি স্বাতন্ত্রিক রূপ পেয়েছে। প্রাকৃতিক বিষয়কে প্রকৃতিমুক্ত রূপ দিতে গিয়ে এ উচ্চাঙ্গের প্রকৃতিবাদকেও প্রকাশ করতে পারে, যা ইসলামের লক্ষ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। তেমনটি আমরা প্রায়ই দেখতে পাই রূগ্নতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের এবং মৃত্যুর মাধ্যমে জীবন প্রতিফলিত হয়। তাই জুদাইজম যেখানে ব্যর্থ হয়েছে সেখানে সফল হতে হলে ইসলামের ঐশী সত্ত্বার অনির্বচনীয়তা সংরক্ষণের জন্য ভিন্ন কিছু আবশ্যক ছিল১০

এখন এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার জন্য মুসলিম শিল্পী দন্ডায়মান হলেন। তার অনন্য সৃজনশীল এবং মৌলিক সমাধান হচ্ছে, যেন, যে কোন বা সকল স্বাতন্ত্রিকরণকে অস্বীকার করার জন্য এবং পরিণামে চৈতন্য থেকে প্রকৃতিবাদকে চিরতরে নির্বাসন দেওয়ার জন্য শিল্পগত তরুলতা ও ফুলকে অন্তহীন পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা। প্রকৃতি বহির্ভূত কোন বিষয় একইভাবে বার বার প্রকাশ করলে তা অ-প্রকৃতিত্বকেই প্রকাশ করে। এর উপরে যদি শিল্পী অ-প্রকৃত পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে সুন্দর তাত্ত্বিকভাবে অসীমতা ও অনির্বচনীয়তা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়, তেমন অবস্থায় পরিণামে তা হয়ে উঠতে পারে এই সাক্ষ্যের সমার্থক লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, যা উচ্চারিত হয় শাব্দিক এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে। কারণ যে অনির্বচনীয়তা এবং অসীমতা শৈল্পিক প্রতিফলনের উপকরণ, তাতে এগুলো যে অ-প্রকৃতির গুণাবলী তার ইঙ্গিত মেলে। তাই ইসলামী মন এই অনুধাবন করে যে, সেমেটিক চৈতন্যের আদি প্রেরণার সঙ্গে, দৃশ্যশিল্পের সাযুজ্যের একটি পন্থা রয়েছে। কিন্তু এখানে প্রধান বাধা হচ্ছে, প্রকৃতির কোন বস্তু যতো শৈল্পিক রূপই তাকে দেওয়া হউক, কি করে তা অসীমতা ও অনির্বচনীয়তা প্রকাশের বাহন হতে পারে?

 

. আরব চৈতন্য: ইসলামের ঐতিহাসিক ভিত্তিমূল

একটি সমাধান লাভের জন্য ইসলামী চেতনাকারণ নেয় তার নিজের ঐতিহাসিক ভিত্তিমূল, তথা আরব চৈতন্যের উপর। ইহাই সেই ঐতিহাসিক বিষয় যা ঐশী প্রত্যাদেশ অবহিত করে এবং তার সংঘটনের জন্য Sitz-im-Leben রূপে ব্যবহার করেছে। ঐশী সত্য প্রকাশের মাধ্যম ও বাহনরূপে এই চেতনাই মূর্তরূপ লাভ করে হযরত মোহাম্মদের (সা.) মধ্যে, যিনি এই প্রত্যাদেশ লাভ করেন এবং দেশকালের মানবজাতির কাছে তা প্রচার করেন নবুয়্যতের মাধ্যমে। ইসলামের পূর্বে ভাষা এবং লেখন শিল্পে এর অর্জন ছিলো প্রকৃতই একটি অলৌকিক ব্যাপার এবং এ বিষয়টিই নতুন প্রত্যাদেশের ধরন বা পদ্ধতি নির্ধারণ করে তা হবে সাহিত্যের পূর্ণতা, কারণ এই প্রত্যাদেশের জন্য তা ছিলো প্রস্তুত এবং তা বহনের ক্ষতাসম্পন্ন।

আরব চৈতন্যের প্রথম হাতিয়ার এবং তার সকল ক্যাটেগরির অবয়ব হচ্ছে আরবী ভাষা। মূলত আরবী ভাষা হচ্ছে তিনটি মূল ব্যঞ্জন ধাতুমূল নিয়ে গঠিত, যার প্রত্যেকটি তিনশতেরও অধিক রূপে ধাতুরূপ সম্ভাব্য বাচ্যে পরিবর্তন করে উপসর্গ, অনুসর্গ বা মধ্যসর্গ যোগ করে। যে শব্দরূপই গঠন করা হউক না কেন, যে সকল শব্দের একই ধাতুরূপ রয়েছে সে সকলের একই প্রকারত্ব অর্থ রয়েছে, ধাতুমূলের ভিন্নতা সত্বেও, ধাতুর অর্থ একই থেকে যায়, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয় অন্য একটি প্রকারাত্বক অর্থ, ধাতুরূপের মাধ্যমে তা যে অর্থটি লাভ করে এবং সকল সময়, সর্বত্র যা একই থাকে১১। তখন ভাষার একটি যৌক্তিক কাঠামো গঠিত হয় যা প্রথমেই  সুস্পষ্ট, সম্পূর্ণ এবং বোধগম্য। এই কাঠামোটি বুঝতে পারলেই যে কোন ব্যক্তি ভাষাপণ্ডিত হয়ে ওঠে, যখন ধাতুমূলের অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান হয়ে উঠে গৌণও গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য-শিল্প নিহিত রয়েছে বিভিন্ন ধারণার একটি পদ্ধতি নির্মাণে, যে ধারণাগুলো এভাবে পরস্পর সম্পর্কিত যে তাতে করে ধাতুগুলোর কনজুগেশনের মাধ্যমে সাদৃশ্য ও বৈপরীত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যখন বোধ শক্তির পক্ষে সম্ভব হয় জটিলতার মধ্য দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন অভঙ্গুর রেখায় অগ্রসর হওয়া একটি এরাবেক্স শিল্পে, যার মধ্যে ত্রিভুজ, বর্গক্ষেত্র, বৃত্ত, পঞ্চভুজ, অষ্টভুজ ইত্যাদি হাজারো রূপ সবই ভিন্ন বর্ণে বিচিত্র এবং একে অপরের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করে অবস্থান করে তা চোখকে ঝলসে দেয়, কিন্তু মনকে নয়প্রত্যেকটি ফিগারকে তার স্বরূপে চিনতে পেরে বর্ণ বিচরণ করতে পারে একটি পঞ্চভুজ থেকে অন্য একটি পঞ্চভুজে, তাদের বর্ণের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এবং শিল্পকর্মটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত এগোতে পারেপ্রত্যেক বিরতির স্থানেই কিছু আনন্দের অভিজ্ঞতা নিয়ে, একইরূপ আকুতিজাত সাদৃশ্য সামঞ্জস্য প্রত্যক্ষ করেঅর্থাৎ ধাতুমূলের বিভিন্ন অর্থ প্রকাশের একইরূপ ধরন এবং খোদ শব্দমূলগুলো কর্তৃক সৃষ্ট বৈপরীত্ব অনুধাবন করে

 

আরবী ভাষার গঠনমূলক প্রকৃতি তার কবিতাকেও গঠন করে। আরবী কবিতা স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ এবং স্বাধীন শ্লোক নিয়ে গঠিত, যার প্রত্যেকটি একই এবং অভিন্ন ছন্দরূপের অভিন্ন রূপায়ণ। আরবী কাব্য ঐতিহ্যে সুপরিচিত ত্রিশটি প্যাটার্নের মধ্যে যে কোন একটিকে বেছে নেবার স্বাধীনতা কবির আছে। কিন্তু একবার নির্বাচনের পর গোটা কবিতাটির প্রত্যেকটি অংশই এই প্যাটার্নের সঙ্গে সাম্যঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। আরবী কবিতা শ্রবণ এবং উপভোগের তাৎপর্যই হচ্ছে এই প্যাটার্নের সঙ্গে উপলব্ধি; কবিতা আবৃতির সঙ্গে সঙ্গে কবিতার শ্রোতা ও সমজদার এর ছন্দ প্রবাহের সঙ্গে অগ্রসর হয় এবং এই প্যাটার্ন যা প্রত্যাশা করেছে তা প্রত্যাশা ও গ্রহণ করে। অবশ্য প্রত্যেক শ্লোকে শব্দ ধারণা এবং অনুভূতি নির্মাণ পৃথক পৃথক। এতে করেই রংয়ের বৈচিত্র ফুটে ওঠে, কিন্তু তার কাঠামোগত রূপ আগাগোড়ায় এক।

আরবী ভাষা ও আরবী কবিতার এই বুনিয়াদি জ্যামিতির বদৌলতে আরব চৈতন্য দ্বিরায়তনের পর্যায়ে অনন্তের ধারণা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। ধাতু মূলগুলো বহু, বলা যায় অনন্ত, কেননা তিনটি স্বরবর্ণের যে কোন নতুন সম্মেলনের প্রতি প্রথাগতভাবে যে কোন অর্থ আরোপ করা যেতে পারে। আরবীয় চৈতন্য বিদেশী ধাতুমূলকে অবিচলিত স্থৈর্যের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং এজন্য বিদেশী শব্দমূলটিকে আরবীয় রূপদানের জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার নিজস্ব ধাতুরূপের কারখানার উপর। তাদের সংখ্যার অনন্ত তার মতই তাদের ধাতুমূলও অনন্ত, ধাতুমূলের পরিচিত, প্যাটার্ন রয়েছে সীমিত সংখ্যক শব্দমূলেরই ধাতুরূপ করা হয়েছে এবং তাদের ধাতুরূপগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ওয়েবষ্টার কিংবা অক্সফোর্ডের মত আরবী ভাষার একটি অভিধান, যাতে সকল শব্দ সংকলিত এবং তালিকাবদ্ধ হবে তা একেবারেই অসম্ভব, কারণ কাল পরম পরাক্রমে পরিচিত সকল শব্দমূলের ধাতুরূপ করা হয়নি। ধাতুমূলের তালিকা কখনো বন্ধ করা হয়নি। ধাতুরূপের সব কয়টি ধরন বা রূপ ব্যবহৃত হয়নি এবং ধরনের তালিকাও সমাপ্ত হয়নি। ঐতিহ্য সচেতনবোধ দ্বারা নতুন ধরনের সম্ভাবনা অস্বীকার করেনা। তবে তারা সেই প্রতিভার অপেক্ষায় থাকেন যে যৌক্তিকতা প্রমাণ এবং নিজের সুবিধার খাতিরে ব্যবহার করা যায়। তাই আরবী ভাষা অস্তিত্বের আরবীয় প্রবাহের মতই এমন একটি পদ্ধতি যা কেন্দ্রস্থলে উজ্জ্বল (ঐতিহ্য হেতু), কিন্তু কিনারের দিকে অস্পষ্ট, যা সকল দিকে ছড়িয়ে পড়ে অনিশ্চিতভাবে১২

এবার কবিতার কথায় আসা যাক। শ্লোকগুলোর ছন্দরূপ কবিতার অবয়র গঠন করে বলে কোনো কবিতার শ্লোকগুলোর জন্য জরুরী নয়- কবি যে ধারণায় সেগুলো রচনা করেছেন সেই ক্রম অনুসারে সেগুলো পাঠ করা, বা অন্য কোন নিয়ম অনুসারে। কবিতাটি শুরু থেকেই সমাপ্তির দিকে পাঠ করা হোক কিংবা সমাপ্তি থেকে শুরুর দিকে আবৃত্তি করা হোক, কবিতাটি বরাবরই একই রকম মাধুর্য বজায় রাখে, কারণ কবি প্রত্যেকটি শ্লোকের সঙ্গে তার প্যাটার্নের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে গেছেন। পুনরাবৃত্তিতে আমরা আনন্দিত হই, কারণ তাতে করে আমাদের ইনটুইটিভ ক্ষমতা স্বীকৃত হয়, অর্থ এবং বোধ কাঠামোর বাস্তবতার বৈচিত্র থেকে আমরা যা প্রত্যাশা করেছিলাম তা প্রত্যাশা ও উপলব্ধি করতে পারি। তাই সংজ্ঞা অনুসারে কোনো আরবী কবিতাই সম্পূর্ণ এবং বন্দী নয় এবং কোন অর্থেই পরিপূর্ণ নয়, যাতে করে মনে করা যেতে পারে কবিতার সঙ্গে কোন কিছু যোগ বা নিরবচ্ছিন্নতা ব্যাহত হতে বা এমন কিছু ধারণা করা যেতে পারে। বলতে কি, আরবী কবিতাকে উভয় দিকে টেনে নিয়ে অগ্রসর হওয়া সম্ভব, তার শুরুতে এবং তার অন্তে। তার সৌন্দর্যকে বিন্দুমাত্র ক্ষুন্ন না করে কোন মানুষ কর্তৃক, ব্যক্তিগত রচনাশৈলীর দ্বারা না হলেও কবিতাটির রচয়িতার দ্বারা তো বটেই। বস্তুত আমরা যদি উত্তম শ্রোতা হই, তাহলে একথা ধরে নেয়া হবে যে, আমরা কবির সঙ্গে তার কবিতা সৃষ্টিতে সূচনাতে অংশগ্রহণ করবো। যেমনটি করা হয় একটি জীবন্ত অভিনয়, এবং দ্বিতীয়ত আমরা তার কবিতা অনুসরণ করবো আমাদের নিজেদেরই হিতার্থে, কেননা তার আবৃত্তি যে গতি সঞ্চার করেছে তার দ্বারা আমাদেরকে বন্দী করেছে এবং আমাদেরকে এর নিজস্ব অসীম কাব্যিক পরিমন্ডলে নিক্ষেপ করেছে। আরব জগতে একজন কবির জন্য এ কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, যখন কবি মহৎ শ্রোতাদের উপস্থিতিতে সেই শ্রোতাদের মৌখিক সাহায্য লাভ করেন, তার কবিতার আবৃত্তিতে, যে কবিতা ইতিপূর্বে কখনো তিনি শোনেননি অথবা তার কবিতার সঙ্গে একই কবিতার আরো অংশ যোগ করে, তার প্রতি মন্তব্য প্রকাশ করে থাকেন১৩

 

. ইসলাম প্রথম শিল্পকর্ম: আলকুরআনুল করীম

এই আরব চৈতন্যই ইসলামের ছাঁচ এবং বুনিয়াদ হিসেবে কাজ করে। ইসলামী প্রত্যাদেশ আল-কুরআনুল করীম নাযিল হয় মহত্তম শিল্পকর্ম হিসেবে। সেই চৈতন্যের সকল আদর্শ লক্ষ্য একই মুহূর্তে চূড়ান্ত পরিপূরণের জন্য এই অনুভূতি আসে।

কোন কিছু যদি শিল্পের দাবী রাখে, কুরআন নিশ্চয়ই শিল্প কোন কিছুর দ্বারা মুসলিম মন যদি আন্দোলিত প্রভাবিত হয়ে থাকে, নিশ্চয়ই কুরআন কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছে এই প্রভাব যদি কোথাও ভিত্তিমূলক উপাদানে পরিণত হবার মত যথেষ্ট গভীরতা অর্জন করে থাকে, তা হচ্ছে নন্দনতাত্ত্বিকতা এমন কোন মুসলমান নেই কুরআনের সুর মুর্ছনা, ছন্দ এবং তার প্রাঞ্জলতার বিভিন্ন স্তর, যার অস্তিত্বের গভীরতম মর্মমূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়নি এমন কোনো মুসলমান নেই, যার আদর্শ সৌন্দর্যের মান কুরআন নতুন করে গড়েনি এবং তার নিজের আলোকে নির্মাণ করেনি

মুসলমানরা কুরআনের এই দিকটিকে ই’জাজ বলে উল্লেখ করেছে, যার অর্থ হচ্ছে স্তব্ধ করে দেওয়া। “ই’জাজ পাঠককে একটি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় স্থাপন করে, যা মোকাবেলা করার জন্য সে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু কখনো মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়না।” বস্তুত কুরআন নিজেই সর্বোচ্চ সাহিত্যিক শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী আরব শ্রোতাগণকে আহ্বান করেছে কুরআনের মত কিছু সৃষ্টি করতে (২: ২৩) এবং তাদের ব্যর্থতার জন্য তাদের তিরস্কার করেছে (১০: ৩৮), (১১: ১৩), (১৭: ১৮)। রাসূলুল্লাহর সমসাময়িকদের মধ্যে ইসলামের কতিপয় শত্রু এই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলার জন্য দাঁড়িয়েছিল, তারা তাদের বিরোধী এবং তাদের আপন বন্ধুদের বিচারে অপমানিত হয়েছিল১৪। মোহাম্মদকে (সা.) বলা হল “একজন ভূতাবিষ্ট মানুষ (১৮: ২২) এবং কুরআন একটি যাদুর কিতাব” (২১: ৫৩), (২৫: ৪), কেবল মাত্র শ্রোতাদের চেতনার উপর এর ক্রিয়ার কারণে।

প্রত্যেকেই এ সত্যটি বুঝতে পারে যে, যদিও কুরআনের আয়াতগুলো কবিতার কোন জ্ঞাত প্যাটার্নের সঙ্গে খাপ খায়না, তবু কবিতার মত একই প্রভাব বিস্তার করে এই সব আয়াত। বলতে কি চূড়ান্ত মাত্রায়, প্রত্যেকটি আয়াতই সম্পূর্ণ এবং নিজস্ব গুণেই নিখুঁত, প্রায়ই তা পূববর্তী আয়াত বা আয়াতসমূহের সঙ্গ ছন্দে মিলে যায় এবং তা পরম সৌন্দর্যের উচ্চারণ বা সাহিত্যিক অভিব্যক্তির মধ্যে নিহিত এক বা একাধিক ধর্মীয় বা নৈতিক তাৎপর্য বহন করে এর আবৃত্তি এত প্রবল গতিসঞ্চার করে যে, শ্রোতারা অনিবার্যভাবেই এ আবৃত্তির সঙ্গে অগ্রসর হতে পরবর্তী আয়াতটি আশা করতে এবং তা শ্রবণের পর গভীরতম স্বীকৃতিতে পৌছাতে বাধ্য হয়। এর পর প্রক্রিয়াটি আবার শুরু হয় পরবর্তী একটি, দুটি অথবা তিনটি বা তিনের অধিক একটি গুচ্ছ আয়াতের সঙ্গে১৫

মুসলিম আরবরা কি সপ্তম শতকে কোনো শিল্প নিয়ে আর্বিভূত হয়েছিলো? তারা কি বিজিত জাতিগুলোর পরবর্তীকালে বিকশিত শিল্পকলায় প্রাসঙ্গিক কোন অবদান রেখেছিলো? অজ্ঞতা বা বিদ্বেষ বশে এবং প্রায়ই এতদ উভয়ের দুঃখজনক সংমিলনে, ইসলামী শিল্পের প্রত্যেকটি পাশ্চাত্য ইতিহাসবিদ জবাব দিয়েছেন, ‘না’। এই শাস্ত্রের পিতামহ ঘোষণা করেছেন, “প্রথম যেসব লোক নিয়ে এই সব সেনাবাহিনী গঠিত হয় (ইসলামের প্রথম আরবীয় সেনাবাহিনী) তারা ছিলো মুখ্যত বেদুইন, এমনকি যারা স্থায়ী বসতি থেকে আসে, যেমন মক্কা ও মদীনা থেকে আগত লোকেরাও স্থাপত্য শিল্পের কিছুই জানতোনা১৬।” তরুণতর প্রজন্ম অন্তহীনভাবে বার বার একথাই বলে, “মুসলিম শিল্পকলা তার আরব অতীত থেকে বলতে গেলে কিছুই অর্জন করেনি১৭।”

সত্য তাদের এই সব অভিযোগের কত বিপরীত। গোটা ইসলামী শিল্পকলাই অর্জিত হয় আরব অতীত থেকে- যা কিছু গঠনমূলক এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ সে সবের মর্মবাণী, নিয়মকানুন এবং পদ্ধতি, এ সবের লক্ষ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পন্থা, সমস্ত কিছুই নিশ্চয়ই দৃশ্য ক্ষেত্রগুলোতে ইসলামী শিল্পকলার প্রয়াসের জন্য আবশ্যক ছিলো উপকরণের এবং বিষয়বস্তুর এবং যেখানে এগুলো পেয়েছে ইসলামী শিল্পকলা সেখান থেকে এগুলো নিয়েছে। কিন্তু শিল্পের অর্থ ও তাৎপর্য, তার ইতিহাস ও তথ্যের যে কোন আলোচনায় এগুলোকে ঋণ বলে উল্লেখ করা রচিবিরুদ্ধভাবে অগভীর। একটি শিল্পকর্ম শিল্প হয়ে উঠে তার শৈলী, তার উপাদান এবং তা প্রকাশের মাধ্যমে- সে যে সব উপকরণ ব্যবহার করে, যা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ভৌগোলিক অথবা সামাজিক আকস্মিকতা থেকে অর্জিত। আরব চেতনায় ইসলামের মাধ্যমে এই ভিত্তির কারণে ইসলামী শিল্পকলা একটি ঐক্য। আরব চৈতন্যের রীতিপ্রণালীগুলোর দ্বারাই সকল মুসলমানের শিল্পসৃষ্টি নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে১৮

 

. দৃশ্যশিল্পের নন্দনতাত্ত্বিক রূপ

পাশ্চাত্য দৃষ্টিনির্ভর শিল্পকলা প্রায় সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করে মানব প্রকৃতির উপর- মানুষের প্রতিকৃতি, ভূ-চিত্র, স্থির জীবন, এমনকি বিমূঢ়ত্ব, নক্সা বা নক্সাহীনতার মাধ্যমে, যেভাবেই প্রকাশিত হউক। ইসলামী দৃশ্যশিল্পের আগ্রহ ছিলনা মানব প্রকৃতিতে, বরং তার আগ্রহ ছিল ঐশী প্রকৃতিতে। যেহেতু মানব প্রকৃতির নতুন নতুন দিক প্রকাশ করা এর লক্ষ্য ছিলোনা, এজন্য এ শিল্প নন্দনতাত্ত্বিকভাবে ফিগার বা প্রতিকৃতির আলোচনা করেনি, অর্থাৎ মানব প্রকৃতির যে অসংখ্য বৈচিত্রপূর্ণ রূপায়ণ ঘটে তা চিত্রিত করেনি। মানব চরিত্র যা মানুষের প্রাকসিদ্ধ এমন একটি ধারণা, যে ধারণায় মানুষকে লক্ষ লক্ষ খুঁটিনাটিরূপে বিশ্লেষণ করা যায় বলে ধরে নেয়া হয়, যে সব খুঁটিনাটিতে মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্য একটি গভীরতা বা উচ্চতা উদ্‌ঘাটিত হয়, এসবই কিন্তু মুসলিম শিল্পীর লক্ষ্যবস্তু ছিলনা। ঐশী সত্ত্বা হচ্ছে তার প্রথম প্রেম এবং তার শেষ আবিষ্টতার বিষয়। তার জন্য ঐশী সত্ত্বার সম্মুখে দাঁড়ানো হচ্ছে অস্তিত্বের এবং সমস্ত মহত্ব সৌন্দর্যের শীর্ষবিন্দু। এই লক্ষ্যে মুসলমানরা নিজেদের চারপাশে জড় করে প্রত্যেকটি অবলম্বন এবং প্রত্যেকটি উদ্দীপক যা সেই ঐশী অস্তিত্বের উপস্থিতির সম্পর্কে ইতিহাসে সহায়তা করে।

প্রথমে, শৈলীকরণের মাধ্যমে প্রকৃতিকে যেহেতু তার প্রকৃতিত্ব থেকে মুক্ত করা হয়, সেজন্য প্রথম দিকের আরব মুসলমানরা সেই উপায়টিকে তার অনিবার্য পরিণতির দিকে নিয়ে যান। অধিকন্তু শৈলীকরণের অর্থ হচ্ছে বৈচিত্র বা পরিবর্তনকে অস্বীকার করা- কাণ্ড থেকে শাখা প্রশাখা পত্রপল্লব পর্যন্ত বিকাশ সাধন, যেমনটি ঘটে থাকে উদ্ভিদ জগতে, অংকন শিল্পের আগাগোড়া কাণ্ড এবং শাখার গাঢ়ত্ব হয়ে উঠে এক, অভিন্ন এবং আকার অথবা রূপ হয়ে উঠে একই। পরিবর্তনের অনুপস্থিতির কারণেও ক্রমবিকাশ বাতিল হয়ে যায়। একই চিত্রের মধ্যে সকল পত্র পল্লব এবং ফুল পায় একই রূপ। পরিশেষে প্রকৃতিবাদের প্রতি মৃত্যু আঘাত হচ্ছে পুনরাবৃত্তি। বৃন্ত, এবং ফুল বার বার অংকন করে এবং সেগুলো একটি অপরটি থেকে অন্তহীন পর্যায়ে এমনভবে নির্গত দেখিয়ে যা প্রকৃতিতে অসম্ভব, প্রকৃতি সম্পর্কে সকল ধারাণাকেই মুছে দেওয়া হয়। পুনরাবৃত্তি এত নিশ্চিতভাবে এবং অভ্রান্তভাবে এই পরিণতি ঘটায় যে, তা আপন শত্রুকেও পর্যন্ত সয়ে যায়- অর্থাৎ বিকাশরূপ তার আপন শত্রুকেও সে বরদাস্ত করে- অবশ্য যদি একটি শিল্প কর্মের অংশে তার বিকাশ ঘটে ও তার পুনরাবৃত্তি ঘটে সমগ্র শিল্পকর্মটির মধ্যে। এভাবে চৈতন্য থেকে প্রকৃতিকে নির্মূল করা হয় এবং তা প্রকৃতিকে চিত্রিত করা হয়। যদি দর্শকের চৈতন্যে বৃন্ত পত্রপল্লব এবং ফুল তখনো প্রকৃতির কোনো চিহ্ন বা অবশেষ রেখে দেয়, সে অবস্থায় সকল ভগ্ন, বৃত্তাকার ফোয়ারার মত উৎসারিত বা বংকিম রেখা যা ফ্রীলান্স, নক্সা বা জ্যামিতিক ফিগারে ব্যবহৃত হয়, তাহলে এ কাজটি সম্পন্ন হবে সন্দেহাতীতভাবে উৎকৃষ্টতররূপে। এটিকে বৃত্ত, পাতা, ফুল উপকরণের সঙ্গে যুক্ত করে দর্শককে উদ্দিষ্ট (জ্যামিতিকতা এবং তার প্রাকৃতিকতার) দিকটি তুলে ধরে পরিশেষে পুনরাবৃত্তিকে যদি সিমেট্রির নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়, যাতে করে তা একই দূরত্ব বজায় রেখে সকল দিকে অগ্রসর হতে পারে, সে অবস্থায় শিল্পকর্মটি মর্মের দিক দিয়ে হয় একটি অনন্ত দৃষ্টিক্ষেত্র। ঘটনাক্রমে এই অনন্তক্ষেত্রের একটি অংশই মাত্র শিল্পী নিজের খেয়াল মত বেছে নেয় এবং পৃষ্ঠা, প্রাচীর, প্যানেল অথবা ক্যানভাসের বাস্তব ফ্রেমে তাকে সীমিত করে, যেখানে মানুষের ফিগারের জান্তব দিকটি ব্যবহৃত হয়, যেমন দেখা যায় ইরানের মিনিয়েচারে; সেখানে প্রকৃতিমুক্ত অবস্থা অর্জিত হয় প্রাণীটির শৈলীরূপ সৃষ্টি করে, এবং মানুষের মুখমন্ডল এবং শরীরকে কোন বিশিষ্ট রূপ, চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব অর্পণ না করে একটি ফুলেরবমতই একজন মানুষ অ- প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করতে পারে শৈলীকরণের মাধ্যমে কিন্তু আসলে ইহাইতো ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের বিমোচন। একারণেই, পারস্যের মহত্তম মিনিয়েচারগুলোতে সব থাকে একাধিক মানুষের ফিগার। তাদের একজনকে অপরজন থেকে স্পষ্টরূপে চিহ্নিত করা যায় না১৯। আরবী কবিতার মতই মিনিয়েচারগুলো চিত্রিত হয় অনেকগুলো অংশ নিয়ে, যারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন, যাদের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব একটি স্বাধীন কেন্দ্রবিন্দু রয়েছে। দর্শক যেমন কবিতার নক্সা বা ছকে স্থাপিত সাহিত্যিক মনিমুক্তাগুলো নিজ চৈতন্যে প্রত্যক্ষ করে, আনন্দের স্বাদ উপভোগ করে, একইভাবে দর্শক গালিচায়, দরজা, প্রাচীর, ঘোড়ার জিন, মানুষের পাগড়ি বা পোশাক ইত্যাদিতে মিনিয়েচারের একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্রে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লতাপাতার বৃন্তে শিল্পগুলো সম্পর্কে চিন্তা করে এবং তখন তাদের মনে এই প্রত্যাশ্যাও থাকে যে, আরও সব অনন্ত কেন্দ্র রয়েছে যার দিকে সে অগ্রসর হতে পারে২০

ইসলামী শিল্পকর্মের সকল অংকন এবং অলংকরণে প্রশ্নাতীতভাবে রয়েছে গতি- প্রকৃতিপক্ষে যে গতি অনিবার্য একটি নক্সার এক ইউনিট থেকে অন্য ইউনিটের দিকে এবং পরে এক নক্সা থেকে অন্য নক্সায় এবং আসলে, একটি দৃষ্টিক্ষেত্র থেকে অন্য একটি দৃষ্টিক্ষেত্রের দিকে, যেমনটি আমরা দেখতে পাই বড় বড় প্রাসাদের বিশাল তোরণে, সম্মুখ ভাগে অথবা প্রাচীরগুলোতে। কিন্তু এমন কোন ইসলামী শিল্প কর্মই নেই যেখানে গতি চূড়ান্ত। দর্শকের দৃষ্টি যে চলমান থাকে তাই মূল কথা। দর্শকের মন গতিশীল হয়ে উঠে অনন্তকে প্রত্যক্ষ করার সন্ধানে। ভর, আয়তন, স্থান, বেষ্টনি, সৌন্দর্য, সামঞ্জস্য, টেনশন এসবই হচ্ছে প্রকৃতির বাস্তবতা, যেগুলোকে অস্বীকার করতে হবে যদি অ-প্রকৃতির উপলব্ধি অর্জন করতে হয় স্বজ্ঞার সাহায্যে। কেবলমাত্র তেমন একটি নক্সাই, তেমন একটি মোমেন্টাম-স্রষ্টা প্যাটার্নই মুসলিম সৌন্দর্য- প্রেমিককে ঘিরে থাকে- সকল দিকে অনন্ত পৃথিবীতে ছাড়িয়ে হয়। এতে করে তার মধ্যে সৃষ্টি হয় একটি ধ্যানী মেজাজ যা ঐশী সত্ত্বার ইনটুইশনের জন্য আবশ্যক। কেবল একটি বইয়ের প্রচ্ছদের ডিজাইন নয়, যে আলোকিত পৃষ্ঠাটি সে পড়ছে তার পায়ের নিচের গালিচা, তার বাড়ীর সিলিং এর সম্মুখ ভাগ, ভিতর ও বাইরের প্রাচীরগুলোই কেবল নয়, বাড়ীটির মেঝের পরিকল্পনাও এমন একটি এরাবেক্স তৈরী করে, যেখানে বাগিচা, বাড়ীর উঠান, প্রবেশ কক্ষ এবং প্রতিটি কক্ষই একটি স্বতন্ত্র কেন্দ্র, লতাপাতার নিজস্ব শিল্পরূপ সমেত যা তার নিজস্ব গতি সৃষ্টি করে।

কিন্তু এরাবেক্স কি? আমরা উপরে এই পরিভাষাটি ব্যবহার করেছি একথা ধরে নিয়ে যে পাঠক এ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। যথার্থভাবেই এধারণা করেছি, কারণ অন্য যে কোন শিল্পকর্ম থেকে এরাবেক্সকে মুহূর্তে পৃথক করে চেনা যায়। সকল মুসলিম দেশে এই শিল্পরূপটি সর্বব্যাপী, এটি সকল ইসলামী শিল্পকর্মের একটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য বা উপাদান। যথাযথই একে বলা হয় এরাবেক্স, কেননা আরবী কাব্য এবং আরবী কুরআনের মতই এটি আরবীয়, তার নান্দনিকতার দিক দিয়ে। এর অস্তিত্ব যে কোন পরিবেশকে রূপান্তরিত করে ইসলামী আবহে, এই বৈশিষ্ট্যটিই চূড়ান্ত রকমে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শিল্পকর্মে দান করে একটি ঐক্য। এটি সঙ্গে সঙ্গে চেনা যায় এবং আসলে এতে ভুল হবার কোন সম্ভাবনা নেই। মূলত এটি অনেকগুলো ইউনিট বা ফিগারের সমন্বয়ে রচিত যা একত্রে মিলিত হয় এবং এমনি ধারা পরস্পর জড়াজড়ি করে, যার ফলে একটি ফিগার বা ইউনিট থেকে অন্য একটি ইউনিটের অভিমুখে অগ্রসর হয় সকল দিকে, যতক্ষণ না শিল্পকর্মটিকে তার বাস্তব কিনার থেকে কিনার পর্যন্ত অতিক্রম করে গেছে দৃষ্টি। ফিগার বা ইউনিটটি অবশ্যই সম্পূর্ণ এবং স্বতন্ত্র, কিন্তু তা পরবর্তী ফিগার বা ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত, দৃষ্টি বাধ্য হয় অগ্রসর হতে একটি ফিগারের আউটলাইন এবং নক্সা অনুসরণ করে পরবর্তী ফিগারটির রূপরেখা এবং নক্সার অনুসন্ধানে। এতেই সৃষ্টি হয় ছন্দ। এই গতিটি মন্থর হতে পারে যতই ফিগারগুলো পরস্পর থেকে হবে অধিকতর বিচ্ছিন্ন। যাই হোক, ফিগারগুলো যতই অধিকতর নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হবে যার ফলে গতি, যতি এবং ছন্দ সৃষ্টি হয় এবং রেখাগুলোর ঘূর্ণায়মানতা এবং ভগ্নতার দ্বারা যতই গতি বাধাগ্রস্থ হয় ততই বেশী শক্তি সঞ্চারিত হয় এরাবেক্স এর গতিবেগে। গতিবেগ যত বাড়বে ততই মনের জন্য সহজ হবে যুক্তিচিন্তার জন্ম দিতে, যাতে করে শিল্পকর্মের সীমা ছাড়িয়ে কল্পনায় ঝাপ দিতে পারে, মন যা চায় তা সৃষ্টির প্রয়াসে। এই প্রক্রিয়ার জন্য পুনরাবৃত্তি আবশ্যক। একারণে যেকোন শিল্পকর্মে ভিন্ন ভিন্ন রকম অনেকগুলো এরাবেক্স এর কাজ থাকে যার প্রত্যেকটি ঢেকে দেয় একটি কাঠামোগত অংশ। উদ্দেশ্যটি সুস্পষ্টঃ এর উদ্দিষ্ট উড্ডয়নের উপর কল্পনার উৎক্ষেপণ। এটি ঘটতে পারে দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা দশম এরাবেক্স-এ, যদি তা না আসে প্রথমটির সঙ্গে।

এরাবেক্সগুলো হয়ে থাকে লতাপাতা ফুলময় বা জ্যামিতিক, শিল্প মাধ্যম হিসেবে সেগুলো যে বৃন্ত, পত্র, ফুল ব্যবহার করলো (আল-তাওরিক) অথবা যে জ্যামিতিক বসম (ফিগার) ব্যবহার করলো, তার উপর ভিত্তি করে। জ্যামিতিক ফিগারটি হতে পারে খাত (রৈখিক) সৎ, যদি তা সরল এবং ভগ্ন রেখা ব্যবহার করে অথবা তা হতে পারে বংকিম (রামী) যদি তা ব্যবহার করে বহুকেন্দ্রিক বক্ররেখা। এ সমস্তরই সম্মেলন ঘটতে পারে এবং তখন তাকে বলা হর বাড়ী। এরাবেক্সগুলো হবে প্লানার বা সমতলিক, যদি সেগুলোর থাকে দুই আয়তন, যেমনটি আমরা দেখতে পাই প্রাচীর, দরজা, সিলিং, আসবাবপত্র কাপড়, গালিচা, পুস্তকের মলাট এবং পৃষ্ঠার সকল অলংকরণের মধ্যে। এগুলো স্থান বিষয়ক অথবা ত্রিমাত্রিক হতে পারে যা নির্মিত হয় স্ব স্ব, তোরণ এবং গম্বুজের পাঁজরের সাহায্যে। এই রূপটি হচ্ছে মাগরিব এবং আন্দালুসিয়ার স্থাপত্যের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য যার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই কর্ডোভার মহান মসজিদে এবং গ্রানাডার আলহামরা প্রাসাদে। আলহামরাতে দৃশ্যমান তোরণের উপর স্থাপিত পরস্পর জড়াজড়ি করা বহু তোরণ দ্বারা নির্মিত হয়েছে একটি  সম্পূর্ণ গম্বুজ যা কেবলমাত্র উদ্দীপ্ত কল্পনাই প্রত্যক্ষ করতে এবং তাদের গতিপথ অনুসরণ করতে পারে। এখানে গতিবেগটি এমনই প্রচন্ড যে ছন্দের সঙ্গে অগ্রসর হতে ইচ্ছুক যে কোন ব্যক্তিকে তা পরিচালিত ও নিক্ষেপ করতে পারে অনন্তের সরাসরি উপলব্ধির দিকে। একটি প্রকাণ্ড মসজিদের মহৎ সম্মুখভাগ, একটা বিশাল প্রাচীরে প্রবেশ কক্ষের প্যানেল, দরজার যে হাতলের উপর দৃষ্টি হুমড়ি খেয়ে পড়ে, একটি পুস্ত কের পৃষ্ঠায় একটি মিনিয়েচার, একটি গালিচার নক্সা অথবা আপন কাপড় চোপড় বা বেল্ট কিংবা বেল্টের বাকল সবই মুসলিমের কাছে ঘোষণা করে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, কেননা সে অ-প্রকৃত বা সৃষ্টিকে ছাড়িয়ে যাওয়া অলৌকিক জগতের অসীমতা ও অনির্বচনীয়তা প্রত্যক্ষ করে এসবের মাধ্যমে২১

 

. আরবী ক্যালিগ্রাফি: অতিন্দ্রীয় উপলব্ধি বা চৈতন্য

মুসলিম চৈতন্য ইন্দ্রিয়াতীত ঐশী সত্ত্বা নিয়ে এতটাই আবিষ্ট যে, মুসলিম উপলব্ধি চেয়েছে সর্বত্রই তার প্রকাশ দেখতে এবং ঐশী উপস্থিতি ঘোষণা করার পন্থা ও উপায় খুঁজে বার করার জন্য এই চৈতন্য এতটাই ব্যগ্র ছিল যে, এই করে পরম ভাব উচ্ছাসের সঙ্গে এমন একটি প্যাটার্ন নির্মাণ যা মানবজাতির অভিজ্ঞতায় আগে কখনো ঘটেনি। এমন কি দৃশ্য শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে এর প্রতিভার জন্য এরাবেক্স-এর অনন্ত বৈচিত্রও যথেষ্ট ছিলোনা। এ প্রতিভা প্রত্যেকটি চিন্তনীয় শিল্প প্রয়াসের বিষয়কে ব্যবহার করেছে, এমন একটি দর্পণে রূপান্তরিত করেছে যাতে এর মর্ম প্রতিবিম্বিত হয়। এটি তখন পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলো আরো একটি অধিকতর চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য।

 

প্রাক-ইসলামী ইতিহাস, সাহিত্যিক গদ্য এবং কবিতায় শব্দের সৌন্দর্য বা নান্দনিকতা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। যদিও এর ধারণা ইসলামের আবির্ভাবকালে, আরবদের অনুরূপ অন্য কারো হাতে ততটুকু বিকশিত ছিলনা, তবু মেসোপটেমিয় এবং হিব্রুগণ, গ্রীক এবং রোমানগণ এবং হিন্দুরা শব্দের নান্দনিকতার সীমান্তকে যতদুর প্রসারিত করেছিল, তা সামান্য বিষয় ছিল না। লিখন শিল্প ছিল অপরিপক্ক, স্থূল এবং সারা পৃথিবীতে সৌন্দর্যের বিচারে অনাকর্ষণীয় এবং এখনো প্রায় সর্বক্ষেত্রে একই অবস্থা বিদ্যমান। ভারত, বাইজানটিয়ান এবং খৃষ্টান প্রতীচ্যে লেখন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে এর যথোচিত ক্যাপাসিটি অনুযায়ী, অর্থাৎ যৌক্তিক প্রতীক হিসেবে। খৃষ্টান ও হিন্দুধর্মের দৃশ্য (প্রতিকৃতি মূলক) শিল্পের প্রকাশ কল্পিত হয়েছে লিখনের মাধ্যমে, অর্থাৎ বাঞ্ছিত খণ্ড খণ্ড ধারণাকে প্রকাশ করার জন্য শব্দের যৌক্তিক প্রতীকতার সাহায্যে তা ব্যক্ত হয়েছে। দৃশ্যশিল্পকে উদ্ধার করার জন্য অসংলগ্ন বিষয়ান্তরগামী চিন্তার সাহায্যের প্রয়োজন নেই, যদি না সেই শিল্প বাঞ্ছিত প্রাকসিদ্ধ ধারণাটিকে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে প্রকাশ করার জন্য অক্ষম হয়। এপোলো এবং এফ্রোদিতের জন্য এধরনের কোন অবলম্বনের প্রয়োজন ছিলোনা দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে, কেবল দৃষ্টহিসেবেই ওরা দর্শকের কাছে ঐশীত্ব প্রকাশ করেছে, কারণ মানব প্রকৃতির সৌন্দর্য থেকেই এবং ইন্দ্রিয়কে প্রদত্ত চরিত্র থেকেই প্রত্যক্ষভাবে ঐশীত্ব বা প্রাকসিদ্ধ ধারণা উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল। কিন্তু বাইজানটাইন বা হিন্দুশিল্পের ব্যাপারে তা ছিলোনা, কারণ এই শিল্পের ফিগারগুলো ইঙ্গিতময় কোনো সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত ছিল, যেখানে এগুলোকে কেবল শৈলীরূপ দেওয়া হয়েছিল। এ কারণে লেখার আশ্রয় নেওয়া হয়, প্রতিচ্যে এবং ভারতীয় শিল্পে এর ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, এর প্রতীকতা ছিল সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং কেবল বুদ্ধিগ্রাহ্য, আরবী অথবা রোমান সংখ্যার থেকে যা ভিন্ন নয়। ইসলামের পূর্বে আরবী ভাষা যে লিপিতেই লেখা হউক না কেন প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এবং দৃশ্য শিল্পকর্মে ইন্দ্রিয়াতীততা অর্জনের জন্য বলিষ্ঠ উদ্যোগের ফলে, লিখন শিল্পে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবার প্রতীক্ষায় ছিলো, ইসলামী প্রতিভা সাফল্যের সঙ্গে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।

 

আরবী ‘আল্লাহ’ শব্দটি নাবাতি বর্ণমালা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নসখ রীতিতে (গোটা গোটা হাতের লেখায়) লিখিত হয় অথবা সিরীয় হরফের মাধ্যমে প্রাপ্ত আরামাইক, কুফী হরফে (কৌণিক)। অন্য যে কোন ভাষার মতই আগাগোড়াই এর তাৎপর্য ছিলো বলা যায়, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরগামী সম্ভবত আরো বেশী, এ কারণে যে, নিকটপ্রাচ্যের মানুষগুলো ক্যালিগ্রাফি বলতে যা বুঝায় তেমন কিছুর সঙ্গে পরিচিতই ছিলনা। রোমানরা ক্যালিগ্রাফিতে কিছুটা সামর্থ অর্জন করলেও হরফগুলোর তাৎপর্য আগের মত উজ্জ্বল, যৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক রয়ে গেল। আয়ারল্যান্ডের কেলটিক সন্যাসীরা Book of Kells এর মতো অল্প ক’টি উদ্ভাসিত পান্ডুলিপি তৈরি করেছিলো। কিন্তু তাদের ক্যালিগ্রাফি রোমান স্তরকে অতিক্রম করেনি। তাদের অক্ষরগুলো ছিল গোল গোল এবং অলংকরণের মাধ্যমে, সৌন্দর্যমন্ডিত, কিন্তু তার পূর্ণ তাৎপর্যটি যৌক্তিকই থেকে যায়। অলংকরণ ছিল একটি অতিরিক্ত ব্যাপার কারণ এতে করে হরফগুলোর চরিত্র পরিবর্তিত হয়নি এবং প্রত্যেকটি হরফই একাকী অবস্থান করে দৃষ্টি এক হরফ থেকে আরেক হরফে পৌঁছায় লাফ দিয়ে এবং বোধশক্তিকে একাজে মধ্যস্থতা করতে হত, যুক্তি এবং স্মৃতি মিলিত হত গ্রাফিক অক্ষরগুলোকে শব্দ বা মনের ধারণায় রূপান্তরিত করার জন্য লিখিত হরফ, শব্দ, ছত্র বা বাক্যের কোনো নান্দনিক ইনটুইশন হতনা ক্রমে ক্রমে দুই জেনারেশনের ব্যবধানের মধ্যেই ইসলামী শিল্প আরবী শব্দকে রূপান্তরিত করলো একটি দৃশ্য শিল্পকর্মে এবং তাতে সংবেদনাত্বক ইনটুইশনকে এমন একটি নান্দনিক অর্থ দান করে যা অসংলগ্ন কর্ম ক্ষমতা ও বোধকে যে অসংলগ্ন অর্থ দান করে তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অন্যান্য শিল্পকলার মতই এই নতুন শিল্প ছিলো ইসলামী চৈতন্যের সামগ্রিক লক্ষের অধীন। এরদৃশ্য সামর্থগুলোর বিকাশ ঘটানো হয় একটি এরাবেক্স নির্মাণ করার জন্য গ্রীক এবং ল্যাটিন বর্ণমালার মতই নাবাতি এবং সিরীয় বর্ণমালার হরফগুলো ছিল একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং স্বতন্ত্র। আরব শিল্পী এগুলোকে একত্রে যুক্ত করে দেয়, যাতে করে একটি অক্ষর প্রত্যক্ষ না করে দর্শকের চোখ একটি মাত্র দৃষ্টিপাতে এবং একটি সংবেদনাত্মক ইনটুইশনের সাহায্যে দেখতে পেতো পুরো শব্দটিকে এবং কার্যত গোটা বাকধারা বা ছত্রটিকে। দ্বিতীয়ত আরব শিল্পী অক্ষরগুলোকে করে নমনীয় যাতে করে সে অক্ষরগুলোকে প্রসারিত, প্রলম্বিত, সংকুচিত, নমিত, বিস্তৃত, সোজা, বাঁকানো, বিভাজন, গাঢ়করণ ক্রমে সংকীর্ণ করে আনয়ন, অংশত বা পূর্ণত বর্ধিতকরণ, যা খুশী তাই করতে পারে। হরফ হয়ে উঠে বংশবদ শিল্প উপকরণ, ক্যালিগ্রাফারের যে কোন নান্দনিক পরিকল্পনা বা ধারণাকে ধারণ ও কার্যকর করার জন্য যা থাকে প্রস্তুত। তৃতীয়ত, এরাবেক্স শিল্পকর্মে এপর্যন্ত যা কিছু জ্ঞানলাভ হয়েছে শিল্পী তার সমস্ত কিছুকেই কাজে লাগায় ফুল ও লতাপাতার শিল্প রূপায়ণ এবং জ্যামিতিক চিত্রণ, কেবলমাত্র লেখন শিল্পের উৎকৃষ্টতর অলংকরণের জন্যই নয়, বরং লিখনকেই তার আপন অধিকারে একটি এরাবেক্স-এ রূপদানের জন্য আরবী লিখন এভাবে হয়ে উঠে একটি মুক্ত তরঙ্গিত রেখা যা এখানে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এবং নিজে নিজেই সম্পূর্ণ হতে পারে। মিল রেখে বিন্যাস করেই হউক বা বৃহৎ পরিবারে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়েই হউক অক্ষর বা বর্ণের নতুন করে অর্জিত নমনীয়তার ফলে ক্যালিগ্রাফারকে লিখনের ক্ষমতা দান করে দুটির একটি পন্থায় বা উভয় পন্থায়। সে যে নান্দনিক পরিকল্পনাটির বিকাশ ঘটাতে চায়, তার অনুসরণে। পরিশেষে সে অক্ষর বা হরফের এই মুক্তি সাধন করে, কেবলমাত্র এরাবেক্স অলংকরণগুলোকে গ্রহণ করার জন্যই নয়, বরং একটি বৃহৎ এরাবেক্স নির্মান করার জন্য তার সঙ্গে হরফকে মিশিয়ে দেয়। শিল্পী এটি সম্ভব করে তোলে- লিখন থেকে যাতে অন্য এরাবেক্সটি বিকাশ লাভ করে, অথবা সেসবের মধ্য থেকে লিখনের বিকাশ ঘটে। অক্ষরের যে মৌলিক প্রকৃতি অক্ষরকে বোধগম্যতা দান করে তা রক্ষিত হয়, এবং কাব্যে ছন্দের প্যাটার্ন এবং সমতল এরাবেক্সগুলোতে গঠিত যে সব জ্যামিতিক ও লতাপাতা ফুলের রূপ ও আকৃতি, বোধগম্য আকারে সেগুলোকে প্রকাশ করার মধ্যেই সৃষ্টি হতো তাদের গতিশীলতা। এরাবেক্স হিসেবে আরবী লিখন অসংলগ্ন রোধের চূড়ান্ত বাহনস্বরূপ অক্ষর বা যৌক্তিক প্রতীকগুলোকে রূপান্তরিত করে একটি সংবেদনাত্মক শিল্প উপকরণে এবং একটি নান্দনিক মাধ্যমে, যা জন্ম দেয় একটি অনন্য নান্দনিক ইনটুইশনের। মানবিক শিল্প হিসেবেই এ ছিল তার এক বিজয়, যার সাহায্যে অসংলগ্ন যুক্তির সর্বশেষ এলাকা অতিক্রম করে মানবিক শিল্পকে সংবদনাত্মক নান্দনিকতার জগতের সঙ্গে মুক্ত ও অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এটি ছিল ইসলামের সর্বোচ্চ এবং চূড়ান্ত শৈল্পিক বিজয়।

 

ইসলাম দাবী করে, আল্লাহর বাণী বা কালাম হচ্ছে চিন্তার দিক দিয়ে তার নিকটতম ধারণা? তাঁর ইচ্ছার আশুতম প্রকাশ; যেহেতু ইন্দ্রিয়াতীত হওয়ার কারণে তিনি অনন্ত কালই অজ্ঞেয় এবং অব্যক্ত মানবের গোচরে। সে কারণে তাঁর কালাম বা শব্দের মাধ্যমে প্রত্যাদেশের আকারে তাঁর ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়েছে। তাহলে কুরআনের শব্দ হচ্ছে God-in-Percipi বুদ্ধিগ্রাহ্য আল্লাহ এবং একারণে সম্মানের দিক দিয়ে ও সৌন্দের্যের দিক দিয়ে তাকে দেওয়া উচিত চূড়ান্ত মর্যাদা। এজন্য ইসলামে এর লিখন হচ্ছে নান্দনিকতার চরম ও পরম। একারণে আরো যুক্তিসঙ্গত যে, আরবী ক্যালিগ্রাফির বিকাশ সাধন করতে হবে ঐশী সত্ত্বার সংবেদনাত্মক ইনটুইশন বা প্রত্যক্ষ উপলব্ধি ঘটানোর জন্য- আল্লাহকে যে প্রকাশ করা যায় না, চেতনায় ব্যক্ত করা এবং প্রতিফলিত করা যায়না, তারই পূর্ণ উপলব্ধির মাধ্যমে। যেহেতু আরবী লিখন একটি এরাবেক্স হয়ে উঠেছে, সে কারণে তা যে কোন লিপিকর্মে প্রবেশ করতে পারে এবং সেখানে আইনত অবস্থান নিতে পারে তার চিন্তামূলক উপাদান যাই হোক। যে কোন শিল্পকর্মের উপরে তা চড়াও হতে পারে, এবং এর নান্দনিক গতিবেগ বা মূল্যের পরিপূরক হিসেবে, আর সেই শিল্পকে করতে পারে মহিমান্বিত, শিল্প কর্মটির সংঘা লিখন সমন্বত বা অঙ্গীভূত হোক বা না হোক, সকল মুসলমান পবিত্র কিতাবের প্রতি যে শ্রদ্ধা পোষণ করে থাকে, পরে লিখন শিল্প দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে এবং সর্বাধিক সংখ্যক মেধাকে সংহত করে প্রবেশ করে মুসলিম জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রস্তরে, কাঠে, কাগজে, চর্ম কিংবা বস্ত্রে, গৃহে, অফিসে, দোকানে, মসজিদে প্রত্যেকটি প্রাচীর এবং সিলিং আরবী লিখন হয়ে উঠলো ইসলামের সাধারণ শিল্পকর্ম এর প্রভাব এবং উপস্থিতি এত ব্যাপকতা লাভ করে যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কোন নগরী বা গ্রাম এই শিল্পকর্মের ডজন ডজন মহৎ স্রষ্টা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়নি। এমনকি, ইসলামের শত্রুরাও এই প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলনা খ্রীষ্টান স্পেন, ফ্রান্স এবং ইটালীতে চিন্তার দিক দিয়ে অজ্ঞতা অযোগ্যতার বশে আনাড়ীর মত আরব লিখন শিল্প ব্যবহার করেছে, তবু সেই ব্যবহারের ফলে নান্দনিকতার দিক দিয়ে তারা প্রভূত লাভবান হয়েছে২২ ইহা যে নান্দনিক সংবেদনাত্মক ইনটুইশনের জন্ম দেয় তা যে কোন এরাবেক্স শিল্পকর্মের মতই কল্পনা উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম, যে কোন যুক্তি অভিমুখে তার উর্ধ অভিসারী উড্ডয়নে, হয়তোবা তার চাইতেও বেশী, কারণ একই সময়ে এর অসংলগ্ন উপাদানগুলো পাঠ করতে সক্ষম দর্শকের জন্য আরবী লিখন বুদ্ধির সক্রিয়তার মাধ্যমে জন্মাবে কল্পনার লক্ষ্যের আরো বিশিষ্ট একটি রূপ, এর গতিবেগে সে লক্ষ্যের অভিমুখে আরো অগ্রসরতা। তাহলে, এ কোন বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, কুরআন কপি করতে গিয়ে আরবী ক্যালিগ্রাফি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম বিশ্বের হয়ে ওঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় শিল্পকর্ম। রাজা বাদশা এবং প্রাকৃতজন প্রত্যেকই তাদের সমগ্র জীবনের জন্য একটি পরম আশা পোষণ করতেন: একখণ্ড সমগ্র কুরআন কপি করা এবং তা সমাপনের পর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ২৩

 

জামাখসারির (তাঁর আছাদ আল বালাগা, দ্রঃ ‘কালাম’) বিবৃতি মতে উজির মোহাম্মদ আবু আলী মুকলা লিখনকে তুলনা করেছিলেন কাজের সঙ্গে এবং দুটি শিল্পকর্মের পরিকল্পনায় ও রচনায় অর্পণ করেছিলেন একই নান্দনিক দায়িত্ব। তিনি লিখন শিল্পের মৌল গুণ পাঁচটি বলে বর্ণনা করেছিলেন; আত্ তাওফিয়া (শব্দটি যেসব অক্ষর দিয়ে নির্মিত তার প্রত্যেকটিকে তার পূর্ণ অংশ প্রদান যাতে করে সমগ্র ও অংশের মধ্যে সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ এবং সুসামঞ্জস্য হতে পারে), আল ইলমান (প্রত্যকটি অক্ষরকে তার জন্য প্রয়োজনীয় স্থান, ক্ষমতা ও গুরুত্ব প্রদান), আল ইকমাল (প্রত্যেকটি অক্ষরকে তার দৃশ্য ব্যক্তিত্ব প্রদান, যা প্রকাশিত তার ভঙ্গিতে, সোজা, দন্ডয়মান অবস্থায়, ফ্ল্যাট অবস্থায়, শুয়ে পড়ায়, দৃঢ় ন্যূজতায়, আত্মসমর্পণ, অভিজ্ঞতালব্ধ বক্রতায়); আল্ ইশবা (প্রত্যেকটি বর্ণকে তার অন্তর্গত দৃশ্য ব্যক্তিত্ব যার প্রকাশ ঘটে সূক্ষ্মতার মাধ্যমে প্রত্যেকটি অক্ষরের যা দাবী তা দান করা); আল ইরসাল (মুক্ত গতিতে রেখার উৎসারণ যা ইতস্ততা বা কোন অন্তর্গত প্রতিনিবৃত্তির দ্বারা বাধ্যগ্রন্থ নয়, যা উচ্চ গতির বেগ সৃষ্টি করে২৪)। আবু হাইয়ান আত্ তাওহীদী তার ইলমুল কিতাবাতে বলেনঃ “সাধারণভাবে লিখন হচ্ছে জাগতিক উপকরণ দিয়ে আধ্যাত্মিক চিত্রণ২৫।” যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা অজ্ঞাতনামা সাধু দরবেশদের উক্তির আবৃত্তি করেছেন, যেমন:

মানুষের মনের অবস্থান তাদের কলমের দাঁতের নীচে,’ “লিখন হচ্ছে চিন্তার পানি সেচন,” “সুন্দর লিখা দুর্বল চিন্তার অভাব পূরণ করে, আর ধ্বনিকে তা দান করে জীবনীশক্তি২৬

 

মধ্যযুগের বহু পণ্ডিত মানবিক বিষয়ে মহৎ খ্যাতি অর্জন করেছেন, যেমন ইবন আবদ রাব্বী, মোহাম্মদ আমীন, ইবনুন আছীর, ইবনুল নাদী, আল কালকাসান্দী প্রমুখ। এঁরা সকলেই লিখন ক্ষেত্রে সহগামী মুসলমানের কৃতিত্বকে স্বীকার করেছেন। তাঁরা এতে গর্বিত ছিলেন যে, অন্য যে কোন লেখনী শিল্পের চেয়ে আরবী লিখন অনেক বেশী বিকশিত হয়েছে। তারা গর্বিত যে, আরবী লিখন-সৌন্দর্য শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছে, এবং এমন অভিব্যাপ্তি ও গৌরব অর্জন করেছে যা সম্পূর্ণভাবে তুলনাবিহীন, এবং পরিশেষে এতে অর্পিত হয়েছে পরমমূল্য অর্থাৎ ধর্মীয় মূল্য, ঐশী প্রজ্ঞা প্রকাশের বাহন এবং মাধ্যম হিসেবে। কুরআনুল করীম তাদের মূল্য নির্ণয়ের অভ্রান্ততার চূড়ান্ত প্রত্যয় ও সন্তোষের সঙ্গে দাবী করে যে, লিখনকে অপার্থিব মর্যাদা দান করেছে একটি আয়াতে যার সূচনা কলম এবং লেখনীর তাকিদ দিয়ে২৭

যেখানে, সমস্ত শিল্পকলাই সমজদারদের উপর চিং-প্রকর্ষ ও মানবিকতা-সৃজনকারী প্রভাব বিস্তার করে, সেখানে গ্রীক এবং রেনেসাঁর শিল্পকলা মানুষের কাছে মানুষের নিজের মূল্য বৃদ্ধি করে এবং তার কল্পনা এবং ইচ্ছাকে আত্মউপলব্ধির বৃহত্তর উচ্চতায় উন্নীত করার জন্য তাকে অনুপ্রাণিত করে। গ্রীক এবং রেনেসাঁ শিল্প তা সম্পাদন করে মানুষকে একটা মহত্তর ও গভীরতর মানবিকতায় শিক্ষিত করে, এমন মহৎ এক মানবিকতা যে, তার চেতনায় তা লোপ পায় ঐশ্বরিকতার মধ্যে যা কিনা আশা ও সর্চোচ্চ জীবন মানের শীর্ষবিন্দু। ইসলামে শিল্পকর্ম উৎকর্ষ মানবিকতা ও আত্মউপলব্ধিকর একই প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু ইসলাম তা সম্পাদন করে মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে ঐশী উপস্থিতির সম্মুখে স্থাপন করে। ঐশীসত্ত্বা অপৌরুষেয় এবং ইন্দ্রিয়াতীত হওয়ায় ইসলামী শিল্পকলা যে আদর্শবাদের জন্ম দেয় তা কখনো দাম্ভিক অথবা অবাধ্য প্রমিথিউসের মত ছিলনা। যেহেতু তা ছিল মানবীয়, একারণে ইসলামী শিল্পকলার আদর্শবাদ নিজেকে নিয়ম-শৃংখলার অধীনে স্থাপন করে, তার নিজের ইন্দ্রিয়াতীত চেতনার মাধ্যমে। এটি কি সীমাবদ্ধতা? নিশ্চয়ই। এই সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয় ইন্দ্রিয়াতীত মূল্যমান দ্বারা সংজ্ঞা মতে যার সূচনা অনন্ত থেকে; এই সীমাবদ্ধতা হচ্ছে সেই সব মূল্যের কারণে যেগুলো, সেসব বিষয়ে ‘বিভ্রান্তির’ মাধ্যমে নয় বরং সোজাসুজি তার সামনে দাঁড়িয়ে, উৎকৃষ্টতরভাবে নিরীক্ষণ ও উপলব্ধি করা যায়। যেহেতু মূল্যের উভয় জগতই প্রাকসিদ্ধ, সে কারণে ধারণার দিক দিয়ে সে সব বিষয়ে মানুষের বিভ্রান্তি অসম্ভব এবং প্রমিথিউস হামেশাই একজন আত্মতুষ্ট ব্যক্তি। ইসলামী শিল্পকর্মের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে খোদ ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের অনুসন্ধান এবং সর্বদা পরম ট্রান্সেন্ডেন্ট বাস্তবতা থেকে পার্থক্যের দূরত্ব বজায় রাখা।

 

টীকা:

১. (আল্লাহ) আসমান এবং জমিনের স্রষ্টা। কোন কিছুই তাঁর মতো নয়। তিনি সমস্ত কিছু শোনেন এবং দেখেন (৪২: ১১)।

২. Arthur Schopenhaser. The World as Will and Idea. tr. R.B. Haldane and J. Kemp London: Routledge and Kegan Paul Limited) vol i. Third Book. p. 217.

৩. Friedrich Nietzsche. Works. tr. and ed Walter Kaufmaan (New York The Viking Press. 1954) পৃ. 459. Walter Kaufmann. Nietzsche. Philospher. Psychologist. Antichrist (Princeton: Princeton Press. Meridian Books. 1956) পৃ.102.

৪. Murray, Five Stages পৃ. 57,60,63.

৫. দ্র: এই গ্রন্থারের… “On the Nature of the Work of Art in Islam”.

৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৬।

৭. দেখুন এই গ্রন্থারের … “Divine Transcendence” pp. 11-19.

৮. দ্রঃ এই গ্রন্থারের… “On the Nature of the Work of Art in Islam” P. 78.

৯. দ্রঃ এই গ্রন্থারের… “Divine Transcedence”…….p. 22.

১০. দ্রঃ এই গ্রন্থারের… “On the Nature of the Work of Art in Islam”.

১১. যে কোন ব্যাকরণমূলক পাঠ অনুসারে এই ভূমিকা প্রায় সকল সেমেটিক ভাষার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ধাতৃমূল্যের ত্রি-ব্যঞ্জনমূলক কাঠামো সেমেটিক ভাষাতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

১২. দ্রঃ এই গ্রন্থারের প্রবন্ধ, “Islam and Art.” Studia Islamica fasciculi xxxvii (1973) পৃ. 93।

১৩. শ্রোতা এবং আবৃত্তিকার বা পরিবেশকের মধ্যে একই ধরনের সহযোগিতামূলক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হচ্ছে গোটা মুসলিম বিশ্বের মধ্যযুগের সঙ্গীত ও কবিতার মোসায়েরাগুলোর বৈশিষ্ট্য, যা দেখা যাবে ঐ আমলের সাহিত্যের প্রয়াস (যেমন: Kitab al Aghani by al Isfahani)।

১৪. Abd al qaidir al Jurjani, Dalail al l’jaz: (Cairo: Al Matba’ah al Arabiyah 1351 H).

১৫. Abu al Faraj al Isfahani. Kitab al Aghani (Beirut: Dar al Thaqafah. 1374/1955) witnesses to a countless number of such instances.

১৬. K.A.C. Creswell. Early Muslim Architecture (Oxford: Clarendon Press. 1932- 1940) vol. পৃ. 40.

১৭. দ্র: Richard Ethinghusen. “The Character of Islamic Art “The Arab Heritage ed. N.A. Fais (Princeton: Princeton University Press 1944) পৃ. 251-67.

১৮. দ্র: Al Faruqi “Urubah and Religion” p. 211.

১৯. T.W. Arnold, Painting in Islam (Oxford: the Clarendon Press, 1928) c,. t. 133.

২০. Sturt Cary Welch, A Kings: The Shah-Nameh of Shah Tahmasp (New York: Metropoliton Museam of Art, 1972), পৃ. 30.

২১. কোনো দৃষ্টি তাকে প্রত্যক্ষ করতে পারে না, কিন্তু তিনি সমস্ত কিছু দেখেন। তিনি দয়াময় (৬: ১০৩)।

২২. ইতিহাসবিদরা ‘মোজারাবিক’ শব্দটি সৃষ্টি করেছেন, খ্রিষ্টিয়ান, ইতালী ও স্পেনিস অলংকরণের সমুদয় ঐতিহ্যটি বুজানোর জন্য, যেগুলোর সঙ্গে আরবী Motive (মুলভাব) এবং নক্সা সংশ্লিষ্ট।

২৩. তা বুঝা যায়, কুরআনের পাঠের কপির অনন্ত বিপুলতায়, যা বাজনাবর্গ অভিজাতগণ এবং সাধারণরা, সকল স্তরের মানুষের কপি করেছিলেন, বা যা রয়েছে সকল স্তরের মানুষের অধিকারে।

২৪. Naji Zayn al Din. Musawwer al Khan al Arabi. Baghdad: Al Mujam al Ilmi al Iraqi, 1288/1968). p. 372.

২৫. ঐ, পৃষ্ঠা ৩৯৬, যাতে জইনুদ্দিন আত তৌহীদের রিসালা ফি ইলমূল কিতাবাত একটি অংশ উদ্ধৃত করেছে। এটি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত একটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি।

২৬. ঐ।

২৭. নুন। কলমের সাক্ষ্য এবং যা, তা লিপিবদ্ধ করে তার সাক্ষ্য (৬৮: ১-২) পাঠকের…. তোমার রাব্বের নামে, যিনি দয়াময়, যিনি কলম ব্যবহার শিখিয়েছেন, মানুষকে শিখিয়েছেন, যা সে জানতো না (৯৬: ৩-৫)।

 

অনুবাদঃ অধ্যাপক শাহেদ আলী।

৬৮৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।
Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top