মহাগ্রন্থ আল কোরআন আমাদেরকে কথা বলার আখলাক, কথার মাধুর্যতা সম্পর্কে খুব সুন্দর একটি ফ্রেম এঁকে দিয়েছে। কিন্তু আমরা সেটাকে ভুলে গিয়ে ডিজিটাল দুর্গ বানিয়েছি এবং সেটা নিজেদের জন্য আত্মরক্ষার বাহন হিসেবে ব্যবহার করে, সোস্যাল মিডিয়ার একাউন্ট সমূহ থেকে আমাদের কি-বোর্ডের বাটন সমূহকে একে অপরের কালবে গুলি ছোঁড়ার মত করে ব্যবহার করছি।

আমরা আমদের কালবকে এবং পেটকে হয়ত রোজা রাখাতে পেরেছি, কিন্তু আমাদের মুখকে এবং হাতের নখকে রোজা রাখাতে পারিনি। এই বিষয়কে সামনে রেখে আজকে আমি কথা বলার আদব বা আখলাক নিয়ে আলোচনা করতে চাই। 

কোরআনে মূলত কথা বলার আখলাক আমাদেরকে বুঝানোর জন্য; ‘আখলাক’ নামক একটি সূরা রয়েছে, যার নাম সূরা-হুজুরাত । সূরা-হুজুরাত, আমাদের প্রিয় নবীর সামনে, বিখ্যাত আরব গোত্র বনী তামিমের সাথে সাহাবাদের মধ্য থেকে কয়েকজন কবি ও বক্তা সাহাবীর মধ্যে ঘটে যাওয়া একটি বিতর্ককে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হয়েছিল। রাসূলে করীমের সেই বিখ্যাত বাণী,  

إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ لَسِحْرًا

কোন কোন কথা কতই না যাদুকরী। ( বুখারী, নিকাহ, ৪৭; তিব্ব, ৫১; তিরমিজি, বিরর, ৮১; আবু দাউদ, আদব, ৯৬) 

এই কথা বলে যে আশ্চর্যতা প্রকাশ করেছিলেন, সেটা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এই সূরা।

 সূরা হুজুরাত, আমাদেরকে কথা বলার আখলাককে শেখানোর জন্য নাযিল হয়েছে। এই সূরা একই সাথে সকল মানুষের একই মূল থেকে, একই মাটি থেকে, একই মা-বাবা, একই সৃষ্টি থেকে আসা সকলের জন্য বিশ্বজনীন এক ভ্রাতৃত্বের ঘোষণা দেয়। আবার একই সাথে ঈমানী ভ্রাতৃত্বের কথাও ঘোষণা দেয়। 

এই সূরার ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, 

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ

হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি৷ তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো৷ একে অপরের অধিকারকে যেন চিনতে পারো। একে অপরের সাথে যেন মারেফত এবং জ্ঞানের আদান প্রদান করতে পারো এই জন্য। ( সূরা হুজুরাত, ১৩) 

এই সুরায় বর্ণিত অপর একটি ভ্রাতৃত্ব হল, ঈমানের ভ্রাতৃত্ব।

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ اِخْوَةٌ

মু’মিনগণ হল পরস্পর ভাই ভাই। 

فَاَصْلِحُوا بَيْنَ اَخَوَيْكُمْ

যদি তাই হয়, তাহলে তোমাদের সকলের কর্তব্য হল, মু’মিনদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বকে ঠিক করে দেওয়া, মু’মিনদের মধ্যকার সম্পর্ককে জোড়া লাগিয়ে দেওয়া। (সূরা হুজুরাত, ১০) 

এই আয়াতটিও এই একই সুরার।

কিন্তু এই সূরা একই সাথে সৃষ্টিগত দিক থেকে সৃষ্ট হওয়া ভ্রাতৃত্ব এবং একই সাথে আমাদেরকে ভাইয়ে পরিণতকারী ঈমানী ভ্রাতৃত্বকে বিনষ্টকারী সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয়টি  সেই মূল বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করে থাকে। এই কারণে এই সূরাকে সূরাতুল আখলাক বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই অর্থে এই অধিকারকে বিনষ্টকারী ৭ টি  জঘন্য খারাপ  বিষয়কে কোরআন খুবই গুরুত্বের সাথে এই সূরায় উল্লেখ করেছে। সেগুলো হল, 

 ১। لَا يَسْخَرْ قَوْمٌ مِنْ قَوْمٍ  তথা একে অপরকে বিদ্রুপ করো না, সাবধান এক গোষ্ঠী যেন অপর কোন গোষ্ঠীকে বিদ্রুপ না করে। (হুজুরাত, ১১) 

মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম৷ 

২। وَلَا تَلْمِزُٓوا اَنْفُسَكُمْ 

একে অপরকে অপমানিত করবে না। ( হুজুরাত, ১১)

একে অপরকে ছোট করে দেখবে না। একে অপরকে নিচু করে দেখবে না। 

৩। وَلَا تَنَابَزُوا بِالْاَلْقَابِۜ

পরস্পরকে খারাপ উপাধি ধরে ডেকো না। (হুজুরাত, ১১) পছন্দ করবে না এমন নামে ডেকো না। 

৪। اجْتَنِبُوا كَث۪يراً مِنَ الظَّنِّۘ 

একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে খারাপ ধারণা করো না, খারাপ ধারণা থেকে বিরত থাকো। (হুজুরাত, ১২) 

৫। وَلَا تَجَسَّسُوا

একজন আরেক জনের দোষ অন্বেষণ করো না। একে অপরের বিরুদ্ধে  গোয়েন্দাগিরি করো না। (হুজুরাত, ১২) 

৬। وَلَا يَغْتَبْ بَعْضُكُمْ بَعْضاً

একে অপরের গীবত করো না। (হুজুরাত, ১২) 

এবং গীবতের আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন গীবত করাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মত খারাপ একটি বিষয়ের সাথে তুলনা করেছে। 

৭। اِنْ جَٓاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَأٍ فَتَبَيَّنُٓوا 

যদি কোন ফাসিক ব্যক্তি তোমাদের নিকট কোন খবর নিয়ে আসে সেটাকে ভালোভাবে যাচাই না করে গ্রহণ করো না। তা না করলে; পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে৷ এই কথা বলা হয়েছে। (হুজুরাত, ৬) 

কোরআনে কথা বলার আখলাক সম্পর্কিত আয়াত সমূহ শুধুমাত্র সূরা হুজুরাতেই আলোচিত হয়নি। সমগ্র কোরআনেই উল্লেখিত রয়েছে এবং কোরআনে কথার আখলাক সম্পর্কিত  আয়াত সমূহকে যদি একত্রিত করি তাহলে অসাধারণ একটি চিত্র আমাদের সামনে ফুটে উঠে। 

১। “কাওলুল হাসান” তথা সুন্দর কথা।

মু’মিন সুন্দর কথার অধিকারী। যখন কথা বলবে উত্তম কথা বলবে। 

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْناً

মানুষের সাথে উত্তমভাবে কথা বলো। (সূরা বাকারা, ৮৩) 

এমনকি এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন বনী ইসরাইলের নিকট থেকে অঙ্গীকার নেওয়ার সময় ঈমানের, ইবাদতের এবং আখলাকের মূলনীতির সাথে একত্রে উল্লেখ করেছে। 

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْناً

মানুষের সাথে উত্তমভাবে কথা বলবে। (বাকারা, ৮৩) 

অন্য একটি আয়াতে খারাপ কথা বা ‘কাওল-উ সু’ উল্লেখ বলা হয়েছে। কাওল-উ হাসানার বিপরীত হল কাওলু সু’উ বা খারাপ কথা যা আল্লাহর নিকট অপছন্দনীয় কথা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

لَا يُحِبُّ اللّٰهُ الْجَهْرَ بِالسُّٓوءِ مِنَ الْقَوْلِ

বলা হয়েছে, আল্লাহ খারাপ কথাকে পছন্দ করেন না। 

২। “কাওলু আদল” তথা আদালত পূর্ণ কথা।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, 

وَاِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا

যখন কথা বলবে তখন আদালতপূর্ণ তথা ন্যায্য কথা বলো। (আনআম, ১৫২) 

যখন কথা বলবে তখন তোমাদের কথা যেন আদালত পূর্ণ হয়। আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কথার আদালত হল, ভারসাম্যপূর্ণ কথা। সকল ধরণের চরমপন্থা থেকে বিরত থাকা। আদালত পূর্ণ কথার বিপরীতে পরিত্যাজ্য এক প্রকারের কথা রয়েছে; আর সেটাই হলঃ “কাওলু যুর”। কাওলু যুর হল, হাকিকত-বিহীন কথা বার্তা। গুজব ছড়ানোর উদ্দেশ্যে বলা সকল কথার অপর নাম হল কাওলু যুর। 

وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِۙ

এমনকি তাগুত থেকে, মূর্তি থেকে বিরত থাকার মত গুজব ও মিথ্যা থেকে কাওলু যুর থেকে দূরে থাকো। আল্লাহ আমাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা হজ্জ, ৩০) 

৩। “কাওলু সাদিদ” ভারসাম্যপূর্ণ, সঠিক কথা বলা। 

وَقُولُوا قَوْلاً سَد۪يداًۙ

তোমরা সঠিক কথা বলো (আহযাব, ৭০) 

তোমাদের কথা যেন হক্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। তোমাদের কথা যেন সঠিক হয়। 

ভারসাম্যপূর্ণ, সত্য এবং ইনসাফপূর্ণ কথা বলার নাম হল কাওলু সাদিদ। অন্যদের সম্পর্কে সকল প্রকারের ইশারাপূর্ণ এবং গোপন অর্থ থেকে, সন্দেহ থেকে মুক্ত ভাবে কথা বলা হল কাওলু সাদিদের অধিকারী হওয়া। সত্যকে অতিরঞ্চিত না করে আবার কোন ধরণের কমতি না রেখে যে রকম আছে সেভাবেই পৌঁছে দেওয়া। এর বিপরীতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন অন্য আয়াত সমূহে, বক্রতাপূর্ণ কথা থেকে দূরে থাকার জন্য আদেশ দিয়েছেন এবং সেটাকে কাওলু লাহন বলা হয়। 

আর কাওলু লাহন হল, নিফাকের মধ্যে নিমজ্জিত মানুষদের কথা বার্তা সমূহ।

وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ ف۪ي لَحْنِ الْقَوْلِۜ

ইরশাদ হয়েছে, তুমি তাদের বক্রতা পূর্ণ কথা থেকেই বুঝতে পারবে। (মুহাম্মদ, ৩০) 

অন্য এক প্রকারের কথার ধরণ হল, কাওলু যুখরুফ, অন্যদেরকে শুধুমাত্র প্রভাবিত করার জন্য বলা চমকপ্রদ কথা-বার্তাকে কাওলু যুখরুফ বলা হয়েছে। কাওলু যুখরুফ এবং কাওলু লাহন বলতে বক্রতাপূর্ণ কথা বার্তা এবং চমকপ্রদ কথা সমূহ থেকে দূরে থেকে বিশেষ করে কাওলু সাদিদ এবং সঠিক কথা বলার নির্দেশ দেয়, মহাগ্রন্থ আল কোরআন। 

৪। “কাওলু লায়্যিন” তথা কোমল কথা। 

 কাওলু লায়্যিনের আয়াত, বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে আল্লাহর দ্বীনের মালিকের (নাউযুবিল্লাহ) মত আচরন করেন এবং এই সকল পয়েন্টে চরমপন্থায় নিপতিত হয়ে থাকেন এই ধরণের মানুষদেরকে আশ্চর্যাবস্থায় ফেলে দেওয়ার মত একটি আয়াত। কারণ এই আয়াত দুইজন বড় নবী, হযরত মুসা এবং হযরত হারুন (আঃ) কে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জালেম ফেরাউনের নিকটে পাঠানোর সময় আমাদের রব তাদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

فَقُولَا لَهُ قَوْلاً لَيِّناً

ইরশাদ হচ্ছে, তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো। (তাহা, ৪৪)

বিখ্যাত জালেম শাসক, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একদিন খুতবা দেয়। সে খুতবা দেওয়ার সময় এক আলেম উঠে দাঁড়ান এবং তাকে খুব কঠিন ভাষায় সমালোচনা করেন। 

সে যে কত বড় জালেম এই কথা বলতে গিয়ে ঐ আলেম একটু গালি দেওয়ার মত করে কথা বলেন। বর্ণিত হয়েছে, জালিম হাজ্জাজ সেই আলেমকে লক্ষ্য করে বলেনঃ এই ভাই! আমি তো আর ফেরাউনের চেয়ে বেশী খারাপ না। আর তুমিও মুসা এবং হারুনের চেয়েও বড় না। আল্লাহ মুসা এবং হারুনকে পর্যন্ত ফেরাউনের কাছে পাঠানোর সময় বলে দেন, 

فَقُولَا لَهُ قَوْلاً لَيِّناً

তোমরা তার সাথে কোমলভাবে কথা বলো 

তাই, কোমল কথা, এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। 

৫। “কাওলু কারিম” হল মন জয় করার মত করে কথা বলা। সম্মানজনক কথা। বীরত্বপূর্ণ কথা।

কাওলু কারিম হল, সন্তানগণ যখন তাদের পিতা-মাতার সাথে কথা বলবে তখন কিভাবে কথা বলবে সেটার পন্থা সম্পর্কিত। 

وَقُلْ لَهُمَا قَوْلاً كَر۪يماً

পিতা-মাতার সাথে কথা বলার সময় মর্যাদা সহকারে কথা বলো। তাদের মন জয় করার মত করে কথা বলো, সম্মান জনক ভাবে কথা বলো। 

فَلَا تَقُلْ لَهُمَٓا اُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا

তাহলে তাদেরকে “উহ্‌” পর্যন্তও বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিয়ো না। 

৬। “কাওলু মারুফ” হল জ্ঞান ভিত্তিক, ইতিবাচক, উপকারী, গঠনমূলক, মাকবুল এবং যথোপযুক্ত কথার নাম। 

وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلاً مَعْرُوفاً

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, তাদের সাথে উত্তমভাবে কথা বলো। (সূরা নিসা, ৫)

এর বিপরীতে অন্যান্য আয়াতেও মারুফ কথার বিপরীত মুনকার কথা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অশ্রাব্য, খারাপ কথা বুঝানোর জন্য কাওলু মুনকার ব্যবহার করা হয়েছে । আর সেটা হল হাকিকতের পাল্লায় যার কোন মূল্য নেই এমন খারাপ কথা এবং বিশেষ করে যারা নিফাকির মধ্যে রয়েছে তাদের কথা বলা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এখানে আমি একটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কাওলু মারুফ বিশেষ করে পরিবারের ব্যাপারে স্বামীগণ তাদের স্ত্রী গণের প্রতি এবং স্ত্রীগণ তাদের স্বামীদের প্রতি ব্যবহার করবেন। এটার নাম হল কাওলু মারুফ এবং কথা বলার সময় মুনকার থেকে দূরে থাকবে। কারণ, এই আয়াত সমূহ জাহেলি যুগে মহিলাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত কথা ও আচরণ সমূহকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমাদেরকে পথ প্রদর্শনকারী আয়াত সমূহে এই সকল কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

৭। কাওলু মাইসুর; 

কাওলু মাইসুর হল, নরম সুরে বলা স্বস্তিদায়ক কথাকে কাওলু মাইসুর বলা হয়। বিশেষ করে কাওলু মাইসুর, ধনী ও বিত্তশালী লোকদের দরিদ্র মানুষের প্রতি, ঋণ গ্রহীতার সাথে ঋণ দাতা যেভাবে কথা বলবেন তার নাম হল কাওলু মাইসুরা। তারা যদি কোন আবেদন নিয়ে আসে তাহলে তাদের সাথে নরমভাবে কথা বলবে। তাদের উপর জোর জবরদস্তি করবে না।

قُلْ لَهُمْ قَوْلاً مَيْسُور

ইরশাদ হয়েছে, অন্তত তাদের সাথে নরম সুরে কিছু বলো। (সূরা বনী ইসরাইল ২৮) 

এই আয়াতটি, সূরা বাকারায়ও মহান আল্লাহ বলেনঃ হে ইমানদারগণ! দরিদ্রদেরকে কষ্ট দিয়ে ও খোঁটা দিয়ে তোমাদের সাদাকাকে নষ্ট করো না। (বাকারা, ২৬৪) এই কথা বলার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন কাওলু মারুফকে এখানেও ব্যবহার করেছেন, কাওলু মাইসুরের সাথে। 

ইরশাদ হয়েছে, 

قَوْلٌ مَعْرُوفٌ وَمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةٍ يَتْبَعُهَٓا اَذًىۜ

মারুফ, মন জয়কারী একটি কথা এবং কোন অপ্রীতিকর ব্যাপারে সামান্য উদারতা ও ক্ষমা প্রদর্শন এমনি দানের চেয়ে ভালো, যার পেছনে আসে দুঃখ ও মর্মজ্বালা ৷ (সূরা বাকারা, ২৬৩) 

৮। কাওলু তায়্যিবঃ পবিত্র কথা । 

কালিমায়ে তায়্যিবা, যদিও কালেমায়ে তাওহীদের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তবুও এই আয়াতের অর্থ অনেক ব্যাপক। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আয়াতেও উত্তম কথা বলাকে এমন একটি গাছের সাথে তুলনা করেছেন যার মূল মাটির গভীরে প্রোথিত, এবং শাখা প্রশাখা সমূহ আকাশে পৌঁছে গেছে, এবং যার ফল সমূহ সব সময় ভক্ষণ করা যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, 

مَثَلًا كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاءِ – تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا ۗ  

(সূরা ইব্রাহিম ২৪-২৫) 

কিন্তু খারাপ কথার উদাহরণও এমন যার কোন ফল নেই, কোন উপকার নেই, পাতা এমন কি কোন মূলও নেই, গন্ধহীন এবং মাটির উপরে নিক্ষিপ্ত একটি গাছের সাথে তুলনা করা হয়েছে। 

وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَب۪يثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَب۪يثَةٍۨ اجْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْاَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَار

অন্যদিকে মন্দ কথার উপমা হচ্ছে, একটি মন্দ গাছ, যাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপড়ে দূরে নিক্ষেপ করা হয়, যার কোন স্থায়িত্ব নেই৷ (সূরা ইব্রাহিম- ২৬)

এরকম একটি পয়েন্টে, বিশেষ করে যারা মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের রহমতের দিকে আহবান করেন, আল্লাহর দ্বীনকে মানুষের নিকট প্রচারকারী, নিজেদেরকে মুরশিদ হিসেবে পরিচয় দানকারী, নিজেকে উস্তাদ হিসেবে উপস্থাপনকারী ভাইদের কাছে, আমি নিজেকেও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বিশেষ করে যারা আমর বিল মারুফের দায়িত্ব পালন করেন, 

মানুষের নিকটে এবং যুবকদেরকে কাছে যারা দ্বীনকে তুলে ধরে থাকেন তারা যেন সবচেয়ে সুন্দর ভাষা ব্যবহার করেন, সবচেয়ে সুন্দর পন্থা যেন অবলম্বন করেন। সবচেয়ে সুন্দর কথা হল, সবচেয়ে ন্যায্য কথা, সবচেয়ে নরম কথা, কাওলু লায়্যিন, কাওলু আদল, কাওলু সাদিদ। সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ভাষা, সম্মানজনক কথা, মন জয়কারী কথা, জ্ঞানভিত্তিক বাণী, মারুফ কথা, সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য কথা, সহজবোধ্য কথা এবং সবচেয়ে দয়াদ্রপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা মানুষকে শুধুমাত্র হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত দান করতে বাধ্য। মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন কতই না সুন্দর করে বলেছেন,  

وَمَنْ اَحْسَنُ قَوْلاً مِمَّنْ دَعَٓا اِلَى اللّٰهِ

যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করে তার কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে? (সূরা ফুসসিলাত, ৩৩) 

ইরশাদ, দাওয়াত এবং তাবলীগ কখনো দাম্ভিকতা পূর্ণ কথা দিয়ে হয় না। চিল্লা-পাল্লা করে মানুষকে কখনো দ্বীনের পথে ডাকা যায় না। মানুষকে ছোট করে ও নিচু করে দেখে তো মোটেই না। 

অন্য একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞাপন ও প্রোপাগান্ডার ভাষা, ইরশাদের (দাওয়াতের) ভাষা এক হতে পারে না। দাওয়াতের ভাষা হল দয়ার ভাষা, মারহামাতের ভাষা, ভালোবাসার ভাষা। আজ কোন আলেম উলামা যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় কথা না বলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বন্দপূর্ণ ভাষা দিয়ে মানুষকে কিভাবে আল্লাহর দিকে আহবান করা যেতে পারে? 

ভাইয়েরা, আমর বিল মারুফের ভাষা কেবল মারুফই। মুনকার ভাষা দিয়ে কাওলু মুনকার কখনো আমর বিল মারুফ হতে পারে না। কাওলু লায়্যিনের অধিকারী হওয়া আবশ্যকীয়, যারা আল্লাহর দ্বীনকে বুঝিয়ে থাকেন। মাটিতে পর্যন্ত আমাদেরকে আস্তে আস্তে পা রাখতে বলা হয়েছে। 

وَلَا تَمْشِ فِي الْاَرْضِ مَرَحاًۚ 

একই ভাবে সুন্দর এবং সঠিক কথার মাধ্যমে মানুষের মন জয় করতে আমরা বাধ্য। 

দৃঢ় চিত্তে হাঁটা, নরম ও ভদ্র ভাষায় কথা বলা বীরত্ব। নম্রতা কোন দুর্বলতা নয়, কোন খারাপ বিষয় নয় বরং গর্ব অহংকার মানুষকে নীচে নামিয়ে দেয়, নম্রতা মানুষকে মর্যাদাবান করে তুলে। মু’মিন তার মারহামাতপূর্ণ হৃদয়কে সকলের জন্য উম্মুক্ত করে দিতে বাধ্য। এটা আমাদের রবের আদেশ তার প্রিয় রাসূলের প্রতি। 

যে কোরআনে কারীম কথা বলার আদবের দিকে এত গুরুত্ব দিয়েছে তা কি শুধুমাত্র মানুষের সাধারণ কোন আচরণের দিকে ইঙ্গিত করে? 

মূলত এগুলো হল মানুষের ব্যক্তিত্ত্বের বহিঃপ্রকাশের জন্য। কারণ কথা বলার পূর্বে নিয়ত রয়েছে। নিয়ত হল আমলের বীজ। কথার পূর্বে ইচ্ছা রয়েছে। কথার পূর্বে একটি চিন্তা রয়েছে। এরপরে রয়েছে কাজ, আমল এবং আচরণ। কথা একই সাথে নিয়ত এবং কাজের বহিঃপ্রকাশ। 

রাসূল সঃ বলেছেনঃ

إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ

প্রত্যেক কাজের ফলাফল তার নিয়তের উপর নির্ভরশীল। ( বুখারী, বাদাউল ওহী, ১) 

মূলত এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে, কথা নিজেই একটি আমল। যে সকল মানুষের কথার মধ্যে কোন মাধুর্যতা নেই তাদের কাজের মধ্যেও আখলাক এবং এসথেটিকস খুঁজে বেড়ানো বেহুদা কাজ। আল্লাহ যে সকল কালেমা ও নাম শিক্ষা দিয়েছে সেগুলো তার শিক্ষা দেওয়া বয়ানের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। 

وَعَلَّمَ اٰدَمَ الْاَسْمَٓاءَ

আল্লাহ আদমকে সকল নাম শিখিয়েছেন। (বাকারা, ৩১) 

اَلرَّحْمٰنُۙ ﴿١﴾ عَلَّمَ الْقُرْاٰنَۜ ﴿٢﴾ خَلَقَ الْاِنْسَانَۙ ﴿٣﴾ عَلَّمَهُ الْبَيَانَ ﴿٤﴾

বায়ানও তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন। ( রাহমান, ১-৫) 

মানুষ এমন ভাবে কথা বলবে তা যেন তার রবের শিক্ষা দেওয়া নামের তাজাল্লি গাহে পরিণত হয়। সুন্দর কথা হল; সুন্দর আচরণের ফলাফল।  

আমি একটু আগে যে আয়াত পাঠ করেছি সেই আয়াতের ধারাবাহিকতায় তা রয়েছেঃ 

وَقُولُوا قَوْلاً سَد۪يداًۙ يُصْلِحْ لَكُمْ اَعْمَالَكُمْ

সঠিক কথা বলো। আল্লাহ তোমাদের কার্যকলাপ ঠিকঠাক করে দিবেন। (আহযাব, ৭০-৭১) 

এগুলো একে অপরের সাথে সম্পৃক্ত। সুন্দর করে কথা বলুন, যেন আপনাদের আমল সালিহ হয়। আপনাদের আমল যেন সুন্দর হয় তাহলে কথাও সুন্দর হবে। শুধুমাত্র আমাদের হাত এবং পায়ের কাজ কর্ম সমূহকেই আমাদের আমলনামা সমূহে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে না। আমাদের মুখ যে কাজ করছে সেটাও কিন্তু একটা আমল। আমাদের আঙ্গুল সমূহ আমাদের কি-বোর্ডের উপর যা করে সেটাও কিন্তু একটি আমল। আমাদের মুখ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি কথাকেই হাকিকতের পাল্লায় অবশ্যই মাপা হবে এবং ইলাহী রেকর্ডে রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে। আমাদের মহান প্রভু বলেনঃ  

مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْلٍ اِلَّا لَدَيْهِ رَق۪يبٌ عَت۪يدٌ

মানুষের মুখ থেকে বের হওয়া প্রতিটি শব্দ এবং কালেমা, আল্লাহর পাহারাদার ফেরেশতাদের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে এবং পরবর্তীতে ঐ সকল লিপিবদ্ধকৃত বিষয় সমূহকে আমল হিসেবে আমল নামায় লিপিবদ্ধ করা হয়। (ক্বাফ, ১৮) 

আমরা একই বিশ্বাসের উত্তরাধিকারী, একই কিতাবে বিশ্বাসী মু’মিন, একই পয়গাম্বরের উম্মত, একই জাতি এবং একই ইতিহাসের সন্তান। তাই আসুন সকল ধরণের বিভাজনকে এক পাশে রেখে দিয়ে কথার আখলাককে সুন্দর করে নতুন একটি জীবন শুরু করি। এমন একটি বিপদপূর্ণ সময়ে অন্যান্য সময়ের মত এই সময়কেও রহমতে পরিণত করি। আমি বলেছিলাম যে, আসুন আমরা দুঃখকে আনন্দে, বঞ্চনাকে রহমতে পরিণত করি, মুহাসারাকে মুহাসাবাতে রূপান্তরিত করি। 

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

৩২৫৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ

প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজ তুরস্কের একজন প্রথিতযশা আলেম। জীবন্ত কিংবদন্তি এ আলেমে দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিষয়সমূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৬২ সালে তুরস্কের গাজিআনতেপ শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা পিতার কাছেই সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর উসমানী ধারার প্রখ্যাত আলেম, 'মেহমেদ আমীন আর' এর নিকট শিক্ষা লাভ করেন। ড. গরমেজ পূর্ব আনাতোলিয়ান অঞ্চলে অবস্থিত উসমানী খিলাফতের সময়কালে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে শিক্ষা লাভের সময় প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন উস্তাদ 'মেহমেদ আমীন আর' এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। সেসময় তিনি একইসাথে গাজিআনতেপ মাদরাসায়ও পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিওলজি বিভাগে ভর্তি হন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ডিগ্রী লাভ করার পর হাদীস বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন এবং খাতীব আল বাগদাদীর বিখ্যাত গ্রন্থ شرف أصحاب الحديث-এর মুহাক্কিক প্রখ্যাত হাদীস শাস্ত্রবিদ প্রফেসর ড. সাঈদ হাতীবওলুর অধীনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তাঁর মাস্টার্সের থিসিস ছিল, 'মুসা জারুল্লাহ বিগিয়েফের চিন্তা ও দর্শন'।
মাস্টার্স করার সময়ে তিনি মিশরে গমন করেন এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। কায়রোতে অবস্থান কালে মিশরের স্বনামধন্য ফকীহ মুহাম্মদ সেলিম আল-আরওয়াহ এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস রিফাত ফাওজীর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এক বছর কায়রোতে অবস্থান করার পর পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন এবং পুনরায় আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট (PhD) শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে কৃতিত্বের সাথে তিনি তাঁর PhD শেষ করেন। তার PhD-এর থিসিস ছিলো "সুন্নত ও হাদীস বুঝা এবং ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সমস্যা।" PhD চলাকালীন সময়ে তিনি এক বছর লন্ডনে অবস্থান করেন এবং সেখানে 'স্কুল অফ অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ' এ গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর এ থিসিস ১৯৯৬ সালে তুরস্কের ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর গবেষণা বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে এবং সে বছর এ গবেষণার জন্য তুর্কী সরকার তাকে গবেষণা পুরস্কার প্রদান করে। তার এ থিসিসটি আরবী ও ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ থিসিসের কারণে তিনি তাঁর একাডেমিক জীবনের অধিকাংশ সময় 'উসূলে ফিকহ' অধ্যয়নে ব্যয় করেন এবং এ সময়ে তিনি একজন উসূলবিদ হয়ে উঠেন।
এযাবৎকাল পর্যন্ত তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বড় বড় মুহাদ্দিস, উসূলবিদ, আলেমগণের সান্নিধ্য লাভ করেছেন ও বিভিন্ন গবেষণায় তাদের থেকে বহু জ্ঞান অর্জন করেন। এছাড়াও উসমানী ধারার বড় বড় দার্শনিকদের সান্নিধ্যে দীর্ঘসময় পড়াশোনা করেন।তিনি আহমেদ ইয়েসেভি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজেত্তেপে বিশ্ববিদ্যালয় এবং আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্সটিটিউট ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যেমন-ইসলাম শিক্ষা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান-এর সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেন।
২০০৩ সালে তিনি Presidency of the Republic of Turkey Presidency of Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেন। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শিক্ষকতাও জারি রাখেন এবং ২০০৬ সালে প্রফেসর হন। দীর্ঘ ৭ বছর এ Religious Affairs এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০১০ সালে তিনি Religious Affairs- এর প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন এবং ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন। এ গুরু দায়িত্ব পালন কালেও তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান এবং এক মুহূর্তের জন্যও জ্ঞান গবেষণায় বিরতি দেননি। এ সময়ে তিনি মুসলিম উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। গাজা, আরাকান, সোমালিয়া, সুদান, মধ্য এশিয়া এবং বলকান অঞ্চলের মুসলমানদের সমস্যা সমাধান করার জন্য অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালান। Religious Affairs-এর প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় অবরুদ্ধ গাজা সফর করেন এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সংহতি ঘোষণা করেন। গাজাতে অবস্থানকালে তিনি অবরুদ্ধ গাজাবাসীর খোঁজ-খবর নেন। এরপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান এবং ঐতিহাসিক এক খুতবা প্রদান করেন।
২০১৭ সালে Religious Affairs-এর দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং দুটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো International Islamic Though: Foundation অপরটি হলো Institute of Islamic Thought. বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠান দুটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top