যখন একটা জাতি তার উপর চলতে থাকা রাজনৈতিক জুলুম, অর্থনৈতিক ভয়াবহ ধ্বস এবং সকল আগ্রাসন থেকে মুক্তির চিন্তা বাদ দিয়ে দেয়! কোন কার্যকর কর্মসূচি, আলাপ বা উদ্যোগ নেওয়া ছেড়ে দেয়!
তখন সেই জাতিকে নির্লজ্জ নানা ইস্যু তৈরি করে মূল বিষয় থেকে দূরে রাখা হবে এটাই স্বাভাবিক!
ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি, কৃষি, রাষ্ট্র ইত্যাদি নিয়ে কোন আলাপ বা প্রস্তাবনা আমরা দিচ্ছিনা কিংবা গত সময়ের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যখাত নিয়েও কোন মাথাব্যাথা নেই।
তাহলে সব মাথাব্যাথা তো তৈরিকৃত ইস্যু নিয়েই হবে, এটাও স্বাভাবিক।
• GDP(Gross Domestic Product) তথা মোট উৎপাদিত দেশীজ পণ্য বেড়ে গেছে, আরো কত উন্নয়নের সূচক এখন দেখা যাচ্ছে!
অথচ BBS এর মতে করোনাকালীন সময়েই কর্মক্ষম মানুষ বেকার হয়েছে ৪ কোটি ৮২ লক্ষ! সরকারপন্থী গবেষক দলের মতেও, প্রথম দিকেই ৩ কোটি ৬৬ লক্ষ নতুন বেকার হয়েছে। আর CPD এর মতে ৫ কোটি। কিন্তু আসল হিসেব হলো এখন ৮ কোটি বেকার!
হিসেব কমবেশী যাই হোক, কিন্তু মানুষের এখন আসল অবস্থা কী তা ভাবতে পারছি আমরা?
যারা আগেই বেকার ছিল, তাদের কী অবস্থা? এর প্রভাব কোথায় কোথায় পড়বে, কতটা ভয়াবহ আকারে ছড়াবে– ভাবতে পারি আমরা? যেখানে বর্তমান কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা ৮ কোটি ৮০ লক্ষ। এগুলি প্রতিদিন বাড়ছে নাকি কমছে!?
• খাদ্য সংকটে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে ৬ কোটি ৯৯ লক্ষ মানুষ।
বিআইডিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জনসংখ্যার ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ স্থায়ী কর্মসংস্থানহীন। বিশ্বব্যাংক গত অর্থবছরে ২% এবং চলতি অর্থবছরে মাত্র ১ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে। কোটিপতি ধনী বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে অথচ সানেম গবেষণায় দেখা যাচ্ছে মহামারিতে দারিদ্র্য দ্বিগুণ হয়ে ৪২ শতাংশে পৌছেছে। বিআইডিএসও গবেষণা দেখিয়েছে, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে দেশে কোটিকোটি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ দারিদ্র্যবিরোধী লড়াইয়ের প্রায় ১৫টি বছর হারিয়ে গেছে। এটা কত ভয়াবহ ভাবছি একবারো?
• দরিদ্র ও অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ থেকে বেড়ে দ্বিগুণ, অর্থাৎ সাড়ে আট কোটিতে পৌঁছাচ্ছে, যাদের দৈনিক আয় ১.৯ ডলারেরও কম।
মানুষের আয় কমছে, ব্যক্তি-সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে, চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। সামষ্টিক বা পরিবারিক সঞ্চয় কমছে বলে ব্যক্তিগত ধার/ঋণের সুযোগ কমছে।
বেকারত্বজনিত কর্মহীনতায় পড়ে শিক্ষা খাতে ঝরে পড়া বাড়বে, কৃষি ও ভাসমান কাজে শিশু শ্রম বাড়বে। একই সাথে প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ঝরে পড়াও বাড়বে এবং হয়তো পাশের হারও কমে আসবে।
শিক্ষায় ঝরে পড়া বিশাল ছাত্র-সমাজকে নিয়ে কে ভাববে? কাউকে এই ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখছি কি? আর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণের ব্যাপারে, প্রতিবাদ করে ও সংকট তুলে ধরে সমাধানের ব্যাপারে যেন কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই!
• বেকারত্ব আর ঝরে পড়া যখন বাড়বে, সামাজিক অপরাধ কি তখন কমবে? নাকি সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ আকারে বাড়তে থাকবে?
• রেমিটেন্স আমাদের আয়ের খাতের অন্যতম, অথচ প্রবাস থেকে শ্রমিকরা ফিরে আসছে প্রতিনিয়ত! সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই! এখন পর্যন্ত খালি হাতে দেশে ফিরেছেন প্রায় ২০ লক্ষ! যা আভাস পাওয়া যাচ্ছে খুব শীঘ্রই ফিরবেন আরো কয়েক লক্ষ শ্রমিক!
অথচ আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ভিত্তি ও আয়ের অন্যতম উৎস বিদেশে থাকা রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের পাঠানো আয়। কোটি কোটি যোদ্ধাদের দুর্দশা বোঝার ক্ষেত্রে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। গত এক বছরে প্রায় ২০ লক্ষ শ্রমিক বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে খালি হাতে! কিন্তু কেউ কি খবর রেখেছে তাদের? বা তাদের কোনো মৌলিক দাবির? তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে? তাদের পারিবারিক অসহায়ত্বের কোনো সমাধান কি হয়েছে?
জমি বিক্রি করে আমাদের টগবগে যুবকরা বিদেশে গিয়ে অসহায় চেহারা নিয়ে রাতদিন খেটে যায়, নির্যাতিত হয়; তাদেরকেই যখন খালি হাতে দেশে ফেরত পাঠানো হয়, তখন একটা লাইনও আমরা উচ্চারণ করি না! কোনো উদ্যোগ ও কর্মসূচি তো বহুদূর!
আরোও কষ্টের ব্যাপার হল,
বাংলার গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প চলমান ছিল, ছোট ছোট উদ্যোক্তার ভূমিকা ছিল, কিন্তু কৃষিতে ভয়াবহ ধ্বস নেমে এসেছে গত কয়েক দশকে! যতটুকুও আছে তা কায়িক শ্রম নির্ভর, আবার সেটাতেও নেই ন্যায্যতা! সবমিলিয়ে গাণিতিক হারে বেড়েছে নারী বেকারত্ব, নারী অসহায়ত্ব। আর এটাকেই ঘুণেধরা রাষ্ট্র কাজে লাগিয়েছে এবং পাচার করেছে লক্ষ লক্ষ নারীকে। বর্তমান সরকার ব্যাপকহারে তাদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে।
বিগত মাত্র এক বছরে তৈরি পোশাক শিল্পে প্রায় ৯০ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। ফলে নির্যাতন, বেকারত্ব বিষয়ে সুরাহায় না গিয়ে সরকার আরো শ্রমিক পাঠানোর ধান্দায় থেকেছে, আছে।
যেটা বলতে চাচ্ছি, শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকেই দিনে আসছে গড়ে ১১ টি কফিন। এক বছরে এসেছে ৪ হাজার ৮৮১ টি। এর মধ্যে নারীদের সংখ্যাও অনেক। সাড়ে তিন বছরে শুধু সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকের লাশ এসেছে প্রায় সাড়ে তিনশ। তাঁদের মধ্যে ৫৩ জনই আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। আত্মহত্যার এই হার তিন বছর আগের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি। তার মানে এই সময়ে তাঁদের ওপর নির্যাতনও ১৭ গুণ বেড়েছে!
কোনটা আত্মহত্যা আর কোনটা হত্যা, তাইবা কে বলবে? কেনইবা পরিবারের জন্য নিবেদিতপ্রাণ আমাদের মায়েরা আত্নহত্যা করে? কেউ আছে আমাদের? আছে কোনো পররাষ্ট্রনীতি, কোনো বৈদেশিক শ্রম ও অধিকার মন্ত্রণালয়?
আচ্ছা, এসব কি ইস্যু হতে পারেনা?
• আবার অর্থনীতির অন্যতম আরেক ভিত্তি আমাদের সমুদ্র বন্দর, যে বন্দর নানাবিধ অবকাঠামোগত সমস্যা, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও সামগ্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে! কিন্তু এ সকল সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার বদলে পুরো বন্দরকে দিয়ে দেওয়া হল ভারতের হাতে!
চিন্তা করা যায়? একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বন্দর নিয়ন্ত্রণ করবে ভিন্ন একটি দেশ।
• ৫০ এর উপরে খনিজ সম্পদ, সব বিদেশীদের হাতে ইজারা দেওয়া।
ইউরেনিয়ামের মত দামী সম্পদ, যার জন্য এত যুদ্ধ, তা কিনা আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের বিনা পয়সায় দিয়ে যাচ্ছি! সবকিছু বাদ দিলাম, গ্যাস যে আমাদের কত বড় সম্পদ– তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্র আমাদের, সেটাও নিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা!
সেখানে সবচেয়ে হাস্যকর বিষয় হল, আমাদের সরকার বিদেশ থেকে আন্তর্জাতিক মূল্যের তিনগুণ দামে গ্যাস আমদানি করছে!! কোন লাইভ প্রোগ্রাম হয়েছে এটা নিয়ে? কোন ভাইরাল পোস্ট!
• এদিকে কৃষির ক্ষেত্রে বণিক বার্তায় প্রকাশিত যে সবচেয়ে ভয়াবহ রিপোর্ট আমরা দেখেছি তা হলো– ধান ব্যতীত সকল প্রকার কৃষিদ্রব্য বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে আমাদের!!!
সারা দেশব্যাপী যে বেকারত্বের ভয়াবহ কালো ছায়া বিরাজমান। তাতে এই বেকার, চাকুরিহীন মানুষগুলো কোথায় যাচ্ছে? তাদের সন্তান, পরিবার সব কিছুই তো গ্রাম-কেন্দ্রিক, তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই গ্রামমুখী হচ্ছে। কিন্তু গ্রামের যে সার্বিক অবস্থা তা দ্বারা তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও সম্ভবপর নয়। এমনকি সরকার থেকেও তারা কোনো সহযোগিতা, ভর্তুকি পাচ্ছে না।
অথচ সরকার থেকে কৃষি ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা! এই বড় অঙ্কের অর্থ আসলে কোথায় যাচ্ছে, যেখানে ৭০% মানুষই ভূমিহীন চাষী! তারা তো সরকারের তালিকারই বাইরে, সরকার থেকে কোনো ঋণ পাচ্ছে না। আবার প্রত্যেক বারই ঘাটতি দেওয়া হচ্ছে। এই ঘাটতির টাকাগুলো কোথায় যাচ্ছে যেখানে ধান ছাড়া সব ফসলই আমাদেরকে বাহির থেকে আমদানি করতে হচ্ছে? এটা সহজেই অনুমেয়– এ জায়গাতেও বড় ধরণের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অযোগ্য নেতৃত্ব কাজ করছে।
LLRD এর মতে বর্তমানে ৫০% পুরুষ এবং ৬০% নারী কৃষক পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ, অন্যান্য চাহিদার কারণে তারা নিজেদের উৎপাদিত ফসল, শাক-সবজি, নিজেদের চাষ করা মাছ নিজেরাই গ্রহণ করতে পারছে না। তারা স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না, বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানেরাও।
এমনকি অনেক বছর আগেও তাদের অবস্থা এ রকমই ছিল। আর তারা যতটুকু গ্রহণ করতে পারছে, সেটাতেও আছে কীটনাশক, সার আর ভেজালের সমাহার। তাহলে চিন্তা করে দেখুন, এই চাষী, হাওড়-নদীর জেলে, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষক, নারী কৃষক, কুটির-শিল্পীদের নিয়ে, তাদের উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে আমরা একটুও ভাবছি? রাষ্ট্রের কোন সহযোগিতা বা উদ্যোগ আছে? আছে কি কোন পরিকল্পনা, পর্যালোচনা, প্রস্তাবনা? না, নেই।
• করোনাকালীন সময়ে শহরাঞ্চলের যে ২ কোটি পুরুষ কর্মসংস্থানহীন হয়ে পড়েছে তারা সবাই কিন্তু গ্রামেই ফিরে যাচ্ছে। ফলে পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বটা অনেকাংশে তাদের স্ত্রী অর্থাৎ নারীদের উপর চলে গেছে। গ্রামের নারীরা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে কিছু টাকা আয় করে। এই আয়ের পরিমাণ-ই বা কতটুকু? তারা আদৌ ন্যায্যমূল্যটা পাচ্ছে? তাদের স্বাস্থ্যের কী অবস্থা, চিকিৎসার কী অবস্থা? আর যতটুকুই বা পাচ্ছে তা দিয়ে কি সংসার, একটি পরিবার চালানো সম্ভব? সবমিলিয়ে এই প্রশ্নগুলো কিন্তু থেকেই যায়!
কিন্তু কোন ইস্যু তৈরি হয় এসব নিয়ে?
• এদিকে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে আমাদের দেশে রোগীর সংখ্যা, কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার কি হাল? তবুও আমাদের গুরুত্বহীন, অপরিচ্ছন্ন ও ভয়াবহ নোংরা পরিবেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বাদই দিলাম!
প্রতিদিন যে হারে মানুষ মারা যাচ্ছে, এগুলিও নজরে পড়েনা আমাদের? এর উত্তরণের কোন কর্মসূচিই নেই!
সব নজর তাহলে সাময়িক ইস্যু গুলিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?