ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন যে, ভৌগলিক দিক থেকে বিবেচনা করলে ইস্তানবুল হল পৃথিবীর রাজধানী।
মহাবীর ফাতিহ সুলতান মেহমেদ ১৪৫৩ সালের ২৯ শে মে পৃথিবীর এই গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থানটিকে বিজয় করেন। তিনি শুধু ইস্তানবুলের ভূমিকেই বিজয় করেননি, ইস্তানবুলে বসবাসরত সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের মন জয় করে এই গুরুত্ত্বপূর্ণ শহরটিকে ইসলামী সভ্যতার একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ রাজধানীতে রূপান্তরিত করেন।
একটি মূল্যায়নঃ কনসটান্টিনোপলকে কেন বিজয় করা হয়েছে?
মানুষজন যদি সমগ্র নবীদের নিকটে আসা ওহী এবং বিশেষ করে রাসূলে আকরাম (সঃ) এর নিকটে আসে ওহীকে ভালোভাবে বুঝতে না পারে, তাহলে তাঁদের সংগ্রাম, তাঁদের জিহাদ এবং তাঁদের দাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল সেটাও বুঝতে পারবে না।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্বাচিত এই নবী ও রাসূলগণ মানবতাকে কি দিয়েছেন?
তাঁরা মানবতাকে যা দিয়েছেন এর বিনিময়ে তারা কি পেয়েছেন? কেবলমাত্র তাঁদের আনিত ওহীকে বিশ্বাস করেই এই সকল কিছুকে ভালোকরে উপলব্ধি করা সম্ভব। তা না হলে অবিশ্বাসীদের মতই বলা শুরু করবে যে, নবীগণ সারা দুনিয়াকে শোষণ করার জন্য সম্রাট হতে চেয়েছিলেন (নাউযুবিল্লাহ)। যারা ইসলামকে এবং ইসলামের বিধান সমূহের প্রতি বিশ্বাস পোষণ করে না তারা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর জিহাদকে এই পন্থাতেই মূল্যায়ন করে থাকে। তারা শাম বিজয়ী খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ), ইরান বিজয়ী সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) কে এবং ইস্তানবুল বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদকে একই ভাবে মূল্যায়ন করে থাকে।
আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করাঃ
হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এবং তার পদাঙ্ক অনুসরণকারী মু’মিন সেনাপতিগণকি এক এক জন শোষক ছিলেন; নাকি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী তার দ্বীনকে পৃথিবীর বুকে বিজয় করার জন্য প্রচেষ্টাকারী মু’মিন ছিলেন?
এই বিষয়টিকে ভালো ভাবে বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদেরকে সপ্তদশ শতকের পৃথিবীকে খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
মুহাম্মাদ (সঃ) যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হন তখন সমগ্র দুনিয়া ছোট ছোট অনেক রাষ্ট্রে ছিল বিভক্ত ছিল আর এই রাষ্ট্র সমূহকে নিয়ন্ত্রকারী এবং শোষণকারী হিসাবে দুটি রাষ্ট্র ছিল। একটি ছিল পারস্য সাম্রাজ্য যার কেন্দ্র ছিল ইরানে আর অপরটি ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য যার কেন্দ্র ছিল ইস্তানবুল (তৎকালীন কনস্টান্টিনোপল)। এই দুটি রাষ্ট্র ৭০০ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর সুপার পাওয়ার ছিল এবং সমগ্র পৃথিবীতে তারাই সকল হর্তাকর্তা। এই বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র দুটি তাঁদের অধিনস্থ স্যাটেলাইট রাষ্ট্র সমূহকে নিজের ইচ্ছামত পরিচালনা করত এবং তাঁদেরকে দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করাত।
হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) তার নবুয়তের প্রথম দিক থেকেই এই দুটি রাষ্ট্রকে লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন। তিনি বলতেন, “ বল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ইরান এবং বাইজান্টাইনের প্রসাদ সমূহ ধ্বসে পড়বে”।
এর অর্থ ছিল, মানুষ যদি এই কালেমা পাঠ করে তাহলে তারা তাঁদেরকে তাঁদেরই মত মানুষদের গোলামী থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে এবং তারা যদি কেবলমাত্র মহান আল্লাহর দাসত্ত্ব গ্রহন করে তাহলে তাঁদেরকে শোষণ কারী ইরান এবং বাইজান্টাইনদের থেকেও নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবে।
নবী করীম (সঃ) এই দাওয়াত মানুষের নিকটে পৌঁছে দিতেন। অর্থাৎ রাসূলে আকরাম (সঃ) মানুষকে মানুষের গোলামী থেকে এবং যাবতীয় মূর্তিপূজা থেকে মুক্ত করে তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি জীবন ব্যবস্থার কথা জানানোর মাধ্যমে সকল প্রকার শোষণ, জুলুম, নির্যাতন এবং আধিপত্যবাদকে মুলোৎপাটন করার কথা প্রচার করতেন।
রাসূলে আকরাম (সঃ) এর ওফাতের পরে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর সময় ফিলিস্তিনে বাইজান্টাইনদের নিয়ন্ত্রিত শহর সমূহ একের পর এক বিজিত হওয়া শুরু হয়।
দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর সময়ে এক দিক থেকে বাইজান্টানদের অধ্যুষিত এলাকা সমূহ বিজত হতে থাকে এবং অপর দিকে সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এর নেতৃত্বে সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্য ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে চলে আসে।
পারসিক সেনাপতি রুস্তম মুসলিম সেনাপতি সা‘দ (রাঃ)-এর কাছে এ মর্মে প্রস্তাব পাঠালেন যে, আলাপ-আলোচনা ও কিছু প্রশ্নের জওয়াব দেওয়ার জন্য একজন বিজ্ঞ লোক পাঠান হোক। রুস্তমের উদ্দেশ্য ছিল এভাবে কালক্ষেপণ করে যুদ্ধ ব্যতীত মুসলিম সৈন্যদের বিরক্ত ও ক্লান্ত করে তোলা। ফলে মুসলমানেরা দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলবে এবং অবশেষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে যাবে। সেনাপতি সা‘দ (রাঃ) এটাকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার মুখ্য সুযোগ মনে করে সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) রিবঈ ইবনু আমের, হুযায়ফা ইবনু মিহসান ও মুগীরা ইবনু শু‘বা (রাঃ)-কে আলাদা আলাদাভাবে রুস্তমের কাছে পাঠান। রিবঈ ইবনু আমের (রাঃ) যখন স্বীয় জীর্ণ-শীর্ণ মোটা পোশাক পরে অস্ত্র নিয়ে তাঁর ছোট ঘোড়াটির উপর আরোহণ করে রুস্তমের দরবারে প্রবেশ করলেন এবং ঘোড়ার পদাঘাতে ঘরে বিছানো গালিচা ফেটে গেল। তখন তারা বলল, অস্ত্র রেখে প্রবেশ কর। রিবঈ ইবনু আমের (রাঃ) বললেন, আমি স্বেচ্ছায় এখানে আসিনি। আপনারা ডেকে পাঠিয়েছেন বলেই এসেছি। যদি আপনারা আমাকে এ অবস্থায় ভিতরে প্রবেশ করতে দিন, তাহ’লে প্রবেশ করব, অন্যথায় ফিরে যাব। তখন সৈন্যরা রুস্তমকে তার কথা বললে তিনি প্রবেশের অনুমতি দিলেন। রিবঈ (রাঃ) তার বর্মের উপর ভর দিয়ে প্রবেশ করার কারণে অধিকাংশ গালিচা ছিঁড়ে গেল। অতঃপর তারা বলল, তোমরা এখানে কি উদ্দেশ্যে এসেছ? তিনি বললেন,
“আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে এখানে আসার ব্যবস্থা করেছেন। যাতে আমরা তাঁর ইচ্ছায় লোকদেরকে মানুষের দাসত্ব থেকে বের করে আল্লাহর দাসত্বে, সংকীর্ণ পৃথিবীর মোহ হ’তে প্রশস্ত জান্নাতের দিকে, খ্রিস্টান ধর্মের অত্যাচার থেকে বের করে ন্যায় ও ইনসাফের ধর্ম ইসলামের দিকে নিয়ে যেতে পারি। তিনি আমাদেরকে তাঁর সত্য দ্বীন সহ প্রেরণ করেছেন মানবজাতির কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার জন্য। যারা এ ধর্ম গ্রহণ করবে, আমরা তাদেরকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করব এবং তাদেরকে নিরাপদে রেখে ফিরে যাব। আর যারা এ ধর্ম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করতে থাকব, যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করেন”।
ইসলামের সকল বিজয়াভিযান এবং জিহাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এটাই। তাছাড়া দুনিয়ার ধনসম্পদকে কুক্ষিগত করা, সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা কিংবা দুনিয়াকে শোষণ করার কোন উদ্দেশ্য ইসলামের নেই। উত্তর-পশ্চিম ফ্রন্ট থেকে বাইজান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস যখন প্রতি দ্বীন একটু একটু করে পিছু হটছিলেন ইরানের কিসরাও তখন আস্তে আস্তে ইরানের ভেতরের দিকে পিছু হটছিলেন।
হযরত উমর ফারুক (রাঃ) এর শাসনামলে পারস্য সাম্রাজ্য বিজিত হয় এবং দুনিয়ার দুটি বৃহৎ শক্তির একটির পতন হয়। অপর আরেকটি অবশিষ্ট ছিল তা ছিল বাইজান্টাইন। সেটারও পতন হওয়া আবশ্যকীয় ছিল। কেননা রাসূলে আকরাম (সঃ) সেটাকেও লক্ষ্য হিসাবে দেখিয়েছিলেন এমনকি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটানটিনিপলের বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছিলেন।
ইসলামী সৈন্য বাহিনী বাইজন্টাইনের দিকে যতই অগ্রসর হচ্ছিল হেরাক্লিয়াস ও তার বাহিনী ততই পিছু হটতেছিল। অবশেষে সে, কন্সটানটিনে আশ্রয় নিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। কিন্তু মুসলমানগণ তাঁদের প্রিয় রাসূলের সুসংবাদকে ভুলে না গিয়ে কন্সটানটিনের বিজয়ের জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে আসতেছিলেন। এমনকি আন্দালুসিয়া অর্থাৎ স্পেনের বিজয়ের পূর্বেই কন্সটানটিনোপলের বিজয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
তাবারীর বর্ণনা মতে, মুসলমান মুজাহিদগণ সর্বপ্রথম হিজরী ৪৩ সালে কন্সটানটিনের বিজয়ের জন্য অভিযানে বের হয়। পরবর্তীতে আরও অনেকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়। কন্সটানটিন তথা ইস্তানবুলের বিজয়ের জন্য মুসলমানগণ সব সময় ব্যাকুল ছিলেন কেননা তাঁদের প্রিয় রাসূল এই ব্যাপারে অনেক প্রশংসা বাণী শুনিয়েছেন।
হিজরী ৪৯ সালে মুসলিম সেনাবাহিনী গণ কনসটানটিনিয়াকে বিজয় করার জন্য যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন সে অভিযানে আইয়ুব আল আনসারী (রাঃ) ও ছিলেন। তিনি সেই অভিযানে এসে শাহাদাত বরণ করেন। তার কবর সম্বলিত স্থান আজ ইস্তানবুলের আইয়ুব সুলতান নামে পরিচিত। কনসটানটিনিয়ার বিজয়ের জন্য মুসলমানগণ অনেক বেশী প্রচেষ্টা চালান কিন্তু কোন ক্রমেই বিজয় করতে পারছিলেন না, অবশেষে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উসমানী রাষ্ট্রকে বিজয় অর্জন করার তওফিক দান করেন।
নবী করীম (সঃ) কর্তৃক প্রশংসিত সৈনিক হওয়ার জন্যঃ
উসমানী সেনাবাহিনীগণও তাঁদের পূর্বের মুসলমানদের মত ইস্তানবুল বিজয় করে রাসূলে আকরাম (সঃ) এর প্রশংসিত সৈনিক হতে চেয়েছিলেন। এই জন্য যুবক উসমানী সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ক্ষমতা গ্রহনের প্রথম দিন থেকেই যে বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেন এবং কাজ শুরু করেন তা ছিল কনস্টান্টিনোপলের বিজয়। উত্তম মানুষ গুলো উত্তমরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করে বিজয়ের জন্য অগ্রসর হতে থাকেন। ১৪৫৩ সালের বসন্ত কালে দ্বিতীয় মেহমেদ তার সেনাবাহিনী নিয়ে কনসটানটিনিয়াকে অবরোধ করেন এবং মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে ২৯শে মে কনসটানটিনিয়াকে বিজয় করতে সক্ষম হন। এর পর থেকে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদের নাম হয়ে যায় ফাতিহ (বিজয়ী)। বিশাল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ইসলামের শক্তির সামনে মাথানত করতে বাধ্য হয়।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ


