স্বৈরাচারী শাসকের পতন : বাংলার জনবিপ্লবে আরব নেতৃবৃন্দের পরামর্শ

হে বাংলার প্রিয় উম্মাহ এবং সম্মানিত জনসাধারণ,
সমগ্র আরববিশ্বে বিগত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে চলমান সংকটাপন্ন পরিস্থিতির আলোকে বিগত একদশকে আরব জনসাধারণ যেসব বিষয়াদির সম্মুখীন হয়েছে আপনাদের সাথে সেসব পরামর্শমূলক আলোচনাই করতে চাই। এমনকি, ইতোমধ্যেই আপনাদের দেশের চলমান এই পরিস্থিতিতেও একই বিষয়াদি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই আলোচনার কারণ এটাই যে, বাংলায় বসবাসরত প্রিয় জনসাধারণ যেনো পূর্বে আরববিশ্বে ঘটে যাওয়া সেসব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারে। মুসলিম উম্মাহর প্রধান শত্রুরা-সহ দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা দেশদ্রোহী শত্রুরাও আপনাদের এই বিপ্লবের হাওয়া অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা চায় বাংলার জনবিপ্লবকে বাতিল করতে, তারা চায় বাংলার জনসাধারণকে পরাধীন করতে, তারা চায় বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজের উপরে আরো হিংস্রভাবে নিপীড়ন চালিয়ে যেতে। ফলশ্রুতিতে, আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে, যেনো আরবের মতো তারা একই পরিবেশ বাংলার ভূমিতেও তৈরি করতে না পারে।

আপনাদের প্রতি অনুরোধ রইলো,
এখনই গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বা আন্দোলনের সূতিকাগার স্থানগুলোকে ফেলে রেখে ঘরে ফিরে যাবেন না। এমনকি, একমুহুর্তের জন্যও ফাঁকা রাখবেন না। সরকারের অবর্তমানে আগত সেনাবাহিনীদের সকলেই কিন্তু দেশের কল্যাণ চায় না; আবার, তাদের মধ্য থেকে যারা দেশের কল্যাণ চায়, তাদেরকেও কিন্তু সকলে চিনে না; ফলে তারা যা-ই বলুক না কেনো, তাদের বক্তব্যকে চূড়ান্তভাবে মেনে নিবেন না। মনে রাখবেন, এদেরই একাংশের হাতে কিন্তু বিগত কিছুদিনে ছোটো-বড়ো অসংখ্য ছাত্র ও জনসাধারণ নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। যারা নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করেছে, যাদের হাতে উদীয়মান মেধাবী তরুণদের তাজা রক্ত লেগে আছে এবং রাজনৈতিক, সামরিক ও বিচার-বিভাগীয় যেসব নেতৃবৃন্দের হাত বাংলার আপামর জনসাধারণের রক্তে রঞ্জিত, একমাত্র মৃত্যুদণ্ড ব্যতিত আর কোনো বিচারই তাদের ক্ষেত্রে আপনাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত নয়। মানবতা রক্ষার তথাকথিত এসব আইনের নামে যারা আপনাদের উপর দীর্ঘ একটা সময় ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জুলুম করে এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে কোনোপ্রকার ছাড় দেবেন না; হোক সে যুবক, প্রৌঢ় বা বয়োবৃদ্ধ! বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই অতিসত্বর একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবী করবেন না, চাই সে নির্বাচন সুষ্ঠু হোক বা অন্যায্য হোক। এমনকি, চলমান এই পরিস্থিতিতে পূর্বের মতোই সর্বজনীন, সাধারণ ও বেসামরিক সরকারের দাবী করে বসবেন না।

এসবের কারণগুলো হলো,

০১.
আপনাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমার চেয়ে কিন্তু আপনারাই ভালো বুঝবেন যে, বর্তমানে যারা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন, তাদেরকে বিগত স্বৈরাচারী শাসকই নিযুক্ত করেছেন। সেহেতু, তাদের অনেকের ভেতরেই বিগত শাসকের অন্যায়, অবিচার, জুলুমের পরোক্ষ মতামত রয়েছে এবং স্বভাবগতভাবে একই হবে। মনে রাখবেন, মাত্র এক ঘণ্টার জন্য হলেও সমগ্র সেনাবাহিনীর উপর বিশ্বাস রাখবেন না। কারণটাও শক্তিশালী যে, যেহেতু বর্তমান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিগত স্বৈরাচারী শাসকই নিযুক্ত করেছেন, সেহেতু দুর্নীতি রোধ করার বিপরীতে সেটাকে আরো রক্ষা করা এবং জনসাধারণের উপর অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে জুলুম করার ক্ষেত্রে বিগত স্বৈরাচারী শাসকের পাশাপাশি তারাও কিন্তু সমভাবে অপরাধী।

০২.
ইসলামী শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক সর্বজনীন সরকার-কে সামরিক শাসনের বিকল্প হিসেবে দেখা হয় না। কেননা, ন্যয়ভিত্তিক অর্থনীতি ও আদালতপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা-র জন্য ইসলাম যেকোনো ধরনের সরকারকে সাধুবাদ জানায়। মূল কথা, নেতৃত্বে যারই আগমন ঘটুক না কেন, তাকে আদালত, মারহামাত ও বিশ্বাস-কে প্রাধান্য দিতে হবে; নতুবা তাকেও গ্রহণ করা হবে না। কিন্তু, দুঃখের বিষয় হলো, বিগত স্বৈরাচারী শাসকের পরে আগত সেনাবাহিনীর মধ্যে এমন সংখ্যক চিন্তা লালনকারী এবং দেশ ও জাতির জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গকারী সৈন্য-সংখ্যা খুবই কম রয়েছে।

আপনাদের এখন মূল কাজ হলো, জাতির জন্য উৎসর্গকৃত সেসব প্রাণ খুঁজে খুঁজে বের করে দেশের নেতৃত্বের ভার তাদের হাতে অর্পণ করা, যাতে করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, প্রশাসনিক ও বিচার-বিভাগীয়-সহ বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরেই যেনো আদালত, মারহামাত ও বিশ্বাস প্রতিস্থাপিত হয় এবং বসবাসযোগ্য একটি বাংলাদেশ পুনঃগঠিত হয়। এমনকি, তারা যদি চলমান এই গনহত্যার হত্যকারীদের কঠিন বিচার করে, তবুও তাদেরকেই সমর্থন করুন।

০৩.
বর্তমান এই পরিস্থিতিতে কখনই আপনারা আপনাদের মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন না বা সেসব বিষয়গুলোকে মূল আলোচনার বিষয়বস্তু বানাবেন না। যদিও সেসব বিষয়গুলো বর্তমান পরিস্থিতির মাত্রাতিরিক্ত বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা নিয়ে হোক না কেনো। এছাড়াও, নিহতদের নিয়ে মাতামাতি করা, সাম্প্রদায়িকতা-সহ যতো ধরনের মনোযোগ-বিশৃঙ্খলকারী বিষয় আছে, সেসবকে দূরে রাখতে হবে। নতুবা, এতে করে দেশ ও জাতির শত্রুরা আপনাদেরকে বিশৃঙ্খল করে দিতে সক্ষম হবে এবং আপনাদের অভ্যন্তরেই বিভাজন সৃষ্টি করে দেবে। তবে, এসব নিয়ে ততটুকু আলোচনাই করবেন, যতটুকু আন্দোলন ও বিপ্লবের জন্য উপকারী হবে এবং দেশ ও জাতির কল্যাণার্থে ব্যবহৃত হবে।

০৪.
আপনাদের লক্ষ্য কিন্তু তথাকথিত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা বা আপনাদের দেশে ইউরোপীয় কৃষ্টিকালচার প্রতিষ্ঠা করা নয়। আপনাদের লক্ষ্য হলো দেশ ও জাতির কল্যাণে ন্যয়ভিত্তিক অর্থনীতি ও আদালতপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা-র সূচনা করা। আর এসব সম্ভব হবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে থাকা জীবন উৎসর্গকারী সেই হাতেগোনা কয়েকজন-এর দ্বারাই, যারা জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে এবং আপনাদের বিপ্লবকে বিপথে পরিচালনাকারী ও প্রোপাগাণ্ডা সৃষ্টিতে সিদ্ধহস্ত মিডিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে, বা প্রয়োজনে সেগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেবে।

০৫.
মনে রাখবেন, বিগত বিপ্লবে নৃশংসভাবে হত্যার পেছনে—এমনকি বিগত এক যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে তাদের অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, নিষ্পেষণে তারা যেসব আইনগুলোকে সামনে রাখে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলোর কিন্তু কোনো অস্তিত্ব নেই; অথবা থাকলেও সেসব আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য গণহত্যায় সমর্থন নয়। খেয়াল করলে দেখবেন, বিগত এক যুগে তারা যে আইনগুলোই প্রণয়ন করেছে, সেগুলো দিয়েই কিন্তু দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করে গিয়েছে। অর্থাৎ, তাদের ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থ হাসিলের জন্যই তারা এসব আইন প্রণয়ন করেছে। ফলে, এগুলোর প্রতিটি আইনই অবৈধ; কেননা এসব আইন দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের কোনো কল্যাণে আসেনি। অতএব, অতিসত্বর এসব আইন বিলুপ্ত করে দিবেন এবং এমন আইন প্রণয়নে সর্বদা বাধা হয়ে দাঁড়াবেন।

০৬.
আপনাদের দেশের চলমান এই পরিস্থিতি কখনই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নয়, চাই সে নির্বাচন সুষ্ঠু হোক বা অন্যায্য। দেশের ইসলামী দলগুলোর প্রতি অনুরোধ রইলো, দীর্ঘ সময়ের জুলুমের পর মরিচীকাতুল্য এই ক্ষমতা পাওয়ার সুযোগের ফাঁদে পা দিবেন না। ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক পন্থায় আপনারা রাজনীতিতে পদার্পণ করেন না। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, জনসাধারণকে আপনাদের যতোই প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকুক না কেনো, রাজনৈতিকভাবে বা রাজনীতির শক্তিতে বাকী রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে আপনারাই কিন্তু অনেক পিছিয়ে। এটা মেনে নিয়ে নিজেদেরকে গুছিয়ে নিন, সংঘবদ্ধ করুন। বাকী দলগুলো দীর্ঘ সময় রাজনীতিতে ব্যয় করেছে, কমবেশি তারা রাজনীতির অলি-গলিতে চলাচল করেছে; কিন্তু আপনারা তাদের মতো করে রাজনীতিতে সময় দেননি। মাঠে-ময়দানে আপনাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া বা রাজনীতিতে আপনাদেরকে বিশৃঙ্খল করে দেওয়া বাকী দলগুলোর চেয়ে সহজ হবে। এটাও কিন্তু সত্য যে, জনসাধারণকে আপনাদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকলেও রাষ্ট্র বা বর্তমান সেনাবাহিনীর উপরে আপনাদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা কম। সাথে এটাও সত্য যে, দেশের আপামত জনতাকে যারা নৃশংসভাবে খুন করেছে এবং যারা দেশের সম্পদ নষ্ট করেছে, তারা কিন্তু আপনাদের পেছনেই লেগে রয়েছে; এমনকি তারা আপনাদের সর্বশেষ কর্মীকে পর্যন্ত হত্যা করতে পিছপা হবে না। কারণ, জনসাধারণের মাঝে তাদের চেয়ে আপনারা দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। এখন, আপনাদের প্রতি অনুরোধ রইলো, নিজেদের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির অলি-গলি ও পথ-ঘাট ভালোভাবে চিনে নিয়ে নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করুন এবং গুছিয়ে নিন।

০৭.
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে আমার অনুরোধ হলো, স্বল্পমেয়াদে নিজেদের আন্দোলনের স্বার্থকতা রক্ষার জন্য মিডিয়াগুলোকে প্রভাবিত করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের আন্দোলনের স্বার্থকতা রক্ষার জন্য প্রচুর পরিমাণে অধ্যয়ন করতে হবে। দুর্নীতিবাজ ও প্রোপাগাণ্ডা সৃষ্টিতে সিদ্ধহস্ত মিডিয়াগুলোকে শক্তহাতে দমন করতে হবে এবং তাদের ভুবন-ভোলানো বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না; এক্ষেত্রে নিজেও সতর্ক থাকতে হবে এবং অপরকেও সতর্ক করতে হবে। সত্যিকারার্থে, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যে কোথাও ‘স্বাধীন মিডিয়া’ বলে কিছুই নেই। ফলে এই মুহূর্তে লক্ষ্য রাখা উচিত, কারা সত্য ও সঠিক খবরাখবর প্রকাশ করে। আর যারাই মিথ্যা ও প্রোপাগাণ্ডা-মূলক খবর প্রচার করে, এখনই তাদের লাগাম টেনে ধরতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বর্তমান এই আন্দোলনের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী করতে এবং এর স্বার্থকতা রক্ষা করতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। কেননা, এই শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই শিক্ষিত একটি প্রজন্ম গড়ে উঠবে, যারা এই আন্দোলনের স্বার্থকতাকে বয়ে নিয়ে বেড়াবে এবং ন্যয়ভিত্তিক অর্থনীতি ও আদালতপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা-কে দীর্ঘায়িত করবে।

পরিশেষে আপনাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই,
এসবই আমাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল, যেসব অভিজ্ঞতার সূচনা হয়েছিলো আরব বসন্তের মাধ্যমে। আরব বসন্তের সেই সময়ে আমাদেরকেও এমন কথাগুলোই বলেছিলেন উম্মাহর মহান মুজাহিদগণ। কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য যে, আমরা সেসব কথাগুলোকে খুব একটা প্রাধান্য দেইনি। যার ফলে আজ আমরা এই অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছি। দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ রইলো, আপনারা একই ভুল দুইবার করবেন না, একই গর্তে দু’বার পা দেবেন না। সতর্ক থাকুন, চোখ-কান খোলা রাখুন। মহান রব সাক্ষী, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ মৌলিক বিষয়গুলোই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি। মহান আল্লাহ আমাদের সকলের প্রচেষ্টাকে কবুল করুক।
আল্লাহুম্মা আমীন।

 

অনুবাদ: মিফতাহুর রহমান। 

৮৭৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top