১৯৩৩ সালের জুন সংখ্যা ‘নিগার’ পত্রিকায় জনাব নিয়াজ ফতেহপুরী আমার সম্পাদিত ‘তর্জুমানুল কুরআন’ সম্পর্কে এক বিস্তৃত সমালোচনা প্রকাশ করেছেন। এজন্যে আমি জনাব ফতেহপুরীর শুকরিয়া আদায় করি। সাধারণত পত্র পত্রিকার সমালোচনা সম্পর্কে বাদানুবাদ কিংবা পাল্টা সমালোচনা করা রীতিসম্মত নয়। কিন্তু যোগ্য সমালোচক তাঁর নিবন্ধটিতে এমন কতকগুলো মতামত প্রকাশ করেছেন, যা তাঁর প্রগতি-ধর্মের বিশিষ্ট মূলনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত; আর এই সমস্ত মূলনীতির সংশোধন করাই তর্জুমানুল কুরআনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এ কারণেই আমি এ সম্পর্কে আমার নিজস্ব মতামত প্রকাশের এই প্রথম সুযোগের সদ্ব্যবহার করা একান্ত জরুরি বোধ করছি। তিনি লিখেছেন :

এই পত্রিকার উদ্দেশ্য এর নাম থেকেই প্রতিভাত হয় অর্থাৎ কুরআনের অর্থ, তাৎপর্য ও শিক্ষাকে সঠিকরূপে লোকদের মধ্যে প্রচার করা। নিসন্দেহে এই উদ্দেশ্যের উপযোগিতাকে কেউ অস্বীকার করতে পারেনা। কিন্তু যোগ্য সম্পাদক নিজেই যেমন স্বীকার করেছেন, বর্তমান যুগে এই লক্ষ্য অর্জনটা মোটেই সহজসাধ্য নয়। কারণ, অতীতকালে ধর্ম বলতে শুধু পূর্ব পুরুষদের অন্ধ অনুকৃতি ও পশ্চাৎমুখী ক্রিয়াকলাপকেই বুঝাতো। তখন কারো পক্ষে ধর্ম প্রচারক বা সংস্কারক সাজা মোটেই কঠিন ব্যাপার ছিলোনা। কিন্তু আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়া মানুষের ‘চিন্তা ও কর্ম’কে সম্পূর্ণ নতুন রূপ দান করছে – তার মনমগজকে ‘চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ দ্বারা সমৃদ্ধ করে দিয়েছে। কাজেই আজকে শুধু পূর্ব-পুরুষদের আচরণ, কর্মনীতি ও চিন্তাধারার প্রমাণ দেখিয়েই ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। পূর্বে হয়তো আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে আলোচনা বা তর্কবিতর্ক করা হতো; কিন্তু আজকে আল্লাহর অস্তিত্বকেই একেবারে অসম্ভব মনে করা হচ্ছে। আগেকার দিনে রসূল সা.-এর পথনির্দেশকে হয়তো মুজিযার সাহায্যে প্রমাণ করা যেতো, আর আজকে সেই মুজিযার ভিত্তিতেই ‘চুম্বক বিজ্ঞান’ বেশুমার নবী ও রসূল সৃষ্টি করতে উদ্যত হয়েছে। অতীতে একজন বক্তা আসমানের দিকে তাকিয়ে আরশ ও কুরসিবিশিষ্ট আল্লাহকে ডাকতে পারতো; কিন্তু আজকে আসমান নামক কোনো জিনিসেরই অস্তিত্ব নেই। এমতাবস্থায় কেউ এ ধরনের কাজ করলে তা মোটেই কল্যাণকর হতে পারেনা। ফলকথা, এখন আর ‘গায়েবের প্রতি ঈমানে’র দিন নেই, এখন তো অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের প্রতি ঈমানের দিন এসেছে। এমনি সঙ্কটজনক সময়ে ধর্মের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা মোটেই সহজ কাজ নয়। বিশেষত আজকে ধর্মের ধারণাই লোকদের কাছে তেমন গ্রহণযোগ্য নয় বলে কাজটা আরো কঠিন মনে হয়।

সামনে অগ্রসর হয়ে তিনি আরো লিখেছেন:

কুরআনপাক তার অর্থের দিক থেকে তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে নৈতিক শিক্ষা প্রদত্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে বিবৃত হয়েছে আকীদা বিশ্বাস। আর তৃতীয় ভাগে রয়েছে ঐতিহাসিক কাহিনী ও উদাহরণ। পথম ভাগ সম্পর্কে বেশিকিছু লিখবার প্রয়োজন নেই এ সম্পর্কে কোনো দলিল প্রমাণ উপস্থিত করারও আবশ্যকতা নেই। কারণ সকল ধর্মের নীতিশাস্ত্রই প্রায় এক অভিন্ন। আর প্রত্যেকেই একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, ইসলামের নীতিশাস্ত্র অন্যান্য ধর্মের নীতিশাস্ত্র থেকে ভিন্ন ও নিম্নমানের নয়। অবশ্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের প্রতি বেশি আলোকপাত করা উচিত। কারণ আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্ক্রিয়া এই দু’ভাগ সম্পর্কে লোকদের মনে সন্দেহ ও দ্বৈধ্যবোধের সৃষ্টি করে দিয়েছে। আর সত্য বলতে কি, এসব শোবা-সন্দেহ কেউ নিরসন করতে সক্ষম হলে তিনি বর্তমান শতকের মুজাদ্দিদ বলে সাব্যস্ত হবেন। এ কারণেই আমি এ সম্পর্কে একটি স্থায়ী বিভাগ খুলবার পরামর্শ দেবো। এই বিভাগের মাধ্যমে আকীদা বিশ্বাস ও আখ্যান সম্পর্কিত তামাম কুরআনী আয়াতের পর্যালোচনা করা উচিত। অতপর এসব আয়াতের সঠিক উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য নিধারণ করে আধুনিক পণ্ডিত ও গবেষকদের তরফ থেকে উত্থাপিত যাবতীয় আপত্তি ও প্রতিবাদ খণ্ডন করা আবশ্যক।

উপসংহারে তিনি লিখছেন:

আগামীতে আমি সর্বপ্রথম ওহী ও ইলহামের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করতে তাঁকে আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ এই জিনিসটি উপলব্ধি করার ওপরেই কালামুল্লাহর মর্মোপলব্ধি নির্ভরশীল। সেই সঙ্গে আখিরাত সম্পর্কিত প্রশ্নটিও আলোচিত হওয়া উচিত। কারণ এর মীমাংসার ওপরই ধার্মিকতা ও অধার্মিকতার প্রশ্ন নির্ভর করে। তিনি কালামে ইলাহী এবং আখিরাত সম্পর্কে কি ব্যাখ্যা প্রদান করেন, তাই আমি দেখতে চাই। তারপরই আমার শোবা-সন্দেহ এবং আপত্তিগুলো উত্থাপন করবো তাঁর প্রচেষ্টায় সেগুলো দূরীভূত হলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হবো। কারণ বর্তমানে অনেকেই ‘দায়ে ঠেকে মুসলমান সাজা’র নিদারুণ অভিশাপে জর্জরিত। এর একটি বিরাট কারণ হচ্ছে পরকাল বিশ্বাস।

এই উদ্ধৃতিতে যোগ্য সমালোচক যেসব খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, সেগুলো বাদ দিয়ে আমি শুধু মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতিই আলোকপাত করতে চাই।

তিনি কুরআন মজিদের আলোচনাকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। কিন্তু আমরা তাকে অনায়াসেই দু’ভাগে বিভক্ত করতে পারি। এর প্রথম ভাগের বিষয়বস্তু হচ্ছে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি ও বিচার ক্ষমতার সীমাবহির্ভূত। এর কোনো একটি বিষয়কেই আমরা চূড়ান্তভাবে ভুল বা নির্ভুল আখ্যা দিতে পারিনা। তাই এগুলোর ব্যাপারে কুরআন আমাদেরকে গায়েবের প্রতি ঈমান পোষণের আহ্বান জানায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর বিষয়গুলো আমাদের জ্ঞান সীমার বহির্ভূত নয় এবং এগুলো সম্পর্কে কোনো যুক্তিসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণও আমাদের পক্ষে সম্ভবপর। এই হিসেবে আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও গুণরাজি, ফেরেশতা, ওহী, খোদায়ী কিতাব, নবুয়াতের তাৎপর্য, মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন, পারলৌকিক শাস্তি ও পুরস্কার ইত্যাদি বিষয়াদি ছাড়াও ঐতিহাসিক কাহিনী ও উদাহরণ প্রসঙ্গে বর্ণিত এবং জ্ঞান বুদ্ধি ও বিচার ক্ষমতার সীমাবহির্ভূত সমস্ত বিষয়ই প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এই বিষয়গুলো সাধারণ মানবীয় বিচার ক্ষমতার সীমাবহির্ভূত হোক কিংবা বর্তমান বুদ্ধিবৃত্তির ও বৈজ্ঞানিক পর্যায়ে এগুলোর সত্যতা ও যথার্থতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের অক্ষমতাই হোক, তাতে কিছু যায় আসেনা। পক্ষান্তরে ইসলামের নীতিশিক্ষা, আত্মশুদ্ধি এবং মানবীয় জীবন পদ্ধতি সম্পর্কিত তামাম বিষয়ই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত।

যোগ্য সমালোচকের মতে, দ্বিতীয় ভাগ সম্বন্ধে আলোচনা করারই কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এ সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষা অন্যান্য ধর্মেরই অনুরূপ। অবশ্য তার মতে প্রথম ভাগটি সম্পর্কে আলোচনা করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর সম্পর্কেই লোকদের মনে সন্দেহ ও দ্বৈধবোধের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বিষয়গুলো সম্পর্কে কেন সন্দেহ ও দ্বৈধবোধের সৃষ্টি হচ্ছে? এর জবাবে তিনি বলেছেন, অতীতকালে পশ্চাৎমুখিতা ও অজ্ঞতার কারণে লোকেরা গায়েবী বিষয়ের প্রতি ঈমান পোষণ করতো। কিন্তু আজকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার উদ্ভাবনী মানুষের চিন্তা ও কর্মকে নতুন রূপদান করেছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দ্বারা তার মনমগজকে সমৃদ্ধ করে দিয়েছে। এ কারণেই এখন আর ‘গায়েবের প্রতি ঈমানের’র দিন নেই, বরং তার পরিবর্তে ‘অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের প্রতি ঈমান’ পোষণের দিন এসেছে।’

এই অভিমতটি কয়েকটি ভ্রান্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর মধ্যে প্রথম ভ্রান্তি হচ্ছে অতীত ও বর্তমানকালের মধ্যকার আসল পার্থক্যটা উপলব্ধি না করা। দুর্ভাগ্যবশত জনাব নিয়াজ কেবল একাই নন; বরং একটি বিরাট দল এই ভ্রান্ত ধারণায় নিমজ্জিত যে, ধর্মের প্রদীপ শুধু বিগত যুগের অন্ধকারেই আলো বিকীরণ করতে পারতো; কিন্তু আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের সূর্যোদয়ের পর তার পক্ষে আর দীপ্তিমান হওয়া সম্ভবপর নয়। অথচ যে যুক্তি বিজ্ঞানকে এরা আলোকরশ্মি বলে অভিহিত করেছেন তা এ যুগের কোনো নিজস্ব সম্পদ নয়। এসকল জ্ঞান বিজ্ঞান অতীতকালেও লোকদের দৃষ্টিশক্তিকে এভাবেই ঝলসে দিয়েছে। আর অতীতকালেও যাদের দৃষ্টি ঝলসে গিয়েছিলো, তারাও এটাই ভেবেছিলো যে, ধর্মের প্রদীপ এখন দীপ্তিমান থাকতে পারেনা। তখনকার দিনের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও নব নব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারও তাদের মতে চিন্তা ও কর্মকে নতুন রূপদান করেছিলো এবং তা চিন্তা ও বিবেকের যুক্তি দ্বারা লোকদের মন মগজকে এমনি সুসমৃদ্ধ করে দিয়েছিলো যে, তাদের সেই আলোকজ্জল যুগে গায়েবের প্রতি ঈমান পোষণের কোনো অবকাশই ছিলোনা। হিজরী দ্বিতীয় শতক থেকে চতুর্থ শতক পর্যন্ত কি এই অবস্থাই বিরাজমান ছিলোনা? প্লেটো, এরিস্টটল, এপিকোরাস, জিনো, বার্কলাস, আলেকজান্ডার, * ফিরদৌসী, ক্লাটিনোস প্রমুখ দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের চিন্তাধারা যখন মুসলিম দেশগুলোতে প্রচারিত হলো এবং তার ফলে দার্শনিক চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অন্বেষার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা হলো, তখনো কি একদল লোক এরূপ ধারণাই পোষণ করতোনা? তখনকার দিনের চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি এবং আচরণও ধারণার নতুন রূপ কি এভাবেই লোকদের ধর্মবিশ্বাসে সন্দেহ ও দ্বৈধবোধের সৃষ্টি করেনি? কিন্তু তারপর কি হয়েছিল? দার্শনিকদের যেসব মতবাদ ও আনুমানিক সিদ্ধান্তের প্রতি তখনকার লোকেরা বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো, পরবর্তীকালে তার অনেকগুলোই মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো। জ্ঞান বিজ্ঞানের যে তীব্র সূর্যালোকে ধর্মের প্রদীপকে তাঁদের নিবু নিবু মনে হচ্ছিলো, যুগের একটি আবর্তনেই তা একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেলো। তাদের ‘আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান’ সেকেলে বস্তুতে পরিণত হলো। তাদের নব নব ‘বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার’ চিন্তা ও কর্মকে নবরূপ দানের শক্তি হারিয়ে ফেললো। যেসব ক্ষেত্রে তাঁরা নতুন রূপ দান করেছিলো, তা পুরনো বলে সাব্যস্ত হলো। এমনকি, সমকালীন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে তারা যেসব যুক্তি প্রমাণের অবতারণা করেছিলো, এবং সেগুলোর ভিত্তিতে যেসব দার্শনিক মতবাদ দাঁড় করিয়েছিলো তার অধিকাংশকেই আজকের একজন নগণ্য ছাত্রও অর্থহীন ও অকেজো আখ্যা দিতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করবেনা।

এমতাবস্থায় কেউ যদি বলে, অতীতের অন্ধকার যুগেই কেবল ধর্মের প্রদীপ জ্বলতে পারতো, কিন্তু আজকের আলোকজ্জ্বল যুগে তা আর জ্বলতে সক্ষম নয়, তাহলে আমরা ভাবতে বাধ্য হবো যে, ইতিহাস নিজেই তার পুনরাবৃত্তি করছে। আজকে যেসব বিষয়কে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও নতুন আবিষ্কার উদ্ভাবনী বলে অতীতের ন্যায় দাবি জানানো হবে, তার বেশির ভাগই পূর্বেকার লোকদের ‘আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান’ ও নতুন আবিষ্ক্রিয়ার পরিণতি লাভ করবে এবং ‘চিন্তা ও কর্মের নব নব রূপ’ ও যুগের আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ও সেকেলে হয়ে যাবে এ ব্যাপারে আমরা সুনিশ্চিত। যে সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান ও আবিষ্ক্রিয়ার কারণে সমালোচক গর্ববোধ করেন, সেগুলোর প্রতি তিনি একবার গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করুন এবং ওগুলোর আসল উদ্ভাবক ও আবিষ্কারকদের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন, তবেই তিনি বুঝতে পারবেন যে, অতীতের জ্ঞান বিজ্ঞানের ন্যায় এগুলোর মধ্যেও নিশ্চায়ক বস্তু খুব কমই রয়েছে। এসকল জ্ঞান বিজ্ঞানের মধ্যে এমনি জিনিস প্রায় নেই বললেই চলে, যার সম্পর্কে একথা নিসংশয়চিত্তে বলা যেতে পারে যে, এটির ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। বাকি জিনিসগুলো শুধু অনুমান, কল্পনা, সন্দেহ, মতামত ও দ্বিধা সঙ্কোচের ওপর ভিত্তিশীল। এগুলো সম্পর্কে পূর্ণ দৃঢ়তা ও নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলা যেতে পারে যে, যুগের গতি যতোই তরক্কীর দিকে এগুতে থাকবে, ‘এসব আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান’ ও ‘নিত্যনতুন আবিষ্ক্রিয়া’ ততোই প্রাচীন ও সেকেলে বস্তুতে পরিণত হবে। এবং সেই সঙ্গে এসকল দুর্বল ও ঠুনকো জ্ঞান বিজ্ঞান ও আবিষ্ক্রিয়ার ওপর নির্ভরশীল চিন্তা ও কর্মের নতুন পদ্ধতিগুলোও অপর কোনো নতুন পদ্ধতির জন্যে জায়গা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।

কাজেই অবস্থা যখন এই, তখন কোনো চেতনাসম্পন্ন ও পরিণত দৃষ্টিসম্পন্ন লোকের পক্ষেই ধর্মের ভবিষ্যত চিন্তায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। ‘আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান’ ও ‘নতুন আবিষ্কার উদ্ভাবনী’ আজ ‘চিন্তা ও কর্মের নতুন ভিত্তি রচনা করেছে এবং ‘চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ দ্বারা লোকদের মন মগজকে সমৃদ্ধ করে দিয়েছে, কাজেই ধর্মের পরিণতি কি দাঁড়াবে, খোদাই জানেন এমনি দুশ্চিন্তায় আতঙ্কিত হবারও কোনো হেতু নেই। এসব জ্ঞান বিজ্ঞান ও আবিষ্ক্রিয়ার ওপর একবার সন্ধানী দৃষ্টি ফেললেই দেখতে পাবেন যে, ধর্মের সাথে যেসব জিনিসের বিরোধ রয়েছে, তা প্রামাণ্য ও সন্দেহাতীত কি না? তা যদি বাস্তবিকই প্রামাণ্য ও সন্দেহাতীত হয় এবং ধর্মের মৌল বিশ্বাসের সঙ্গে তার বিরোধও দেখা দেয়, তাহলে নি:সন্দেহে তার সামনে এই প্রশ্ন এসে দাঁড়াবে যে, ধর্ম এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার এই দু’টির কোনটির প্রতি সে ঈমান পোষণ করবে? কিন্তু তা যদি শুধু অনুমান, কল্পনা, সন্দেহ ও দ্বৈধবোধে নিক্ষেপকারী জিনিসই হয়, তাহলে ধর্মের সঙ্গে তার বিরোধে ঘাবড়াবার কিছু নেই। কারণ ধর্ম যদি ঈমান ও প্রত্যয়ের ওপর ভিত্তিশীল হয় তো তার মুকাবিলায় অনুমান, কল্পনা, সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কোনোই গুরুত্ব নেই। পক্ষান্তরে ধর্ম যদি আনুমানিক ও কাল্পনিক জিনিস হয় তো আধুনিক বৈজ্ঞানিক মতবাদগুলোও তো এই অনুমান ও কল্পনার ওপর নির্ভরশীল। কাজেই উভয়ের তারতম্য বিচারের আর কি কারণ থাকতে পারে?

আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও নিত্য নতুন আবিষ্ক্রিয়ার দ্বারা অভিভূত হয়ে ধর্মের প্রতি সংস্কার দৃষ্টিক্ষেপ করা এমন লোকের পক্ষেই শোভা পায়, যার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে যে, প্রতিটি নতুন জিনিসই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, কাজেই যুগের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে তাকে গ্রহণ করা কিংবা তার প্রতি ঈমান পোষণ করা একান্ত আবশ্যক। এমনকি, তা যদি শুধু আনুমানিক ও কাল্পনিক জিনিসও হয় এবং প্রগাঢ় বৈজ্ঞানিক দূরদৃষ্টি নিয়ে, নির্ভুল মানদণ্ডে তা যাচাই করা নাও হয়, তবু তা বরণ করতে হবে। বস্তুত এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন লোকদের মধ্যেই আজ ‘চিন্তা ও কর্মের নতুন পদ্ধতি রচনা’র আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ চিন্তা ও কর্মের নতুন পদ্ধতি কিভাবে রচিত হয়, কোন্ পদ্ধতিটি যুক্তিসম্মত আর কোনটি নিছক বালকসুলভ এই কথাটি পর্যন্ত তারা জানেনা। অনুরূপভাবে চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ হবার দাবিটাও এই শ্রেণীর স্থূলদৃষ্টিসম্পন্ন লোকদের একটা বৈশিষ্টে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তারা এতোটুকু অবহিত নয় যে, নিছক চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি একটা ফিতনা, বরং একটা ভয়ঙ্কর জিনিস। বিশেষত, তার সঙ্গে যদি প্রশস্ত ও পরিপক্ক জ্ঞান, প্রগাঢ় ও পরিণত দৃষ্টি এবং সুষম ও স্বচ্ছ চিন্তাশক্তির সমাবেশ না ঘটে, তবে তা গুরুতর আকার ধারণ করতে বাধ্য। আর এই জিনিসগুলো সম্পর্কে আজকাল যেরূপ ধারণা পোষণ করা হয়, প্রকৃতি ততোটা অকৃপণভাবে এগুলো দান করেনি।

প্রথমোক্ত মতবাদটি থেকে যে দ্বিতীয় মতটির সৃষ্টি হয়েছে, তাহলো এই যে, এখন আর ‘গায়েবের প্রতি ঈমানে’র যুগ নেই, বরং এটা হচ্ছে ‘অভিজ্ঞতা ও পর্যক্ষেণের প্রতি ঈমানে’র দিন। এই কথাগুলো দ্বারা বক্তা আসলে কি বুঝাতে চান, অনেক চিন্তা ভাবনার পরও তা আমার বোধগম্য হয়নি। একথার তাৎপর্য যদি এই হয় যে, বর্তমান যুগের গায়েব বা অদৃশ্য পদবাচ্য কোনো জিনিসকে স্বীকার করা এবং অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া কোনো বস্তুকে গ্রহণ করাই হয়না, তবে তা নিতান্তই ভুল। অন্যকথায় এর তাৎপর্য দাঁড়ায় এই যে, বর্তমান যুগের মানুষ এমন একটি সংকীর্ণ পরিধির মধ্যে সীমিত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যেখানে কেবল অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণই তাদের জন্যে জ্ঞানার্জনের উপায় হতে পারে এবং ইন্দ্রিয়নিচয়ই শুধু ক্রিয়াশীল থাকতে সক্ষম। এই পরিধির বহির্ভূত বিষয়গুলো সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করা এবং অনুমান অনুসন্ধান মারফত সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কাজ মানুষ পরিত্যাগ করেছে। কিন্তু যিনি ‘আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও নবতর আবিষ্ক্রিয়া’ সম্পর্কে মোটামুটি অধ্যয়নও করেছেন, এই ভাষণকে তিনি মোটেই স্বীকার করবেননা। দর্শন ও অতি প্রকৃতিবাদের কথা ছেড়েই দিন, কারণ এ দু’টির গোটা প্রতিপাদ্যই হচ্ছে অদৃশ্য বিষয়। খোদ জড় বিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার কথাই ধরুন, কারণ এর ওপর নির্ভর করেই সমালোচকপ্রবর ‘অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে’র প্রতি ঈমানের দোহাই পাড়ছেন। এই শাস্ত্রটির কোন বিভাগের গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান শক্তি, এনার্জি, প্রাকৃতিক বিধান, মৌলসূত্র, কার্যকারণ এবং এই ধরনের বিষয়াদির স্বীকৃতির ওপর নির্ভরশীল নয়? কোন পদার্থ বিজ্ঞানী এগুলোর প্রতি বিশ্বাস করেননা? কিন্তু আপনি কোনো জাঁদরেল বিজ্ঞানীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, এসবের মধ্যে কোনটির গুঢ় রহস্য তিনি জানেন? কোন্ বস্তুর কতোটুকু তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন? কোন্টির অস্তিত্ব তিনি প্রত্যক্ষ ও পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হয়েছেন এবং কোন্টির সপক্ষে তিনি যথার্থ প্রমাণ পেশ করতে পারেন? বস্তুত এসব কিছুকেই গায়েবের প্রতি ঈমান ছাড়া আর কি বলা চলে?

এ কথাগুলোর দ্বিতীয় অর্থ এই হতে পারে যে, বর্তমান যুগে কেবল এমন জিনিসই স্বীকৃত হয়ে থাকে, যা প্রতিটি মানুষের প্রত্যক্ষ করার উপযোগী এবং গোটা মানব সমাজই যা প্রত্যক্ষ ও পর্যবক্ষেণ করেছে। কিন্তু এ ধরনের কথা কোনো বুদ্ধিমান লোকের মুখ দিয়েই নিঃসৃত হতে পারেনা। কারণ, একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, কোনো মানুষই ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত মানবীয় জ্ঞানের অধিকারী নয়, বরং তার একটি বড় ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ দল ও ব্যক্তিদের বিশেষত্ব রয়েছে। এই বিশেষ জ্ঞান ভাণ্ডারের প্রতিটি বিভাগ কেবল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের কাছে প্রত্যক্ষ, আর বাকি সমস্ত মানুষের কাছে অদৃশ্য। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষকে ঐ বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও দলের প্রতিই গায়েবী ঈমান পোষণ করতে হয়।

বক্তব্যটির তৃতীয় অর্থ এ-ও হতে পারে যে, এযুগের মানুষ কেবল ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ বিষয়কেই স্বীকার করে এবং নিজের কাছে অদৃশ্য কোনো জিনিসকেই তারা বিশ্বাস করেনা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর চাইতে অবাস্তব কোনো কথাই মানুষের মগজ থেকে বের হতে পারেনা। কারণ এ ধরনের মানুষ পূর্বে কখনো দুনিয়ায় পাওয়া যায়নি, আজো পাওয়া যাবেনা এবং কিয়ামত অবধি পাওয়া যাবার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এমন লোক যদি বাস্তবিকই কোথাও থেকে থাকে তো তাকে খুঁজে বের করতে আদৌ কালবিলম্ব করা উচিত নয়। কারণ ‘সাম্প্রতিক আবিষ্ক্রিয়া’র মধ্যে এটিই হবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। ফলকথা, যে কোনো দিক থেকেই উক্তিটিকে বিচার করা যাক না কেন, এর ভেতর সত্যতার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবেনা। খোদ অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণই একথার সাক্ষ্য বহন করে যে বর্তমান যুগটিও অতীতের ন্যায়ই অদৃশ্যে বিশ্বাসী আর এই অদৃশ্যে বিশ্বাস থেকে মানুষ কখনো নিষ্কৃতি পেতে পারেনা। প্রতিটি মানুষ হাজারে ৯৯৯ টিরও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অদৃশ্যে বিশ্বাস পোষণ করতে বাধ্য। এখন সে যদি কেবল নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের উপরই ঈমান আনার সিদ্ধান্ত করে বসে তাহলে অন্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে যে বিপুল জ্ঞান ভাণ্ডার সে সঞ্চয় করেছিলো, তা সবই তাকে বিসর্জন দিতে হবে। নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া জ্ঞানার্জনের তামাম উপায় ও সূত্রই তাকে পরিত্যাগ করতে হবে। এমতাবস্থায় দুনিয়ার কোনো কাজ করা তো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্বই সে টিকিয়ে রাখতে পারবেনা। বস্তুত অদৃশ্যে বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ অস্বীকার এবং অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের প্রতি পুরোপুরি নির্ভরতা যেমন এযুগে সম্ভব নয়, তেমনি এর চাইতে উজ্জ্বলতর কোনো যুগেও তার সম্ভাবনা নেই। যে কোনো যুগে এবং যে কোনো অবস্থায় মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ ছাড়াই শুধু অন্যের প্রতি নির্ভর করে বহুতরো বিষয় মেনে নিতে বাধ্য। কতগুলো বিষয় শুধু প্রচলিত ধারণা হিসেবেই মানতে হয়, যেমন সেঁকোবিষ সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা এই যে, এটি খেলে মানুষ মরে যায়। অথচ এটি ব্যক্তিগতভাবে খেয়ে সবাই পরিক্ষা করে দেখেনি কিংবা কাউকে খেয়ে মরতেও দেখেনি। কতকগুলো বিষয় আবার এক বা একাধিক নির্ভরযোগ্য লোকের বর্ণনার ভিত্তিতেই মানতে হয়। যেমন আদালতের সাক্ষ্য বিশ্বাস না করলে আইনের যন্ত্রটি এক মুহূর্তের জন্যেও চলতে পারেনা। কতগুলো ক্ষেত্রে আবার নিছক একজন পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞের কথা বিশ্বাস করতে হয়। স্কুল কলেজের ছাত্রদের বেলায় তো এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক ব্যাপার। তারা যদি বিভিন্ন শাস্ত্রের পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের গবেষণা, আবিষ্কার ও মতাদর্শের প্রতি অন্ধভাবে বিশ্বাস পোষণ না করে, তবে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক কদমও সামনে এগোতে পারেনা। ফলে ঐ পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞদের ন্যায় জ্ঞান গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধানের মতো যোগ্যতাও তারা কখনো অর্জন করতে পারেনা।

এথেকে প্রমাণিত হলো যে, যেসকল ব্যাপারে আমরা অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের দ্বারা জ্ঞানার্জন করিনি, সেসব ক্ষেত্রে অন্য লোকের প্রতি অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন করতে আমরা বাধ্য। এখন কোন্ ব্যাপারে কার প্রতি অন্ধভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত কেবল এই প্রশ্নটিই বাকি থেকে যায় এবং এর ওপরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ নির্ভর করে। নীতিগতভাবে এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, যে ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি বা দলের ভালো জ্ঞান আছে এবং জ্ঞানার্জনের ভালো উপায়ও করায়ত্ত রয়েছে বলে আমাদের প্রতীতি জন্মাবে সে ব্যাপারে কেবল তার ওপরই বিশ্বাস পোষণ করা উচিত। এই সাধারণ রীতি অনুযায়ী একজন রুগী ডাক্তারের কাছে না গিয়ে আইনজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করেনা। মামলা-মোকাদ্দমার ব্যাপারে কেউ আইনজ্ঞ বাদ দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের শরণার্থী হয়না। কিন্তু ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মবাদের প্রশ্নেই কেবল এ-ব্যাপারে মতানৈক্য লক্ষ্য করা যায়। কেবল সেখানেই প্রশ্ন ওঠে এসব ব্যাপারে দার্শনিক ও যুক্তি-বিজ্ঞানীদের মতামত গ্রহণ করা হবে, কি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুদের কথা শোনা হবে? আল্লাহ্, ফিরিস্তা, ওহী, ইলহাম, আত্মা, পুনরুজ্জীবন এবং পারলৌকিক শাস্তি ও পুরস্কার ইত্যাকার গায়েবী বিষয়ে কি কান্ট, স্পেনসর, আইনেস্টাইন, বেগর্সন প্রমুখের কথা মানা হবে, না ইব্রাহীম আ., মূসা আ., ঈসা আ. ও মুহাম্মদ স. প্রমুখের বক্তব্য শোনা হবে। ‘চিন্তা ও বুদ্ধির স্বাধীনতা’র দাবিদারদের মানসিক ঝোঁক প্রথম দলের দিকে। এরা তাদেরই সংগৃহীত মানদণ্ডে নবীদের কথা যাচাই করে চলেছে এবং এই যাচাইয়ের ফলে যে বিষয়টি উত্তীর্ণ হচ্ছে, সেটিকেই তারা গ্রহণ করছে। সেটিকে তারা নবীদের কথা বলেই স্বীকৃতি দিচ্ছেনা; বরং দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা তার গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়েছেন বলেই স্বীকার করা হচ্ছে। (দুর্ভাগ্যক্রমে, এই ধরনের বিষয় নিতান্তই কম, বরং একেবারে নেই বললেই চলে) পক্ষান্তরে যে বিষয়টি এই মানদণ্ডে অনুত্তীর্ণ হয় সেটিকে তারা অনির্ভরযোগ্য বলে নাকচ করে দিচ্ছে। অপরদিকে ‘প্রাচীন পন্থী’ ও ‘গুরুবাদীদে’র বক্তব্য এই যে, প্রকৃতিবাদ ও যুক্তিবাদ সম্পর্কে ধর্মতাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মাবাদীদের কাছে প্রশ্ন করোনা, কিংবা ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মবাদের কথা যুক্তিবাদী প্রকৃতিবাদীর কাছে জিজ্ঞেস করোনা। কারণ উভয়ের কর্মক্ষেত্রই সম্পূর্ণ আলাদা বিধায় একটি শাস্ত্র সম্পর্কে অন্য শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞের মতামত জিজ্ঞেস করা মূলতই ভুল। দার্শনিক ও বিজ্ঞানী তাদের নিজ নিজ শাস্ত্রে যতোই পারদর্শী হননা কেন, ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মবাদে তাঁদের মর্যাদা একজন সাধারণ মানুষের চাইতে মোটেই বেশি নয়। কারণ এ সম্পর্কে জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহের যেটুকু উপায় তাদের করায়ত্ত, একজন সাধারণ লোকেরও ততোটুকু উপায়ই করায়ত্ত। প্রকৃতপক্ষে এ শাস্ত্রটি শুধু নবীদের জন্যেই নির্দিষ্ট। তারাই এ শাস্ত্রের বিশেষজ্ঞ। এ সম্পর্কিত জ্ঞান ও তথ্য সংগ্রহের প্রকৃত উপায়ও তাঁদেরই করায়ত্ত। কাজেই এসব ব্যাপারে তাঁদের প্রতিই ‘অদৃশ্য বিশ্বাস’ পোষণ করা উচিত। এব্যাপারে বড়জোর এইটুকু প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকতে পারে যে, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সত্যবাদী এবং ধর্মতত্ত্বে পূর্ণাঙ্গ দূরদৃষ্টির অধিকারী কিনা? কিন্তু যখনি এটা প্রমাণ হয়ে যাবে যে, তাঁরা বাস্তবিকই এ ব্যাপারে যোগ্যতার অধিকারী, তখন স্বকীয় দূরদৃষ্টি ও জ্ঞানানুযায়ী তারা যা কিছু করেছেন, তা সবই আপনাকে সত্য বলে মানতে হবে। তাঁদের প্রচারিত সত্যকে অস্বীকার এবং তার বিরুদ্ধে যুক্তি প্রমাণ উত্থাপন করা আর অন্ধ কর্তৃক সূর্যের অস্তিত্ব অস্বীকার এবং চক্ষুষ্মান ব্যক্তিকে বিভ্রান্ত করার জন্যে সূর্যের অস্তিত্ব বিরোধী দলিলপত্র পেশ করা একই কথা। এই ধরনের লোক নিজস্ব ধারণায় যতোবড় দার্শনিকই হোক না কেন, কিন্তু যে ব্যক্তি নিজ চোখে সূর্যকে প্রত্যক্ষ করছে, সে-যে এই অন্ধ সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করবে, তা বলাই নিষ্প্রয়োজন।

সমালোচক হয়তো বলবেন, নবীগণ অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন, ‘আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান’ ও ‘সাম্প্রতিক আবিষ্কার উদ্ভাবনী’ দ্বারা তা সমর্থিত হয়না। এ কারণেই লোকেরা ‘সন্দেহ ও দ্বৈধবোধে’ নিক্ষিপ্ত হয়ে ‘দায়ে ঠেকে মুসলমান সাজা’র অভিশাপ ভোগ করছে। কিন্তু আমি বলবো, এসব জ্ঞান বিজ্ঞান ও আবিষ্ক্রিয়ার মধ্যেই বা এমন কোন্ নিশ্চয়তাটা রয়েছে, যা ইসলামী নীতির পরিপন্থী? এমন কোনো বিষয় থাকলে তার উল্লেখ করুন যাতে করে আমরাও ভেবে দেখতে পারি যে, কুরআন শরীফ এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারাদি, এর মধ্যে কোনটি আমরা মেনে চলবো! যদি তা না থাকে আর তা কিছুতেই থাকতে পারেনা, যেমন আপনার উক্তি ‘সন্দেহ ও দ্বৈধবোধ’ ‘দায়ে ঠেকে মুসলমান সাজা’ ইত্যাদি থেকেও প্রমাণিত হয় তবে কি আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাম্প্রতিক আবিষ্কার উদ্ভাবনীর অস্ত্রাগারে কেবল ধারণা কল্পনা ও আন্দাজ অনুমানের অস্ত্রই মওজুদ রয়েছে, যার ওপর ভরসা করে ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা হচ্ছে? এবং সে অস্ত্রের ধারণা দেখে শুধু চাকচিক্য দেখেই ‘স্বাধীন চিন্তাধারা’র উপাসকরা এই আশা পোষণ করছেন যে, ধর্ম তার নাম শুনেই ময়দান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে? আপনি ঐ জ্ঞান বিজ্ঞান ও আবিষ্কারাদিকে যতোই গুরুত্ব দিন না কেন, কিন্তু মনে রাখবেন, অদৃশ্য বিষয়াদির ব্যাপারে তা মোটেই নিশ্চয়ক বস্তু নয়। তার প্রভাবে বড়জোর আপনি নিজে ‘সন্দেহ ও দ্বৈধবোধে’ নিক্ষিপ্ত হতে পারেন এবং বলতে পারেন যে, ওহী, ইলহাম, পূনরুজ্জীবন, পারলৌকিক শাস্তি ও পুরস্কার, ফিরিশতাদের অস্তিত্ব এমনকি আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেও আমরা ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারিনা। কিন্তু আপনাকে ‘দায়ে ঠেকে মুসলমান সাজা’র অভিশাপ থেকে মুক্তি কিংবা ‘সানন্দে কাফির সাজা’র আশির্বাদ লাভ করবার ব্যাপারে এসব জ্ঞান বিজ্ঞানের পক্ষে কিছু মাত্র সাহায্য করা সম্ভবপর নয়। কারণ উল্লেখিত বিষয়াদিকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকার করার মতো কোনো যুক্তি প্রমাণ এসকল জ্ঞান বিজ্ঞানে উপস্থিত থাকতে পারেনা। তাছাড়া কোনো জিনিসের অনস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যে শুধু এটুকু যুক্তিই যথেষ্ট নয় যে, তার অস্তিত্বের পক্ষে কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, ‘আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান ও ‘সাম্প্রতিক আবিষ্কারাদি’ আপনাকে শুধু ‘সন্দেহ ও দ্বৈধবোধে’র চরম পর্যায়ে নিয়েই পৌছিয়ে দিচ্ছে আর মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক দিয়ে এ হচ্ছে একটি নিকৃষ্টতম স্থান। বস্তুত যে জ্ঞান বিজ্ঞান মানুষকে নিশ্চয়তা, নিশ্চিন্ততা ও প্রত্যয়শীলতা দান করতে পারেনা, যা তাকে শূন্যে দোদুল্যমান অবস্থায় নিক্ষেপ করে এবং কোথাও এতোটুকু স্থিরতা লাভের অবকাশ দেয়না, যা তাকে ‘কাফির হয়োনা, দায়ে ঠেকে মুসলমান হও’ এর মতো ন্যাক্কারজনক অবস্থায় ফেলে দেয়, তা নিঃসন্দেহে অজ্ঞতার চাইতেও নিকৃষ্টতর।

এই সংস্কটাবস্থা থেকে একমাত্র ‘ঈমান বিল্ গায়েব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাসই মানুষকে রক্ষা করতে পারে। একবার যদি আপনি কাউকে নবী বলে মেনে নেন এবং সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করেন যে, খোদায়ী জ্ঞানশাস্ত্রে তিনি পুরোপুরি ব্যুৎপত্তির অধিকারী এবং তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেননা, তবে আর অদৃশ্য বিষয়াদির ব্যাপারে আপনার মনে কোনো সন্দেহ ও দ্বৈধবোধের অবকাশ থাকতে পারেনা। এর ফলে আপনার ধর্মমত বিশ্বাস ও প্রত্যয় এমন এক মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় যা কোনো আধুনিক জ্ঞান বা নবাবিষ্কার, চিন্তা ও কর্মের নতুন ধারা এবং ‘মুক্তবুদ্ধির’ কোনো প্রবল প্রতাপে আহত হয়না। এই কারণেই কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে, এই কিতাব হচ্ছে মুত্তাকী লোকদের পথপ্রদর্শক। আর মুত্তাকী লোকদের প্রথম পরিচয় হচ্ছে এই যে, তারা অদৃশ্যবিষয়ে ঈমান পোষণ করে:

 

هُدًى لِلْمُتَّقِينَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ . (البقرة)

অর্থ: এই কুরআন মুত্তাকীদের পথ প্রদর্শক, যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে।’

 

বস্তুত ‘ঈমান বিল গায়েব’ বা অদৃশ্যে বিশ্বাসের ওপরই ধর্মের গোটা ঈমারত প্রতিষ্ঠিত। কাজেই এই মূলভিত্তিকে একবার চুরমার করে ফেললে তারপর ধর্মের এসব বুনিয়াদী মতবিশ্বাস সম্পর্কে যে গুলোর নিগুঢ় রহস্য জানার কোনো উপায়ই আপনার কাছে নেই কোনো স্থির সিদ্ধান্তে আপনি পৌছতে পারেননা। এমতাবস্থায় যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, তার যথার্থতা সম্পর্কে আপনার নিজেরই পুরোপুরি আস্থা হবেনা এবং তার সত্যতা সম্পর্কে অন্য লোককেও আপনি আস্থাবান করতে পারবেননা। এ ব্যাপারে সর্বশেষ প্রশ্ন হলো, এক ব্যক্তি আল্লাহর নবী এবং তিনি ধর্মতত্ত্বে পুরোপুরি বি্যুৎপত্তির অধিকারী এটা জানবার উপায় কী? তিনি এতোবড় সত্যবাদী যে, তিনি অদৃশ্য বিষয়ে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধির সীমাবহির্ভূত কথা বললেও আমরা তাঁর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করবো এবং তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেননা, একথা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করবো এটাই বা বুঝবো কি করে? এই প্রশ্নটির মীমাংসা দু’টি জিনিসের উপর নির্ভরশীল। প্রথম, তাঁর ব্যক্তি চরিত্র আমাদের সকল সম্ভাব্য পন্থায় এবং কঠোরতর মানদন্ডে যাচাই করে দেখতে হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁর পেশকৃত বিষয়াদির মধ্যে যেগুলো আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি ও বিচারশক্তির অন্তর্ভুক্ত, সেগুলোকে পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এই উভয় পরীক্ষায় যদি কেউ অনুপম সত্যবাদী বলে প্রমাণিত হন এবং সেই সঙ্গে মানব জীবনের চিন্তা ও কর্মের সকল দিক ও বিভাগের জন্যে প্রদত্ত তাঁর বিচক্ষণ ও কল্যাণকর ব্যবস্থার মধ্যে কোনো ত্রুটি নির্দেশ করতে সক্ষম না হয়, তবে তাকে সত্যবাদী বলে স্বীকার না করার কোনোই হেতু নেই। আর তিনি খোঁজ খবর ও জানা শোনা ছাড়াই নিছক দুনিয়াবাসীকে ধোকা দেয়ার জন্যেই আল্লাহ্, ফেরেশতা, আরশ, কুরসী, ওহী, ইলহাম, পুনরুত্থান, বেহশত ও দোযখ ইত্যাদির একটা বিরাট ষড়যন্ত্র পাকিয়েছেন (আল্লাহ মাফ করুন) বলে সন্দেহ পোষণ করারও কোনো যৌক্তিকতা নেই।

কাজেই জনাব নিয়াজের তৃতীয় ভ্রান্তি হচ্ছে এই যে, তিনি কুরআনের প্রথম অংশকে (আমরা যাকে দ্বিতীয় অংশ বলে উল্লেখ করেছি) আলোচনার যোগ্যই মনে করেননা, বরঞ্চ তিনি এই ধারণা পোষণ করেন যে, ‘এ ব্যাপারে সমস্ত ধর্মই প্রায় একরকম এবং ইসলামের শিক্ষা অন্যান্য ধর্ম থেকে ভিন্ন বা নিকৃষ্টতর নয়। পক্ষান্তরে আমাদের বক্তব্য হলো, তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী কুরআনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় অংশের (কিংবা আমাদের বিশ্লেষণ অনুসারে প্রথম অংশের) সত্যতা নির্ণয় করতে হলে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন চরিত্র এবং কুরআনের অদৃশ্য বহির্ভূত বিষয়াদির পর্যালোচনা করা আমাদের জন্যে অপরিহার্য। পরন্তু ইসলামী শিক্ষার এই অংশটি ‘অন্যান্য ধর্ম থেকে ভিন্ন বা নিকৃষ্টতর নয়’ কেবল এটুকু ধারণা নিয়ে তুষ্ট থাকলেই চলবেনা; বরং সেটি তামাম অনিসলামী ধর্মের চাইতে উন্নত এবং উৎকৃষ্ট, যুক্তি প্রমাণ দ্বারা এটাও প্রতিপন্ন করা আবশ্যক। কাজেই আলোচনার এই বিষয়টি সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে অন্য বিষয়ের অবতারণা করা নীতিগতভাবেই ভুল। তাছাড়া এ বিষয়টির মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত অন্যান্য বিষয়ের মীমাংসা করাও সম্ভবপর নয়।

জনাব নিয়াজের ইচ্ছা হলো, আমরা যেনো ‘পরকাল’, ‘কালামে ইলাহী’ এবং আকাইদ ও ইতিহাস সংক্রান্ত আয়াতগুলোর বিচার বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হই। কিন্তু আমাদের মতে, এই আলোচনার দু’টি দিক রয়েছে এবং তা দু’টি ভিন্ন দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রথম দলটি হলো তারা, যারা রসূলে আকরাম স.-এর নবুয়্যতের প্রতিই ঈমান পোষণ করেনা এবং এই কারণেই তারা উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সন্দেহ পরায়ণ। দ্বিতীয় দলটি হলো, যারা তাঁর নবুয়‍্যাতকে স্বীকার করে, কিন্তু অদৃশ্য বিষয়াদির ব্যাপারে সন্দিগ্ধচিত্ত। এই দু’টি দলের সঙ্গে আলাপ আলোচনার পদ্ধতিও ভিন্ন। কাজেই আপত্তিকারী এর কোন দলের অন্তর্ভুক্ত, তা না জানা পর্যন্ত আমরা তাঁর সঙ্গে আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে পারিনা।

প্রথম দলটির সঙ্গে পরকাল, কালামে ইলাহী এবং অন্যান্য অদৃশ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা একেবারেই অর্থহীন। কারণ মূল বিষয়ে মতানৈক্য রেখে খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। আমরা পরকাল, কালামে ইলাহী, এমনকি আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণরাজি সম্পর্কেও যে বিষয়গুলোর প্রতি ঈমান ও প্রত্যয় পোষণ করি, তার ভিত্তি এই নয় যে, আমাদের নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধিৎসা কিংবা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের দ্বারা আমরা কোনো চূড়ান্ত ও নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করতে পেরেছি এবং তার বিরুদ্ধে আর কোনো যুক্তি প্রমাণ উত্থাপন করা যেতে পারেনা। এমনটি যদি হতো, তো নিসন্দেহে নবুয়্যত সংক্রান্ত আলোচনা করা যেতো। কিন্তু এই বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের অটল অনড় ঈমান প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বাসের ওপর গড়ে উঠেছে যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম সত্যবাদী। তিনি আপন নবুয়্যত এবং কালামে ইলাহী সম্পর্কে যাকিছু বিবৃত করেছেন, তা সবই অভ্রান্ত। এই মৌলিক কারণেই মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু, আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অবিশ্বাসী ব্যক্তির সাথে এই বুনিয়াদী প্রশ্নটিকে স্বীকার না করা পর্যন্ত কোনো খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করতে আমরা সম্মত নই।

দ্বিতীয় দলটির এই অধিকার আমরা স্বীকার করিনা যে, তারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতাও স্বীকার করবে আবার অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে কুরআন মজীদ এবং মুহাম্মদ স.-এর বর্ণনার সত্যাসত্য সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করবে। কারণ এরূপ ভূমিকা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তারা প্রথম দলটির সামিল হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে তাদের দ্বিতীয় দলে শামিল থাকতে হলে এ সত্য স্বীকার করতে হবে যে, কুরআনের প্রতিটি শব্দ অভ্রান্ত এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকিছু পেশ করেছেন তা সম্পূর্ণ ভ্রান্তিমুক্ত। অবশ্য এ ব্যাপারে সে দু’টি দিক থেকে প্রশ্ন তুলতে পারে। প্রথম এই যে, কুরআন শরীফে বাস্তবিকই এ ধরনের বিষয় বর্ণিত হয়েছে কিনা? আর রসূলের করীম স. সত্যসত্যই এরূপ কথা বলেছেন কিনা। দ্বিতীয়ত, কুরআন সুন্নায় এ সম্পর্কে যাকিছু রয়েছে, তার সঠিক অর্থ এবং মর্ম কি হতে পারে?

পরিশেষে আমার আর একটি কথা বলতে হচ্ছে। জনাব নিয়াজ ‘তর্জমানুল কুরআনে’ একটি বিতর্ক বিভাগ খোলার অনুরোধ জানিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি এই অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছেন যে, তাঁর যাবতীয় শোবা সন্দেহ এবং প্রশ্ন ও আপত্তি তিনি উক্ত বিভাগে পেশ করবেন। কিন্তু পেশাদারি বিতর্ক ও বাদানুবাদ থেকে আমি হামেশাই আত্মরক্ষা করে এসেছি এবং এখনো রক্ষা করতে ইচ্ছুক। কারণ যে বিতর্কের উদ্দেশ্য গুরু মস্তিষ্কের ব্যায়াম আর বুদ্ধির কসরৎ দেখিয়ে বাহবা কুড়ানো তেমন বিতর্কের আমি আদৌ পক্ষপাতী নই। তবে জ্ঞানগর্ভ ও তত্ত্বপূর্ণ আলোচনার জন্যে আমি সর্বদাই প্রস্তুত, যদি সে আলোচনার উদ্দেশ্য হয় সত্যানুসন্ধান এবং তাতে উভয়পক্ষ এমনি আন্তরিকতা নিয়ে অংশগ্রহণ করেন যে, আসল সত্য প্রমাণিত হবার পর প্রত্যেকে তা স্বীকার করে নেবেন। এই হিসেবে ‘নিগার’ পত্রিকায় যেসব শোবা সন্দেহ ও আপত্তি প্রকাশিত হবে, তর্জমানুল কুরআনে তা পুনরুল্লেখ করা হবে এবং সেই সঙ্গে তার জবাবও দেয়া হবে। অনুরূপভাবে ‘তরজুমানুল কুরআনে’র জবাব সম্পর্কে জনাব নিয়াজ কোনো মন্তব্য করলে মূল জবাবটিও তার সঙ্গে উল্লেখ করবেন বলে আশা করি, যাতে করে উভয় পত্রিকার পাঠকবর্গ আলোচনার উভয় দিক সম্পর্কে অবহিত এবং সেই সম্পর্কে নিজেরাও কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। পক্ষান্তরে কেবল একটি দিক উল্লেখ করা এবং অন্যদিক এড়িয়ে যাওয়াকে আপন দুর্বলতার স্বীকৃতি বলেই আমি মনে করি।

২৮৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

আবুল আ'লা মওদুদী (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ – ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯), যিনি মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ তাকে "আধুনিক ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাবিদ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মওদুদী কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস, আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন। তার লেখাগুলো মূলত উর্দুতে । পরে তার লেখাগুলো ইংরেজী, আরবি, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, বর্মি, মালায়ালাম এবং অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তিনি মুসলিম মিল্লাতের কাছে ইসলামের আসল রুপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দ্বীনী জ্ঞান নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, এ ব্যাপারে মাওলানা মওদুদী বলেন, "আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। অতএব খোদার দ্বীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবি করে, এ কথা জানার জন্যে আমি দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।" তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের রাজনীতির জন্য ইসলাম অপরিহার্য। শরিয়া এবং ইসলামী সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন খিলাফতে রাশিদুনের শাসনের মতো এবং অনৈতিকতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে দেখতেন। তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি এশিয়ার তৎকালীন বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী-র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর আলোচিত ও একইসাথে বিতর্কিত মুসলিম আলেমদের মধ্যে একজন। ইসলাম ধর্মে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯৭৯ সালে কিং ফয়সাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারটি প্রদান করা হয়।
Picture of সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

আবুল আ'লা মওদুদী (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ – ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯), যিনি মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ তাকে "আধুনিক ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাবিদ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মওদুদী কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস, আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন। তার লেখাগুলো মূলত উর্দুতে । পরে তার লেখাগুলো ইংরেজী, আরবি, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, বর্মি, মালায়ালাম এবং অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তিনি মুসলিম মিল্লাতের কাছে ইসলামের আসল রুপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দ্বীনী জ্ঞান নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, এ ব্যাপারে মাওলানা মওদুদী বলেন, "আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। অতএব খোদার দ্বীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবি করে, এ কথা জানার জন্যে আমি দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।" তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের রাজনীতির জন্য ইসলাম অপরিহার্য। শরিয়া এবং ইসলামী সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন খিলাফতে রাশিদুনের শাসনের মতো এবং অনৈতিকতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে দেখতেন। তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি এশিয়ার তৎকালীন বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী-র প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর আলোচিত ও একইসাথে বিতর্কিত মুসলিম আলেমদের মধ্যে একজন। ইসলাম ধর্মে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯৭৯ সালে কিং ফয়সাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারটি প্রদান করা হয়।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top