জানালা- বাইরের কোলাহল ও অন্দরমহলের নৈঃশব্দের এক অনন্য মেলবন্ধনের সুর। যে সুরের কাব্যিক প্রহেলিকায় রচিত হয় প্রাত্যহিক জীবনের বিচিত্র চিত্রপট। প্রতিটি খাঁজ, প্রতিটি খোদাই ,কারুকাজ এবং প্রতিটি ফ্রেম এক একটি স্থাপনার সময়ের দলিল হিসেবে আভিজাত্য আর ঐতিহ্যের কথা বলে। যেন এক একটি ক্যানভাসরুপে হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে রয়ে যায়।
এক্ষেত্রে উপমহাদেশের স্থাপত্যে, শিল্পের অনবদ্য ছাপ জানালাগুলোতে যেন আরও বিস্তৃত বিশেষণ দেয়; স্থাপত্যের বিশেষ অংশ হিসেবেই নয় বরং প্রকৃতি ও মানুষের অমলিন মেলবন্ধনের শ্বাশত আবহের প্রতীকরুপে। কেবল আলো-বাতাস চলাচলের জন্যই জানালাগুলো তৈরি করা হত না বরং একদিকে বাইরের পৃথিবীকে ফ্রেম করতো অন্য দিকে অভ্যন্তরের মানুষের সুরক্ষা্য় সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা দিত। বৈরী আবহাওয়ায় বা বৃষ্টির স্নিগ্ধতায়, কখনো বা রাতের নীরবতা উপেক্ষায় জানালার ওপারেই যেন মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ ও প্রশান্তির আশ্রয়। অর্থাৎ জানালাগুলোর কাঠামো এমনভাবেই তৈরি করা হত প্রতিকূলতায়ও আশ্রয় নেয়াই ছিলো সর্বোচ্চ নিরাপত্তা।
তাপ নিয়ন্ত্রণেও একাধিক স্তরের জানালার জালি কিংবা রঙিন কাচ, সূর্যালোক ছেকে নিয়ে অন্দরমহলে মৃদু আলো্য় এক বিশেষ আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি করতো যেখানে আলোর পরোক্ষ প্রবেশে অভ্যন্তরের অনুভব যেন তীব্র সুর্যালোকের মনোমুগ্ধকর আভায় স্নিগ্ধ বহিঃ প্রকাশ। অপরদিকে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতেও জানালার একাধিক স্তরে জালির ভূমিকা বিশেষ।
এছাড়াও জানালার আদলে আধ্যাত্মিক অভিব্যক্তির ছাপ ছিলো স্পষ্ট। সমাজের একেকটি গল্পের একেক বাহকরুপে দৃশ্যমান হলেও প্রতিটি জানালায় শৈল্পিক দক্ষতার স্পর্শে পবিত্রতার এবং নান্দনিকতার মেলবন্ধনে এক গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলিত রুপ বিদ্যমান। বৈচিত্রময় নকশা ,কারুকাজ একদিকে সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের সৃজনশীলতাকে প্রকাশ করে এবং অন্যদিকে তাদের জীবনধারার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। দেখা যায় জানালার এসব বৈচিত্র্যময় বিকাশ ও নান্দনিকতার মাধ্যমে মুলত স্রষ্টার একত্বের প্রকাশই মুখ্য বিষয়।
উপমহাদেশে ইসলাম আগমনের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপত্য যে নতুন এক মাত্রা পেয়েছিল তা মূলত প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক সংলাপ। আর এই প্রেক্ষিতে জানালার ভাষা নানান কণ্ঠে রূপ পেল—কখনো পাথরের জালি, কখনো কাঠের ঝারোখা, কখনো বা পোড়ামাটির অলংকরণে।
- জালি কাজ: ১২শ শতকের শেষভাগে ভারতীয় উপমহাদেশের স্থাপত্যে এক অভিনব অভিযোজন ‘জানালায় জালি কাজ’। প্রথম দেখা মেলে দিল্লির কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদের স্থাপত্যে। পাথর বা কাঠের উপর সূক্ষ্ম খোদাইয়ের মাধ্যমে এ ধরনের জালি তৈরি করা হত। জালির সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে জানালাগুলোর নকশায় জটিল জ্যামিতি, আরবী ক্যালিগ্রাফি এবং নিখুঁত এরাবেস্ক নকশা করা হতো। এসব কৌশল অবলম্বনে বাইরের পরিবেশ থেকে যেমন অভ্যন্তরভাগের পর্দা (হায়া) রক্ষা করা হত, তেমনি আলো ও বাতাসের পরোক্ষ প্রবাহের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শীতলতাও বজায় থাকতো।

- আরকুয়েট স্টাইল: উপমহাদেশে ১৩১১ সালে আলাই দরওয়াজায় প্রথম আরকুয়েট জানালার ব্যবহার শুরু হয়। বৃহৎ পরিসরে আলো-বাতাস প্রবেশের জন্যই ইসলামিক স্থাপত্যে ‘খিলানযুক্ত জানালা’ একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে গড়ে উঠেছে। এছাড়াও পূর্বের ট্র্যাবেটেড (আনুভূমিক বীম আর আড়াআড়ি খুঁটির সমন্বয়ে গঠিত) পদ্ধতির বিপরীতে ভূসুয়া খিলান (স্থায়িত্বশীল) পদ্ধতির কাঠামো আবিষ্কার হয় যা উপমহাদেশীয় ইমারতের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও উচ্চতর নির্মাণশৈলীর বাহক। খিলান কখনও হয় অর্ধবৃত্ত, কখনও ওজাইভ (উপরের দিক উপবৃত্তাকার শীর্ষযুক্ত; pointed arc), আবার কখনও সূক্ষ্ম সর্পিলকৃতির—যেন জানালার জালি ও খিলানের জ্যামিতিক নকশার পরিমিত বিন্যাসের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া এক অভিন্ন ব্যাকরণ। আলাই দরওয়াজায় ছাড়াও হুমায়ুনের সমাধি, জামে মসজিদ, আকবরের মকবরা, ফতেহপুর সিক্রি এবং তাজমহল—সবখানেই আরকুয়েট জানালা; এমনকি বাংলার আটচালা ও দোচালা গঠনেও খিলানবিশিষ্ট জানালার সংযোজন দেখা যায়।

- জ্যামিতিক নকশা: জানালার অলংকরণে জ্যামিতির বিন্যাস উপমহাদেশের স্থাপত্যশৈলীর এক অভিনব উৎকর্ষতা। জটিল জ্যামিতি ও এরাবেস্ক নকশা স্থাপত্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির সাথে আধ্যাত্মিকতারও প্রতিফলন ঘটায়। শুধু তাই নয় উপমহাদেশের ইসলামি স্থাপত্যে জ্যামিতি স্থানীয় উপকরণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন এক ভাষা তৈরি করে যেখানে পাথর বা কাঠের জালি কেটে জ্যামিতিক প্যাটার্ন তৈরি করা হত। আগ্রার তাজমহল, দিল্লির হুমায়ুনের সমাধি, লাহোর দুর্গ—এখানে পাথরের জালির মাধ্যমে বহুমাত্রিক জ্যামিতিক প্যাটার্ন ব্যবহৃত হয়েছে। বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, সোনারগাঁওয়ের গোয়ালদি মসজিদ— এখানে ইট ও পোড়ামাটির ফলকে জ্যামিতিক অলংকরণ করা হয়েছে।

- রঙিন কাঁচের ব্যবহার: উপমহাদেশের স্থাপত্যে রঙিন কাচের ব্যবহার স্থাপত্যশৈলীতে যেমন নতুন মাত্রা যোগ করেছে তেমনি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম উপাদান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রঙিন কাঁচের ব্যবহার মোঘল স্থাপত্যের মাধ্যমে শুরু হলেও কেবল মোঘল স্থাপত্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; খুব দ্রুত অন্যান্য স্থাপত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে। জানালার কাচ ও কাঠের কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা হত যেন সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে অভ্যন্তরে প্রশান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও রঙিন কাঁচের মাধ্যমে আলোর নান্দনিক প্রতিফলন অন্দরমহলে বিশেষ আবহ তৈরি হয় যার কারণে এর ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সুলতান আকবরের শাসনামলে ফতেহপুর সিক্রিতে, সুলতান শাহজাহানের আমলে তাজমহলে রঙিন কাঁচের ব্যবহার দেখা যায় এবং পরবর্তীতে দিল্লির অন্যান্য মোঘল স্থাপত্যে ব্যবহারের মাধ্যমে আরও বিস্তৃতি পায়।

- ঝারোখা জানালা: ভারতীয় উপমহাদেশের স্থাপত্যের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ঝারোখা জানালা; কাঠামোগতভাবে ওরিয়েল জানালা যা ভবনের উপরিভাগ থেকে প্রসারিত হয় এবং বাইরের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে সম্মুখভাগে উন্মুক্ত হয়। ১৬শ-১৮শ শতাব্দীতে,রাজপুত এবং মোঘল স্থাপত্যের প্রভাবে, এগুলি স্থাপত্যের ট্রেডমার্ক হয়ে ওঠে। কেননা এ জানালাগুলোকে ধরা হত ইমারাহ-র চূড়ান্ত প্রকাশরুপ—যেখানে আমির ও উম্মাহর মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠত সম্মান, নিকটতা ও তাকরিমের ভিত্তিতে অর্থাৎ সমাজে রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় অর্থে এক প্রতীকী কাঠামো। আর সাধারণ মানুষের জন্য বাইরের জগৎ অবলোকনের স্বাধীনতা, বিশেষত নারীদের জন্য মর্যাদা ও গোপনীয়তার নিখুঁত সমন্বয়। ঝারোখার জালি-কাজ, পাথরখোদাই ও অলঙ্করণ কেবল প্রাসাদ নয়, নগরীর অলিগলির দৃশ্যপটকেও শিল্পমণ্ডিত করত। রঙিন কাঁচ, খচিত পাথর ও খোদাইকৃত কাঠের ফ্রেম—সব মিলিয়ে যেন এক ছায়াময় সংগীত।


সময়ের বিবর্তনে সাধারণত এসব জানালার জালি কাজ, আরকুয়েট স্টাইল, জ্যামিতিক নকশা এবং রঙিন কাঁচের ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; একইসাথে ব্যবহারের সুবিধার্থেও আজও প্রাসঙ্গিক।নিচে উপমহাদেশের স্থাপত্যে জানালার বৈচিত্র্য ও বিবর্তন ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হলো। এখানে প্রাক সুলতানি আমল থেকে শুরু করে দিল্লি সালতানাত, তুঘলক, লোদী ও মোঘল আমল, এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত জানালার শিল্পরূপ ও ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্যের ক্রমবিকাশ তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষত জানালার নান্দনিকতা, কার্যকারিতা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাবের প্রতিফলনও ধাপে ধাপে লক্ষ্যণীয়।
কুতুব মিনার (Qutub Minar, Delhi)
১২শ শতকের শেষভাগে তুর্কি বিজয়ের পর নির্মিত দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্সের জানালায় জালির (তারকা আকৃতির জালি) প্রথম সূচনার দেখা মেলে—যেখানে সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা পাথর-নকশার মাধ্যমে আলো ও বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়। যা ইসলামী ‘হায়া’ বা সংযমের চেতনাকে প্রতিফলিত করে।

আড়াই দিন কা ঝোঁপড়া (১২০০ খ্রি., আজমীর, রাজস্থান)
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের প্রারম্ভিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। এখানে পাথরে খোদাইকৃত জালি (lattice window) ব্যবহার লক্ষ্যণীয়; পাথরে ছোট ছোট ছিদ্রকাটা জালি জানালা, যা সূক্ষ্ম জ্যামিতিক ও ফুলেল নকশায় অলঙ্কৃত এবং পরবর্তীতে খিলজী, তুঘলক ও মোঘল আমলে আরও সূক্ষ্ম রূপ নেয়।

গিয়াসউদ্দিন বলবনের মাকবারা (১২৮৭ খ্রি., দিল্লি, মেহরৌলি)
গিয়াসউদ্দিন বলবনের মাকবারা ভারতীয় স্থাপত্যের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এখানে প্রথমবারের মতো Pointed Arch ( ওজাইভ; Ogive) খিলান ব্যবহৃত হয়, যা ভারতীয় উপমহাদেশে পরবর্তী স্থাপত্য বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করে। উপমহাদেশে আরকুয়েট শৈলীর (arcuate style) সূচনার আগে দিল্লির সুলতানি স্থাপত্যে মূলত ট্রাবেটেড শৈলী (Trabeated) প্রচলিত ছিল। খিলানগুলোর মধ্যে জালি (perforated screen) সংযুক্ত করা হয়েছিল আলো ও বায়ু চলাচলের জন্য।

আলাই দরওয়াজা (১৩১১ খ্রি.)
সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর নির্মিত একটি গেটওয়ে, যেখানে প্রথমবারের মতো True Arch ও গম্বুজ ব্যবহার হয়। জানালায় সূক্ষ্ম জালি ও pointed arch-এর ব্যবহার নিছক দৃষ্টিনন্দনতার জন্য নয়; বরং সূর্যালোক প্রবাহকে নিয়ন্ত্রিত করে অভ্যন্তরীণ শীতলতা বজায় রাখাই উদ্দেশ্যে।

খিরকী মসজিদ (১৩৫১-৫৪)
মসজিদটি ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে জুনা শাহ (ফিরোজ শাহ তুঘলকের একজন প্রধানমন্ত্রী) নির্মাণ করেন। মসজিদের দেয়ালে রয়েছে বহু জালি-জানালা (খিরকী) বা lattice window। এখান থেকেই নাম হয় “খিরকী মসজিদ”।

বড় গম্বুজ মসজিদ
সুলতান সিকান্দার লোদীর আমলে (প্রায় ১৪৯০ খ্রি.) নির্মিত। জানালাগুলো মূলত তীক্ষ্ণ খিলানাকৃতির এবং মোটা পাথরের দেয়ালে বসানো, যা প্রতিরক্ষামূলক কাঠামোর ধারণা দেয়। মোঘল আমলের মতো সূক্ষ্ম ফুলেল খোদাই নেই বরং লোদী স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সরল ও দৃঢ়।

হুমায়ুনের সমাধি (Humayun’s Tomb)
দিল্লির হুমায়ুনের সমাধি স্থাপত্যে ব্যবহৃত জানালার আকৃতি অনেক সময় অর্ধবৃত্তাকার বা ঘোড়ার নাল আকৃতির হয়। ফলে খিলান যেমন কাঠামোতে দৃঢ়তা দেয় একইসাথে জ্যামিতিক অলংকরণ, তারকা, ষড়ভুজ ও আরবেস্ক শৈলীর পুনরাবৃত্ত মোটিফের জালি জানালা আলো ছেঁকে অভ্যন্তরে শীতল বাতাস প্রবাহিত করে। যা দিল্লির আবহাওয়ার জন্য কার্যকর সমাধান।

সমাধি স্থাপত্যে আরও এক ধরণের জানালার ব্যবহার দেখা যায়। লাল বেলেপাথর (red sandstone), সাদা ও কালো মার্বেল (white & black marble) দিয়ে এই ধরণের জানালা ও খিলান নির্মিত এবং সূক্ষ্ম খোদাইকৃত জালি জানালা সমাধির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও জানালায় ছোট বারান্দা (jharokha-style) যুক্ত, যেগুলো সমাধির বাইরের দেয়ালে বের হয়ে এসেছে।

নিচের জানালাটি বার্বারের টুম্ব বা নায়ি-কা-গুম্বাদ (Nai-ka-Gumbad) এর, যেটি দিল্লির হুমায়ুনের সমাধি কমপ্লেক্সের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ১৫৯০–৯১ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। এর স্থাপত্য শৈলী মোঘল স্থাপত্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি উদাহরণ যেখানে লাল এবং সাদা বেলে পাথরের (Sandstone) সমন্বিত ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সরাসরি বা ভারী প্রলেপহীন বেলে পাথরের ব্যবহার , পাথরের জালিতে সূক্ষ্ম খোদাই করা জ্যামিতিক প্যাটার্ন সমাধিটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।

রানি রূপমতী মসজিদ
সুলতান মুহম্মদ বেগড়া আনুমানিক ১৪৩০- ১৪৪০ খ্রিষ্টাব্দে, আহমদাবাদে রানি রূপমতী মসজিদ নির্মাণ করেন। এর জানালাগুলোতে পাথরের মোটা ফ্রেমে বসানো, যেগুলোতে সূক্ষ্ম খোদাই করা অলঙ্করণ রয়েছে এবং ফ্রেমের ভেতরের জালিতে বিভিন্ন আকা্রের বৈচিত্র্যময় জটিল জ্যামিতিক নকশা ব্যবহৃত হয়েছে। জানালার দুই পাশে ছোট স্তম্ভ (miniature columns) বা পিলাস্টার (Pilaster) দেখা যায় এবং উপরিভাগে কার্নিস (cornice) বা ছোট ছাউনির মতো প্রক্ষেপণ, যা সূর্যের তাপ ও বৃষ্টির হাত থেকে জানালাকে রক্ষা করে। এছাড়াও জানালার চারপাশে পাথরে খোদাইকৃত ফুল, লতা-পাতা নকশার শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং কাঠামোগত দৃঢ়তা ও আলো-বাতাসের কার্যকারিতা স্থাপত্যশৈলীর উচ্চমাত্রার প্রকাশ।

অ্যাম্বার ফোর্ট (Amber Fort, ১৬শ শতক, জয়পুর, রাজস্থান)
অ্যাম্বার ফোর্ট মোঘল ও রাজপুত স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে তৈরি। খিলান (arch), ঝারোখা, জালি ও ফুলেল খোদাই মিলিয়ে অ্যাম্বার ফোর্টের জানালাগুলো আভিজাত্য অনন্য প্রকাশ। খোদাইকৃত মার্বেল বা লাল পাথরে তৈরি সূক্ষ্ম জালি জানালা (Stone lattice / Jaali) অন্দরমহলে আলো-ছায়ার নকশা তৈরি করে, যা প্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজকীয় পরিবেশকে রহস্যময় ও শৈল্পিক করে তোলে।

হুশাং শাহ-এর সমাধি (Hushang Shah’s Tomb, মাণ্ডু, মধ্যপ্রদেশ, ১৪৪০ খ্রি.)
হুশাং শাহ-এর সমাধির জানালায় উপমহাদেশে প্রথম মার্বেল পাথরের জালি দেখা যায়। যেখানে জালিগুলো সূক্ষ্মভাবে খোদাইকৃত মার্বেল জালির ফুলেল ও জ্যামিতিক নকশায় সমৃদ্ধ এবং অর্ধবৃত্তাকার খিলানের ভেতর স্থাপিত।

সালিম চিশতির সমাধি (Tomb of Salim Chishti, ফতেহপুর সিক্রি, আগ্রা, ১৬শ শতক, আকবর আমল)
সালিম চিশতির সমাধি ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্বেল স্থাপত্য। জানালাগুলো সম্পূর্ণ সাদা মার্বেলে খোদাই করা এবং প্রতিটি জালিতে ভিন্ন ভিন্ন জ্যামিতিক নকশা (ষড়ভুজ, তারকা, ফুলের নকশা) করা।

ক্যারৌলি রয়্যাল প্যালেস (রাজস্থান, ভারত)
ক্যারৌলি রয়্যাল প্যালেস ১৪শ শতকের দিকে রাজপুত রাজাদের দ্বারা নির্মিত প্রাসাদ স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। ঝারোখা জানালাগুলো শুধু স্থাপত্য উপাদান নয়, বরং এর সূক্ষ্ম খোদাই, অলঙ্কৃত খিলান ও প্রক্ষেপিত গঠন একদিকে নান্দনিক সৌন্দর্য তৈরি করেছে, অন্যদিকে কার্যকারিতার মাধ্যমে বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করেছে। corbelled brackets বা খোদাইকৃত পাথরের cusped arch (মৃদু বাঁকানো খিলান) রাজস্থানি লাল বেলেপাথর ও সাদা পাথরের সমন্বয় দেখা যায়।

নওলাখা প্যাভিলিয়ন
নওলাখা প্যাভিলিয়ন সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে (১৬৩১–৪৩ খ্রিঃ) লাহোর ফোর্টের ভেতরে নির্মিত হয়। প্যাভিলিয়নটি প্রধানত সাদা মার্বেল পাথরদ্বারা নির্মিত এবং এর জানালাগুলো সূক্ষ্ম মার্বেল পাথরে খোদাই করা জালিতে আবৃত। জানালার শীর্ষ অংশ অর্ধবৃত্তাকার ও বহু-পাপড়ি বিশিষ্ট খিলান দ্বারা গঠিত। খিলানগুলোতে সূক্ষ্ম ইনলে কাজ এবং ফুলের মোটিফ ব্যবহৃত হয়েছে, যা মোঘল স্থাপত্যে শাহজাহানীয় যুগের শৈল্পিক পরিপূর্ণতার এক অসাধারণ নিদর্শন।

বিবি কা মাকবারা (Bibi ka Maqbara)
১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেব বিবি কা মাকবারা নির্মাণ করেন। প্রধান উপকরণ হিসেবে সাদা মার্বেল (উপরাংশ), লাল বেলেপাথর (নিচের অংশে) এবং প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়েছে। জ্যামিতিক নকশায় ষড়ভুজ, তারকাকৃতি ও অষ্টভুজ দেখা যায়। জানালাগুলো বড় আকারের, উপরে তীক্ষ্ণ শীর্ষযুক্ত খিলান (pointed arch), যা দিল্লির মোঘল স্থাপত্যের প্রচলিত ধারা বহন করে।

বিবি কা মকবরা মূলত তাজমহলের প্রতিরূপ হলেও এটি দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে মোঘল স্থাপত্যের শাখা বিস্তারের একটি অনন্য নিদর্শন। উঁচু খিলানযুক্ত (pointed arch) জানালা এবং জ্যামিতিক ও ফুলেল মোটিফযুক্ত খোদাই স্থাপত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য । এছাড়াও জানালাগুলো অনেকটা ঝারোখা ধাঁচের বারান্দার মতো বাহিরে বেরিয়ে এসেছে। এতে ভিতর থেকে বাইরের বাগান দেখার সুযোগ রয়েছে।

মাদ্রাসা-ই-গাজীউদ্দিন (Madrasa-i-Ghaziuddin)
১৭১০ খ্রিস্টাব্দে আজমেরি গেটের বাইরে মাদ্রাসা-ই-গাজীউদ্দিন নির্মাণ করা হয়। এর জানালা থেকে ধারণা করা যায় মূলত মোঘল স্থাপত্যেশৈলীতে নির্মিত এবং নির্মাণে স্থানীয় উপাদান ইট ও চুন-সুরকির ব্যবহারে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অলংকরণে সূক্ষ্ম জ্যামিতিক নকশা ও ফুলের মোটিফ এর খোদাইকৃত জালি ব্যবহার করা হয়েছে যার উপরের অংশে রয়েছে উঁচু অর্ধবৃত্তাকার খিলান। মোঘল স্থাপত্যের এ জালিগুলো একইসাথে নান্দনিক সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিকভাবে ঘর ঠাণ্ডা রাখার ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত।

শীশ মহল (Shish Mahal)
মোঘল সম্রাট শাহজাহান আনুমানিক ১৬৩১–৩২ খ্রিস্টাব্দে ব্যক্তিগত আবাসস্থল হিসেবে শীশ মহল নির্মাণ করেন। কিছু জানালায় রঙিন কাঁচ বসানো হয়েছিল, যা শীশ মহলের আয়না খচিত দেয়ালের সাথে আলো প্রতিফলনের এক জাদুকরী পরিবেশ তৈরি করত। এছাড়াও রাজ পরিবারের সদস্যরা আঙিনা ও প্রাসাদের ভেতরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার জন্য ঝারোখা নির্মাণ করেন। নান্দনিকতার জন্য এসব জানালার চারপাশে মার্বেল ইনলে কাজ, ফুলেল খোদাই ও রঙিন টাইলস বসানো হয় যার মাধ্যমে মোঘল শিল্পের সূক্ষ্মতা ফুটে ওঠে।

জামা মসজিদ, দিল্লি (Jama Masjid, Delhi), ১৬৫০–১৬৫৬ খ্রি., শাহজাহান আমল
জামা মসজিদ মোঘল আমলের অন্যতম বৃহৎ স্থাপত্যকীর্তি। এর জানালাগুলো বেশ বড় এবং অর্ধবৃত্তাকার ও সূচালো খিলানযুক্ত যা লাল বেলেপাথর (red sandstone) এবং সাদা মার্বেলের সংমিশ্রণে নির্মিত।এছাড়াও ঝারোখা কাঠামোর জানালায় লাল বেলেপাথরে খোদাই করা জালি কাজ (lattice work) এবং জানালার ফ্রেমে সূক্ষ্ম খোদাই, কার্নিস এবং পাশ দিয়ে পিলাস্টারের ব্যবহার দেখা যায়।

জ্যায়সালমার (Jaisalmer), রাজস্থান
নিচে দেখা যাচ্ছে জ্যায়সালমার প্রাসাদের জানালা। জ্যায়সালমার প্রাসাদের এই জানালা শুধু স্থাপত্যের অপরিহার্য অংশই নয়, বরং এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। জানালার ফ্রেমগুলোতে cusped arches (multi-foil) এবং খোদাই করা পাথরের স্তম্ভ দেখা যায়। জানালার চারপাশে সূক্ষ্ম সোনালি রঙের পাথরে floral scrolls, geometric bands এর জালি খোদাই করা।সোনালি বেলেপাথরে তৈরি হওয়ায় জানালা রাজস্থানের মরুভূমির রঙকে বহন করে ভেতরের শৈল্পিক কাজ রাজপুত অভিজাত রুচি, ও ঐতিহ্যের প্রতীক।

আগ্রা ফোর্ট
১৫৬৫–১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মোঘল সুলতান আকবরের সময় আগ্রা ফোর্ট নির্মিত হয়। প্রাথমিকভাবে লাল বেলেপাথরে তৈরি হলেও পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান এর সময়ে সাদা মার্বেল ও জালি জানালা যুক্ত হয়। ফোর্টের স্থাপত্যে পাথরে সূক্ষ্ম খোদাই বা মার্বেল ইনলে নকশা মোঘল শিল্পের বিকাশের জীবন্ত দলিল। এসব জানালা আলো-ছায়া, বায়ুপ্রবাহ, গোপনীয়তা রক্ষায় যেমন কার্যকর তেমনি নান্দনিক খোদাই ও শিল্পকলার উৎকর্ষের বহিঃ প্রকাশ।

সুলতান আকবরের সমাধি (Akbar’s Tomb) সিকান্দ্রা, ১৬০৫–১৬১২/১৩
নিচের জানালাটি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় মোঘল সুলতান আকবরের সমাধিতে নির্মিত, যার প্রধান নির্মাণ উপাদান ছিলো লাল বেলেপাথর। জানালা স্থাপনায় দেখা যায় পরবর্তী মোঘল সমাধি এবং তাজমহলের জানালার জালি নকশার প্রোটোটাইপ।

তাজমহল
সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরে এই জানালাগুলো ১৬৩২–১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তাজমহলে নির্মাণ করা হয়। তাজমহল ভারতীয় স্থাপত্যকে বিশ্বের সমকক্ষ করে এবং এটি স্থাপত্যের শীর্ষ শৈল্পিক উদাহরণ এর একটি। জানালায় জ্যামিতিক প্যাটার্ন, আরবেস্ক, ফুলের মোটিফ এর মার্বেল খোদাই করে জালির নিখুঁত প্যাটার্ন এর স্থাপত্যকে আরও অনন্যতায় নিয়ে যায়।

ইতিমাদ-উদ-দৌলাহর সমাধি
১৬২২–১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে ইতিমাদ-উদ-দৌলাহর সমাধিটি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় নির্মাণ করা হয়। সাদা মার্বেল পাথরে সূক্ষ্ম খোদাইয়ের জ্যামিতিক, ফুলের মোটিফ এর জালি (jali screens) এবং অলংকরণে সাদা মার্বেল এর উপর এরাবেস্ক ও জ্যামিতিক নকশা এই জানালার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ।

সামোদ প্যালেস (১৭শ শতক, পরে ১৮–১৯শ শতকে সম্প্রসারিত)
রাজস্থানের সামোদ প্যালেস রাজপুত ও মোঘল শৈলীর মিলিত রূপে নির্মিত এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি। জানালার শীর্ষ অংশে বহু-পাপড়ি খিলান (cusped arches) ব্যবহৃত। এগুলো মার্বেল বা বেলেপাথরে খোদাই করা সূক্ষ্ম লতাপাতা ও ফুলের নকশা দ্বারা সজ্জিত। জানালায় হস্তনির্মিত কাঠ বা পাথরের ফ্রেম, যেখানে পেইন্টিং এর মাধ্যমে পারসিয়ান আরবেস্ক ও জ্যামিতিক নকশার কারুকাজ দেখা যায়।

লালকেল্লা (১৭শ শতক, শাহজাহান আমল)
লালকেল্লার জালি জানালা বা ল্যাটিস উইন্ডো মোঘল সৌধশিল্পের অন্যতম শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য। এর নান্দনিকতা, রাজকীয় আভিজাত্য এবং সামাজিক প্রয়োজনের সমন্বিত প্রকাশ। জানালার শীর্ষ অংশ অর্ধবৃত্তাকার বা বহু-পাপড়ি খিলান (cusped arch) এবং সাদা মার্বেলে সূক্ষ্ম ছিদ্র বা নকশা কেটে তৈরি করা জালি জানালার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অলংকরণে দেখা যায় জ্যামিতিক মোটিফ ও আরবেস্ক ইসলামী নান্দনিকতার প্রতিফলন, আর সূক্ষ্ম মার্বেল ইনলে কাজ পারসিয়ান শিল্পরীতির অনুকরণ। শুধুমাত্র কার্যকারীতার জন্য নয়, বরং জানালাগুলো শাহজাহানীয় আমলের বিলাসিতা, শিল্পপ্রেম ও সূক্ষ্ম স্থাপত্যবোধের পরিচায়ক।


রোহতাস ফোর্ট (Rohtas Fort), ১৫৪১–৪৮ খ্রিঃ
রোহতাস ফোর্ট নির্মাণ করেন শের শাহ সূরি। এর জানালাগুলো সাধারণত অর্ধবৃত্তাকার খিলানযুক্ত বা আয়তাকার ফ্রেমে বসানো এবং ফ্রেমগুলো মোটা ও শক্ত, যাতে আক্রমণ প্রতিরোধে দেয়ালের দৃঢ়তা নষ্ট না হয়। খিলানগুলোতে ছোট আকারের পাথরের জালি (perforated stone screens) ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে অলঙ্করণ নয়, বরং কার্যকারিতা মুখ্য বিষয়।

মারওয়ারি হাভেলি
১৮শ–১৯শ শতকে হাভেলি নির্মাণ এক বিশেষ ধারায় রূপ নেয়। ধনী মারওয়ারি ব্যবসায়ী ও জমিদার পরিবারের নির্মিত হাভেলিগুলোতে এ ধরণের জানালা দেখা যায় যেগুলো শুধু বাসগৃহ ছিল না; বরং ঐশ্বর্য, শিল্প-সংবেদন ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। অলংকৃত হাভেলিগুলোর জানালায় কাঠের ফ্রেম ও শাটার এর চারপাশে সূক্ষ্ম খোদাই করা ফুলেল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশার ব্যবহার দেখা যায়; যা মোঘল খিলান, রাজপুত পাথর খোদাই, এবং স্থানীয় কারিগরদের দক্ষতার এক বিশেষ সংমিশ্রিত নকশা সৃষ্টির প্রয়াস। মাঝের কাঠের জানালাগুলো সাধারণত ভেতর থেকে খোলা যায় এবং পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
উমর হায়াত মহল (Umer Hayat Mahal, Chiniot, 1930)
চিনিওট (পাঞ্জাব, পাকিস্তান) ঐতিহ্যগতভাবে কাঠের নিপুণ খোদাই শিল্পের জন্য বিশ্ববিখ্যাত। এখানকার হাভেলি, মসজিদ ও প্রাসাদের ঝারোখা জানালা এক অনন্য স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য, যেখানে মোঘল, ফারসি শৈলীর সূক্ষ্মতা স্থানীয় পাঞ্জাবি ঐতিহ্যের সাথে মিশে স্থাপত্যকে জীবন্ত শিল্পকর্মে পরিণত করেছে। এটি (নিচে) উমর হায়াত মহল এর ঝারোখা জানালা যা projecting balconies আকারে তৈরি কাঠের জানালা। পাথরের বদলে শিসম কাঠ (Sheesham wood) ব্যবহার করে সূক্ষ্ম খোদাই করা হয়েছে। জানালার ফ্রেমগুলোতে বহুস্তর বিশিষ্ট cusped arches এবং প্রতিটি স্তরে খোদাই করা floral scrolls, arabesques, এবং জ্যামিতিক নকশা।

উমর হায়াত মহল চিনিওটের কাঠের নিপুণ কারুশিল্পের জীবন্ত দলিল। এর জানালা স্থাপত্য এ প্রাসাদের শৈল্পিক পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু অর্থাৎ মোঘল সূক্ষ্মতা, ফারসি নকশা ও পাঞ্জাবি লোকজ অলঙ্করণের সমন্বয় জানালার প্রতিটি অংশ সূক্ষ্ম হাতে খোদাই করা, যা চিনিওটের কাঠশিল্পের সর্বোচ্চ মান প্রদর্শন করে। কাঠের সাথে কখনো ইনলে (inlay) ও আয়না শোভা যুক্ত যা সূর্যালোক ছেঁকে নরম আভা তৈরি করে।

হাভেলি, শেখাওয়াতি (Shekhawati)
শেখাওয়াতি (Shekhawati) অঞ্চলের হাভেলি স্থাপত্য মূলত ১৮শ–১৯শ শতাব্দীতে সমৃদ্ধ হয়েছিল, যখন মারওয়ারি ব্যবসায়ী সমাজ তাদের ধন-সম্পদ, রুচি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় হাভেলির জানালা, দরজা ও দেয়ালের অলঙ্করণে ফুটিয়ে তুলেছিল। অধিকাংশ জানালা অর্ধবৃত্তাকার খিলানযুক্ত এবং জানালার চারপাশে জ্যামিতিক মোটিফ, ফুল-পত্র নকশা করা। কাঠ ও পাথরের খোদাই, খিলান, এবং ল্যাটিসওয়ার্কে রাজপুত ঐতিহ্য এবং মোঘল শৈল্পিকতা একত্রিত হয়েছিল।


সোনার কেল্লা (Sonar Quila / Golden Fort, 1156)
জ্যায়সালমারের সোনার কেল্লা নির্মিত হয় ১১৫৬ খ্রিস্টাব্দে। এর জানালা স্থাপত্য মরুভূমির পরিবেশ, রাজপুত শিল্পরুচি এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের এক অনন্য দলিল। স্থানীয় হলুদ স্যান্ডস্টোনে খোদাই করা সূক্ষ্ম জালি নকশা আলো ও বাতাস প্রবাহের জন্য কার্যকর, আবার গোপনীয়তাও রক্ষা করত। জানালার চারপাশে খোদাই করা floral scrolls, geometric bands এর সূক্ষ্ম খোদাই রাজপুত স্থাপত্যের গৌরবময় নিদর্শন।
হাভেলি, জ্যায়সালমার
রাজস্থানের হাভেলি স্থাপত্য মূলত রাজপুত ও মারওয়ারি ব্যবসায়ী পরিবারের সমৃদ্ধ জীবনধারা ও শিল্পরুচির বহিঃপ্রকাশ। আর এর জানালা স্থাপত্য, বিশেষ করে ঝারোখা,পুরো শহরকে “সোনার শহর” নামে পরিচিত করেছে।এর ঝারোখাগুলো স্থানীয় হলুদ বেলেপাথরে (Yellow Sandstone) খোদাই করা brackets ও সূক্ষ্ম খোদাই করা স্যান্ডস্টোনের জালি কখনো অর্ধবৃত্তাকার, কখনো জটিল বহুলতর খিলান দ্বারা সংযুক্ত।

ওয়াজির খান মসজিদ (লাহোর, পাকিস্তান)
ওয়াজির খান মসজিদ ১৬৩৪–১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মোঘল আমলের অন্যতম সেরা স্থাপত্য নিদর্শন। ঝারোখা জানালাগুলো মসজিদের বাইরের দেওয়ালে, বিশেষ করে সামনের (façade) এবং মিনারের সংলগ্ন অংশে দেখা যায়। জানালাগুলো অর্ধবৃত্তাকার খিলান দ্বারা আবৃত এবং প্রতিটি জানালার চারপাশে টেরাকোটা ও টাইলসের অলঙ্করণ রয়েছে। জানালার নিচে corbelled brackets দেখা যায়, যা ঝারোখাকে projecting balcony-র রূপ দিয়েছে।

পুরনো ভবন, পেশোয়ার
নিচে পেশোয়ারের প্রাচীরঘেরা নগরীর পুরনো ভবনের কাঠখোদাই ঝারোখা জানালা। মোঘল শিল্পকলা, পশতুন জীবনধারা এবং কারিগরদের অনন্য দক্ষতায় ঝারোখা জানালাগুলো আজও টিকে আছে। যা পশতু সমাজের শিল্প-রুচি, সামাজিক রীতিনীতি এবং ইসলামি-দক্ষিণ এশীয় স্থাপত্যের মিশ্র ঐতিহ্য বহন করে।

কাশ্মীরি হাভেলি (Kashmiri Haveli)
নিচের জানালাটি কাশ্মীরি হাভেলি বা ঐতিহ্যবাহী কাশ্মীরি বাড়ির কাঠখোদাই করা ঝারোখা জানালা। জানালার কাঠামো কাঠ দিয়ে তৈরি এবং উপরে টালিযুক্ত ছাউনি রয়েছে। নিচের অংশে আলো বাতাস প্রবাহের জন্য জালি নকশা এবং উপরের অংশে কাঠের জানালা শাটার, যেখানে ছোট কাচ বসানো যা গ্রীষ্মকালে খোলা রাখা আর শীতে বন্ধ রেখে কাচ দিয়ে আলো প্রবাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।

মহেশ্বর দুর্গ (Maheshwar Fort)
১৮শ শতাব্দীর শেষভাগে মহেশ্বর দুর্গে এ জানালা নির্মাণ করা হয়। ১৫শ শতকে মোঘল সুলতান আকবর প্রজাদের সঙ্গে সংযোগ রাখতে “ঝারোখা-দর্শন” (Jharokha Darshan) এর প্রথা চালু করলেও ঝারোখার আলোর প্রক্ষেপণ শৈলী, সূক্ষ্ম খোদাই, গোপনীয়তা, নান্দনিকতার সমন্বয় ধীরে ধীরে একে স্থাপত্যের অনন্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত করে।

আয়না মহল (Aina Mahal)
গুজরাটের ভুজ শহরে (১৮শ শতক, আনুমানিক ১৭৫২ খ্রি.) নির্মাণ করা হয় আয়না মহল। আয়না মহলের ঝারোখা জানালাগুলো সূক্ষ্ম পাথরে ফুল-লতা, জ্যামিতিক এবং আরবেস্ক মোটিফ খোদাই করা।


হাভেলি, গুজর খাঁ (Gujar Khan)
এই ঝারোখা জানালাগুলো গুজর খাঁ জেলার কাউন্ত্রিলা (Kauntrila) এলাকায় এক হাভেলিতে নির্মিত। এ ধরণের জানালা সাধারণত উপরের তলায়, বাসগৃহের অভ্যন্তর থেকে রাস্তাঘাট ও জনসমাজ পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও এগুলো ছিল শৈল্পিক ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক। জানালার চারপাশে কাঠের সূক্ষ্ম খোদাই, নীচে কারুকার্যপূর্ণ করবেল (corbel) বা ব্র্যাকেট (bracket), জানালার খিলান, ছাদের কার্নিশ ও কাঠের রেলিং বা বালাস্টার (balustrade) এর স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কিস্সা খওয়ানি বাজার, পেশোয়ার (পাকিস্তান)
কিস্সা খওয়ানি বাজারের ঝারোখাগুলো সাধারণত রঙিন কাঠ দ্বারা তৈরি , কাঠে সূক্ষ্ম খোদাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের নকশা এবং আলো বাতাস প্রবাহের জন্য জালির ব্যবহার দেখা যায়। পেশোয়ারের নগর ঐতিহ্য ও কারুশিল্পের ধারক হিসেবে ঝারোখাগুলো ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।


বখ্শী রাম সিংহের হাভেলি
১৮৮৬ সালে বখ্শী রাম সিংহের হাভেলির এই ঝারোখা জানালা নির্মাণ করা হয়। বালুকাপাথরের খোদাই করা ফ্রেম এবং কাঠের প্যানেল এটির স্থাপত্যের প্রধান আকর্ষণ। যা প্রয়োজনে খোলা এবং বন্ধ রাখার বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। মোঘল স্থাপত্যের ছায়া থাকলেও ঔপনিবেশিক যুগের প্রভাব (arched verandahs, decorative cornices) লক্ষ্য করা যায়।

জীবন সিংহ হাভেলি
জীবন সিংহ হাভেলির (দৌলতলা) ঝারোখা জানালা উনবিংশ শতকের শেষভাগে, আনুমানিক ১৮৮০–১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত। সমসাময়িক অন্যান্য হাভেলি (যেমন বখ্শী রাম সিংহ হাভেলি, ১৮৮৬)–এর স্থাপত্যধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।

আতম সিং গুজরাল হাভেলি
আতম সিং গুজরাল হাভেলি উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে নির্মিত বলে অনুমান করা হয়। জানালার অংশে কাঠ ও পাথরের খোদাইকৃত অলঙ্করণ (floral patterns) লক্ষ্যণীয়।

নাউ নিহাল সিংহের হাভেলি
নাউ নিহাল সিংহের হাভেলির ঝারোখা জানালা (১৮শ শতকের শেষের দিকে বা ১৯শ শতকের শুরুতে তৈরি) পাঞ্জাবের লাহোর অঞ্চলে নির্মিত। নির্মাণ উপাদান হিসেবে কাঠ ও পাথর ব্যবহার করা হয়। অলংকরণে প্রাচীর এবং কাঠের অংশে সূক্ষ্ম রঙিন পেইন্টিং করা হয়।
ইসলামিয়া কলেজ, পেশোয়ার (পাকিস্তান)
১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামিয়া কলেজ, পেশোয়ার (Pakistan)-এর ঝারোখা জানালা। এতে খোদাই করা কাঠ, খিলানযুক্ত ফ্রেম এবং ছাদ বা ছত্রি-আকৃতির আচ্ছাদন রয়েছে।


ওয়াল্ড সিটি, পেশোয়ার (Walled City of Peshawar)
ওয়াল্ড সিটি মূলত শতাব্দী প্রাচীন স্থাপত্যের ভাণ্ডার। মোঘল আমল থেকে পেশোয়ার ছিল একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখানকার ব্যবসায়ী ও ধনী পরিবারগুলো তাদের হাভেলি ও বাড়িতে ঝারোখা জানালা স্থাপন করত সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। ঝারোখাগুলোতে সেগুন বা চিরকালীন শক্ত কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে এবং খোদাইয়ে ফুললতা, জ্যামিতিক নকশা, আরবেস্ক, এবং কখনো কখনো স্থানীয় পশতুন মোটিফ পাওয়া যায়।

পেশোয়ারের প্রাসাদ
এটি পেশোয়ারে অবস্থিত একটি প্রাসাদ যা ১৮শ–১৯শ শতাব্দীতে “সেটি ব্যবসায়ী পরিবার” নির্মাণ করেছিলেন। সেটি মহল্লার জানালা কাঠের নকশাশিল্প, খিলানাকৃতির ফ্রেম ও জালি শৈলী তাদের ঐশ্বর্য ও শিল্পরুচির প্রতিফলন। অলংকৃত কাঠের কারুকাজ মধ্য এশীয় ইসলামী নকশা থেকে অনুপ্রাণিত যাতে রঙিন কাঁচ, ফ্রেস্কো এবং স্থানীয় কারিগরির ছোঁয়া শিল্পের অনন্যতায় নিয়ে যায়। সাধারণত শিশম কাঠ ও অন্যান্য শক্ত কাঠ দিয়ে এসব কাঠামো তৈরি। কাঠের নকশায় সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা হয়—ফুল ,লতা, আরবেস্ক ও জ্যামিতিক মোটিফ।
________________________
তথ্যসূত্রঃ
https://commons.wikimedia.org/wiki/Category:Ahmed_Shah_Mosque
https://comedoresdepaisagem.com/mandu-india/
https://thearchitectsdiary.com/through-time-and-glass-exploring-10-indian-window-designs/
https://mohsinphotos.blogspot.com/2019/03/barbers-tomb-aka-nai-ka-gumbad.html
https://islamicarchitectureinindia.weebly.com/hushang-shahs-tomb.html
https://www.thefridaytimes.com/30-Mar-2024/exploring-the-pre-partition-havelis-of-daultala
https://www.zameen.com/blog/rohtas-fort-jhelum-guide.html


