জীবের দুইটি সত্তা আছে, একটি অহং-সত্তা ও অপরটি ভূমা-সত্তা। অহং-সত্তা আমিত্বকে ঘিরিয়া থাকে এবং ভূমা-সত্তা এককে বহুর মধ্যে বিস্তৃত করিতে চায়। অহং-সত্তা জীবের কর্ম-প্রেরণার উৎস; কিন্তু ইহা অত্যন্ত উচ্ছৃংখল ও স্বভাবে ইহা কাম, ক্রোধ প্রভৃতি ষড়রিপুর প্রভাবে পরিচালিত হয়। অহং-সত্তা গতিশীল। ইহা বন্যার স্রোতের ন্যায় আপনার চলার আনন্দে ছুটিয়া বেড়ায় এবং চলার পথে বাঁধা পাইলে গর্জন করিতে থাকে ও শক্তি থাকিলে নির্মমভাবে বাঁধার প্রাচীরকে ধ্বংস করিয়া আপনার গতিপথ পরিষ্কার করিয়া লয়। এই অহং-সত্তাই সৃষ্টির গতি ও বৈচিত্র্যের কারণ। ইহা এক দিকে যেমন নতুন নতুন জনপদ ও উর্বর শস্যক্ষেত্র সৃষ্টি করে, অন্য দিকে তেমনি বহু সমৃদ্ধশালী নগর ও ক্ষেত্রকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে; ইহা এক দিকে যেমন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতি ও বিস্তারের কর্মপ্রেরণা দেয়, অপরদিকে তেমনি সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করিয়া কোটি কোটি নর–নারীর অশেষ দুঃখের কারণ হয়।
পক্ষান্তরে ভূমা-সত্তা জ্ঞানলাভের উৎস। ভূমা-সত্তার সত্যানুসন্ধান স্পৃহা বর্ষার রস্রোতের ভরা-নদীর দুই পার্শ্বের বাঁধের ন্যায় অহং-সত্তার গতিকে সুসংহত ও সুনিয়ন্ত্রিত করে। বিশ্বের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সাধনই ইহার স্বভাব। সংসারে দুঃখ আছে সত্য, কিন্তু ইহা কেবলই দুঃখ ভরা নয়, এখানে প্রচুর আনন্দও আছে। এই আনন্দের উৎস ভূমা-সত্তা। দ্বন্দ্ব, গতি ও পরিবর্তন সৃষ্টির শাশ্বত ধর্ম। অহং ও ভূমা-সত্তার বিরামহীন পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকে দেয় তাহার গতি-বৈচিত্র্য এবং সেই গতি-বৈচিত্র্যই আনে সৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য পরিবর্তন। এই দ্বন্দ্বরত দুই সত্তার মধ্যে অহং-সত্তার অবলুপ্তি ঘটিলে সৃষ্টির অগ্রগতি ও তাহার মাধ্যমে বিবর্তন রুদ্ধ হইয়া যায়, অপরপক্ষে ভূমা-সত্তার বিলুপ্তি ঘটিলে অহং-সত্তা যে অগ্রগতি ঘটায় উহা সৃষ্টিকে ধ্বংসের দিকেই আগাইয়া নেয় সমৃদ্ধির দিকে নয়। এই দুই সত্তার সুসামঞ্জস্য এবং ভারসাম্যময় অবস্থানই কেবল সৃষ্টিকে দিতে পারে শন্তিপূর্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতি ও পরিবর্তন।
মানুষের সমাজ-জীবনে যে দ্বন্দ্ব, গতি ও পরিবর্তন দেখা যায়, তাহা মানুষের অন্তর্জগতের এই দ্বন্দ্বের প্রতিক্রিয়া, সুতরাং বহির্জগতে যে দ্বন্দ্ব, গতি ও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়, মানুষের অন্তর্জগতের দ্বন্দ্ব-নিরপেক্ষ কোন অস্তিত্ব উহাদের নাই। অহং ও ভূমা-সত্তার এই বিরামহীন দ্বন্দ্বই ইতিহাসের স্রষ্টা, বহির্জগতের অর্থনৈতিক শ্রেণী। সংগ্রাম ইতিহাসের স্রষ্টা নহে। মার্ক্সবাদীরা ভূমা-সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না, কিন্তু তাঁহারা স্বীকার না করিলেও মার্ক্সবাদের প্রবর্তক কার্ল মার্ক্স, এংগেলস ও তাঁহাদের উত্তরসূরী লেনিনের চিন্তা ও কর্মে ভূমা-সত্তার ক্রিয়া ও প্রভাব দিবালোকের মত পরিষ্কার দেখা যায়। ভূমা-সত্তাকে নীতিগতভাবে অস্বীকার করেন বলিয়া তাঁহাদের সমাজে বহু ত্যাগী ও ত্যাগের কাহিনী থাকা সত্ত্বেও ত্যাগের কোন দার্শনিক যৌক্তিকতা তাঁহাদের ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে’ পাওয়া যায় না। ভূমা-সত্তাকে অস্বীকার করা হইয়াছে বলিয়াই মার্ক্সবাদ মানুষের অন্তর্জগতের ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করে এবং মানুষের ধারণাকে তাহার বাস্তব পরিবেশের সৃষ্টি বলিয়া ভুল করিয়া থাকে। এই ভুল অত্যন্ত মারাত্মক। যে দৃষ্টিভংগি রোগের আদি কারণ ও বাহ্যিক উপসর্গের পার্থক্য বুঝিতে না পারিয়া উপসর্গকে রোগের আদি কারণ বলিয়া ভুল করে, সেই দৃষ্টিভংগিতে মার্ক্সবাদীরা ইতিহাস বিশ্লেষণ করিয়া থাকেন।
ভূমা-সত্তাকে অস্বীকার করেন বলিয়া মার্ক্সবাদীদিগকে সমাজ-পালননীতি ও পরিকল্পনার কেবলমাত্র মানুষের নশ্বর জৈবিক সত্তার লালন-পালনের ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায়। এই আদর্শ মনুষ্যত্বকে হত্যা করিয়া মানুষকে বাঁচাইয়া রাখিতে চায়। তাই এই আদর্শের আবেদন আপাতত দৃষ্টিতে সার্বিক হওয়া সত্ত্বেও সুদূর-প্রসারী দৃষ্টিতে ইহা কল্যাণপ্রসূ নহে। কারণ ইহার আবেদন বস্তুত এক বিশেষ শ্রেণীর মধ্যেই সীমিত।
পরিবর্তন মাত্রই বিবর্তন নহে, পরিবর্তন বিবর্তনমূলক ও নিবর্তনমূলক দুই-ই হইতে পারে। যে গতি-বৈচিত্র্যে ভূমা-সত্তার প্রভাব পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে সেই গতি- বৈচিত্র্য যে পরিবর্তন ঘটায় তাহাই হয় বিবর্তনমূলক; অহং-প্রধান পরিবর্তন সাধারণত নিবর্তনমূলক। মানুষ সৃষ্টির প্রথম হইতে ব্যক্তির ন্যায় সমাজেরও অবিচ্ছেদ্য পরিবর্তন ঘটিতেছে। পরিবর্তনের স্রোতে বহু গ্রহ-উপগ্রহ নিশ্চিহ্ন হইয়াছে এবং বহু নতুন গ্রহ-উপগ্রহ জন্মলাভ করিয়া আকাশের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিয়াছে। জীব-জগতের মধ্যে হস্তী, জলঘোটক প্রভৃতি বহু জীব ধরা-পৃষ্ঠ হইতে অবলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, আবার বহু নতুন জীবেরও আবির্ভাব হইয়াছে। এইভাবে এক দিকে পৃথিবীর বহু সম্পদ রূপ, রস ও গন্ধ ধ্বংস হইয়াছে এবং অন্য দিকে বহু নতুন নতুন ঐশ্বর্য্য সৃষ্টি হইয়াছে। নিবর্তন, বিবর্তন ও ভাঙা-গড়ার হিসাব-নিকাশ করিলে দেখা যায়, সামগ্রিকভাবে সৃষ্টি সুন্দর হইতে সুন্দরতর হইতেছে। সৃষ্টির এই ধারাবাহিক পরিবর্তন নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করিতেছে যে, স্রোতমূখে তৃণের মত জগত কাল-স্রোতে অসহায়ভাবে বিক্ষিপ্ত ও লক্ষ্যহীন গতিতে ভাসিয়া বেড়াইতেছে না, কোন এক নির্দিষ্ট মঞ্জিল লক্ষ্য করিয়া ধীর পদক্ষেপে মহাকালের আঁধার ভেদ করিয়া অগ্রসর হইতেছে। অহং-সত্তার উচ্ছৃঙ্খল গতি ভূমা-সত্তা সংযত করিয়া সৃষ্টির এই অগ্রগতি নিয়ন্ত্রিত করে।
সমাজ-বিবর্তনের ক্ষেত্রেও এই একই কথা। ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে সর্ব যুগে ছোট বড় সকল সমাজে তিন শ্রেণীর মানুষ দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাদের একটি জালিম, একটি মজলুম, আর একটি জালিমের দুশমন ও মজলুমের বন্ধু। মজলুম-শ্রেণী জালিম-শ্রেণীর জুলুমের ফলে সৃষ্ট এবং জুলুম-বিরোধী শ্রেণীর সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফলভোগী। জুলুম-বিরোধী শ্রেণী সমাজের ভূমা-সত্তা এবং জালিম শ্রেণী অহং-সত্তার মূর্ত প্রতীক। এই দুই শ্রেণীর অবিরাম সংগ্রাম সমাজ জীবনের পরিবর্তনের কারণ, জালিম ও মজলুম-শ্রেণীর দ্বন্দ্ব নহে। দাস-প্রথা রহিত করিবার জন্য যাঁহারা আন্দোলন করিয়াছিলেন তাঁহারা দাস ছিলেন না, অর্থনৈতিক শ্রেণীবিচারে তাঁহারা ছিলেন দাসের প্রভু শ্রেণীভুক্ত। নারী-স্বাধীনতা-সংগ্রামের উদ্যোক্তরা নারী নহে পুরুষ এবং মজুরের মুক্তি-আন্দোলনের গোড়াপত্তন ও নেতৃত্ব করিয়াছিলেন যাঁহারা, তাঁহারাও মজদুর ছিলেন না, ছিলেন মালিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত জুলুম- বিরোধী মার্ক্স ও এংগেসের মত মহাপুরুষেরা। অর্থনৈতিক শ্রেণী বিচারে যাহারা জালিম শ্রেণীভুক্ত, চিন্তা ও কর্মে তাহারা সকলেই জালিম নহেন, অন্য দিকে যাহারা মজলুম শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত, তাহাদেরও সকলেই জুলুম-বিরোধী নহে। যাহাদের মধ্যে ভূমা-সত্তা প্রবল, তাহারা অর্থনৈতিক শ্রেণী বিচারে যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, তাহারাই জুলুম-বিরোধী।
যুগে যুগে জুলুমের অস্ত্র ও পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখিতে পাওয়া যায়। সর্বযুগে উৎপাদন-যন্ত্রের অধিকারীরা জালিম এবং উৎপাদন-যন্ত্রের অধিকারে বঞ্চিতরা মজলুম, একথা সত্য নহে, অবশ্য বর্তমান যুগে একথা সত্য। আসলে সমাজের পরিচালন-ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যখন অহং-সত্তার প্রাবল্য লাভ করে, তখনই তাহাদিগকে জালিমের ভূমিতায় দেখা যায়। তখন তাহাদের নিজ স্বার্থ রক্ষা ও পুষ্টির জন্য তাহারা দুর্বলদের উপর শাসন, শোষণ ও জুলুম-নিপীড়ন চালাইতে আরম্ভ করে।
এই ক্ষমতার ভিত্তি যেরূপ বিভিন্ন হইতে পারে, ক্ষমতার অধিকারী অহং-সর্বস্বদের জুলুম-নিপীড়নের পন্থা এবং পদ্ধতিও সেইরূপ বিভিন্ন হইতে পারে। সনাতন আর্য-ভারতের কঠিন বর্ণাশ্রমের যুগে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরা উৎপাদন-যন্ত্রের অধিকারী ছিলেন না, কিন্তু তাহারাই ছিলেন সেকালের সমাজ-পতি ও জালিম। মজলুম ছিলেন উৎপাদন-যন্ত্রের অধিকারী বৈশ্য ও শূদ্রেরা। সামন্ত যুগে সামন্তেরা উৎপাদন-যন্ত্র ও ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকারী ছিলেন না বরং ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৃত্তি হিসাবে তাহারা তাহাদের আভিজাত্যের হানিকর মনে করিতেন- দোকানদার, ব্যবসায়ী এবং কৃষি ও শিল্প-যন্ত্রের অধিকারীকে ঘৃণার চোখে দেখিতেন। সুতরাং সেকালে উৎপাদন-যন্ত্রের অধিকারী তাঁতী, কামার প্রভৃতিরাই ছিলেন মজলুম এবং জালিম ছিলেন সামন্তেরা। বর্তমান ধনতান্ত্রিক যুগের পূর্বে শোষণ-নিপীড়নের অস্ত্র ছিল ব্রাহ্মণের জ্ঞান-বৃদ্ধি ও ক্ষত্রিয়ের ক্ষাত্রশক্তি। বর্তমান যুগে সমাজের পরিচালন-ক্ষমতা হস্তান্তরিত হইয়াছে বণিক ও শিল্পপতিদের নিকট। সুতরাং আমাদের এই বিশেষ যুগে উৎপাদন ক্ষমতার অধিকারী গোষ্ঠীই সমাজ-জীবনের বল্লাহীন অহং-সত্তার প্রতীক তথা জালিম। কিন্তু মানবেতিহাসের আদি হইতে অন্ত পর্যন্ত এই শ্রেণীই জালিম- একথা সত্য নহে।
সমাজের অহং-সত্তা অর্থাৎ জালিম-শ্রেণী নিজ শ্রেণীর স্বার্থে বহু সমাজ ও সভ্যতা ধ্বংস করিয়াছে এবং কোটি কোটি নর-নারীর মর্মন্তুদ দুঃখ-কষ্টের কারণ ঘটাইয়াছে। অন্য দিকে ভূমা-সত্তা, অহং-সত্তার ধ্বংস-প্রবৃত্তিকে দমন করিয়া তাহার কর্মশক্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করিয়া সুন্দরতম সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিয়াছে। অহং ও ভূমা- সত্তার এই ভাঙা-গড়ার হিসাব-নিকাশ করিলেও দেখা যায়, সমাজ-জীবনে বিবর্তনমূলক অগ্রগতি সাধিত হইয়াছে এবং বিশ্বমানব সুন্দর হইতে সুন্দরতম জীবনের সন্ধান পাইয়াছে। বিশ্বমানবের এই সমাজ-বিবর্তন ও সৃষ্টির গতি-বৈচিত্র্যের একটি বস্তু- নিরপেক্ষ উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা আছে ইহাই প্রমাণ করে। ভূমা-সত্তা মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি ও বিবর্তনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার উৎস রাব্বুল আলামীনের সহিত জীবাত্মার পরিচয় ঘটায়। এই পরিচয় যে আদর্শের সন্ধান দেয়, সেই আদর্শভিত্তিক সমাজ সারা বিশ্বের জন্য নিরংকুশ কল্যাণপ্রসূ। এই প্রকার সমাজেরই নাম রব্বানী সমাজ। কারণ এই সমাজাদর্শ বিশ্বস্রষ্টা রাব্বুল আলামীনের বিশ্বপালন-নীতির আলোকে সমাজের লালন-পালন করিতে চায়। যে আদর্শের সহিত ভূমা-সত্তা তথা বিশ্বস্রষ্টা ও তাহার পালন-নীতির পরিচয় নাই, সেই আদর্শভিত্তিক সমাজ আদর্শভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও রব্বানী নহে, উহার বিপরীত নানী অর্থাৎ অহং-সর্বস্ব। বর্তমান যুগের মার্কস্বাদী সমাজ নফসানী সমাজের চরমতম বিকাশ। ইহার ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া অব্যাহত থাকিলে রক্তভিত্তিক বা স্বার্থভিত্তিক নক্সানী সমাজের মত কেবল কোন একটি শ্রেণী, সমাজ বা সভ্যতাকেই ধ্বংস করিবে না, সমগ্র বিশ্ব-মানবকেই জীব-জগতের বহু লুপ্ত জাতির মত সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করিবে।
সামগ্রিক দৃষ্টিতে সমাজের বিবর্তন নিরবচ্ছিন্ন, কিন্তু কোন একটি সমাজ বা সমাজ- গোষ্ঠীর পরিবর্তন ধারাবাহিকভাবে বিবর্তনমূলক নহে। সমাজ-জীবনের নিম্নতম স্তর হইতে বিবর্তনের প্রতিটি স্তর অতিক্রম করিয়া কোন একটি সমাজের রূপান্তর হয় নাই। মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পায় যে উচ্চাংগের সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়, তাহার ধারাবাহিক বিবর্তন ঘটিলে বর্তমান যুগে যে সভ্যতা দেখিতেছি তাহা বহু শতাব্দী পূর্বেই দেখা যাইত। কিভাবে এই সভ্যতা সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হইল এবং ভারতে আবার নতুন করিয়া সমাজের অতি নিম্নস্তরের সভ্যতা, পশুপালন, কৃষি প্রভৃতি স্তর ধীরে ধীরে অতিক্রম করিয়া মৌর্যের পাটলীপুত্র ও নালন্দা গড়িয়া উঠিল, কে এই রহস্য উদঘাটন করিবে?
দুই একটি সমৃদ্ধশালী নগর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভূগর্ভে সমাধিস্থ হইলে অথবা অন্য কোনভাবে ধ্বংস হইলে ঐ নগরের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সারা দেশ হইতে বিলুপ্ত হইবার কথা নহে। ভিসুবিয়াসের লাভা উদ্গীরণে পাম্পিয়ায় সুসভ্য নগর ধ্বংস হইলেও ইউরোপ হইতে পাম্পিয়াই-এ সভ্যতা লোপ পায় নাই। বর্তমান দুনিয়ায় সুসভ্য ইংরেজ ও ফরাসী জাতির পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার গভীরে নরখাদক অসভ্য সমাজ আজও দেখিতে পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রাম ইতিহাসের গতি-বৈচিত্র্য নিয়ন্ত্রণ করে – ইহা যদি চরম ও পরম সত্য হইত, তাহা হইলে প্রত্যেকটি সমাজ এই শ্রেণী- সংগ্রামের মাধ্যমে সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে ইংরেজ ও ফরাসী সমাজের মতই সমৃদ্ধশালী হইত।
যে আদর্শ ও কর্মপ্রেরণা উন্নততর সমাজ সৃষ্টি করে, কোন দুর্বল সমাজ-সংহতি- সম্পন্ন জরাগ্রস্ত অথচ বাস্তব সম্পদ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ সমাজ তাহার প্রয়োগ- ক্ষেত্র হয় না, তজ্জন্য প্রয়োজন হয় কোন একটি বলিষ্ঠ সমাজ সংহতি-সম্পন্ন নবজাত সমাজ। এই কারণে উপনিষদের সভ্যতার প্রয়োগক্ষেত্র হইল বহিরাগত পশুপালক নবজাত আর্য-সমাজ, মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পার সমসাময়িক কোন সুসভ্য আর্যসমাজ নহে। সেই একই কারণে ইসলামের প্রয়োগক্ষেত্র হইল বেদুঈন আরবের নবজাত মুসলিম সমাজ- সুসভ্য পারস্য অথবা বাইজান্টাইনের রোমক সমাজ নহে। কার্ল মার্ক্স তাঁহার অর্থনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রামের ছক কাটিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন যে, ইংল্যান্ড জার্মানীর মত ধনতান্ত্রিক শিল্পোন্নত দেশগুলোতেই হইবে মার্ক্সবাদের প্রথম বিকাশ, কল- কারখানার মালিক ও মজদুরের শ্রেণী-সংগ্রামের মাধ্যমের ইতিহাসে ইহাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করিয়াছে। কারণ, মার্ক্সবাদের বিকাশ ঘটিয়াছে সামন্তবাদী রাশিয়ায় এবং আজও পাশ্চাত্যের সুশৃংখল ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে মার্ক্সবাদের কোন প্রভাবই পরিদৃষ্ট হয় না, বরং অধুনাও উহার প্রসার ঘটিতেছে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার পশ্চাৎপদ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশসমূহে। বাষ্পীয় বা বৈদ্যুতিক শক্তির মত উৎপাদন–পদ্ধতি অথবা ইসলামের মত কোন এক জীবনাদর্শ যাহা সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায় তাহা শ্রেণী–সংগ্রামের ফল নহে, ইতিহাসের গতি–বৈচিত্র্যের নিয়ন্তা রাব্বুল আলামীনের আকস্মিক দান। এই রহস্যের উৎস ভৌতিক নহে ভূতোত্তর।
হেগেলের দ্বান্দ্বিক ভাববাদ এবং মার্ক্সের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভংগি পরস্পর বিরোধী হইলেও উভয় দ্বন্দ্ববাদের প্রস্তাব একই। প্রত্যেক বস্তুর গর্ভে উহার বিপরীত আর একটি বস্তু আছে; এই দুই বিপরীত বস্তুর দ্বন্দ্বের ফলে হয় একটি তৃতীয় বস্তুর আবির্ভাব। আবার তৃতীয় বস্তুর গর্ভেও উহার বিপরীত আর একটি বস্তু থাকে এবং তাহাদের দ্বন্দ্বের ফলে আরেকটি নতুন বস্তুর আবির্ভাব ঘটে। এইভাবে এক বস্তু ও তাহার গর্ভস্থ বিপরীত বস্তুর বিরামহীন অবিচ্ছেদ্য দ্বন্দ্ব এক হইতে বহুর উৎপত্তি এবং সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের কারণ, ইহাই হেগেল ও মার্ক্সের দ্বন্দ্ববাদের মূল প্রস্তাব। তাঁহাদের দার্শনিক মতবাদের পার্থক্য এই যে, হেগেল মনে করেন, এই দ্বন্দ্বের মূল উৎস ভাব, আর মার্ক্স মনে করেন বস্তু। মার্ক্স বস্তুবাদী। সুতরাং তিনি মনে করেন, বস্তুই অনাদি ও অনন্ত, ভাব বাস্তব পরিবেশের সৃষ্টি অর্থাৎ ভাবের কোন বস্তুনিরপেক্ষ স্বাধীন অস্তিত্ব নাই। মার্ক্সের মতে, বাস্তব পরিবেশের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ভাবেরও পরিবর্তন ঘটে এবং এই অর্থে বস্তু-নির্ভর। দার্শনিক পরিভাষায় দ্বন্দ্বের প্রথম সত্তাটিকে নয়। দ্বিতীয়টিকে অন্বয় এবং তৃতীয়টিকে সমন্বয় বলা হয়। বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, হেগেল ও মার্ক্স উভয়েই নয়, অন্বয় ও সমন্বয় এই তিনটিকে ভিন্ন ভিন্ন সত্তা মনে করেন। এই দৃষ্টিভংগিতে ইতিহাস ব্যাখ্যা করিলে ইহাই বলিতে হয় যে, যে কোন সমাজের মধ্যে দুইটি পরস্পর-বিরোধী শ্রেণী থাকে ও ইহাদের দ্বন্দ্ব একটি তৃতীয় শ্রে সৃষ্টি করে এবং এই শ্রেণী-সংগ্রাম নতুন সৃষ্টির ফলে নতুন সমাজের জন্ম হয়। মার্ক্সের মতে এই শ্রেণীগুলি অর্থনৈতিক এবং দ্বন্দ্ব অর্থনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রাম। সুতরাং মার্ক্সের মতে, এই দুই বিপরীত অর্থনৈতিক শ্রেণীর দ্বন্দ্বের ফলে আর একটি তৃতীয় শ্রেণীর জন্ম হয়। এই তৃতীয় শ্রেণী আপাত প্রগতিশীল হইলেও পরে ইহাকেই আবার জালিমের ভূমিকায় দেখা যায়। মার্ক্স মনে করেন যে, এই শ্রেণী-সংগ্রামের অবসান ঘটিবে সেইদিন, যেদিন অর্থনৈতিক শ্রেণী-সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত শ্রেণী বিলুপ্ত হইয়া যাইবে অর্থনৈতিক শ্রেণীহীন সমাজের আবির্ভাবে। মার্ক্স বলেন যে, জালিম-শ্রেণী উৎপাদন যন্ত্রের অধিকারী এবং এই অধিকারে বঞ্চিত শ্রেণী মজলুম। সুতরাং বিশ্বের মজদুর যাহাদের শ্রম-মূল্য অপহরণ করিয়া মালিক-শ্রেণী বাঁচিয়া থাকে, যেই মজদূর বিশ্বের উৎপাদন-যন্ত্রের অধিকারী হইলেই শ্রেণী সংগ্রামের অবসান ঘটিবে; মজদুরকে উৎপাদন- যন্ত্রের অধিকারী হইতে হইলে মজদুরের রাজনৈতিক এক-নায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হইতে হইবে।
আমরা পূর্বেই বলিয়াছি যে, এই দ্বন্দ্ব জালিম ও মজলুমের দ্বন্দ্ব নয়- সমাজের অহং ও ভূমা-সত্তার দ্বন্দ্ব। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যে কোন শ্রেণীর মধ্যে অহং-প্রধান ও ভূমা-প্রধান লোক থাকে। দ্বন্দ্ব তাহাদের। মজলুম শ্রেণীর মধ্যেও এই দুই শ্রেণী দেখিতে পাওয়া যায়। অহং ও ভূমা-সত্তা দুইটি পৃথক বস্তু নহে, উহারা একই বস্তুর দুই বিপরীত ভাব। ইহাদের দ্বন্দ্বের ফলে ক্ষেত্র-বিশেষে কোন এক নতুন বস্তুর আবির্ভাব হইতে পারে; কিন্তু নতুন বস্তুর আবির্ভাব হইবেই এমন নহে। সাধারণত ইহারা বস্তুর দুইটি বিপরীত ভাব, সেই বস্তুর সামগ্রিক রূপান্তর ঘটে। এই দ্বন্দ্বে ভূমা প্রবল হইলে ফল শুভ এবং অহং প্রবল হইলে ফল অশুভ হয়। দ্বন্দ্বের ফল শুভ হইলে বস্তুর যে রূপান্তর ঘটে তাহা বিবর্তনমূলক এবং অশুভ হইলে নিবর্তমূলক হয়। সমাজ-জীবনে এই দ্বন্দ্ব নতুন কোন শ্রেণী সৃষ্টি হবে না, সমাজের বিবর্তন অথবা নিবর্তমূলক সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটায়। হেগেল ও মার্ক্সের দ্বান্দ্বিকত্রয়ী ন্বয়, অন্বয় ও সমন্বয় ইতিহাসের গতি-বৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা করিতে পারে না। অহং ও ভূমার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কই এই সমাজের জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও লয়ের প্রকৃত রহস্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে সমাজের জন্মের কারণ। সেই সমাজ-সৃষ্টির দ্বন্দ্ব সমাজের অন্তর্জগতে নহে, বহির্জগতে। কারণ ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দুইটি বিপরীতধর্মী প্রাকৃতিক শক্তির ফল। জনসংখ্যার আধিক্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক কারণে অথবা অন্য কোন প্রকার জুলুমে সমাজদেহের একাংশ মূল দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যে নতুন সমাজ সৃষ্টি করে, সেই সমাজ-সৃষ্টির দ্বন্দ্বও সমাজের অন্তর্জগতে, সমাজের অহং ও ভূমা-সত্তার দ্বন্দ্ব। আদর্শ যে সমাজের সৃষ্টি করে, সেই সমাজ-সৃষ্টির দ্বন্দ্ব ভৌতিক নহে ভূতোত্তর। বিশ্বস্রষ্টা রাব্বুল আলামীনের ইতিহাসের গতি-বৈচিত্র্য নিয়ন্ত্রণের বিধান অনুযায়ী যে অবিরাম ভাঙা-গড়া চলিতেছে, ইহা সেই ভাঙা-গড়ার দ্বন্দ্ব। প্রত্যেক বস্তুর গর্ভে তাহার বিপরীত আর একটি বস্তু আছে, একথা সত্য নহে; প্রত্যেক বস্তুরই দুইটি পরস্পর বিরোধী ধর্ম আছে- অর্থাৎ বস্তু মাত্রই দুইটি বিপরীত শক্তির সমন্বয় ইহাই সত্য। এই দ্বন্দ্ব শাশ্বত এবং ইহাই সৃষ্টির গূঢ়তম রহস্য এবং ইহাই সৃষ্টির গতি ও বৈচিত্র্যের এবং এক হইতে বহুর উৎপত্তির কারণ। সৃষ্টির এ সংগ্রাম অবিরাম ও অবিচ্ছিন্ন। ইহার অবলুপ্তিতে সৃষ্টিরও অবলুপ্তি ঘটিতে পারে। এইভাবে কোন ব্যক্তির অন্তরে অহং ও ভূমার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিলে সেই ব্যক্তি নির্বাণ, মোক্ষ, মুক্তি, কৈবল্য বা বেলায়েত হাসিল করে এবং অন্তর্দ্বন্দ্ব ও উহার বহিঃপ্রকাশের ঊর্ধ্বে স্থিত হইয়া নির্বিকার চিত্তের অনাবিল আনন্দের অধিকারী হয়।
(সমাজবিজ্ঞান ও ইসলাম গ্রন্থ থেকে সংকলিত)