যুব সমাজের প্রত্যয় ও প্রচেষ্টা

[১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ই ও ৬ই নভেম্বর সিরাজগঞ্জ নাট্যভবনে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলনের সভাপতি রূপে কবি নজরুল ইসলাম এই অভিভাষণ প্রদান করেন।]

আমার প্রিয় তরুণ যুবকগণ!

আপনারা কি ভেবে আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তিকে আপনাদের সভাপতি নির্বাচন করেছেন, জানিনা। দেশের জাতির ঘনঘোর ঘেরা দুর্দিনে দেশের জাতির শক্তিমজ্জা প্রাণস্বরূপ তরুণদের যাত্রাপথের দিশারি হবার স্পর্ধা বা যোগ্যতা আমার কোনোদিন ছিল না, আজও নাই। আমি দেশকর্মী, দেশনেতা নই; যদিও দেশের প্রতি আমার মমত্ববোধ কোনো স্বদেশপ্রেমিকের অপেক্ষা কম নয়। রাজ-লাঞ্ছনা ও ত্যাগ-স্বীকারের মাপকাঠি দিয়া মাপলে হয়তো আমি তাঁদের কাছে খর্ব বলে অনুমিত হইবো। তবু দেশের জন্য অন্তত এটুকু ত্যাগ স্বীকার করেছি যে, দেশের মঙ্গল করতে না পারলেও অমঙ্গলচিন্তা কোনদিন করি নি, যাঁরা দেশের কাজ করেন তাঁদের পথে প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াই নাই। রাজ-লাঞ্ছনার চন্দন তিলক কোনোদিন আমারও ললাটে ধারণ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো, কিন্তু তা আজ মুছে গেছে। আজ তা নিয়ে গৌরব করার অধিকার আমার নাই।

আমার বলতে দ্বিধা নাই যে, আমি আজ তাদেরই দলে যাঁরা কর্মী নন- ধ্যানী। যাঁরা মানবজাতির কল্যাণ সাধন করেন সেবা দিয়া, কর্ম দিয়া, তাঁরা মহৎ; কিন্তু সেই মহৎ হবার প্রেরণা যারা জোগান, তাঁরা মহৎ যদি না-ই হন অন্তত ক্ষুদ্র নন। তারা থাকেন শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো গোপন, ফুলের মাঝে মাটির মমতা রসের মতো অলক্ষ্যে। আমি কবি। বনের পাখির মতো স্বভাব আমার গান করায়। কারো ভালো লাগলেও গাই, ভালো না লাগলেও গেয়ে যাই। বায়স-ফিঙে যখন বেচারা গানের পাখিকে তাড়া করে, তীক্ষ্ণ চঞ্চ দ্বারা আঘাত করে, তখনও সে এক গাছ হইতে উড়ে অন্য গাছে গিয়ে গান ধরেন। তার হাসিতে গান, তার কান্নায় গান। সে গান করে আপনার মনের আনন্দে, যদি তাতে কারো অলস-তন্দ্রা মোহ-নিদ্রা টুটে যায়, তা একান্ত দৈব। যৌবনের সীমা পরিক্রমণ আজো আমার শেষ হয় নি, কাজেই আমি যে গান গাই তা যৌবনের গান। তারুণ্যের ভরা ভাদরে যদি আমার গান জোয়ার এনে থাকে তা আমার অগোচরে। যে চাঁদ সাগরে জোয়ার জাগায় সে হয়তো তার শক্তির সম্বন্ধে আজো লা-ওয়াকিফ।

আমি বক্তাও নই। আমি কম বক্তার দলে। বক্তৃতায় যাঁরা দিগ্বিজয়ী বখতিয়ার খিলজি, তাঁদের বাক্যের সৈন্য-সামন্ত অত দ্রুত বেগে কোথা হতে কেমন করে আসে বলতে পারি না। তা দেখিয়া লক্ষ্মণ সেন অপেক্ষাও আমরা বেশি অভিভূত হয়ে পড়ি। তাঁদের বাণী আসে বৃষ্টিধারার মতো অবিরল ধারায়। আমাদের কবিদের বাণী বহে ক্ষীণ ঝর্নাধারার মতো। ছন্দের দু-কূল প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে সে সঙ্গীতগুঞ্জন করতে করতে বহে যায়। পদ্মা-ভাগীরথীর মতো খরস্রোতা যাঁদের বাণী আমি তাঁদের বহু পশ্চাতে।

আমার একমাত্র সম্বল, আপনাদের-যুবকদের প্রতি আমার অপরিসীম ভালোবাসা, প্রাণের টান। তারুণ্যকে-যৌবনকে আমি যেদিন হতে গান গাইতে শিখেছি সেই দিন হইতে বারে বারে সালাম করেছি, তাজিম করেছি, সশ্রদ্ধ নিবেদন করেছি। গানে কবিতায় আমার সকল শক্তি দিয়া তারই জয় ঘোষণা করেছি, স্তব রচনা করেছি। জবাকুসুমসঙ্কাশ তরুণ অরুণকে দেখে প্রথম মানব যেমন করে সশ্রদ্ধ সালাম করেছিলেন, আমার প্রথম জাগরণ প্রভাতে তেমনি সশ্রদ্ধ বিস্ময় নিয়ে যৌবনকে অন্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি, তার স্তবগান গেয়েছি। তরুণ অরুণের মতোই যে তারুণ্য তিমিরবিদারী সে যে আলোর দেবতা। রঙের খেলা খেলতে খেলতে তার উদয়, রঙ ছড়াতে ছড়াতে তাহার অস্ত। যৌবনসূর্য যথায় অস্তমিত, দুঃখের তিমিরকুন্তলা নিশীথিনীর সেই তো লীলাভূমি।

আমি যৌবনের কাণ্ডারি কবি বলেই যদি আমাকে আপনারা আপনাদের মালার মধ্যমণি করে থাকেন, তা হলে আমার অভিযোগ করার কিছুই নাই। আপনাদের এই মহাদান আমি সানন্দে শির নত করে গ্রহণ করলাম। আপনাদের দলপতি হয়ে নয়। আপনাদের দলভুক্ত হয়ে, সহযাত্রী হয়ে। আমাদের দলে কেউ দলপতি নাই; আজ আমরা শত দিক হইতে শত শত যুবক মিলে তারুণ্যের শতদল ফুটিয়ে তুলেছি। আমরা সকলে মিলে এক সিদ্ধি এক ধ্যানের মৃণাল ধরে বিকশিত হতে চাই। আজ সিরাজগঞ্জে এসে সর্বপ্রধান অভাব অনুভব করছি আমাদের মহানুভব নেতা-বাংলার তরুণ মুসলিমের সর্ব প্রথম অগ্রদূত তারুণ্যের নিশানবরদার মওলানা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী সাহেবের। সিরাজগঞ্জের শিরাজীর সাথে বাংলার শিরাজ, বাংলার প্রদীপ নিভে গেছে। যাঁর অনল-প্রবাহ, সম বাণীর গৈরিক নিঃস্রাব জ্বালাময়ী ধারা মেঘ-নিরন্ধু গগনে অপরিমাণ জ্যোতি সঞ্চার করেছিল, নিদ্রাতুরা বঙ্গদেশ উন্মাদ আবেগ নিয়ে মেতে উঠেছিল, ‘অনল প্রবাহের’ সেই অমর কবির কণ্ঠস্বর বাণীকুঞ্জে আর শুনতে পাইব না। বেহেশতের বুলবুলি বেহেশতে উড়ে গেছে। জাতির কওমের দেশের যে মহা ক্ষতি হয়েছে, আমি শুধু তার কথাই বলতেছি না, আমি বলিতেছি আমার একার বেদনার ক্ষতির কাহিনী। আমি তখন প্রথম কাব্যকাননে ভয়ে ভয়ে পা টিপিয়া টিপিয়া প্রবেশ করিয়াছি-ফিঙে বায়স বাজপাখির ভয়ে ভীরু পাখির মতো কণ্ঠ ছাড়িয়া গাহিবারও দুঃসাহস সঞ্চয় করতে পারি না,  নখচঞ্চুর আঘাতও যে না খেয়েছি এমন নয়-এমনি ভীতির দুর্দিনে মনি- ওর্ডারে আমার নামে দশটি টাকা এসে হাজির। কুপনে শিরাজী সাহেবের হাতে লেখা: ❝তোমার লেখা পড়িয়া খুশি হয়ে দশটি টাকা পাঠালাম। ফিরাইয়া দিও না, ব্যথা পাইব। আমার থাকলে দশ হাজার টাকা পাঠাতাম।❞ চোখের জলে স্নেহসুধা- সিক্ত ঐ কয় পংক্তি লেখা বারে বারে পড়িলাম; টাকা দশটি নিয়ে মাথায় ঠেকাইলাম। তখনো আমি তাঁকে দেখি নাই। কাঙাল ভক্তের মতো দূর হইতেই তাঁর লেখা পড়েছি, মুখস্থ করেছি, শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি। সেইদিন প্রথম মানসনেত্রে কবির স্নেহ-উজ্জ্বল মূর্তি মনে মনে রচনা করলাম, গলায় পায়ে ফুলের মালা পরালাম। তাহার পর ফরিদপুর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কনফারেন্সে তাঁর জ্যোতিবিমণ্ডিত মূর্তি দেখলাম। দুই হাতে তাঁর পায়ের তলার ধূলি কুড়িয়ে মাথায় মুখে মাখিলাম। তিনি আমায় একেবারে বুকের ভিতর টেনে নিলেন, নিজে হাতে করিয়া মিষ্টি খাওইয়া দিতে লাগলেন। যেন বহুকাল পরে পিতা তার হারানো পুত্রকে ফিরে পেয়েছি। আজ সিরাজগঞ্জে এসে বাংলার সেই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মনস্বী দেশপ্রেমিকের কথাই বারে বারে মনে হইতেছে। এ যেন হজ্জ করতে এসে কাবা শরিফ না দেখে ফিরে যাওয়া। তাঁর রুহ মোবারক হয়তো আজ এই সভায় আমাদের ঘিরে রয়েছে। তাঁরই প্রেরণায় হয়তো আজ আমরা তরুণেরা এই যৌবনের আরাফাত ময়দানে এসে মিলিত হয়েছি। আজ তাঁর উদ্দেশ্যে আমার অন্তরের অন্তরতম প্রদেশ হতে শ্রদ্ধা, তসলিম নিবেদন করছি, তাঁর দোয়া ভিক্ষা করছি।

আপনারা যে অপূর্ব অভিনন্দন আমায় দিয়েছেন, তার ভারে আমার শির নত হয়ে গিয়েছে, আমার অন্তরের ঘট আপনদের প্রীতির সলিলে কানায় কানায় পুরিয়া উঠেছে। সেই পূর্ণঘটে আর শ্রদ্ধা প্রতিনিবেদনের ভাষা ফুটতেছে না। আমার পরিপূর্ণ অন্তরের বাকহীন শ্রদ্ধা-প্রীতি-সালাম আপনারা গ্রহণ করুন। আমি উপদেশের শিলাবৃষ্টি করিতে আসি নাই। প্রয়োজনের অনুরোধে যা না বলিলে নয়, শুধু সেইটুকু বলিয়াই আমি ক্ষান্ত হইব।

১১৩১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top