ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উপমহাদেশের মুসলিম নারী

 সুদীর্ঘ ৭০০ বছর সমগ্র উপমহাদেশকে ন্যায়ভিত্তিকভাবে পরিচালনাকারী ইসলামী সভ্যতার জাজ্জ্বল্যমান আলোক শিখাকে নিভিয়ে দিয়েছিল পরবর্তী দু’শ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন। ইংরেজদের হাতে ১৭৫৭ সালে মুর্শিদাবাদ এবং ১৮৫৭ সালে দিল্লির পতন হলেও তারও প্রায় দু’শ বছর আগেই বাণিজ্যের নামে সাম্রাজ্যবাদীরা এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল এবং ধীরে ধীরে নিজেদের চক্রান্তের জাল বিস্তার করেছিল। অবশেষে পলাশীর বিজয়ের পর তারা সরাসরি দৃশ্যপটে চলে আসে এবং পরবর্তীতে তারা প্রত্যক্ষভাবে উপমহাদেশে শাসনের নামে নিকৃষ্ট শোষণ ও লুণ্ঠন চালায় । এই দীর্ঘ সময়ের শাসন ও শোষণ ভারতীয় উপমহাদেশকে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই পঙ্গু করেনি; সাম্প্রদায়িক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভেদের বিষবৃক্ষও রোপন করা হয়েছিল এই সময়েই। হরণ করা হয়েছিল সাধারণ মানুষের বাক স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, কর্ম ও ভোগের স্বাধীনতা! পাশাপাশি ভয়াবহ জুলুম, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, নিকৃষ্ট শোষণের ফলশ্রুতিতে মানসিকভাবে ব্রিটিশ আজ্ঞাবহ শ্রেণি গড়ে তুলে এ অঞ্চলে জুলুমবিরোধী সকল আন্দোলনকে নিস্তব্ধ করার সব ধরণের চেষ্টাই তারা করেছে। ব্রিটিশ কারিকুলামে শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করে এ ভয়াবহ শোষণকে তারা জায়েজীকরণ করে, তাদের নীতি আদর্শে গড়ে উঠা চিন্তক, লেখক, সাহিত্যিকদের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের মানসপটে এর ইতিবাচক একটি চিত্র ফুটিয়ে তুলে।

ব্রিটিশদের দু’শ বছরের শাসনে পরাধীনতার গ্লানিতে ছেয়ে যায় সমগ্র ভারতবর্ষ। এই পরাধীনতার জিঞ্জির থেকে মুক্তি পেতে শুরু থেকেই হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যেই ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম দানা বাঁধে। স্বাধীনতা সংগ্রাম যাতে ঐক্যবদ্ধ রূপ ধারণ করতে না পারে সেজন্য ব্রিটিশ শাসকেরা ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি প্রবর্তন করেছিল। তাদের এই হীন প্রয়াস ক্ষেত্র বিশেষে সফলও হয়েছিল। তবে এ মাটির সংগ্রামী সন্তানরা নিকৃষ্ট ব্রিটিশ শাসনকালে বিদ্যমান ভয়াবহ জুলুমকে উপলব্ধি করেছিল । তারা বুঝেছিল সম্মুখ লড়াই ছাড়া মুক্তির আর কোনো দুয়ার খোলা নেই। ফলে ব্যক্তিক, সামাজিক বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তারা দলে দলে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত হয়। ভারতের ইতিহাসে মুসলিম সংগ্রামীরা প্রকৃত মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি না পেলেও শোষণের বিরুদ্ধে তাদের আপ্রাণ লড়াই, অবিচল দৃঢ়তার সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, কারাবরণ, অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন- এগুলোকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছেও ফেলা যায়নি। ইতিহাসের এই দলীলগুলো একইসাথে আমাদের আত্মবিশ্বাসের অন্যতম উৎস, আমাদের সংগ্রামমুখর ঐতিহাসিক ইশতেহারের অন্যতম অনুপ্রেরণা।
স্বাধীনতা আন্দোলনে তিতুমীর, মুসা শাহ, মজনু শাহদের পাশাপাশি বি আম্মা, লালবিবি, বেগম মহলরাও বীরত্ব ও সাহসিকতার উজ্জ্বল নজির স্থাপন করেছেন। কখনো সম্মুখে লড়াই করেছেন, কখনো পেছন থেকে সাহস জুগিয়েছেন, কখনো-বা হেঁটে হেঁটে জনসমর্থন আদায় করেছেন। যে হাতে অস্ত্র ধরে জালিমের সামনে হুঙ্কার তুলেছেন, সে হাতের কোমল স্পর্শে মজলুমের ব্যাথা উপশম করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই শাসকচক্রের রোষাণলেও পড়েছেন, ঘৃণ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন, বুক চিতিয়ে মৃত্যুকে বরণ করেছেন, সম্ভ্রম দিয়েছেন, তবু সংগ্রামের পথ থেকে পিছপা হননি। কিন্তু আফসোস, ইতিহাসে তাদের এই বর্ণাঢ্য সংগ্রামের বর্ণনা সেভাবে পাওয়া যায় না। তার কারণ প্রধানত তিনটি-
  • আমাদের একাডেমিক জগতে এ ইতিহাসের চর্চা না থাকা।
  • নারীদের ব্যাপারে সামাজিক বিভিন্ন বাড়াবাড়ি।
  • ইসলামী ঘরণায় নারীদের রাজনীতির প্রচলন কম থাকা।
তবুও ইতিহাসের পাতায় যে ক’জন অবিচল সংগ্রামী নারীর নাম পাওয়া যায়, যারা সকল হুমকির মুখে দাঁড়িয়েও আমৃত্যু সংগ্রাম করে গিয়েছেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে এখানে তুলে ধরছি,
লাল-বিবি : জ্ঞানে, গুণে, কর্মে-বীরত্বে ও তেজস্বিতায় রাণী লালবিবি ছিলেন সেকালের নারী সমাজের শিরোমণি। তাছাড়া তাঁর আজাদী মানসিকতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব ও দেশপ্রেম তাকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে। রাণী লালবিবি দেশের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে স্বামীর হাতে ও পরবর্তীকালে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহীদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের ব্যক্তিগত ধন ভাণ্ডারের সমস্ত অর্থ, এমনকি হীরা-জহরত পর্যন্ত। ফকির বিদ্রোহের প্রধান নায়ক মজনু শাহ লালবিবির কাছ থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। মূলত মজনু শাহের আজাদী যুদ্ধ প্রেরণার মূল উৎসস্থল ছিলো বীরভূমের রাজবাড়ি তথা লালবিবির দেশপ্রেমে উদ্দীপনাময়ী ভাষণ। সেই সঙ্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্বামী, বীরভূমের রাজা আসাদ-উজ- জামানকে তিনি সর্বতোভাবে সাহায্য করতেন। সেনা সংগ্রহে লাল বিবিই প্রধান সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। পরে সারা বীরভূম জুড়ে ইংরেজ বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন এই অভিযোগে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস লালবিবিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
বেগম হজরত মহল : ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের অন্যতম নায়িকা ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে অনেকেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং আজও করে থাকেন। কিন্তু লক্ষ্মী-এর বেগম হজরত মহল আশ্চর্যজনকভাবে বাঙালীদের কাছে প্রায় উপেক্ষিতই বলা যায়। পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায়ের লেখনিতে বেগমের অসামান্য তেজস্বিতার পরিচয় ধরা পড়ে, যিনি দুঃসময়ে অস্ত্র হাতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন এক অকুতোভয় স্বাধীনতার সৈনিকে। ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করতে তিনি এক শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন করেন। লক্ষ্ণৌতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লে এক পর্যায়ে চরম মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে! তখন তিনি সাম্রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে সৈনিকের বেশে হাতির পিঠে আরোহণ করেন। বেগমের প্রভাবে সমগ্র অযোধ্যার লাখ লাখ মানুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অস্ত্র পরিচালনা করতে না পারা প্রায় এক লাখ মানুষ শুধু বেগমের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে যুদ্ধে অংশ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
জীনাত মহল : তিনি শেষ মুঘল সুলতান দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের স্ত্রী। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানী লাভের পর ১৮৫৭ সাল অবধি গোটা মুঘল সালতানাত ইংরেজরা দখল করে নেয়। ইংরেজরা সুলতানকে মোটা অঙ্কের বৃত্তি প্রদান করলে সুলতান তাতে সন্তুষ্ট হয়ে যান। কিন্তু সুলতান স্ত্রী জীনাত মহলের রক্তে জ্বলে উঠলো স্বাধীনতা ও ঐতিহ্য চেতনার আগুন। জগৎ তোলপাড় করা ‘মুঘল সালতানাত’ এমন করুণভাবে ভারতের বুক থেকে বিদায় নেবে একথা ভাবতে কষ্ট হয় জীনাত মহলের। কিন্তু বৃদ্ধ সুলতান চুপচাপ। অত বড় ইংরেজ শক্তিকে তিনি ঘাটাতে চান না এই বয়সে। জীনাত মহলের সংগ্রামী মন কিছুতেই তা মানছে না। অপরদিকে দেশের বীর সিপাহী জনতার মনে এই চিন্তা চেতনা জেগে উঠলো যে, কোনোক্রমেই দিল্লির পতন ঘটতে দেওয়া যায় না। নিজের দেশে ইংরেজদের শাসনের নাগপাশে আবদ্ধ থাকতে হবে, এটা মেনে নিতে রাজি নয় বীর সিপাহী জনতা। জীনাত মহল এই সুযোগটি গ্রহণ করলেন অতি দক্ষতার সঙ্গে। তিনি গোপনে যোগাযোগ করলেন এসব দেশপ্রেমিক সৈনিকদের সঙ্গে। তিনি এসে দাঁড়ালেন দেশের সৈনিকদেরকে উৎসাহ যোগাতে সুলতানের কাছে। তিনি সুলতানকে বোঝাতে সক্ষম হলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা। বেগমের সাহসিকতাপূর্ণ প্রস্তাবে বাহাদুর শাহের চেতনা ফিরে এল। দিল্লির দূর্গে গোপনে সংগ্রামপূর্ব প্রস্তুতি নিতে লাগলেন বেগম জীনাত মহল। তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে সিপাহী বিপ্লব কীভাবে সার্থক করা যায় তা নিয়ে বিপ্লবী সেনাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। অবশেষে ১৮৫৭ সালের ২৩ জুন বিপ্লবের দিন ঠিক হলো। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর বিপ্লবীদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২১ এপ্রিল সিপাহী মঙ্গল পান্ডেকে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো। পান্ডের ফাঁসির প্রতিশোধ নিতে চারদিকে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়লো। সিপাহী জনতা বুকের রক্ত ঢেলে প্রতিশোধ নিয়ে চললো। অতি শীঘ্রই দিল্লি নগরী বিপ্লবীদের দখলে এলো। বিভিন্ন স্থান থেকে পালিয়ে এসে বিপ্লবীরা আশ্রয় নিতে শুরু করলো দিল্লিতে। জীনাত মহলের হৃদয় কেঁদে উঠলো। তিনি আশ্রয় দিতে লাগলেন সিপাহী জনতাকে। আশ্রয় দিতে লাগলেন দিল্লির আশপাশে বসবাসরত সাধারণ ইংরেজদেরকে, যারা সিপাহী জনতার আক্রমণের ভয়ে বেগমের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপ্লবীদের রক্ষা করা গেলো না। ইংরেজদের ষড়যন্ত্র ও তাদের কুটবুদ্ধিতে জড়িয়ে গেলো অনেক সেনা ও দেশীয় নেতা। ফলে বিপ্লবের ধারা ঘুরে গেলো। এই অবস্থায় জীনাত মহলের আর কী করার আছে! তিনি ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইলেন। কিন্তু ইংরেজদের পক্ষ থেকে উত্তর এলো নেতিবাচক। এই অবস্থায় জীনাত মহল পালিয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য পরামর্শ দিলেন দেশপ্রেমিক সিপাহী জনতাকে। বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নিয়ে তিনি আত্মগোপন করলেন হুমায়ুনের সমাধিতে। পরে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে বন্দী হন সম্রাট ও তাঁর স্ত্রী জীনাত। বিপ্লবী মীর আহমদ চৌধুরির মাতা চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের বিপ্লবীরা এই নারীকে মাসী, পিসী বা ঠাকুরমা বলেই ডাকতো। বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা ছিলো তাঁর বাড়ি। তিনি বিপ্লবীদের নানাভাবে সাহায্য করতেন। দামাল ছেলেগুলোকে তিনি প্রায় পিঠা তৈরি করে আদর আপ্যায়ন করতেন।
জামানী খাতুন : মহাবিদ্রোহের সর্বভারতীয় নেতা শেষ মুঘল সম্রাটের (দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ) কন্যা। সিপাহী বিদ্রোহের সাহসী যোদ্ধা। ইংরেজরা তাকে বন্দি করে রেঙ্গুনের জেলে পাঠায়।
বি-আম্মা : স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল তারকা। তিনি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, অর্থ সংগ্রহ করেছেন, গোটা ভারতবর্ষ ঘুরে ঘুরে নারীদের যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। তিনি কলকাতা অধিবেশনে স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীসহ যোগদান করেন এবং জ্বালাময়ী ভাষণে ভারতের নারীদের দেশের সেবায় বীর মাতারূপে ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, “আমার সন্তানেরা স্বদেশের জন্য কারাবরণ করায় জননী হিসেবে আমি গর্ববোধ করছি। ” “যা হবার তাতো হবেই, জুলুম করতে করতে জালিম নিজেই ক্লান্ত হয়ে যাবে।” মহাত্মা গান্ধীর সাথে অসহযোগ আন্দোলনের প্রচারকার্যে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ও বাংলাদেশ ভ্রমণ করে তিনি বাংলার মুসলিমদের মধ্যে এক অভূতপূর্ব সাড়া ফেলেন। তার আহ্বানে মুসলমানরা দলে দলে যোগ দেন অসহযোগ আন্দোলনে। হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলন-মৈত্রী গড়তে আজীবন লড়ে গেছেন তিনি। ভারতের সকল জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষকে তিনি নিজের সন্তান মনে করতেন।
বেগম দৌলৎ-উন-নেসা : বাঙালী নারীদের মধ্যে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে দৌলত-উন-নেসার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেশের সেবা করতে গিয়ে তাকে বহু লাঞ্ছনা ও অপবাদ সহ্য করতে হয়েছিলো। তবুও তিনি দমে যাননি। ১৯৩০ সালের লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সভা ও শোভাযাত্রায় তার সরব উপস্থিতি ছিলো। ১৯৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি ‘গাঁইবাধা মহিলা সমিতি’ গড়ে তুলেছিলেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দী করে রাখে, তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়। নুরুন্নেসা : শহীদ টিপু সুলতানের বংশের সন্তান। তিনি কয়েকটি ভাষা শিখেছিলেন ও বিদেশিদের মতোই ইংরেজি বলতে পারতেন। গুপ্তচর বৃত্তিতে নাম লিখান। বিশেষভাবে তিনি গেরিলা ট্রেনিংও নিয়েছিলেন। ভারত ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক স্তরে গোয়েন্দাবৃত্তির কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। ফ্রান্স থেকে জার্মানীতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন। তাঁকে শাস্তি স্বরূপ দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাতেও শাস্তির শেষ হয়নি মনে করে তাঁর দেহটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়। ইংল্যান্ডে তিনি বিমান চালনার ট্রেনিংও নিয়েছিলেন। (মুক্তির সংগ্রামে ভারত, পঃ বঃ সরকার, পৃ. ১৭২)

বেগম হোসনে আরা : যখন নেতৃস্থানীয় সকল ব্যক্তিই ব্রিটিশ কারাগারে তখন এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অন্দর মহল ছেড়ে বেরিয়ে আসে মেয়েরা। এই সঙ্কটময় মুহুর্তে যে সকল মুসলিম নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অকুতোভয়ে অগ্রসর হয়, জাতীয় পতাকা হাতে সুদৃঢ় পদক্ষেপে তালে তালে চলে ও আইন অমান্য করে বন্দীজীবন বরণ করে নেয়, তাদের মধ্যে হোসনে আরার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি ছিলেন একাধারে দেশ ও সমাজসেবিকা এবং কবি। বিদেশি দ্রব্য বর্জন, স্বদেশের কুটির শিল্পের উজ্জীবন, উন্নয়ন ও প্রচারে তিনি উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রাখেন। বিদেশি শাসন তার কাছে ছিলো গ্লানিকর। দেশ স্বাধীন করতে হলে মেয়েদেরকে পুরুষের পাশে থেকে কাজ করতে হবে, ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, কারাবরণ করতে হবে এই ছিলো হোসনে আরার ঘোষণা। বৃটিশ বিরোধিতার জন্য তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। আলিপুর ও বহরমপুরের দুই সেন্ট্রাল জেলে তাঁকে রাখা হয়েছিলো। তিনি লিখেছেন-
“নূতন দিনের দীপ্ত আলোয় ভরেছে ভূবনখানি
আঁধার পুরীর আগল ভেঙেছে
অন্ধ পেয়েছে আঁখি।
বন্দিনীগণ বাঁধন ছিঁড়েছে
মুক্ত হয়েছে নাকি?”
জয়তুন বিবি, সুফিয়া বিবি : বৃটিশ নীলক্যানের বিরুদ্ধে তারা অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন। নীলচাষ বিরোধী আন্দোলনে অজস্র প্রতিবন্ধকতা এড়িয়েও আন্দোলন চালিয়ে গেছেন।
ফুলবাহার বিবি : ফুলবাহার পাইক পাড়ার কিরণ রুদ্রের সঙ্গে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৩২ সালের আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় তাঁর ছয়মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তাঁকে ঢাকা ও বহরমপুরের জেলে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়।
রাজিয়া খাতুন : অল্প বয়সী রাজিয়া ১৯৩০-৩২ সালের কংগ্রেস আন্দোলনে যোগদান করেন। শুধু তাই নয়, ময়মনসিংহের বিপ্লবী যুগান্তর দলের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিলো। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ও অনেক নির্যাতন ভোগ করেন।
হালিমা খাতুন : আইন অমান্য আন্দোলন ও ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে অমানবিক নির্যাতন ভোগ করেন। বিপ্লবী যুগান্তর দলের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এছাড়াও রকিনা খাতুন, বদরুন্নেসার নাম আইন অমান্য আন্দোলনের শীর্ষে স্মরণীয় হয়ে আছে।
শামসুননেসা, রওশন আরা, রাইসা বানু : এই তিন মহীয়সী আইন অমান্য আন্দোলনের সময় সত্যাগ্রহীদের সাধ্যমতো সাহায্য করেন। সম্ভ্রান্ত বংশের নারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজে সহায়তা ও অর্থ সাহায্য করেন। তাঁদের কারাগারে কয়েকমাস বন্দী রাখা হয়। বেগম শাহনাওয়াজ, বেগম কামালুদ্দিন, বেগম শাহজাদি : তারা পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা। জাতীয়তাদী আন্দোলন এ অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন এবং বহু নির্যাতন ভোগ করেন। (বাঙালী স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান)
জোবেদা খাতুন চৌধুরি : লবণ আইন আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য। শ্রীহট্টের নারী সংঘের সদস্যরূপে তিনি এ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৮ সালে সিলেট থেকে কংগ্রেসের প্রথম নারী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর আর্তের সেবায় নিযুক্ত হন। তিনি এজন্য রেডক্রসের পক্ষ থেকে ‘করোনেশন পদক’ পান। (বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান 2.90)
নাজিমুন্নেসা আহমেদ : কলকাতায় ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ গঠন করেন ও নারীদের সংগঠিত করেন। খাদ্য আন্দোলনে যোগ দেন। (বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান পৃ. ৯৮)
ফতিমা জিন্নাহ : ছোটবেলা থেকেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে যোগ দেন । নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনে নারীদের শামিল করার জন্য নারী শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন।
বেগম শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ : তিনি ছাত্রী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। নারী সংগঠন গড়ে তোলেন। স্বামীর বাধা সত্ত্বেও জাতীয় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, স্বাধীনতার লড়াই থেকে সরে দাঁড়াননি।
আয়েশা বাণু : সূর্য সেনের বিপ্লবী দলে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের সঙ্গে আয়েশা বাণুর নামও ছিলো সমভাবে। কিন্তু ইতিহাস তার নাম লিখতে কার্পণ্যই বোধ করেছে হয়তো। তখন আয়েশাকে বলা হতো ‘সূর্যসেনের বিপ্লবী কন্যা’। তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী কবিতা লিখে বিপ্লবীদের উদ্দীপনা জোগাতেন।
বেগম সাকিনা ফারুক : ছোট বেলায়ই কংগ্রেসের বিপ্লবী শাখায় যোগ দেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন (বাঙালী স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান, পৃ. ১৩৩)।
বেগম হামিদ আলি : কমিউনিস্ট নারী নেত্রী। জাতীয় আন্দোলনে যোগ দিয়ে অশেষ নির্যাতন সহ্য করেন। (বাঙালী স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান পৃ. ১৩১)
রাহেলা : তেভাগা আন্দোলনের বিখ্যাত নারী কর্মী। গ্রেফতার হয়ে পুলিশের সীমাহীন নির্যাতন সহ্য করেছেন। তিনি রাজশাহী জেলে ছিলেন। (ঐ, পৃ. ১৭১)
রিজিয়া : বিপ্লবী দীপালি সংঘের সদস্য হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেন। কলকাতার আঞ্জুমান-এ-আখাওয়াতিন এর সদস্যা ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ উপাধি দেয় কিন্তু ব্রিটিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি এই উপাধি বর্জন করেন। অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কাউন্সিল ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্স কাউন্সিলের সদস্যা হিসেবে বহু সমাজ সেবামূলক কাজ করেন। (ঐ, পৃ. ২০৪)
বেগম শামসুন্নাহার : তিনি ছিলেন প্রথম মুসলিম নারী পাইলট। জাতীয় আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য।
সুলতানা মকসুদা : শ্রমিক-কর্মচারীদের বিপ্লবী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বিশেষ করে ধাঙড় আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। অনেক নির্যাতন ভোগ করেন ।
অরুনা আসফ : আগষ্ট বিপ্লবের বীরাঙ্গনা। ছিলেন সমাজসেবী। পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে ও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩০ সালে রাজদ্রোহিতার অপরাধে তার একবছরের কারাদণ্ড হয়। ১৯৪১ সালে মহাত্মা গান্ধী ভারতকে ব্রিটিশ কর্তৃক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অকারণে লিপ্ত করার প্রতিবাদে যে ব্যক্তিগত আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন তাতে যোগ দিয়ে এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি আত্মগোপন করে থাকেন, ফলে তাঁকে ‘আউট ল’ করা হয় এবং মৃত বা জীবিত অবস্থায় ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষিত হয়। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়লে মহাত্মা গান্ধী তাকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিলেও তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। ১৯৪৬ সালে তাঁর গ্রেপ্তারের সময় তুলে নেওয়া হলে তিনি প্রকাশ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯৪৬ সালের রাজকীয় ভারতীয় নৌবাহিনীর বিদ্রোহে বামপন্থী রাজনৈতিক দল, শ্রমিক শ্রেণি ও বিদ্রোহীদের পূর্ণ সমর্থন করেন। (স্বাধীনতা সংগ্রামী চরিতাভিধান, ননীগোপাল দাস, পৃ. ৯)
মাজেরা খাতুন : দেশকে স্বাধীন করতে তিনি একটি নারী বাহিনী তৈরি করেছিলেন। বাহিনীর প্রত্যেকের পরনে থাকতো মোটা পাজামা, পায়ে মোজার উপরে শক্ত জুতো। জামার উপর মোটা কোট আর মাথার চুল ঢেকে তাঁর উপর একটি পাগড়ি। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াইয়ের শেষে তিনি নিজে ও তাঁর দলের বেশিরভাগ বীরাঙ্গনা শহীদ হয়েছিলেন। যে সব মুসলিম নারী যুদ্ধে বন্দী হয়েছিলেন তাদের উপর অমানুষিক ও পাশবিক অত্যাচার চালাতে ব্রিটিশ সরকার কসুর করেননি। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হলো, বন্দী হবার পূর্ব পর্যন্ত অনুমান করা যায়নি যে তারা নারী ছিলেন ।
বেগম আসগারী : ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের এক দুঃসাহসী নায়িকা। স্বাধীনতা আন্দোলনের নিরলস সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ার পর তাকে জীবন্ত অবস্থায় অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা হয় । জামিলা খাতুন : এ অঞ্চলের আরেক দুঃসাহসী নারী জামিলা খাতুন। ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্টে সৈন্যদের খাবার তৈরির সময় তাতে বিষ মিশিয়ে দিয়ে একসঙ্গে বহু সৈন্যকে শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিলো-এ কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন জামিলা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন, ফলে তার ফাঁসি হয়।
বেগম বেলায়েত ও বেগম এনায়েত : দুজনেই ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং ইংরেজ ও তাদের আমলাদের দ্বারা নানা নির্যাতন ও অমানবিক শাস্তি সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বেগম রোকেয়া : সমাজ সংস্কারক ও সাহিত্যিক। আমরা জানি ব্রিটিশ শোষণের একটি দিক ছিলো আমাদের দেশীয় কুটির শিল্প ও বস্ত্রশিল্প ধ্বংস করা। এই সাহসী এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নারী এর বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। নারী উন্নয়ন বিশেষ করে মুসলিম নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য তিনি সারা জীবন লড়াই করে দেখিয়েছেন, নারীর সহায়তা না পেলে একা পুরুষের চেষ্টায় দেশের স্বাধীনতা আনা সম্ভব নয়। প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান না করলেও অনগ্রসর সমাজের নারীদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাবার যে প্রচেষ্টা তিনি সারাজীবন ধরে করে গেছেন তার মূল্য পরিমাপযোগ্য নয়।
বেগম সুফিয়া কামাল : একজন প্রতিবাদী কবি, সমাজসেবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। কিশোর বয়স থেকেই তিনি স্বদেশী আন্দোলনে অংশ নেন। পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে চরকায় সুতো কাটা ও খদ্দর বোনার কাজ করতেন। তিনি। এর ফাঁকে লুকিয়ে সভা মিছিলে যোগ দিতেন। ত্রিশের দশকে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান-এ-আখাওয়াতিনের কর্মী হিসেবে বস্তিতে বস্তিতে কাজও করেছেন। ১৯৪৬-এর কলকাতার দাঙ্গার সময় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে আশ্রয় কেন্দ্র পরিচালনা করেন। দেশভাগের পর তিনি তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন।
ওয়াজিয়া বাঈ, আম্মাজান, হীরামন বিবি, হাজিমন্নেসা, হোসেন্নেসা বেগম, শহীদা খান : এই মহীয়সী নারীগণ ১৯৩০ সালের লবণ আইন অমান্য আন্দোলন ও ১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করে বহু নির্যাতনসহ কারাবরণ করেন।
আজিজান বাঈ : লক্ষ্ণৌ এর এক দুঃসাহসী বীরাঙ্গনা বাঈজি। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করার জন্যে তিনি অস্ত্রসজ্জিত পুরুষ সিপাহীর বেশ ধরে ঘোড়ায় চড়ে কানপুর আসেন। কানপুরের বিখ্যাত বিবিঘর আক্রমণের সময় তিনি সংগঠিত এক নারীবাহিনী নিয়ে বিদ্রোহী সিপাহীদের সাহায্য করেন। তাঁর সৌন্দর্য, বীরত্ব এবং দেশাত্মবোধের কথা প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলো। মহাবিদ্রোহের এই বীরাঙ্গনার পরিণতি নিয়ে মতান্তর আছে। শোনা যায়, উমরাওজানের পুত্র আলি খান বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দিলে তারা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
খাদিজা হাসান : সামাজিক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। বিদূষী খাদিজা ইস্তাম্বুল এবং লন্ডনে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। তিনি ভারতে সমাজ কল্যাণ, শিক্ষা-সংস্কার এবং নারীদের অধিকার রক্ষার বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেন।
নিশাতুন নিশা : ব্রিটেনের ভারত সচিব মি. মন্টেগু যখন ১৯১৭ সালে সাংবিধানিক সংস্কার সংক্রান্ত আলোচনা করার জন্য ভারতবর্ষে আসেন, সে সময় তাঁর সঙ্গে আলোচনার জন্য যে নারী প্রতিনিধিদল গঠন করা হয়, তার অন্যতম সদস্য ছিলেন নিশাতুন নিশা। ১৯১৯ সালে অমৃতসর শহরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ও লীগ অধিবেশন দুটিতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। এরপরই তিনি আলিগড় ছেড়ে চলে আসেন কানপুর এবং স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী হিসেবে সেখানে খদ্দরের এক ভাঙার খোলেন। ১৯২১ সালে আমেদাবাদে কংগ্রেস, লীগ ও খিলাফত অধিবেশনগুলোতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯২১ সালে আমেদাবাদ শহরে অনুষ্ঠিত নারী সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯২২ সালে কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনে তিনি একদিকে প্রচণ্ডভাবে সমালোচনা করেন গান্ধীজিকে, যিনি মৌলানা হযরত মোহানির প্রস্তাবিত পূর্ণ স্বরাজ এর দাবির বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি কংগ্রেস অধিবেশন উপলক্ষ্যে কানপুরে আয়োজিত এক শ্রমিক মিছিলের নেতৃত্বও দেন।
ভূপালের বেগম : আরও কয়েকজন শ্রদ্ধেয়া নারী ছিলেন যারা মুসলিম নারী শিক্ষার প্রবক্তা হিসেবে প্রখ্যাত। তাঁরা সামাজিক সংস্কারের জন্য আন্দোলন সংগঠিত করেন, যেগুলো প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে। এই প্রসঙ্গে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ছিলেন ভূপালের বেগম।

গওহরজান : তিনি অত্যন্ত বিত্তবতী নারী ছিলেন। ২০টি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তার কণ্ঠ এতই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, তাঁকে ৬০০টি গানের রেকর্ড করতে হয়েছিলো। গওহরজানের স্বদেশানুরাগও ছিলো প্রবল। একবার মহাত্মা গান্ধী কলকাতায় তাঁর কাছে জনহিতকর কাজের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য চাইলে গান্ধীজির হাতে তিনি ১২ হাজার টাকা তুলে দেন।

হয়তো এমনি আরও অনেক নাম না জানা বীর মায়েদের কথা, হার না মানা দুরন্ত কিশোরীদের গল্প উপমহাদেশের মাটি জানে, বহমান নদীগুলো জানে আর জানে মাথার উপরের ঐ উদার আকাশ। কালের গর্ভে আর আমাদের ইতিহাসবিদদের সংকীর্ণ কলমের বর্ণনায় আমরা হারিয়ে ফেলেছি তাদের নাম। তাদের এ সংগ্রাম ও মুক্তির আন্দোলন ও ভূখণ্ডকে ধারণ করে আমৃত্যু অবিচলতার সাথে সংগ্রামমুখর জীবনকে বেছে নেওয়ার এক বর্ণাঢ্য জীবনগাথা বাংলা অঞ্চলে জ্ঞান ও মুক্তির আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী নারীদের জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণার উৎস। এ ভূখণ্ড কখনোই তার সন্তানদের সংগ্রামী কাব্যগাথা ভুলে যেতে পারে না, রক্তের ঋণ বিস্মৃত হতে পারে না। সেই ঋণের শোধ নিতে এই মাটিতে আবারও জন্ম নিবে এমন অনেক বিপ্লবী, সংগ্রামী আর তেজস্বী নারী হয়তো ভিন্ন কোনো রূপে, ভিন্ন কোনো প্রেক্ষাপটে।

১৬২৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top