মক্কা বিজয়; হাল আমলের প্রেক্ষিতে রাসূলের (সা.) বিজয়ী ভাষণের গুরুত্ব

০১.

সারাটা জীবন রাসূলের সীরাত পড়ার পরেও আমরা রাসূল (সা.)-কে কতটুকু চিনতে পেরেছি, সেটা বিরাট একটা প্রশ্ন আমাদের সামনে। বেশ আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিবেচনার বিষয়ও বটে।

তারচেয়েও বড় কথা, রাসূলের জীবনীকে আমরা কেনো যেনো সেই ১৪০০ বছর পূর্বের ঘটনাবলি হিসেবে বিবেচনা করেই ক্ষান্ত হই। দুঃখের বিষয় হলো, রাসূলের সীরাত বর্তমান সময়ের সাথে কীভাবে সম্পর্কিত আর সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে বিষয়টা নিয়ে আমাদের মাঝে কোনোপ্রকার আলাপ হয় না বললেই চলে।

আমাদের দেশের একটা রূঢ় বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের অধিকাংশই রাসূলের সীরাত পড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে। তাই, রাসূলের সীরাতটা পড়া থাকলেও রাসূলের জীবনকে সেই সময়ের আলোকেই বুঝি আমরা; বর্তমানের সাথে খুব একটা সম্পৃক্ত করতে পারি না।

রাসূলের মাক্কী জীবন, মাদানী জীবন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অর্থনৈতিক মূলনীতি, কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত, সামাজিক ব্যবস্থাপনা বা দৈনন্দিন জীবনাচরণ—এসব বিষয় যে সামগ্রিক, এগুলো যে আমাদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত একেকটা বিষয় আর এই বিষয়গুলো যে কেয়ামতাব্দি উসূল হিসেবে আমাদের সামনে সংরক্ষিত থাকবে, এই বুঝটা যেনো আমাদের মাঝে পয়দাই হয় না।

রাসূলের জীবনকে শুধু নস্টালজিক ইতিহাসের পাতাতেই রাখতে পছন্দ করি আমরা। রাসূলের দুঃখী সময়কে স্মরণ করে ওয়াজের ময়দানে বেদনা-বিধুর সেসব বয়ান শুনে কান্নাকাটি করি। কিন্তু, শিক্ষা নেওয়ার সময় আমাদের উপলব্ধির আকলটা কেনো যেনো অকার্যকর হয়ে যায় তখন।

 

০২.

কথাগুলো বলার কারণ হলো, আজ ২০ রমজান, মক্কা বিজয় দিবস।
তবে ইংরেজি তারিখ নিয়ে একটু মতভেদ আছে। হয় ৩১ ডিসেম্বর রাসূল (সা.) মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্য মদীনা হতে রওয়ানা দিয়ে ১১ জানুয়ারি মক্কায় বিজয় করেছিলেন। অথবা, সে তারিখেরও ১১দিন পূর্বে রওয়ানা দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর রাসূল (সা.) মক্কায় পৌঁছেছিলেন।

সে যাই হোক, রাসূলের (সা.) মক্কা বিজয়টা রাসূলের (সা.) জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ একটা বিজয় বললেও ভুল হবে না। রক্তপাতহীন সুমহান সেই বিজয়টা পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য এক স্থান দখল করে আছে। শুধু অনন্য নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে এমন রক্তপাতহীন বিজয় আর দ্বিতীয়টি নেই।

আজকের কথিত এই আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার বর্তমান শাসনপদ্ধতিতে ট্রিটি অব ওয়েস্টফেলিয়াকে আধুনিক শান্তি ও নিরাপত্তার ম্যাগনাম ওপাস হিসেবে অভিহিত করা হয়। অথচ, মক্কা বিজয়ের পর কাবার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে রাসূল (সা.) যে শান্তি ও নিরাপত্তার বিধান ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং যে মডেল উপস্থাপন করেছিলেন, তা সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এবং এক ও অদ্বিতীয়।

যে ভূমি থেকেই রাসূল (সা.)-কে বিতাড়িত করা হয়েছিলো, সেই অঞ্চলটাই তিনি বিজয় করলেন—মাত্র এক দশকের মাথায়; তাও আবার কোনো প্রকার যু্দ্ধ ও রক্তপাত ছাড়াই, একেবারে নির্বিঘ্নে।

হুদায়বিয়ার সন্ধির পর সাহাবীরা মক্কা গমনের যে সুযোগটা পেয়েছিলেন, সেই সুযোগেই পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত হয়েছিলো মুসলিমদের আখলাকী সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক নান্দনিকতা। নচেৎ মাত্র কয়েক বছরের মাথায় হু-হু করে বহু-সংখ্যক আরব ও অনারব ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতো না।

এখানে সংস্কৃতির বিষয়টা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মক্কা বিজয়ের পেছনে যে সাংস্কৃতিক একটা প্রভাবও বিদ্যমান ছিলো, এটা অনস্বীকার্য। কিন্তু, এই বিষয়টা বরাবরই আমাদের পর্যালোচনার আড়ালে থেকে যায়। এর পেছনে হয়তো সংস্কৃতির সংজ্ঞায়নটাই বড় একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, সংস্কৃতিকে আমরা শুধুমাত্র বিনোদন আর নির্দিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি।

সান জু-র আর্ট অব ওয়ার থেকে শুরু করে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী হয়ে বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতা, যে সময়ই হোক না কেনো, কোনো অঞ্চল বিজয়ের ক্ষেত্রে একটা সুপ্রসিদ্ধ দর্শন হচ্ছে, কেউ যদি কোনো অঞ্চলকে বিনা যুদ্ধে জয় করতে চায়, তাহলে সেই অঞ্চলে স্থানীয় সংস্কৃতির চেয়ে সেই বিজেতাদের সংস্কৃতিকে বেশি আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। ফলাফলস্বরূপ, মাত্র কয়েকবছরের মাথায় সেই অঞ্চলের অধীবাসীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবেই পরাজিত হয়ে পড়বে; এবং তখন অতি স্বাভাবিকভাবেই তাদের উপর করায়ত্ত করা সম্ভব হবে।

কারণ, সাংস্কৃতিক দিক থেকে কেউ অনুগত হলে তাকে জয় করা খুবই সহজ হয়ে পড়ে। আর সংস্কৃতি আমাদের জীবনাচরণে কতোটা প্রভাব ফেলে, তা একজন আকলবান ব্যক্তিমাত্রই বুঝতে পারবেন। তাহলে মনে হয়, এটা বললে খুব একটা ভুল হবে না যে, সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে যেকোনো রাজনৈতিক বিপ্লবের পূর্বশর্ত বলা যায়।

এসব দিক বিবেচনায় মাত্র চার বছরের মাথায় মক্কার মতো একটি অঞ্চলকে বিজয় করা, তাও আবার বিনা যুদ্ধে ও বিনা রক্তপাতে, এখানে আসলে আখলাকী আর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণকে কখনই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।

 

০৩.

মক্কা বিজয়ের পর কাবার প্রাঙ্গনে রাসূলের দেওয়া সেই ভাষণের কয়েকটা পয়েন্ট তুলে ধরা যাক,

  • ক. নিজ ঘরে থাকলে নিরাপদ;
  • খ. আবু সুফিয়ানের ঘরে থাকলে নিরাপদ:
  • গ. অস্ত্র ত্যাগ করলে নিরাপদ;
  • ঘ. পশু হত্যা করা যাবে না;
  • ঙ. গাছপালা, ঘাস কাটা যাবে না;
  • চ. সকল জাত্যাভিমান বাতিল করা হলো;
  • ছ. মক্কাকে নিরাপদ স্থান হিসেবে ঘোষণা করা হলো;
  • জ. মক্কার সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো।

এখান থেকে কয়েকটা নির্দেশ নিয়ে বর্তমানের আলোকে পর্যালোচনা করা যাক।

প্রথমত,
দীর্ঘ তেরোটা বছরের অত্যাচার, নির্যাতন, বন্দিত্ব; আবার বদর, উহুদ, খন্দক-এর পরেও রাসূল (সা.) একেবারে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন; শুধু হাতেগোনা কয়েকজন বাদ দিয়ে। ইসলামের বিশেষত্বটা ঠিক এখানেই।

বিষয়গুলোকে এখন একটু আধুনিক সময়ে কনভার্ট করা যাক!
আমাদের প্রযুক্তির এই সময়ে সংস্কৃতি বলতে আমরা কী বুঝি!? তার কতটুকু আমাদের মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে? আমরা যদি কোথাও পাশ্চাত্যের বিপরীতে ইসলামকে দাঁড় করাইতে চাই, তাহলে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষমতা কতটুকু আছে আমাদের!?
এরপর না-হয় আমরা সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবো বা ক্ষমা করার সেই বিষয়টা আমাদের সামনে আসবে। পুরো দুনিয়ায় এতোগুলো মুসলিম দেশ থাকার পরেও গাজায় এক বোতল পানি পাঠানোর সক্ষমতা অর্জন করতে পারি না আমরা, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিসরে রাজনৈতিকভাবে সবাইকে নিরাপদ ঘোষণাই করবোই বা কখন?

তবে আবার, সে যুগের সাধারণ ক্ষমা আর বর্তমানের সাধারণ ক্ষমার ধরন কস্মিনকালেও যে এক হবে না, এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সবার সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত, ট্যাক্স নিয়ন্ত্রণ, মারহামাতপূর্ণ বিচারব্যবস্থা, আদালতপূর্ণ অর্থনীতি, দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ ইত্যাদির মাঝেই রাসূলের সাধারণ ক্ষমার মর্মার্থ বিদ্যমান। অন্তত উপরের আটটা পয়েন্টের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যথার্থ ব্যাখ্যা এমনটা না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না।

তাই, মক্কা বিজয়ের পর কাবার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে এতোবছরের নির্যাতন, নিপীড়ন ও অত্যাচার সহ্য করেও রাসূলের ক্ষমা করার বিষয়টা আমাদের স্বতন্ত্র গবেষণার দাবি রাখে।

দ্বিতীয়ত,
মানুষের জানের নিরাপত্তা দেওয়ার পর, রাসূল দিলেন মানুষের মালের নিরাপত্তা। আবার নির্দেশ দিলেন রবের দেওয়া প্রাকৃতিক নেয়ামতগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্বের ঘোষণা; অর্থাৎ, রাসূল দিলেন গাছপালা ও পশুপাখির নিরাপত্তা।

এই বিষয়গুলোকেও এবার বর্তমানের সাথে মিলিয়ে দেখা যাক।
আমরা মুসলিমরাই কতটুকু স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চায়ন করতে পারছি? আবার পরিবেশবাদী আন্দোলন যেগুলো রয়েছে বর্তমান বিশ্বে, তার কতগুলো সংস্থাই বা মূলত পরিবেশ সংরক্ষণের জন্যই কাজ করে যাচ্ছে?

আবার খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টাও আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন!
আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাপনা কতটুকু নিরাপদ? মধ্যস্বত্বভোগী লোকদের জন্য কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পায় না, দরিদ্ররা খাবার ক্রয় করতে পারে না আর বর্গাচাষীরা একবেলা পেটপুরে খাবারের চিন্তায় দিনাতিপাত করে। বিষয়গুলোকে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা আর সামাজিক নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে না!?

এবার একটু বীজ ব্যবস্থাপনার দিকে খেয়াল করেন তো!
কয়েক বছর আগেও তো খাদ্যে এতো বিষ আর ভেজাল ছিলো না। ক্ষেতে ক্ষেতে এতোটা পোকা মাকড়ের উপদ্রব ছিলো না। শুধু এক জৈবসার ব্যবহার করেই যে পরিমাণ নিরাপদ খাদ্যশস্য উৎপাদন করা হতো, তা দিয়ে মানুষের সময়টা এমনেই পার হয়ে যেতো।

কিন্তু, প্রশ্ন হলো, তার কতটুকু এখন হয়? মানুষ কেন আজ ৫০-এ পা রাখলেই বুড়িয়ে যেতে থাকে? ৪০-এ পা দিতেই কেন মানুষের হাড়-গোড়ে সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে? যুবকদের শারীরিক অবস্থার আজ এতো অবনতি কেন? একজন যুবককে কেন লো-প্রেশার নিয়ে চলাফেরা করতে হয়? এগুলোর পেছনে কি খাদ্য ব্যবস্থাপনা দায়ী নয়?
এগুলো কি রাসূলের বলা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে বর্তমানের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ সময়োপযোগী আধুনিক বিষয় নয়?

চোখের উপর থেকে অদৃশ্য পর্দাটা একটু সরালেই দেখা যায়, যারাই বীজ উৎপাদন করছে, তারাই আবার বীজের প্রতিষেধক তৈরি করছে। অতএব, এতোটুকু বুঝতে আর দেরি হয় না যে, বীজে বিষ মেশানোটা পরিকল্পিত একটা প্রজেক্ট। হেনরি কিসিঞ্জারের কথাটাই না-হয় তুলে ধরি,
❝তেল নিয়ন্ত্রণ করলে আপনি দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে বীজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।❞

আরেকটু গভীরে গেলে আমাদের এটাও বুঝতে অসুবিধা হবে না যে, এসব কিছুর মূল হোতা হাতেগোনা কয়েকজনই। আমেরিকার রকফেলার পরিবার, ইংল্যান্ডের রথাচাইল্ড পরিবার আর ইতালির এগনেল্লি পরিবার। রাজনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি আর হলিউডি নোংরা সংস্কৃতির পেছনে তাদের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য।

তৃতীয়ত,
রাসূল (সা.) শস্যের পাশাপাশি দিলেন পশুপাখির নিরাপত্তা।
কিন্তু আজকের ডেইরি ফার্মগুলোর অবস্থা খুবই ভয়াবহ। গাভীর দুধগুলো মেশিনের সাহায্যে একপ্রকার জোর করে দুধ দোহন করা হয়। বাছুরগুলো তাদের প্রধান খাদ্য মায়ের দুধ পর্যাপ্তভাবে পায় না। অথচ, রাসূলের সুস্পষ্ট বিধান আছে যে, মা পশুকে কষ্ট দিয়ে এবং বাচ্চাকে ক্ষুধার্ত রেখে দুধ দোহন করা যাবে না। মুরগির ফার্মগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

আবার, প্রাণীদেরকে নিয়ে নিষ্ঠুর আর অমানবিক সব এক্সপেরিমেন্ট থেকে শুরু করে মানুষকে পর্যন্ত গিনিপিগ বানিয়েছে পশ্চিমারা। শিল্পায়নের নাম করে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে গিয়ে প্রকৃতির অবস্থাটা দুরবস্থা করতে এমন কোনো উপায় বাকী নেই, যেটার ব্যবহার তারা করেনি। প্রতি বছর শয়ে শয়ে পাখি মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র বিল্ডিংয়ের থাই গ্লাস বা কাচের জানালার সাথে ধাক্কা খেয়ে। ইনকা, মায়া, এযটেক সভ্যতাকে ধ্বংস করে সেসব জায়গায় ইট-পাথরের বস্তি বানিয়ে রেখেছে এখন তারা।

অথচ, নেটফ্লিক্সের বিখ্যাত ডকু সিরিজ Our Planet-এর দ্বিতীয় সিজনের সম্ভবত প্রথম এপিসোডেই বিখ্যাত ন্যারেটর David Attenborough বলেন,
“Across the island, chicks are dying. There is now so much plastic in our oceans, that it reaches even the most remote islands on Earth, carried here by the currents. And only now are we beginning to understand that all life on Earth depends on the freedom to move.”

প্রকৃতির ভারসাম্যকে নষ্ট করে প্রাণীদের উদ্বাস্তু করে এখন এসে তারা প্রকৃতির উপর দরদ দেখাচ্ছে। তারা বলছে, মানুষ নাকি কেবল বুঝতে শুরু করেছে প্রাণীদেরকে তাদের মতো করেই রেখে দিতে হয়। কিন্তু কোথায়? উন্নতির নাম করে শিল্পায়নের আগে তো কখনও প্রাণীরা তাদের জীবন নিয়ে এতোটা বিপাকে পড়েনি!

উন্নতি কি আগে হয়নি? উসমানীয়দের সময়ে বরং প্রতিটি দালানেই নির্দিষ্ট একটি স্থান থাকতো, যেখান থেকে পাখিরা বিশ্রাম নিতো আর খাবার খেতো। এমনকি, কোনো অঞ্চলে পাখিদের সুবিধার জন্য উঁচু উঁচু দালান নির্মাণ করা নিষিদ্ধ ছিলো। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমাদের এতোসব কাজ-কারবার যতোটা না আশ্চর্যজনক, তারচেয়েও বেশি আশ্চর্যজনক হলো, মানুষরা এসব আবার বিনা দ্বিধায় বিশ্বাসও করে থাকে।

চতুর্থত,
কাবার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে রাসূল (সা.) চিরতরে নিষিদ্ধ করলেন জাতপ্রথা, জাত্যাভিমান ও জাতিগগ শ্রেষ্ঠত্বকে; এবং মক্কাকে সকল দিক থেকে বালাদুল আমীন বা নিরাপদ শহর হিসেবে ঘোষণা করলেন।

কিন্তু আজকে? বর্তমান সভ্যতার কথিত স্বাধীন পৃথিবীতে?
কোথাও কি শান্তি ও নিরাপত্তার নামে কোনোকিছু আছে? নাকি সমগ্র দুনিয়ায় আজকে যুদ্ধাবস্থা আর অস্থিতীশীলতা বিরাজ করছে? পৃথিবীর কোন প্রান্তে আজ মুসলিমরা প্রশান্ত মনে রাতের নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতে পারছে? বিষয়টা কি সম্পূর্ণ বিপরীত না?

অথচ, আজকের পৃথিবীতে শান্তি বিনষ্টকারী হিসেবেই তুলে ধরা হয় ইসলামকে। সমগ্র দুনিয়াজুড়েই আজকে মুসলিম দেশগুলোকে যুদ্ধবিধ্বস্ত, জঙ্গী আর শান্তি বিনষ্টকারী হিসেবে পরিচিত করানো হয়েছে। এক্ষেত্রে গত শতকে দেওয়া মার্গারেট থ্যাচারের সেই বক্তব্যকে তুলে না ধরলেই নয়। তিনি বলেন,
“আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। তাই ন্যাটোর সামনে কোনো শত্রু নেই। কিন্তু, কোনো মতাদর্শ এবং কোনো আন্দোলন শত্রু ছাড়া পরিচালিত হতে পারে না। আর বর্তমান দুনিয়ায় ইসলামই একমাত্র সকল সমস্যার মূল। তাই আজ থেকে ন্যাটোর প্রধান শত্রু হচ্ছে ইসলাম।”

যে শান্তি ও নিরাপত্তার কথা বলে তারা, যে শান্তি ও নিরাপত্তার মডেল উপস্থাপন করে তারা আর যার উপর ভিত্তি করে সমগ্র পৃথিবীতে শান্তি রক্ষাকারী বনে গিয়েছে তারা, তার বয়স মাত্র কয়েকশ বছর; আর সেটি হলো ট্রিটি অব ওয়েস্টফেলিয়া। অথচ, সেই চোদ্দোশো বছর আগেই রাসূল (সা.) শান্তি ও নিরাপত্তার যে বিধান দিয়েছিলেন, তা আজও পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম এবং এক ও অনন্য।

আর আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতার ধ্বজাধারীরা, যারা শান্তি ও নিরাপত্তার বুলি আওড়িয়ে ভুবন ভোলানো বক্তব্য দেয়, তারা কি আদৌ পৃথিবীতে শান্তি স্থাপন করতে পেরেছে? নাকি আজকের এই শান্তি ও নিরাপত্তার বিধান ও কথিত ডেমোক্রেসি শুধু তাদের স্বার্থের জন্যই ব্যবহৃত হয়?

তাদের ডেমোক্রেসি ততক্ষণ পর্যন্ত ডেমোক্রেসি থাকে, যতক্ষণ না আপনার আমার মন্তব্য তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তাদের শান্তি ও নিরাপত্তার মডেল ততক্ষণ পর্যন্ত বজায় থাকে, যতক্ষণ না আপনার আমার নিরাপত্তা ইস্যু তাদের নিরাপত্তার বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

যার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের অবস্থান এবং অপারেশন আকসা তুফানের পর গাজাবাসী নিয়ে তাদের অবস্থানের দিকে খেয়াল করলে। এটাই হচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রেসক্রিপশনে তৈরি আজকের সভ্য দুনিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার আসল চরিত্র।

 

০৪.

তাই, পরিশেষে মনে হয় এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে,
আমাদের এখন আত্মসমালোচনা করা খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে! কেননা, আমরা আজকে বর্তমান বিশ্বের এনাটমিটা বুঝি না আর এর ব্যবস্থাপনাটা বুঝার চেষ্টাও করি না।

অথচ, দুনিয়াব্যাপী ইসলামের ঝাণ্ডা উড়ানোর ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ! তাহলে কোথায় গেলো সূরা আনফাল আর সূরা নিসায় বলা কাফেরদের বিরুদ্ধে সর্বদিক থেকে নেওয়া আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতির বিষয়টা? তাহলে কোথায় গেলো সূরা নাহলে বলা সেই হিকমত ও প্রজ্ঞার সাথে ইসলাম ছড়িয়ে দেওয়ার কথা?

বর্তমান বিশ্বকে না বুঝা, আমাদের পর্যাপ্ত সামর্থ অর্জন না করা, বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি, সংস্কৃতি না বুঝাই কি তাহলে আমাদের আল্লাহর বলা সেই হিকমত ও প্রজ্ঞা অর্জন করা? কোনো কিছুর প্রস্তুতি না নেওয়া বা কোনো সেক্টরেই সম্পূর্ণরূপে দক্ষতা অর্জন না করাই কি তাহলে কাফেরদের বিরুদ্ধে নেওয়া আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতির নমুনা?

প্রশ্নগুলো তাদের নিকট রইলো, যারা ইসলাম নিয়ে চিন্তা করেন, ভাবেন, ইসলাম নিয়ে স্বপ্ন দেখেন।

মক্কা বিজয়ের পর কাবার প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে রাসূলের সেই ভাষণটি আমাদের আকল ও বিবেকের জন্য চক্ষু উন্মোচনকারী হোক এবং আগামীর নতুন দুনিয়া বিনির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের সকলকেই একেকজন মুজাহিদ হিসেবে মহান রব কবুল করে নিক, এই দোয়া ও কামনা করি। আল্লাহুম্মা আমীন।

প্রচেষ্টা ও জিহাদ আমাদের, সফলতা দেবার দায়িত্ব মহান রবের।

১৯৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of মিফতাহুর রহমান

মিফতাহুর রহমান

পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে। দীর্ঘদিন যাবত লেখালেখি ও অনুবাদের সাথে যুক্ত আছেন। তার প্রকাশিত যৌথ অনুবাদ গ্রন্থ 'মসজিদে আকসাকে মুক্ত করার কৌশলগত পরিকল্পনা'। এককভাবে অনুবাদ করেছেন, “আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মসজিদে আকসার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব"। পড়াশুনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি ও অনুবাদ চলমান রেখেছেন। অনুবাদ করছেন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। তার আগ্রহ ইতিহাস, উসূল, ধর্মতত্ত্ব, ফিকহ, রাজনীতিতে। এছাড়া ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Picture of মিফতাহুর রহমান

মিফতাহুর রহমান

পড়াশোনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে। দীর্ঘদিন যাবত লেখালেখি ও অনুবাদের সাথে যুক্ত আছেন। তার প্রকাশিত যৌথ অনুবাদ গ্রন্থ 'মসজিদে আকসাকে মুক্ত করার কৌশলগত পরিকল্পনা'। এককভাবে অনুবাদ করেছেন, “আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মসজিদে আকসার ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব"। পড়াশুনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি ও অনুবাদ চলমান রেখেছেন। অনুবাদ করছেন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। তার আগ্রহ ইতিহাস, উসূল, ধর্মতত্ত্ব, ফিকহ, রাজনীতিতে। এছাড়া ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top