১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরানে সমাজ সংস্কারের যে কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, পরবর্তীতে তার বড় একটা প্রভাব ইরানের শিল্প সাহিত্যে দেখা যায়। আজ বিশ্বে ইরানি সংস্কৃতির এতো নাম ডাক তাই-ই প্রমাণ করে। একটা বিষয় অকপটে স্বীকার করতেই হবে “রাজনৈতিক বিপ্লবের অপর নাম সাংস্কৃতিক বিপ্লব”
ইরান তাদের সিনেমা দিয়ে সাংস্কৃতিক জগতে বড় একটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে; আব্বাস খিয়োরোস্তামি, জাফর পানাহি, মাজিদ মাজিদি, বাহ্রাম বেজাই, দারিয়স মেহেরজুই, মহসেন মাখমালবাফ, পারভেজ কিনাইভি, সামিরা মাখমালবাফ সহ এমন আরও একঝাঁক মেধাবী কঠোর পরিশ্রমী সিনেমাকারদের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপক্ষ সিনেমার জন্য যে নীতিমালার বিধান করে রেখেছেন তা মুক্ত সিনেমার জন্য বাধা, তারপরও এই সিনেমাকাররা যেভাবে কৌশলে, ইশারা-ইঙ্গিতে সিনেমার শারীরিক বাচনভঙ্গি উপস্থাপন করে চলেছেন, তা পুরো সিনওয়ার্ল্ডের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতো বাঁধা বিপত্তির মাঝেও ইরানি সিনেমা সারাবিশ্বে যেভাবে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে, সেটা সকল সুস্থ সংস্কৃতির চিন্তাধারার সিনেপ্রেমিকদের জন্য অবশ্যই আনন্দদায়ক একইসাথে সুসংবাদও বটে।
‘দ্যা চিলড্রেন অব হ্যাভেন’ ১৯৯৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র। মাজিদ মাজিদি কর্তৃক পরিচালিত একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির পরিচালক একইসাথে প্রযোজক, অভিনেতা এবং চিত্রনাট্যকার। যা একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছোট দুই ভাই বোনের জুতা হারানোর কাহিনী দিয়েই সাজানো হয়েছে। আলী ও জারা ভাইবোন। স্বল্প আয়ের পরিবার। পাশাপাশি মা বিছানায় শয্যাশায়ী।
সিনেমায় দেখানো হয় আলী তার বোন জারার ময়লায় মলিন ছেড়া জুতা জোড়া বাজারে ঠিক করতে এনে হারিয়ে ফেলে। এমনিতেই অভাবের সংসার। অসহায় নির্বাক মনে বাড়ি ফিরে বোনকে নতুন জুতা দেবার আশ্বাস দেয় এবং বাবা মা থেকে জুতা হারানোর বিষয় গোপন রাখতে অনুরোধ করে! বোনের বেদনা কিছুটা লাঘব করার প্রচেষ্টায় আলী তার নিজের পেন্সিল এবং ক্লাসে দ্বিতীয় হওয়ার পুরস্কার নীল কলম দিয়ে দেয়।
জারা নতুন জুতা পাবার আশায় আলীর বেমানান জুতা পায়ে মর্নিং শিফটে ক্লাস করে এবং স্কুল ছুটির পর দৌড়ে এসে আলীর স্কুলে যাবার পথে জুতা বদল করে তার দেওয়া কথা অনুযায়ী বাবা মা থেকে জুতা হারানোর কথা গোপন রাখে।
অসহায়ত্ব যখন মানুষের দ্বার প্রান্তে এসে হানা দেয়, কঠিন বাস্তবতার সম্মুখে বেদনাগুলোও তখন অনেক আনন্দের বস্তুতে পরিনত হয়। ভাই বোনের ভালোবাসা আর একে অপরের প্রতি সহানুভূতির দৃশ্যটা আসলেই চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে উক্ত সিনেমায়।
এদিকে আলীর স্কুলে নিয়মিত অনিয়ম এবং দেরিতে গমন প্রধান শিক্ষকের নজর এড়াতে পারেনি। এর দরুন আলীকে কঠোর শৃঙ্খলার কথা শুনতে হয়। অন্যদিকে জারাও বিরক্ত প্রতিনিয়ত ভাইয়ের বেমানান জুতা পরে স্কুলে যাওয়া নিয়ে! আবার নিজেরই হারানো জুতা জারার নিজেরই ক্লাসমেট রয়া’র পায়ে দেখে অবাক হয়।
অবশেষে সুযোগ আসে আলীর! শহরের দৌঁড় প্রতিযোগিতায় হাজার হাজার প্রতিযোগীর মাঝে আলীর লক্ষ্য ৩য় স্থান। কিন্তু অনাকাক্ষিত আলী হয়ে যায় ১ম। বিবর্ণ মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরে জারার সামনে আসতেই জারা আলীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়!
সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের হক তো আর থেমে থাকে না! সিনেমার শেষ অংশে দেখা যায়, আলীর বাবা নতুন সাইকেল সাথে দুই জোড়া নতুন জুতা নিয়ে বাজার থেকে বাড়ির পথে রওনা হয়েছেন।
কাহিনী নাকি সিনেমার প্রাণ। মাজিদ মাজিদি এই সিনেমায় একজোড়া ময়লায় মলিন ছেড়া জুতা হারানোর সাদামাটা কাহিনী দিয়ে যেভাবে কৌশলে, ইশারা -ইঙ্গিতে এই সিনেমাকে একটা রাজনৈতিক ভাষ্যে রূপান্তরিত করেছেন, তা সারা সিনওয়ার্ল্ডের জন্য একটা চ্যালেঞ্জিং কর্ম সাধনের নামান্তর।