আজকের দিনে ইসলামের প্রতি পশ্চিমা জগত তথা আধুনিক সভ্যতার চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে কাউকে আলোচনা করতে হলে স্বাভাবিকভাবেই উভয়ের মধ্যে পার্থক্যের তলোয়ার চালিয়ে এবং প্রতিমা ভঙ্গের মতো এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া দিয়ে শুরু করতে হবে। আধুনিক সভ্যতা মানুষের সূক্ষ্ম মননশীলতা ও বস্তুনিরপেক্ষ সমালোচনা শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে বলে গর্বের সাথে দাবি করে। যদিও বাস্তবিকপক্ষে আমাদের জানা কোনো সভ্যতা আজ পর্যন্ত নিজেদের কাজের বস্তুনিরপেক্ষ বিচার বা সমালোচনা করার ন্যূনতম গুণাবলির অধিকারী ছিল না। আজকের সভ্যতা এমন এক সভ্যতা যা কোনো মৌলিক সংস্কার আনতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ কোনো সংস্কার কর্মসূচী নিয়ে এর শুরু হয়নি। বস্তুত আধুনিক সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা এবং প্রকৃত অর্থে সূক্ষ্ম আত্মসমালোচনার অভাব।

একটা প্রচলিত কথা আছে যে, “শয়তান ধার ও তীক্ষ্ণতা পছন্দ করে না”। আজকের অবস্থার সাথে এই পুরনো দিনের কথাটি হুবহু প্রযোজ্য। আজকে শয়তানী প্রভাব সর্বত্র স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ বিষয়গুলোকে আরো অস্পষ্ট ও স্থূল করে দিচ্ছে। যেখানেই স্পষ্ট ব্যবধান অনুপস্থিত সেখানেই শয়তানের অবাধ আনাগোনা। সুস্পষ্ট ও সুনির্ধারিত মতবাদগুলোর তীক্ষ্ণতা ক্রমশ অবক্ষয়ের প্রক্রিয়ায় নিপতিত হচ্ছে এবং দিনে দিনে তাদের সংজ্ঞা সমূহের স্পষ্টতা বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। সত্য ও মিথ্যা এতবেশি মিশ্রিত হয়ে পড়েছে যে, এমনকি পবিত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিশ্বাস যা অল্লাহর তরফ থেকে মানুষের জন্য মহা মূল্যবান নিয়ামত, সেগুলোও এই বিনাশী প্রক্রিয়ার প্রভাবে হয়ে উঠে অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট, সব কিছুকে করে তোলে নিস্তেজ ও অনিশ্চিত। সুতরাং ইসলামের প্রতি আধুনিক বিশ্বের কাছ থেকে যে চ্যালেঞ্জ এসেছে, সে সম্পর্কে আলোচনার জন্য প্রয়োজন শাহাদাতের প্রেরণা নির্ভর দৃঢ় বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা, যার প্রথম চিঠি লেখা হয়েছিল আরবিতে তলোয়ারের ভাষায়। এই তলোয়ার অবশ্যই চালিত হবে আজকের নতুন জাহিলিয়াতের ভুয়া সংস্কারের বিরুদ্ধে। যে সংস্কার আজ বহু মুসলমান এমনকি নির্দ্বিধায় কবুল করে নিচ্ছে। যে চিন্তা ও মতবাদ আধুনিকমনা মুসলমানদের মনকে বিশৃঙ্খল করে দিচ্ছে, সেই শক্তিকে ছিন্নভিন্ন ও উৎখাত করতে এই তলোয়ার ব্যবহার করতে হবে। এই তলোয়ার অবশ্যই বর্তমান সময়ের মুসলমানদের অন্তরকে এলোমেলো স্তূপ থেকে স্বচ্ছ কাঁচ খণ্ডের মতো ঐশী আলোক বিচ্ছুরণের উপযোগী করে খোদাই করে নেবে। এটা অবশ্যই ভুললে চলবে না যে, স্বচ্ছ কাঁচ খণ্ডের বিচ্ছুরণ সত্যিই দুষ্প্রাপ্য, কারণ হচ্ছে এর সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ধার।

সবসময় স্মরণ রাখতে হবে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় নীতিমালার আলোকে আধুনিকতার সমালোচনা করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ হবে এবং ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একথা ভুললেও চলবে না যে, আমাদের নবী করীম (স.) সবচেয়ে পরিপূর্ণ শিষ্টাচারের অধিকারী হয়েও প্রয়োজনে অত্যন্ত খোলাখুলি ও অকপটভাবে সত্যকে প্রকাশ করেছেন। তাঁর জীবনের বহু মুহুর্ত অতিবাহিত হয়েছে যখন তিনি ছিলেন আপোষহীন সত্যভাষী এবং জীবনে কখনো নিছক আদবের জন্য সত্যকে পরিত্যাগ করেননি। ইসলাম এরূপ শিক্ষা কখনো দেয়নি যে, দুইকে স্বীকার করা হবে কিন্তু আদব দেখানোর জন্য দুই আবার কখনো পাঁচ হয়ে যাবে। মূলতঃ আদিব হচ্ছে সকল পরিস্থিতি ও অবস্থায় সত্যের প্রতি দৃঢ় প্রতীতি ও যথার্থ অনুধাবনের পরিপূরক। উত্তর আফ্রিকার একজন বিখ্যাত আধ্যাত্মবাদী গ্রন্থকার বলেছিলেন, ‘আপনি কি জানেন আদব কাকে বলে? আদব হলো তলোয়ারকে এমনিভাবে ধারালো করা, যাতে আপনার শরীরের কোনো অংশ কেটে ফেলা হলেও কোনো আঘাত পাওয়া যাবে না। ইসলামের প্রতি পশ্চিমা জগতের সে আলোচনা করতে হলে যেকোনো মুসলমানের আজকে এর মনোভাব থাকা প্রয়োজন। আমাদের জীবন ও সত্তার উপরই যে সত্যের হক আছে তা নয়, অন্যদের মনে সত্যের চেতনা জাগ্রত করা, যখন যেখানে সম্ভব সত্যকে প্রকাশ করা এবং সত্যের ব্যাখ্যা প্রদান করা আমাদের বিশেষ দায়িত্ব। আজকের দিনে প্রয়োজন কঠোর সমালোচনা, বিশেষ করে যেহেতু এ ধরনের মনোভাব সত্যিই বিরল এবং এ মনোভাবের প্রয়োজন আজ সবথেকে বেশি। আজকের দিনে ইসলামী দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে আধুনিক জগতের ঘটনাবলিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ ও যথার্থ সমালোচনা করা। এ ধরনের সমালোচনা ছাড়া পাশ্চাত্য জগতের মোকাবেলায় বাস্তব কোনো ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। আধুনিকতাবাদী মুসলমানদের কেন বক্তব্য শুরু হয় এভাবে, ‘ইসলামকে সুসংহত করার পথ হচ্ছে…। এরপর যেভাবেই হোক না কেন তার উপসংহারে এসে বলেন, ‘এবং এগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য যদি অন্যান্য আহলে কিতাবের মতো না করা হয় এবং জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত না করা হয়। পাশ্চাত্য সমাজতন্ত্র, মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদ, বিবর্তনবাদ বা অন্য যেকোনো মতবাদের সাথে ইসলামকে সঙ্গতিশীল করার ক্ষেত্রে শুরুতেই গলদ আছে। কারণ তারা কোনো ব্যবস্থা বা মতবাদকে ইসলামী বৈশিষ্ট্যের আলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দোষগুণ বিচার করে দেখে না। এছাড়া তারা ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ হিসেবে দেখার পরিবর্তে দেখে আংশিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, যেন ইসলামকে আধুনিক কোনো আদর্শ দিয়ে পরিপূর্ণ করে নিতে হবে। সামগ্রিকতার দৃষ্টিভঙ্গিকে কোনো বিশেষ্যের জন্য অবচেতনভাবে ও নিছক গুণবাচক শব্দ হিসেবে ইসলামের মৌল ভাবধারায় স্থান দেয়া হয়নি। এভাবে ফ্যাশনের ক্রমাগত পরিবর্তন অর্থাৎ আজকে বহুলালোচিত ইসলামী সমাজতন্ত্র আবার পরবর্তী সময়ে উদারনৈতিকতাবাদ বা পশ্চিমা অন্যকোনো মতবাদপ্রীতি এসবের অসারতা ও অজ্ঞতা প্রমাণ করে। যিনি ইসলামকে তার পূর্ণাঙ্গ কাঠামোসহ বুঝতে পেরেছেন, তিনি কখনো নিছক একজন রূপান্তরকারী বা প্রয়োজনের কাছে এর মর্যাদাকে খাটো করতে পারেন না। এটি এমন এক চিন্তাধারা যা উপরোক্ত সকল অবস্থা থেকে স্বাধীন।

বহু আধুনিকতাবাদী মুসলমান বিভিন্ন ফ্যাশনসূলভ চিন্তাধারার সাথে আত্মরক্ষামূলক ও আপোসকামী মনোভাব প্রদর্শন করেছে, যেগুলোর সাথে সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি বা সুক্ষ্ম চিন্তাভাবনার কোনো সম্পর্ক নেই। সাধারণত স্পষ্ট দোষত্রুটি এবং যেসব বিষয় সমালোচনা করা সহজ সেগুলোর সমালোচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু খুব কম লোকেই বর্তমান যুগের মৌলিক ভ্রান্তিগুলো সম্পর্কে সমালোচনার সাহস রাখেন। প্রচলিত মাদরাসাসমূহের ছাত্ররা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন যাপন করে এটা বলা খুবই সহজ, কিন্তু দৃঢ়তার সাথে এটা বলা কঠিন যে, কিছু পুরনো মাদ্রাসা ভবনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাস্থের যতটুকু ক্ষতি হয় আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের আত্মার এর চাইতেও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হয়। এটাও ঠিক যে, ইসলামী দুনিয়ায় খুব কম সংখ্যক লোকই পাশ্চাত্যের মোকাবেলা করা বা সমালোচনা করার ক্ষমতা রাখেন এবং পাশ্চাত্য জগত যে শক্তিবলে ইসলামের মোকাবেলা করছে, আত্মিক শক্তি ও বুদ্ধির তলোয়ার দিয়ে তার ভিত্তিমূলে আঘাত করতে পারে না আজকের অবস্থা হলো এই। কিন্তু এটা হতে দেয়া যায় না। ইসলামের ঐশীবাণীর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আধুনিক জগতের বস্তুনিরপেক্ষ সমালোচনা করার যোগ্যতা নিয়ে কেন নতুন করে বুদ্ধিবৃত্তির উন্মেষ ঘটবে না তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।

ধর্মীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, বর্তমান ইসলামী দুনিয়ায় দুধরনের লোক রয়েছেন। প্রথমত ওলামা এবং অন্যান্য ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ (সুফিগণসহ), আর অন্যরা হলেন আধুনিকতাবাদী। সাম্প্রতিককালে আরেকটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব হচ্ছে। তারা ওলামাগণের মতো প্রাচীনপন্থী কিন্তু আধুনিক জগত সম্পর্কেও খোঁজ-খবর রাখেন। কিন্তু এই তৃতীয় শ্রেণির সংখ্যা খুবই নগণ্য। ওলামা ও অন্যান্য প্রাচীনপন্থী ধর্মীয় নেতার মতো তারাও সাধারণত আধুনিক জগতের সমস্যা ও জটিলতা সম্পর্কে তত গভীর জ্ঞান রাখেন না। কিন্তু তারা হচ্ছেন ইসলামী ঐতিহ্যের রক্ষক ও জিম্মাদার, তাদের ছাড়া ঐতিহ্যের বহমানধারা ব্যাহত হবে। তাদেরকে ইউরোপীয় দর্শন, বিজ্ঞান ও অর্থনীতির দুর্বোধ্য বিষয়ে অজ্ঞতার জন্য আধুনিকতাবাদীরা সমালোচনা করে থাকে। কিন্তু আধুনিকতাবাদীরা এতো নরম সুরে এবং গড়পড়তা সমালোচনা করেছে যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা অপাত্রে পড়েছে। বিগত শতাব্দীতে ইসলামী দুনিয়ায় যারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন ছিলেন তারা কদাচিৎ মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে কলুষমুক্ত উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে জাতিকে পরিচালিত করেছেন। কতিপয় স্থানে মাদরাসা কারিকুলাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হলেও এই কোর্সের মাধ্যমে মাদরাসা ছাত্রদেরকে প্রকৃত অর্থে ইসলামী শিক্ষার আলোকে বর্তমান দুনিয়ার সাথে পরিচিত করে নব আশা সঞ্চারের উদ্দেশ্যে করা হয়নি; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিকৃত করে দেয়ার গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রাচীনপন্থী মাদরাসা শিক্ষা ও আধুনিক শিক্ষার সাথে সংযোগ স্থাপনকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কিছু কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ওলামাগণের বস্তুগত জ্ঞানের অভাব নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার আধুনিকতাবাদীদের নেই, কারণ তারা এ সকল জ্ঞানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। উল্লিখিত তিনটি শ্রেণির মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির লোকেরা হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা ইসলামী দুনিয়ার পাশ্চাত্যের অনুসারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল যারা কম-বেশি পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে। ইসলামী দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ এক সংকটের সম্মুখীন, তা হলো আত্মপরিচয়ের সংকট। কারণ একটি শিক্ষা ব্যবস্থা যে সংস্কৃতির গর্ভে লালিত হয় সে সংস্কৃতির সাথে থাকে তার আংগিক সম্পর্ক। একটি জেট বিমান এশিয়া, আফ্রিকা বা যে কোনো দেশের বিমান বন্দরে অবতরণের উপযোগী করে তৈরি করা যায় এবং সে দেশের অংশ হিসেবে পরিচিত হতে পারে। বস্তুত ইসলামী দুনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে ধরনের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে পাশ্চাত্য দুনিয়ার সংকট এর চাইতে আলাদা। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে জেট বিমানের মতো আমদানি করা চলে না। এই সংকট দেখা দিতো না, যদি ইসলামী সংস্কৃতি এখনো যথেষ্ট প্রাণবন্ত না থাকতো। উপরন্তু এই সংকট উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিগণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অনুরূপভাবে যাদেরকে ইন্টেলেকচুয়াল নামে অভিহিত করা হয় দুর্ভাগ্যবশত তাদের বুদ্ধিবৃত্তির সীমানা প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তি থেকে বহু দূরে অবস্থান করে। কিন্তু যে নামেই তাদেরকে অভিহিত করা হোক না কেন পাশ্চাত্যমুখী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষিত এই শ্রেণির অধিকাংশ লোক প্রায় একই বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, কেননা তারা পাশ্চাত্যের যে কোনো বিষয়ে পূর্বানুরাগ এবং ইসলামের যে কোনো বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে। পাশ্চাত্যের বহু আধুনিকমনা মুসলমানের মধ্যে এমনকি বহু আধুনিকমনা হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য প্রাচ্যবাসী যারা আধুনিকতাবাদী সংস্কারের মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে তাদের সবার মধ্যে এই হীনমন্যতা বিরাজ করছে। ইসলামী দুনিয়া আজকে এই মারাত্মক রোগ-যন্ত্রণায় ভুগছে এবং তারাই সবচাইতে বেশি যন্ত্রণাক্লিষ্ট, যাদের কাছে আমরা আশা করি যে, তারা পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করবে। সুতরাং ইসলামের সাথে পাশ্চাত্যের সংঘাতের প্রশ্নে এই মানসিকতাসম্পন্ন আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের কথা মনে রাখতে হবে। কারণ তারা বিংশ শতাব্দীতে ইসলাম সম্পর্কে অধিকাংশ আপোষকামী রচনা দ্বারা পাশ্চাত্যের মোকাবেলায় নিজেদেরকে পেশ করেছেন।

এ সব আপোষকামী আধুনিকতাবাদী প্রচেষ্টার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করা এক ধরনের হীন মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। তারা পাশ্চাত্য দুনিয়ার বিষয়গুলোকে কোনো না কোনোভাবে ইসলামে গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করেন। অথচ যে সব বিষয়কে কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়েও পাশ্চাত্যের সাথে তুলনা করা যায়নি ইসলামের সে বিষয়কে তারা মূল্যহীনভাবে দূরে ছুঁড়ে ফেলেছেন অথবা আরও অগ্রসর হয়ে কোনো উপদল সৃষ্টি করেছেন।

ইসলামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির স্বাস্থ্যপ্রদ গুণাবলি এবং ইসলামের মানবতাবাদী আদর্শ সম্পর্কে অসংখ্য যুক্তি পেশ করা হয়েছে কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, তারা ইসলামকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ণাঙ্গ আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে এসব যুক্তি পেশ করেছেন বরং যেহেতু স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও সব মানুষের সাম্যের ধারণা বর্তমানে পাশ্চাত্য সমাজে সমাদৃত হচ্ছে বা অন্ততপক্ষে হিপ্পিবাদ প্রচলনের পূর্বে চালু ছিল। এভাবে স্পষ্ট আত্মরক্ষামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আপোষকামীরা পশ্চিমা জগতের মূল চ্যালেঞ্জটাকে এড়িয়ে গেছেন, যে চ্যালেঞ্জ ইসলামের মর্মমূলে আঘাত করছে এবং যে বিষয়ে শত তোষামোদেও শত্রুকে নিবৃত্ত করা যায় না। যখন সার্জারী করা জরুরী হয়ে পড়ে তখন বিষাক্ত স্থানকে উপড়িয়ে ফেলার জন্য অবশ্যই একটা ছুরি রাখতে হবে। তেমনিভাবে মিথ্যা যখন ধর্মীয় সত্যকে নিশ্চিত হুমকির মুখে ফেলে, তখন সমালোচনা ও বুদ্ধির তলোয়ার অন্য কিছুর বিকল্প হতে পারে না। মিথ্যার সাথে শান্তি স্থাপন করে বন্ধুত্বের ভান করে কেউ কখনো খারাপ পরিণতি থেকে বাঁচতে পারে না। এই নতজানু মনোভাব যখন দার্শনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়সমূহেও ভূমিকা রাখতে চায় তখন সেটা আরো বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে মিসর ও ভারতীয় উপমহাদেশে প্রকাশিত এ জাতীয় কিছু হীনমন্য সাহিত্য পড়তে গেলে দেখা যাবে যে, ইংল্যান্ডে ভিক্টোরীয় যুগে ও সমকালীন ফ্রান্সে বিজ্ঞান ও ধর্মশাস্ত্রের মধ্যে বিস্বাদ ও পরিত্যক্ত কিছু বিতর্ককে নতুন করে টেনে আনা হয়েছে। এগুলো পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের জবাব দেওয়ার জন্য লেখা হলেও তাদের দুর্বলতা এতো প্রকট হয়ে ওঠে যে, এমনকি তাদের বক্তব্য সে যুগেরও পটভূমির প্রতিকূলে চলে যায়। অবশ্য আপনি একইসাথে কোনো একজন প্রাচীনপন্থীর বলিষ্ঠ কণ্ঠ শুনতে পারেন যিনি ইসলামী আদর্শের শাশ্বত নীতির ভিত্তিতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিচ্ছেন। যদিও তার বিষয়ের সাথে জড়িত বিমূর্ত ধারণা, গভীর দার্শনিক তত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে ততো পরিচিতি নাও থাকতে পারে কিন্তু এ ধরনের কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসে, শেষ পর্যন্ত একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। অথচ আধুনিকতাবাদীদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে আরো জোড়ালো এবং আক্রমণাত্মক। বস্তুত বর্তমান বিশ্বে পাশ্চাত্য সভ্যতার সবচেয়ে উৎসাহী ধারক ও বাহক হচ্ছেন শিক্ষিত ও প্রাচ্যদেশীয় পাশ্চাত্যমনা ব্যক্তিবর্গ যারা পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে গেছে।

আধুনিকতামনা প্রাচ্যদেশীয়দের চাইতে একজন অক্সফোর্ড বা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র পাশ্চাত্যের প্রতি অনেক কম আস্থা পোষণ করে। এই সময় আধুনিকমনারা আধুনিকীকরণের জন্য অতীতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বর্তমানে অবশ্য এই সংস্কার সম্পূর্ণরূপে ধসে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় আজকে তারা আরও মরিয়া হয়ে আকড়ে ধরে রাখতে চাচ্ছে। আধুনিকতাবাদী মুসলমানদের মধ্যে যারা বিশেষ করে অধিকতর চরমপন্থী তাদের কাছে পাশ্চাত্যের বলে দেয়া অর্থই ইসলামের প্রকৃত অর্থ বা তাৎপর্য। বিবর্তনবাদ যদি ট্রেন্ড হিসেবে চালু হয়ে থাকে তাদের কাছে প্রকৃত ইসলাম হচ্ছে বিবর্তনবাদ। যদি সমাজতন্ত্র ঐ সময়কার হয়ে থাকে তবে তাদের কাছে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সমাজতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত। যারা এ মানসিকতা ও লেখার সাথে পরিচিত আছেন জানেন যে, কতটা হীনমন্য ও দাসত্ববাদী প্রকৃতির বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি আইনের যেসব বিষয় সম্পূর্ণ অনৈতিক ও ইসলাম বিরোধী, সেসব বিষয়ের শুরুতেও ‘বিসমিল্লাহ’ এবং শেষে ‘বিহি নাস্তায়ীন’ জুড়ে দিয়েছে। এই শ্রেণির লোকেরা যারা পাশ্চাত্যের জন্য জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে রাজী, তারা যদি তাদের অবিশ্বাস্য চোখে দেখতে থাকে যে, পাশ্চাত্য সভ্যতার মরণযন্ত্রণা শুরু হয়েছে, তাদের জন্য সে দৃশ্য কতোইনা যন্ত্রণাদায়ক। তাই তারা পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের পক্ষে সবরকম প্রচেষ্টা চালায় এবং তারা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে যদি দেখে, আধুনিক জগতের কিছু লোক নিজেরা নিজেদের সমালোচনা করতে শুরু করেছে। সম্ভবত আধুনিক সভ্যতার এই সুস্পষ্ট অবক্ষয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ক্রমশ আরও স্পষ্ট হচ্ছে। যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই অবস্থা শুরু হতো, যখন এশীয় ঐতিহ্যসমূহ ছিল প্রায় অক্ষত, ঐতিহ্যবাহী এই সভ্যতাসমূহ তাহলে অনেকাংশে রক্ষা পেতো। কিন্তু তাকদীর মানবজাতির জন্য অন্য ব্যবস্থা রেখেছিলো। যাইহোক, বর্তমান পরিস্থিতিতেও অনেক কিছু করার আছে। প্রবাদ আছে, “যতক্ষণ পর্যন্ত গাছের শিকড় পানিতে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত আশা আছে”। সনাতন নিয়ম-নীতি অনুযায়ী যদি সৎকাজ করা হয় অর্থাৎ আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে যদি সত্য বলা ও তদনুযায়ী আমল করা হয়, তবে কিছু না কিছু সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঈমান যেখানে কার্যকর, হতাশা সেখানে অর্থহীন। এমনকি আজকেও যদি ইসলামী দুনিয়া সনাতন ও আধুনিক ধ্যান-ধারণার সাথে বিশেষভাবে পরিচিত কোনো প্রকৃত বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, তবে পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জের জবাব দেয়া সম্ভব এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অবশ করে দেয়ার আশংকা থেকে ইসলামী ঐতিহ্যসমূহকে রক্ষা করা যাবে। ইসলামী দুনিয়াকে আসলেই কতটুকু রক্ষা করা যাবে এটা বোঝার জন্য এতটুকু স্মরণ রাখলেই চলবে যে, বিপুল সংখ্যক মুসলমান এখনো ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করছে এবং তাদের জীবন জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই সংস্কৃতির মধ্যেই অতিবাহিত হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মুসলমানের মধ্যে ইসলামী সংস্কৃতি এখনো বর্তমান, এটা অতীতকালের কোনো ব্যাপার নয়। যারা এটাকে অতীতকালের বিষয় হিসেবে গণ্য করতে চান, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তবে তাদেরকে বলা যায়, উচ্চকণ্ঠ সংখ্যালঘু। তারা ঐতিহ্যবাহী দুনিয়ার সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং নিজেদের পথভ্রষ্টতার ফলে পুরো ইসলামী সমাজকে নিজেদের অনুরূপ মনে করতে শুরু করেছে। পরিস্থিতির আরেকটি দুঃখজনক দিক হলো যারা ইসলামকে অতীতের ব্যাপার মনে করছে, তারাই আজকে ইসলামী দুনিয়ায় গণসংযোগের সকল মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা মানুষের মন ও চিন্তার উপর এত প্রভাব খাটাচ্ছে যে, তাদের সংখ্যার স্বল্পতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা থেকেও মানুষ অনেক দূরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্বের রেডিও, টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকাগুলোর উপর যারা নিয়ন্ত্রণ রাখছে তাদের কাছে ইসলামী সংস্কৃতি অতীতের ব্যাপার। কারণ তারা পাশ্চাত্যের প্রতি এত মোহিত হয়ে আছে যে, অন্য যে কোনো পথকে তারা অবাস্তব মনে করে, এমনকি পথটি যদি তার বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে ঘরের দুয়ারে এসে অবস্থান করে।

আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, ইসলামী দুনিয়ায় আধুনিকতাবাদী সংখ্যালঘুরা যে মুহূর্তে তুঙ্গে আরোহণ করছে, সে মুহূর্তে পাশ্চাত্যে তারা সম্পূর্ণ নোঙ্গরহীনভাবে ঘুরে চলছে, জানে না কি করতে হবে বা কোথায় যেতে হবে। যদি একজন সাধারণ পার্সী বা আরব চাষাভুষা লোককে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো বিমান বন্দরে এনে আগত ইউরোপীয়ানদেরকে দেখতে বলা হয়, প্রথম যে বৈসাদৃশ্য সে দেখতে পাবে তা হলো পোশাক-পরিচ্ছদের পার্থক্য। সন্ন্যাসী থেকে নগ্নপ্রায় সব মানুষের মধ্যে সে দেখতে পাবে নিজের তুলনায় অনেক পার্থক্য। এগুলোই তার সরল মনে ছাপ ফেলার জন্য যথেষ্ট যে, আসলে পাশ্চাত্য সভ্যতার সাথে তার নিজের সঙ্গতি বা মিলের কতো অভাব। কিন্তু এই মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একজন আগাগোড়া আধুনিকতাবাদী ইসলামের শুভাকাঙ্খীও বটে। হয়তো অন্য কোনো কারণে নয়, তিনি ইসলামের জন্য নিজস্ব পদ্ধতিতে যে চেষ্টা চালাচ্ছেন তার জন্য আধুনিক সভ্যতার সাথে প্রত্যক্ষ বিরোধিতায় যেতে চান না বলেই এগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য বিগত তিনটি যুগে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে যেসব মুসলমান ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা টেমস্ নদী ও সিনে নদীর দুপাশের গাছপালাকে মনে করেছেন বুঝি আল শাজারাতুত তুবা এবং নদী দুটোকে মনে করেছেন যেন বেহেশতের ঝরনা। কিন্তু সজ্ঞানে অথবা অবচেতন মনে আধুনিকতাবাদী মুসলমানদের ঐ সদস্যরা প্রায় সকলেই তাদের বেহেশতের ধারণা এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার পরিপূর্ণতার ধারণা পরিবর্তন করে ফেলেছেন। কিন্তু পাশ্চাত্য সম্পর্কে কোনো ঐক্যবদ্ধ বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা পাশ্চাত্যকে অন্ধ সংস্কার মনে করার তেমন কোনো লক্ষণ আজও দেখা যাচ্ছে না। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব বিগত তিন যুগ ধরে এতো প্রকট হয়ে ওঠেছে যে, এরূপ মনোভাব আর থাকার কথা নয়। আজকের দিনে আধুনিক মুসলমানগণ পাশ্চাত্যের একক মূল্যবোধ সম্পর্কে তাদের বাপ-চাচারা যারা আগে পাশ্চাত্যে গিয়েছিলেন তাদের চাইতে অনেক কম আস্থাশীল। এটা একটা ইতিবাচক প্রবণতা হতে পারতো যদি তা আধুনিকতাবাদের (Modernism) ইতিবাচক ও বস্তুনিরপেক্ষ মূল্যায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হতো। এটা আসলে আধুনিক মুসলমানদের মনে কিছু অতিরিক্ত সন্দেহের যোগান দিয়েছে মাত্র। অবশ্য আজকাল যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম পণ্ডিত বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সক্ষম হচ্ছেন এবং তাঁরা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুসরণ করা ত্যাগ করেছেন। কিন্তু মূল সমস্যা অর্থাৎ ইসলামী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত ব্যাপক জ্ঞানের অভাব আজও রয়ে গেছে। ইসলামী জগতে আজো পাশ্চাত্যবিদগণ (Occidentalist) সংখ্যায় খুবই নগণ্য যারা অষ্টাদশ শতকের পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদদের (Orientalist) মতো কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারেন।

পাশ্চাত্য সম্পর্কে আধুনিক মুসলমানদের আস্থা ক্রমশ দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানগণ এখনও পাশ্চাত্যের চিন্তা ও বস্তুগত উপাদান থেকে রস সংগ্রহ করে যাচ্ছে। নিজেদের চিন্তাগত ঐতিহ্যের প্রতি আস্থাহীনতার ফলে অধিকাংশ আধুনিক মুসলমান যেন নিজেদের শ্বেত পটের উপর পাশ্চাত্যের কাছ থেকে কোনো না কোনো ছাপ গ্রহণ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। উপরন্তু ইসলামী দুনিয়া পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অংশ থেকে অনেক ধারণার সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু এই ধারণাগুলোর সাথে পাশ্চাত্য জগত গভীরভাবে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও তারা বক্তব্যের দিক থেকে পরপর ভিন্ন ধরনের। উদাহরণস্বরূপ, বিগত শতাব্দীতে উপমহাদেশ সমাজ বিজ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে বৃটিশ, ফরাসী ও পারস্যের চিন্তাধারা গভীরভাবে অনুসরণ করেছে। কিন্তু সর্বত্রই আমাদের আধুনিক সমাজ পাশ্চাত্যের কাছ থেকে যাই আসুক না কেন সাথে সাথে তা গ্রহণ করার জন্য বসে বসে প্রতীক্ষা করছে। আজকে দৃষ্টবাদ (Positivism), তো কালকে আবার স্ট্রাকচারালিজম। খুব কদাচিৎ কেউ সঠিক ইসলামী চিন্তাভাবনাকে কাজে লাগাতে চায়, যা সক্রিয় ও কার্যকরভাবে বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজে লাগানো হলে আমাদের পথ চলাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে পারতো। বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের মেয়েরা পোশাকের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে যা করে থাকে, দর্শনের ক্ষেত্রে একই অবস্থা বিরাজ করছে, তারা অনুগত ব্যবহারকারীর মতো উদাসীনভাবে পাশ্চাত্যের ফ্যাশন প্রণেতারা যখন যা তৈরি করে দেয় তাই অন্ধভাবে ব্যবহার করে। পোশাকের ফ্যাশনের মতো দর্শন ও শিল্পকলার ক্ষেত্রেও আধুনিক মুসলমানগণ সিদ্ধান্ত প্রণয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না, স্বতন্ত্র ধারা প্রণয়ন করতে পারে না। স্রেফ পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করে চলে।

এটাও অবশ্য ঠিক যে, পাশ্চাত্যে একের পর এক বিভিন্ন আলোড়নের অন্তর্নিহিত উৎস কোথায় এবং বিশ বছর আগে কেউ ভাবতে পারেনি যে, হিপ্পি আন্দোলন পাশ্চাত্যে এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু আধুনিক মুসলমানগণ তারপরও বর্তমান থেকে দূরে সরে আছে। কেননা, তারা শুধু এর উৎস সম্পর্কে অসচেতন নয়, এমনকি এসবের উৎপত্তি ও বিকাশের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কেও তারা অসতর্ক রয়েছে। তাদের চোখের সামনে কেন্দ্রীয় মঞ্চ অন্যদের দ্বারা বেদখল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। এরপর তাদের প্রতিক্রিয়া শুরু হয় হতবাক হওয়া অথবা আবারো অন্ধভাবে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। বর্তমান দুনিয়ার পরিবেশ সঙ্কট এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিপুল সংখ্যক পাশ্চাত্যবাসী এই প্রধানতম সমস্যা প্রায় জর্জরিত অথচ মুসলমানগণ সমস্যার অস্তিত্ব সম্পর্কেও সজাগ নন। এমনকি আজকেও ইসলামী জগতের ক’জন লোক প্রকৃতির এই মারাত্মক সমস্যা সম্পর্কে ইসলামের গৌরবময় ঐতিহ্যের আলোকে চিন্তা-ভাবনা করেন, যা হতে পারতো এই প্রধান সমস্যার সম্ভাব্য সমাধানের একমাত্র চাবিকাঠি। এমন কেউ কি আছেন যিনি এই চাবিকাঠি ব্যবহারে আগ্রহী? ইসলামের প্রতি পাশ্চাত্যের চ্যালেঞ্জকে আরও বিশদভাবে জানতে হলে আধুনিক বিশ্বে প্রচলিত কতিপয় ‘ইজম বা মতবাদ’ থেকে উদাহরণ নেয়া প্রয়োজন, যে সব মতবাদ ইসলামী দুনিয়ার সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। আসুন শুরু করা যাক মার্ক্সবাদ তথা সমাজতন্ত্র দিয়ে। আজকে ইসলামী দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে মার্ক্সবাদ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে তারা সরাসরি কিছু না বললেও ধর্মীয় জীবনে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের কথা বাদই দিলাম। তাদের অনেকে ইসলামী দুনিয়ায় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে সাধারণভাবে মার্ক্সবাদ বা সমাজতন্ত্রের কথা বলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই সত্যিকার অর্থে মার্ক্সবাদ সম্পর্কে জানেন বা সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক দিকগুলো গভীরভাবে বুঝতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অসংখ্য মুসলিম তরুণ ছাত্রদের মুখে মার্ক্সবাদের কথা শোনা যায়, কিন্তু, জেনে আশ্চর্য হবেন, তাদের মধ্যে ক’জন আসলে ‘দাস ক্যাপিটাল’ (Das Kapital) বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রাসংগিক বইপত্র পড়াশোনা করেছে বা মার্ক্সবাদকে খাঁটি যুক্তিতর্কের মাধ্যমে পেশ করতে জানে? মার্ক্সবাদী খেয়াল চেপে বসায় মুসলিম যুবকরা ইসলামী সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে এখন আর ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখার কথা ভাবতেও চায় না। তারা চায় কালো বাক্সের অজানা অভ্যন্তরের মতো অবস্থাকে গ্রহণ করতে, যেখানে সে তার অহমিকাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মনকে মিথ্যা প্রবোধ দিতে পারে যে, সে একজন বুদ্ধিজীবী বা উদারচেতা কোনো বুদ্ধিজীবী চক্রের সদস্য।

তাদের ভাবনা-জগত ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশে সকল সমস্যার যে মার্ক্সবাদী সমাধান বের করা হয়েছে তাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। ইসলামী সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে নতুনভাবে চিন্তা-ভাবনা করার আর কোনো দায়-দায়িত্ব যেন তাদের নেই। এটা হচ্ছে মার্ক্সবাদের এমনি অন্ধ অনুসরণ যেন এই প্যাকেটে কি আছে কোনো দিন খুলে দেখা হয়নি অথবা যেন এ্যাসপিরিনকে সকল প্রকার ব্যথা দূর করার সমর্থনে বিরক্তিকর বক্তব্য খাড়া করার মতো। সমস্যার যুক্তি ও অর্থপূর্ণ আলোচনার পরিবর্তে যারা ঢিলেঢালাভাবে মার্ক্সবাদের প্রভাবে পড়েছেন তারা নির্বোধের মত অন্ধভাবে এর আনুগত্য করে, যার ফলে একটা অর্থহীন বিরোধ সৃষ্টি হয় এবং শেষ পর্যন্ত ইসলামী সমাজের যুবক শ্রেণি অদৃশ্য যন্ত্রণায় মনের দিক থেকে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে অথচ ঈমানী জিন্দেগীতে এ সব যন্ত্রণা তেমন কিছুই নয়। দুর্ভাগ্যবশত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের চ্যালেঞ্জের জবাবে ইসলামী তত্ত্ববিদগণের পক্ষ থেকে এ যাবৎ যেসব যুক্তিতর্ক উত্থাপিত হয়েছে তার বেশির ভাগ যুক্তি ঐতিহ্যগত জ্ঞান-বিজ্ঞানের (আকলী) উৎস থেকে না এসে শুধুমাত্র ধর্মশাস্ত্রীয় এবং নাকলী (Naqli) উৎস থেকে এসেছে।১০

যারা ঈমানদার ব্যক্তি, কেবল তাদের কাছেই ধর্মীয় যুক্তি উত্থাপন করা যেতে পারে। কুরআনের নির্ভরযোগ্যতায় বিশ্বাস করে না, কোনো বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য তার কাছে কুরআনের বিশেষ কোনো অংশ তুলে ধরার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? ওলামাগণের লেখা বহু কর্ম এ কারণেই সমালোচনা করা যায় যে, তাঁরা তাঁদের বক্তব্য বধির লোকদের কাছে পেশ করেছেন, তাদের পেশকৃত যুক্তি, উক্ত সমস্যার সাথে কোনো কার্যকর সম্পর্ক রাখে না। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আমরা মনে করি ইসলামী ঐতিহ্য এতো ঐশ্বর্যমণ্ডিত এবং এতো গভীর যে, আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনের যে কোনো প্রশ্নের অত্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক মানসম্পন্ন ও যুক্তিপূর্ণ জবাব দিতে সক্ষম। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, ঐতিহ্যবাদী (Traditionalist) প্রজ্ঞার আবির্ভাবের আগে সকল আধুনিক দর্শনে ধর্মকে মনে করা হয়েছে স্বর্গে যাওয়ার মাধ্যম আর আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র। আজকের দিনে তথাকথিত অনেক সমস্যা নিছক কূটতর্ক ও প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে সৃষ্ট। একমাত্র ঐতিহ্যবাদী প্রজ্ঞার মাধ্যমেই এর সমাধান লাভ করা সম্ভব। প্রাচীন ব্যাবিলনীয় থেকে শুরু করে মধ্যযুগীয় চীনে সনাতনী প্রজ্ঞার সেই শাশ্বত এবং ব্যাপকতর রূপের সমন্বয়ে চৌদ্দ শতকের ইসলামী সমাজ যে সামগ্রিক ও ব্যাপক বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল তাই নিয়ে ইসলামী ঐতিহ্যের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব গঠিত। কয়েকটি দেশে ইসলামের জন্য মার্ক্সবাদের এই বিপদ আরও মারাত্মক হয়ে ওঠেছে। কারণ তারা কিছু সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের আবরণে মার্ক্সবাদের মারাত্মক লোভনীয় ফাঁদ সৃষ্টি করছে। এভাবে ধর্মকে সরাসরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কপটভাবে ব্যবহার করার চাইতে ধর্ম বিরোধী এবং খাঁটি মার্ক্সবাদীরা অনেক কম ক্ষতিকর। পবিত্র কুরআনে এ শ্রেণির চিন্তা ও মানসিকতাসম্পন্ন লোকদেরকে বলা হয়েছে ‘মুনাফিকুন’ (হিপোক্রেটস)। এসব কপট সিনথেসিসের বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেয়া ছাড়া অন্যকোনো পথ নেই। তাদেরকে স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিতে হবে, ইসলাম এমন কোনো আদর্শ নয় যে, এতে যে কোনো বিষয় বিসমিল্লাহ নাম নিয়ে বৈধ করা যায়; বরং বাস্তবতাকে ইসলাম সামগ্রিক দৃষ্টি দিয়ে দেখে। অর্ধেক সত্যের সাথে ইসলামের কোনো প্রকার আপস হতে পারে না। ইসলামের জন্য মার্ক্সবাদের চাইতেও বিপজ্জনক আরেকটি মতবাদ হচ্ছে ডারউইনবাদ বা বিবর্তনবাদ। ইসলামী দুনিয়ায় অনুপ্রবেশ যার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, এর প্রভাব বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্পষ্ট কারণ হচ্ছে, তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার শক্তিশালী প্রভাব। ইউরোপীয় বহু গুণী-জ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে১১ যুক্তি অথবা সমসাময়িক নৃবিজ্ঞানীদের সকল প্রমাণ যথাযথভাবে উপস্থাপন করে দেখানোর অবকাশ এখানে নেই। তাহলে দেখানো যেত আসলে দুনিয়াতে মানুষ আসার আগে কি ঘটেছিল। বস্তুত পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ পদার্পণ করার পর থেকে তার মধ্যে আজ পর্যন্ত সামান্যতম বিবর্তনও ঘটেনি।১২

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, সমসাময়িক কোনো মুসলিম চিন্তাবিদ আসলে এসব উৎসের দিকে লক্ষ্যই করেননি এবং মানুষের ঐতিহ্যবাহী চিন্তা-ভাবনার সমর্থনে এসব যুক্তিকে ব্যবহার করেননি। তাই আধুনিকতাবাদী মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের কাছে বিবর্তনবাদ এখনও পবিত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের তুল্য। তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে কুরআনের শিক্ষার সাথে বিবর্তনবাদের সরাসরি বিরোধ রয়েছে।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সত্যিই অসম্ভব এবং যৌক্তিকভাবে অবান্তর। কিন্তু এক শ্রেণির লোকেরা ইসলামের কতিপয় বিষয়কে দুঃখজনকভাবে, অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে মিশ্রিত করে ফেলেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক মিশ্রণ। আল্লামা ইকবাল অত্যন্ত খোলাখুলি ও স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে, আধুনিক মুসলিম লেখকরা কীভাবে বিবর্তনবাদের ত্রুটিসমূহের জবাব দেয়ার পরিবর্তে পিছু হটে এসে আপোষকামী মনোভাব দেখাচ্ছে এবং কিরূপ হাস্যকরভাবে বিবর্তনবাদের আলোকে ইসলামী শিক্ষাসমূহের ব্যাখ্যা করার জন্য তারা মনেপ্রাণে চেষ্টা চালাচ্ছে।১৩

বিবর্তনবাদী মানসিকতার প্রভাবে সময়ের অগ্রগতি সম্পর্কিত ইসলামী ধারণার কথা মুসলমানরা ভুলে গিয়েছেন।১৪ কুরআনে বর্ণিত মৃত্যুর পরের জিন্দেগী ও তার পরবর্তী দিনগুলোর কথা তারা ভুলে যাচ্ছে। যেমন এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, রাসূল (স.)-এর যুগ হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ। এরপর যুগের পর যুগ আসবে এবং বাতিল হয়ে যাওয়ার উপযোগী সময় এসে শেষ হয়ে যাবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই হচ্ছে ইতিহাসের রৈখিক বিবর্তন ও প্রগতির ধারণা। যারা ইসলামী চিন্তাধারার সাথে বিবর্তনবাদী ধারণাকে সংযুক্ত করে দিয়ে ভাবেন যে, তারা ইসলামের খিদমত করেছেন, তাঁরা আসলে আজ মারাত্মক খাদের মধ্যে পতিত। এর মাধ্যমে তারা অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর অনুরূপ পথ ধরে মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরানো এবং আধুনিক মানুষের কপট বিশ্বাসের কাছে ইসলামকে আত্মসমর্পণ করতে চাচ্ছেন। উপরন্তু বিবর্তনবাদী তত্ত্বকে গ্রহণ করলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কতকগুলো স্পষ্ট বিরোধ এসে উপস্থিত হয়, যাকে অপসারণ করা যায় না। যদি সবকিছু অপেক্ষাকৃত ভালোর দিকে বিবর্তিত হতে থাকে, তবে উন্নতির জন্য চেষ্টা-তদবির করার প্রয়োজন কি? সবকিছু নিজে থেকেই কোনো না কোনো ভাবে উন্নতি লাভ করবে। আধুনিকতাবাদীরা জীবনের যে গতিশীলতার (Dynamism) কথা বলে তা সাধারণত বিবর্তনবাদী ধারণার পরিপন্থী।

এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে আধুনিকতাবাদীরা বলে প্রচেষ্টা, কর্ম, সংগ্রাম ইত্যাদি আধুনিক জগতে খুবই কার্যকর অথবা মানুষ তার ভবিষ্যৎ এবং অদৃষ্টকে প্রভাবিত করতে পারে। যদি সে তার ভবিষ্যৎকে পরিবর্তন করতে পারে, তবে সে তার মন্দসমূহকেও পরিবর্তন করতে পারে, সুতরাং স্বাভাবিক প্রগতি বা বিবর্তনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসব কিছু এবং অন্যান্য অনেক অসঙ্গতিকে বিশেষ শ্রেণির লোকেরা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতার কারণে ঝেড়েমুছে একপাশে ফেলে রেখে দেয়। তাই বিবর্তনবাদী ধারণার গভীর আধ্যাত্মিক ও সর্বজনসম্মত বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামী জবাব এখনও রচনার অপেক্ষায় আছে। বিবর্তনবাদী চিন্তাধারার চ্যালেঞ্জের জবাব সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাবিদগণের পক্ষ থেকে মার্ক্সবাদের মতো অনেকটা একই পদ্ধতিতে অর্থাৎ পবিত্র গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বহু ধর্মীয় জবাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বুদ্ধিবৃত্তিক জবাব দেয়া হলে মুসলিম যুবকরা কোরআন বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হতে পারতো।

স্পেনসারের মতো উনবিংশ শতাব্দীর অন্যান্য বিবর্তনবাদী দার্শনিক, যারা নিজেরা দেশেও এখন আর তেমন প্রভাবশালী নন, ইসলামী দুনিয়ার বিশেষ করে উপমহাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও তাদের দর্শন বিস্তৃতভাবে পড়ানো হচ্ছে, যেন তারা সাম্প্রতিককালের কোনো প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দান করছেন বা পাশ্চাত্যের সর্বশেষ দার্শনিক তত্ত্ব শিক্ষা দিচ্ছেন। কেউ কেউ এমনকি জীব বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক বিবর্তনবাদ বিরোধী ধারণা তথা মানুষের বিবর্তনবাদ-পূর্ব ধারণাকে পুনঃ প্রতিষ্ঠার বর্তমান অগ্রগতি এবং পাশ্চাত্যের কোনো কোনো মহলে এর ক্রমবর্ধমান সমঝদার দৃষ্টির খবর তারা জানতেও চাচ্ছেন না। আরও দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, মানুষ ও বিশ্বজগতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ইসলামী উৎসসমূহের আলোকে কোনো মৌলিক নীতিমালা রচনায় মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। যা হবে মানুষ ও বিশ্বজগৎ সম্পর্কিত বিবর্তনবাদী বা অন্য যে কোনো তত্ত্বের সত্যাসত্য নিরূপণের মানদণ্ড, যা নিছক হাইপোথেসিসকে বৈজ্ঞানিক সত্যের মর্যাদা দেবে না। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং স্থুল দার্শনিক বস্তুবাদকে ধর্মীয় বিশ্বাসের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত না করে এসব ভণ্ডামির আসল চেহারা নিয়ে প্রয়োজনীয় আলোকপাত করবে।১৫

ইসলামী দুনিয়ার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক চ্যালেঞ্জ মানব মনের ফ্রয়েডীয় ও জাংগিয়ান ব্যাখ্যার সাথে জড়িত। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক বিজ্ঞান ও মনোঃসমীক্ষণবাদ চেষ্টা করছে মানুষের উচ্চতর সকল উপাদানকে ‘মনে’র সমস্ত স্তরে নিয়ে আসতে, উপরন্তু তারা ‘মন’কে এতটুকুই গুরুত্ব দিতে চান, যতটুকু আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক ও মনোঃসমীক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে জানা সম্ভব। এখন পর্যন্ত এই চিন্তা পদ্ধতি ইসলামী দুনিয়াকে বিবর্তনবাদের মতো সরাসরি নাড়া দিতে পারেনি, আমার জানামতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম লেখককে ফ্রয়েডিয়ান বা জাংগিয়ান হতে দেখিনি, কিন্তু এর প্রভাব শীঘ্রই বেড়ে যাবে। এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, ফ্রয়েডের মতবাদ, অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক এবং মনঃচিকিৎসার পাশ্চাত্য মতবাদগুলো বিশেষ একটি সমাজ ব্যবস্থার উপজাত, যা ইসলাম থেকে ভিন্ন। স্মরণ করা প্রয়োজন যে, ফ্রয়েড ছিলেন একজন ভিয়েনাবাসী ইহুদী, যিনি পরে গোড়া ইহুদীবাদ থেকেও দূরে সরে যান। খুব কম লোকেই জানেন যে, তিনি একটি মেসিয়ানিক (Mesianic) আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। যারা ছিলেন সেন্ট্রাল ইউরোপের গোঁড়া ইহুদী সম্প্রদায়ের বিরোধী তথা ইহুদী জীবনযাত্রার মূল স্রোতধারা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ভিন্ন দল, খৃষ্টবাদের সাথে তো এর কোনো দূরতম সম্পর্কও নেই। অনেকেই ফ্রয়েডীয় মতবাদ অধ্যয়ন করেন কিন্তু খুব কম লোকই এর গভীরে প্রবেশ করেন, যেখানে এর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যাবে।১৬ সম্প্রতি প্রাচ্যে সূফীবাদের একজন বিখ্যাত প্রবক্তা সূফীবাদ এবং ফ্রান্সের মনোঃসমীক্ষণবীদের সাথে তুলনামূলক কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রতি পূর্ণ শঙ্কা জ্ঞাপন করে বলতে হচ্ছে যে, তিনি মনোঃসমীক্ষণের (Psychoanalysis) প্রতি যথেষ্ট নমনীয় ও কোমল মনোভাব প্রদর্শন করেছেন যা প্রকৃতপক্ষে সূফীবাদের প্রাথমিক নীতিমালার প্রতি বিদ্রুপাত্মক হয়ে পড়েছে। সৌভাগ্যবশত মুসলমানদের মধ্যে মনোঃসমীক্ষণের প্রভাব এখনো তত গভীরভাবে প্রবেশ করতে পারেনি এবং তারাও এর প্রয়োজন অনুভব করেনি। কারণ হচ্ছে অধিকাংশ মুসলমান এখনও দৈনন্দিন নামায আদায় ও হজ্জ্ব পালন করে যাচ্ছেন। হজ্জ্বের প্রধান কেন্দ্র মক্কা হলেও মুসলিম বিশ্বে আরো কিছু পবিত্র স্থান আছে।

এখানকার বুজুর্গ ব্যক্তিগণের উপদেশ এবং নারী-পুরুষ ও শিশুদেরকে যে ধরনের পরামর্শ দেয়া হয় তাতে তাদের অন্তর খোদায়ী রহমতের দ্বারা আরও প্রসারিত হয় এবং মনের সকল প্রকার জট ও ব্যাধি আরোগ্যের জন্য শক্তিশালী উপকরণ হিসেবে কাজ করে। মনঃসমীক্ষণবাদীরা যে কাজ করতে গিয়ে বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনে, বুজুর্গ ব্যক্তিগণ অতি সহজেই সে লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন। কারণ মনঃসমীক্ষণে আধ্যাত্মিক শক্তি থাকে না এবং একমাত্র আধ্যাত্মিক শক্তিই মানুষের আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব করতে পারে। অজ্ঞেয়বাদী (Agnostic) এমনকি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ভৌতিক প্রক্রিয়ার অনুসারী এই মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতি ক্রমশ ইসলামী জগতে অনুপ্রবেশ করবে সম্ভবত পাশ্চাত্য সাহিত্যের আরবি, ফার্সী, উর্দু এবং অন্যান্য ইসলামী ভাষায় অনুবাদের ফলে। এ ধরনের অনুবাদের প্রভাব অতি অল্পকালের মধ্যে চালু হয়ে যাবে এবং বস্তুত ইতোমধ্যেই তথাকথিত মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্যের নামে ইসলামের আদর্শ ও প্রকৃতি বিরোধী সাহিত্য চালু হয়েছে। তবে ইসলাম ব্যক্তিকেন্দ্রিক আধ্যাত্মবাদের বিরোধী। ইসলামের সবচাইতে স্পষ্ট বস্তুগত নমুনা হচ্ছে মসজিদ। মসজিদ ভবনকে এমনি নমুনা ও পরিসর নিয়ে নির্মাণ করা হয়ে থাকে, যেখানে আত্মকেন্দ্রিকতার সকল উপাদানকে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। ইসলাম হচ্ছে সত্যের ব্যবহারিক নিশ্চয়তা এবং এমন এক স্বচ্ছ স্ফটিক যার মধ্য থেকে আত্মার আলোক বিচ্ছুরিত হয়। ইসলামের আধ্যাত্মিক আদর্শ মসজিদের মতো মুসলমানের অন্তরকেও স্ফটিকে রূপান্তর করে দেয় যার মধ্যে দিয়ে ঐশী আলো বিচ্ছুরিত হবে। বস্তুত ইসলামী সাহিত্য ফ্রানজ কাফকা এমনকি দস্তয়ভস্কির আত্মসংবেদনশীল সাহিত্য থেকে ভিন্ন। তারা ছাড়াও সমসাময়িক আধুনিক পাশ্চাত্যের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক আছে, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিরোধীও বটে। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির নিকটতর প্রাচীন সাহিত্যিকগণের মধ্যে প্রথমেই দান্তে এবং গ্যেটের নাম করতে হয়, তারা নিজেরা আন্তরিকভাবে খৃষ্টান ছিলেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই মুসলমান লেখকদের মতো।

আধুনিক যুগের অবশ্য অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে টি.এস.ইলিয়টের নাম উল্লেখ করা যায়। তিনি ছিলেন আধুনিক অন্যান্য লেখকের ব্যতিক্রম, খৃষ্টধর্মের মূল দর্শনের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল ও নিষ্ঠাবান এবং এ কারণেই জগৎ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ইসলাম থেকে বেশি দূরে ছিল না। যাইহোক এদের লেখাগুলো থেকে ভিন্ন, অভিনব, মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতির নিজস্ব ধরন ও উদ্যোগ নিয়ে বেশ কিছু সাহিত্যের প্রভাব মানুষের মনোজগতে অনুপ্রবেশ করছে যা ইসলাম থেকে ভিন্ন। এরা সত্যের বস্তুনিরপেক্ষ মাপকাঠি বলতে কিছু অনুসরণ করেন না। নিঃসন্দেহে ‘মার্সেল প্রস্ত’ ফরাসী ভাষার একজন পণ্ডিত এবং তার লিখিত In search of time past গ্রন্থটি আধুনিক ফরাসী সাহিত্য প্রেমিকদের যথেষ্ট আগ্রহ যুগিয়েছে, কিন্তু এর ধরন ও বক্তব্য নিষ্ঠাবান মুসলিম সাহিত্যের মডেল হতে পারে না। তথাপি এ ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্য কিছু সংখ্যক আরব ও ফার্সী লেখকের জন্য প্রেরণার উৎস হিসেবে স্থান দখল করতে শুরু করেছে। মজার ব্যাপার হলো, আধুনিক ফার্সী সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব সাদেক হিদায়াত নিজেই কাফকা কতৃক গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন, যিনি শেষ পর্যন্ত মনো বিকলনের ফলে আত্মহত্যা করেছিলেন। বিশেষ সাহিত্য প্রতিজ্ঞাসস্পন্ন হয় তিনি শেষ পর্যন্ত ইসলামী জীবনধারা থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন এবং আজকের ফার্সী সমাজের ইসলাম পন্থীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। এ ধরনের লেখকরা সাধারণত পাশ্চাত্য সমাজের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা নিয়েই বেশি আলোচনা করেছেন। মুসলিম সমাজ এখনও যে সমস্যার মুখোমুখি হয়নি তার সাথে মুসলিম যুবকদেরকে পরিচিত করানোর কারণে বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে এবং যুব সমাজ নতুন ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

সবচাইতে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আজকে মুসলিমবিদদের কিছু সংখ্যক লোক জেনেশুনে পাশ্চাত্যের এসব ব্যাধির অনুকরণ করতে চাচ্ছেন। এসব লোকের আসলে কোনো মানসিক অশান্তি নেই। তবুও তারা নিজেদেরকে শুধু আধুনিক প্রমাণ করার জন্যই এরূপ করছে। তারা কবিতা লিখেন যেন যন্ত্রণাক্লিষ্ট এবং বিধ্বস্ত আত্মার প্রতিধ্বনি তুলছেন অথচ তাদের সেরূপ কোনো মানসিক অশান্তি নেই। বস্তুত শূন্যতাবাদের (Nihilism) মতো খারাপ মতবাদ আর একটিও নেই, যদি কেউ শূন্যতাবাদী না হয়েও শুধুমাত্র শূন্যতাবাদীদের অনুকরণে পাশ্চাত্যের ধ্বংসশীল শিল্পসাহিত্য রচনা করতে চায়। মনস্তত্ত্ব ও মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির সাথে নাস্তিকতাবাদী ও শূন্যতাবাদী ধারণা যুক্ত হয়ে ইসলামী দুনিয়ার শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইসলামের জন্য আরেকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ পেশ করেছে। এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হলে একমাত্র ইসলামী ঐতিহ্যবাহী মনস্তত্ত্ব ও মনঃচিকিৎসা পদ্ধতি যা সূফীবাদের মধ্যে পাওয়া যাবে, তার অনুসরণ থাকতে হবে। এছাড়া সঠিক অর্থে ইসলামী সমালোচনা সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমেও আজকের দিনে প্রচলিত সাহিত্যের বস্তুনিরপেক্ষ মূল্যায়ন করা সম্ভব।

ইসলাম বিরোধী মনস্ততত্ত্ব এবং পাশ্চাত্যের দার্শনিক মতবাদগুলো সাহিত্যের ক্ষেত্রে কি হারে অনুপ্রবেশ করছে তা মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিকটবর্তী রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলে বেশ বোঝা যায়। সর্বত্র এখানে সেখানে, বই দোকানে কিংবা গ্রন্থাগারে অনেক বইয়ের মধ্যে কিছু কিছু ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় পুস্তক দেখা যাবে, এমনকি পবিত্র কোরআনও এর মধ্যে রয়েছে। সাথে সাথে বিভিন্ন মুসলিম ভাষায় মার্ক্সবাদ ও অস্তিত্ববাদ (Existentialism) থেকে শুরু করে পর্নোগ্রাফি পর্যন্ত সকল বিষয়ে বিপুল সংখ্যক বই-পুস্তক সাহিত্যের নামে পেশ করা হচ্ছে। ইসলাম ও আধ্যাত্মিকতার অস্তিত্ব যেহেতু সেখানে এখনও আছে, সেহেতু বাদ-প্রতিবাদ সেখানে ওঠছে না, তা নয়। তারপরও এ ধরনের বইপত্র ইসলামের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

শূন্যতাবাদের ব্যাপারে ইসলামের অত্যন্ত জোরালো জবাব আছে এবং মুসলমানগণ, এমনকি আধুনিকতাবাদীরাও পাশ্চাত্যের শূন্যতাবাদের অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে খৃষ্টবাদে ‘আধ্যাত্মবাদ’কে সবসময় ইতিবাচক বা হ্যাঁ-বাচক বিষয় হিসেবে পেশ করা হয়েছে, খৃষ্টানদের ধর্মীয় শিল্পকলাসমূহ থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ব্যর্থতা বা শূন্যতাকে কখনই খৃষ্টীয় শিল্পকলায় আধ্যাত্মিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি, যেরূপ দেখতে পাওয়া যায় ইসলামী ও দূরপ্রাচ্যের শিল্পকলায়।১৭ সুতরাং খৃষ্টবাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে আধুনিক মানুষ শূন্যতাকে (Nihil) দেখেছে নেতিবাচক ও ভয়ঙ্কর বিষয়বস্তু হিসেবে, যদিও তাদের কেউ আবার শূন্যতাকে গুরুত্ব দেয়ার কারণে প্রাচ্যদেশীয় মতবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।

খৃষ্টবাদে ‘আধ্যাত্মবাদ’কে সবসময় হ্যাঁ-বোধক বা ইতিবাচক হিসেবে দেখানো হয়েছে, অপরদিকে ইসলামী শিল্পকলায় নেতিবাচক বা শূন্যতাকে আধ্যাত্মিক ও ইতিবাচক রূপে দেখানো হয়েছে, যেমন কালেমায়ে শাহাদাত যার প্রথম অংশ শুরু হয়েছে, আল্লাহ ছাড়া সকল কিছুকে অস্বীকার করার মাধ্যমে। ইসলামী স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনায় অন্যকোনো বস্তুকেন্দ্রিক স্পেস (Space) নেয়া হয়নি বা অন্য কোনো বস্তুকে অবস্থান নির্ণায়ক হিসেবে গ্রহণ করা হয়নি। বরং বস্তুগত পরিমণ্ডলের বাইরে আলাদা নেতিবাচক স্পেসের (Space) অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ইসলামী যুগের প্রাচীন বাজারের কথা বলা যায়। কেউ যখন দেয়ালঘেরা বাজারে অভ্যন্তর ভাগে চলতে শুরু করেন সেটা থাকে প্রান্তহীন (Continious) স্পেস এবং অন্যকোন কিছুকে কেন্দ্রস্থলে রেখে নয়। অথচ আজকাল পাশ্চাত্যের অনুকরণে মধ্যপ্রাচ্যের বহু নগরীতে কোনো স্কোয়ারের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল মনুমেন্ট নির্মাণ করা হয়ে থাকে, যা শিল্পকলার ইসলামী নীতির পরিপন্থী। অথচ ইসলামী স্থাপত্যের Negative Space এবং Nihil-এর ইতিবাচক আধ্যাত্মিকতার স্থান দখল করার কথা, বলতে গেলে ইসলামী আধ্যাত্মিকতায় অপূর্ণতার ইতিবাচক দিক থাকার ফলে মুসলমানরা অজ্ঞেয়বাদ বা শূন্যতাবাদের নিছক নেতিবাচক প্রভাব তথা পাশ্চাত্যের অভিজ্ঞতা থেকে রেহাই পেয়েছে। এবার মনস্তত্ত্ব ও মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির প্রশ্নে ফিরে আসা যাক, পাশ্চাত্যের শিল্প সমালোচনায় এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগের ফলে ইসলামী সমাজের একটি ক্ষুদ্র অথচ গুরত্বপূর্ণ অংশের মন-মানসিকতায় শিল্পকলার মাধ্যমে অনুরূপ চিন্তা-ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ অংশ এজন্য বলছি যে, তাদের চিন্তা-ভাবনার প্রভাবে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সমাজে মনস্তাত্ত্বিকভাবে উদাসীন রুচির মানুষ সৃষ্টি হতে থাকে। সুতরাং ফ্রয়েডীয় ও জাংগিয়ান চক্রের প্রভাবাধীন সম্পূর্ণ ইসলাম বিরোধী ভাবধারা এভাবেই ইসলামী সমালোচনা সাহিত্য ও সাহিত্যের রুচিশীলতাকে প্রভাবিত করছে এবং সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের মতো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশ পথে মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। এখানে পুনঃরোল্লেখ করা যেতে পারে যে, জাংগ-এর মনস্তত্ত্ব ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্বের চাইতেও বিপজ্জনক। কেননা, তাঁর মনস্তত্ত্ব আপাতদৃষ্টিতে পবিত্র ও ইন্দ্রিয়াতীত জগতের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে বলে প্রতীয়মান হলেও মূলত মানুষের মনে আধ্যাত্মিক ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ক সন্দেহ সৃষ্টি করে দিয়ে পবিত্রতার ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেয় এবং মৌল আদর্শকে জানবার অলৌকিক ও আলোকোজ্জ্বল পথকে তার বিনাশী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রুদ্ধ করে দিয়ে সামষ্টিক অজ্ঞানতা সৃষ্টি করে দেয়, যা বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মানুষের মন নিয়ে সামষ্টিক ক্রীড়াক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। ইসলামী আধ্যাত্মিকতা অন্য যে কোনো খাঁটি আধ্যাত্মিকতার মতো অর্থহীন, বিনাশী, তথা মনঃসমীক্ষণ পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিরোধী। আগেই বলেছি এগুলো সূফীগণের ব্যবহৃত কৌশলসমূহের হাস্যকর অনুকরণ মাত্র। কিন্তু আজকের দিনে ক’জন মুসলমান আধুনিক জগতের সকল ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতাকে এরূপ অনায়াসে চলতে না দিয়ে এর সাথে ইসলামের মৌলিক পার্থক্যগুলো তুলে ধরার জন্য এগিয়ে আসছেন?

ইসলামের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ অস্তিত্ববাদ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন চিন্তাভাবনা ও মনোভাবকে সাধারণভাবে একত্রে সত্তাবাদ (Existentialism) বলা হয়। পাশ্চাত্যের সাম্প্রতিকতম চিন্তা স্রোতের বিভিন্ন চেহারায় একটি দৃষ্টবাদের (Positivism) রূপ নিয়ে মুসলমানদের কাছে এসে পৌঁছেছে। সত্তাবাদের অবশ্য অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা রয়েছে, জার্মান আস্তিক্যবাদী দার্শনিক গ্যারিয়েল মার্সেলের Existez Philosphie থেকে শুরু করে সাঁরত্রে ও তাঁর অনুসারীদের অজ্ঞেয়বাদী ও নাস্তিক্যবাদী ধারণাসমূহ এর অন্তর্ভুক্ত। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে এসব দর্শন ইউরোপ মহাদেশে আবির্ভূত হয়। বর্তমানেও তা ইউরোপের বিভিন্ন অংশে শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। যদিও মুসলিম বিশ্বে এগুলো ততবেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি, তথাপি অল্প কয়েক বছর আগে থেকে, (যাকে অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব বলা যায়) শিল্পকলার মধ্য দিয়ে আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে তথাকথিত দার্শনিক রচনাসমূহে বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা দর্শনের সাথে জড়িত বা বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-যাপন করেন তাদের কিছু সংখ্যককে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। এসব চিন্তাধারায় আধ্যাত্ম-বিরোধী মনোভাব শিক্ষা দেয়া হয়, ফলে মানুষ ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আধ্যাত্মিকতার তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করে না। অথচ আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে ইসলামী দর্শনের মর্মকথা। তাই সত্তাবাদ বিশেষ করে অজ্ঞেয়বাদী ধারণা ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের জন্য আজ সবচেয়ে বিপজ্জনক কুহক। উপরন্তু সত্তাবাদের সর্বশেষ প্রচেষ্টা হচ্ছে, বিশেষ মহল কতৃক ইসলামী দর্শনকে পাশ্চাত্য চিন্তাধারার আলোকে ব্যাখ্যা করা। মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এই মারাত্মক চিন্তাধারার অহেতুক অন্ধ অনুকরণের জন্য সরাসরি দায়ী।১৮

যদি এ ধরনের ব্যাখ্যা চলতে থাকে তবে অতি সহজেই মুসলমানদের মধ্যে এরূপ আরেকটি নতুন পদ সৃষ্টি হবে। আজকে দেখা যায় প্রায় সব মুসলিম দেশে মুসলমানেরা তাদের দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিক অতীতকে পাশ্চাত্যের লেখকদের কাছ থেকে শিখছে। এরমধ্যে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য থাকতে পারে এবং জ্ঞানের দিক থেকে অত্যন্ত মূল্যবান হতে পারে কিন্তু এর সবকিছুই অমুসলিমদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনে সৃষ্ট। ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে গেলে যে সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি অথবা ফরাসি ভাষা ব্যবহার করা হয় যেমন পাকিস্তান, ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়া এবং পশ্চিম মরক্কো এবং তিউনিসিয়া ইত্যাদি দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। উপনিবেশবাদ বিরোধী বক্তব্যের সাথে তাল মিলিয়ে এখন মুসলমানদের উপর নিকৃষ্টতম উপনিবেশবাদ তথা চিন্তাগত দাসত্ব বা মনস্তাত্ত্বিক ঔপনিবেশিকতাকে জয় করার এখনই প্রকৃষ্ট সময়, এখনই তাদের সংস্কৃতিকে জানা ও বোঝা, বিশেষ করে এ বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক মর্ম নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে উপলব্ধি করতে হবে।

এমন কিছু সংখ্যক মুসলমান আছেন, যাঁরা তাঁদের নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারের কোনো কোনো অংশকে অস্বীকার করেন, সর্বাগ্রে তাদের সেই উত্তরাধিকারকে জানা উচিত। গ্রহণ ও বর্জন উভয়ই জ্ঞানের ভিত্তিতে হবে। যে পথেই আপনি চলুন না কেন অজ্ঞতার কোনো ক্ষমা নেই। কোনো বিষয় না জেনে যেমন অস্বীকার করাও যায় না, তেমনি সঠিক জ্ঞান ছাড়া কোনো বিষয়কে গভীরভাবে গ্রহণ করা যায় না। কারণ যে জিনিস তার হাতে নেই তা হারানোর প্রশ্ন ওঠে না। এই সহজ-সত্য কথাটি আজকে সবাই ভুলে যাচ্ছেন। কয়েক বছর আগের একটি ঘটনা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ঘটনাটি ঘটে যখন একজন বিখ্যাত জেন (zen) বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত পাশ্চাত্যের কোনো একটি প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে সফরে গিয়েছিলেন। জেন বিষয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ হওয়ার পর একজন গ্র্যাজুয়েট ছাত্র প্রশ্ন করল, “জেন বিশেষজ্ঞ কি মনে করেন না যে, বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র পুড়ে ফেলা এবং বুদ্ধ মূর্তি ছুঁড়ে ফেলে দেয়া উচিত?” পণ্ডিত মৃদু হেসে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ” কিন্তু আপনি শুধু আপনার কাছে যে কাগজপত্র আছে সেগুলো পুড়তে পারেন এবং আপনার কাছে যে মূর্তিটি আছে শুধু সেটিই ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন”। এটা ছিল তাঁর বিজ্ঞজনোচিত জবাব। ঐ পণ্ডিত বোঝাতে চেয়েছিলেন, কোনো ধর্মের বাহ্যিক রূপকে পরিবর্তন করতে হলে তার বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানগুলো পালন করতে হবে, পরবর্তী পর্যায়ে এর অন্তনিহিত তাৎপর্যে অনুপ্রবেশ এবং স্বরূপ বদল করতে হবে। যে লোক এ সব বাহ্যিক অনুষ্ঠানাদি পালন করে না, সে কখনও একে টিকানোর আশা করতে পারে না। সে বরং আরও পিছিয়ে পড়বে এবং বাইরের রূপ বদল করতে গিয়ে ভুল করবে। মানুষের ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিবৃত্তিক উত্তরাধিকারের বেলায় একথাটি অন্যভাবে প্রযোজ্য হতে পারে।

প্রাচীন প্রজ্ঞার নিয়ম হবে, মূলনীতি মোটেও না বুঝে কারও পক্ষে ঐ প্রজ্ঞাকে অতিক্রম করে যাওয়া উচিত নয়। যদি কেউ তার শোচনীয় অজ্ঞতা নিয়ে ঐতিহ্যবাহী চিন্তা পদ্ধতি থেকে সরাসরি মুক্ত হতে চায় বা নতুন চিন্তার প্রসার ঘটাতে চায় সেটা হবে এমন এক অজ্ঞতা যা বস্তুত পক্ষে তাকে তার স্বভাবের নিকৃষ্টতম দাসে পরিণত করেছে। একমাত্র আধ্যাত্মিক জগতের সীমাহীন পরিমণ্ডল থেকেই প্রকৃত মুক্তি আসতে পারে, ধর্মের বাহন এবং তার সুচিন্তিত শিক্ষা সমূহের মাধ্যমেই সে লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। আজকের মুসলমানদের যথেষ্ট বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বুঝাতে হবে যে, তারা যেখান থেকে যে দিকে যেতে চায়, যাত্রা শুরু করে দিতে হবে। একটি বিখ্যাত চীনা প্রবাদ আছে, ‘হাজার মাইলের ভ্রমণ শুরু হয় একটি পদক্ষেপ দিয়ে’। এখন এই প্রথম পদক্ষেপ শুরু করতে হবে তার নিজ এলাকায় এবং এটা অধিক সত্য যে, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকে শুরু করতে হবে। ইসলামী দুনিয়া যেখানেই যেতে চাক না কেন তাদের নিজস্ব বাস্তবতা এবং ইসলামী ঐতিহ্যের ভিত্তিতে শুরু করতে হবে, কল্পিত পরিস্থিতির আলোকে নয়। যারা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বঞ্চিত তাদের সফর আসলে সফল ও কার্যকর সফর নয়। তারা শুধু কল্পিত সফর করে যায়। একজন পাকিস্তানী, ফার্সী বা আরব বুদ্ধিজীবী যিনি মুসলমানদের সফল চিন্তানায়ক হতে চান, তাঁকে স্মরণ রাখতে হবে তিনি কে এবং কোথা থেকে এসেছেন, যদি তিনি নিজেকে পুরো ইসলামী সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না চান। অক্সফোর্ড বা সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবাধীন থেকে তিনি লাহোর, তেহরান বা কায়রোতে বসে যত কঠোর প্রচেষ্টা করে থাকুন না কেন সফল হতে পারবেন না। পাশ্চাত্যমনা তথাকথিত মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ যারা অভিযোগ করেন যে, ইসলামী সমাজ তাদেরকে বুঝতে চাচ্ছে না বা স্বীকৃতি দিচ্ছে না, তারা ভুলে যান যে, তাঁরা নিজেদের সংস্কৃতি ও সমাজকে বুঝতে বা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিলেন বলেই আজ তারা নিজেদের সমাজ কর্তৃক অগ্রাহ্য হচ্ছেন। সুতরাং এই অগ্রাহ্য করা হচ্ছে ইসলামী সমাজে জীবনের প্রতীক, ইসলামী সংস্কৃতির অস্তিত্বের প্রতীক।

দর্শন প্রসংগে বলতে হয়, যে সব মুসলিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মুসলিম ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, তাদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো, বিশেষত পারস্যে ইসলামী দর্শন আজও সক্রিয় ঐতিহ্য হিসেবে বেঁচে আছে এবং সেখানে দর্শনের নামে ইসলাম বিরোধী কোনো বিষয় ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধিজীবীগণের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি না হয়ে পারেনি। অবশ্য পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতজানু ও বশ্যতামূলক ইসলামী চিন্তাধারা সৃষ্টির প্রচেষ্টা থেকে মুসলিম বিশ্বের এই অংশটুকুও সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। তবে প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, দুটি কারণে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাব এখানে অপেক্ষাকৃত কম লক্ষ্য করা যায়। তা হলো, ভাষার প্রতিবন্ধকতা এবং ঐতিহ্যবাহী ইসলামী দর্শনের সক্রিয়তা। এছাড়া ইংরেজী ভাষায় আল্লামা ইকবালের দুটি দার্শনিক গ্রন্থ The Development of Metaphysics in PersiaReconstruction of Religious thought in Islam পাকিস্তানে এবং সম্প্রতি এর ফার্সী ভাষায় তরজমা প্রকাশিত হওয়ার ফলে পারস্যে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গবেষণালব্ধ ফসল উপহার দিয়েছে। মুসলিম ভাষা ব্যবহারকারী কতিপয় দেশে কিছু কিছু দর্শনের বই ফার্সী এমনকি আরবি ভাষায় প্রকাশিত হলেও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেমন বইয়ের নাম ফালাসাফাতুনা (আমাদের দর্শন), যেন সত্য দর্শন অথবা সত্যানুসন্ধান কখনো আমার বা আমাদের হতে পারে। কোনো আরব বা ফার্সী ঐতিহ্যবাহী দার্শনিক এ জাতীয় কথা বলেননি। কারণ মুসলমানরা যখনই দর্শন চর্চা করেছেন, দর্শন ছিল তাদের কাছে আল-ফালসাফা বা আল-হিকমাহ্ অর্থাৎ দি ফিলোসফি বা দর্শন-ইসলামের অবস্থান শাস্ত্র ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে উন্নীত হয়ে এই উচ্চতর সত্য দর্শন এবং সত্য (আল হাক্কাহ) থেকেই এর উৎপত্তি। আমাদের দর্শন বা আমার চিন্তা এরূপ প্রত্যয় বা পরিভাষা ব্যবহার করা হলে মুসলিম ভাষাসমূহে একে ইসলামী মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি বোঝায়। এর ফলে চিন্তাধারাকে কখনোই বিশ্বজনীন করা যাবে না। এমন সব ত্রুটি-বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ইসলামী চিন্তাধারার বিপুল ভাণ্ডারে রক্ষিত সনাতনী অস্ত্র এবং এই ভাণ্ডার থেকে সংগৃহীত জবাব প্রয়োজনে আবার সমাজে ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন ধারার প্লাবন এনে দিতে পারবে।

এ ব্যাপারে সত্তাবাদ এবং পারস্যের সনাতনী ইসলামী দর্শনের কথায় ফিরে আসা যাক। এখানে উল্লেখ্য, যেহেতু পারস্যে ফালসাফাত আল উজুদ (Falsafat- al-Wujud) নীতির ভিত্তিতে (যাকে কেউ কেউ ভুল বশত মতবাদ হিসেবে তরজমা করে থাকেন) সনাতনী বা ঐতিহ্যবাহী দর্শন এখনও সক্রিয় থাকায়, ইউরোপীয় সত্তাবাদকে সেখানে শক্তিশালী প্রতিরোধের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। বস্তুত কেউ যদি ঐতিহ্যবাহী ইসলামী দর্শনকে ইবনে সীনা এবং সোহরাওয়ার্দী থেকে শুরু করে আধ্যাত্মবিদ্যার মহান ব্যাখ্যাদাতা সদরুদ্দীন সিরাজী (মোল্লা সাদরা) থেকে জেনেছেন, তিনি খুব সহজেই ঐতিহ্যবাহী ইসলামী দর্শন ও আধুনিক সত্তাবাদের বিরাট পার্থক্যটুকু উপলব্ধি করতে পারবেন। এমনকি সত্তাবাদের যে বিষয়গুলো খুবই স্পষ্ট তা থেকে কোনো খণ্ডিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়তো সম্ভব কিন্তু মূল সূত্রসমূহের আলোকে একটি পরিপূর্ণ সিদ্ধান্ত একমাত্র ঐতিহ্যবাহী দর্শনে পাওয়া যায়।

হেনরী করবিন পাশ্চাত্যের একমাত্র পণ্ডিত যিনি সদরুদ্দিন সিরাজীর Kitab al Masha’ir গ্রন্থের ফরাসী অনুবাদের দীর্ঘ ভূমিকায় (ফরাসী নাম Le Livre das penetrations metaphysique) ইসলামী দর্শনের এই শেষের পর্যায়টুকু অর্থাৎ ইসলামী দর্শন ও সত্তাবাদে দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা তুলে ধরেছেন। উপরন্তু প্রথমোক্তটি শেষোক্তটির জন্য যে সংশোধনের সুযোগ এনে দিয়েছে, তা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন।১৯ ঘটনাক্রমে একটি মজার ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, Heidegger রচিত Seinund Zeit গ্রন্থটি হেনরী করবিন কর্তৃক অনূদিত হওয়ার পর সারত্রেঁ প্রথম সত্তাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন, কিন্তু করবিন নিজে এই চিন্তাধারা থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে গিয়ে সোহরাওয়ার্দীর প্রাচ্যের আলোক (Orient of light) সমুদ্রে এবং সদরুদ্দিন সিরাজীর আলোকোজ্জ্বল দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। আলোচনার উপসংহারে এসে আরেকটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখের দাবী রাখে, তা হলো আধুনিক সভ্যতার পরিবেশ সংকট, যা ইসলামী দুনিয়ার মুসলমানসহ সমগ্র মানবতার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বর্তমান সময় সম্পর্কে যাঁরা সচেতন তারা জানেন যে, এটা সবচাইতে জরুরী সমস্যা, অন্ততঃপক্ষে বস্তুগত দিক থেকে পৃথিবী আজ মারাত্মক পরিবেশ সংকটের মুখোমুখি, মানুষ এবং পরিবেশের মধ্যে ক্রমশ ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অথবা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পূর্বেই বলা হয়েছে, ইসলাম ও তার বৈজ্ঞানিক অবদানসমূহে এ সম্পর্কে বিশেষ জরুরী ও সময়োপযোগী বক্তব্য পাওয়া যায় যা বিশ্বের এই মারাত্মক সমস্যার যতদূর সম্ভব সমাধানে সাহায্য করতে পারে। যাইহোক, দুর্ভাগ্যবশত খুব অল্প সংখ্যক আধুনিকতাবাদী মুসলমান ইসলামের সে আহ্বানের প্রতি মনোযোগ দিতে পেরেছেন। আমরা জানি, মুসলমানরা প্রকৃতির বিভিন্ন শাখা যেমন জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে চর্চা করেছেন এবং প্রকৃতির সাথে ভারসাম্য নষ্ট না করেও তারা বড় বড় আবদান রেখেছেন। তারা প্রকৃতির নিজস্ব দর্শনে অন্তর্ভুক্ত থেকেই সবসময় প্রকৃতি বিজ্ঞানের (Natural Science) চর্চা করেছেন যা ছিল ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে নিখিল বিশ্বের সমগ্র সৃষ্টি কাঠামোর সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। ইসলামী বিজ্ঞানের পিছনে কাজ করেছে খাঁটি প্রকৃতিগত দর্শন, আধুনিক ভাষাসমূহের মাধ্যমে সবার সামনে এই দর্শন যদি তুলে ধরা হয় তবে আজকের ভিত্তিহীন প্রকৃতি দর্শনের বিকল্প হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে, এছাড়া মূলনীতিসমূহ যথার্থ আধ্যাত্মিক উপলব্ধির অভাবে আজকে মানুষ ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে।২০

দুর্ভাগ্যবশত মুসলমানরা ইসলামের বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে খুব কমই অধ্যয়ন করেছেন, যদিও তারা অধ্যয়ন করেছেন একটা হীনমন্যতা নিয়ে। সুতরাং তারা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, বৈজ্ঞানিক অবিষ্কারে মুসলমানরা পাশ্চাত্যের অগ্রগামী ছিল, সুতরাং মুসলমানরা সাংস্কৃতিক অগ্রগতির দিক থেকেও পিছনে পড়ে নেই। কিন্তু মুসলমানদের এই মূল্যবান বৈজ্ঞানিক উত্তরাধিকারকে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ব্যবহারের চিন্তা খুব কমই করা হয়েছে। অথচ এই উত্তরাধিকারকে কাজে লাগানো হলে আধুনিক বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার প্রয়োগের ফলে মানুষের জন্য যেসব মারাত্মক আপদ সৃষ্টি হয়েছে তা এড়ানো যেতো এবং অতীতেও তা সম্ভব হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সপ্তদশ শতকের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও তার পরিণতি যা আজকে আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা মুসলমানরা আনেনি। মুসলিম পণ্ডিত চিন্তাবিদগণকে ইসলামের বৈজ্ঞানিক অবদানসমূহে যে প্রকৃতি দর্শন (Philosophy of Nature) রয়েছে তাতে আবারও জীবনদান করার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে হলে তাদের নিজেদেরই এসব বিজ্ঞানকে অধ্যয়ন করতে হবে।

আধুনিক মুসলমানদের নির্ধারিত লক্ষ্য এবং এর কাক্সিক্ষত ফলাফল আসলে আলাদা। তারা এ বলে গর্ববোধ করেন, ইসলাম রেনেসাঁর পথকে সুগম করেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে রেনেসাঁ ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং ইসলামী সংস্কৃতি রেনেসাঁ সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। অতএব, ইসলামী সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এটা সম্পূর্ণ হীনমন্য বক্তব্য। এ ধরনের অবাস্তব যুক্তি প্রদর্শনের সময় তারা সজাগ থাকেন না যে, পাশ্চাত্যের মানুষ যখন আল্লাহ-প্রদত্ত ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিদ্রোহ করেছিল এবং পাশ্চাত্যের লোকেরা রেনেসাঁর সময় যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল তার অধিকাংশের ফলশ্রুতিতে আজকের আধুনিক জগত নানাভাবে ভুগছে। মুসলমানদের শোকর গুজার করা উচিত যে, তারা কখনও আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি বা আধ্যাত্মবিরোধী মানবতাবাদে অংশগ্রহণ করেনি, যে কারণে দুনিয়া আজ মানবেতর পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইসলাম মূলত যে কাজটা করেছে তা হলো, আল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদের বিদ্রোহকে প্রতিরোধ করেছে, প্রেমিথিয়ান এবং তিতানেষ্কের আদর্শ রেনেসাঁ যুগের শিল্পকলায় স্পষ্টভাবে যা দেখানো হয়েছে ইসলামী আদর্শ তার বিপরীত এবং আল্লাহর উপর সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এটা ঠিক যে, ইসলামী সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান পাশ্চাত্যে রেনেসাঁর উত্থানে বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে কিন্তু ইসলামী উপাদানগুলোকে ইসলামী বৈশিষ্ট্য এবং সামগ্রিক ব্যবস্থা থেকে ছিন্ন করার পরই ব্যবহার করা হয়েছে, অথচ সামগ্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই কেবল ইসলামী দর্শনের পূর্ণ তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে।

মুসলমানদের উচিত ইসলামী বিজ্ঞান সম্পর্কে চর্চা করা। প্রথমত মুসলিম যুবকদেরকে (তাদের অনেকেই এ্যালজেবরার প্রাথমিক সূত্রগুলো সম্পর্কে জানার প্রবণতা বন্ধ করে দিয়েছে) দেখানোর জন্য যে মুসলমানরা কয়েক শতাব্দী ধরে বিজ্ঞানের চর্চা করেছিল এবং আজকের দিনে মাধ্যমিক স্কুলসমূহে যে গণিতশাস্ত্র শেখানো হয় তার বেশির ভাগ মুসলমানদের অবদান, বিজ্ঞানী হয়েও তারা নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। দ্বিতীয়ত ইসলামী দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও আধ্যাত্মবিদ্যার মধ্যে ইসলামী-বিজ্ঞানের যে সংগতি এবং ইসলামী বিজ্ঞানের সাথে প্রকৃতি দর্শনের সংগতি, যে সংগতির কথা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে তা দেখিয়ে দেয়া। ইসলামী বিজ্ঞানের মহান কীর্তি যেমন ইবনে সীনা, আল বিরুনী, ওমর খৈয়াম এবং নাসিরউদ্দীন তুসীর অবদানসমূহকে এই উভয় দিক থেকেই প্রয়োগ ও বিচার করতে হবে। সর্বশেষে আরও স্পষ্ট করে বলতে হচ্ছে যে, ইসলাম ও ইসলামী সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে ইসলামী ঐতিহ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক আত্মরক্ষা ব্যবস্থা ও সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সর্বোপরি আধুনিক জগত ও তার এ সকল ত্রুটিসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনা করতে হবে। ঘন ঘন পরিবর্তনের ধুয়া উঠার ফলে পাশ্চাত্যের পথ অনুসরণকারী মুসলমানরা একই পরিণতি বা এর চাইতে দূরতিক্রম্য খারাপ পরিণতি ছাড়া অন্য কিছু আশা করতে পারে না। মুসলিম বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জ ও অন্য সবকিছুকে আত্মবিশ্বাসের সাথে মোকাবেলা করতে তাদের মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হীনমন্য জীবন যাপন করা বন্ধ করতে হবে। তাদের নিজেদের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, এশিয়ার অন্যান্য মহান ঐতিহ্যের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে শুধুমাত্র প্রতিবাদ করার জন্য নয়; বরং প্রয়োজনবোধে আঘাত করার জন্যও। বর্তমান বিশ্বের এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে মানবতাকে আল্লাহ-প্রদত্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে ওষুধ প্রদান করে চিকিৎসা করতে হবে, তা অবশ্য রোগী যদি স্বেচ্ছায় চিকিৎসা পেতে চায়। সবচেয়ে বড় কাজ হলো সত্যকে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করা, এর প্রভাব এতো সুদূরপ্রসারী যে, সাধারণভাবে তা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং সত্যকে অবশ্যই দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং চ্যালেঞ্জের সকল ফ্রন্টে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ইসলামের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, ফলাফল আল্লাহর হাতে। কোরআন দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছে, ‘সত্য সমাগত মিথ্যা অপসারিত, মিথ্যা তো অপসারিত হবারই কথা (১৭:৮১) (Truth hath come and falsehood hath vanished away. Lo falsehood is ever bound to vanish)-(১৭ ও ৮১, পিকথলের তরজমা)।

 

অনুবাদ : নূরুল আমীন জাওহার

 

 

তথ্যসূত্র :

১. এই রচনাটি ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে ইসলামিক কালচারাল সেন্টার লন্ডনের উদ্যোগে আয়োজিত প্রথম ইসলামী সম্মেলনে বিপুল সংখ্যক মুসলিম শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে পেশকৃত ভাষণের উপর ভিত্তি করে রচিত। এটি লন্ডনের ‘দি মুসলিম’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং পরে আরও সংশোধিত হয়ে ‘দি ইসলামিক কোয়াটারলি’ লন্ডনে প্রকাশিত হয়। (১৭শ ভলিউম, ১ম ও ২য় সংখ্যা জানুয়ারী থেকে জুন ১৯৭৩)।

২. এটা অবশ্যই বলতে হয় যে, দুই যুগ ধরে পাশ্চাত্য সমাজ, এর  দ্রæত অবনতির পর কিছু তরুণ মুসলমান বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পাশ্চাত্য জগতকে উপলব্ধি করার পর তারা পূর্ববর্তীদের চাইতে অনেক কম মোহিত হচ্ছেন এবং মাত্র সমালোচনা করতে শুরু করেছেন। কিন্তু ইসলামের আলোকে এরূপ সমালোচকের সংখ্যা খুবই সীমিত। মরিয়ম জামিলার বিভিন্ন রচনায় এ সম্পর্কিত আলোচনা এবং এবং ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সংঘাতের সাধারণ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ইসলাম ভারসাস দা ওয়েষ্ট (লাহোর, ১৯৬৮) নামক তার গ্রন্থটি দেখুন।

৩. কিছু সংখ্যক আধুনিকমনা ওলামাও অবশ্য এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। দেখুন ডবিøউ. সি.স্মিথ, ইসলাম ইন মডার্ন হিস্টোরী (পি.ইউ.পি, ১৯৫৭) যেখানে মিসরীয় ওলামাগণের এ জাতীয় আপোষকামী মনোভাবের ধরন ও বক্তব্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

৪.এখানেই মৌলবাদী পিউরিট্যানিক্যাল মুভমেন্ট এবং সালাফিয়্যাহদের এবং আধুনিকতাবাদী ধারার সম্মিলন ।

৫. F. Schoun , ÔNon activity without Truth : Studies in Comperative Religion, 3rd Edition (১৯৬৯), p. ১৯৪-২০৩ ।

৬. আমি বলতে চাচ্ছি না যে, মুসলিম পাশ্চাত্যবিদেরা (Occidentalist) পাশ্চাত্যের প্রাচ্যবিদদের (Occidentalist) কুসংস্কার ও ভুলত্রুটিগুলো এখানে চালু করুক, বরং তারা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পাশ্চাত্যকে যতবেশি সম্ভব জানুক যেমনিভাবে ওরিয়েন্টালিষ্টরা প্রাচ্যকে জানতে চেষ্টা করেছেন পাশ্চাত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে । অবশ্য আধুনিক পাশ্চাত্যের সনাতন -বিরোধী স্বভাবের কারণে প্রাচ্যদেশীয় দর্শন ও ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি যথার্থ ছিল না, যাহোক প্রসঙ্গটি বর্তমান আলোচনার বিষয় নয়।

৭. দেখুন সাইয়েদ হোসেইন নাসর, ইসলামিক স্টাডিজ (বৈরূত, ১৯৬৭) অষ্টম অধ্যায়।

৮. দেখুন হোসেইন নাসর, দি এনকাউন্টার অব ম্যান এন্ড নেচার (লন্ডন, ১৯৬৮), পৃ. ৯৩।

৯. সমাজতন্ত্র বর্তমান সময়ে ইসলামী সমাজতন্ত্র বা আরব সমাজতন্ত্র ইত্যাদি নামে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, সমাজতন্ত্রকে ভ্রান্তভাবে ‘সামাজিক সুবিচারের’ পদবাচ্যে অভিহিত করা হয় এবং এর রাজনৈতিক উপযুক্ততা সম্পর্কে প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণ না করেই শুধুমাত্র আধুনিক বা প্রগতিশীল মনে হওয়ায় অনেকেই একে গ্রহণ করে নিচ্ছেন।

১০. আল্লামা সাঈদ মোহাম্মদ হোসাইন তাবাতাবাই কর্তৃক পাঁচ খণ্ড প্রণীত ‘উসুল-ই -ফালসাফা’ গ্রন্থটিকে এখানে ব্যতিক্রমী গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় যা আজকের পারস্যে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও পরম পবিত্র গ্রন্থ হিসেবে গণ্য। এতে আয়াতুল্লাহ মুর্তাজা মুতাহারীর মন্তব্য সংযোজিত আছে। (কোম, ১৩৯২ হিজরী)। আমরা যতদূর জানি এটাই একমাত্র গ্রন্থ যেখানে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামী মৌলদর্শন বিশেষ করে মোল্লা সাদরার চিন্তাধারার আলোকে দ্বা›িদ্বক বস্তুবাদের জবাব দিতে চেষ্টা করা হয়েছে।

১১. দেখুন, সাইয়েদ হুসেইন নাসর, এনকাউন্টার অব ম্যান এ্যান্ড নেচার, পৃঃ ১২৪, যেখানে জীববিজ্ঞানীদের বিভিন্ন যুক্তি ও সূত্রসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়াও দেখুন, (G.Berthault) L’evolution, fruit d’une illusion scientifique প্যারিস, ১৯৭২।

১২. উদাহরণস্বরূপ দেখুন Leroi Gourhan, Le Geste et la parole, ২য় খণ্ড, (প্যারিস, ১৯৬৪-৬৫), জে. সারভিয়র, LÕhome et la invisible (প্যারিস, ১৯৬৩), ই খোল্লব (সম্পাদিত) Eternita’e storia, l tion philosophique et figure traduction elle de l’homme en Occicent’ Eranos Jahrbuch xxxviii ১৯৬৯, (জ্যুরিখ, ১৯৭১), পৃ. ৪৫-৯৩। এমনকি লেভি স্ট্রস-এর মত শিক্ষাবিদ যিনি স্ট্রাকচারালিজমের প্রতিষ্ঠাতা তিনি বলেছেন Les homes out toujours perse aussi bien’. অর্থাৎ The men are still Persian as well.

১৩. যাহোক এটা বলতে হয়, সৌভাগ্যবশত ইসলামকে বিবর্তনবাদী ধর্ম হিসেবে তুলে ধরার মত তেমন উল্লেখযোগ্য লেখকের এখনও আবির্ভাব হয়নি। হিন্দু ধর্মে ও খৃস্টবাদে যথাক্রমে শ্রী অরবিন্দু এবং তেলহার্ড দ্য চারভীন অনুরূপ বক্তব্য নিয়ে তাদের চারপাশে অসংখ্য ভক্ত যোগাড় করেছিলেন। ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষার ভিত্তি এখনও এমন শক্তিশালী শাশ্বত ঐশী বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত যে, ব্যাপক প্রভাব খাটিয়েও অনুরূপ বিচ্যুতি ঘটান সম্ভব হয়নি।

১৪. দেখুন আবুবকর সিরাজুদ্দীন, দি ইসলামিক এন্ড খ্রিস্টীয়ান কনসেপশনস অব দি মাচ অব টাইম : দি ইসলামিক কোয়াটারলী। (১৯৫৪) পৃঃ ২২৯-৩০।

১৫. Lord. Northbowrne, Looking back on Progress (লন্ডন, ১৯৭১), M. Lings, Ancient Beliefs and modern superstitions (লন্ডন, ১৯৫৪) এবং, F. Schuon, -Light on the ancient worlds, অনূদিত, লর্ড নর্থ বোরন (লন্ডন, ১৯৬৫)

১৬. দেখুন ডবিøউ.ন.পেরী (W. N. Pery) দি রিভোল্ট এগেনস্ট মোসেজ, স্টাডিজ ইন কমপারেটিভ রিলিজিয়ন (১৯৬৭), পৃ. ১০৩-১৯, এফ.শউন (F. Schuon), দি সাইকোলজিকাল ইমপোস্চার, ঐ, পৃঃ ৯৮-১০০, এবং আর গুয়েনন, The heign of quantity and the signs of the times অনূদিত, লর্ড নর্থ বোরন (বাল্টিমোর, ১৯৭২) অধ্যায় ২৪, ফ্রয়েডের চাইতে জাংগ-এর মতবাদ অধিক বিপজ্জনক। কারণ তিনি প্রাচীন প্রতীকসমূহকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে মনস্তাত্তি¡ক দিক থেকে বিচার করেন। দেখুন Burckhardt; Cosmology and modern Science iii; Tomorrow, iii (১৯৬৫), পৃ. ১৯-৩১, Scienza modernae suggezza tradizionale, (Tornio-১৯৬২) অধ্যায়-৪ ।

১৭. ইসলামী শিল্পকলায় অপূর্ণতা বা অসম্পূর্ণতার গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে হলে দেখুন T. Burchardt ‘দি ভয়েড ইন ইসলামিক আর্ট স্টাডিজ ইন কমপারেটিভ রিলিজিয়ন IV (১৯৭০), ৯৬-৯৯, এস. এইচ. নাসর, “দি সিগনিফিক্যানস অব দি ভয়েড ইন দি আর্ট এ্যান্ড আর্কিটেকচার অব ইসলামিক পারসিয়া”, জার্নাল অব দি রিজিওনাল কালচারাল ইন্সটিটিউট (তেহরান), খন্ড (১৯৭২), ১২৮-৮০, ঐ, দি সিগনিফিক্যান্স অব দি ভয়েড আর্ট , দি আর্ট এন্ড আর্কিটেকচার অব ইসলাম , দি ইসলামিক কোয়াটারলী , ১৬শ ভলিউম , ১ম খন্ড , পৃঃ ১১৫-২০ ।

১৮. দেখুন সাইয়েদ হোসেইন নাসর, ইসলামিক স্টাডিজ, ৮ম ও  ৯ম অধ্যায়।

১৯. Talat 143, Kitab al-Mashair (Le livres des penetrations metaphysiques) তেহরান-প্যারিস (১৯৬৪) ভূমিকায় ৪র্থ অধ্যায়; এছাড়া দেখুন The concept and reality of existence (টোকিও, ১৯৭১) যেখানে ইসলামের গভীর তাত্তি¡ক আলোচনা করা হয়েছে এমনকি ২য় অধ্যায়ে পাশ্চাত্যের সত্তাবাদ এবং ইসলামের সাথে কিছু তুলনামূলক আলোচনাও করা হয়েছে। অবশ্য এর সবকিছু গ্রহণ করা আমাদের পক্ষে কঠিন ।

২০. দেখুন সাইয়েদ হোসেইন নাসর , সায়েন্স এ্যান্ড সিভিলাইজেশন ইন ইসলাম (ক্যামব্রিজ, ১৯৬৮) এবং সাইয়েদ হোসেইন নাসর, এন ইনট্রোডাকশন টু ইসলামিক কসমোলজিক্যাল ডকট্রিন্স (ক্যামব্রিজ, ১৯৬৪)।

 

 

১৪৩৯ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top