সৈয়দ আমীর আলীর Spirit of Islam একই বিষয়ে ইংরেজী ভাষীদের কাছে খুবই পরিচিত। বস্তুত তা ইংরেজী ভাষার উৎকৃষ্ট শ্রেণীর গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। একইভাবে ইউরোপ এবং আমেরিকার ধর্মান্তরিত মুসলমানরা এই বই থেকে ইসলামের একটা বিকৃত ধারণা লাভ করেন। একজন ইংরেজ মুসলমান এই বই সম্পর্কে বৈচিত্র্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন: “ইসলাম সম্পর্কিত অধ্যয়নে যে বইটি আমাকে সব চাইতে প্রভাবিত করেছে সেটি হচ্ছে সৈয়দ আমীল আলীর Spirit of Islam, যদিও বইটি মুসলিম বিশ্বে সমালোচনার উর্ধে নয়। এতে বহু আচার প্রথার সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এতে অবশ্য মুসলমানদের সামনে ঈমানের অনুপ্রেরণামূলক বিশালতা তুলে ধরা হয়েছে যা জীবনে বাস্তবায়ন করা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য। এটি নিঃসন্দেহে এমন বই যা প্রতিটি মুসলমান ছাত্রের পড়ার চেষ্টা করা উচিৎ”।
মুসলিম বিশ্বে এর আশাতীত সমালোচনা হয়েছে। বস্তুতঃ শুধুমাত্র সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। উলেমারা যদি ঘুমিয়ে না থেকে দায়িত্ব সচেতন হতেন তা হলে এই বই এর বিষয়বস্তু ধর্মের বিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ ছিল।
১৮৪৯ সালে শিয়া ধর্মানুসারী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আমীর আলী আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন এবং স্যার সৈয়দ আহমদের একনিষ্ঠ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি ইংরেজী সংস্কৃতির প্রতি সীমাহীন উৎসাহী ছিলেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি স্বীকার করেছেন যে, বিশ বছর বয়সে তিনি শেক্সপিয়ার, মিলটন, কীটস, বায়রন, রংফেলো সহ অন্যান্য কবির অধিকাংশ বই এবং Thackery ও স্কট প্রমুখের উপন্যাস শেষ করেছেন। শেলীকে অন্তর দিয়ে জানতেন। পরে তিনি ওকালতি শুরু করেন এবং যৌবনের অধিকাংশ সময় ও ১৯২৮ সালের মৃত্যু পর্যন্ত তার ইংরেজ স্ত্রীর সঙ্গে লন্ডনে কাটান।
তার বিখ্যাত Spirit of Islam এর প্রথম সংস্করণ ১৮৯১ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে বর্তমান রূপ গ্রহণ করার আগে আমীর আলী বইটি বহুবার সংশোধন এবং পরিবর্ধন করেছেন। তখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যাণ্ডে বইটি বার বার ছাপা হচ্ছে। এই বই এর অংশবিশেষ আরবী এবং তুর্কী ভাষায় অনুদিত হয় এবং সে সব এলাকার আধুনিক শিক্ষিতদের প্রশংসা লাভ করে। Spirit of Islam গ্রন্থের লক্ষ্য ছিল ইসলামকে উদার এবং যৌক্তিক ধর্ম হিসেবে প্রমাণ করা। এই কারণে বহু বিবাহ, পর্দা এবং জেহাদকে ইসলামের সত্যিকার মেজাজের বিরোধী বলে নিন্দে করা হয়েছে। এইভাবে তিনি আশা করেছিলেন যে, ইউরোপীয় নব মুসলমানরা পশ্চিমা আদর্শের সঙ্গে ইসলামকে সমপর্যায়ে দেখবেন।
Spirit of Islam এর প্রথম অর্ধাংশ জুড়ে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর জীবন তুলে ধরা হয়েছে। এখানে তিনি পশ্চিমা জগতকে দেখাতে চেয়েছেন যে, তাঁর চরিত্র ছিল মিষ্ট, কোমলতা, ভদ্রতা, ক্ষমা, দয়া এবং ভালবাসার সমষ্টি। এই ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনকারী সকল সাহিত্যিক হীনমন্যতাবোধ থেকে মহানবীর জেহাদকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন:
“শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার আগেই কোরাইশ সৈন্য মাঠে এসে পড়ে। জীবনে কোনদিন অস্ত্র হাতে ধরেন নি। মানুষের দুঃখ কষ্টে যিনি বেদনাভারাক্রান্ত হতেন, যিনি ছিলেন আরব চরিত্রের বিপরীত, আপন সন্তান বা শিষ্যের মৃত্যুতে কেঁদে বুক ভাসাতেন, যার হৃদয় এতই কোমল এবং করুণ হওয়ার কারণে শত্রুরাও তাকে নারীসুলভ কোমল হৃদয়ের অধিকারী বলতেন, তাঁকেই পরিস্থিতির প্রয়োজনে ইচ্ছার বিরুদ্ধে শত্রুর আক্রমণ শক্তির দ্বারা প্রতিহত করতে হল এবং আত্মরক্ষার জন্যে সাহাবীদের সংঘবদ্ধ করতে হলো।” (পৃঃ ২১৪-২১৮)
বই এর লেখক পশ্চিমা সমালোচনার মুখে নিজেকে এতই দুর্বল মনে করতেন যে, জেহাদের ধারণাকে তিনি কুলক্ষণ মনে করতেন এবং এই কারণে দেখাতে চেয়েছেন যে, আমাদের মহানবী প্রকৃতপক্ষে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করতে চাননি। কেবল মাত্র পরিস্থিতি তাকে তা করতে বাধ্য করেছে। রাসূলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনী গ্রন্থ-যেমন, ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের ‘সিরাতে রাসূলুল্লাহ’ আল ওয়াকিদীর ‘কিতাবুল মাগাযী’তে এ ধরনের আচরণের সাক্ষ্য দেয় না। কোরআনের অষ্টম এবং নবম সূরার কেন্দ্রীয় আলোচ্য হচ্ছে জেহাদ। এ থেকেই আমীর আলীর আত্মপক্ষ সমর্থনকারী বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হয়। আধুনিক মন মানসিকতা নিয়ে তিনি বর্তমানকে অতীতে দেখতে চেয়েছেন। “এই খ্যাতনামা শিক্ষকের মন বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রগতির দিক থেকে ছিল আধুনিক, তার কাছে মানবতার সেবাই ছিল সর্বোচ্চ এবাদত” (পৃঃ-১২১)।
লেখক পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, কোরআন অভ্রান্ত নয় এবং সম্পূর্ণ মানবিক ধ্যানের ফলাফল।
“এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ধর্মীয় সচেতনতায় মহান শিক্ষকের মন পূর্ণত্ব লাভ করার আগে মধ্যবর্তী পর্যায়ের সূরাগুলোতে জোরাষ্টার, সাবিয়ান এবং ইহুদী পুরানের ভাসা ভাসা বিবরণ থেকে স্বর্গ ও নরকের বাস্তব ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মরুভূমির সাধারণ মানুষের জন্যে ভাষার এই চাতুর্যের প্রয়োজনও ছিল। যাতে তারা এসব দেখে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিনয় ও ভালবাসার দ্বারা প্রার্থনা করে এবং খোদার সত্যিকার অস্তিত্ব অনুধাবন করতে পারে। জোরাষ্টারদের কাছ থেকেই স্বর্গ এবং হুরের ধারণা এসেছে অপরদিকে ইহুদী পুরানে কঠোর শাস্তির জন্যে নরকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্ভবতঃ ধর্মীয় চেতনার প্রথম দিকে মুহাম্মদ নিজে তার চারিদিকের চিরাচরিত জিনিসে বিশ্বাস করতেন, তবে আত্মার ব্যাপক জাগৃতির ফলে বিশ্বের স্রষ্টার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ সৃষ্টি হয় এবং যে সব চিন্তা বস্তুগত দিক থেকে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল তা প্রথমে আধ্যাত্মিকতায় রূপ নেয়। মহান শিক্ষকের মন শুধুমাত্র সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়নি বরং আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের ব্যাপারে তার সাহাবীদের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেও পরিবর্তিত হয়েছে, উন্নত মনের দ্বারাই গুণাগুণ অনুধাবন করা যায়। সাধারণ বুদ্ধির লোক, অশিক্ষিত লোকদের ব্যাপক বা সংক্ষিপ্ত যে ধরনেরই হোক না কেন বিধি-নিষেদের প্রয়োজন রয়েছে।” (পৃঃ ১৯৭-১৯৮)।
আমীর আলী পরকালের সত্যিকার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে পারেননি। তবে সাধারণ মানুষের উন্নতির অপরিহার্য হাতিয়ার হিসাবে তা স্বীকার করে নিয়েছেন। এই জন্যে জীবন সম্পর্কে প্রাচীন জোরাষ্ট্রানদের ধারণার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে দেখিয়েছেন এগুলো কিভাবে মুহাম্মদের বিশ্বাসে প্রভাব ফেলেছে। শিয়াদের ধর্মমতানুসারে খলিফাদের ইতিহাস রচনা করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যায়ভাবে তিনি তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর সমালোচনা করেছেন।
“হযরত আবু বকরের তীক্ষ্মতা, হযরত ওমরের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণোৎসাহ এবং নৈতিক সুক্ষ্মতা হযরত ওসমানের ছিল না। Dozy সুস্পষ্টভাবে প্রতারিত ধর্ম যাজকের (?) চরিত্র অঙ্কন করেছেন। ওসমানের ব্যক্তিত্ব খলিফা হিসেবে তার নির্বাচনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে না। এটা সত্য যে, তিনি ধনী এবং দরদী ছিলেন, মুহাম্মদ (সা) এবং ইসলামকে আর্থিক সাহায্য করেছেন এবং প্রায়ই প্রার্থনা করতেন, রোজা রাখতেন এবং তিনি অমায়িক ও দয়ার্দ হৃদয় ছিলেন। তিনি অবশ্য প্রেরণাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন এবং বার্ধক্যজনিত দুর্বল ছিলেন। দুঃখের বিষয় এই বৃদ্ধ মানুষ তার আত্মীয়দের প্রতি অসাধারণ দুর্বল ছিলেন। তারা মক্কার ঐসব অভিজাত যারা ২০ বছর ধরে মুহাম্মদ (সা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাঁকে শাস্তি দিয়েছে, অপমান করেছে, খলিফা এসব লোকদের আনুকূল্য করেছেন। সমগ্র সাম্রাজ্য থেকে মদীনায় অভিযোগ আসতে শুরু করে। কিন্তু প্রায় অভিযোগই গালি আর কর্কশ ভাষায় বাতিল করা হয়েছে। খলিফা আবু বকরের ছেলে মোহাম্মদের নেতৃত্বে ১২ হাজার লোকের একটি প্রতিনিধিদল ওসমানের কাছে অভাব অভিযোগ জানাতে এবং তার প্রতিকার দাবী করতে এসেছে। ফেরার পথে খলিফার সীলমোহর সহ তার সেক্রেটারী একটি চিঠি দিয়েছেন। যাতে নীতিজ্ঞানশূন্য মুয়াবিয়াকে বলা হয়েছে তাদেরকে সদলবলে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। তার ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা মদীনায় ফিরে যায় এবং বৃদ্ধ খলিফার ঘরে প্রবেশ করে তাঁকে হত্যা করে। ওসমানের মৃত্যুর পর উমায়াদের দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ইসলাম বিরোধী, ইসলামের গণতন্ত্র সাম্য এবং নৈতিকতার কঠোর নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সুযোগ সৃষ্টি হয়।” (পৃঃ ২৯৪-২৯৫)।
আমাদের প্রিয় নবীর বিশ্বস্ততম সাহাবীর বিরুদ্ধে ইতিহাসের এই নিন্দাকারী ভাষা। ওসমান বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। উল্লেখিত চিঠিগুলি ছিল জাল যেখানে ওসমানের কিছুই করণীয় ছিল না। লেখক যেভাবে চিত্রিত করেছেন, খোদা না করুক ওসমান যদি সত্যিই সেরূপ হতেন তাহলে আমাদের মহানবী কখনো তাকে তার বিশ্বস্ত সহচরদের অন্তর্ভুক্ত এবং সরাসরি বেহেশতে গমনকারী দশজনের একজন বলে ঘোষণা করতেন না। আমাদের মহানবী ঘোষণা করেছেন ওসমান বেহেশতে তার নিত্য সহচর থাকবেন। অনেক নির্ভরযোগ্য হাদীসেই ওসমানের গুণাবলীর স্বীকৃতি রয়েছে। ওসমানের সঙ্গে বিশ বছরেরও অধিক সময় কাছাকাছি থেকে আমাদের প্রিয় নবী ওসমানের চরিত্র সম্পর্কে আধুনিকতাবাদী এবং শিয়া প্রভাবিতদের চাইতে অনেক বেশী প্রাজ্ঞ ছিলেন।
একইভাবে এই লেখক মুসলিম বিশ্বের পরবর্তী অধঃপতনের জন্যে ইমাম এবং মুজাদ্দিদদের দোষারোপ করেছেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলকে তিনি কিভাবে চিহ্নিত করেছেন তার নমুনা-
“চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ‘সুন্নী গীর্জা সম্প্রদায়ের’ সৃষ্টি হয় ইবনে হাম্বলের হাতে। তিনি মামুন এবং তার উত্তরাধিকারী মুতাসীম বিল্লাহর সময় উন্নতি লাভ করেন। এই দুইজন খলিফা ছিলেন ‘মুতাজিলা পন্থী’; ইবনে হাম্বলের চরম গোঁড়ামী এবং জেদ, যার দ্বারা তিনি ধর্মান্ধতা দিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণকে উত্তেজিত করতে চেয়েছিলেন, তা শাসকদের সঙ্গে তার মনোমালিন্যের সৃষ্টি করে। ইবনে হাম্বল এবং তার হিতৈষীরা মুতাজিলা প্রচারে মানুষের অসৎ সাফল্যের জন্যে এবং ঘন ঘন মুসলিম হত্যা অভিযানের জন্যে দায়ী। এই হত্যাভিযান মুসলিম ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছে।” (পৃঃ ৩৫২)
“অতি শুদ্ধাচারী ব্যক্তি ইবনে হাম্বল তার মতবিরোধীদের চির অবলুপ্তি কামনা করতেন। তিনি হানাফীদের উদারতায় মনক্ষুন্ন, মালেকীদের নিরঙ্কুশ সংকীর্ণতায় হতাশ এবং শাফেয়ীদের সাধারণ চরিত্রে সুখী হতে না পেরে চিরাচরিত প্রথার ভিত্তিতে সমগ্র সাম্রাজ্যের জন্যে একটি নতুন পদ্ধতি চালু করেন। আবু হানিফা চিরাচরিত প্রথার অধিকাংশ প্রত্যাখ্যান করেছেন (ইহা ঠিক নয়)। ইবনে হাম্বলের পদ্ধতি অসঙ্গত, অযৌক্তিক এবং হতবুদ্ধিকারী গল্পের সমষ্টি যার অধিকাংশই পরষ্পরের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং মনগড়া। তিনি বিদ্যা অর্জন ও বিজ্ঞানের নিন্দা করেছেন এবং যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
জনসাধারণের মধ্যে তার বাগ্মীতা অথবা প্রচন্ডতা ধর্ম প্রচারের মঞ্চ থেকে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদীদের বিরুদ্ধে আগুন ছড়াতে শুরু করলো। বাগদাদের রাস্তায় ঘন ঘন দাঙ্গা এবং রক্তপাত শুরু হলো। গোলযোগের প্রধান উদগাতাকে জেলে পাঠানো হয় এবং সেখানেই তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন”(খৃঃ ৪৩৮-৪৩৯)। “ইবনে হাম্বলের প্রধান অনুসারী ধর্মতত্বের ছাত্ররা দুর্বল আব্বাসীয় খলিফাদের জন্যে বাগদাদে বিরাট সমস্যার কারণ হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের নিয়ে দায়িত্বহীন ছিদ্রান্বেষী সমালোচকদল গড়ে তুলল। তারা জোর করে মানুষের বাড়ীতে ঢুকে বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে দিত এবং এ ধরনের বর্বরতা চালাতো” (পৃঃ ৪৮৭)।
এইভাবে লেখক শরিয়তের বিধানকে সেকেলে এবং প্রগতির বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। মুসলমানদের বর্তমান জড়ত্বের কারণ হচ্ছে মুসলমানদের সাধারণ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস চিন্তার স্বাধীনতা ও বিচার বিচক্ষণ ক্ষমতা হরণ করে কিছু জিনিস মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে দিয়েছে। নবী যুক্তিকেই মানব মনীষার সর্বোচ্চ এবং আদর্শ অবদান বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের মধ্যযুগের পণ্ডিত এবং তাদের অনুসারীরা এর প্রয়োগকে সবচাইতে পাপ এবং অপরাধ বলে গণ্য করেছেন। আজকের মুসলমানেরা সেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেছেন। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রশংসা প্রকাশ করতে গিয়ে তার প্রাথমিক যুগের অনুসারীরা তখনকার জন্যে প্রযোজ্য আদেশ এবং নিয়মকানুনকে সর্বকালের করে দিয়েছেন। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারকের প্রচলিত এবং একটি আধা সভ্য জাতির জন্যে প্রযোজ্য বিধানকে এখন পর্যন্ত চালু করা নবীর প্রতিই অবিচারের সামিল। সমাজ ও নৈতিকতার ক্রম পরিবর্তনশীল ধারণা নিয়ে কারও পক্ষেই চিরকালের বিধান দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মানবতার প্রগতিশীল দাবীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোন ধর্মই এত বিরাট প্রতিশ্রুতি দেয়নি (পৃঃ ১৮২-৮৩)। গীর্জার জনক যা দিয়েছেন তা অপরিবর্তনীয় এবং আলোচনার আওতা বহির্ভূত। (পৃঃ ৩৫৩)।
আমীর আলীর মতে মুতাজিলাদের পথই ইসলামের সত্যিকার পথ। তার অনুসারী আলকিন্দী, আল ফারাবী, ইবনে সিনা এবং রুশদ ইসলামের ভেতর গ্রীক দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটাতে চেষ্টা করেছিলেন। আমীর আলী মুতাজিলাদেরকে অগ্রপথিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, জীবনের মূল জায়গায় না হলেও আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার দিক থেকে। যে সব মুজাদ্দিদ বাইরের ধ্যান ধারণাকে বাতিল করে সত্যিকার ইসলাম রক্ষা করেছিলেন তিনি তাদেরকে মুসলিম বিশ্বের ক্ষতির জন্যে দায়ী করেন। তবে এটা সুস্পষ্ট যে, লেখক যার পক্ষে কথা বলেছেন, তা ইসলাম ছিল না বরং তা ছিল মুসলিম নামের ছদ্মাবরণে পশ্চিমা ধ্যান ধারণা।
অনুবাদঃ এ কে এম হানিফ।