নশ্বর এই ধরণীর উন্মুক্ত মনোহর ময়দান সেই আদিকাল থেকে আধুনিকতার এই যুগ পর্যন্ত বীর পূজার (Heroworship) দিকে ধাবিত হয়ে আসছে। বড় কোনো জিনিসকে দেখে “হাযা রাব্বী-এটাই আমার প্রভু”, “হাযা আকবার-এটাই সর্ববৃহৎ” বলার অভ্যাস অনেক আগ থেকেই প্রচলন হয়েছিল, আজও পর্যন্ত তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়নি। যেভাবে দু’হাজার বছর পূর্বে বুদ্ধের ব্যক্তিত্বের দাবীতে নির্বোধ সৃষ্টিকুল অন্য কোনো পন্থা উদ্ভাবন করতে না পেরে বীরের স্বীকারোক্তিতে তার আকৃতি তৈরি করে তারই পূজা-অর্চনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, এমনিভাবেই আজ বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সবচাইতে জঘন্য প্রথা – দাসপ্রথা বিরোধী জাতি (রুশ) মনন-মেধা লেনিনের মাহাত্ম্যের স্বীকারোক্তির পথ ও পন্থা ছাড়া চিন্তাই করতে পারে না যে তার ব্যক্তিত্বের বাইরে মানবতার জয়গান কেউ গাইতে পারে। 

অবশ্য, মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন বৈকি। বীর পূজার কল্পনা তাদের মনন-মেধায় অঙ্কিত হয়ে কোনো দিকে ঝুঁকে পড়ে না। মুসলমানরা বড়দের সাথে আচরণের একমাত্র দিকই চিন্তা করতে পারে। আর তা হলো- আল্লাহ তাদেরকে জীবন-চলার সঠিক পথ দেখিয়েছেন, যার উপর চলে তারা বুজুর্গীর উচ্চতম মার্গে উপনীত হবে। সেজন্য তাদের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং তাদের ন্যয়ই আমল করা।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সংক্ষিপ্ত বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমার দেশের যুবক সম্প্রদায়কে এই দিক-নির্দেশনা দিতে চাই, যে ইকবালের মহত্ত্বের বার্তা তাদের হৃদয়ে মোহরাঙ্কিত হয়ে রয়েছে, তার জীবন আমাদেরকে কী শিক্ষা দেয়?

এটা সবাই জানেন যে, ইকবাল ঐ পাশ্চাত্য শিক্ষাই অর্জন করেছিলেন, যে শিক্ষা আমাদের যুব-সম্প্রদায়ও ইংরেজদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গ্রহণ করছেন। সেই ইতিহাস, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন এবং সেই দর্শন শাস্ত্রই তিনি পড়েছেন আর এসব বিষয়েই তিনি কেবল শিক্ষানবিস ছিলেন না, বরং তিনি উল্লেখিত বিষয়ে খ্যাতিমান এবং বিশেষজ্ঞ হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে দর্শনশাস্ত্রে তো তিনি এমন উচ্চতর মার্গে পৌঁছেছিলেন, অধুনাকালের খ্যাতিমান দার্শনিকরাও যার স্বীকারোক্তি করেছেন। যে শরাবের দু-চার ঢোক পান করেই অনেক লোক বিপথে চালিত হতে থাকে, মরহুম ইকবাল তাে সেই শরাবের মহাসাগরই পান করেছিলেন।

কিন্তু, পাশ্চাত্য সভ্যতা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচারকে তিনি বাহ্যিকভাবে নিরীক্ষণ করেননি। যেমনটি আমাদের শতকরা ৯৯ ভাগ যুবক নিরীক্ষণ  করছেন। তিনি সেই সমুদ্রে নেমে প্রতিটি দিকে এত গভীরে পৌঁছেছেন, যেখানে পৌঁছে আমাদের অধুনাকালের তরুণ যুবকরা স্বীয় দ্বীন-ধর্ম, সভ্যতা-সংস্কৃতি, তাহজীব-তমদ্দুন এবং জাতীয় রীতি-নীতি বেমালুম ভুলে পশ্চাৎগামী হয়ে যান। পাশ্চাত্য প্রভাবে তারা এমনই প্রভাবিত হন যে, মাতৃভাষায় কথাবার্তা বলার রুচি পর্যন্ত তাদের লোপ পেয়ে যায়।

কিন্তু ঐ ব্যক্তিত্বের অবস্থা কী ছিলো? পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির মহাসমুদ্রে পা রাখার সময় তিনি যেই মুসলমান ছিলেন, তার মধ্যভাগে গিয়ে তিনি আরো পাক্কা মুসলমানই বনে গেলেন। সমুদ্রের গভীরে যতই সাঁতার কাটলেন তিনি ততই খাঁটি মুসলমান রূপেই নিরূপিত হয়েছেন। এমনকি সমুদ্রের গভীরে যখন পৌঁছেন, তখন বিশ্ব দেখেছিল তিনি কোরআনের মধ্যেই ডুবে ছিলেন। আর যা-ই চিন্তা করতেন কোরআনের নিরিখেই তার বাস্তবায়ন করতেন। যা-ই নিরীক্ষণ করতেন, কোরআনের নিরিখেই নিরীক্ষণ করতেন।

হাকীকত এবং কোরআন তার দৃষ্টিতে ছিলো একই বস্তু। আর এই এক বস্তুর মধ্যেই তিনি এমনিভাবে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন যে, তার সমসাময়িক ওলামায়ে দ্বীনের মধ্যেও এমন কোনো ব্যক্তিত্ব আমি দেখছি না যিনি কোরআনের মধ্যে বিলীন হবার ক্ষেত্রে এই দর্শনের ইমাম, এই এমএ, পিএইচডি, বার এটল’ কে উতরে গেছেন। অল্পসংখ্যক লোকই এটা জানেন যে, জীবনের শেষ দিনগুলোতে ইকবাল কোরআন ব্যতীত সমুদয় বই থেকে নিজেকে পৃথক করে নিয়েছিলেন। একমাত্র কোরআন ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো বই-ই তিনি সামনে রাখতেন না। বছরের পর বছর জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে ডুবে থাকার পর চূড়ান্ত যে মার্গে পৌঁছেছিলেন, তা হলো মূল জ্ঞান – কোরআন। আর অমূল্য এ সম্পদ যার হাতে আসবে, সে দুনিয়ার অন্য সব কিতাব হতে সম্পূর্ণ স্বাধীন।

একবার ইকবালের কাছে এক ব্যক্তি দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন করে উত্তরের প্রত্যাশা করেছিলেন যে, এখন আল্লামা তাঁর লাইব্রেরির আলমারি খোলাবেন এবং বড় বড় বই বের করিয়ে উদ্দিষ্ট প্রশ্নাবলীর উত্তর তালাশ করবেন। কিন্তু তারা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন যে, লাইব্রেরির আলমারিগুলোতে সেই তালাই লাগানো থাকলো, তিনি শুধু কোরআনুল কারীম হাতে নিয়েই জবাব লিখতে বসে গেলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর তাঁর আকীদা-বিশ্বাসের বিষয়টি তো অনেকেরই জানা। সম্ভবত এটা কেউই জানেন না যে, তিনি তাঁর সম্পূর্ণ দর্শন এবং সমুদয় চিন্তা-চেতনাকে রাসুলে আরাবীর পবিত্র চরণে ক্ষুদ্র সম্পদ হিসেবেই উপঢৌকন স্বরূপ রেখে দিয়েছেন। হাদীসের যেসব দিকে শুধুমাত্র শিক্ষানবিসই নয়; লব্ধপ্রতিষ্ঠ আরবী শিক্ষাবিদও কান খাড়া করেন, বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে থাকেন এই ডঃ অফ ফিলোসফি হাদীসের নির্ভেজাল ব্যাখ্যার উপরই ঈমান রাখতেন। আর এ ধরনের কোনো হাদীস শ্রবণ করার পর এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর অন্তরে সন্দেহের উদ্রেক হতো না। একবার জনৈক ব্যক্তি তাঁর (ইকবালের) সামনে অতি বিস্ময়করভাবে ঐ হাদীসটি উল্লেখ করেন, যাতে বর্ণনা রয়েছে যে, রাসূলে করীম (স.) তিনজন সাহাবীর সাথে উহুদ পাহাড়ে আরোহণ করেছিলেন। এ সময় উহুদ পাহাড় কাঁপতে লাগলো। রাসূল (স.) পাহাড়কে নির্দেশ দিলেন- স্থির হয়ে যাও। তোমার উপর একজন নবী, সিদ্দীক ও দুজন শহীদ আরোহণ করেছেন। হাদীসখানা শুনেই ইকবাল বললেন:

“এতে আশ্চর্য হবার এমন কী আছে? আমি একে রূপক বা অবাস্তব কিছুই মনে করছি না; বরং একে নিরেট বাস্তব বলেই মনে করছি। এ ঘটনাকে মেনে নেয়ার জন্যে আমার কোনো ব্যাখ্যা-প্রমাণের প্রয়োজন নেই। তোমার কাছে মহাসত্যের সন্ধান যদি থাকতো, তা হলে তুমি বুঝতে পারতে কিভাবে একজন নবীর পদতলে এসে বড় বড় পাহাড়ের চূড়া প্রকম্পিত হয়ে যেতো, এ কম্পন রূপক কম্পন নয়, বাস্তব ঘটনা বৈ কি”।

ইসলামী শরীয়তের যেসব আহকামকে অনেক স্বচ্ছ ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বিস্মৃত ও পচনযুক্ত কানুন বলে মনে করেন, আর যেসব কানুনের বিশ্বাস করা তাদের নিকট এক ধরনের অন্ধকারে ডুবে থাকার শামিল যে, সভ্য সমাজে এর সাহায্য করা একজন শিক্ষিতের জন্য ডুবে মৃত্যুবরণ করার চাইতেও নিকৃষ্টতর – ইকবাল শুধু সেগুলো মানতেনই না এবং সেগুলোর উপর আমলই করতেন না; বরং প্রকাশ্যে এগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। আর কারও সামনে এগুলো সহায়তা করার ব্যাপারে তার ভয়-ভীতি ছিলো না।

এর সাধারণ একটি উপমা শুনুন। একবার ভারতীয় গভর্নমেন্ট তাকে স্বীয় এজেন্ট করে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠাতে চেয়েছিল। তাঁর কাছে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো, কিন্তু সাথে একটি শর্ত ছিলো এই যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে পর্দা করাতে পারবেন না। আর বক্তব্যের সময় তাঁর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে শরীক হতে হবে।

ইকবাল সংশ্লিষ্ট শর্ত সম্বলিত এই পদ গ্রহণ করার কথা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি স্বয়ং লর্ড ওলংডনকে বলেছিলেন-

“নিঃসন্দেহে আমি একজন গুনাহগার মানুষ। ইসলামী হকুম-আহকাম পালনের ব্যাপারে অনেক অলসতাই আমার হয়ে থাকে। কিন্তু এ লাঞ্ছনা তো গ্রহণ করতে পারি না যে, আপনার নগণ্য পদ-পদবী গ্রহণ করার লোভে শরীয়তের হুকুমকে ছিন্ন করবো”।

ইকবাল সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণার রটানো হয়েছে যে – তিনি শুধু আকীদার দিক থেকেই মুসলমান ছিলেন, আমলের সাথে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিলো না। এই ভুল ধারণা সৃষ্টির পেছনে তাঁর প্রকৃতিগত কিছু উপাদানও দায়ী। এর সাথে সংযুক্ত হয়েহে ছিদ্রান্বেষীদের উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। অথচ বাস্তবে তিনি মোটেও আমল বিমুখ ছিলেন না। কোরআন তেলাওয়াতে ছিলো তাঁর গভীর অনুরাগ। ফজরের নামাজের পর পাক কালাম তেলাওয়াতে নিবিষ্ট হয়ে যেতেন। কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে এসে স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে তেলাওয়াতের সময় অবিরত কান্নার ভারে তাঁর শ্বাস বন্ধ হয়ে যেতো, তেলাওয়াতে আর এগোতে পারতেন না। নামাজও পড়তেন তিনি গভীর অভিনিবেশের সাথে নীরব পরিবেশে। কিন্তু সাধারণ্যের মধ্যে রটে গিয়েছিলো ‘কথার গাজী বলে।

তাঁর সাদামাটা জীবনমান এবং তবিয়তের অবস্থা তাঁর ইন্তেকালের পরপরই মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিলো। এর আগে স্বাভাবিক ধারণা ছিলো যে, ‘স্যার’ সাহেবরা আর পাঁচজন যেমন, ইকবাল তদ্রুপই হবেন। আর এর উপর ভিত্তি করে অনেকে বিচার বিশেষ না করেই লিখেও দিলেন যে, আলাহর দরবারে তাঁর ক্ষমা কিভাবে হতে পারে! কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো এই ব্যক্তিত্ব মানুষের ধারণার বাইরে রিক্ত নিঃস্ব ও সাদাসিধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। যেমনটি তাঁর ইন্তেকালের পর মানুষও খবরের কাগজে বর্ণনা করে।

একদিনের কাহিনী শুনুন। এর দ্বারা এই নাইট এবং ব্যারিস্টারের তবীয়ত সম্পর্কে আপনারা ধারণা করতে পারবেন। পাঞ্জাবের এক বিত্তশালী জমিদার একটি আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্য ইকবাল ও স্যার ফজলে হোসাইন মরহুম সহ আরও দু’জন প্রসিদ্ধ আইনজ্ঞকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানান। তার তৈরি বিলাসবহুল প্রাসাদে তাঁদের থাকবার ব্যাবস্থা করেন। রাত্রে ইকবাল নির্ধারিত রুমে বিশ্রাম করতে গিয়ে চারদিকে বিলাস সামগ্রী দেখে এবং তার পীঠের নীচে দামী নরম বিছানা পেয়ে সাথে সাথেই মনে মনে ভাবলেন, যেই রাসূলে পাক (স.) এর জুতোর সদকায় আজ আমাদের এই মর্যাদা নসীব হয়েছে, তিনি তো খেজুর পাতার উপর শুয়ে-বসেই জীবনাবসান ঘটিয়েছেন। এ চিন্তা করতে করতে তাঁর নয়ন যুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। ঐ বিছানায় শোয়া তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে গেলো। তিনি উঠে বসলেন এবং সামনের গোসলখানায় গিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়ে অবিরত কান্না আরম্ভ করলেন। কাঁদতে কাঁদতে মন কিছুটা হালকা হলে স্বীয় ভৃত্যকে ডেকে তার লাগেজ খোলেন এবং একটি চৌকি ঐ গোসলখানায় বিছিয়ে যতদিন পর্যন্ত ওখানে ছিলেন ঐ গোসল খানাতেই তিনি শুতেন। এটা মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বেকার ঘটনা। যখন বাইরের দুনিয়ায় তাঁকে স্যুট-বুটে সচরাচর দেখা যেতো, কেউ জানতোই না যে, ঐ স্যুটের মধ্যে যে ব্যক্তিত্ব লুকায়িত রয়েছে তার প্রকৃত ব্যক্তিত্ব স্বরূপ কী! তিনি ঐ সব মানব দরদীর পর্যায়ভুক্ত ছিলেন না, যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সাদাসিধা এবং ফকিরি জীবন যাপনের ঘোষণা দিতো। আর সোশালিস্ট সেজে গরীব-নিঃস্বদের দুঃখে দুঃখী হবার ফাঁকা বুলি আওড়াতো, কিন্তু জনগণের দৃষ্টির আড়ালে গিয়ে তাদের জীবন যাপন হয়ে উঠতো বাদশাহী এবং অভিলাষী।

ইকবালের নাইটবুট এবং স্যার সফী মরহুমের ন্যায় ব্যক্তিত্বের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক দেখে সাধারণ্যে এই ধারণা ছিলো আর এখনো বিদ্যমান যে, তিনি কবিতা রচনাতেই শুধু স্বাধীন ছিলেন, আমলী জীবনে স্বাধিকার তাকে ঘেঁষতেও পারেনি, অধিকন্তু তিনি ছিলেন ইংরেজদের দাস। কিন্তু প্রকৃত সত্য ছিলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। যারা তাঁর সাহচর্যে ছিলেন, ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, আর তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে জানেন, তারা অবশ্যই জ্ঞাত যে, ব্রিটিশ রাজনীতি হতে তার চিন্তাধারা এবং আমল দুটোই কঠোর বিরোধী। শাসনযন্ত্র হতে তিনি ছিলেন অতি অতি দূরে। সরকার এবং তার চাটুকার উভয়ই তাকে দেখতো বাঁকা চোখে। আর তাঁর ব্যক্তিত্বকে তারা তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির অন্তরায়ই ধরে নিয়েছিলো।

রাজনীতিতে তাঁর চিন্তা-ধারাই শুধু স্বাধীন ছিলো না, বরং তিনি স্বাধীন হিন্দুস্তানে দারুল ইসলামকে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করে নিয়েছিলেন। এজন্যই তিনি এমন কোনো পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন না, যা একটি দারুল কুফরকে আরেকটি দারুল কুফরে বদলে দেবে মাত্র। শুধুমাত্র এ কারণেই তিনি রাজনীতির মাঠে সব লোকের সাথে বাধ্য হয়ে সহায়তা করেছেন, যারা রাজ্যের ছায়াতলে হিন্দু রাজ্যের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছিলো। সে যা-ই হোক উদ্দেশ্যের নিরিখে তাঁর মধ্যে এবং ঐ তবকার মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। তবে হ্যাঁ, এই বিবেচনায় তাকে এই দলের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন যে, যত সময় পর্যন্ত মুসলমান যুবকদের মধ্য দারুল ইসলামের একটি স্ফুলিঙ্গ দাউ দাউ করে জ্বলে না উঠবে, আর যুব সম্প্রদায় যতক্ষণ না এ ত্যাগ-তিতিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত অন্যূন বিস্ময়ের ধারা বিপরীত দিকে ধাবিত করার চাইতে এ ধারাকে ধরে রাখা যায়। এ কারণেই তিনি একদিন তার কবিতার দ্বারা মুসলিম যুবকদের অন্তরে এই রূহ ফোকার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, যে ব্যাপারে সবাই সম্যক ওয়াকিফহাল। অন্যদিকে রাজনীতির বাস্তব ময়দানে এই পথ অবলম্বন করেছেন, যার উদ্দিষ্ট লক্ষ্য হতে কয়েকজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব ব্যতীত কেউ ওয়াকিফহাল নন। আর বাহ্যিক দিকের নিরিখে তিনি স্বয়ং অতি আপনজনেরও তিরস্কার পর্যন্ত শুনেছিলেন।

অনুবাদ: ড. আব্দুল ওয়াহিদ

১৩৭১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

আবুল আ'লা মওদুদী (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ – ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯), যিনি মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ তাকে "আধুনিক ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাবিদ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মওদুদী কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস, আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন। তার লেখাগুলো মূলত উর্দুতে । পরে তার লেখাগুলো ইংরেজী, আরবি, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, বর্মি, মালায়ালাম এবং অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তিনি মুসলিম মিল্লাতের কাছে ইসলামের আসল রুপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দ্বীনী জ্ঞান নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, এ ব্যাপারে মাওলানা মওদুদী বলেন, "আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। অতএব খোদার দ্বীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবি করে, এ কথা জানার জন্যে আমি দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।" তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের রাজনীতির ইসলাম জন্য অপরিহার্য। শরিয়া এবং ইসলামী সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন খিলাফতে রাশিদুনের শাসনের মতো এবং অনৈতিকতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে দেখতেন।তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি এশিয়ার তৎকালীন বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নামক একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর আলোচিত ও একইসাথে বিতর্কিত মুসলিম আলেমদের মধ্যে একজন। ইসলাম ধর্মে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯৭৯ সালে কিং ফয়সাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারটি প্রদান করা হয়।
Picture of সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী

আবুল আ'লা মওদুদী (২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ – ২২ সেপ্টেম্বের ১৯৭৯), যিনি মাওলানা মওদুদী, বা শাইখ সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী নামেও পরিচিত, ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথ তাকে "আধুনিক ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাবিদ" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মওদুদী কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস, আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন। তার লেখাগুলো মূলত উর্দুতে । পরে তার লেখাগুলো ইংরেজী, আরবি, হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু, কন্নড়, বর্মি, মালায়ালাম এবং অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তিনি মুসলিম মিল্লাতের কাছে ইসলামের আসল রুপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। দ্বীনী জ্ঞান নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন, এ ব্যাপারে মাওলানা মওদুদী বলেন, "আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। অতএব খোদার দ্বীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবি করে, এ কথা জানার জন্যে আমি দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।" তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের রাজনীতির ইসলাম জন্য অপরিহার্য। শরিয়া এবং ইসলামী সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন খিলাফতে রাশিদুনের শাসনের মতো এবং অনৈতিকতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে দেখতেন।তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি এশিয়ার তৎকালীন বৃহত্তম ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নামক একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ২০ শতাব্দীর আলোচিত ও একইসাথে বিতর্কিত মুসলিম আলেমদের মধ্যে একজন। ইসলাম ধর্মে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ১৯৭৯ সালে কিং ফয়সাল ফাউন্ডেশন কর্তৃক বাদশাহ ফয়সাল পুরস্কারটি প্রদান করা হয়।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top