এ বছর মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ আল-কোরআন নাজিলের ১৪০০ বছর পূর্ণ হলো। কোরআনের এই ১৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সমগ্র দুনিয়াতেই বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। আমি নিজেও কোরআনকে পুনরায় অধ্যয়ন করে অনেক নতুন কিছু উপলব্ধি করেছি। এইবার কোরআন অধ্যয়ন করতে গিয়ে আমি নতুন করে কী শিখলাম, এবং বিশেষ করে এইবার কোন কোন বিষয়গুলো আমার নজর কেড়েছে, সেই বিষয়সমূহ পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই।

ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ একটি দৃষ্টিভঙ্গি হলো – “ইসলাম শুধু একটি বিশ্বাসের নাম নয়, ইসলাম এর চেয়েও আরও অনেক বিস্তৃত বিষয়। ইসলাম কেবলমাত্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনধারাই নয়, একইসাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকেও পরিগ্রহকারী একটি দ্বীন”। মৌলিকভাবে সঠিক এই চিন্তাটি কাদের দ্বারা সৃষ্টি হলো, কেমন একটি জ্ঞান এবং যা সত্যের অধিকারী, এবং সর্বজনবিদিত এ দাবিকে কেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এসকল বিষয় সম্পর্কে অনেক বই পুস্তক লেখা হয়েছে। এখানে আমাদের জন্য যেই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল, ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম বিশ্বাসের নাম নয়, ইসলাম মানুষের জীবনকে সামগ্রিকভাবে পরিগ্রহকারী একটি ব্যবস্থা।

সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামী পুনর্জাগরণ নিয়ে অনেক বেশী আলোচনা হওয়ায় এই বিষয়টি সকলের মধ্যে এক নতুন গতির সঞ্চার করেছে এবং একটি সংগ্রামী ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে। শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিগত বিষয় সমূহ নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানও ইসলামেই রয়েছে (ভিনদেশি আইডিওলজি সমূহে নয়)।

ইসলাম মানুষের জীবনের সকল কিছুকেই সামগ্রিকভাবে পরিগ্রহ করে, এই আশ্চর্যজনক দাবিকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করে আমার নিজেকে এই প্রশ্ন করলাম, ইসলাম; বিশেষ করে তার প্রথম ও মৌলিক উৎস হিসেবে কোরআন কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বজনীন?

 

যখন যুবক ছিলাম তখন এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করার সময় কোরআনকে অধ্যয়ন করে শুধুমাত্র দ্বীনী বিষয়সমূহ নয়, তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক – এমন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতাম। কোরআনের মধ্যে আমি বৈজ্ঞানিক সত্য সমূহ, রাজনৈতিক, সামাজিক, এমনকি অর্থনৈতিক সিস্টেম সম্পর্কে নির্দেশনা খুঁজে পাব, এ ব্যাপারে আমার বিশ্বাস ছিলো অতান্ত শক্তিশালী। আমার এ শক্তিশালী বিশ্বাস – কোরআনের মধ্যে সরাসরি পাওয়া যাবে না, এমন বিষয়সমূহও কোরআনের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার নেশায় আকুল করে তুলতো। পরবর্তীতে যখন আস্তে-আস্তে চিন্তাগত দিক থেকে পরিপক্ব হওয়া শুরু করলাম, তখন আমার নিজস্ব জীবনবোধ আমার কিছু কিছু বিষয়কে সংশোধন করে দিতো এবং আমি উপলব্ধি করতে শুরু করি যে, মানুষের জীবন ও তাকদীরগত দিক থেকে দ্বীনি ও আখলাকী বিষয়সমূহই মূলত একমাত্র সত্য। কেননা আমি সেভাবেই চিন্তা করতাম যে, নিকট ভবিষ্যতে আমরা সবাই প্রতিষ্ঠিত হবো এবং হয়তোবা অনেক কম কাজ করে অনেক কিছুর মালিক হওয়ার পরেও সুখ এবং আত্মতৃপ্তি পাবো না – এটা দেখতে পেতাম। শুধুমাত্র নিজের জন্য বেঁচে থেকে এবং নিজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পরস্পর একত্রে বসবাস করার দ্বীনি চিন্তাকে পরিত্যাগ করার কারণে ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায় হোক, জযবার স্থানটি দখল করে নিবে আবেগহীনতা এবং জীবনসঙ্কট। আর ইবাদতের সাথে গভীর চিন্তার পরিবর্তে দখল করে নিবে অর্থহীন এক মৃত্যু এবং তৈরি হবে এমন এক দুনিয়া: যেথায় পরবর্তীতে বসবাসকারীরা আমাদের উপর দিবে অভিশাপ।

মানুষের শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বৈষয়িক উন্নতি যে এককভাবে সুখ-শান্তি বয়ে আনতে পারে না, এটা প্রাচীনকাল থেকেই বড় বড় দ্বীনের প্রতিষ্ঠাতাগণ এবং আখলাকবিদগণ বলে আসছেন। তবে শুধুমাত্র বৈষয়িক উন্নতি ও অগ্রগতিই যে মানুষের জীবনে শান্তি বইয়ে আনতে পারে না, এটা আজ সবচেয়ে বেশী সুস্পষ্টভাবে মানুষের সামনে এসে ধরা দিয়েছে। আজকের এই যুগে ইউরোপ ও আমেরিকা এর বাস্তব সাক্ষী। একজন মানুষের সাথে অপর একজন মানুষের মধ্যকার পার্থক্য তাদের পরিচয়কে কীভাবে তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে নয়, বরং সত্যিকার অর্থেই তারা কী – এই ব্যাপারটার মাঝে নিহিত রয়েছে। একইভাবে দুইটি সমাজের মধ্যকার সত্যিকার পার্থক্য, তাদেরকে কীভাবে পরিচালিত করা হয়েছে তার মধ্যে নয়; বরং সেই সমাজের মানুষকে গঠনকারী মূল্যবোধসমূহের মাঝে নিহিত থাকে। মানুষকে সত্যিকার অর্থেই মানুষ করে তুলে তাদের মধ্যকার আখলাক, মানবতাবোধ, ব্যক্তিত্ব ও তাদের বিবেকবোধ। যে সমাজের মানুষ তাদের আখলাক ও মূল্যবোধকে হারিয়ে ফেলেছে, তাদের দ্বারা আদর্শ সমাজ গঠন করা অসম্ভব। এই ধরনের সমাজের মানুষ সামান্য স্বার্থ পেলেই তাদের আখলাকহীনতাকে প্রকাশ করে দেয়।

যদি একটি সমাজকে আখলাকী মূল্যবোধের উপর গড়ে তুলতে হয়, তাহলে সেই সমাজের শিক্ষাকে ঢেলে সাজানোর কোনো বিকল্প নেই। কারণ সমাজ শৃঙ্খলা সম্পূর্ণভাবে মানুষের শিক্ষা-দীক্ষার উপর নির্ভর করে থাকে। কোরআনের ১৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে এই চিন্তা ভাবনাকে সামনে রেখে আমি কোরআন অধ্যয়ন করেছিলাম।

যৌবনকালে আমি সবসময় চিন্তা করতাম যে, সকল ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যাবলি মানুষকে ‘শিক্ষা দেওয়া’র মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। আমার রুহের মধ্যকার এই গোপন রহস্যটি একটি সমাধানে উপনীত হয়েছে। কোরআন কীভাবে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার জবাব দিতে সক্ষম হয়েছিল? কোরআনকে ভালোভাবে অধ্যয়ন করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম যে, মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান কোরআনে রয়েছে, তবে আমরা যেভাবে ধারণা করি সেভাবে নয়। মূলত কোরআন মানুষের এই দুনিয়ার জীবনকে ব্যাখ্যা করেছে এবং তাদের অবস্থাকে তুলে ধরে, মৌলিক হাকীকতসমূহকে তুলে ধরে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে আমাদেরকে মূলনীতি দিয়েছে। এই হাকীকতসমূহও দ্বীন ও আখলাকের বিষয়। আর মানুষের জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, এগুলোই হলো প্রতিটি মানুষের মৌলিক বিষয়। মানবজীবনকে পরিগ্রহকারী অন্যান্য বিষয়াবলির তুলনায় এই বিষয় দুটি আরও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই, এই বিষয় দুইটি (দ্বীন ও আখলাক) ব্যতীত মানব জীবনের অগ্রগতি ও উন্নতি অসম্ভব।

 

এখন, আমরা দেখতে পাই যে, কোরআনের মৌলিক হাকীকত সমূহ হচ্ছে-

সকল কিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। এই দুনিয়ার শক্তির সাথে, আইন ও কানুনের সাথে মানুষের সম্পর্ক যাই হোক না কেন, সকল মানুষ তার কাজের হিসাব প্রদান করবে। সকল মানুষের জন্য দুইটি পথ সব সময় উন্মুক্ত রয়েছে – সে চাইলে খারাপ পথ কিংবা ভালো পথ বেছে নিতে পারে। মহান আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে সকল মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।

এ সকল মৌলিক বিষয়ে এবং দ্বীন ও আখলাকের গুরুত্বের ব্যাপারে কারোর কোনো দ্বিমত করার ক্ষমতা নেই। একইসাথে একমাত্র ওহীভিত্তিক দুনিয়া-দর্শন ছাড়া অন্য কোন জীবন দর্শন নেই, এটিও যুক্তিসংগত ও বাস্তবভিত্তিক।

হুমকি এবং কষ্টের বিনিময়ে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকা, নাকি মান সম্মান ও ইজ্জতকে বিকিয়ে দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট ও আয়েশি জীবন যাপন করা – এই দুইয়ের মধ্যে কোনটি বেছে নিব? এই প্রশ্নটি সকল মানুষের সামনে প্রতিনিয়ত পুনরাবৃত্ত হতে থাকে। দুনিয়ার কোনো গবেষণাই এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি। বিশ্বাস করবে কি করবে না, এই প্রশ্ন কিংবা এই ধরনের অন্যান্য প্রশ্নের মুখোমুখি হলে প্রতিটি মানুষই নিঃসঙ্গতায় পড়ে যায়। কেবলমাত্র এবং শুধুমাত্র ওহীই এই নিঃসঙ্গতাকে দূরীভূত করে দিতে পারে। এই সকল প্রশ্নের জবাব কেবলমাত্র ওহীর মধ্যেই রয়েছে। এ কারণে ওহী শুধুমাত্র মূল্যবান একটি বিষয়ই নয়, ওহী একইসাথে এমন এক জ্ঞান যার শুন্যতাকে পূর্ণ করা অসম্ভব।

মানুষের এ সকল বড় বড় প্রশ্নের জবাবে কোরআন কী বলে? কোরআন কোন ধরনের জবাব দেয়? পূর্বে উল্লিখিত এ সকল বড় বড় বিষয়ে কোরআনের অবস্থান কী? এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্যই হলো কোরআনকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝার ক্ষেত্রে সাহায্য করা।

 

কোরআনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রথম উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর প্রতি ঈমানকে মানুষের মনে বদ্ধমূল করে দেওয়া এবং একক, মহান ও ন্যায়পরায়ণ এক স্রষ্টার ব্যাপারে মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করে বিকাশ করা। এই অর্থে কোরআন সবচেয়ে সুস্পষ্ট এবং সবচেয়ে মহান একত্ববাদের উপমা।

১. “পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর। যেদিকে তোমরা মুখ ফিরাবে, সেদিকেই আল্লাহর সত্তা বিরাজমান। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশালতার অধিকারী এবং সর্ব বিষয়ে অবহিত।” (সূরা আল-বাকারা: ১১৫)

২. “বলো, হে আহলে কিতাব! তোমরা কেন আল্লাহর কথা মানতে অস্বীকার করছো? তোমরা যেসব কাজকর্ম করছো, তা সবই আল্লাহ প্রত্যক্ষ করছেন”। (সূরা আলে-ইমরান: ৯৮)

৩. “আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাজিল করেছেন এবং তোমাকে এমন বিষয় জানিয়ে দিয়েছেন, যা তোমার জানা ছিলো না। বস্তুত তোমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ অসীম।” (সূরা আন-নিসা: ১১৩)

৪. “অতএব তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণের প্রতি ঈমান আনো এবং বলো না, তিন জন আছে। বিরত হও; এ তোমাদেরই পক্ষে কল্যাণকর। আল্লাহই অভিভাবক হিসেবে যথেষ্ট।” (সূরা আন-নিসা: ১৭১)

৫. “আল্লাহ কি তাঁর শোকর আদায়কারী বান্দাদেরকে এদের নিজেদের অপেক্ষাও বেশি জানেন না? আমার আয়াতের প্রতি যারা ঈমান আনে তারা যখন তোমার কাছে আসে তখন তাদেরকে বলো, “তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।” তোমাদের রব দয়া ও অনুগ্রহের নীতি নিজের জন্য অপরিহার্য করে নিয়েছেন। তোমাদের কেউ যদি অজ্ঞতাবশত কোনো খারাপ কাজ করে বসে, তারপর তাওবা করে এবং সংশোধন করে নেয়, তাহলে তিনি তাকে মাফ করে দেন এবং নরম নীতি অবলম্বন করেন, এটি তাঁর দয়া ও অনুগ্রহেরই প্রকাশ।” (সূরা আল-আনয়াম: ৫৩-৫৪)

৬. “ইবরাহীমের ঘটনা স্মরণ করো, যখন সে আপন পিতা আজরকে বলেছিল, ‘তুমি কি মূর্তিকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছ? আমি তো তোমাকে ও তোমার দলের লোকজনকে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত দেখতে পাচ্ছি’। ইবরাহীমকে এভাবেই আমি জমিন ও আসমানের রাজ্য পরিচালন-ব্যবস্থা দেখাচ্ছিলাম। আর এজন্য যে, সে যেন নিঃসন্দেহে বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। অতঃপর যখন তার উপর রাত আচ্ছন্ন হয়ে এলো তখন সে একটি তারকা দেখতে পেলো। বললো, এ আমার রব। কিন্তু পরে তা যখন অস্তমিত হয়ে গেলো, তখন বললো, অস্ত হয়ে যাওয়া জিনিসের প্রতি আমি কিছুমাত্র অনুরাগী নই। পরে যখন উজ্জ্বল চন্দ্র দেখতে পেল তখন বললো, এ আমার রব। কিন্তু তাও যখন অস্তগমন করল, তখন বললো, আমার রব যদি আমাকে পথ না দেখান তাবে আমিও গোমরাহ লোকদের মধ্যে শামিল হয়ে পড়ব। এরপর যখন সূর্যকে উজ্জ্বল-উদ্ভাসিত দেখতে পেলো, তখন বলল, এ-ই হচ্ছে আমার রব। এটি সর্বাপেক্ষা বড়। কিন্তু পরে এটাও যখন ডুবে গেলো, তখন ইবরাহীম চিৎকার করে বলে উঠল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক বানাচ্ছ, আমি সেই সব থেকে মুক্ত। আমি তো একনিষ্ঠভাবে নিজের লক্ষ্য সেই মহান সত্তার দিকে কেন্দ্রীভূত করেছি, যিনি যমীন ও আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং আমি কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।” (সূরা আল-আনয়াম: ৭৪-৭৯)

৭. “আল্লাহই শস্যবীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনিই জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং তিনিই বের করেন মৃতকে জীবিত থেকে। এ সমস্ত কাজ তো আল্লাহই করেন, তাহলে তোমরা বিভ্রান্ত হয়ে কোন দিকে ছুটে চলছো? তিনিই রাতের আবরণ বিদীর্ণ করে রঙিন প্রভাতের উন্মেষ করেন। তিনিই রাতকে করেছেন প্রশান্তিকাল। তিনিই চন্দ্র ও সূর্যের উদয়াস্তের হিসেব নির্দিষ্ট করেছেন। বস্তুত এসবই সেই মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানীর নির্ধারিত পরিমাপ। আর তিনিই তোমাদের জন্য তারকাসমূহকে মরু-সমুদ্রের গভীর অন্ধকারে পথ জানার উপায় বানিয়ে দিয়েছেন। লক্ষ করো, আমি নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি তাদের জন্য যারা জ্ঞান রাখে। আর তিনিই এক প্রাণসত্তা থেকে তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর প্রত্যেকের জন্য রয়েছে একটি অবস্থান স্থল এবং তাকে সোপর্দ করার একটি জায়গা। এ নিদর্শনগুলো সুস্পষ্ট করে দিয়েছি তাদের জন্য যার জ্ঞান বুদ্ধির অধিকারী। আর তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। তারপর তার সাহায্য সব ধরনের উদ্ভিদ উৎপাদন করেছেন এবং তার দ্বারা শস্য-শ্যামল ক্ষেত-খামার ও গাছ-পালার সৃষ্টি করেছেন। তারপর তা থেকে বিভিন্ন কোষসম্পন্ন শস্যদানা উৎপাদন করেছেন, খেজুরের মোচা থেকে ফলের থোকা থোকা বানিয়েছেন, যা বোঝার ভারে নুয়ে পড়ে। আর সজ্জিত করেছেন আঙুর, যয়তুন ও ডালিমের বাগান, সাজিয়ে দিয়েছেন সেখানে ফলসমূহ পরস্পর সদৃশ, অথচ প্রত্যেকটি পৃথক বৈশিষ্ট্যেরও অধিকারী। এ গাছগুলো যখন ফলধারণ করে তখন তাদের ফল বের হওয়া ও তা পেকে যাওয়ার অবস্থাটি একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করো। এসব জিনিসেই সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিহিত রয়েছে তাদের জন্য, যারা ঈমান আনে।” (সূরা আল-আনয়াম: ৯৫-৯৯)

৮. “বলো, আমার নামাজ, আমার সর্বপ্রকার ইবাদত অনুষ্ঠানসমূহ, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবকিছুই সারে জাহানের রব আল্লাহরই জন্য।” (সূরা আল-আনয়াম: ১৬২)

৯. “মূলত একথা তারা শুধু এ জন্যই বলবে যে, যে সত্যকে তারা পূর্বে আবৃত ও গোপন করে রেখেছিল, এক্ষণে তা উন্মুক্ত হয়ে তাদের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে; নতুবা, তাদেরকে পূর্ববর্তী জীবনের দিকে যদি ফিরিয়ে দেয়া হয় তা হলেও তারা সেইসব কাজই করবে যা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। তারা তো বড়ই মিথ্যাবাদী। (তাই নিজেদের মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও তারা মিথ্যারই আশ্রয় নেবে)। আজ তারা বলে, জীবন বলতে যা কিছু আছে, তা শুধু এ দুনিয়ার জীবনটুকুই এবং মৃত্যুর পর আমরা কখনই পুনরুত্থান লাভ করব না।” (সূরা আল-আনয়াম: ২৮- ২৯)

১০. “বলুন, ‘আমার রব নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের।’ আর তোমরা প্রত্যেক সাজদাহ বা ইবাদতে তোমাদের লক্ষ্য একমাত্র আল্লাহকেই নির্ধারণ কর এবং তাঁরই আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁকে ডাক। তিনি যেভাবে তোমাদেরকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন তোমরা সেভাবে ফিরে আসবে। একটি দলকে তিনি সোজা পথ দেখিয়ে দিয়েছেন কিন্তু অন্য দলটির ওপর গোমরাহী সত্য হয়ে চেপেই বসেছে। কারণ তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তানদেরকে নিজেদের অভিভাবকে পরিণত করেছে এবং তারা মনে করছে, আমরা সঠিক পথেই আছি।” (সূরা আল-আ’রাফ: ২৯-৩০)

১১. “আমার সাহায্যকারী ও রক্ষাকর্তা হচ্ছেন সেই আল্লাহ, যিনি কিতাব নাযিল করেছেন এবং তিনি তার সালিহ বান্দাদেরকে সাহায্য করে থাকেন। পক্ষান্তরে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা না তোমাদের কোনো সাহায্য করতে পারে আর না তারা নিজেদের সাহায্য করার ক্ষমতা রাখে।” (সূরা আ’রাফ: ১৯৬-১৯৭)

১২. “আল্লাহ তোমাদের মায়ের পেট থেকে তোমাদের বের করেছেন এমন অবস্থায় যখন তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, চিন্তা-ভাবনা করার মতো হৃদয় দিয়েছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। এই লোকেরা কি কখনও পাখিদের দেখেনি যে, আকাশের শূন্যলোকে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত রয়েছে? আল্লাহ ছাড়া কে তাদেরকে ধরে রেখেছে? নিশ্চয়ই এতে বহু নিদর্শন রয়েছে সেই লোকদের জন্য যারা ঈমান আনে।” (সূরা নাহল: ৭৮-৭৯)

১৩. “আল্লাহ তায়া’লা ন্যায়বিচার (ইনসাফ), অনুগ্রহ ও সিলায়ে রেহমীর নির্দেশ দিচ্ছেন এবং অন্যায়, পাপাচার, নির্লজ্জতা ও জুলুম পীড়ন করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে নসিহত করেছেন, যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারো। তোমরা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে ওয়াদা করার পর তা পূরণ করো এবং নিজেদের কসম পাকা-পোক্তভাবে করার পর তা ভঙ্গ করো না, যখন তোমরা আল্লাহকে নিজেদের ওপর সাক্ষী বানিয়ে নিয়েছো। আল্লাহ তোমাদের সব কাজকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিফহাল রয়েছেন।” (সূরা নাহল: ৯০-৯১)

১৪. “আল্লাহর ওয়াদা-প্রতিশ্রুতিকে সামান্য ও নগণ্য ফায়দার বিনিময়ে বিক্রি করে দিও না। যা কিছু আল্লাহর কাছে রয়েছে, তা তোমাদের জন্য অধিক উত্তম-যদি তোমরা জানতে ও বুঝতে পারো। তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে আর যা আল্লাহর কাছে রয়েছে, তাই চিরদিন অবশিষ্ট থাকবে। আমরা অবশ্যই ধৈর্য ধারণকারীদেরকে তাদের উত্তম কাজ অনুপাতে প্রতিফল দান করব।” (সূরা নাহল: ৯৫-৯৬)

১৫. “আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে এ রাত ও দিন এবং সূর্য ও চাঁদ। সূর্য ও চাঁদকে সেজদা করো না; সেজদা করো সেই আল্লাহকে যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, যদি বাস্তবিকই তোমরা তাঁরই ইবাদতকারী হয়ে থাকো।” (সূরা হা-মীম আস সাজদাহ: ৩৭)

১৬. “আর আল্লাহর নিদর্শনের মধ্যে একটি এই যে, তোমরা দেখতে পাচ্ছ, জমিন শুকনো জীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। অতঃপর যখনই আমরা তার ওপর পানি বর্ষণ করি, সহসা তা উথলে ওঠে-অঙ্কুরোদগমে স্ফীত হয়। যে আল্লাহ এ মৃত জমিনকে জীবন্ত করে দেন, তিনি মৃত লোকদেরকেও নিশ্চিতভাবে জীবন দান করবেন। নিঃসন্দেহে তিনি প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর ক্ষমতাবান।” (সূরা হা-মীম আস সাজদাহ: ৩৯)

১৭. “এরপর সে সেগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আর ডান হাতে খুব করে আঘাত হানলো। সেই লোকেরা (ফিরে এসে) দ্রুতবেগে তার কাছে উপস্থিত হলো। সে বললঃ “তোমরা কি নিজেদেরই নির্মিত জিনিসের পূজা-উপাসনা করো? অথচ আল্লাহই তোমাদেরকেও সৃষ্টি করেছেন আর তোমরা যে জিনিসগুলো বানিয়ে রাখো সেগুলোকেও।” (সূরা সাফফাত: ৯৩-৯৬)

১৮. “অতীব মহান ও শ্রেষ্ঠ সেই সত্তা, যার মুষ্ঠির মধ্যে রয়েছে সমগ্র সৃষ্টিলোকের কর্তৃত্ব-সার্বভৌমত্ব। প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর-ই তাঁর কর্তৃত্ব সংস্থাপিত। তিনিই মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন, যেন তোমাদেরকে পরখ করে দেখতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে আমলের দিক দিয়ে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? তিনি যেমন সর্বজয়ী শক্তিমান, তেমনি ক্ষমাশীলও।” (সূরা মূলক: ১-২)

 

একক, কাদিরে মুতলাক এবং সর্বোত্তম এক স্রষ্টার ধারণা সম্পর্কে এমন সুস্পষ্ট পরিভাষা সমূহের উপর নির্ভরশীল দ্বীন এবং ঈমানও সাধারণ মানুষের আকল এবং কালবের জন্য উন্মুক্ত। এবং স্রষ্টা সম্পর্কে এত সহজ ধারণা সকলের দ্বারাই অনুধাবনযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য। আর মানুষের এই ক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো মহান আল্লাহর ইচ্ছাকে গ্রহণ করা এবং উত্তম কাজ করা।

১. “নিশ্চয় জানো শেষ নবীর প্রতি বিশ্বাসী হোক, কি ইহুদি, খ্রিষ্টান কিংবা সাবীই-যে ব্যক্তিই আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনবে ও নেক কাজ করবে, তার পুরস্কার তার রব-এর কাছে রয়েছে এবং তার জন্য কোনো প্রকার ভয় ও চিন্তার কারণ নেই।” (সূরা বাকারা: ৬২)

২. “স্মরণ করো, ইসরাইল-সন্তানদের কাছ থেকে আমরা এ পাকাপোক্ত প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলাম যে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করবে না। পিতামাতার সাথে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে, ইয়াতীম ও মিসকীনদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে। লোকদের সাথে ভালো কথাবার্তা বলবে, নামাজ কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। কিন্তু মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া তোমরা সকলেই এ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছ এবং এখন পর্যন্ত সেই অবস্থায়ই রয়েছে।” (সূরা বাকারা: ৮৩)

৩. “প্রত্যেকের জন্য একটি দিক রয়েছে, যেদিকে সে মুখ করে দাঁড়ায়। কাজেই তোমরা প্রতিযোগিতার সাথে কল্যাণের দিকে অগ্রসর হও। তোমরা যেখানেই থাকবে, আল্লাহ তোমাদেরকে নিশ্চয়ই পাবেন। কোনো জিনিসই তার শক্তিবহির্ভূত নয়।” (সূরা বাকারা: ১৪৮)

৪. “হে ঈমানদারগণ, ধৈর্য ও নামাজের সাহায্যে প্রার্থনা করো, আল্লাহ ধৈর্যশীল লোকদের সঙ্গে রয়েছেন।” (সূরা বাকারা: ১৫৩)

৫. “তোমাদের মুখ পূর্ব দিকে বা পশ্চিম দিকে ফিরাবার মধ্যে কোন পুণ্য নেই। বরং কাজ হচ্ছে এই যে, মানুষ আল্লাহ‌, কিয়ামতের দিন, ফেরেশতা আল্লাহ‌র অবতীর্ণ কিতাব ও নবীদেরকে মনে প্রাণে মেনে নেবে এবং আল্লাহ‌র প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণপ্রিয় ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, এতীম, মিসকীন, মুসাফির, সাহায্য প্রার্থী ও ক্রীতদাসদের মুক্ত করার জন্য ব্যয় করবে। আর নামায কায়েম করবে এবং যাকাত দান করবে। যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করবে এবং বিপদে-অনটনে ও হক–বাতিলের সংগ্রামে সবর করবে তারাই সৎ ও সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই মুত্তাকী।” (সূরা বাকারা: ১৭৭)

৬. “হে ঈমানদারগণ! যা কিছু অর্থ-সম্পদ আমরা তোমাদেরকে দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করো, সেই দিনটি উপস্থিত হওয়ার পূর্বে যে দিন না ক্রয়-বিক্রয় হবে, না বন্ধুত্ব কোনো কাজে আসবে আর না চলবে কোনো সুপারিশ। প্রকৃত জালিম তারাই, যারা কুফরির নীতি অবলম্বন করে।” (সূরা বাকারা: ২৫৪)

৭. “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের দান-খয়রাতের কথা বলে (অনুগ্রহের দোহাই দিয়ে) এবং কষ্ট দিয়ে তাকে সেই ব্যক্তির ন্যায় নষ্ট করো না, যে ব্যক্তি শুধু লোকদের দেখাবার উদ্দেশ্যেই নিজের ধন-মাল ব্যয় করে আর না আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে, না পরকালের প্রতি। তার খরচের দৃষ্টান্ত এইরূপ : যেমন একটি পাথুরে চাতাল, যার ওপর মাটির আস্তর পড়ে ছিল-এর ওপর যখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ল, তখন সমস্ত মাটি ধুয়ে ভেসে গেল এবং গোটা চাতালটি নির্মল ও পরিষ্কার হয়ে পরে রইল। এই সব লোক দান-সদকা করে যে পুণ্য অর্জন করে, তার কিছুই তাদের হাতে আসে না। আর কাফেরদেরকে সঠিক পথ নির্দেশ করা আল্লাহর রীতি নয়।” (সূরা বাকারা: ২৬৪)

৮. “পক্ষান্তরে যারা নিজেদের ধন-মাল খালেসভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মনের ঐকান্তিক স্থিরতা ও দৃঢ়তা সহকারে খরচ করে, তাদের এই ব্যয়ের দৃষ্টান্ত এইরূপ। যেমন কোনো উচ্চ ভূমিতে একটি বাগান রয়েছে, প্রবল বেগে বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ ফল ধরে, আর জোরে বৃষ্টি না হলেও বৃষ্টির রেণুই তার জন্য যথেষ্ট প্রমাণিত হয়। বস্তুত তোমরা যা করো, সবই আল্লাহর গোচরীভূত রয়েছে।” (সূরা বাকারা: ২৬৫)

৯. “তোমরা কিছুতেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারো না, যতক্ষণ না তোমরা (আল্লাহর পথে) সেই সব জিনিস ব্যয় ও নিয়োগ করবে, যা তোমাদের প্রিয় ও পছন্দনীয়। আর যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহ সে সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবহিত রয়েছেন। (সূরা আলে-ইমরান: ৯২)

১০. “হে ঈমানদারগণ! অঙ্গীকারসমূহ পুরোপুরি মেনে চলো। তোমাদের জন্য গৃহপালিত ধরনের সমস্ত জন্তুকে হালাল করা হয়েছে, সে সব বাদে, যা একটু পরই তোমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ইহরামের অবস্থায় শিকার কার্যকে নিজেদের জন্য হালাল করে নিও না। বস্তুত আল্লাহ যা-ই চান, তারই আদেশ দান করেন।” (সূরা মায়েদা: ১)

১১. “হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর আনুগত্য ও ভক্তির নিদর্শনসমূহের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করো না। হারাম মাসসমূহের কোনো মাসকে হালাল করে নিও না। কুরবানির জন্তু-জানোয়ারগুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করো না; সে সব জন্তুর ওপরও হস্তক্ষেপ করো না, যে সবের গলদেশে খোদায়ী মানতের চিহ্নস্বরূপ পট্টি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেই সব লোককেও কোনো কষ্ট দিয়ো না, যারা নিজেদের পরোয়ারদেগারের অনুগ্রহ এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের সন্ধানে পবিত্র ও সম্মানিত ঘরে (কা’বায় যাচ্ছে। ইহরামের অবস্থা শেষ হয়ে গেলে অবশ্য তোমরা শিকার করতে পারো। আর দেখো, একদল লোক যে তোমাদের জন্য মসজিদে হারামের পথ বন্ধ করে দিয়েছে, সেজন্য তোমাদের ক্রোধ যেন তোমাদেরকে এতদূর উত্তেজিত করে না তোলে যে, তোমরাও তাদের মোকাবিলায় অবৈধ বাড়াবাড়ি করতে শুরু করবে। যে সব কাজ পুণ্যময় ও আল্লাহর ভয়মূলক, তাতে সকলের সঙ্গে সহযোগিতা করো; আর গুনাহ ও সীমালঙ্ঘনের কাজ, তাতে কারো একবিন্দু সাহায্য ও সহযোগিতা করো না। আল্লাহকে ভয় করো, কেননা, তাঁর শান্তি অত্যন্ত কঠিন।” (সূরা মায়েদা: ২)

১২. “হে ঈমানদার লোকেরা! এই মদ, জুয়া, আস্তানা ও পাশা এ সবই নাপাক শয়তানি কাজ। তোমরা এটা পরিহার করো। আশা করা যায় যে, তোমরা সাফল্য লাভ করতে পারবে।” (সূরা মায়েদা: ৯০)

১৩. “হে মুহাম্মাদ! এই লোকদেরকে বলো যে, তোমরা এসো, আমি তোমাদেরকে শুনিয়ে দেবো তোমাদের রব তোমাদের ওপর কি কি বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। তা এই যে, তাঁর সঙ্গে কাউকেও শরিক করবে না, ব্যবহার করবে, পিতামাতার সঙ্গে ভালো নিজেদের সন্তানদের দারিদ্রের ভয়ে হত্যা করবে না, কেননা আমিই তোমাদেরকে রিযিক দেই, এবং তাদেরকেও দেবো। নির্লজ্জতার বিষয় ও। প্রসঙ্গের কাছেও যাবেনা, তা প্রকাশ্যেই হোক, কি গোপনে। কোনো প্রাণ আল্লাহ্ যাকে সম্মানীয় করেছেন ধ্বংস করবে না, অবশ্য সত্য ও ন্যায় সহকারে (করা যাবে)। এসব কথা পালন করার জন্য তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, সম্ভবত তোমরা বুঝে-শুনে কাজ করবে।” (সূরা আনয়াম: ১৫১)

১৪. “আরো এই যে, তোমরা ইয়াতীমের মাল-সম্পদের নিকটেও যাবে না, অবশ্য এমন নিয়ম ও পন্থায় (যেতে পারো) যা সর্বাপেক্ষা ভালো, যতদিন না সে জ্ঞানবুদ্ধি লাভের বয়স পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আর মাপে এবং ওজনে পুরোপুরি ইনসাফ করো। আমরা প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর দায়িত্বের বোঝা ততখানিই চাপাই, যতখানির সাধ্য তার রয়েছে। আর যখন কথা বলো, ইনসাফের কথা বলো: ব্যাপারটি নিজের আত্মীয়েরই হোক না কেন এবং আল্লাহর ওয়াদা পূরণ করো। এসব বিষয়ের হেদায়েত আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে দিয়েছেন; হয়ত তোমরা নসীহত কবুল করবে।” (সূরা আনয়াম: ১৫২)

১৫. “আমি কি তাকে দুটি চোখ, একটি জিহ্বা এবং দুটি ওষ্ঠ দেই নাই? আর আমি কি তাকে দুটি স্পষ্ট পথ দেখাই না? কিন্তু সে দুর্গম বন্ধুর পথ অতিক্রম করার সাহস করেনি। তুমি কি জানো সেই দুর্গম বন্ধুর পথটি কি? কোনো গলাকে দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা কিংবা উপবাসের দিনে কোনো নিকটবর্তী ইয়াতীম বা ধূলি মলিন মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো। সেই সঙ্গে শামিল হওয়া সেই লোকদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যারা পরস্পরকে ধৈর্য ধারণের ও (সৃষ্টিকুলের প্রতি) দয়া প্রদর্শনের উপদেশ দেয়। এ লোকেরাই দক্ষিণপন্থি। আর যারা আমার আয়াতসমূহ মেনে নিতে অস্বীকার করেছে তারা বামপন্থী। তাদের ওপর আগুন। একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।” (সূরা বালাদ: ৮-১৬)

১৬. সূর্য ও তার রৌদ্রের শপথ। চাঁদের শপথ যখন তা সূর্যের পিছনে পিছনে আসে। দিনের শপথ যখন তা (সূর্যকে) প্রকট করে তোলে। এবং রাতের শপথ যখন তা (সূর্যকে) আচ্ছাদিত করে নেয়। আকাশসমূহের এবং সেই সত্তার শপথ যিনি তা সংস্থাপিত করেছেন। আর পৃথিবীর ও সেই সত্তার শপথ, যিনি তাকে বিছিয়ে দিয়েছেন। মানব-প্রকৃতির এবং সেই সত্তার শপথ, যিনি তাকে সুবিন্যস্ত করেছেন। অতঃপর তার পাপ ও তার তাকওয়া (সতর্কতা) তার প্রতি ইলহাম করেছেন। নিঃসন্দেহে কল্যাণ পেল সে, যে নিজের নফসের পবিত্রতা বিধান করল। এবং ব্যর্থ হলো সে, যে তাকে খর্ব ও গুপ্ত করল। (সূরা শামস: ১-১০)

১৭. “(লোকেরা) জিজ্ঞেস করছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে কী নির্দেশ? বলে দাও এ দুটি জিনিসেই বড় পাপ রয়েছে, যদিও এতেই লোকদের জন্য কিছুটা উপকারিতাও আছে; কিন্তু উভয় কাজের পাপ উপকারিতা থেকে অনেক বেশি জিজ্ঞেস করছে? আমরা আল্লাহর পথে কি খরচ করব? বলো, যা কিছু তোমাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত। বস্তুত, আল্লাহ তোমাদের জন্য এভাবে বিধানসমূহ স্পষ্টরূপে বিবৃত করেন।” (সূরা বাকারা: ২১৯)

১৮. “একটু মিষ্টি কথা এবং কোনো অপ্রিয় ব্যাপারে সামান্য উদারতা দেখানো সে দান অপেক্ষা ভালো যার পিছনে আসে দুঃখ ও তিক্ততা। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, তিনি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা গুণে ভূষিত।” (সূরা বাকারা: ২৬৩)

১৯. “সেই পথে তীব্র গতিতে চলো, যা তােমাদের রব্ব-এর ক্ষমা এবং আকাশ ও পৃথিবীর সমান প্রশন্ত বেহেশতের দিকে চলে গেছে এবং যা সেই মুত্তাকী লোকদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যারা সব সময়ই নিজেদের ধন-মাল খরচ করে, দুরবস্থায়ই হোক আর সচ্ছল অবস্থায়ই হোক, যারা ক্রোধকে হজম করে এবং অন্যান্য লোকদের অপরাধ মাফ করে দেয়। এই সব নেককার লোককেই আল্লাহ খুব ভালোবাসেন।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৩৩-১৩৪)

২০. “হে ঈমানদারগণ! ধৈর্য অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মুকাবিলায় দৃঢ়তা ও অনমনীয়তা প্রদর্শন করো, সত্যের খেদমতের জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে।” (সূরা আলে-ইমরান: ২০০)

২১. “ইয়াতিমদের ধন-সম্পত্তি তাদের কাছে ফিরিয়ে দাও। ভালো সম্পদ খারাপ সম্পদের সাথে বদল করো না এবং তাদের সম্পদ তোমাদের সম্পদের সাথে মিলিয়ে হজম করে ফেলো না। এটি অত্যন্ত বড় গুনাহ।” (সূরা নিসা: ২)

২২. “যারা ইয়াতিমদের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করে, তারা প্রকৃতপক্ষে আগুন দ্বারা নিজেদের পেট বোঝাই করে এবং তারা নিশ্চয়ই জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।” (সূরা নিসা: ১০)

২৩. “সেই সব লোককেও আল্লাহ পছন্দ করেন না, যারা কার্পণ্য করে এবং অন্য লোককেও কার্পণ্য করার উপদেশ দেয় এবং আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দান করেছেন, তা লুকিয়ে রাখে এরূপ অকৃতজ্ঞ-নেয়ামত অস্বীকারকারী লোকদের জন্য আমরা অপমানকর আযাবের ব্যবস্থা করে রেখেছি।” (সূরা নিসা: ৩৭)

২৪. “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের সব ক্রিয়াকার্য জানেন গোপন ও অদৃশ্য বিষয়ও এবং প্রকাশ্য ব্যাপারগুলোও। তিনি সে লোকদেরকে আদৌ পছন্দ করেন না যারা আত্ম-অহংকারে নিমজ্জিত।” (সূরা নাহল: ২৩)

২৫. “হে নবী! তোমার রব-এর পথের দিকে আহ্বান জানাও হেকমত ও উত্তম নসিহতের সাহায্যে। আর লোকদের সঙ্গে পরস্পর বিতর্ক করো এমন পন্থায়, যা অতি উত্তম। তোমার রবই বেশি ভালো জানেন, কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে আর কে সঠিক পথে আছে।” (সূরা নাহল: ১২৫)

২৬. “(হে নবী!) তিলাওয়াত করো এই কিতাব, যা ওহীর মাধ্যমে তোমার কাছে পাঠানো হয়েছে আর নামাজ আদায় করো: নিঃসন্দেহে নামাজ অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর যিকির তা থেকেও অধিক বড় জিনিস। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কিছু করো।” (সূরা আনকাবুত: ৪৫)

২৭. “ধ্বংস, হীন ঠকবাজদের জন্য (যারা মাপে বা ওজনে কম দেয়)। তাদের অবস্থা এই যে, লোকদের কাছ থেকে গ্রহণের সময় পুরোমাত্রায় গ্রহণ করে; কিন্তু তাদেরকে ওজন বা পরিমাপ করে দেওয়ার সময় তাদের ক্ষতিসাধন করে। এ লোকেরা কি চিন্তা করে না যে, একটা মহাদিবসে তাদেরকে উঠিয়ে আনা হবে? এটি সেই দিন, যেদিন সমস্ত মানুষ রাব্বুল আ’লামীনের সামনে দাঁড়াবে।” (সূরা মুতাফফিফীন, ১-৬)

 

দ্বীন আকলের কোন ফসল নয়, তবে আকলের সাথে দ্বীনের কোনো সংঘর্ষও নেই। জ্ঞান ও বিজ্ঞান যদিও দ্বীনকে বিচার করার ও তাকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা রাখে না, তবুও জ্ঞান ও বিজ্ঞান তাকে সমৃদ্ধ করতে পারে এবং আমাদের জযবার মাধ্যমে আমাদের গভীর চিন্তার গোপন রহস্য সমূহকে অনেক বেশী সম্প্রসারিত করতে পারে।

১. “পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে যে সমস্ত বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে ও শয়নে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠণাকৃতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে, তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন। তারা আপনা আপনি বলে ওঠে, হে আমাদের প্রভু! এসব তুমি অনর্থক ও উদ্দেশ্যবিহীনভাবে সৃষ্টি করোনি। বাজে ও নিরর্থক কাজ করা থেকে তুমি পাক-পবিত্র ও মুক্ত।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৯০-১৯১)

২. “হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের কাছে যেয়ো না। নামাজ সেই সময় পড়া উচিত যখন তোমরা যা বলছো তা জানতে পারো। অনুরূপভাবে অপবিত্র অবস্থায়ও গোসল না করা পর্যন্ত নামাযের কাছে যেয়ো না। তবে যদি পথ অতিক্রমকারী হও, তাহলে অবশ্য স্বতন্ত্র কথা। আর যদি কখনো তোমরা অসুস্থ হয়ে পড়ো, সফরে থাকো বা তোমাদের কেউ মলমূত্র ত্যাগ করে আসে অথবা তোমরা নারী সম্ভোগ করে থাকো এবং এরপর পানি না পাও, তাহলে পাক পবিত্র মাটির সাহায্য গ্রহণ করো এবং তা নিজেদের চেহারা ও হাতের ওপর বোলাও। নিঃসন্দেহে আল্লাহ কোমলতা অবলম্বনকারী ও ক্ষমাশীল।” (সূরা নিসা: ৪৩)

৩. “তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বললো, আমরা শুনেছি অথচ তারা শোনে না। অবশ্য আল্লাহর কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের জানোয়ার হচ্ছে সেই সব বধির ও বোবা লোক যারা-বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগায় না।” (সূরা আনফাল: ২১- ২২)

৪. “এদেরকে জিজ্ঞেস করো, আকাশ ও পৃথিবীর রব কে? বলো আল্লাহ! তারপর এদেরকে জিজ্ঞেস করো, আসল ব্যাপার যখন এই তখন তোমরা কি তাঁকে বাদ দিয়ে এমন মাবুদদেরকে নিজেদের কার্যসম্পাদনকারী বানিয়ে নিয়েছো যারা তাদের নিজেদের জন্যও কোন লাভ ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না? বলো অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান হয়ে থাকে? আলো ও আঁধার কি এক রকম হয়? যদি এমন না হয়, তাহলে তাদের বানানো শরীকরাও কি আল্লাহর মতো কিছু সৃষ্টি করেছে, যে কারণে তারাও সৃষ্টি ক্ষমতার অধিকারী বলে সন্দেহ হয়েছে? বলো, প্রত্যেকটি জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। তিনি একক ও সবার ওপর পরাক্রমশালী।” (সূরা রা’দ: ১৬)

৫. “একমাত্র আল্লাহই সেই সময়ের জ্ঞান রাখেন। তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তিনিই জানেন মাতৃগর্ভে কি লালিত হচ্ছে। কোন প্রাণসত্তা জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কোন ব্যক্তির জানা নেই তার মৃত্যু হবে কোন যমিনে। আল্লাহই সকল জ্ঞানের অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জানেন।” (সূরা লোকমান: ৩৪)

৬. “(এরা মানছে না) তাহলে কি এরা উটগুলো দেখছে না, কীভাবে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে? আকাশ দেখছে না, কীভাবে তাকে উঠানো হয়েছে? পাহাড়গুলো দেখছে না, কীভাবে তাদেরকে শক্তভাবে বসানো হয়েছে? আর যমীনকে দেখছে না, কীভাবে তাকে বিছানো হয়েছে? বেশ (হে নবি) তাহলে তুমি উপদেশ দিয়ে যেতে থাকো। তুমি তো শুধুমাত্র একজন উপদেশক, এদের উপর বল প্রয়োগকারী নও।” (সূরা গাশিয়া: ১৭-২২)

৭. “(এই সত্যটি চিহ্নিত করার জন্য যদি কোন নিদর্শন বা আলামতের প্রয়োজন হয় তাহলে) যারা বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহার করে তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর ঘটনাকৃতিতে, রাত্রদিনের অনবরত আবর্তনে, মানুষের প্রয়োজনীয় ও উপকারী সামগ্রী নিয়ে সাগর দরিয়ার চলমান জলযানসমূহে, বৃষ্টিধারার মধ্যে, যা আল্লাহ বর্ষণ করেন ওপর থেকে তারপর তার মাধ্যমে মৃত ভূমিকে জীবন দান করেন এবং নিজের এই ব্যবস্থাপনার বদৌলতে পৃথিবীতে সব রকমের প্রাণী ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন, আর বায়ু প্রবাহে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালায় অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা বাকারা: ১৬৪)

৮. “হে নবী! তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে যে হেদায়াত পাঠানো হচ্ছে তুমি তার অনুসরণ করো। আর আল্লাহ ফায়সালা দান করা পর্যন্ত সবর করো এবং তিনিই সবচেয়ে ভালো ফয়সালাকারী।” (সূরা ইউসুফ: ১০৯)

৯. “আর তিনিই এ ভূ-তলকে বিছিয়ে রেখেছেন, এর মধ্যে পাহাড়ের খুঁটি গেড়ে দিয়েছেন এবং নদী প্রবাহিত করেছেন। তিনিই সব রকম ফল সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায় এবং তিনিই দিনকে রাত দিয়ে ঢেকে ফেলেন। এ সমস্ত জিনিসের মধ্যে বহুতর নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা করে।” (সূরা রা’দ: ৩)

১০. “আর দেখো, পৃথিবীতে রয়েছে পরস্পর সংলগ্ন আলাদা আলাদা ভূখণ্ড, রয়েছে আঙুর বাগান, শস্যক্ষেত, খেজুর গাছ- কিছু একাধিক কান্ডবিশিষ্ট আবার কিছু এক কাণ্ড বিশিষ্ট, সবাই সিঞ্চিত একই পানিতে কিন্তু স্বাদের ক্ষেত্রে আমি করে দেই তাদের কোনোটাকে বেশী ভালো এবং কোনোটাকে কম ভালো। এসব জিনিসের মধ্যে যারা বুদ্ধিকে কাজে লাগায় তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন।” (সূরা রা’দ: ৪)

১১. “পাক-পবিত্র সে সত্তা যিনি সব রকমের জোড়া সৃষ্টি করেছেন, তা ভূমিজাত উদ্ভিদের মধ্য থেকে হোক অথবা স্বয়ং এদের নিজেদের প্রজাতির অর্থাৎ মানব জাতি মধ্য থেকে হোক কিংবা এমন জিনিসের মধ্য থেকে হোক যাদেরকে এরা জানেও না। এদের জন্য রাত হচ্ছে আর একটি নিদর্শন। আমি তার উপর থেকে দিনকে সরিয়ে দেই তখন এদের ওপর অন্ধকার ছেয়ে যায়। আর সূর্য, সে তার নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে ধেয়ে চলছে। এটি প্রবল পরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তার নিয়ন্ত্রিত হিসেবে আর চাঁদ, তার জন্য আমি মনযিল নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, সেগুলো অতিক্রম করে সে শেষ পর্যন্ত আবার খেজুরের শুকনো ডালের মতো হয়ে যায়। না সূর্যের ক্ষমতা আছে চাঁদকে ধরে ফেলে এবং না রাত দিনের ওপর অগ্রবর্তী হতে পারে, সবাই এক একটি কক্ষপথে সন্তরণ করছে।” (সূরা ইয়াসিন: ৩৬-৪০)

 

এখন যে আয়াত সমূহকে আমি উল্লেখ করেছি, সেই সকল আয়াতে আমরা দেখতে পাই যে, প্রকৃতির সাথে ইসলামের সম্পর্ক এবং বহিঃজগতের সাথে তার সম্পৃক্ততা আমাদের নজর কেড়ে নেয়। মহাগ্রন্থ আল কোরআন আল্লাহর প্রতি ঈমান সম্পর্কে, মানুষের দায়িত্ব ও আদালত সম্পর্কে যেমন বলে থাকে, একইভাবে আমাদেরকে পশু-পাখি, নদী-পাহাড়, তারকাপুঞ্জ, চন্দ্র-সূর্য, পিঁপড়া, মৌমাছি, খেজুর এবং উট সম্পর্কেও বলে থাকে। এই সকল সৃষ্ট বিষয় সমূহের অভ্যন্তরীণ এবং প্রাকৃতিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না। এই দুনিয়ার ব্যাপারে ইসলাম আমাদের সামনে অনুপম এক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরে। হয়তোবা এটি ইসলামের আখলাকের ক্ষেত্রে ভালোবাসা ও মারহামাতের পরিবর্তে হক এবং আদালতকে বেশী প্রাধান্য দেওয়ার একটি জবাবও।

১. “হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অথবা তোমাদের বাপ-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাদের চাইতে অনেক বেশী কল্যাণকামী। কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকো না। আর যদি তোমরা প্যাঁচালো কথা বলো অথবা সত্যতাকে পাশ কাটিয়ে চলো, তাহলে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তার খবর রাখেন।” (সূরা নিসা: ১৩৫)

২. “লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে, তাদের জন্য কি হালাল করা হয়েছে? বলে দাও, তোমাদের জন্য সমস্ত পাক- পবিত্র জিনিস হালাল করা হয়েছে। আর যে-সব শিকারি প্রাণীকে তোমরা শিক্ষিত করে তুলেছ, যাদেরকে আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে তোমরা শিকার করা শিখিয়েছো, তারা তোমাদের জন্য যে-সব প্রাণী ধরে রাখে, তাও তোমরা খেতে পারো। তবে তার ওপর আল্লাহর নাম নিতে হবে। আর আল্লাহর আইন ভাঙার ব্যাপারে সাবধান। অবশ্য হিসাব নিতে আল্লাহর মোটেই দেরি হয় না।” (সূর মায়েদা: ৮)

৩. “এরা মিথ্যা শ্রবণকারী ও হারাম আহারকারী। কাজেই এরা যদি তোমাদের কাছে (নিজেদের মামলা নিয়ে) আসে তাহলে তোমরা চাইলে তাদের মীমাংসা করে দিতে অথবা অস্বীকার করে দিতে পারো। অস্বীকার করে দিলে এর তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর মীমাংসা করে দিলে যথার্থ ইনসাফ সহকারে মীমাংসা করো। কারণ আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।” (সূরা মায়েদা: ৪২)

৪. “আর যদি তোমরা প্রতিশোধ নাও, তাহলে ঠিক ততটুকু নাও যতটুকু তোমাদের ওপর বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। কিন্তু যদি তোমরা সবর করো তাহলে নিশ্চিতভাবেই এটা সবরকারীদের পক্ষে উত্তম।” (সূরা নাহল: ১২৬)

৫. “(আমি তাকে বললাম) হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য সহকারে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করো এবং প্রবৃত্তির কামনার অনুসরণ করো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করবে। যারা আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হয় অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শান্তি, যেহেতু তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে।” (সূরা সোয়াদ: ২৬)

 

আদালত, সামাজিক আদালত এবং ইনসাফ সম্পন্ন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলামের যে প্রচেষ্টা, সেটার মূল ভিত্তি হচ্ছে আখলাক। আমি এখন যে সকল আয়াতকে উল্লেখ করব, সেই সকল আয়াতসমূহ অতীতের মুসলমানদের ভুবনজয়ী ঐতিহাসিক বিজয় সমূহের সাথে বর্তমান মুসলিম সমাজের পরাজয়ের কারণ সমূহকে বুঝার জন্য সাহায্য করবে। যদি কোরআনের ব্যবস্থাকে অপচয়হীন এবং দুর্দশাহীন একটি ব্যবস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তাহলে আমাদেরকে আজকে একথা স্বীকার করতে হবে যে, কোরআনের ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি ব্যবস্থা আমাদের সমাজে বিদ্যমান। যার ফলে আজকের মুসলিম সমাজে এত অপচয় ও দুর্দশা বিরাজ করছে।

১. “আর তোমরা জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু গনিমতের মাল লাভ করেছো তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ আল্লাহ, তাঁর রসূল, আত্মীয়স্বজন, এতিম মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত। যদি তোমরা ঈমান এনে থাকো আল্লাহর প্রতি এবং ফায়সালার দিন অর্থাৎ উভয় সেনাবাহিনীর সামনা সামানি মোকাবিলার দিন আমি নিজের বান্দার ওপর যা নাফিল করেছিলাম তার প্রতি, (অতএব সানন্দে এ অংশ আদায় করো) আল্লাহ প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর শক্তিশালী।” (সূরা আনফাল: ৪১)

২. “এ সদকাগুলো তো আসলে ফকীর মিসকীনদের জন্য। আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত এবং যাদের জন্য মন জয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য। তাছাড়া দাস মুক্ত করার, ঋণগ্রস্তের সাহায্য করার, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের উপকারে ব্যয় করার জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষে থেকে একটি বিধান এবং আল্লাহর সবকিছু জানেন, তিনি বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ।” (সূরা তওবা: ৬০)

৩. “আর দেখো, আল্লাহ তোমাদের একজনকে আর একজনের ওপর রিযিকের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তারপর যাদেরকে এ শ্রেষ্ঠত্ব দান করা হয়েছে তারা এমন নয় যে নিজেদের রিযিক নিজেদের গোলামদের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে থাকে, যাতে উভয় এ রিযিকে সমান অংশীদার হয়ে যায়। তাহলে কি এরা শুধু আল্লাহরই অনুগ্রহ মেনে নিতে অস্বীকার করে?” (সূরা নাহল: ৭১)

৪. “তোমাদের মধ্য থেকে যারা প্রাচুর্য ও সামর্থ্যের অধিকারী তারা যেন এ মর্মে কসম খেয়ে না বসে যে, তারা নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, গরিব-মিসকিন ও আল্লাহর পথে গৃহত্যাগকারীদেরকে সাহায্য করবে না। তাদেরকে ক্ষমা করা ও তাদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করা উচিত। তোমরা কি চাও না আল্লাহ তোমাদের মাফ করেন? আর আল্লাহ ক্ষমাশীলতা ও দয়া গুণে গুণান্বিত।” (সূরা নূর: ২২)

৫. “এবং যখন এদেরকে বলা হয়, আল্লাহ তোমাদের যে রিযিক দান করেছেন তার মধ্য থেকে কিছু আল্লাহর পথে খরচ করো তখন এসব কুফরিতে লিপ্ত লোক মু’মিনদেরকে জবাব দেয় “আমরা কি তাদেরকে খাওয়াবো, যাদেরকে আল্লাহ চাইলে নিজেই খাওয়াতেন? তোমরা তো পরিষ্কার বিভ্রান্তির শিকার হয়েছো।” (সূরা ইয়াসিন: ৪৭)

৬. “(এ সবই এজন্য) যাতে যে ক্ষতিই তোমাদের হয়ে থাকুক তাতে তোমরা মনক্ষুণ্ন না হও। আর আল্লাহ তোমাদের যা দান করেছেন। সেজন্য গর্বিত না হও। যারা নিজেরা নিজেদের বড় মনে করে এবং অহংকার করে, নিজেরাও কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতা করতে উৎসাহ দেয় আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না। এরপর ও যদি কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহ অভাবশূন্য ও অতি প্রশংসিত।” (সূরা হাদীদ: ২৩-২৪)

৭. “তুমি কি তাকে দেখেছো যে আখেরাতের পুরস্কার ও শাস্ত্রিকে মিথ্যা বলছে? সে-ই তো এতিমকে ধাক্কা দেয় এবং মিসকিনকে খাবার দিতে উদ্বুদ্ধ করে না।” (সূরা মাউন: ১-৩)

৮. “কাজেই (হে মুমিন!) আত্মীয়দেরকে তাদের অধিকার দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরকে (দাও তাদের অধিকার)। এ পদ্ধতি এমন লোকদের জন্য ভালো যারা চায় আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তারাই সফলকাম হবে।” (সূরা রুম: ৩৮)

এই আয়াতের মাধ্যমে পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা সম্পর্কিত এই হুকুম সমূহ, সমাজের দুর্বলদের অধিকারের সাথে শক্তিশালীদের দায়িত্ব সমূহকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং সকল মানুষ যে সমান এই মূলনীতির মাধ্যমে অনুপম এক সাদৃশ্য রয়েছে। কোরআনে আলোকে নির্বাচিত কোনো সমাজ কিংবা উচ্চ বর্ণের কোনো জাতি নেই।

৯. “প্রথমে সব মানুষ একই পথের অনুসারী ছিল। (তারপর এ অবস্থা অপরিবর্তিত থাকেনি, তাদের মধ্যে মতভেদের সূচনা হয়) তখন আল্লাহ নবী পাঠান। তারা ছিলেন সত্য সঠিক পথের অনুসারীদের জন্য সুসংবাদদাতা এবং অসত্য ও বেঠিক পথ অবলমম্বনের পরিণতির ব্যাপারে ভীতিপ্রদর্শনকারী। আর তাদের সাথে সত্য কিতাব পাঠান, যাতে সত্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল তার মীমাংসা করা যায়। এবং প্রথমে তাদেরকে সত্য সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হয়নি বলে এ মতভেদগুলো সৃষ্টি হয়েছিল, তা নয়। মতভেদ তারাই করেছিল যাদেরকে সত্যের জ্ঞান দান করা হয়েছিল। তারা সুস্পষ্ট পথনির্দেশ লাভ করার পরও কেবলমাত্র পরস্পরের ওপর বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছিল বলেই সত্য পরিহার করে বিভিন্ন পথ উদ্ভাবন করে। কাজেই যারা নবীদের ওপর ঈমান এনেছে তাদেরকে আল্লাহ নিজের ইচ্ছাক্রমে সেই সত্যের পথ দিয়েছেন, যে ব্যাপারে লোকেরা মতবিরোধ করেছিল। আল্লাহ যাকে চান সত্য সঠিক পথ দেখিয়ে দেন। (সূরা বাকারা: ২১৩)

১০. “হে মানব জাতি! তোমাদের রবকে ভয় করো। তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একটি প্রাণ থেকে। আর সেই একই প্রাণ থেকে সৃষ্টি করেছেন তার জোড়া। তারপর তাদের দুজনার থেকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। সেই আল্লাহকে ভয় করো যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাকো এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন।” (সূরা নিসা: ১)

১১. হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার। তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত। (সূরা হুজুরাত: ১৩)

১২. তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা নেকী ও সৎকর্মশীলতার দিকে আহ্বান জানাবে, ভাল কাজের নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে। (সূরা আলে-ইমরান: ১০৪)

 

মানুষের মধ্যকার সমতা ও সমমর্যাদার বিষয়টি নারীদের সাথেও অনেক বেশী সংগতিপূর্ণ। এই বিষয়টির গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম নয়। সকলেই অবগত যে সমগ্র মানবতার অর্ধেকই হলো নারী। এই ক্ষেত্রে ইসলাম ইউরোপিয়ানদের তথাকথিত নারী অধিকার ও সমতা নয়, ইসলাম কোরআনের আলোকে মানুষের মর্যাদাকে নিরূপণ করে এবং নারীর সমতা ও মর্যাদা নিয়ে অনুপম একটি ধারণা পেশ করে থাকে। আর সমতার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বিষয় হলো – নারী একজন মানুষ হিসেবে একই মূল্য ও মর্যাদার অধিকারী। নারী ও পুরুষের মূল্য ও মর্যাদা একই, তবে তারা একে অপরের চেয়ে ভিন্ন। কোরআন নারী পুরুষের মধ্যকার এই ভিন্নতাকে উঠিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে এই সকল ভিন্নতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। নারীর ক্ষেত্রে ইসলাম ও পাশ্চাত্যের পার্থক্য এখানেই। ইসলাম চায় নারীর ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্যকে রক্ষা করে তাদেরকে সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে। আর পাশ্চাত্য চায় নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্যকে তুলে দিয়ে তাদেরকে সমান মর্যাদা দিতে চায়। তবে সমতার প্রশ্নে কোরআন শুধুমাত্র এই বিষয়টিকে স্বীকৃতিই দেয় না, একইসাথে কেউ যেন ভুল অর্থ বের করতে না পারে, এমন বাক্য ব্যবহার করেছে।

১. “জবাবে তাদের রব বললেন, আমি তোমাদের কারো কর্মকাণ্ড নষ্ট করবো না। পুরুষ হও বা নারী, তোমরা সবাই একই জাতির অন্তর্ভুক্ত। কাজেই যারা আমার জন্য নিজেদের স্বদেশ ভূমি ত্যাগ করেছে এবং আমার পথে যাদেরকে নিজেদের ঘর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া ও কষ্ট দেয়া হয়েছে এবং যারা আমার জন্য লড়েছে ও মারা গেছে, তাদের সমস্ত গোনাহ আমি মাফ করে দেবো এবং তাদেরকে এমন সব বাগানে প্রবেশ করাবো যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে। এসব হচ্ছে আল্লাহর কাছে তাদের প্রতিদান এবং সবচেয়ে ভালো প্রতিদান আল্লাহর কাছেই আছে।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৯৫)

২. “আর যা কিছু আল্লাহ তোমাদের কাউকে অন্যদের মোকাবিলায় বেশি দিয়েছেন তার আকাঙ্ক্ষা করো না। যা কিছু পুরুষেরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী। আর যা কিছু মেয়েরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী। হাঁ, আল্লাহর কাছে তাঁর ফজল ও মেহেরবানীর জন্য দোয়া করতে থাকো। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত জিনিসের জ্ঞান রাখেন।” (সূরা নিসা: ৩২)

৩. “মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, এরা সবাই পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। এরা ভাল কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে। এরা এমন লোক যাদের ওপর আল্লাহর রহমত নাজিল হবেই। অবশ্যই আল্লাহ সবার ওপর পরাক্রমশালী এবং জ্ঞানী ও বিজ্ঞ। এ মুমিন পুরুষ ও নারীকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদেরকে তিনি এমন বাগান দান করবেন যার নিম্নদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান হবে এবং তারা তার মধ্যে চিরকাল বাস করবে। এসব চির সবুজ বাগানে তাদের জন্য থাকবে বাসগৃহ এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” (সূরা তওবা: ৭১-৭২)

৪. “পুরুষ বা নারী যে-ই সৎকাজ করবে, সে যদি মুমিন হয়, তাহলে তাকে আমি দুনিয়ায় পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জীবন দান করবো এবং (আখেরাতে) তাদের প্রতিদান দেবো তাদের সর্বোত্তম কাজ অনুসারে।” (সূরা নাহল: ৯৭)

৫. “যারা সতী সাধ্বী, সরলমনা মু’মিন মহিলাদের প্রতি অপবাদ দেয় তারা দুনিয়ায় ও আখেরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশান্তি।” (সূরা নূর: ২৩)

৬. ” হে নবী! মু’মিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য বেশী পবিত্র পদ্ধতি। যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা জানেন। আর হে নবী! মু’মিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে আর তাদের সাজসজ্জা না দেখায়, যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে। তারা যেন তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে, তবে নিম্নোক্তদের সামনে ছাড়া স্বামী, বাপ, স্বামীর বাপ, নিজের ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, নিজের মেলামেশার মেয়েদের, নিজের মালিকানাধীনদের, অধীনস্থ পুরুষদের যাদের অন্য কোনোরকম উদ্দেশ্য নেই এবং এমন শিশুদের সামনে ছাড়া যারা মেয়েদের গোপন বিষয় সম্পর্কে এখনো অজ্ঞ। তারা যেন নিজেদের যে সৌন্দর্য তারা লুকিয়ে রেখেছে তা লোকদের সামনে প্রকাশ করে দেবার উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মু’মিনগণ! তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।” (সূরা নূর: ৩০-৩১)

৭. “একথা সুনিশ্চিত যে, যে পুরুষ ও নারী মুসলিম, মুমিন, হুকুমের অনুগত, সত্যবাদী, সবরকারী, আল্লাহর সামনে বিনত, সাদকাদানকারী, রোযা পালনকারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত এবং প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।” (সূরা আহযাব: ৭৩)

৮. “সেই দিন তাদের বলা হবে, হে আমার বান্দারা, আজ তোমাদের কোনো ভয় নেই এবং কোনো দুঃখও আজ তোমাদের স্পর্শ করবে না। তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীরা জান্নাতে প্রবেশ করো। তোমাদের খুশী করা হবে।” (সূরা যুখরুফ: ৬৯-৭০)

 

অর্থাৎ একটি নারীদের জন্য অপরটি পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট এরকম দুই ধরনের আখলাকের স্থান নেই। কোরআন এই অনুপম আখলাকের ধারণার আলোকে সকল মানুষের কাছ থেকে যা কিছু চেয়ে থাকে সেগুলো হলো:

১. “তোমার রব ফায়সালা করে দিয়েছেন: তোমরা কারোর ইবাদাত করো না, একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করো। পিতামাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করো। যদি তোমাদের কাছে তাদের কোনো একজন বা উভয় বৃদ্ধ অবস্থায় উপনীত হয়, তাহলে তাদেরকে “উহ্” পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমকের সুরে জবাব দিও না। আর তাদের সাথে মর্যাদা সহকারে কথা বলো। আর দয়া ও কোমলতা সহকারে তাদের সামনে বিনম্র থাকো এবং দোয়া করতে থাকো এই বলেঃ হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়া, মায়া, মমতা সহকারে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।” (সূরা ইসরা: ২৩-২৪)

২. “এতীমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেও না, তবে হ্যাঁ সুদপায়ে, যে পর্যন্ত না সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে যায়। প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। এটিই ভালো পদ্ধতি এবং পরিণামের দিক দিয়েও এটিই উত্তম। এমন কোনো জিনিসের পেছনে লেগে যেও না, যে সম্পর্কে তোমার জ্ঞান নেই। নিশ্চিতভাবেই চোখ, কান ও দিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যমীনে দম্ভভরে চলো না। তুমি না যমীনকে চিরে ফেলতে পারবে, না পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারবে। এ বিষয়গুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটির খারাপ দিক তোমার রবের কাছে অপছন্দনীয়।” (সূরা ইসরা: ৩৪-৩৮)

৩. “হে ঈমানদারগণ! নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যের গৃহে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না গৃহবাসীদের সম্মতি লাভ করো এবং তার অধিবাসীদেরকে সালাম করো। এটিই তোমাদের জন্য ভালো পদ্ধতি, আশা করা যায় তোমরা এদিকে নজর রাখবে। তারপর যদি সেখানে কাউকে না পাও, তাহলে তাতে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না তোমাদের অনুমতি না দেয়া হয়। আর যদি তোমাদের বলা হয়, ফিরে যাও তাহলে ফিরে যাবে, এটিই তোমাদের জন্য বেশী শালীন ও পরিচ্ছন্ন পদ্ধতি এবং যা কিছু তোমরা করো আল্লাহ তা খুব ভালোভাবেই জানেন।” (সূরা নূর: ২৭-২৮)

৪. “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মালিকানাধীন দাসদাসী এবং তোমাদের এমন সব সন্তান যারা এখনো বুদ্ধির সীমানায় পৌঁছেনি, তাদের অবশ্যই তিনটি সময়ে অনুমতি নিয়ে তোমাদের কাছে আসা উচিত: ফজরের নামাযের আগে, দুপুরে যখন তোমরা পোশাক ছেড়ে রেখে দাও এবং এশার নামাযের পর। এ তিনটি তোমাদের গোপনীয়তার সময়। এরপরে তারা বিনা অনুমতিতে এলে তোমাদের কোন গুনাহ নেই এবং তাদেরও না। তোমাদের পরস্পরের কাছে বারবার আসতেই হয়। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিজের বাণী সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন ও বিজ্ঞ।” (সূরা নূর: ৫৮)

৫. “হে নবী, সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকী দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভাল। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে। ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।” (সূরা ফুসসিলাত: ৩৪-৩৫)

৬. “এটাই সেই জিনিস যার সুসংবাদ আল্লাহ তার সেই সব বান্দাদের দেন যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে। হে নবী, এসব লোককে বলে দাও, এ কাজের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। তবে আত্মীয়তার ভালবাসা অবশ্যই চাই। যে কল্যাণ উপার্জন করবে আমি তার জন্য তার সেই কল্যাণের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দিব। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল ও নেক কাজের মর্যাদাদাতা।” (সূরা শুরা: ২৩)

৭. “আমি মানুষ এই মর্মে নির্দেশনা দিয়েছি যে, তারা যেন পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে। তার মা কষ্ট করে তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলো এবং কষ্ট করেই তাকে প্রসব করেছিলো। তাকে গর্ভে ধারণ ও দুধপান করাতে ত্রিশ মাস লেগেছে। এমন কি যখন সে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছেছে এবং তারপর চল্লিশ বছর বয়সে উপনীত হয়েছে তখন বলেছেঃ “হে আমার রব, তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে যে-সব নিয়ামত দান করেছো আমাকে তার শুকরিয়া আদায় করার তাওফীক দাও। আর এমন সৎ কাজ করার তাওফীক দাও যা তুমি পছন্দ করো। আমার সন্তানদেরকে সৎ বানিয়ে আমাকে সুখ দাও। আমি তোমার কাছে তওবা করছি। আমি নির্দেশের অনুগত (মুসলিম) বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা আহকাফ: ১৫)

৮. “হে ঈমান গ্রহণকারীগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে তাহলে তা অনুসন্ধান করে দেখ। এমন যেন না হয় যে, না জেনে শুনেই তোমরা কোনো গোষ্ঠীর ক্ষতি করে বসবে এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।” (সূরা হুজুরাত: ৬)

৯. “ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। তারপরও যদি দু’টি দলের কোন একটি অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তবে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো। যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। এরপর যদি তারা ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করিয়ে দাও এবং ইনসাফ করো। আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন। মু’মিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ঠিক করে দাও। আল্লাহকে ভয় করো, আশা করা যায় তোমাদের প্রতি মেহেরবানী করা হবে।” (সূরা হুজুরাত: ৯-১০)

১০. “হে ঈমানদাগণ, বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গোনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তওবা কবুলকারী এবং দয়ালু।” (সূরা হুজুরাত: ১২)

১১. “মনমরা হয়ো না, দুঃখ করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৩৯)

১২. “হে পুত্র! নামাজ কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যা কিছু বিপদই আসুক সে জন্য সবর করো। একথাগুলোর জন্য বড়ই তাকিদ করা হয়েছে। আর মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলো না, পৃথিবীর বুকে চলো না উদ্ধত ভঙ্গিতে, আল্লাহ পছন্দ করেন না আত্মম্ভরি ও অহংকারীকে। নিজের চলনে ভারসাম্য আনো এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো। সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ।” (সূরা লোকমান: ১৭-১৯)

১৩. “আমি তাওরাত নাযিল করেছি। তাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো। সমস্ত নবী, যারা মুসলিম ছিল, সে অনুযায়ী এ ইহুদী হয়ে যাওয়া লোকদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা করতো। আর এভাবে রব্বানী ও আহবারও (এরই ওপর তাদের ফায়সালার ভিত্তি স্থাপন করতো)। কারণ তাদেরকে আল্লাহর কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল এবং তারা ছিল এর ওপর সাক্ষী। কাজেই (হে ইহুদী গোষ্ঠী।) তোমরা মানুষকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো এবং সামান্য তুচ্ছ মূল্যের বিনিময়ে আমার আয়াত বিক্রি করা পরিহার করো। আল্লাহর নাযিল করা আইন অনুযায়ী যারা ফায়সালা করে না, তারাই কাফের।” (সূরা মায়েদা: ৪৪)

১৪. “তোমরা অন্যদের সৎকর্মশীলতার পথ অবলম্বন করতে বলো কিন্তু নিজেদের কথা ভুলে যাও। অথচ তোমরা কিতাব পাঠ করে থাকো। তোমরা কি জ্ঞান বুদ্ধি একটুও কাজে লাগাও না?” (সূরা বাকারা: ৪৪)

 

মহাগ্রন্থ আল কোরআন সুদ এবং যারা সুদি কারবার করে তাদেরকে এমনভাবে নিন্দা জানায় যার দৃষ্টান্ত অন্য কোনো কিতাবে কিংবা কোরআনের আগে পরে রচিত কোনো আইনের গ্রন্থে দেখা যায় না। কোরআন এমন এক সমাজের ধারণা তুলে ধরে, যে সমাজের মূল ভিত্তি হবে আখলাক ও ইহসান, এই জন্য এই ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোরআন উচ্চকণ্ঠ হতে বাধ্য হয়। কোরআন সুদকে এবং সকল ধরণের সুদি কারবারকে প্রত্যাখ্যান করে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং যারা বৈধ পথে উপার্জন করে তাদের পক্ষাবলম্বন করে থাকে। কোরআন শুধুমাত্র এর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি, একইসাথে সকল ধরনের শোষণ, মধ্যস্বত্বভোগী এবং অন্যায়ভাবে উপার্জন করে যারা জীবন নির্বাহ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণ করে।

১. “কিন্তু যারা সুদ খায় তাদের অবস্থা হয় ঠিক সেই লোকটির মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল করে দিয়েছে। তাদের এই অবস্থায় উপনীত হওয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা বলে: ব্যবসা তো সুদেরই মতো। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। কাজেই যে ব্যক্তির কাছে তার রবের পক্ষ থেকে এই নসীহত পৌঁছে যায় এবং ভবিষ্যতে সুদখোরি থেকে সে বিরত হয়, সে ক্ষেত্রে যা কিছু সে খেয়েছে তাতো খেয়ে ফেলেছেই এবং এ ব্যাপারটি আল্লাহর কাছে সোপর্দ হয়ে গেছে। আর এই নির্দেশের পরও যে ব্যক্তি আবার এই কাজ করে, সে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে সে থাকবে চিরকাল। আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বর্ধিত ও বিকশিত করেন। আর আল্লাহ অকৃতজ্ঞ দুষ্কৃতিকারীকে পছন্দ করেন না। অবশ্যই যারা ঈমান আনে, সৎকাজ করে, নামাজ কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাদের প্রতিদান নিঃসন্দেহে তাদের রবের কাছে আছে এবং তাদের কোন ভয় ও মর্মজ্বালাও নেই। হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং লোকদের কাছে তোমাদের যে সুদ বাকি রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও, যদি যথার্থই তোমরা ঈমান এনে থাকো। কিন্তু যদি তোমরা এমনটি না করো তাহলে জেনে রাখো, এটা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। এখনো তওবা করে নাও (এবং সুদ ছেড়ে দাও) তাহলে তোমরা আসল মূলধনের অধিকারী হবে। তোমরা জুলুম করবে না এবং তোমাদের ওপর জুলুম করাও হবে না।” (সূরা বাকারা: ২৭৫-২৭৯)

২. “যে সুদ তোমরা দিয়ে থাকো, যাতে মানুষের সম্পদের সাথে মিশে তা বেড়ে যায়, আল্লাহর কাছে তা বাড়ে না। আর যে যাকাত তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে দিয়ে থাকো, তা প্রদানকারী আসলে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করে।” (সূরা রূম: ৩৯)

 

সবশেষে, কেউ কেউ বিভিন্ন দলিলের উপর ভিত্তি করে জিহাদকে ইসলামের ষষ্ঠ রুকন বলে উল্লেখ করেছেন। আমিও তাদের এই মতকে সমর্থন করি। কারণ জিহাদবিহীন ইবাদত ও তাবলীগ রিয়া ছাড়া অন্যকিছু নয়। জিহাদ এবং শুধুমাত্র জিহাদের জযবাই পারে আমাদেরকে সত্যিকারের মুসলিম বানাতে।

১. “আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, কিন্তু বাড়াবাড়ি করো না। কারণ যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না।” (সূরা বাকারা: ১৯০)

২. “আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না। অনুগ্রহ প্রদর্শনের পথ অবলম্বন করো, কেননা আল্লাহ অনুগ্রহ প্রদর্শনকারীদেরকে ভালোবাসেন।” (সূরা বাকারা: ১৯৫)

৩. তোমাদের যুদ্ধ করার হুকুম দেয়া হয়েছে এবং তা তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর। হতে পারে কোনো জিনিস তোমরা পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না। (সূরা বাকারা: ২১৬)

৪. “তারপর তালুত যখন সেনাবাহিনী নিয়ে এগিয়ে চললো, সে বললোঃ “আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি নদীতে তোমাদের পরীক্ষা হবে। যে তার পানি পান করবে সে আমার সহযোগী নয়। একমাত্র সে-ই আমার সহযোগী যে তার পানি থেকে নিজের পিপাসা নিবৃত্ত করবে না। তবে এক আধ আঁজলা কেউ পান করতে চাইলে করতে পারে। কিন্তু স্বল্প সংখ্যক লোক ছাড়া বাকি সবাই সেই নদীর পানি আকণ্ঠ পান করলো। অতঃপর তালুত ও তার সাথী মুসলমানরা যখন নদী পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো তখন তারা তালুতকে বলে দিল, আজ জালুত ও তার সেনাদলের মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যারা একথা মনে করছিল যে, তাদের একদিন আল্লাহর সাথে মোলাকাত হবে, তারা বললোঃ “অনেকবারই দেখা গেছে, স্বল্প সংখ্যক লোকের একটি দল আল্লাহর হুকুমে একটি বিরাট দলের ওপর বিজয় লাভ করেছে। আল্লাহ সবরকারীদের সাথী।” (সূরা বাকারা: ২৪৯)

৫. “অবশেষে আল্লাহর হুকুমে তারা কাফেরদের পরাজিত করলো। আর দাউদ জালুতকে হত্যা করলো এবং আল্লাহ তাকে রাজ্য ও প্রজ্ঞা দান করলেন আর এই সাথে যা যা তিনি চাইলেন তাকে শিখিয়ে দিলেন। এভাবে আল্লাহ যদি মানুষদের একটি দলের সাহায্যে আর একটি দলকে দমন না করতে থাকতেন, তাহলে পৃথিবীর ব্যবস্থাপনা বিপর্যস্ত হতো। কিন্তু দুনিয়াবাসীদের ওপর আল্লাহর অপার করুণা (যে, তিনি এভাবে বিপর্যয় রোধের ব্যবস্থা করতেন)।” (সূরা বাকারা: ২৫১)

৬. “হে ঈমানদারগণ! এ আহলে কিতাবদের অধিকাংশ আলেম ও দরবেশের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা মানুষের ধন- সম্পদ অন্যায় পদ্ধতিতে খায়, এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে। যারা সোনা রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রণাময় আযাবের সুখবর দাও।” (সূরা তওবা: ৩৪)

৭. “তোমাদের ওপর যখন বিপদ এসে পড়লো তোমরা বলতে লাগলে, এ আবার কোথায় থেকে এলো? তোমাদের এ অবস্থা কেন? অথচ (বদরের যুদ্ধে) এর দ্বিগুণ বিপদ তোমাদের মাধ্যমে তোমাদের বিরোধী পক্ষের ওপর পড়েছিল। হে নবী! ওদের বলে দাও, তোমরা নিজেরাই এ বিপদ এনেছো। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের ওপর শক্তিমান।” (সূরা আলে-ইমরান: ১৬৫)

৮. “হে ঈমানদানগণ! সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবলায় দৃঢ়তা দেখাও, হকের খেদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে।” (সূরা আলে-ইমরান: ২০০)

৯. “হে ঈমানদারগণ! মোকাবিলা করার জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকো। তারপর সুযোগ পেলে পৃথক পৃথক বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে বের হয়ে পড়ো অথবা একসাথে।” (সূরা নিসা: ৭১)

১০. “যে-সব মুসলমান কোন প্রকার অক্ষমতা ছাড়াই ঘরে বসে থাকে আর যারা ধন-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে, তাদের উভয়ের মর্যাদা সমান নয়। যারা ঘরে বসে থাকে তাদের তুলনায় জানমাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের মর্যাদা আল্লাহ বুলন্দ করেছেন। যদিও সবার জন্য আল্লাহ কল্যাণ ও নেকীর ওয়াদা করেছেন তবুও তাঁর কাছে মুজাহিদদের কাজের বিনেময়ে বসে থাকা লোকেদের তুলনায় অনেক বেশী।” (সূরা নিসা: ৯৫)

এখন আমি বিশেষ একটি বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেই বিষয়টি হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান। দ্বীনের বিষয় আসলে আমরা সাধারণত মানুষকে দুইভাগে বিভক্ত করে থাকি: মু’মিন (বিশ্বাসী) ও কাফির (অবিশ্বাসী)। যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখতে পাব যে, এই ধরনের বিভাজন করলে খুবই সরলীকরণ হয়ে যায়। এই দুই ধরনের মানুষ ছাড়াও সমাজে তৃতীয় একটি দল রয়েছে, আমরা অনেক সময় তাদেরকে উল্লেখ করতে ভুলে যাই। এই তৃতীয় দলটি হলো এমন দল যারা নিজেদেরকে বিশ্বাসী (মুমিন) দাবি করে এবং বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তারা এমন নয়। এরা কম হোক কিংবা বেশি হোক আল্লাহর ইবাদত করে, ঈদ উদযাপন করে, দ্বীনের নির্দিষ্ট কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করে। কিন্তু তারা ভয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করে, ব্যবসার ক্ষেত্রে মানুষকে প্রতারিত করে, অন্যের উপর ভর করে নিজের জীবন পরিচালনা করে, মদ পান করে, হারামভাবে জীবনকে উপভোগ করে এবং যেন এক হাজার বছর বেঁচে থাকবে এমনভাবে জীবন, সম্পদ ও পদপদবীকে ভয়ের সাথে রক্ষা করে অথবা শক্তিশালী ও ক্ষমতাবানদের চাটুকারী করে। এই ধরণের মানুষদের অভিন্ন ও সুস্পষ্ট একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে – ‘ভয়’। আর এই ভয় তাদের জীবনের জন্য, তাদের সম্পদের জন্য এবং তাদের পদ-পদবীর জন্য। তাদের জীবন যেন ভয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়ে থাকে। তাদের সকল প্রচেষ্টা হয়ে থাকে শক্তিশালী গোষ্ঠীর কিংবা সরকারের সমর্থন অর্জন করার জন্য।

আর তাদের এত সকল ভয়ের মধ্যে একটি ভয়ের ঘাটতি রয়েছে আর সেটি হলো – “আল্লাহর ভয়”। তারা তাদের এই রুহ এবং অনির্ধারিত দ্বিমুখী একটি পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে গড়ে তোলে থাকে। তবে আমরা যদি এই তৃতীয় দলটির অস্তিত্বকে বিবেচনায় ধরি তাহলে দুনিয়ার অনেক কিছুকে অনেক সহজভাবে বুঝতে পারব। ‘কী হচ্ছে’, এর সাথে ‘কেন হচ্ছে’ সেটাও আমরা বুঝতে পারব।

বর্তমান মুসলিম উম্মাহর মধ্যে দ্বীনের সত্যিকারের অনুসারীর সংখ্যা খুবই কম, তবে মৌখিকভাবে দ্বীনের স্বীকৃতিদানকারীদের সংখ্যা অনেক। দ্বীনের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গকারীদের সংখ্যা খুবই কম, তবে দ্বীনকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারকারীদের সংখ্যা অনেক। এরা দ্বীনকে শর্তহীনভাবে সামনে নিয়ে আসে, তবে ঐ একই দ্বীনের চাওয়াকে ব্যক্তিগত জীবনে খুব কমই বাস্তবায়ন করে। এই প্যারাডক্স এবং বাহ্যিকতা ও অভ্যন্তরের মধ্যকার এই অন্তর্দ্বন্দ্ব মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য খুবই সহায়ক।

মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কোরআনের যে অবস্থান, তা আজকের অবস্থাকে খুব করুণভাবে তুলে ধরেছে। আজ মুসলিম উম্মাহর সদস্যদের ঘরে গিয়ে দেখবেন কোরআনকে সবচেয়ে উঁচু স্থানে তুলে রাখা হয়েছে। কোরআনকে সবচেয়ে ভালো উপহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কোরআন ছাপার জন্য সবচেয়ে ভালো মানের কাগজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মানুষ এখনো কোরআনের আয়াত দিয়ে সুন্দর সুন্দর ক্যালিগ্রাফি অঙ্কন করে এবং এর পৃষ্ঠা সমূহকে চাকচিক্য করে তুলে ধরার জন্য প্রতিযোগিতা করে।

শিশুরাও সর্বপ্রথম যে বইটি পড়তে শেখে সেটি হলো কোরআন। কিন্তু তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ এর মধ্যে আসলেই কী লেখা আছে, সেটা না জেনে এবং সেটার গুরুত্ব না বুঝেই বড় হবে ও জীবন যাপন করবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কোরআন হলো অনেক বড় একটি شعائر (সিম্বল)। কিন্তু বর্তমানে কুরআনকে এই শায়ায়ীর বা নিদর্শনের মাঝেই সীমাবদ্ধ রেখে জীবন পাথেয় হিসেবে বিবেচনা করা হয় না।

একটু ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন, কোরআন বুঝে পড়ার চেয়ে সুন্দর সুরে কোরআন পড়াকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। আবার সুর দেওয়ার ক্ষেত্রেও আরব হোক কিংবা অনারব হোক, কেহই কোরআনের মৌলিক অর্থে উপনীত হতে পারছে না। এছাড়াও কোরআনের রয়েছে অনুপম এক সুরের দ্যোতনা। কখনো আদেশ দানকারী ও নিশ্চিত অর্থবোধক, আবার কখনো মিষ্টিভাবে সতর্ককারী ও দাওয়াতদানকারী এবং উচ্চস্বরে সতর্ককারী। কিন্তু যারা সুন্দর সুললিত কণ্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করেন, তারা কি এসব বিষয় খেয়াল রাখেন?

দ্বীন আরাম আয়েশের জন্য নয়। দ্বীন হলো একটি আহ্বান, একটি দায়িত্ব, একটি আবেদন। সত্যিকারের ঈমানদ্বার ও জযবাধারী একটি প্রজন্ম, জযবা ও চেতনাহীনভাবে দ্বীনকে ধারণাকারী একটি প্রজন্ম থেকে অনেক কিছু করতে সক্ষম। বিগত ১৪০০ বছর ধরে ইসলামের মধ্যে যে সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং যে আখলাক দেখতে পাচ্ছি, এটা শুরুর দিকের ৩ টি মুসলিম প্রজন্ম কর্তৃক তৈরিকৃত। ১৪০০ বছর আগে সেই তিনটি প্রজন্ম যা কিছু করেছেন মুসলিম উম্মাহ আজও সেটার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরবর্তীতে যারাই এসেছে তারা সকলেই এই তিন প্রজন্মকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তাদের নিকট থেকে প্রেরণা নিয়েছেন।

এই কারণে মুসলিম দেশসমূহে ভবিষ্যতে যে সকল বিপ্লব হবে তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হবে দ্বীনি বিপ্লব। মানুষের রুহ এবং কলবের মধ্যে সংগঠিত হওয়া এই বিপ্লব অনেক মুজিযার জন্ম দিবে। আজকে যে সকল বিষয়কে অসম্ভব ও অকল্পনীয় মনে হচ্ছে সেই সকল কিছু অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে এই অদৃশ্য বিপ্লবের বদৌলতে। রুহ ও কালবের মধ্যে ঘটে যাওয়া এই বিপ্লবের বদৌলতে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নবদিগন্ত উন্মোচিত হবে, শোষক ও দখলদারদেরকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করবে, অভাব, কুসংস্কার, আদালতহীনতা, জুলুম ও মূর্খতা বিদায় নিবে। আমাদের শহর ও গ্রামগুলো হবে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি – এমন অনেক ক্ষেত্রে এমন এমন কাজ হবে, যেটার বদৌলতে মানুষ দেখতে পাবে এক নব সংস্কৃতি ও নব দিগন্ত।

হে আল্লাহ, তুমি সকল মুসমানদেরকে এবং সকল মানুষকে ঈমান দান করো। আমিন।

 

(সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯)

 

অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ

৪৪০৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ হলেন গোটা দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের একজন মহান পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে জন্ম লাভ করা এই মহাপুরুষ দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করেছেন বিরল অনেক দৃষ্টান্ত। তিনি বসনিয়া হেরসেকের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, যার হাত ধরেই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মুক্তি পেয়েছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অসম যুদ্ধে জয়ী হয়ে শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছিলেন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে।

জন্ম ও শৈশবকাল:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ১৯২৫ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বস্নাকা ক্রুপা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিলো ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি পরিবার। কিন্তু আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলাম বিরোধী একটি বৈরী পরিবেশ ও ইউরোপিয়ানদের দারা দখলকৃত একটি ভূমিতে বেড়ে উঠেন। সারায়েভোর একটি জার্মান স্কুলে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। একজন মেধাবী ও সুশৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে সবার কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। তিনি তার স্কুল জীবনেই পাশ্চাত্য ও ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য তার সহপাঠীদের কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। সে সময়েই তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে গড়ে তুলেন মেলাদি মুসলমানি (মুসলিম যুবসংঘ) নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠন কায়েমকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু তার জ্ঞান এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে সবার কাছেই ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ। আর এই কারণেই তার প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্লাব না হয়ে পরিণত হয় সক্রিয় একটি সংগঠনে। যার ফলে এটি হয়ে ওঠে ছাত্রদের ক্যারিয়ার গঠন ও গঠনমূলক কাজের অন্যতম সূতিকাগার। অপরদিকে মেয়েদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠনটি দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ এর প্রতিষ্ঠিত এই মুসলিম যুবসংঘটি যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার এই যুগান্তকারী ভূমিকা তাকে ও তার সংগঠনকে সবার সামনে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী বসনিয়াতে ১ লাখেরও বেশি মুসলমান হত্যা করে।

কম্যুনিস্ট শাসনের জুলুম-নির্যাতন:
১৯৪৬ সালের ১৩ জানুয়ারি বসনিয়া পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। কিন্তু এই সংগ্রামে বামপন্থি নেতাদের আধিপত্য থাকায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বামপন্থিরা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। বসনিয়া একটি স্বায়ত্ত শাসিত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এক চুক্তি অনুযায়ী যুগোশ্লাভিয়ার সাথে আরও ৬টি দেশ মিলে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে। বসনিয়া হয় এই ৬টি দেশের একটি।
কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলামী আন্দোলনের নেতা হওয়ায় এবং নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকার কারণে কম্যুনিস্টদের টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৪৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। এবং তিনি একাধারে ৫ বছর বন্দি জীবন যাপন করেন।
১৯৫৩ সালে টিটু (Titu) ক্ষমতায় আসার পর আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের উপর জুলুম-নির্যাতন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি এ সকল জুলুম- নির্যাতনের পরেও তার বিপ্লবী ভূমিকা অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কাজকে অব্যাহত রাখেন, চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটানোর কাজে রত থাকেন। এ সময়ে তিনি অন্য একটি ইসলামী দলের নেতা হাসান দুজুর সাথে মিলে তার কাজের গতি বৃদ্ধি করেন।
১৯৭৪ সালে টিটুর নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসা নতুন করে উন্মুক্ত হয়। ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম-নির্যাতন কমে আসায় অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলোর উপর পরিমাণে স্বল্প হলেও জুলুম-নির্যাতন কমে আসে। ইসলামী সংগনগুলোর কাজের ফলে জনগণের মধ্যে ইসলামের একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়।

টিটুর মৃত্যু ও আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ইসলামী মেনিফেস্টো (Islamic Menifesto):
১৯৮০ সালে টিটুর মৃত্যুর পর ফেডারেশন প্রেসিডেন্টের বিষয়ে একটি চুক্তি প্রস্তাবিত হয়। আর এটি হলো ৬টি স্বায়ত্ত শাসিত দেশের প্রেসিডেন্টগণ সবাই এক বছর করে ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই চুক্তির কারণে স্বল্প পরিসরে হলেও গণতন্ত্র ফিরে আসে। চুক্তির আলোকে সকলেই কাজ করার সুযোগ পায়। আর এ সময়েই আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ছেলে তার পিতার বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধসমূহকে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে বই আকারে প্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে Islamic Declartion নামে একটি বই প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে এই বই প্রকাশিত হওয়ায় আলীয়া ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রে রেডিকেল ইসলামের প্রবর্তন করতে চাচ্ছেন, এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচকে আদালতে নেওয়া হলে তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বসনিয়া হেরসেককে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপর তারা তাকে এক অন্যায় আদেশের মাধ্যমে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এবং তার বইকেও নিষিদ্ধ করে। এতে করে এই বই এর প্রচার ও প্রকাশনা গোপনে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এবং এই বই (ডেক্লারেশন) লেখার কারণেই লেখক আজ কারাগারে এই বিষয়টি পাঠকের মনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে।

জেল জীবন:
উচ্চ আদালত তার ১৪ বছরের সাজা কমিয়ে ১১ বছরে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এক ক্ষমার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দান করে। ৫ বছরের জেল জীবনে আলীয়া তার চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটান। তার আগের চিন্তাগুলোকে সংশোধন করে মজবুত যুক্তির উপর দাঁড় করান। তার যুক্তিভিত্তিক যে লেখনীর কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তিনি তার সেই যুক্তিকে শাণিত করে কারাগারে বসেই লিখেন তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ Islam between East and West। তার এক বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সব জায়গায় তার এই বইটিকে ছড়িয়ে দেন। আর তিনি আলীয়ার এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষিত মুসলিমদেরকে আলীয়ার দলে ভিড়াতে থাকেন। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে তার এই জেল জীবন তাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলে এবং তিনি সকলের মাঝে একজন স্কলার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর জনগণ তাকে একজন মহান নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বসনিয়া হেরসেক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেগবান করেন।

রাজনৈতিক জীবন:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ যখন জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘণ্টা বেজে গিয়েছিলো। যুগোস্লাভিয়াতে স্বাধীনতা সংগ্রাম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। অপরদিকে ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোও একে একে স্বাধীনতার দিকে আগাতে থাকে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাতে তার নেতৃত্বে Democratic Action Party (SDA) নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে এবং আলীয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথম বার নির্বাচন করেই তার দল সরকার গঠন করে এবং পার্লামেন্টে ৮৬টি আসন লাভ করে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম:
১৯৯০ দশকের দিকে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশন স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফেডারেশন এর ৬টি দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ১ মার্চ ১৯৯২ সালের এক রেফারেনডামের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কারণ শতকরা ৬২% জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সার্বিয়া বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা করে মুসলিম নিধনের নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একই ফেডারেশনের দেশ ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাধুবাদ জানালেও মুসলিমদের দেশ বসনিয়া হেরসেক- এর উপর সার্বিয়ার হামলাকে সাধুবাদ জানায়। বসনিয়া হেরসেক-এর দুর্দশায় নতুন মাত্রা যোগ করে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী দেশ যুগোস্লাভিয়া। তারা সার্বিয়ার এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানিয়ে তাদেরকে সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি ছাড়া এ সময় কোনো মুসলিম দেশ নির্যাতিত বসনিয়ান মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহর শত্রুপক্ষ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসনে তারা লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে তারা ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত বিভিন্ন স্থাপনা ও মসজিদসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতা খুব একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। কারণ একথা সত্য যে, বাতিলরা কখনো মুখের কথায় তাদের জুলুম বন্ধ করে না। তাদের জুলুমকে বন্ধ করার জন্য তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং তারা কেবলমাত্র শক্তিকেই ভয় করে। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজারে। সব মিলিয়ে ১ মিলিয়ন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময়ে বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ। এই ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি তার নেতৃত্বের অসীম গুণাবলী দ্বারা ও সাহসিকতার সাথে তার দেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তার জাতিকে একত্রিত করে সার্বিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

ডেটন চুক্তি:
বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলিমদের এই সংগ্রামে বিশ্বের মুসলিমগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুবকগণ বসনিয়ার মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সংগ্রাম ও জিহাদের পাশাপাশি বসনিয়ান মুসলিমদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। তিনি তুরস্ক থেকে হাজার হাজার যুবক পাঠান বসনিয় মুসলিম ভাইদের সাহায্য করার জন্য। তার সম্পদের বিশাল এক অংশ দিয়ে বসনিয়ায় গড়ে তুলেন অস্ত্রাগার। OIC-ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে বসনিয় মুসলিমদের সাহায্যার্থে ভঙ্গ করেন জাতিসংঘের সকল চুক্তিকে। ইরানকে সাথে নিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের। এরবাকান তৎকালীন তুরস্ক সরকারকে বাধ্য করেন বসনিয় মুসলিমদের সাহায্য করতে। আর এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্বিয়াকে তাদের এক তরফা সমর্থন দিতে থাকে। তারা সার্বিয়ার সাথে চুক্তি করার জন্য বসনিয়াকে চাপ দিতে থাকে। পরবর্তীতে আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কারণ তিনি তাতে রাজি না হলে এই অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র বসনিয়ানরা আরও হত্যার শিকার হতো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তিতে বসনিয়া পায় ৫১% ভূমি আর ক্রোয়েশিয়াকে দেওয়া হয় ৪৯% ভূমি। এবং বিভিন্ন অসম চুক্তিতে বসনিয়াকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।

মৃত্যু:
এই মহান মানুষটি ১৯ অক্টোবর ২০০৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান মহান মনিবের দরবারে।
Picture of আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ

আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ হলেন গোটা দুনিয়ার ইসলামী আন্দোলনের একজন মহান পুরুষ। বিংশ শতাব্দীতে জন্ম লাভ করা এই মহাপুরুষ দুনিয়াবাসীর সামনে পেশ করেছেন বিরল অনেক দৃষ্টান্ত। তিনি বসনিয়া হেরসেকের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, যার হাত ধরেই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মুক্তি পেয়েছিলো পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে। বিশ্ব মোড়লদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে অসম যুদ্ধে জয়ী হয়ে শত বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছিলেন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে।

জন্ম ও শৈশবকাল:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ১৯২৫ সালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় বস্নাকা ক্রুপা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পরিবার ছিলো ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষায় ঐতিহ্যমণ্ডিত একটি পরিবার। কিন্তু আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলাম বিরোধী একটি বৈরী পরিবেশ ও ইউরোপিয়ানদের দারা দখলকৃত একটি ভূমিতে বেড়ে উঠেন। সারায়েভোর একটি জার্মান স্কুলে তিনি তার মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। একজন মেধাবী ও সুশৃঙ্খল ছাত্র হিসেবে সবার কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। তিনি তার স্কুল জীবনেই পাশ্চাত্য ও ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য তার সহপাঠীদের কাছে ছিলেন অতি পরিচিত। সে সময়েই তিনি তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে মিলে গড়ে তুলেন মেলাদি মুসলমানি (মুসলিম যুবসংঘ) নামে একটি সংগঠন। এই সংগঠন কায়েমকালে তার বয়স ছিলো মাত্র ১৬ বছর। কিন্তু তার জ্ঞান এবং চিন্তার প্রখরতার কারণে সবার কাছেই ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ। আর এই কারণেই তার প্রতিষ্ঠিত এই ক্লাবটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ক্লাব না হয়ে পরিণত হয় সক্রিয় একটি সংগঠনে। যার ফলে এটি হয়ে ওঠে ছাত্রদের ক্যারিয়ার গঠন ও গঠনমূলক কাজের অন্যতম সূতিকাগার। অপরদিকে মেয়েদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা একটি সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংগঠনটি দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং বিভিন্ন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ এর প্রতিষ্ঠিত এই মুসলিম যুবসংঘটি যুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার এই যুগান্তকারী ভূমিকা তাকে ও তার সংগঠনকে সবার সামনে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে জার্মান সেনাবাহিনী বসনিয়াতে ১ লাখেরও বেশি মুসলমান হত্যা করে।

কম্যুনিস্ট শাসনের জুলুম-নির্যাতন:
১৯৪৬ সালের ১৩ জানুয়ারি বসনিয়া পুনরায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে। কিন্তু এই সংগ্রামে বামপন্থি নেতাদের আধিপত্য থাকায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বামপন্থিরা ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করে। বসনিয়া একটি স্বায়ত্ত শাসিত দেশ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এক চুক্তি অনুযায়ী যুগোশ্লাভিয়ার সাথে আরও ৬টি দেশ মিলে একটি স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে। বসনিয়া হয় এই ৬টি দেশের একটি।
কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ধর্মের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ ইসলামী আন্দোলনের নেতা হওয়ায় এবং নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকার কারণে কম্যুনিস্টদের টার্গেটে পরিণত হন। ১৯৪৯ সালে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। এবং তিনি একাধারে ৫ বছর বন্দি জীবন যাপন করেন।
১৯৫৩ সালে টিটু (Titu) ক্ষমতায় আসার পর আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের উপর জুলুম-নির্যাতন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তিনি এ সকল জুলুম- নির্যাতনের পরেও তার বিপ্লবী ভূমিকা অব্যাহত রেখে জনগণের মধ্যে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের কাজকে অব্যাহত রাখেন, চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটানোর কাজে রত থাকেন। এ সময়ে তিনি অন্য একটি ইসলামী দলের নেতা হাসান দুজুর সাথে মিলে তার কাজের গতি বৃদ্ধি করেন।
১৯৭৪ সালে টিটুর নতুন সংবিধান প্রবর্তনের পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসা নতুন করে উন্মুক্ত হয়। ইসলামী আন্দোলনের উপর জুলুম-নির্যাতন কমে আসায় অন্যান্য ইসলামী সংগঠনগুলোর উপর পরিমাণে স্বল্প হলেও জুলুম-নির্যাতন কমে আসে। ইসলামী সংগনগুলোর কাজের ফলে জনগণের মধ্যে ইসলামের একটি জাগরণ সৃষ্টি হয়।

টিটুর মৃত্যু ও আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ইসলামী মেনিফেস্টো (Islamic Menifesto):
১৯৮০ সালে টিটুর মৃত্যুর পর ফেডারেশন প্রেসিডেন্টের বিষয়ে একটি চুক্তি প্রস্তাবিত হয়। আর এটি হলো ৬টি স্বায়ত্ত শাসিত দেশের প্রেসিডেন্টগণ সবাই এক বছর করে ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই চুক্তির কারণে স্বল্প পরিসরে হলেও গণতন্ত্র ফিরে আসে। চুক্তির আলোকে সকলেই কাজ করার সুযোগ পায়। আর এ সময়েই আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের ছেলে তার পিতার বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধসমূহকে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে বই আকারে প্রকাশ করেন। ১৯৭০ সালে Islamic Declartion নামে একটি বই প্রকাশ হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে Islamic Menifesto নামে এই বই প্রকাশিত হওয়ায় আলীয়া ইউরোপের প্রাণ কেন্দ্রে রেডিকেল ইসলামের প্রবর্তন করতে চাচ্ছেন, এই অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচকে আদালতে নেওয়া হলে তিনি উচ্চস্বরে ঘোষণা করেন, আমাদের বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে বসনিয়া হেরসেককে একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরপর তারা তাকে এক অন্যায় আদেশের মাধ্যমে ১৪ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এবং তার বইকেও নিষিদ্ধ করে। এতে করে এই বই এর প্রচার ও প্রকাশনা গোপনে আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এবং এই বই (ডেক্লারেশন) লেখার কারণেই লেখক আজ কারাগারে এই বিষয়টি পাঠকের মনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে।

জেল জীবন:
উচ্চ আদালত তার ১৪ বছরের সাজা কমিয়ে ১১ বছরে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালে এক ক্ষমার মাধ্যমে তাকে মুক্তি দান করে। ৫ বছরের জেল জীবনে আলীয়া তার চিন্তার রাজ্যে বিপ্লব ঘটান। তার আগের চিন্তাগুলোকে সংশোধন করে মজবুত যুক্তির উপর দাঁড় করান। তার যুক্তিভিত্তিক যে লেখনীর কারণে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়, তিনি তার সেই যুক্তিকে শাণিত করে কারাগারে বসেই লিখেন তার ঐতিহাসিক গ্রন্থ Islam between East and West। তার এক বন্ধু অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে সব জায়গায় তার এই বইটিকে ছড়িয়ে দেন। আর তিনি আলীয়ার এই বইয়ের মাধ্যমে শিক্ষিত মুসলিমদেরকে আলীয়ার দলে ভিড়াতে থাকেন। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে তার এই জেল জীবন তাকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তুলে এবং তিনি সকলের মাঝে একজন স্কলার হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর জনগণ তাকে একজন মহান নেতা হিসাবে বরণ করে নেয়। তিনি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বসনিয়া হেরসেক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেগবান করেন।

রাজনৈতিক জীবন:
আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ যখন জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘণ্টা বেজে গিয়েছিলো। যুগোস্লাভিয়াতে স্বাধীনতা সংগ্রাম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলো। অপরদিকে ফেডারেল রাষ্ট্রগুলোও একে একে স্বাধীনতার দিকে আগাতে থাকে। আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাতে তার নেতৃত্বে Democratic Action Party (SDA) নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন এই দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে এবং আলীয়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথম বার নির্বাচন করেই তার দল সরকার গঠন করে এবং পার্লামেন্টে ৮৬টি আসন লাভ করে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম:
১৯৯০ দশকের দিকে যুগোশ্লাভিয়া ফেডারেশন স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ফেডারেশন এর ৬টি দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ১ মার্চ ১৯৯২ সালের এক রেফারেনডামের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কারণ শতকরা ৬২% জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সার্বিয়া বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় হামলা করে মুসলিম নিধনের নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা একই ফেডারেশনের দেশ ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাধুবাদ জানালেও মুসলিমদের দেশ বসনিয়া হেরসেক- এর উপর সার্বিয়ার হামলাকে সাধুবাদ জানায়। বসনিয়া হেরসেক-এর দুর্দশায় নতুন মাত্রা যোগ করে ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর অধিকারী দেশ যুগোস্লাভিয়া। তারা সার্বিয়ার এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন জানিয়ে তাদেরকে সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, কিছু সংগঠন ও ব্যক্তি ছাড়া এ সময় কোনো মুসলিম দেশ নির্যাতিত বসনিয়ান মুসলিমদের পাশে দাঁড়ায়নি। ফলে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার গুরুত্বপূর্ণ কিছু শহর শত্রুপক্ষ দখল করে নেয়। এই আগ্রাসনে তারা লক্ষ লক্ষ মুসলিমকে হত্যা করে এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে তারা ইসলামের ইতিহাস সম্বলিত বিভিন্ন স্থাপনা ও মসজিদসমূহকে জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বিভিন্ন মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যস্থতা খুব একটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারেনি। কারণ একথা সত্য যে, বাতিলরা কখনো মুখের কথায় তাদের জুলুম বন্ধ করে না। তাদের জুলুমকে বন্ধ করার জন্য তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতে হয় এবং তারা কেবলমাত্র শক্তিকেই ভয় করে। ১৯৯৪ সালের শেষ নাগাদ মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজারে। সব মিলিয়ে ১ মিলিয়ন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময়ে বসনিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ। এই ভয়াবহতার মধ্যেও তিনি তার নেতৃত্বের অসীম গুণাবলী দ্বারা ও সাহসিকতার সাথে তার দেশের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি তার জাতিকে একত্রিত করে সার্বিয়ার এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

ডেটন চুক্তি:
বসনিয়া হার্জেগোভিনার মুসলিমদের এই সংগ্রামে বিশ্বের মুসলিমগণ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের যুবকগণ বসনিয়ার মুসলিমদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সংগ্রাম ও জিহাদের পাশাপাশি বসনিয়ান মুসলিমদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করার বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলনের মহান নেতা প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান। তিনি তুরস্ক থেকে হাজার হাজার যুবক পাঠান বসনিয় মুসলিম ভাইদের সাহায্য করার জন্য। তার সম্পদের বিশাল এক অংশ দিয়ে বসনিয়ায় গড়ে তুলেন অস্ত্রাগার। OIC-ভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের নিয়ে বসনিয় মুসলিমদের সাহায্যার্থে ভঙ্গ করেন জাতিসংঘের সকল চুক্তিকে। ইরানকে সাথে নিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান নেতা আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচের। এরবাকান তৎকালীন তুরস্ক সরকারকে বাধ্য করেন বসনিয় মুসলিমদের সাহায্য করতে। আর এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সার্বিয়াকে তাদের এক তরফা সমর্থন দিতে থাকে। তারা সার্বিয়ার সাথে চুক্তি করার জন্য বসনিয়াকে চাপ দিতে থাকে। পরবর্তীতে আলীয়া ইজ্জেতবেগোভিচ তাদের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন। কারণ তিনি তাতে রাজি না হলে এই অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র বসনিয়ানরা আরও হত্যার শিকার হতো। অবশেষে ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। এই চুক্তিতে বসনিয়া পায় ৫১% ভূমি আর ক্রোয়েশিয়াকে দেওয়া হয় ৪৯% ভূমি। এবং বিভিন্ন অসম চুক্তিতে বসনিয়াকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।

মৃত্যু:
এই মহান মানুষটি ১৯ অক্টোবর ২০০৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে দুনিয়াবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান মহান মনিবের দরবারে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top