“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়
পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।”
সুকান্ত ভট্টাচার্যের চরণ দুখানির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। একটি চিত্রনাট্য তখনই শ্রেষ্ঠ হয় যখন তা সমাজের অসুখগুলোকে স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে সিনেমার পর্দায়। ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ সেরকমই এক চলচ্চিত্র যা তৎকালীন সময়ের অর্থনৈতিক ভঙ্গুর অবস্থা এবং অভাব-অনটনে ভুগতে থাকা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে তুলে ধরে। ক্ষুধার যন্ত্রণা কোনো আইন মানে না, চেনে না কোনো ধর্মজাতের হিসাবনিকাশ, মানুষকে টেনে নিয়ে আসে বাস্তবতার এক কঠিন কর্মযজ্ঞের দরজায়। কুসংস্কার, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা ও ক্ষমতাশীল ধনিক শ্রেণীর শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট এক নারীর জীবন সংগ্রামের অনবদ্য দলিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’।
বাংলা কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র আবু ইসহাক (১৯৩৬-২০০৩)। তিনি ঐ সকল লেখকদের একজন, যাদের রচনাসম্ভার সংখ্যার বিবেচনায় খুব বেশি না হলেও সৃজনীশক্তি এবং মননশীলতার গুণে মহিমান্বিত। তিনি মোট তিনটি উপন্যাস লিখেছিলেন, বলা হয় ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন কর্মী মসিহউদ্দিন শাকের এবং শেখ নিয়ামত আলী যৌথভাবে এই উপন্যাসকে চলচ্চিত্রে রূপ দেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশী চলচ্চিত্র ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।এই সিনেমা ১৯৭৯ সালের ৩০শে ডিসেম্বর মুক্তি পায় । সূর্য দীঘল বাড়ি স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে প্রথম সরকারি অনুদানে নির্মিত সিনেমা।
একটি স্বার্থক উপন্যাসের যেসকল বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, তার সবগুলোই আছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ সিনেমাতে। একেবারে সাধারণ ঘটনার বর্ণনা কিংবা প্রকৃতির একটি সাধারণ দৃশ্যকেও স্বার্থকভাবে উপস্থাপন করতে ভুল করেননি আবু ইসহাক।
গ্রাম্য বধূ জয়গুন। প্রথমপক্ষের পুত্র হাসু আর দ্বিতীয়পক্ষের কন্যা মায়মুনকে নিয়ে তার ঘর। প্রথম স্বামী জব্বার মুন্সী মারা যাওয়ার পর, করিম বকশ নামের এক বদমেজাজী কৃষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় আপন শিশুপুত্র কাসুকে রেখে কন্যা মায়মুনসহ জয়গুনকে তাড়িয়ে দেয় করিম। ক্ষুধার তাড়নায় স্বামী পরিত্যক্তা জয়গুন একটুখানি ভালো থাকার আশায় পাড়ি জমায় শহরে। কিন্তু শহুরে নির্মম বাস্তবতায় খানখান হয়ে যায় ভাগ্যদেবীর বরপ্রাপ্তির আশা। একদম নিঃস্ব হয়ে তাকে ফিরে আসতে হয় গ্রামে। কঙ্কালসার দেহ আর অপুষ্টিতে ভোগা সন্তানদের নিয়ে ভিটেমাটিহীন উদ্বাস্তু জয়গুন আশ্রয় নেয় গ্রামের পরিত্যক্ত অপয়া ভিটে ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’তে। গ্রামীণ লোকদের বিশ্বাসে সূর্যের উদয়াস্তের দিক, অর্থাৎ পূর্ব-পশ্চিম বিস্তারী সূর্যদীঘল বাড়িকে অপয়া মনে করা হয়। বলা হয়, বহু বাসিন্দার অপঘাত মৃত্যু, ভূত-প্রেতের উপদ্রবের সাক্ষী এ বিরান বাড়িতে বাস করলে নির্বংশ হতে হবে। কিন্তু ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ শ্রেণীর হতদরিদ্র মানুষের কি আর ভূতের ভয় করলে চলে? অসীম সাহসী জয়গুন তার ভ্রাতৃপত্নী, ভাতিজা এবং সন্তানদের নিয়ে সেখানে ঘর তোলে। শুরু হয় আত্মবিশ্বাসী জয়গুনের নতুন করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। পেটের তাগিদে পর্দা ঠেলে পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে চাল এনে আশেপাশের গ্রামে ব্যবসা শুরু করে সে। পাশাপাশি ধান ভানা,বাড়ির শাকসবজি বিক্রিসহ নানা কাজের মাধ্যমে চলে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
দারিদ্র্যের কষাঘাতে ছেলে-মেয়েরাও অল্প বয়সে অর্জন করে সংযম আর পরিশ্রমের শিক্ষা। হাসুর ছোট্ট কাঁধ মায়ের সাথে ভাগ করে নেয় জীবিকা নির্বাহের বোঝা, স্টেশনে, লঞ্চ-স্টিমার ঘাটে কুলিগিরি এবং অন্যান্য ছোটখাট কাজ করে সংসারের চাকা সচল রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করে সে। আর দশ বছরের শীর্ণকায় মায়মুন তার অপুষ্ট হাতে সামলায় ঘর-গৃহস্থলির কাজ। সমাজের শোষণ নিপীড়নকে পায়ে দলে অজ্ঞতা আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের হীন সমাজপতিদের তৈরি করা হীনতর নিয়ম ভেঙে এগিয়ে যায় জয়গুন।
দরিদ্র এবং নারী- এ দুই পরিচয় যেন তাকে প্রতিকারহীন শোষণের দুটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত করে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় রক্ষণশীল সমাজ। জয়গুনের স্বাধীন চলাফেরাকে মেনে নেয় না সমাজপতিরা। গ্রামের মোড়ল গদু প্রধানের লালসার দৃষ্টি পড়ে জয়গুনের উপর। তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে জয়গুণকে বিয়ে করতে চাইলে সে দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে গদু প্রধানকে। নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে জয়গুনের জীবিকার পথ বন্ধ করে তাকে বশে আনবার চেষ্টা করে সে।
একটা সময়, সন্তানকে সুস্থ করে দেওয়ার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ জয়গুনকে আবার বিয়ের প্রস্তাব দেয় প্রাক্তন স্বামী করিম বকশ। এতে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ভিটা থেকে জয়গুনদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করে গদু। সিনেমার শেষাংশে তার নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রে ভেঙে যায় কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে চলা গরিবের সংসার- প্রাণ যায় করিম বকশের, শেষ আশ্রয়টুকু ত্যাগ করে কেবল দূর্ভাগ্যকে পুঁজি করে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা করতে বাধ্য হয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ সমাজের নির্মম বলি জয়গুন ও তার পরিবার।
সিনেমায় দেখা যায়, জয়গুন তার নিজের পালিত হাঁসের ডিম, পুত্রকে দিয়ে মসজিদে দান করে, কিন্তু ইমাম সাহেব ‘হারাম’ আখ্যা দিয়ে তা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। কেননা ‘বেগানা-বেপর্দা’ জয়গুন অন্যের বাড়িতে ও ভিন্ন গ্রামে কাজ করে খায়। মেয়ের বিয়েতে তাকে এই মর্মে ‘তওবা’ করতে হয় যে, বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করা বাদ দিতে হবে। পরিবারের প্রধান আয়ক্ষম মানুষটির ঘরে হাতগুটিয়ে বসে থাকার দরুণ তীব্র অভাব, অনাহার দেখা গেলেও, খোদার প্রতি অটল শ্রদ্ধাশীল জয়গুণ তার তওবা ভঙ্গ করেনি।
এ অংশে সাধারণ মানুষের সরল ধর্মবিশ্বাস এবং ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার সাথে আমরা প্রত্যক্ষ করি আধিপত্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কী করে শোষণের কৌশল হিসেবে চিরকালের কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক প্রতিপত্তিকে অস্ত্র বানিয়ে রাখে। ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা জয়গুনকে তওবা করিয়ে চার দেয়ালে বন্দি করে রাখে, কিন্তু তার বাড়িতে একবেলা খাবারের ব্যবস্থাও করেনি, করেনি কোনো বিকল্প হালাল আয়ের ব্যবস্থা, কোন সামাজিক সহযোগিতা, এমনকি তার মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেয়ার পরও কেউ পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসেনি। উপরন্তু সমাজপতিদের কুদৃষ্টি পতিত হয় নিঃস্ব জয়গুনের ওপর। এর চূড়ান্ত কদাকার রূপ দেখি জয়গুন ও তার পরিবারকে ভিটেমাটি ছাড়া করার মধ্য দিয়ে।
কুসংস্কার এবং সামাজিক কূপমণ্ডুকতার এরূপ জীবন্ত চিত্র সমসাময়িক ‘জননী’, ‘লালসালু’ কিংবা ‘হাজার বছর ধরে’ সিনেমাগুলোর মতো ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’তেও সার্থকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যদিও অনেকেই এই চিত্রনাট্যগুলোকে ধর্মবিরোধী হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, মানুষের দুঃখ কষ্টকে পুঁজি করে নিজ স্বার্থের ধর্মীয়কৃত ব্যাখ্যায়ন নতুন কিছুনা। আবু ইসহাক, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহদের লেখায় সে চিত্রই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ এবং তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনীতির করুণ অবস্থা, দেশভাগ, নবগঠিত পাকিস্তান নিয়ে বাংলার মানুষের আশাভঙ্গ হওয়া, তৎকালীন পশ্চাৎপদ গ্রামীণ সমাজের কুসংস্কার, অভাব-অনটন, ধর্মভীরু সমাজে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার চাদরে আশ্রয় নিয়ে মোড়ল শ্রেণীর মানুষের অত্যাচার, দুর্নীতি, ষড়যন্ত্র, পুরুষতন্ত্রের নির্যাতন ও শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট গ্রামীণ বাংলাদেশের এক নারীর জীবন সংগ্রামের অনুপুঙ্খ ছবিতে চিত্রিত ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’।
এই কাহিনীর বিচিত্রতার মধ্যে মূল বিষয় একটিই; তা হচ্ছে কুসংস্কার, সম্পদ, ধর্ম, প্রতিপত্তি, সামাজিক বাধা-নিষেধ, এমনকি জাতীয়তাবোধ- এসব কিছুকে শ্রমজীবি মানুষের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা।
একটি সাধারণ আর্টকে কিভাবে সিনেমাতে কাজে লাগানো যায়, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার অভাব পুষিয়ে নেয়া যায়, পরিচালক তাঁর শক্তিশালী স্বাক্ষর রেখেছেন এ সিনেমায়। সিনেমার দৃশ্যধারণে জয়নুল আবেদীনের “চিত্রকলাকে” সিনেমার অংশে পরিণত করে, দুর্ভিক্ষের যে সার্থক চিত্রায়ন, তা অবশ্যই পরিচালকের অসাধারণত্বের জায়গা। নিতান্তই সাধারণ কিছু উপাদান ব্যবহার করে, সীমাবদ্ধতাগুলোকে উৎরে গিয়েছেন পরিচালক, যা সিনেমাটির অনন্যতার অন্যতম ক্ষেত্র।
একইসাথে পরিবেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ গ্রামীণ ভাষার ব্যবহার, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসহ সবকিছুতেই গ্রামীণ আবহ সিনেমাটিকে বিশেষায়িত করেছে। সমালোচকেরা সিনেমাটির বাস্তববাদীতার অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে দেখেছেন এটিকে।
সিনেমার শেষভাগে দগ্ধগৃহ পেছনে ফেলে বাস্তুহারা মানুষের গৃহত্যাগের দৃশ্য দেখানো হয়েছে। নতুন বাড়ির খোঁজে তাদের এই যাত্রা বাঁচার জন্য মানুষের অব্যাহত জীবন-সংগ্রামের ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এই বোধটিকে দর্শকের চিত্তে ভালোভাবে গেঁথে দেওয়ার জন্য দরকার ছিল আরেকটু সময়, আরেকটু স্পেসের। এই দৃশ্য বড় সংক্ষিপ্ত, ফলে অস্পষ্টতাটা স্পষ্ট। গোটা সিনেমাতে মানুষের ব্যক্তিগত ও সংঘবদ্ধ জীবনযাপনের যে সংগ্রাম, অপমান, পরাজয় দেখি, আকস্মিকভাবে তার সমাপ্তি ঘটায় বিষয়টি দর্শকদের চেতনায় দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে পারে না। চিরকালের একটি মহৎ শিল্পকর্ম ঋত্বিক ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমাতে দেখা যায়, নদীর বুক রুদ্ধ হওয়ায় একটি গোটা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেও মানুষের অব্যাহত জীবনযাত্রার সংগ্রামমুখরতার কথা ঘোষিত হয় একটি নারীর বাঁশি বাজানো ও শিশুকে স্বপ্নে দেখার মধ্যে। দৃশ্যটি দর্শকের চেতনাকে ব্যথায়, বেদনায়, ক্ষোভে এবং একইসঙ্গে আশায় পরিপূর্ণ করে তোলে। তার সমস্ত অগোছালো উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে একটি সুসংহত আবেগে এবং দর্শক আগের চেয়ে পরিণত মানুষে রূপান্তরিত হন। কিন্তু ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ সিনেমাটি দর্শকের মধ্যে এরকম কোনো আবেগসঞ্চার করতে পারেনি।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অভিঘাত আমাদের সমাজ জীবনে কি পরিমাণ স্পষ্ট ছাপ রেখে গেছে, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’তে সে চিত্র স্পষ্ট। জয়গুন, আর তাঁর সংগ্রামকে শুধুমাত্র একজন স্বামীহীনা গ্রাম্য বধূর সংগ্রাম, কিংবা একজন নারীর একক পথচলা হিসেবে দেখলে সম্ভবত একে খণ্ডিত ও এককেন্দ্রিক হিসেবে দেখা হবে। একে দেখতে হবে, ব্রিটিশ শোষণের ফলে সৃষ্ট মন্বন্তর ও তৎপরবর্তী ভয়াবহ অবস্থায় একজন সহায় সম্বলহীন মানুষের জীবনসংগ্রাম হিসেবে।
ব্রিটিশ শোষণকে যারা জায়েজীকরণ করতে চান, পরোক্ষভাবে হলেও ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবাদ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জুলুমকে অনেকেই ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’র সংলাপ ধারণা, তাদের চিন্তাভঙ্গিতে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনবে, এ প্রত্যাশা অবান্তর হবেনা।
ইবনে বতুতা আর হিউয়েন সাঙদের পরখ করা বাংলা, যেখানে দরিদ্র-অনাহারী খুঁজে পাওয়া রীতিমত দুরূহ ছিলো, আদালত, জ্ঞান আর অর্থনৈতিক দিক থেকে যে অঞ্চলে অবস্থান করতো সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ চূড়ায়, সে অঞ্চলেই মানুষ ক্ষুধা, অনাহার, জুলুম আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়ছে, একজন সার্থক শিল্পী হিসেবে কলমে আবু ইসহাক, আর ক্যামেরায় মসিহউদ্দীন শাকের এবং শেখ নিয়ামত আলী তাঁর নকশা একেছেন সার্থকভাবেই।
সিনেমাতে জয়গুন চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেছেন ডলি আনোয়ার (ইব্রাহিম)। করিম বকশ চরিত্রে ছিলেন কেরামত মাওলা। গদু প্রধানের চরিত্রে অভিনয় করেন জহিরুল হক। ভায়ের স্ত্রী শফির মা চরিত্রে ছিলেন রওশন জামিল। ফকির চরিত্রে ছিলেন এটিএম শামসুজ্জামান। আরো অভিনয় করেন আরিফুল হক, ইলোরা গহর, হাসান ইমাম, ফখরুল হাসান বৈরাগী, নাজমুল হুদা বাচ্চু, লেনিন প্রমুখ।। সিনেমাটির প্রযোজক ছিলেন মসিহউদ্দিন শাকের। সংলাপও তার তৈরি। সংগীত পরিচালক ছিলেন আলাউদ্দিন আলী।
সিনেমাটি সমালোচকদের প্রশংসায় সিক্ত হয়। ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। শেখ নিয়ামত আলী শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করেন। অনবদ্য অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ডলি আনোয়ার। ১৯৮০ সালে সিনেমাটি জার্মানির ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে তিনটি পুরস্কার লাভ করে। পর্তুগালের ফিগুয়েরা দ্য ফোজ চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নিয়ে অর্জন করে আরও একটি পুরস্কার। সিনেমাটি ডন কিহটে পুরস্কারও পায়। বাংলাদেশ সিনে জার্নাল অ্যাসোসিয়েশন ছয়টি বিভাগে সিনেমাটিকে পুরস্কৃত করে।
সিনেমাটির মন্তাজ ছিলো অসাধারণ। দৃশ্য ধারণ, অভিনয়, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, পরিচালনা আর সংলাপের শক্তির জোরে সিনেমাটি স্থান করে নিয়েছে ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের কাতারে।
‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে বহুবছর আগে কিন্তু এতবছর পরে এসেও ক্ষুধা, শোষণ, নির্যাতন থেকে মুক্তি পায়নি বাংলার সাধারণ মানুষ। প্রশ্নে জর্জরিত করা যায় পুরো ইতিহাসটাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কেউ কি বলতে পারবে, কবে নিরসন হবে এই দরিদ্র্যতার? এখনও এ দেশে ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে অন্নবস্ত্র-সহায়-সম্বলহীন হতদরিদ্র মানুষেরা। ‘শোষণের মঞ্চে জীবনের জয়গান’ ছিলো এ সিনেমাটির মূল প্রতিপাদ্য, যার ফলে সময়ের অবগাহনেও ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ – চিত্রনাট্যটির আবেদন ফুরিয়ে যায়নি আজও।