দিল্লির সালতানাত চলেছিল ১১৮৬ থেকে ১৫২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। কিন্তু দিল্লির সালতানাত এতদিন টিকলেও তা ভেঙে একাধিক অঞ্চলে সৃষ্টি হতে পেরেছিল আরও কয়েকটি বিভিন্ন স্বাধীন সালতানাত। এদের মধ্যে বাংলা, মালব, গুজরাট ও কাশ্মির হলো উল্লেখ্য। এদের মধ্যে আবার বাংলার সালতানাত (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.) হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। আজকের বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য বুঝতে হলে স্বাধীন সুলতানী আমলের ইতিহাসকে নিতে হয় বিশেষ বিবেচনায়। কারণ, এ সময় বাংলার একটি নিজস্ব স্থাপত্যরীতির উদ্ভব ঘটে। ঘটে বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিশেষ বিকাশ। সুলতানী আমলের আগের কোনো প্রকৃত বাংলাভাষার পুঁথি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। এর একটি কারণ হলো বাংলাদেশের হিন্দুরা বাংলা ভাষার চর্চা সেভাবে করতেন না। করতেন সংস্কৃত ভাষার চর্চা। সংস্কৃততেই তাই সাহিত্য রচিত হতো; বাংলাভাষায় নয়। কৃত্তিবাস প্রথম সংস্কৃত রামায়ণ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। এজন্য তাঁকে গোড়া হিন্দুদের কোপানলে পড়তে হয়। তারা চান কৃত্তিবাসকে হত্যা করতে। কিন্তু সুলতান রোকন-উদ-দীন বারবাক শাহ বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন কৃত্তিবাসের জন্য। রোকন-উদ-দীন বারবাক শাহ ২১ বছর রাজত্ব করেছিলেন (১৪৫৫-১৪৭৬ খ্রি.)। এ সময়ের মধ্যে কৃত্তিবাস সংস্কৃত থেকে বাংলায় রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন বলে ধরা হয়।
সুলতানী আমল
সুলতানী আমলে বাংলার শাসনব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট মজবুত। দেশে ছিল মোটামুটিভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা। আর তাই ঘটতে পেরেছিল আর্থ-সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি। উর্বর ভূমি ছিল বাংলার সম্পদ। এখানে সহজেই কৃষিকাজ করা যেত। প্রচুর ধান উৎপাদন করা যেত অনেক সহজেই। সুলতানী আমলে আখের চাষ হতো। আখের রস থেকে প্রস্তুত হতো গুড় ও চিনি। যা বিদেশে রফতানি হতো। বাংলাদেশে তৈরি হতো বড় বড় সমুদ্রগামী কাঠের নৌকা এবং জাহাজ। যাতে করে বাংলাদেশ থেকে মানুষ যেতে পারত অনেক দূরদেশে সওদা নিয়ে বাণিজ্য করতে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল সওদাগরের দেশ। বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে রেশম উৎপন্ন হতো। রেশমী বস্ত্র বিক্রি হতো বিদেশি বাজারে। সুলতানী আমলে এক পর্যায়ে চীন থেকে এসেছিলেন মা হুয়াং নামে একজন চীনা মুসলিম পর্যটক। তিনি তার ভ্রমণ কাহিনীতে লিখেছেন যে, রেশম উৎপাদনের জন্য এদেশে যত্ন করে তুতগাছ লাগানো হয়।
বাংলাদেশের রাজ্য ব্যবস্থায় সুলতানের ছেলে সাধারণত সুলতান হতেন। কিন্তু কাউকে সুলতান হতে গেলে প্রয়োজন হতো আমির ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সমর্থন। তাদের সমর্থন ছাড়া কেউ সুলতান হতে পারতেন না। সুলতানের ছেলে না হয়েও বাংলাদেশে সুলতান হবার দৃষ্টান্ত আছে। বাংলার বিখ্যাত সুলতান আলা-উদ-দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৮খ্রি.) ছিলেন উচ্চ রাজকর্মচারী কর্তৃক নির্বাচিত সুলতান। তিনি সুলতানের পুত্র হিসেবে সুলতান হননি। তার পুত্র নাসির-উদ-দীন নূসরত শাহ (১৫১৮-১৫৩২ খ্রি.) সুলতান হবার সময় উচ্চ রাজকর্মচারীদের সাধারণ অনুমোদন লেগেছিল। অর্থাৎ সুলতানী আমলের বাংলায় এক ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা অনুসরণ করা হতো। কাউকে সুলতান হতে গেলে লাগতো সে সময়ের উচ্চ রাজকর্মচারীদের অনুমোদন বা ভোট। সুলতানী আমল একেবারেই স্বেচ্ছাতন্ত্র বা স্বৈরশাসন ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সুলতানের মৃত্যু হবার আগে তাঁর জ্যৈষ্ঠ পুত্র তাঁর সঙ্গে সহসুলতান হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করছেন। এভাবে বাংলায় একজন সুলতান চাইতেন তার পুত্রকে রাজ্য পরিচালনায় দক্ষ করে যেতে।
সুলতানী আমলে সেনাবাহিনী ছিল চার ভাগে বিভক্ত: অশ্বারহী, গজারহী, পদাতিক এবং নৌবহর। পদাতিক সৈন্যদের বলা হতো ‘পাইক’। দশজন অশ্বারহী নিয়ে একটি করে দল গঠিত হতো। যাকে বলা হতো ‘খেল’। খেলের নায়ককে বলা হতো ‘সর-ই-খেল’। বাংলার নৌবহরের অধিনায়ককে বলা হতো ‘মির বহর’। বাংলার গজবাহিনী খুব বিখ্যাত ছিল। বাংলার সৈন্যরা নিয়মিত বেতন পেতেন। সৈন্যবাহিনীর বেতনদাতার উপাধি ছিল ‘উজির-ই-লস্কর’। বাংলার সৈন্যরা অনেক আগেই পর্তুগিজদের কাছ থেকে কামান চালাতে শিখেছিলেন। তারা বাবরের সাথে যুদ্ধের সময় কামান ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়। বাবর বাংলা জয় করতে পারেননি। নূসরত শাহ’র সঙ্গে সম্মানজনক সন্ধি করেছিলেন। বাবর তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীতে নূসরত শাহ’র খুব প্রশংসা করেছেন। নূসরত শাহ’র ছিল ১৮ টি পুত্র সন্তান। নূসরত শাহ তার প্রত্যেকটি ভাইকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বাবর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, এরকম ভাতৃপ্রেম রাজাদের মধ্যে দেখা যায় না। বাবরের অন্যতম পূর্বপুরুষ তৈমুর লং বলেছেন, রাজাদের কোনো বন্ধু থাকে না। রাজাদের একমাত্র সম্বল তাঁদের নিজ বাহুবল। বাবরও এরকম নীতিতেই ছিলেন আস্থাবান। বাবর নূসরত শাহকে বলেছেন, “বাঙালি”। এর আগে কোন সুলতানের নামের পরে কেউ বাঙালি কথাটা যোগ করেননি।
খাজনা আদায়ের অঞ্চলকে বলা হতো মহল। কয়েকটি মহল নিয়ে গঠিত হত একটি শিক। শিকের কর্তাকে বলা হতো শিকদার। এ থেকেই বাংলা ভাষায় শিকদার উপাধির উদ্ভব হতে পেরেছে। যা এখনও চলে আসছে (যেমন শিরাজ শিকদার, দেবেন শিকদার)। সুলতানী আমলে অনেক মহল ছিল। সুলতানী আমলে ঘটেছিল বেশকিছুটা নগর বিপ্লব। গড়ে উঠেছিল শহর। দুর্গযুক্ত শহরকে বলা হতো ‘খিটাহ্’। আর দুর্গবিহীন শহরকে বলা হতো ‘কসবাহ্’। সীমান্ত ঘাঁটি শহরকে বলা হতো থানা।
সুলতানী আমলে বহু হিন্দু উচ্চ রাজ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতা ছিল বিশেষ মাপকাঠি। অনেক হিন্দু চাকরি করেছেন মুসলমান রাজকর্মচারীর উপরে। করেছেন তাদের নিয়ন্ত্রিত। সুলতানী আমলে ধর্মীয় গোঁড়ামি সেভাবে ছিল না। বহু প্রমাণ আমরা পেতে পারি তাঁর এ সময়ের ইতিহাস অনুশীলন করলে। হিন্দুরা সুলতানী আমলে দুর্গাপূজা করতে পারতেন অবাধে। তাদের দুর্গাপূজায় কোনো বাধা ছিল না। আসলে দুর্গাপুজার উদ্ভব হয়েছে সুলতানী শাসনামলে, বর্তমান রাজশাহী জেলার তাহেরপুর নামক স্থানে। গৌড়ের সুলতানের এক সামন্ত রাজা কংস নারায়ণ প্রথম, এখন যেভাবে দুর্গাপুজা হয়, প্রচুর অর্থ ব্যয়ে তা প্রবর্তন করেন। তাঁর প্রবর্তিত দুর্গাপুজার রীতি এখনও চলে আসছে। বাংলায় যেভাবে দুর্গাপুজা হয়, অন্যত্র সেভাবে হয় না। কংস নারায়ণ অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা তাঁকে বলেন, যেহেতু তিনি সামন্ত রাজা তাই তিনি অশ্বমেধযজ্ঞ করবার অধিকারী নন।
বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় গোড়ামি সেভাবে না থাকলেও, তারা হিন্দু রাজার অধীনে থাকতে চাননি। গণেশ ছিলেন একজন আমির। তিনি পরে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন। কিন্তু মুসলমানরা তাঁর অধীনে থাকতে চাননি। গণেশের পুত্র যদু, ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং হন সুলতান জালাল- উদ-দীন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৪-১৪৩১ খ্রি.)। তিনি ছিলেন খুবই শক্তিশালী সুলতান। আরাকানের (রাখাইন) এক রাজা (মেং সোআন) মধ্যব্রহ্মের (মিয়ানমার) রাজার কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসে জালালউদ্দিন-এর কাছে আশ্রয় নেন। জালাল-উদ-দীন তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। তিনি দখল করতে পারেন আরাকান। আরাকানের এই রাজা কৃতজ্ঞতাবশে হন জালাল-উদ-দীনের সামন্ত। যেসব সৈন্যরা এসময় গৌড় থেকে গিয়ে আরাকানে বসতি স্থাপন করেন, তাদের বংশধরকে বলা হয় রোহিঙ্গা। কারণ এসময় আরাকানের রাজধানী ছিল রোহং। বাংলা ভাষায় একসময় আরাকানকে বলা হতো রোসাঙ্গ। রোহং থেকেই হতে পেরেছিল রোসাঙ্গ নামের উদ্ভব।
বাদশাহী আমল
বাংলায় যার আরম্ভ হতে পারে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এবং যা চলেছিল বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হওয়া পর্যন্ত, তা বাংলার মানুষের কাছে কখনই খুব প্রিয় ছিল না। মোগল শাসনকে বাংলার মানুষের কাছে মোটামুটি মনে হয়েছে বিদেশি শাসন। বাংলায় এবং বিহারে আকবরের ধর্মীয় উদারতার বিপক্ষে হয়েছে প্রতিবাদ। পরে বাংলাদেশে আবির্ভাব হয়েছে বারো ভূঁইয়ার। যারা মানতে চাননি মোগল শাসনকে। এরা অনেকেই পেয়েছেন জনসমর্থন। মোগল আমলে বাংলা শাসিত হয়েছে দিল্লি থেকে। মোগল শাসনব্যবস্থায় সুবে বাংলার মানুষ বিশেষ কেউ পায়নি উচ্চ সরকারি পদ। কেউ পায়নি ১০০০ সৈন্যর বেশি সৈন্য পরিচালনার ভার। যে দুই একজন ১০০০ সৈন্য পরিচালনার ভার পেতেন তাদের বলা হত হাজারি। বাংলায় হাজারি ছিলেন হাতে গোনা। মোগল আমলে বাংলাদেশে ফারসি ভাষার প্রভাব আগের তুলনায় বেশি বাড়ে। শাহজাহানের পুত্র শাহজাদা সুজা প্রায় ২১ বছর (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রি.) বাংলার সুবেদার ছিলেন। এ সময় বাংলা ভাষা সাহিত্যের ওপর পড়তে পারে ফারসি সাহিত্যের বর্ধিত প্রভাব। এ সময়ের কবি আলাওল ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ কারেন ‘সিকান্দার নামা’ ও ‘হস্ত পয়কর’। সুলতানী আমলেও সরকারি ভাষা হিসেবে ফারসিই চলত। বাংলার বিখ্যাত সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ ইরানের বিখ্যাত কবি হাফিজকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার রাজসভায় অতিথি হতে। হাফিজ তাকে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন। দুঃখ করেছিলেন আসতে না পারবার জন্য। মোগল শাসনের আগেও এদেশে ফারসি ভাষা সাহিত্যের কদর ছিল। কিন্তু শাহজাদা সুজার সময় ফারসি ভাষার কদর হতে পেরেছিল আরও বেশি। সরকারি ভাষা ফারসি হবার জন্যে হিন্দুরাও ফারসি শিখতেন। কিন্তু তাদের ওপর ফারসি ভাষার প্রভাব মুসলমানদের মতো পড়েনি। কারণ, হিন্দুরা ধর্ম চর্চা করেছেন সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে। কিন্তু বাংলার মুসলমানরা তাদের ধর্ম চর্চাও করেছেন প্রধানত ফারসি ভাষার মাধ্যমে। একসময় আল্লাহর চাইতে খোদা শব্দটির প্রচলন বাংলার মুসলমান সমাজে ছিল বেশি। আমরা বলেছি, নামজ, বেহেস্ত, দোজখ শব্দগুলো আরবি ভাষার নয়। এই শব্দগুলো বাংলা ভাষায় এসেছে ফারসি ভাষা থেকে। দরবেশ শব্দটিও ফারসি ভাষার। সুলতান শব্দটি আরবি। শব্দগত অর্থে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সুলতানরা সকলেই বাগদাদের খলিফাকে মানতেন। তারা বলতেন, তারা ক্ষমতা লাভ করেছেন বাগদাদের খলিফার সম্মতির মাধ্যমে। দিল্লি এবং বাংলার অনেক সুলতানের মুদ্রায় তাই সুলতানের নামের সঙ্গে মুদ্রিত থাকতে দেখা যায় বাগদাদের খলিফার নাম। কিন্তু মোগল বাদশারা খলিফা মানতেন না। তারা বলতেন, সব ক্ষমতার শেষ উৎস হচ্ছেন আল্লাহ। যিনি বাদশা হন তিনি সেটা হতে পারেন আল্লাহর সম্মতিতে। বাদশা বহন করেন আল্লাহর ছায়া। মোগল বাদশারা তাদের এই ধারণাটি অবশ্য লাভ করেছিলেন ইরানের প্রাচীন রাষ্ট্রচিন্তা থেকে।
মোগল আমলের প্রায় শেষভাগে বাংলার দেওয়ান হয়ে আসেন মুর্শিদকুলী খাঁ। মুর্শিদকুলী খাঁর জীবন ইতিহাস খুবই বিচিত্র। তিনি জন্মেছিলেন এক তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে। তাকে ক্রয় করেন একজন শিয়া মুসলিম ইরানী সওদাগর। এবং নিয়ে যান ইরানে। তিনি তাকে মানুষ করেন নিজের পুত্র সন্তানের মতো। মুর্শিদকুলী খাঁ ইরানে লেখাপড়া শিখে মোগল দরবারে আসেন চাকরির খোঁজে। তিনি উচ্চ সরকারি পদ পান তার দক্ষতার গুণে। এক পর্যায়ে বাদশা আওরঙ্গজেব তাকে বাংলায় পাঠান দেওয়ান হিসেবে (১৭০১ খ্রি.)। আওরঙ্গজেব মারা যান ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে। মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলায় দেওয়ান হয়ে এসে তিনি বেশকিছু সংখ্যক হিন্দু ব্রাহ্মণকে প্রদান করেন খাজনা আদায়ের অধিকার। যারা পরে হয়ে ওঠেন জমিদার। সাধারণত মনে করা হয়, ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দুরা বাংলায় হয়ে উঠতে থাকেন জমিদার। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। মুর্শিদকুলী খাঁর আমল থেকেই উদ্ভব হতে শুরু করে হিন্দু জমিদারদের। হিন্দু জমিদারদের সেরেস্তায় কাজ করতেন অনেক হিন্দু কর্মচারী। যাদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠে একটি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এদের সঙ্গে পরে বিবাদ বাধে বাংলার মুসলিম কৃষক প্রজাদের (রায়ত)। কেবল অর্থনৈতিক কারণে নয়, ধর্মীয় কারণেও ঘটেছিল বিরোধ। ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু জমিদাররা মুসলমান প্রজাদের বাধ্য করতেন দুর্গাপুজার চাঁদা দিতে। যেটা দিতে চান না মুসলমান প্রজারা (রায়ত)। এই বিরোধ খুব প্রবল হয়ে ওঠে ফরায়েজি আন্দোলনের সময়।
মোগল ও পাঠান
পাঠান বলতে বোঝাত পশতু ভাষাভাষী মানুষকে। পাঠান ও আফগান শব্দ দুটি সমার্থক। বাংলাদেশে আফগান বংশের একাধিক রাজা রাজত্ব করেছেন। এদের মধ্যে শেরশাহ্ শুর ও দাউদ করানী (করলানী) বিশেষভাবে খ্যাত হয়ে আছে। বাংলাদেশে মোগল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সময় নেয়। এদেশের বড় বড় ভূস্বামী বা ভূঁইয়ারা মোগল শাসন মানতে চাননি। এই সমস্ত ভূঁইয়াদের অনেকেই নিজেদের দাবি করতেন পাঠন বংশোদ্ভূত হিসেবে। যেমন ইশা খাঁ, মুসা খাঁ, বাহাদুর গাজী প্রমুখ। মোগল শাসনকে বাংলার মানুষের কাছে মনে হয়েছে বিদেশি আগ্রাসন। বার ভূঁইয়ারা মোগল শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাই পেয়েছেন বিশেষ সমর্থন। অনেকে মনে করেন, দূর সীমান্ত প্রদেশের সঙ্গে (বর্তমানে পাখতুনিয়া) বাংলার মানুষের সম্পর্ক কতটুকু।
কিন্তু একসময় বাংলাদেশের মুসলমানদের একটা বড় অংশ নিজেদের ভেবেছেন পাঠান হিসেবে; মোগল হিসাবে নয়। আমার আত্মপরিচয়ের সন্ধানে একথাটিও মনে রাখতে হবে।