সুলতান আকবর এবং দীন-ই-এলাহী

সুলতানের ধর্মমত

এতে কোন সন্দেহ নাই যে, আকবর সকল ধর্মের প্রতি উদার ছিলেন। আকবর ছিলেন নবযুগের স্রষ্টা, আবার তিনি নিজেই যুগের সৃষ্টি। আকবরের উদার মনোভাব ষোল শতকের উদার চিন্তাধারার প্রতীক, ঐ শতকে মানুষ অন্ধ বিশ্বাস পরিত্যাগ করে অনুসন্ধান এবং যুক্তির যুগে প্রবেশ করে। মোগল সাম্রাজ্য স্থাপিত হওয়ার আগে ভারতে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়, কবীর, নানক, রামানন্দ, চৈতন্য প্রমুখ ধর্ম সংস্কারকেরা হিন্দুদের বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং জাতিভেদের কথা ভুলে এক ঈশ্বর উপাসনার উপদেশ দেন। আকবর হয়তঃ তাঁদের শিক্ষায় প্রভাবান্বিত হন, এবং হিন্দু মুসলমান ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের ভেদাভেদ তুলে দিয়ে সকলের সমবেত প্রচেষ্টায় শক্তিশালী মোগল সাম্রাজ্য স্থাপনে সচেষ্ট হন। এই রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও তিনি হয়ত ধর্ম সম্পর্কে জানার চেষ্টায় থাকতেন। তিনি প্রায়ই সকাল বেলা ফতেহপুর সিক্রিতে একখানা পাথরের উপরে বসে ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দেখে তিনি ব্যথিত হতেন। মুসলমানদের মধ্যে সুন্নী, শিয়া, মাহদভী এবং সূফী মতবাদের তর্ক বিতর্ক তাঁকে পীড়া দিত। এই সকল মতবাদের বিভেদ দূর করার বিষয়ে তিনি চিন্তা করতেন এবং সকলকে সমঝোতায় আনার কথা ভাবতেন।

 

জন্ম শয়খ মোবারকের প্রভাব

আকবরের জন্ম হয় একটি উদার পরিবারে, তাঁর পিতা-মাতা উভয়েই উদার মতাবলম্বী ছিলেন, তাঁরা কেউ ধর্মবিষয়ে গোঁড়া ছিলেননা। তাঁর মা হামিদা বানু বেগম বাল্যকাল থেকে তাঁর মনে ধর্ম বিষয়ে উদারতার বীজ বপন করেন। আকবরের গৃহশিক্ষক আবদুল লতীফ ছিলেন একজন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা লোক, তিনিও ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি উদার, তিনি আকবরকে উদারনীতি শিক্ষা দেন। বয়স বাড়লে আকবর রাজপুতদের সংস্পর্শে আসেন এবং রাজপুত রমণী বিয়ে করেন। হিন্দু মেয়ে বিয়ে করায় আকবরের মনে চিন্তায় বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। আকবর সুন্নী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, অতএব তিনি নিজেও ছিলেন সুন্নী, এই সুন্নী পরিবারেই হিন্দু মহিলারা প্রাসাদে পূজা অর্চনা করেন।

ক্রমে ক্রমে আকবর রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে যেমন, ধর্মীয় ব্যাপারেও তেমন স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে আরম্ভ করেন। ধর্মীয় ব্যাপারে তিনি শয়খ মোবারক এবং তাঁর দুই ছেলে শয়খ আবুল ফজল এবং শয়খ ফৈজীর দ্বারা প্রভাবিত হন। শয়খ মোবারক নিজেই সুপণ্ডিত ছিলেন, আবুল ফজল ঐতিহাসিক এবং ফৈজী কবি ছিলেন, কিন্তু ধর্ম বিষয়ে তাঁদের প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য ছিল। তাঁরা সকলেই সূফী ছিলেন এবং তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে প্রচলিত ধর্মসমূহ সত্য অনুসন্ধানের বিভিন্ন রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁরা সকল ধর্মের সার বস্তুর উপর জোর দিতেন, কোন ধর্মের বাহ্যিক রূপ ছিল তাঁদের কাছে গৌণ।

শয়খ মোবারক ও তাঁর পুত্রদ্বয়ের এই মতবাদ ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, কারণ ইসলামে ঈমান ও আমল অর্থাৎ বিশ্বাস ও কর্ম উভয়ের সমান গুরুত্ব। তাঁদের সংস্পর্শে এসে আকবরের চিন্তা জগতে আলোড়নের সৃষ্টি হয়, তিনি ক্রমে ক্রমে তাঁদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। আকবরও চিন্তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং চিন্তার স্বাধীনতাকে আধ্যাত্মিক মুক্তির প্রধান ধাপ হিসেবে গণ্য করতেন। দিল্লীর শয়খ তাজ-উদ-দীনকে আকবর অত্যন্ত ভক্তি করতেন, কিন্তু শয়খ তাজ-উদ-দীনও শয়খ মোবারক ও তার পুত্রদ্বয়ের চিন্তাধারার সঙ্গে একমত ছিলেন। অতএব আকবর ক্রমে ক্রমে শয়খ মোবারক, আবুল ফজল ও ফৈজীর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁদের চিন্তাধারাকে গ্রহণ করেন।

 

ইবাদত খানা নির্মাণ: ধর্ম বিষয়ে আলোচনা

আকবর চিন্তা করেন যে সকল ধর্মের প্রতি তাঁর পরিচিত হওয়া দরকার, তাই তিনি সকল ধর্মের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার ইচ্ছা করেন, অর্থাৎ আকবর সত্যানুসন্ধানে লিপ্ত হন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধর্মের নেতৃবৃন্দকে আহবান করে স্ব স্ব ধর্ম বিষয়ে আলোচনার অনুরোধ করেন। মুসলমানদের মধ্যে শয়খ-সূফী-সৈয়দ এবং অন্যান্য পণ্ডিতবর্গ উপস্থিত থাকতেন; মখদুম-উল-মুলক আব-দুল্লাহ সুলতানপুরী এবং শয়খ আবদুন নবী, তৎকালে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন এবং মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দিতেন। শয়খ মোবারক তাঁর দুই পুত্র সহ উপস্থিত থাকতেন। ব্রাহ্মণ, জৈন, পারসিক, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের নেতৃবৃন্দকেও আহ্বান জানানো হয় এবং তাঁরাও সেখানে আলোচনা করেন। আকবর অত্যন্ত মনযোগের সঙ্গে প্রত্যক ধর্মের পণ্ডিতদের আলোচনা শুনেন, তিনি অশিক্ষিত হলেও তাঁর প্রখর বুদ্ধি এবং অতুলনীয় স্মরণ শক্তি ছিল। ইবাদতখানায় তীব্র প্রতিযোগিতামূলক আলোচনা শুরু হয়, প্রত্যেক মতবাদের পণ্ডিতরা নিজ নিজ মতবাদকে সংস্থাপিত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সঙ্গে সঙ্গে বিরুদ্ধ মতবাদকে খণ্ডন করত। আলোচনা অবশেষে ব্যক্তিগত আক্রোশে পরিণত হয় এবং ইবাদতখানা বাক-যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

আকবর সকল ধর্মের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে উদার ও অমায়িক ব্যবহার করেন, কেউ বুঝতে পারেনা সম্রাট নিজে কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সকলেই মনে করে যে সম্রাট তাঁদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, অথচ সম্রাটের নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেন, কারো ধর্ম গ্রহণ করেননি। দু’একজন জৈন গুরু সর্বদা সম্রাটের দরবারে থাকতেন; সম্রাট সর্বদা রাজদরবারে আগুন জ্বালিয়ে রাখার আদেশ দেন, ইহাতে পারসিকরা মনে করে যে সম্রাট তাদের ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়েছে। আসলে সম্রাট কোন ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হননি। সম্রাট খ্রিস্টান পাদ্রীদেরও আহবান জানান, কিন্তু পাদ্রীরা পবিত্র কোরআন ও হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এর প্রতি অসৌজন্য মূলক কথাবার্তা বললে দরবারের সকলেই তাদের প্রতি বিরক্ত হয়, সম্রাট নিজেও বিরক্তি প্রকাশ করেন। সম্রাট শিখদেরও সম্মান করেন এবং “গ্রন্থ সাহেব” কে ভক্তি করতেন।

 

খোতবা পাঠ

ধর্মবিষয়ে আলোচনার ফলে আকবর গোঁড়া ধর্মীয় নেতাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন, মুসলিম ধর্মীয় নেতারাও সম্রাটকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ধর্ম বিষয় মতামত দানে মুসলিম আলেমদের মধ্যে মতভেদ হলে সম্রাট নিজে মতামত দেয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে ফতেহপুর সিক্রির জামে মসজিদে সম্রাট নিজে শুক্রবারে জুমার নামাজে খুতবা পাঠ করেন। বিখ্যাত কবি ফৈজী খোতবা রচনা করেন এবং খোতবায় সম্রাট বলেন: “যিনি আমাদের সার্বভৌম ক্ষমতা দিয়েছেন, যিনি আমাদের অন্তর এবং বাহু শক্তিশালী করেছেন, যিনি আমাদের সৎপথে ন্যায়বিচারের পথে পরিচালিত করেছেন, তাঁরই নামে সকল প্রসংশা, সম্রাট মহান হউক, আল্লাহু আকবর আকবরের এই খোতবা পাঠকে রক্ষণশীল আলেমরা নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে; কেহ বলে আকবর খোতবা পাঠের সময় ঘাবড়িয়ে যান, পরে নির্ধারিত ইমাম খোতবা শেষ করেন, আবার কেহ বলে আকবর “আল্লাহু আকবর” দ্বারা নিজেকে খোদা বলে দাবী করেছেন।

 

মুজতাহিদের ভূমিকা গ্রহণ

কিন্তু ইহার পরে আকবর আরো দৃঢ় এবং ধর্মীয় ব্যাপারে বিপ্লবাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেন, ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে সম্রাটকে ইমাম-ই-আদিল বা মুজতাহিদরূপে ঘোষণা করা হয়। শয়খ মোবারকের নেতৃত্বে কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম ঘোষণাপত্র জারী করেন যে আলেমরা ধর্মের কোন ব্যাপারে একমত হতে ব্যর্থ হলে সম্রাট সেই সব ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দান করবেন। সম্রাটের রায় সকলের উপর বাধ্যতামূলক হবে, কেউ অমান্য করলে তার পরকাল নষ্ট হবে, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে এবং তার কোন ধর্মীয় অধিকার থাকবেনা। এই ঘোষণা পত্র প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ষণশীল আলেমদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তারা দেখে যে আকবর রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় উভয় ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেহ কেহ বলেন যে এই ঘোষণার দ্বারা আকবর নিজের সিদ্ধান্তকে অভ্রান্ত বলে দাবী করেন, অথচ কোন মানুষের পক্ষে অভ্রান্ত হওয়া সম্ভব নয়। নিরপেক্ষ বিচারে মনে হয়, আকবর ধর্ম বিষয়ে সর্বময় কর্তৃত্বও গ্রহণ করেননি, নিজেকে অভ্রান্ত বলেও দাবী করেননি। আলেমরা ঐক্যমত্যে পৌছুতে ব্যর্থ হলেই সম্রাট মতামত দেয়ার অধিকার গ্রহণ করেন এবং তাঁর এই ক্ষমতাকে পবিত্র কোরান ও জাতীয় স্বার্থ দ্বারা সীমিত করা হয়।

 

দীনএলাহী প্রবর্তন

১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে উপরোক্ত ঘোষণার প্রকৃত তাৎপর্য ঐ ঘোষণার শব্দগত ব্যাখ্যায় বুঝা যায়না, প্রকৃত তাৎপর্য হচ্ছে ধর্ম বিষয়ে আকবরের মনে ও চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন। এই পরিবর্তন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে বৎসর দু’য়েক পরে তাঁর নতুন ধর্মমত দীন-ই-এলাহী প্রবর্তনের মাধ্যমে।

সম্রাট এমন একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গঠন করতে তৎপর হন, যেখানে সকলেই সমান, যেখানে ধর্মের বিভিন্নতা হেতু কেহ শাস্তি ভোগ করবেনা বা অবহেলিত হবেনা। এই উদ্দেশ্যে তিনি দীন-ই-এলাহীর নামে একটি নতুন মতবাদ ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রচার করেন। ইহাতে কোন প্রেরিত পুরুষ ছিলনা, বা কোন অন্ধ বিশ্বাস ছিলনা, সম্রাট নিজেই ইহার উদ্যোক্তা। দীনএলাহীর সদস্যরা একে অন্যের সঙ্গে মিলিত হলেআল্লাহু আকবরএবংজল্লুজালালুহুবলে সম্ভাষণ জানাবে। মানুষের মৃত্যুর পরে জেয়াফত দেওয়া হয় কিন্তু দীনএলাহীর সদস্যরা জীবিত অবস্থায় জেয়াফত দেবে। সদস্যরা মাংস খাবেনা, কিন্তু অন্যেরা খেলে বাধা দেবেনা, জন্মের মাসে সদস্যরা মাংসের নিকটেও যাবেনা। সদস্যরা কসাই, ধীবর এবং ব্যাধ জাতীয় নীচ লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করবেনা; প্রত্যেক সদস্য জন্মদিবস পালন করবে এবং ভোজের আয়োজন করবে। সম্রাটের প্রতি ভক্তির চারিটি মান ছিল, অর্থাৎ সম্রাটের নিকট জান, মাল, সম্মান ও ধর্ম সমর্পণ করা; যারা চারটিই সমর্পণ করবে, তারা প্রথম শ্রেণীর, যারা তিনটি সমর্পণ করবে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর, দুইটি সমর্পণ করলে তৃতীয় শ্রেণীর এবং একটি সমর্পণ করলে চতুর্থ শ্রেণীর সদস্যরূপে গণ্য হবে।

 

দীনএলাহীর প্রচার

আকবর দীন-ই-এলাহী প্রচারের চেষ্টা করেননি, ধর্মমত প্রচার করা বা দীন-ই-এলাহীর সদস্য বাড়ানো তাঁর ইচ্ছা ছিলনা। তাঁর চেষ্টা ছিল মানুষে মানুষে বিভেদ তুলে দেওয়া। দীন-ই-এলাহী গ্রহণ করার জন্য তিনি কোন অফিসারকে প্রলুব্ধ করেননি। সম্রাট নিজে স্বাধীন চিন্তা করতেন, অপরকেও স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ দিতেন, কারো প্রতি জোর জবরদস্তি করতেননা। শেষ পর্যন্ত আঠারজন লোক দীন-ই-এলাহী গ্রহণ করেন, তাদের মধ্যে শয়খ মোবারক, আবুল ফজল, ফৈজী, মিরজা জানী, মিরজা আজিজ কোকা এবং হিন্দুদের মধ্যে রাজা বীরবলের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে দীন-ই-এলাহী কোন ধর্মমত নয়, ইহাতে কোন প্রেরিত পুরুষ ছিলনা, কোন ধর্ম গ্রন্থ ছিলনা। মনে হয় আকবরের দীন-ই-এলাহী রাজনৈতিক কারণে প্রবর্তিত হয়, সম্রাটের ইচ্ছা ছিল বিভিন্ন ধর্মের লোকদের একত্রিত করে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠন, ইহাতে তিনি সম্পূর্ণ সফল হন।

 

আকবর কি ইসলাম ত্যাগ করেন?

কোন কোন ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেন যে আকবর ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। ঐতিহাসিক আবদুল কাদির বদায়ুনী আকবরের ইসলাম বিরোধী নিম্নরূপ আইনের উল্লেখ করেন:

  • ১। মুদ্রায় হাজার বৎসর উৎকীর্ণ করা হয় এবং হজরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর মত্যুর পর থেকে আরম্ভ করে “তারিখ-ই-আলফী” লেখার আদেশ দেওয়া হয়।
  • ২। সম্রাটের প্রতি সেজদা দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়।
  • ৩। বার বৎসর বয়সের আগে ছেলেদের খতনা নিষিদ্ধ করা হয়, বার বৎসর পূর্ণ হলেও খতনা করা না করা ছেলেদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল করা হয়।
  • ৪। গরুর গোশত এবং পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।
  • ৫। দাড়ি রাখা নিরুৎসাহিত করা হয়।
  • ৬। পুরুষদের সোনার অলংকার ব্যবহার করা এবং সিল্কের কাপড় পরা ইসলামে নিষিদ্ধ, কিন্তু সম্রাট এইগুলি ব্যবহারের আদেশ দেন।
  • ৭। বন্যপশু, যেমন বাঘ-ভালুকের মাংস খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় এবং শূকর ও কুকুর প্রাসাদে রাখা হয়। সম্রাট আরো বলতেন যে, প্রতি সকালে শূকর ও কুকুর দেখা পূণ্যের কাজ।
  • ৮। মসজিদে নামাজ পড়া এবং আজান দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলমানদের আহমদ, মোহাম্মদ এবং মোস্তফা নাম রাখা সম্রাটের মনঃপূত ছিলনা এবং সম্রাট এই সকল নাম পরিবর্তন করেন। রমজান মাসে রোজা রাখা এবং মক্কা শরীফে হজ্জ্ব করা নিষিদ্ধ করা হয়। আরবি ভাষা শিক্ষা দূষণীয় গণ্য হয় এবং কোরান হাদিস শিক্ষা নিরুৎসাহিত করা হয়, এই সব বিষয়ের স্থলে গণিত শাস্ত্র, জ্যোতিষ শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র এবং ইতিহাস ইত্যাদি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
  • ৯। বালকদের ষোল বৎসর বয়সের আগে এবং বালিকাদের চৌদ্দ বৎসরের আগে বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়।
  • ১০। মসজিদ ও উপাসনালয়কে গুদাম ও গোলা ঘরে পরিণত করা হয়।

উপরোক্ত আইনগুলি ভালরূপে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ইহাদের অনেকগুলির সঙ্গে ইসলামের মূলনীতির কোন বিরোধ নাই। মসজিদে নামাজ পড়া, আজান দেওয়া, রোজা, হজ্জ্ব ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয় কারণ এইগুলি ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত।

বদায়ুনীর এই অভিযোগগুলি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য নয়, হজ্জ্ব সম্পর্কে বলা যায় যে আকবরের সময়ে মুসলমানদের হজ্ব করতে যাওয়ার প্রমাণ আছে। রোজা রাখা, নামাজ পড়া ব্যক্তিগত ব্যাপার, ব্যক্তিগতভাবে কেউ নামাজ পড়লে বা রোজা রাখলে কেউ বাধ সাধতে পারেনা, মসজিদে যাওয়া হয়ত বন্ধ করতে পারে, কিন্তু আকবর মসজিদ বন্ধ করে দেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না। আহমদ, মোহাম্মদ, মোস্তফা নাম পরিবর্তন করেন এইরূপ কোন প্রমাণও পাওয়া যায় না। আকবরের নিজের নামের সংগে মোহাম্মদ ছিল, তিনি তাঁর নাম পরিবর্তন করেন এইরূপ কোন প্রমাণও পাওয়া যায় না। অন্য কয়েকটি আইন, যেমন অল্প বয়সে বিয়ে না করার উপকার আজকাল অনুভূত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আকরর ধর্ম বিষয়ে স্বাধীন চিন্তাধারায় প্রবর্তন করে দেশে একটি আলোড়নের সৃষ্টি করেন। তখন জনগণ ধর্ম বিষয়ে আলেমুদের কথা অন্ধভাবে মেনে নিতে অভ্যস্ত ছিলেন। আলেমদের এই আধিপত্যে হস্তক্ষেপ করায় আলেমরা আকবরের বিরুদ্ধে চলে যান।

রক্ষণশীল আলেমরা আকবরের আচরণে ইসলামের সর্বনাশ দেখতে পান। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের কোন ক্ষতি হয়নি বরং ওলামাদের প্রভাব কমে যায়। তাই ওলামারা আকবরের বিরুদ্ধে নানারূপ কুৎসা রটনায় লিপ্ত হন। ঐতিহাসিক আবদুল কাদির বদায়ুনী ছিলেন এই রক্ষণশীল ওলামাদের একজন, তাই তাঁর লেখায় তিনি দেখাতে চান যে আকবর ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেন। আকবর তাঁর অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে ইসলাম সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিচার বিশ্লেষণ করেন, তাতে গোঁড়া ইসলাম পন্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, কিন্তু আকবর প্রকৃতপক্ষে ইসলাম ত্যাগ করেননি।

২০৬ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।
Picture of রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক ডেস্ক

রোয়াক, ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অনলাইন মুখপাত্র। বুদ্ধিবৃত্তিক ও সময়ের চিন্তাগত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কাজ করে যাবে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top