মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে?  মহান স্রষ্টা ছাড়া এ প্রশ্নের যথার্থ ও নির্ভুল জবাব আর কে দিতে পারে? মানুষের বিবেক-বুদ্ধি নিজে নিজেই এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না । কেননা সৃষ্টি-উদ্দেশ্য সৃষ্টি-কর্মের পূর্বেই স্রষ্টার নিকট নির্দিষ্ট হয়ে ছিল । মানুষের চোখ যেমন সম্মুখে দেখে, পেছনে তাকাতে পারে না, তেমনি বিবেক-বুদ্ধিও বলতে পারে না তাকে অস্তিত্ব দানের মূলে কি উদ্দেশ্য নিহিত ছিল । তাই স্রষ্টাই স্পষ্টতর ভাষায় মানুষকে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানিয়ে দিয়েছেন । বলেছেনঃ

আমি জ্বিন ও মানুষকে কেবলমাত্র এই উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি যে, তারা নিজেরা স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে কেবল আমারই দাসত্ব করবে ।

অর্থাৎ স্রষ্টা-মালিক ও মনিবের সার্বক্ষণিক ও সর্বমুখী দাসত্ব-আনুগত্য ও অধীনতা করা-পূজা-উপাসনা-আরাধনা থেকে শুরু করে হুকুম পালন ও আইন অনুসরণ পর্যন্ত সব মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য । একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মানুষ এই কাজ স্বতঃ অনুপ্রাণিত হয়ে সম্পন্ন করবে । এই কাজ সম্পাদন করে নিজেকে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাহ–দাসানুদাস–প্রমাণ না করা পর্যন্ত তার দ্বারা খিলাফতের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন হতে পারে না । মানুষের মধ্যে আল্লাহর একান্ত দাস হওয়ার অনুভূতি ও চেতনা সঞ্চারিত না হলে তার পক্ষে আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়া; প্রতিনিধি হিসেবে কর্তব্য পালন করা তার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব । এই ব্যাপারে কোন খুঁত বা ত্রুটি থেকে গেলে এবং এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উপেক্ষা দেখালে শয়তান তাকে সহজেই অসঅসা দিতে পারে, নিজের ক্রীড়নক বানিয়ে ফেলতে পারে । সেরূপ ক্ষেত্রে সে আল্লাহর খলীফা হওয়ার সমস্ত যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলে । এমতাবস্থায় তার চিন্তায়ও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে । নিজেকে জন্তু-জানোয়ার অপেক্ষা হীন ও নিকৃষ্ট মনে করতেও সে লজ্জা পায় না, আর পশুর বংশধর প্রমাণ করে দিলে তো তার খুশীরই অন্ত থাকে না; বরং পশুর বংশধর হওয়ার গৌরবে সে নেচে উঠে, পশুসুলভ কাজকর্ম করে নিজেকে ধন্য মনে করে । এমন কি এর পরিণামে পশুর চাইতেও নিম্নস্তরে পৌঁছে যেতেও দ্বিধাবোধ করে না । অথচ মানুষ কখনই পশু নয় ।

কখনও আবার এর বিপরীত খোদা বা প্রভু হয়ে বসতে চেষ্টা করে মানুষ । কিন্তু প্রকৃত খোদা হওয়ার ও কার্যত খোদার ন্যায় কাজ করার কোন যোগ্যতাই মানুষের নেই । সে খোদা হওয়ার ভান করে, দুর্বল-অক্ষম জনগণের ওপর খোদার ন্যায় নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে, তাদের ধন-মাল কেড়ে নিয়ে রিযিকদাতা হতে চায়, জীবন-মৃত্যুর কর্তা হয়ে বসে আর আইন-শাসনের নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব চাপিয়ে দেয় সাধারণ মানুষের ওপর । নমরূদের দাবি ‘আমিই বাঁচাই আমিই মারি’ এবং ফিরাউনের দাবি, ‘আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ রব্ব’ এই পর্যায়েরই প্রলাপ-উক্তি বিশেষ।

 

এই কারণে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ায় মানুষ পাঠানোর পূর্বেই তার (মানুষের) ‘রূহ’গুলিকে হাযির করে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন । তিনি প্রশ্ন করেছিলেনঃ

আমিই কি তোমাদের রব নই?

সকলেই সুস্পষ্ট ভাষায় জবাব দিয়েছিল হ্যাঁ, তুমিই আমাদের রব্ব, হে আল্লাহ ।

তাই দুনিয়ায় জনবসতি শুরুর পর থেকেই মহান আল্লাহ এখানে নবী রাসূল পাঠিয়ে বৈষয়িক জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সর্ব বিষয়ে একমাত্র তাঁকেই রব্ব ও মা’বুদ মেনে নেয়ার এবং কেবল তাঁরই যাপন করার আহ্বান জানানোর ব্যবস্থা করেছেন । তিনি মানুষকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, হে মানুষ! তোমরা পশু বা জন্তু-জানোয়ার নও-নও তোমরা খোদা-মালিক, সার্বভৌম । তাই সব নবী-রাসূলেরই এই একটিমাত্র দাওয়াত ছিল মানুষের প্রতিঃ

“তোমরা কেবল আল্লাহকে মা’বুদ ও নিজেদেরকে তাঁর বান্দাহ বানাও । তিনি ছাড়া তোমাদের মা’বুদ হতে পারে তোমরা তার বান্দাহ হতে পার, এমন কেউ-ই নেই।”

একইভাবে উদাত্ত কণ্ঠে সমস্ত মানুষকে আহ্বান জানানো হয়েছেঃ

হে মানুষ! তোমরা দাসত্ব স্বীকার করো তোমাদের সেই রব্ব-এর যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে চলে যাওয়া লোকদেরকে সৃষ্টি করেছেন । তা হলে আশা করা যায়, তোমরা রক্ষা পাবে ।

এ আয়াতে আল্লাহর পরিচয়-তিনি রব্ব, তিনিই সৃষ্টিকর্তা, তিনিই মা’বুদ । আর এই হিসেবেই তাঁকে মেনে নেয়া মানুষের কর্তব্য । তিনি সৃষ্টিকর্তা, অতএব মানুষের গোটা সত্তা কেবল তাঁরই অনুগৃহীত হবে । তিনিই রব্ব, অতএব মানুষ অধীনতা আনুগত্য করবে কেবল তাঁরই । অনুগৃহীত মনে করার স্বাভাবিক পরিণতি স্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পণ করা ।

তাই পূজা-উপাসনা-আরাধনা আইন পালন ইত্যাদি কেবল আল্লাহরই হতে পারে। অন্য কেউ সৃষ্টিকর্তা নয়, পালনকারী নয়, আইনদাতাও নয় । কাজেই অন্য কেউ-ই মানুষের মা’বুদ, মনিব ও সার্বভৌম হতে পারে না । প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে, নবী-রাসূলগণও মানুষের আনুগত্য ও অনুসরণ পাওয়ার অধিকারী, কিন্তু তা মৌলিক নয়, আল্লাহর আনুগত্যের অধীন । আল্লাহ-ই তাঁদেরকে পাঠান তাঁদের আনুগত্য ও অনুসরণ করা হবে এই উদ্দেশ্যে।

আমরা রাসূল তো পাঠিয়েছি এই উদ্দেশ্যেই যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদের আনুগত্য করা হবে।

শুধু তা-ই নয়, আল্লাহ্ তাঁর নিজের আনুগত্য করার নির্দেশের সাথে সাথে রাসূলেরও আনুগত্য করার আদেশ করেছেনঃ

আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর।

মানুষ যখন তার এই অবস্থান ও পদমর্যাদার (position) কথা বিস্মৃত হয়েছে তখনই সে চরম গুমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে গেছে । সে তার বন্দেগী, আনুগত্য ও পূজা-উপাসনার ক্ষেত্রে অন্যকে শরীক বানিয়ে নিয়েছে । ফলে সে আল্লাহর অর্পিত খিলাফতের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে-আমানতে খিয়ানত করেছে; সে খোদাদ্রোহী হয়েছে । অথচ সে আদিষ্ট ছিল একমাত্র আল্লাহর খালেস বান্দাহ হওয়ার জন্যে ।

সর্বদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আনুগত্যকে খালেস করে কেবল আল্লাহর দাসত্ব করার জন্যেই তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল ।

এইরূপ ইবাদত বা দাসত্ব করার তাৎপর্য হল, মহান আল্লাহ জীবন যাপনের জন্য যে পন্থা ও বিধান তৈরী করে দিয়েছেন, সমগ্র জীবন সেই অনুসারেই যাপন করতে হবে । মানুষের মনগড়া ধর্মমত, পূজা-উপাসনা পদ্ধতি ও জীবন-সমাজ পরিচালনার আইন-বিধানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে খালেস ভাবে এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে হবে। এই বিরাট ও মহান কাজের জন্যেই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ।

দুনিয়ায় বসতি স্থাপনের পর সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত মানুষ এভাবেই জীবন যাপন করেছ । ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু লংঘন হলেও সামষ্টিক পর্যায়ে আদর্শচ্যুতি ঘটেনি । অবশ্য পরে এক সময় আবার শয়তান মানুষকে গুমরাহ করতে সফল হয় । তখন মানুষ সঠিক পথ ছেড়ে দেয় এবং পারস্পরিক মত-পার্থক্যের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে । তখন মানুষকে সিরাতুল মুস্তাকীমে অবিচল রাখার উদ্দেশ্যে আল্লাহর ক্রমাগতভাবে নবী-রাসূল পাঠাতে শুরু করে দেন । কেননা খিলাফত আল্লাহর দেয়া একটি বিরাট নিয়ামত । তাতে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের বিরাট সুযোগ রয়েছে, মানুষকে প্রস্তর, বৃক্ষ কিংবা জন্তু-জানোয়ারের ন্যায় স্বাধীনতাহীন বানাননি । তাকে ইচ্ছা পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে । এই স্বাধীনতাই মানুষের পরীক্ষার আসল ভিত্তি । একটি আয়াতে এই কথা সুস্পষ্ট রূপে বলে দেয়া হয়েছেঃ

সেই মহান আল্লাহ্-ই তোমাদেরকে পৃথিবীর খলীফা বানিয়াছেন এবং তোমাদের কতককে অপর কতকের ওপর উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন, যেন তোমাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন । তোমার রব্ব শাস্তিদানে নিঃসন্দেহে তীব্র ও ক্ষীপ্র । আর তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অতীব দয়াশীলও । (সূরা আন’আম : ১৬৫)

এই আয়াতটিতে মানুষের খিলাফত জীবন-উদ্দেশ্য ও বৈষয়িক জীবনের নিগূঢ় তত্ত্ব-এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এক সাথে কথা বলা হয়েছে । প্রথমত বলা হয়েছে, মানুষ এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহর খলীফা । দ্বিতীয়ত স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে অগণিত ও অপরিমিত নিয়ামত দান করেছেন এবং সেইগুলির উৎপাদন ও ব্যয় ব্যবহারের পূর্ণ অধিকারও মানুষকে দিয়েছেন । সেই সাথে একথাও জানা গেল যে, মানুষের–আল্লাহর খলীফাগণের মান-মর্যাদায় পার্থক্য রয়েছে এবং এ পার্থক্য স্বয়ং আল্লাহর সৃষ্টি । আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্তিতে সব মানুষ সমান নয়-সব মানুষের ইখতিয়ার বা উৎপাদন ও ব্যয়-ব্যবহারের ক্ষমতাও সমান নয় । কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতা-প্রতিভার দিক দিয়েও আল্লাহ মানুষে মানুষে যথেষ্ট তারতম্য রেখেছেন । পৃথিবীতে মানুষকে যে খিলাফত ও অন্যান্য নিয়ামত তিনি দিয়েছেন, তা সবই মূলত মানুষের পরীক্ষার সামগ্রী । এই গোটা জীবন-ই মানুষের পরীক্ষাকাল এবং এ দুনিয়া হচ্ছে পরীক্ষার স্থান বা ক্ষেত্র । এখানে প্রতিটি মানুষই পরীক্ষা দেয়ার কাজে রত ও ব্যস্ত । তাদের এই পরীক্ষার ফল অনুযায়ীই পরবর্তী জীবনে তাদের মান-মর্যাদায় পার্থক্য করা হবে । কোন ব্যক্তি এই পরীক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে এবং খোদাদ্রোহীদের কাতারে তার স্থান নির্দিষ্ট হলে সেখানে তাকে অতি দ্রুত হিসেব গ্রহণকারী আল্লাহর সম্মুখীন হতে হবে । কেউ যদি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ভুল-ত্রুটির কারণে কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে পড়ে, তা হলে সর্বক্ষমাশীল ও অতীব দয়াবান আল্লাহ তাকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নিবেন ।

বস্তুত দুনিয়ায় আগমনের পূর্বেই মানুষকে এই নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল । পরে নবী-রাসূলগণ তাদেরকে এই কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন । আর এক্ষণে কুরআন মজীদ কিয়ামত পর্যন্ত মানুষকে এই তত্ত্বকথা স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবে অব্যাহতভাবে ।

এই বিস্তারিত আলোচনার প্রেক্ষিতে প্রতিটি বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বিবেচনা করতে পারেন যে, মানুষ যদি তার এই প্রকৃত অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে অবহিত না হয়, তা হলে তার নৈতিক অবস্থা কি সাংঘাতিক পরিণতি লাভ করতে পারে । এই ধরনের আরও কতিপয় প্রশ্ন এমন রয়েছে, যে সবের নির্ভুল জবাব নিছক মানবীয় বিবেক-বুদ্ধির পক্ষে দেয়া কখনই সম্ভব হতে পারে না । এই শেষ প্রশ্নটি সুস্পষ্ট রূপে পেশ করলে দাঁড়ায়ঃ মানুষের জীবন লক্ষ্য কি? স্রষ্টার সাথে তার সম্পর্ক কি? স্রষ্টা তার নিকট কোন জিনিসের দাবি করেন? কোন কাজে স্রষ্টা খুশী হন, কোন কাজে হন অসন্তুষ্ট? ইহকালীন কোন কাজের পরিণাম পরকালে মানুষের জন্য ভালো হবে এবং কোন কাজের পরিণাম খারাপ হবে–এই প্রশ্নগুলির কোন সুস্পষ্ট নিশ্চিত ও নির্ভুল জব্বার কি মানুষের বিবেক-বুদ্ধি দিতে পারে?  কারোর বিবেক-বুদ্ধি এ সব প্রশ্নের কোন জবাব খাড়া করলেও তা কি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা যাবে? অথচ নীতিদর্শন পর্যায়ে এই সব প্রশ্নই প্রবল হয়ে দেখা দেয় এবং তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ইসলামের নীতিদর্শন এ সব প্রশ্নের । সুস্পষ্ট ও নিশ্চিত জবাব পেশ করেছে এবং তা পুরাপুরি যথার্থ ও একান্তই নির্ভুল ।

১৩৯৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা ! এ শতকে যে ক'জন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন-দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাদের অন্যতম । এই ক্ষণজন্ম পুরুষ ১৩২৫ সনের ৬ মাঘ (১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারী) সোমবার, বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালী থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্রােন্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৩৮ সালে তিনি শীর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্ৰী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার জ্ঞানগর্ভ রচনাবলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এ ভূখণ্ডে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দােলন শুরু করেন এবং সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরলসভাবে এর নেতৃত্ব দেন ।বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত তীর প্রায় ৬০টিরও বেশি। অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার কালেমা তাইয়েবা, ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা', 'মহাসত্যের সন্ধানে', 'বিজ্ঞান ও জীবন বিধান', 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, "আজকের চিন্তাধারা', "পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত", "ইসলামের অর্থনীতি’, ‘ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন', 'সূদমুক্ত। অর্থনীতি’, ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম', 'নারী', 'পরিবার ও শিরক ও তাওহীদ”, “আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত', "আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকারী', ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী দাওয়াত’, ‘ইসলামী শরীয়াতের উৎস', 'অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’, ‘অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম’, ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ইসলামে জিহাদ', 'হাদীস শরীফ (তিন খণ্ড) ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে তার অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তার কোনো জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রয়েছে মওলানা মওদূদী। (রহ:)-এর বিখ্যাত তফসীর তাফহীমুল কুরআন', আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী'-কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান (দুই খণ্ড) ও ইসলামে হালাল হারামের বিধান', মুহাম্মদ কুতুবের বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত' এবং ইমাম আবু বকর আল-জাসসাসের ঐতিহাসিক তফসীর ‘আহকামুল কুরআন' । তার অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৬০টিরও উর্ধে। মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অন্তর্গত। ফিকহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সূচিত “আল-কুরআনে অর্থনীতি' এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকল্পেরও সদস্য ছিলেন। প্রথমোক্ত প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধ৷ তাঁরই রচিত। শেষোক্ত প্রকল্পের অধীনে তাঁর রচিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও ইতিহাস দর্শন' নামক গ্রন্থটি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় । মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ণ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন, একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশী। ইসলামী মহাসম্মেলন, ১৯৮০ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই যুগস্রষ্টা মনীষী ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর) a দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সন্নিধ্যে চলে গেছেন। (ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)
Picture of মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বর্তমান শতকের এক অনন্যসাধারণ ইসলামী প্রতিভা ! এ শতকে যে ক'জন খ্যাতনামা মনীষী ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা কায়েমের জিহাদে নেতৃত্ব দানের পাশাপাশি লেখনীর সাহায্যে ইসলামকে একটি কালজয়ী জীবন-দর্শন রূপে তুলে ধরতে পেরেছেন, তিনি তাদের অন্যতম । এই ক্ষণজন্ম পুরুষ ১৩২৫ সনের ৬ মাঘ (১৯১৮ সালের ১৯ জানুয়ারী) সোমবার, বর্তমান পিরোজপুর জিলার কাউখালী থানার অন্তর্গত শিয়ালকাঠি গ্রামের এক সম্রােন্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ১৯৩৮ সালে তিনি শীর্ষীনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম এবং ১৯৪০ ও ১৯৪২ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে যথাক্রমে ফাযিল ও কামিল ডিগ্ৰী লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার জ্ঞানগর্ভ রচনাবলি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে উচ্চতর গবেষণায় নিরত থাকেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এ ভূখণ্ডে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দােলন শুরু করেন এবং সুদীর্ঘ চার দশক ধরে নিরলসভাবে এর নেতৃত্ব দেন ।বাংলা ভাষায় ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) শুধু পথিকৃতই ছিলেন না, ইসলামী জীবন দর্শনের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ সম্পর্কে এ পর্যন্ত তীর প্রায় ৬০টিরও বেশি। অতুলনীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার কালেমা তাইয়েবা, ইসলামী রাজনীতির ভূমিকা', 'মহাসত্যের সন্ধানে', 'বিজ্ঞান ও জীবন বিধান', 'বিবর্তনবাদ ও সৃষ্টিতত্ত্ব, "আজকের চিন্তাধারা', "পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তি’, ‘সুন্নাত ও বিদয়াত", "ইসলামের অর্থনীতি’, ‘ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন', 'সূদমুক্ত। অর্থনীতি’, ‘ইসলামে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বীমা’, ‘কমিউনিজম ও ইসলাম', 'নারী', 'পরিবার ও শিরক ও তাওহীদ”, “আল-কুরআনের আলোকে নবুয়্যাত ও রিসালাত', "আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকারী', ইসলাম ও মানবাধিকার’, ‘ইকবালের রাজনৈতিক চিন্তাধারা’, ‘রাসূলুল্লাহর বিপ্লবী দাওয়াত’, ‘ইসলামী শরীয়াতের উৎস', 'অপরাধ প্রতিরোধে ইসলাম’, ‘অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে ইসলাম’, ‘শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘ইসলামে জিহাদ', 'হাদীস শরীফ (তিন খণ্ড) ইত্যাকার গ্রন্থ দেশের সুধীমহলে প্রচণ্ড আলোড়ন তুলেছে। এছাড়া অপ্রকাশিত রয়েছে তার অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি। মৌলিক ও গবেষণামূলক রচনার পাশাপাশি বিশ্বের খ্যাতনামা ইসলামী মনীষীদের রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করার ব্যাপারেও তার কোনো জুড়ি নেই। এসব অনুবাদের মধ্যে রয়েছে মওলানা মওদূদী। (রহ:)-এর বিখ্যাত তফসীর তাফহীমুল কুরআন', আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী'-কৃত ‘ইসলামের যাকাত বিধান (দুই খণ্ড) ও ইসলামে হালাল হারামের বিধান', মুহাম্মদ কুতুবের বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত' এবং ইমাম আবু বকর আল-জাসসাসের ঐতিহাসিক তফসীর ‘আহকামুল কুরআন' । তার অনূদিত গ্রন্থের সংখ্যাও ৬০টিরও উর্ধে। মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র অন্তর্গত। ফিকহ একাডেমীর একমাত্র সদস্য ছিলেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ সূচিত “আল-কুরআনে অর্থনীতি' এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস’ শীর্ষক দুটি গবেষণা প্রকল্পেরও সদস্য ছিলেন। প্রথমোক্ত প্রকল্পের অধীনে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের অধিকাংশ প্রবন্ধ৷ তাঁরই রচিত। শেষোক্ত প্রকল্পের অধীনে তাঁর রচিত সৃষ্টিতত্ত্ব ও ইতিহাস দর্শন' নামক গ্রন্থটি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় । মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ) ১৯৭৭ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন ও রাবেতা আলমে ইসলামীর সম্মেলন, ১৯৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম দক্ষিণ-পূর্ণ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ইসলামী দাওয়াত সম্মেলন, একই বছর করাচীতে অনুষ্ঠিত প্রথম এশী। ইসলামী মহাসম্মেলন, ১৯৮০ সালে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত আন্তঃপার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং ১৯৮২ সালে তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামী বিপ্লবের তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এই যুগস্রষ্টা মনীষী ১৩৯৪ সনের ১৪ আশ্বিন (১৯৮৭ সালের ১ অক্টোবর) a দুনিয়া ছেড়ে মহান আল্লাহর সন্নিধ্যে চলে গেছেন। (ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রাজিউন)

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top