• সংস্কৃতি কী

সংস্কৃতি কী এবং কী নয় এ সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে গত একশ বছর ধরে। এ বিতর্ক বৃদ্ধি পায় মার্কসিজমের উত্থানের পরে। মার্কসিজমের উত্থানের পর একটি নতুন দর্শন আসে Art for life sake নামে। এ নিয়ে একটি বিতর্ক দেখা দেয় যে Art for Art sake or Art for life sake। এ বিতর্ক আগে ছিল না। কমিউনিস্টরা এ বিতর্ক তুলে ধরে। এটা করতে গিয়ে তারা বাড়াবাড়িও করেন। আর্ট এখানে সংস্কৃতি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সংস্কৃতির ভিতর যে একটা সৌন্দর্য থাকতে হবে, তা তারা হাইলাইট করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। তারা সম্পূর্ণভাবে এটাকে উপেক্ষা করে।

অন্যদিকে যারা “আর্ট ফর আর্ট সেক’-এর পক্ষে তারাও এ ইস্যুকে রাজনীতিকরণ করে। তারা বলেন, আর্ট আর্টের জন্য। অর্থাৎ এর মধ্যে সৌন্দর্য থাকতে হবে। সৌন্দর্যের চেতনা থাকতে হবে। যা কিছুই সুন্দর করে এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করে জীবনের বিভিন্ন দিককে, সাহিত্যকলায় তাই সংস্কৃতি।

সংস্কৃতির প্রশ্নে যদি আমরা সুবিচার করতে চাই তাহলে সেখানে আর্ট বা সংস্কৃতিতে দুটো দিকই থাকতে হবে। জীবনের জন্য তা প্রয়োজনীয় হতে হবে। জীবনের জন্যেই হবে। জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। জীবনকেই সার্ভ করতে হবে। এটাই সত্য কথা। অন্যদিকে এটাও সত্য যে যা কিছু সুন্দর নয়, তা আর্ট বা সংস্কৃতি হবে না, তা জীবনের জন্য হলেও। কাজেই দুটো উপাদানই প্রয়োজন। দুটোই সত্য। এই বিতর্কের পরিসমাপ্তির প্রয়োজন রয়েছে। তবে আমার মনে হয় বর্তমানে তার পরিসমাপ্তি কিছুটা হয়েও গেছে। মার্কসিজমের পতনের পর এই বিতর্ক আর খুব একটা আছে বলে মনে হয় না।

যে কোনো আদর্শভিত্তিক দলও একথা ভুলতে পারে যে আর্ট ফর লাইফ সেক। এটা তারাও নিয়ে নিতে পারে। এটা কেউ কেউ কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিয়েও নিয়েছে। কিন্তু এটা প্রয়োজনীয় নয়। এ তর্ক ইসলামিস্টদেরও দরকার নেই। ইসলামপন্থীদের সংস্কৃতির মধ্যে এ দুটি জিনিসের সমন্বয় ঘটাতে হবে।

এই তাত্ত্বিক কথার বাইরে বলা যায় সংস্কৃতির বহুদিক রয়েছে। বহু ডাইমেনশন রয়েছে। সাহিত্য, শিল্প, সিনেমা, নাটক, সবই সংস্কৃতির অংশ। সংস্কৃতির ডাইমেনশনের কথা বলতে গিয়ে তার বিভিন্ন ডাইমেনশন কথা আসে। গান, সংগীত, সাহিত্য থেকে শুরু করে নাটক, সিনেমা সবকিছুই সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে। আরেকটি দিক থেকে বলতে গেলে বলা যায় মানুষের জীবনাচারই সংস্কৃতি, মানুষের গোটা জীবনপদ্ধতিই সংস্কৃতি। সেই অর্থে সংস্কৃতি আরো ব্যাপক অর্থে দাঁড়ায়। সংস্কৃতির সংজ্ঞার মধ্যে আমাদের কিছুটা মতপার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু মৌলিকভাবে আমরা স্বীকার করি সংস্কৃতি একটি ব্যাপক বিষয়। সংস্কৃতি গোটা জীবনব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সংস্কৃতি প্রতিটি জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তার অনেক দিক বা ডাইমেনশন রয়েছে। এবং সর্বোপরি এটা জীবনকে সার্ভ করতে হবে। সৌন্দর্যকেও সার্ভ করতে হবে। আবারও বলি এটাকে সুন্দরও হতে হবে এবং জীবনের জন্যেও হতে হবে।

  • সংস্কৃতি ও মানুষ

সংস্কৃতি ও মানুষকে আলাদা করা যায় না। তবে এভাবে বলা যায় সংস্কৃতির জন্য মানুষ নয়। মানুষের জন্য সংস্কৃতি। সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে কোনো ব্যক্তি বা সমাজ কল্পনা করা যায় না। মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি রয়েছে। ব্যক্তির স্বতন্ত্র সংস্কৃতিও একটি রয়েছে। তার চালচলন আর স্বভাবের মধ্যে সেসব পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। প্রত্যেক পরিবারের একটি সংস্কৃতি রয়েছে। তার মধ্যেও একটি স্বাতন্ত্র্য থাকতে পারে। তার ধরনে, বলনে, কথনে, বক্তব্যে, চলনে সেটা থাকতে পারে। সমাজের থাকতে পারে। একটা জাতির থাকতে পারে। সুতরাং সংস্কৃতির বাইরে মানুষ নয়। আবার মানুষের বাইরেও সংস্কৃতি নয়।

  • সংস্কৃতির ভিত্তি

সংস্কৃতিকে কয়েকটি ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে। সুস্থ বিশ্বাসের ওপর সংস্কৃতিকে দাঁড়াতে হবে। যদি দুর্নীতির চিন্তার (Corrupt thought) উপর সংস্কৃতি দাড়ায় সে সংস্কৃতিও দুর্নীতিপ্রাপ্ত হবে। কারণ বিশ্বাস আচরণকে প্রভাবিত করে। সংস্কৃতি হচ্ছে আচরণ। তার পেছনে রয়েছে বিশ্বাস। এই বিশ্বাস দুর্নীতিগ্রস্ত হলে আচরণও তাই হবে। বিশ্বাস সুস্থ হলে সেটাও সুস্থ হবে।

এখানে মুসলিম জাতির কথা বললে তার ভিত্তি অবশ্যই তৌহিদ হতে হবে। তৌহিদ বলতে আমরা বুঝি একজন স্রষ্টা রয়েছেন। সব সৃষ্টির একটা উদ্দেশ্য রয়েছে। আমরা মানুষ। আমরা আল্লাহর প্রতিনিধি। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তার মিশনকে এই বিশ্ব, আকাশ সর্বত্র কার্যকরী করা। এর জন্য মুসলিম সংস্কৃতিকে সব সময়ই শিরকমুক্ত হতে হবে। মুসলিম সংস্কৃতি এমন হতে হবে যেন খলিফার মর্যাদা রক্ষা পায়। তার যে প্রতিনিধি মানুষ তার সঙ্গে খাপ খায়। অর্থাৎ যন্ত্র হতে হবে। সৌন্দর্যমণ্ডিত হতে হবে। মার্জিত হতে হবে। অমার্জিত হলে চলবে না। এটা অশ্লীলতামুক্ত হবে।

কাজেই সংস্কৃতির প্রথম ভিত্তি হচ্ছে সুস্থ বিশ্বাস। ইসলামের ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে তৌহিদ। তৌহিদ বিভিন্ন দিকের কারণে সংস্কৃতিও এরকম হয়। তেমনি যদি আমরা ইসলামের বাইরে গিয়ে দেখি অর্থাৎ অমুসলিমদের মধ্যেও সুস্থ বিশ্বাস থাকতে হবে। সেটা তৌহিদ নাও হতে পারে। সেটা আমার দৃষ্টিতে সঠিক নাও হতে পারে। কিন্তু আমার দৃষ্টিতে যাই হোক না কেন তুমি তার এটার ওপর বিশ্বাস থাকে, ভালো হয়, মানবতাবাদী হয় তাহলে তার উপরেও যে সংস্কৃতি গড়ে উঠবে সেটাও ভালো হবে। মানবতার একটা অংশ মুসলিম। বাকি অংশ অমুসলিম। তাদের সংস্কৃতি ভালো হবে যদি তা সুস্থ বিশ্বাসের উপর হয়। তাদের ক্ষেত্রে সেটা প্রচার হতে হবে। যদি নাস্তিকতার উপর হয় তাহলে ক্ষতি হবে। যদি স্রষ্টার অস্তিত্বের ওপর ভিত্তিশীল হয় তাহলে তা নাস্তিকতার চেয়ে অনেক ভালো হবে, এতে কোনো সন্দেহ নাই। সেটা যদি মানবতাবাদী হয় তাহলে অবশ্যই ভালো হবে। কিন্তু সেটা যদি জাতিপূজা বা গোত্রপূজা হয় তাহলে কী হবে? অসুস্থ সংস্কৃতি হবে। সুতরাং ইসলামের ক্ষেত্রে তৌহিদ বলব। কিন্তু মানবতারও যে অন্য অংশ রয়েছে, তারা তৌহিদ মানছে না। তাদের ক্ষেত্রে সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তোলার ভিত্তির জন্য অবশ্যই একটি সুস্থ বিশ্বাস লাগবে। সেটা হতে পারে মানবতাবাদ এবং স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস। কিন্তু নাস্তিকতার ওপর হতে পারে না। যদি হয় তাহলে তা মারাত্মক হবে। যদি রেসিজম বা গোত্রবাদ হয়, বংশ পূজা হয়, অতিপূজা হয় তাহলে সেটা মারাত্মক হবে।

তাহলে আমরা বলতে পারি সংস্কৃতির জন্য প্রথমত সুস্থ বিশ্বাস লাগবে। দ্বিতীয়ত অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে। যদিও এটা প্রথমটির সাথে সম্পর্কযুক্ত। যদি সংস্কৃতি সুস্থ বিশ্বাসের উপর হয় তাহলে তা অশ্লীলতা মুক্ত হবেই। কারণ কোনো সুস্থ বিশ্বাসই বলে না অশ্লীলতা ভালো। এটা অবশ্যই মানবজাতির জন্য হতে হবে। সংস্কৃতিকে মানবজাতিকে সার্ভ করতে হবে। মানবতাবাদী হতে হবে। কল্যাণধর্মী হতে হবে।

সংস্কৃতির আরেকটি ভিত্তি হচ্ছে সৌন্দর্য চেতনা। সুন্দর চেতনা থাকতে হবে। কোনো কিছুই অসুন্দর করা যাবে না। কাজেই সার্বিকভাবে বলা যায় সংস্কৃতির ভিত্তির জন্য একটি সুস্থ বিশ্বাস লাগবে। মানবতাবাদী হতে হবে। মানুষের প্রয়োজনে হতে হবে, অশ্লীলতামুক্ত হতে হবে। কল্যাণধর্মী হতে হবে এবং সৌন্দর্য চেতনামণ্ডিত ও সৌন্দর্যবুদ্ধিমতি হতে হবে।

এর জন্য আমার মনে কাজ করছে বিভিন্ন পার্থক্যকে (pluralism) মেনে নেয়া। বিশ্ব এক রকম নয়। বিশ্ব এক জাতি মিলে হয়নি। আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলছেন, আমি যদি চাইতাম, সবাই ইসলামের অনুসারী হয়ে যেত। সবাই সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে থাকত। কিন্তু আমি তো এরকম পরিকল্পনা করিনি। আমি মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছি। অর্থাৎ সবাই এক পথে আসবে না আমার এই দেয়া স্বাধীনতার কারণে।

এটাকে সামনে রেখে বলা যায় এই বাস্তবতা আজকে আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। মানুষ বিভিন্ন মতের হবে, বিভিন্ন ধরনের হবে। সেটাকে সামনে রেখে আমি বলেছি সুস্থ বিশ্বাস ইসলামের ক্ষেত্রে তৌহিদ। অন্যদের ক্ষেত্রে মানবিকতা হতে হবে। স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস হতে হবে যদি তা তৌহিদ নাও হয়। তা হলে সেটা সুস্থ সংস্কৃতি হবে। সেটা নাস্তিকতার চেয়ে অনেকগুণ ভালো নাস্তিকতার উপরে, রেসিজমের উপরে কোনো ভালো সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে না।

  • সংস্কৃতিতে নিয়ন্ত্রণ

সংস্কৃতি কি মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ? নিয়ন্ত্রিত হলে কতটুকু? এটা আসলে ইয়েস ও নো (yes and no) প্রশ্ন। এটা ঠিক যে সংস্কৃতিকে মানুষ নির্মাণ করে। একা এক ব্যক্তিই করে না। অনেকে মিলে, অনেক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে একটি সংস্কৃতি শত বছরে হাজার বছরে গড়ে ওঠে। তাই যদি হয় তাহলে এটা কে গড়ল? মানুষ গড়ল। কিন্তু কোনো এক ব্যক্তি বা একজনের বা এক বংশের এর উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই অর্থে বলা যায় এটা মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। কিন্তু আবার এটাও তো সত্য যে সংস্কৃতি মানুষই তৈরি করেছে। সকল মানুষ মিলে তৈরি করেছে। সুতরাং আমরা বলতে পারি সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে মানুষ তৈরি করে এবং এই অর্থে মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু এই অর্থে নিয়ন্ত্রিত নয় যে কোনো একটি জাতি, কোনো একটি জেনারেশন (generation) এই সংস্কৃতি নির্মাণ করেনি। অথচ আমরা তো জেনারেশন ধরে চিন্তা করি, আমরা তো ঐতিহাসিকভাবে একত্রে অবস্থান (exist) করছি না- সুতরাং এই অর্থে বলা যায় সংস্কৃতি মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। এটা একটা ঐতিহাসিক বিকাশ (Historical Identify)। এই জন্যই আমি বিভিন্ন জায়গায় বলে থাকি যে সংস্কৃতিকে নিয়ে খেলা চলবে না । সংস্কৃতি মানুষের গভীর চেতনা থেকে উৎসারিত। এটা খুব স্পর্শকাতর। এই জন্য আমি সবখানে একথাই বলি সংস্কৃতি নিয়ে সাবধানে এগুতে হবে। যেহেতু আমি একজন ইসলামপন্থী একথা সেজন্য ইসলামপন্থীদেরও বেশি করে বলি। আমার অনেক কিছুই পছন্দ হবে না। কিন্তু সেটাকে সরাতে হবে আস্তে আস্তে। ধৈর্য ধরে সরাতে হবে। যেটা রাখলে চলে সেটা রাখতে হবে। কারণ ইসলামের শুরুতেই রাসূল (সা) সরাসরি ইসলাম বিরোধী না এমন স্থানীয় রীতিনীতি, আচার আচরণকে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরব রীতিনীতি গ্রহণ করে নিয়েছেন। ইবনে তাইমিয়ার একটি বিখ্যাত ফতোয়া আছে, যেকোনো দেশের স্থানীয় কাস্টমস (রীতি প্রথা) তা যদি সরাসরি ইসলাম বিরোধী না হয়, একেবারে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ না হয়, তাহলে সেটা থাকবে।

আমরা এ ব্যাপারে অনেক সময় কিছুটা হঠকারিতা করে বসি। কিছুটা বাড়াবাড়ি করে বসি। এগুলো থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। আমাদের ইসলামের যে মহত্ত্ব, সামগ্রিকতা, ব্যাপকতা এবং ইসলামের মধ্যে যে বহু মত ও পথের সুযোগ আছে সে সুযোগের বিষয়টি মনে রাখতে হবে। যদি এই মত ও পথের সুযোগ না থাকত তাহলে এতগুলো মাজহাব হলো কিভাবে? সুন্নীদের চারটি মাজহাব হলো কিভাবে? শিয়াদের মধ্যে কয়েকটি মাজহাব হলো কী কারণে? এটা হয়েছে এই কারণে যে ইসলামে এই অপশনটা আছে।

সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন মতামতকে মানতে হবে। এইখানে বিভিন্ন মত-পথের স্বীকৃতি আমাদের দিতে হবে। বিশ্বব্যাপী ইসলামের যে সংস্কৃতি তার তো একেক দেশের একেক সংস্করণ। ইন্দোনেশিয়ার ইসলামী সংস্কৃতি রূপে রসে রঙে একই সাথে ইসলামীও হবে, ইন্দোনেশিয়ানও হবে এবং তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। সংস্কৃতির ভিতর যদি সুস্পষ্ট ইসলাম বিরোধী কোনো মূল উপাদান না থাকে তাহলে তা ইসলামী সংস্কৃতি হতে বাধা নেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তেমনিভাবে তা মরোক্কো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও। প্রত্যেকটার নিজের রঙ হবে। আমার মনে হয় এটা অনেকটা এরকম হবে যে একই বাগানে ইসলাম তার মধ্যে একশটি ফুল গাছ। এই বিষয়গুলো ইসলামী সংস্কৃতি কর্মীদের ভেবে দেখা দরকার। এই বিষয়টি বিচার করে দেখা দরকার।

সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সংস্কৃতিই তার অন্যতম পরিচয়। নতুন পরিচয় গড়ে তোলা কঠিন। মানুষ পরিচয় ছাড়া চলতে পারে না। তাই হঠাৎ করে নতুন আইডেন্টিটি সে গড়ে তুলবে কিভাবে? তার পুরাতন পরিচয় রাখতে হবে। শুধু ততটুকু বাদ দিতে হবে যতটুকু মানবতার জন্য ভালো নয়। যেটুকু সৌন্দর্যের বাইরে, অশ্লীলতায় ভরা এবং ইসলামের ক্ষেত্রে শিরক রয়েছে অথবা ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী, সেটুকু বাদ দিয়ে বাকিটুকু রাখাটাই তার দায়বদ্ধতা।

  • বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য

বিশ্বায়ন বর্তমান বিশ্বে একটি মেজর ঘটনা। সেটা মূলত ঘটেছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে। একথা ঠিক যে আজ ভ্রমণ সহজ হয়ে গেছে। কিন্তু ভ্রমণ সহজ হলেও কত লোকই বা ভ্রমণ করে। বড়জোর পাঁচ ভাগ। আমেরিকার কথা বলি, বছরে কতজন তারা বাইরে ভ্রমণে যায়? খুবই কম। এই যদি হয় তাহলে বিশ্বায়ন যেটা হচ্ছে তা ভ্রমণের কারণে নয়। এটা হচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়া ডেভেলপমেন্টের কারণে। সারা বিশ্বেই আমরা ভ্রমণ করছি, কিন্তু শারীরিকভাবে ভ্রমণ করছি না। আমরা মন, চোখ, কান দ্বারা ভ্রমণ করছি। আমরা তার গন্ধ পাচ্ছি। এই নতুন ভ্রমণের কারণে বিশ্বে একটা নীরব যোগাযোগ ও লেনদেন চলছে। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী কল্যাণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। অকল্যাণও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে উভয় দিকের সম্ভাবনাই রয়েছে।

এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোতে সংস্কৃতি কতটা ভিন্ন থাকবে বলা মুশকিল। আমার মনে হয় সংস্কৃতির অনেক কিছু এক হয়ে যাবে। যেমন পোশাক-আশাক বিশ্বব্যাপী ক্রমেই কাছাকাছি চলে আসতে পারে। এটা অসম্ভব নয়। স্বীকার করতে হবে ইতোমধ্যেই পুরুষ পোশাকের ক্ষেত্রে শার্ট প্যান্ট প্রায় এক হয়ে গেছে। যদিও নারী পোশাকের ক্ষেত্রে ঠিক অন্যরকম হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে তো নারীর পোশাক নানাভাবে অন্যরকমই রয়ে গেছে। ফলে আমি মনে করি অনেক ক্ষেত্রে কাছাকাছি আসলেও যে সব ক্ষেত্রে এক হবে না সেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন থেকে যাবে। যেমন খাওয়া দাওয়ার উপকরণাদি একেক জায়গায় একেক রকম থেকে যাবে। আবার প্রত্যেক এলাকার নিজস্ব গানের সুর আলাদা থেকে যাবে। প্রত্যেক এলাকার নিজস্ব প্রকৃতি, নদী, সমুদ্র, বন, ফসল, মাঠ আছে। তার আলাদা একরকম সুর আছে। সুতরাং গানে, সংগীতে এ পার্থক্য থেকে যাবে। প্রত্যেক এলাকার জনগোষ্ঠীর নিজস্বতার জন্য এবং অন্য জনগোষ্ঠী ও এলাকার ভিন্নতার জন্য সাহিত্যেও একটা পার্থক্য থেকে যাবে।

সংস্কৃতির একটি নিয়ামক হলো ধর্ম বা বিশ্বাস। এটা এক অর্থে সংস্কৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। সে নিয়ামকের আলাদা বৈশিষ্ট্যের জন্য সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য থেকেই যাবে। হতে পারে, শত সংস্কৃতি না থাকতে পারে, কিন্তু অন্তত পাঁচ-দশটি সংস্কৃতি বিশ্বে থেকে যাবে। তবে ভবিষ্যতে কী হতে যাচ্ছে তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কিন্তু অনেক দিকেই ঐক্য বাড়বে। সাংস্কৃতিক ঐক্য বাড়বে। অনেক বেশি পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়বে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই পার্থক্যও থেকে যাবে। এখানে আগ্রাসন (aggression) ও ইন্টারাকশনকে (interaction) যদি এক না করে পার্থক্য করতে পারি তাহলে ভালো হবে। ইন্টারাকশনকে আমরা পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বা লেনদেন বলি, আর আগ্রাসন হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে চাপিয়ে দেয়া। আমাদেরকে অবশ্যই পরিকল্পিত চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে হবে। ‘লা ইকরাহা ফিদ দিন’-এ ভিতরও এ তাৎপর্য রয়ে গেছে। রাসূলও (স.) ইহুদীদের সাথে প্রথম চুক্তিতেই সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা দিয়ে দিলেন। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা দিয়ে দিলেন। এটা এই প্রমাণ করে যে সংস্কৃতিকে জোর করে বদলে দেয়া ইসলামও নয় মানবতাও নয়। এখানে আমাদের আগ্রাসনের ব্যাপারেও এ দিকটি খেয়াল রাখতে হবে।

পাশ্চাত্যের কালচার দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও বস্তুবাদের উপর ভিত্তিশীল। বস্তুবাদ হলো ভোগবাদ এবং স্বার্থপরতা। তার কারণেই কালচার খুব নোংরা হয়ে গেছে। কালচার নারী কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নারীর অপব্যবহার কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এটাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবার যে প্রবণতা তা রুখতে হবে। এটাকে রুখতে পশ্চিমাদের মধ্যে যারা ভালো তাদেরকেও উৎসাহিত করতে হবে। পশ্চিমা বস্তুবাদ নাস্তিকতা না হলেও নাস্তিকতার কাছাকাছি। এটার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। এই বস্তুবাদ মানবতার জন্য কল্যাণকর নয়।

  • বিনোদনের সংস্কৃতি

সংস্কৃতির বাইরে কোনো মানুষ হতে পারে না। সমাজ হতে পারে না। তাই তার পক্ষে সংস্কৃতি বিমুখ হওয়া সম্ভব নয়। তবে সুশিক্ষার অভাবে দারিদ্র্যের কারণে কিছু লোক যদি অপরাধী হয়ে যায়, তাহলে তার সংস্কৃতি হয়ে যাচ্ছে কুসংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি। আবার প্রত্যেকেরই ব্যক্তিগত একটি সংস্কৃতি আছে। কেউ দেশের গান পছন্দ করে, কেউ হামদ-নাত পছন্দ করে। এটা হলো একটি দিক। আর গান-বাজনা হলো কালচারের বাইরের একটি দিক। যদিও এগুলোই বেশি, তারপরও এসব কিছু কালচারের মূল দিক নয়। কালচারের মূল দিক হচ্ছে জীবনাচার, পুরো জীবন। প্রত্যেকটি কথা, প্রত্যেকটি উচ্চারণ, প্রত্যেকটি বক্তব্য, প্রত্যেকটি চলাচল, ভ্রমণ, কখন সবকিছু হচ্ছে তার কালচার। আমরা খুব গভীরভাবে না দেখার কারণে গান, নাচকেই বড় ভেবে এসব বিষয়কে ছোট ভাবি। কিন্তু এগুলো না থাকলেও একটি জাতির পক্ষে সংস্কৃতিবান হওয়া সম্ভব। এগুলো বাদ দিয়েও জাতি সংস্কৃতিবান হতে পারে। অনেক জাতিই আছে যাদের গান খুব পপুলার নয়, নাচ নেই- তাতে কিছু আসে যায় না।

আমরা বিনোদনের নামে যা খুশি তাই করতে পারি না। জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিনোদন। বিনোদন প্রয়োজন। আধুনিক বিশ্বে বিনোদনকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষের দৈনিক জীবনের একটা বড় অংশ রাস্তায় চলে যায়। তার সাথে অফিসের সময়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষ ব্যস্ত। এ অবস্থায় তার জন্য অবশ্যই একটা সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিনোদনকে সুস্থ হতে হবে। অসুস্থ হওয়া যাবে না। অশ্লীল হওয়া যাবে না। কু-স্বভাব সৃষ্টি করে, ক্রাইম ছড়ায় এমন কিছু করা যাবে না। খারাপ যা খুব কম ঘটে তাকে নাটকে এনে জাতিকে জানাতেই হবে তা আসলে জরুরি নয়। সাহিত্যের নামে যেটা করা হয়- একটি পরিবারের দুর্ঘটনাকে গোটা জাতিকে জানানো হয়। তা যদি সুন্দর কিছু হতো তাও কথা ছিল।

আসলে বিনোদনের মধ্যে একটা সীমা থাকতেই হবে। আইনের মাধ্যমে এবং কাস্টমসের মাধ্যমে। এ ব্যাপারে স্বাধীনতার নামে আমরা কদাচারকে অনুমোদন করতে পারি না। আমরা এমন স্বাধীনতা চাই না যে স্বাধীনতা মানুষকে অমানুষ করে দেয়।

১২৮৭ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান (১৯৩৯ – ২০২১) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইসলামী দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ সেবক। তিনি বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং ধারার পথিকৃৎ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের প্রথম সারির ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দি ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। এর বাইরে তিনি দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানসহ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য ছিলেন।
শাহ আব্দুল হান্নান ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছেনঃ
১। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা
২।ইসলামী অর্থনীতি দর্শন ও কর্মকৌশল
৩।নারী সমস্যা ও ইসলাম
৪।নারী ও বাস্তবতা
৫।সোস্যাল ল অব ইসলাম
৬।দেশ সমাজ ও রাজনীতি
৭।বিশ্ব চিন্তা
৮।সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম
৯।উসুল আল ফিকহ
১০। ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি
১১। আমার কাল, আমার চিন্তা
Picture of শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান

শাহ আব্দুল হান্নান (১৯৩৯ – ২০২১) ছিলেন একজন বাংলাদেশী ইসলামী দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, লেখক, অর্থনীতিবিদ ও সমাজ সেবক। তিনি বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও ব্যাংকিং বিভাগের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংকিং ধারার পথিকৃৎ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এর চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশের প্রথম সারির ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দি ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড এর চেয়ারম্যানও ছিলেন। এর বাইরে তিনি দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানসহ দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সদস্য ছিলেন।
শাহ আব্দুল হান্নান ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছেনঃ
১। ইসলামী অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা
২।ইসলামী অর্থনীতি দর্শন ও কর্মকৌশল
৩।নারী সমস্যা ও ইসলাম
৪।নারী ও বাস্তবতা
৫।সোস্যাল ল অব ইসলাম
৬।দেশ সমাজ ও রাজনীতি
৭।বিশ্ব চিন্তা
৮।সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম
৯।উসুল আল ফিকহ
১০। ল ইকনোমিক অ্যান্ড হিস্টোরি
১১। আমার কাল, আমার চিন্তা

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top