১৮৫৬ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বিলাত থেকে আমদানি করে এনফিল্ড রাইফেল। এই রাইফেলে যে কার্তুজ ব্যবহার করা হতো তার গায়ে দেওয়া হত চর্বির একটা বিশেষ প্রলেপ। এই চর্বির প্রলেপ দেবার কারণ ছিল, কার্তুজ যাতে পানিতে ভিজে নষ্ট না হতে পারে। এই কার্তুজ এনফিল্ড রাইফেলে ভরবার আগে ওই চর্বির আবরণ দাঁত দিয়ে কেটে ফেলে দিতে হতো। জানাজানি হয়, ওই চর্বির আস্তরণ প্রস্তুত করা হয় শূকর ও গরুর চর্বি মিশিয়ে। মুসলমান সৈন্যরা এটা জেনে ক্ষুব্ধ হন, কারণ শূকর তাদের ধর্মে খাওয়া নিষিদ্ধ (হারাম)। অন্যদিকে হিন্দু সৈন্যরাও এটা জেনে ক্ষুব্ধ হন, কারণ গো-মাংস তাদের ধর্মে খাওয়া নিষিদ্ধ। গো-চর্বি তাই তারা দাঁতে কাটতে পারেন না। প্রথমে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এই কার্তুজ ব্যবহারের অস্বীকৃতি জানান সৈন্যরা। পরে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৯ মার্চ বারাকপুর সেনানিবাসে মঙ্গল পাণ্ডে নামে একজন ব্রাহ্মণ সৈনিক প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেন। তার সঙ্গে যোগ দেন আরও কয়েকজন ব্রাহ্মণ সৈন্য। এভাবেই বাংলায় প্রথম শুরু হয় সিপাহি অভ্যুত্থান। অবশ্য এই সৈন্যরা বাঙালি ছিলেন না। প্রথমে এই বিদ্রোহের কারণ ছিল ধর্মীয় আবেগ। কিন্তু পরে এই বিদ্রোহ পরিগ্রহ করে রাজনৈতিক রূপ। প্রথমে সৈন্যদের মধ্যে কোনো পরিকল্পনা ও সংগঠন ছিল না। কিন্তু বিদ্রোহ আরম্ভ হলে তা গড়ে উঠতে শুরু করে। কেবল তাই নয়, উত্তর ভারতের বড় বড় শহরের সর্বসাধারণ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে সিপাহিদের। সিপাহি অভ্যুত্থান উত্তর ভারতের বড় বড় শহরে গ্রহণ করে গণআন্দোলনের বিশিষ্ট রূপ।

 

১৮৫৭ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ছিল ২,৩৮,০০০ সৈন্য। এদের মধ্যে ৩৮,০০০ ছিল ইউরোপীয় সৈন্য। বাদবাকি ছিল এই উপমহাদেশের। এসময় ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে ১৩,০০০ ছিল পাঞ্জাবে। বাংলা ও মিরাটের মাঝামাঝি অঞ্চলে কোনো ইউরোপীয় সৈন্য ছিল না। বারাকপুরে যে সৈন্যরা প্রথম বিদ্রোহ করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছিলেন উত্তর-ভারতের হিন্দিভাষী ব্রাহ্মণ। যারা গরুর চর্বি দাঁত দিয়ে কেটেছেন জেনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বাংলা থেকে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে উত্তর-ভারতের নানা জায়গায়। বিদ্রোহীরা দিল্লি দখল করে ৮৬ বছর বয়স্ক নাম মাত্র মোগল বাদশা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে দেশের প্রকৃত বাদশা বলে ঘোষণা করেন। অর্থাৎ সিপাহিদের মাথায় যেকোনো রাজনৈতিক বুদ্ধি ছিল না, তা নয়। বাংলাদেশে এই বিদ্রোহ তেমন জোরালো না হলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম ও শ্রীহট্টে হতে পেরেছিল। চট্টগ্রামে এই বিদ্রোহ হতে পেরেছিল ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে। ১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকায় সিপাহিরা বিদ্রোহ করেন। সিপাহি বিদ্রোহ দমিত হয়েছিল, কিন্তু তখনকার বিশ্বের সবচেয়ে বড় কোম্পানি, ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ভেঙে পড়েছিল। তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সরাসরি ব্রিটেনের রাজত্ব। মহারানি ভিক্টোরিয়াকে ঘোষণা করা হয়েছিল ভারত সম্রাজ্ঞী। শেষ মোগল বাদশা বাহাদুর শাহ (দ্বিতীয়)-কে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহের আগেই অপসারণ করে। কিন্তু ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহিরা দিল্লি অধিকার করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ফের সম্রাট বলে ঘোষণা করেন। পরে ইংরেজরা পুনরায় দিল্লি অধিকার করে বাহাদুর শাহকে বন্দী করে। এবং নামমাত্র বিচার করে তাকে রেঙ্গুনে নিয়ে গিয়ে কারারুদ্ধ করে রাখে। সেখানে বন্দী অবস্থায় ৮৬ বছর বয়সে ঘটে তার মৃত্যু।

পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তার The Discovery of India বইতে বলেছেন, এই বিদ্রোহ ব্রিটেনের বিরুদ্ধে এ দেশবাসীর কোনো দেশপ্রেমের অভ্যুত্থান ছিল না। এর পিছনে ছিল না কোন গণসমর্থন। এটা ছিল একটা সামন্তবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ষড়যন্ত্রেরই ফল। কিন্তু আধুনিক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সিপাহিদের পক্ষে ছিল বিরাট গণসমর্থন। আর এই অভ্যুত্থানকে বলা চলে না একটি প্রতিক্রিয়াশীল সামান্ততান্ত্রিক ষড়যন্ত্রেরই ফল। কেননা, সে সময়ের অধিকাংশ সামন্ত এই অভ্যুত্থানে কোনো অংশগ্রহণ করেননি। উপরন্ত, করেছেন কোম্পানীর শাসকদেরই সাহায্য সহযোগিতা। তখনকার বাংলায় যাদেরকে ধরা হতো প্রগতিশীল শক্তি হিসাবে, তারা অবশ্য সকলেই সমর্থন করেছিলেন কোম্পানির রাজত্বকে। কিন্তু উত্তর-ভারতের বড় বড় শহর, দিল্লি, আগ্রা, এহলাবাদ’ কানপুর, লাখৌ শহরে সর্বসাধারণ এসে দাঁড়িয়েছিলেন সিপাহিদের পাশে। কলকাতা শহর তখন ছিল সারা ভারতের রাজধানী। এখানে হিন্দু বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বিশেষভাবেই গ্রহণ করেছিলেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ। কবি ঈশ্বরগুপ্ত ১৮৫৭ সালের ২০ জুন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লেখেন,

জয় জয় জগদীশ, জগতের সার।

লহ লহ লহ নাথ, প্রণাম আমার ॥

করি এই নিবেদন, দীন দয়াময়।

বাঞ্ছা ফল পূর্ণ কর, হয়ে বাঞ্ছাময় ॥

চিরকাল হয় যেন, ব্রিটিশের জয়।

ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী, স্থির যেন রয় ॥

বিদ্রোহী সিপাহীগণ, করি নিবেদন।

ছাড় দ্বেষ রণবেশ কর সম্বরণ ॥

কার কথা শুনে সবে, সেজেছ সমরে?

পিপীলিকার পাখা উঠে, মরিবার তরে ।

এখনই ছেড়ে দেও, মিছে ছেলে খেলা।

আকাশের উপরেতে, কেন মার ঢেলা ॥

 

সিপাহি অভ্যুত্থান হিন্দু অথবা মুসলমান সিপাহিদের অভ্যুত্থান ছিল না। এটা ছিল সিপাহিদের একটা মিলিত অভ্যুত্থান। কিন্তু যেহেতু সিপাহিদের মধ্যে সংখ্যায় মুসলমানরাই ছিলেন বেশি, তাই এর চেহারাটা উত্তর-ভারতের অনেক জায়গায় হয়ে উঠেছিল কিছুটা মুসলমানী। বাংলাদেশে মুসলমানরা যাতে সিপাহি অভ্যুত্থানে কোনো অংশগ্রহণ না করতে পারে, সে জন্য ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করে ১৮৫৭ সালে তাকে জেলে রাজবন্দী রূপে রাখা হয়। ১৮৬০ সালে বাহাদুরপুরে হয় তার মৃত্যু। ১৮৫৭-এর সিপাহি অভ্যুত্থান মুসলিম অভ্যুত্থান ছিল না। কিন্তু ভারতে ১৯৫৭ সালে এর শতবার্ষিকী পালন করা হয় না। অনেক হিন্দু বুদ্ধিজীবী বলেন, এটা ছিল একটা মুসলিম ষড়যন্ত্র। এর লক্ষ্য ছিল মুসলিম বাদশাহীকে ফিরিয়ে আনা। যে জন্য দিল্লি দখল করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ঘোষণা করা হয়েছিল, হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে। কিন্তু এটা করা হয়েছিল শাসনতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখার জন্য। কারণ, মোগল বাদশাহী ছাড়া দিল্লিতে তখন আর কোনো বাদশাহী ছিল না। তাই বলা চলে না, এটা ছিল একটি মুসলিম ষড়যন্ত্র। কিন্তু ১৯৫৭ সালে সাবেক পাকিস্তানে সিপাহি অভ্যুত্থানের শতবার্ষিকী পালিত হয়েছিল। ঢাকায় রানি ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম বদলিয়ে রাখা হয়েছিল বাহাদুর শাহ পার্ক। যে নাম আজও বদলানো হয়নি। এই দিনটি উপলক্ষে ঢাকায় করা হয়েছিল মিছিল, সভা- সমাবেশ।

৮৯৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top