শিক্ষা (জ্ঞান ও আখলাক) আন্দোলনের ভিত্তি নির্মাণে শাহীদ ইনসান হিসেবে আমাদের করণীয়

প্রতিটি সৃষ্টিকেই মহান আল্লাহ কিছু প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বা ফিতরাত দিয়েছেন। এ অনুসারে মানুষেরও ফিতরাত রয়েছে। যেমন– মানুষ ক্ষুধা লাগলে খাবার খায়, ঘুম পেলে ঘুমায়, আবার জাগ্রত হয় ৷ একইভাবে মানুষের ফিতরাত হলো সে জানতে চায়, সে অন্বেষী হয়ে জানে ও শুনে। এটি মানুষের খুব সাধারণ একটি ফিতরাত। কিন্তু গত কয়েকশো বছরে সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থার আগ্রাসন এবং মুসলমানদের ব্যর্থতার দরুণ আমরা জ্ঞানকে সেভাবে তুলে ধরতে পারছি না। ফলশ্রুতিতে মানুষ জানার সুযোগও পাচ্ছে না। এই আগ্রাসন জ্ঞানকে পুজিঁর স্বার্থে বা পণ্য হিসেবে ব্যবহার করায় জ্ঞান তার সত্যিকারের রূহকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারছে না।
একইভাবে বর্তমান শিক্ষা কাঠামো আমাদেরকে কোম্পানির দাস বা তাদের সিস্টেমের গোলাম হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। সেই লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে দিয়ে কিছু তথ্য বা অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে জ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে, ফলে জ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়। আর এ কারণে ফিতরাত থাকা সত্ত্বেও মানুষ এ বৈশিষ্ট্যকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছে না।
ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে যে বিষয়টি আমাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে, তা হলো পৃথিবীর ইতিহাসে ইসলামী সভ্যতাই একমাত্র সভ্যতা যা জ্ঞানার্জনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে এবং জ্ঞানার্জনের পরেই মানুষের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা তথা খাদ্য, বাসস্থান এবং অর্থনৈতিক মুক্তিকে গুরুত্ব দিয়েছে। এ সকল বিষয়ে এত গুরুত্বারোপ করার কারণে প্রতিটি যুগেই মানুষ ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলো।
ইসলামী সভ্যতাই জ্ঞান অন্বেষণ ও গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করেছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এর জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থায়ন করেছে। ফলে শুধু মুসলমানরাই নয়, অন্যান্য ধর্মাবলম্বী বা জাতিগোষ্ঠীও এর দ্বারা উপকৃত হয়েছে এবং মুসলিম উম্মাহ ইসলামী সভ্যতাকে জ্ঞানভিত্তিক একটি সভ্যতা হিসেবে মানুষের সামনে হাজির করতে পেরেছে।
আমরা যদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসে মুসলিম উম্মাহর ক্রান্তিকালের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো যে, বর্তমানে দুইটি সভ্যতা বিদ্যমান।
– পাশ্চাত্য সভ্যতা
– ইসলামী সভ্যতা।
পাশ্চাত্য সভ্যতা তার শক্তি বলয়ে বিশ্বব্যবস্থাকে পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করছে এবং পরিচালনাকারী শক্তি হিসেবে তারা তাদের চিন্তাধারাকে সকল স্তরে প্রয়োগ করছে। ফলশ্রুতিতে তাদের আইডিওলজি বর্তমানের ক্ষমতাসীন আইডিওলজি এবং এটিকে সবচেয়ে শক্তিশালী আইডিওলজি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। আর এ আইডিওলজি জ্ঞানকে ব্যবহার করে শোষণ ও ক্ষমতার জন্য, এ জ্ঞান দর্শনের ডায়লগই হলো knowledge is power, অর্থাৎ জ্ঞানের মধ্য দিয়ে তারা শক্তি অর্জন করবে ও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অপরদিকে মুসলমানদের জ্ঞানের উদ্দেশ্য হলো হাকীকত অন্বেষণ, আমানতের সংরক্ষণ এবং মানব সভ্যতার কল্যাণ। সুতরাং স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে, ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে গিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা নিজস্ব জ্ঞান দর্শনকে নিজেদের স্বার্থ বা পুজিঁবাদী আগ্রাসন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যবহার করে থাকে৷ ফলশ্রুতিতে মানুষ পাশ্চাত্যের শিক্ষা কাঠামো থেকে কথিত জ্ঞানার্জন করলেও তাদের তৈরিকৃত সিস্টেমের গোলাম হিসেবে বা কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে নিজেদের তৈরি করা ব্যতীত ভিন্ন কিছু অর্জন করতে পারে না। তাদের দৃষ্টিতে জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যই যেন মুখলেস ও আন্তরিক দাস হয়ে, আধুনিক কোম্পানির কর্মচারী হয়ে সুন্দর ফ্ল্যাটে বসবাস করা। এর ফলাফল স্বরূপ মুসলমানরা ভুলেই গিয়েছে যে, জ্ঞান দিয়েই আসমানী কিতাব কোরআনের যাত্রা শুরু হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (স) জ্ঞান দিয়েই মানবতার মুক্তি সংগ্রামের সূচনা করেছেন, আল্লাহ পাক আমাদের শিখিয়েছেন কোরআনের সবচেয়ে ওজনদার দোয়া “রাব্বি যিদনি ইলমা”। এ সবকিছুর মর্মার্থ আমরা মুসলমানরা ভুলে গিয়েছি। সব মানুষ তার স্বাভাবিক ফিতরাত হিসেবেই, জ্ঞান অর্জন করতে চাইছে তথা জানতে চাইছে, মুসলমানদের আবেগ সেই জ্ঞানের দিকেই বারবার ধাবিত হচ্ছে, কিন্তু এ আবেগকে আমরা বাস্তবে রূপ দান করতে পারছি না। এটি আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা।
একইসাথে যদি লক্ষ্য করি, মুসলিম উম্মাহর সদস্য প্রায় ২০০ কোটি, যা পৃথিবীর জনসংখ্যার ৩০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে, যে ৩০ শতাংশ সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন না করলে গোটা মানব সভ্যতা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়, ৪০০ কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের দিকে তাকালেই যা বুঝা যায়। এজন্য সর্বপ্রথম আমাদের দায়িত্ব ছিলো মুসলমান হিসেবে, শাহীদ ইনসান হিসেবে ইসলামকে, সত্যিকারের জ্ঞান দর্শনকে বিশ্ববাসীর সামনে, মুসলিম উম্মাহর সামনে তুলে ধরা। কারণ মুসলমানদের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যই হলো শাহীদ উম্মাহ হিসেবে মানুষের সামনে এই সত্যকে তুলে ধরবে। কিন্তু এক্ষেত্রেও আমরা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছি।
প্রশ্ন আসে, “কেন আমরা পারছি না?” বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি যুবকদের অধিকাংশের মধ্যেই যে সংশয়টি বিরাজ করছে, তা হলো এ চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, জ্ঞানচর্চা কি আদৌ মানুষ গ্রহণ করবে? আদৌ কি মানুষের কাছে তা পৌঁছাবে? কী হবে এসব চর্চা আর প্রচেষ্টা দিয়ে?
এর মানে হলো আমরা ভুলেই গিয়েছি যে, এটি মানুষের স্বাভাবিক ফিতরাত। ভুলে যাওয়ার কারণ কী? কারণ আমাদের কাছে জ্ঞানার্জনকে চাপিয়ে দেওয়া বস্তুবাদী গাধার বোঝার মতো মনে হয়, আর সার্টিফিকেট অর্জনকেই জ্ঞানের সফলতা, জীবনের স্বার্থকতা মনে হয়।
মুসলিম উম্মাহর সদস্য হিসেবে আমাদের মনে রাখা আবশ্যক যে, এ সকল চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, জ্ঞান চর্চা সরাসরি মানুষের ফিতরাতের সাথে সম্পৃক্ত। আমরা যদি এটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারি, তাহলে মানুষ তা গ্রহণ করবেই। এছাড়া ভিন্ন কোনো পথ মানুষের সামনে খোলা নেই।
দ্বিতীয়ত, জ্ঞান ও চিন্তার নিজস্ব ডানা রয়েছে। এ ডানা মূলত মানুষকে মুক্তির দিকে ধাবিত করে। বর্তমান মানবসভ্যতা একটুখানি মুক্তির জন্য হাহাকার করছে। সুতরাং আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার মাধ্যমে আমাদের চিন্তা-বিশ্বাসকে আমলী ও নাজারী দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরতে পারি, তাহলে অবশ্যই মানুষ তা গ্রহণ করবে। আর এটি তুলে ধরা মুসলমানদের দায়িত্ব। এ সময়ে শাহীদ ইনসান হিসেবে এ দায়িত্ব আমাদেরই। কারণ আজকের বাংলাদেশের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, অস্থিরতা, কর্তৃত্ববাদীতা, শোষণ, জুলুম, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সংঘাত, মানবাধিকার লংঘন, নারীদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অনগ্রসরতা, পাশ্চাত্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের উপর নির্ভরশীলতা– এভাবে প্রতিটি মানবিক সমস্যার সারনির্যাস আমাদের সামনে বিদ্যমান। এ সকল সমস্যা থেকে মুক্তির অন্যতম ওসিলা হলো জ্ঞানতাত্ত্বিক সচেতনতা। আর জ্ঞানতাত্ত্বিক সচেতনতাই আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতার দিকে ধাবিত করবে। আমরা যদি জ্ঞানকে সেই অর্থে তুলে ধরতে পারি, তাহলে মানুষও তা গ্রহণ করবেই।
এরপর যে আলোচনাটি আমাদের সামনে আসে, তা হলো আমাকেই কেন করতে হবে? এর সবচেয়ে বড় জবাব হলো একজন মুসলমান হিসেবে এ যুগে খেলাফতের দায়িত্ব পালনের কাজ আমাকেও শুরু করতে হবে, মুক্তির আওয়াজ আমাকেও তুলতে হবে। কেননা প্রতিটি যুগেই কেউ না কেউ এই আওয়াজ তুলে ধরেন, আযান দিয়ে যান। কোনো না কোনো গ্ৰুপ এজন্য সংগ্ৰাম করে যায়। আমরাও যদি বর্তমান যুগের প্রেক্ষিতে ব্যক্তি হিসেবে কিংবা জনগোষ্ঠীর সন্তান হিসেবে নিজেদের সে অর্থে তুলে ধরতে পারি, তাহলে এটিই আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। এজন্য আল্লামা রাগেব ইস্পাহানি বলেছেন, “আমরা যদি দুনিয়া ও আখিরাতে সুখী হতে চাই এবং পৃথিবী বিনির্মাণ করতে চাই, তাহলে আমাদেরকে এ দায়িত্বটি পালন করতেই হবে। এবং মুসলমান হওয়ার কারণে আমরাই এ দায়িত্ব পালন করবো, পালন করে যাচ্ছি।” তাই আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেকে এ সংগ্ৰামের দিকে ধাবিত করা আমাদের আবশ্যকীয় কর্তব্য।
এরপর প্রশ্ন আসবে, এত বিশাল সংকট, দারিদ্র্য, বঞ্চনা, জুলুম-শোষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে উত্তরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটিয়ে এক সমৃদ্ধশালী দেশ গঠন করার জন্য আসলেই আমাদের অবস্থান থেকে কী কী করা প্রয়োজন? এক্ষেত্রে সবচেয়ে সুন্দর জবাব হলো–
– ইসলামী সভ্যতার চৌদ্দশো বছরের ইতিহাসকে ধারণ করে, সে মুকতাসাব আকলকে সামনে রেখে এ সকল সংকটের চ্যালেঞ্জ গ্ৰহণ করতে হবে।
– শত্রুর সাজে সজ্জিত হতে হবে (অর্থাৎ শত্রুর সকল কর্মপরিকল্পনা বুঝে তার আক্রমণ মোকাবেলা করার ও বিজয়ী হওয়ার শক্তি অর্জন করতে হবে), তাদের বিপরীতে সবোর্চ্চ কার্যকরী শক্তি অর্জন করে এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নতুন এক জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটাতে হবে।
তাই চিন্তাগত দিক থেকে আমাদেরকে যে বিষয়টি সব সময় স্মরণ রাখতে হবে, তা হলো আমাদের আইডিওলজিক্যাল দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের মদদপুষ্ট বিভিন্ন চিন্তাধারা ইসলামের দুটি বিষয়ের উপর চরমভাবে আক্রমণ করেছে। বিষয়গুলো হলো–
— তরিকত বা তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতা
– ফিকহ
এই দুটি বিষয়ে আক্রমণ করার ফলে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক রূহকে যেমন হারিয়ে ফেলেছি, তেমনি আমাদের ব্যবস্থাগত সংকট মোকাবেলা করার অস্ত্রও হারিয়ে ফেলেছি।
সেটি‌ কীভাবে?
প্রথমত তরিকত বা তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতা-
প্রথমত তরিকত বা তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতার প্রসঙ্গে আসা যাক। আমরা যদি আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকাই, যেমন– আলজেরিয়া, সেখানে ফ্রান্সের শোষণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ কারা গড়ে তুলেছিলো? সূফীগণ, খানকাভিত্তিক আন্দোলনসমূহ। রাষ্ট্রব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে চলে যাওয়ার পরে সংগঠিত শক্তি হিসেবে এ আধ্যাত্মিক আন্দোলনগুলো, তরিকতপন্থী সূফী ও আলেমগণ মুক্তির সংগ্ৰামের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এ সংগ্রামের বার্তা তুলে ধরেছেন।
এভাবে প্রতিটি অঞ্চলেই এর নজির দেখতে পাওয়া যায়। তাই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এ আধ্যাত্মিক খানকা, দরগাহগুলোর বিরুদ্ধে নিউ সালাফিজমের মাধ্যমে, ওহাবিজমের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ফতোয়া দেয় এবং এটিকে ভিন্ন দিকে ধাবিত করে। বিশেষ করে গত কয়েক দশকে তারা খুব ভালোভাবেই এক্ষেত্রে সফলতা পেয়েছে। নানাবিধ প্রচারণার মাধ্যমে তরিকতের ব্যাপারগুলোকে সব সময়ই নেতিবাচক, হারাম, কুসংস্কার ও বিদআতের অর্থে যুবশ্রেণির সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। হ্যাঁ! বর্তমানে হাকীকতপন্থী তরিকত, দরগা, খানকার খুব অভাব লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এ জাতীয় নেতিবাচক প্রোপাগান্ডার কারণে আমরা আধ্যাত্মিকতা, হাকীকতপন্থী তরিকত, খানকা ও দরগাকে গুরুত্ব না দিয়ে একটি রূহবিহীন কাঠখোট্টা ধর্ম চর্চার দিকে ধাবিত হয়েছি।‌
দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় হলো ফিকহ-
ফিকহের উপর এত আক্রমণ কেন হলো? কারণ আমাদের সভ্যতার সবকিছু ফিকহ নির্ভর। আমাদের কাছে যদি জীবন্ত একটি ফিকহ থাকে, তবে ব্রিটিশরা, ফরাসিরা কিংবা সাম্রাজ্যবাদী কোনো শক্তিই তাদের জুলুম, শোষণ দীর্ঘস্থায়ী করতে পারবে না। ফিকহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি যদি সচল থাকে, তারা কখনোই পূঁজিবাদী আগ্রাসনকে মানবতার সামনে নিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের অর্থনীতির সাথে সমাজতত্ত্বকে যদি আমরা ভালোভাবে দাঁড় করাতে পারি, তাহলে তাদের চাপিয়ে দেওয়া সোশিওলজি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হতে পারবে না, রাজনীতির মাইলফলক হতে পারবে না, এটি অসম্ভব। তাই তারা ফিকহকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রসহ সকল ক্ষেত্রে ফিকহকে অপ্রাসঙ্গিক করে রেখেছে। এক্ষেত্রেও সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে তাদেরই মদদপুষ্ট নিউ সালাফিজম। তারা বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি উম্মাহর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে পর্যন্ত তারা অস্বীকার করেছে। যেমন– ইলমুল কালাম তো ভ্রান্ত জ্ঞান! দর্শন বলতে ইসলামে কিছু নেই! হাদীস থাকতে ফিকহের কেন প্রয়োজন! এভাবেই তারা ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মিরাসগুলোকে অস্বীকার করে, নব্য বিতর্কের জন্ম দিয়ে মুসলমানদেরকে ভিন্ন ব্যস্ততার দিকে ধাবিত করছে। যার ফলে পাশ্চাত্যের কঠিন চ্যালেঞ্জ, সাম্রাজ্যবাদী শোষণ মোকাবেলার পরিবর্তে আমাদের অভ্যন্তরীণ ধর্ম ও জ্ঞান চর্চাকেই আমরা সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।
এ প্রেক্ষাপট কি শুধু পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে বিরাজমান? না, এ প্রেক্ষাপট আমাদের বাংলাদেশেও বিদ্যমান। অধিকাংশ তরুণ কিংবা বিভিন্ন জ্ঞানের ধারা, বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্দোলনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, তারা তাসাউফ, আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রগুলো জানে না, ফিকহকে ভালোভাবে উপলব্ধি করে এর সামগ্ৰীকতা নিয়ে চর্চা করে না, এমনকি বড় অংশ তাসাউফ ও ফিকহকে শত্রু মনে করে, অপ্রয়োজনীয় মনে করে। তারা ফিকহের কিছু খন্ডিত অংশ পাঠ করে ফিকহকে জটিল একটি দূর্বোধ্য জ্ঞানতত্ত্ব হিসেবে লাইব্রেরীতে তুলে রাখে। এসবের মাধ্যমে যে আমরা ভয়াবহ অপরাজনীতির শিকার হচ্ছি, তা আমরা আজও উপলব্ধি করতে পারছি না।
এ দুটি বিষয়ের সাথে আরেকটি তৃতীয় বিষয় ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যখন আধ্যাত্মিকতা এবং ইসলামী সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মিরাস ও সম্পদ ফিকহকে আমরা দূরে ঠেলে দিচ্ছি, তখন খুব সহজেই ওরিয়েন্টালিস্টদের মদদপুষ্ট ইতিহাসবিদরা আমাদেরকে ইতিহাসবিহীন জাতি হিসেবে উপস্থাপন করতে পারছে। অন্যসব অঞ্চলের মতো বাংলা অঞ্চলের মুসলমানরাও ইতিহাসবিহীন জাতি হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে। আমাদের লেখকগণ, পাশ্চাত্যপন্থী শিক্ষাবিদগণ রাষ্ট্রব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের জাতিকে ইতিহাসবিহীন জাতি হিসেবে উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং আমাদের বারোশো বছরের সোনালী সভ্যতাকে, বাংলা অঞ্চলের পাঁচশো বছরের সালতানাতকে সাধারণ একটি ধর্মতাত্ত্বিক কিংবা রাষ্ট্রীয় কিছু দ্বন্দ্ব নির্ভর একটি গতানুগতিক সাধারণ ইতিহাসে রূপান্তরিত করেছে, বয়ান সৃষ্টি করেছে। এগুলোর মাধ্যমে আমরা নিজেদেরকে আত্মবিশ্বাসী করতে তো পারছিই না, বরং হীনম্মন্যতায় ডুবে যাচ্ছি। অথচ এ সভ্যতা আমাদের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। এ প্রতীক যদি সামনে না রাখি, সেভাবে যদি ইতিহাসের মেলবন্ধন তৈরি করতে না পারি, তাহলে কখনোই বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
উপরোক্ত পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে মূলত যে বিষয়টি আমরা আলোচনা করতে চাই, তা হলো- এ সকল সংকট আমাদের সবচেয়ে ভয়াবহ একটি সংকটের দিকে ধাবিত করেছে। এ সংকট হলো আমাদের সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব। সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব এ মুহূর্তে আমাদের জন্য অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।
• বিশ্বব্যাপী যে ইসলামী আন্দোলনগুলো গড়ে উঠেছিলো, বর্তমানে সেগুলো এক ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। তাদের দেখানো ভিশনকে যুব সমাজের কাছে আস্থাহীন করে রাখা হয়েছে। নানাবিধ মতভেদ, ভাঙ্গন, ইসলামপন্থীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, ইসলামী ধারাসমূহের একে অপরকে ঘায়েল করে দেওয়ার মানসিকতা ইত্যাদি যুব সমাজের সামনে ইসলামের ভিশনকে আস্থাহীন করে তুলেছে।
ফলশ্রুতিতে, এ প্রতিটি ধারাই আজ মৃত দেহের মতো পড়ে আছে। দেহের সবই আছে কিন্তু রূহ নেই। এ ভয়াবহ পরিস্থিতে আমরা ভালোভাবেই উপলব্ধি পারছি যে, মুসলমানদেরকে যদি এ রূপ বিভাজন থেকে বের করে নিয়ে এসে জ্ঞানগত বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ করা না যায়, তাহলে কখনোই মুক্তি সম্ভব নয়। ঠিক একইভাবে এ সভ্যতার অন্তর্দ্বন্দ্ব থেকে আমাদেরকে বের করে নিয়ে আসতে পারে দুটি মাত্র উপায় রয়েছে।
– আমাদের বিশ্বাস
– আমাদের জ্ঞানগত সম্পদসমূহ
আমাদের বিশ্বাস তথা ঈমানী ঐক্য সকলের মধ্যে রয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। তাই জ্ঞানগত বিষয়সমূহ নিয়ে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি, অন্য কোনো বিষয় দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। এটি ছাড়া আমরা সর্বোচ্চ একে অন্যকে শত্রু বানিয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিতে পারবো, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি কোনো বন্ধন সৃষ্টি করতে পারবো না। আর দীর্ঘ মেয়াদি বন্ধন সৃষ্টি করতে হলে হাকীকত অন্বেষী জ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই তা দাঁড় করাতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এ জ্ঞান কোন জ্ঞান? এ জ্ঞান হলো ইসলামের জ্ঞানের শাখাসমূহ।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উসূল এবং মাকাসিদ। প্রশ্ন আসতে পারে উসূল কেন প্রয়োজন? এর জবাব হলো উসূলের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ওহীর আলোকে আল্লাহ ও মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সাথে পৃথিবী ও প্রকৃতির সম্পর্ক ইত্যাদিসহ সমাজের সকল সমস্যা, কর্মসূচি এবং প্রত্যেকটি বিষয়ের সুনির্দিষ্ট মূলনীতি ও ব্যাখ্যা। সে আলোকে যদি আমরা মূল মিহওয়ারে ফিরে আসতে পারি, তাহলে অবশ্যই এ জ্ঞান আমাদেরকে ঐক্যের দিকে, মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে।
জ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি উদ্দেশ্য হলো ফিকহকে নতুন করে বিনির্মাণ। কেননা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার এ কাঠামো মানুষের স্বাভাবিক ফিতরাতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একইভাবে এ বিশ্বব্যবস্থা অন্টোলজিক্যালি, এপিস্টোমোলজিক্যালি ইসলামের সাথে ফাংশনাল নয়। তাই আমরা যদি ফিকহকে নতুনভাবে বিনির্মাণ করতে পারি, ফিকহকে উসূল এবং মাকাসিদের উপর ভিত্তি করে দাঁড় করাতে পারি, তাহলে ইসলামী সভ্যতা ইতিহাসের নানা সংকটের মধ্যেও যেভাবে পুনর্জাগরিত হয়েছিলো, একইভাবে বর্তমান সময়েও আমাদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে আমরা রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে আবার নতুন প্রস্তাবনা হাজির করতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।
এরপর গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো আমরা, বর্তমান সময়ের মুসলমানরা নানাবিধ অভিযোগ ও বিতর্কের উপর ভিত্তি করে ইসলামকে ব্যাখ্যা করে যাচ্ছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, اعتراض বা অভিযোগের উপর ভিত্তি করে কখনো নিজেদের অস্তিত্ব দাঁড় করানো যায় না। নিজেদের অস্তিত্ব যদি দাঁড় করাতে চাই, তাহলে অবশ্যই তাকলিফ তথা প্রস্তাবনা নিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু আমরা কীভাবে ইসলাম চর্চা করছি? পাশ্চাত্যের নারীবাদ যখন আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন আমরা আমাদের ইসলামের নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলছি। পুঁজিবাদী সভ্যতা যখন নানাভাবে আমাদের শোষণ করছে, তখন ইসলামী অর্থব্যবস্থার কিছুদিক নিয়ে আমরা ডিফেন্স করছি। অথচ আমাদের ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতির স্বতন্ত্র প্রস্তাবনা রয়েছে, নারীদের ব্যাপারে সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ জীবনধারা রয়েছে, রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিজীবন সর্বস্তরে আদালতের প্রস্তাবনা রয়েছে, সমাজ সংস্কৃতির ব্যাপারে ইসলামের প্রস্তাবনাও সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু সেগুলোকে আমরা বর্তমান সময়ের আলোকে তুলে ধরতে পারছি না। অথচ এ সকল প্রস্তাবনা ব্যতিত কখনোই মুক্তি আনয়ন সম্ভব নয়, যার নজির রয়েছে ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে।
সেই বাদশা নাজ্জাশির সামনে জাফর বিন আবু তালিবের প্রস্তাবনা, পারস্য সম্রাটের সামনে মুসলিম সেনাপতির প্রস্তাবনা, এভাবে প্রতিটি প্রস্তাবনার শিক্ষাকে হাজির করার মধ্য দিয়ে জাতির রূহকে উপলব্ধি করে এবং কারো বিরোধিতা কিংবা বিতর্কের জন্য নয়, বরং হক্ব বা হাকীকত হিসেবে জ্ঞানকে তুলে ধরার জন্য আমরা তাকলিফ করবো। তখন অবশ্যই সে জ্ঞান মানুষের গ্ৰহণ উপযোগী হিসেবেই জাতির সামনে উপস্থাপিত হবে‌। মানুষ তখন তার ফিতরাতের আলোকেই এ বিষয়গুলোকে গ্ৰহণ করতে থাকবে। এটিই প্রাকৃতিক ব্যাপার।
তাই আমাদের অন্যতম ইশতেহার হলো- দ্বীনে মুবিন ইসলামের মৌলিক চিন্তাসমূহকে কীভাবে যুবসমাজের চিন্তায় রূপ দেওয়া যায়, কীভাবে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাকাঠামো, শিক্ষাপদ্ধতি ও বিভিন্ন ধারার শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামী চিন্তা-দর্শনকে, ১৪০০ বছরের মূল চিন্তাধারাকে জাতির মূল চিন্তায় পরিণত করা যায়।
আর এ ইশতেহারকে বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে যে বিষয়গুলো সামনে রাখতে হবে–
১. ব্যক্তির অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ যোগ্যতা অর্জন ও ত্যাগের অন্যতম উপমা হিসেবে জাতির সামনে, পরবর্তী প্রজন্মের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে হবে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হলেন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও আখলাকবিদ নুরুদ্দিন তুপচে, যিনি ফ্রান্সের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আখলাকের উপর পিএইচডি করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার প্রস্তাবনা ফিরিয়ে দিয়ে নিজ দেশে গিয়ে সাধারণ কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। অতঃপর তিনি চিন্তাকে প্রসারিত করাসহ জাতি গঠনের জন্য প্রতি মূহুর্তে কাজ করেছেন, আমৃত্যু এর উপর নিজেকে টিকিয়ে রেখেছেন। ফলশ্রুতিতে জাতির বিকাশে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে তাকে আখ্যা করা হয়। আমরাও যদি এভাবে কাজ করতে পারি, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম সেভাবেই গড়ে উঠবে। আর কাজ করলে আল্লাহ বরকত দেন, বরকত দিবেন, ইনশাআল্লাহ।
২. জ্ঞান ও আখলাকের আন্দোলনকে খুব ভালোভাবে ধরণ করা এবং সে আলোকেই সকলের সামনে উপস্থাপন করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইমাম আবু হানিফার জ্ঞানের আন্দোলন। সেটি অনেক বড় পরিসরে হয়েছিলো, যা বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত হয়েছে। পরবর্তীতে গত কয়েকশো বছরে ভারতীয় উপমহাদেশে বড় বড় অনেক শিক্ষা আন্দোলন এখানেও গড়ে উঠেছে। যেমন– দেওবন্দি আন্দোলন (দেওবন্দি শিক্ষা কাঠামোর মডেল)। একইভাবে আলিগড় শিক্ষা আন্দোলন (যা তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম মডেল ছিলো)। এ শিক্ষা আন্দোলনগুলো শুধুমাত্র শিক্ষা আন্দোলনের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো, কিন্তু এ আন্দোলনগুলো থেকে বের হয়েছেন বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আলেম কিংবা বড় বড় আন্দোলনের কর্ণধার। বর্তমানেও জাতির সামনে তারা তারকার ন্যায় অমলিন হয়ে আছেন। এ ধরনের বহু শিক্ষা মডেল আমাদের সামনে রয়েছে।
আবার একইভাবে ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসে বড় বড় মক্তব গড়ে উঠেছে, যেমন– ইমাম গাজ্জালী, ইমাম রাযী নিজেই একটি মক্তব। এ সকল ব্যক্তি নিজেরাই একেকটি ধারায় পরিণত হয়েছেন, শিক্ষা আন্দোলনে পরিণত হয়েছেন। যেহেতু একজন ব্যক্তি একটি ধারায় পরিণত হয়েছেন, তাহলে আমরা কেন সম্মিলিতভাবে একটি শিক্ষা আন্দোলন দাঁড় করাতে পারবো না? চেষ্টা করলে আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকেও দিবেন।
৩. তালকিহুল ফুহুল, অর্থাৎ জ্ঞান ও গবেষণা কেন্দ্রিক যে আন্দোলন আমরা দাড়ঁ করাবো, তার অন্যতম দাবী হলো নিজেরা যোগ্য চিন্তাবিদ হয়ে চিন্তা তৈরি করতে হবে, অর্থাৎ চিন্তা সৃষ্টি করা এবং চিন্তাগুলোকে জাতির মনে গেঁথে দেওয়া, মানুষকে প্রভাবিত করা, সমাজের সাথে সম্পৃক্ত করা। আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত করতে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে ও স্থায়ীত্ব দান করতে এটি অন্যতম দাবি।
৪. দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে ইস্তেকামাতের উপর টিকে থাকা। আল্লাহ অবশ্যই আমাদের দিবেন এ বিশ্বাস নিয়ে টিকে থাকলে বরকত আসবেই। কখনোই তাড়াহুড়ো করা যাবে না।
৫. আন্দোলনকে জীবনের কেন্দ্রে স্থাপন করা, আর জ্ঞান ও আখলাককে আন্দোলনের কেন্দ্রে স্থাপন করা। এ জ্ঞান হতে হবে সবার জন্য উন্মুক্ত। নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ বা আটকে থাকা যাবে না, সামগ্রিক ও বৈপরীত্য মুক্ত হতে হবে। হবেও, ইনশাআল্লাহ।
৬. চ্যালেঞ্জ গ্ৰহন করা। উপমহাদেশে গত কয়েকশো বছরে বহু আন্দোলন, শিক্ষা কাঠামো, ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এগুলোর অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ হওয়ার ইতিহাস যদি বার বার আমরা সামনে রাখি, তাহলে হতাশ হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমি ব্যর্থ হবো কি সফল হবো তা এ মুহূর্তের আলোচ্য বিষয় নয়। আমি মুক্তির জন্য পথ চলছি, টিকে থাকার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছি এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে সংগ্ৰাম করে যাচ্ছি, এটিই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি অর্থবহ।
অনেক প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়েছে অন্যের সহযোগিতা নিয়ে কিংবা পাশ্চাত্যের আদলে, এর কোনোটিই আমরা গ্ৰহন করছি না। আমরা নিজেরাই দাঁড়াবো। এক্ষেত্রে শত্রুর সাজে সজ্জিত হয়ে, জামানার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে যোগ্য সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব হয়ে তাদেরকে মোকাবেলা করে মুক্তির ইশতেহারের কাব্যগাঁথা রচনা করবো– এটিই আমাদের ডায়ালগ হওয়া উচিত।
৭. নানাবিধ ব্যর্থতা, নানাবিধ সামাজিক দৈন্যতা আমাদের সামনে রয়েছে। এক্ষেত্রে স্মরণে রাখা যে, বাংলা অঞ্চলে পূর্বের কাজসমূহে চিন্তাগত যে অপরিপক্কতা ছিলো, যে মানবীয় দূর্বলতা ছিলো, সেগুলোকে পূর্ববর্তীদের দোষ হিসেবে না দেখে সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, সে আলোকে সামনে অগ্ৰসর হওয়াই আমাদের প্রধান কর্তব্য।
আমরা বর্তমান সময়ের প্রযুক্তিগত কারণে, নানাবিধ বিষয়ের বদৌলতে বহু নেয়ামত পেয়েছি, এর মধ্যে প্রধান হলো আমরা সময়ের সবচেয়ে উন্নত চিন্তা, চৌদ্দশো বছরের মুকতাসাব জ্ঞানসহ শিক্ষক ও উম্মাহর ভাইদের পাশে পেয়েছি। এ নেয়ামত আল্লাহ সবাইকে দেন না। যেহেতু আল্লাহ আমাদের এ নেয়ামত দিয়েছেন, অতএব আল্লাহ অবশ্যই সহযোগিতা করবেন। আল্লামা ইকবাল, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভিরা যেভাবে ব্যক্তি হিসেবে সারা দুনিয়াকে আন্দোলিত করেছেন, আমরা তাদের সন্তান হিসেবে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে, ক্ষুদ্র আন্দোলন হিসেবে কেন নূন্যতম অবদান রাখতে পারবো না? আল্লাহ অবশ্যই আমাদেরকেও দিবেন। এক্ষেত্রে আল্লাহর দেওয়া নজরনা হলো উমরের (রা.) এর রাষ্ট্র পরিচালনা। তার রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা বেশি দিনের ছিলো না, কিন্তু দ্বীনের রূহ, মূলনীতি, আখলাক ও রবের রহমতের বদৌলতে সেই উমর (রা.) মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে বিশাল পারস্য অঞ্চল পরিচালনা করছেন, মানবসভ্যতার সামনে এ সভ্যতাকে সবচেয়ে সফল একটি সভ্যতা হিসেবে তুলে ধরেছেন।
৮. আমরা কাজ করে যাবো। তবে সবাই সামগ্ৰীকভাবে উঠে আসবে এ রকম উচ্চাশাও করা যাবে না। আমাদের চেষ্টা, আমাদের সংগ্ৰাম, আমাদের ইখলাস ও দোয়ার মধ্য দিয়ে আল্লাহ কাউকে না কাউকে উঠিয়ে আনবেন। এটিই স্বাভাবিক। যদি আমরা পাশ্চাত্যের ক্ষেত্রেও দেখি, তারা ছয়শো বছর যাবৎ ইউরোপের দর্শন চর্চা করছে, এত কাজ করছে, তাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই আলাদা ডিপার্টমেন্ট রয়েছে, হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক গড়ে তোলার জন্য তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু গত কয়েকশো বছরে তাদের কতজন দার্শনিক উঠে এসেছে? হাতে গোনা বিশ-ত্রিশ জন দার্শনিক আমরা দেখতে পাই।
সুতরাং এত কাজের মধ্যে দিয়ে যদি তাদের মাত্র বিশ-ত্রিশ জন দার্শনিক উঠে আসে, তাহলে আমরা অল্প কাজ করে বেশি ফলাফল আশা করাটা আমাদের নিজেদের প্রতিই অবিচার করা হবে। এজন্য আমরা সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো, কখনো হাল ছেড়ে দিবো না। আল্লাহ অবশ্যই আমাদের মধ্য থেকে বড় বড় ব্যক্তিত্ব, রাসেখ আলেমদের উঠিয়ে আনবেন। তারাই মানুষের স্বাভাবিক ফিতরাতকে কাজে লাগিয়ে মুক্তির ইশতেহার রচনা করে নতুন এক সভ্যতার সূর্যোদয় ঘটাবেন, ইনশাআল্লাহ।
১০৭৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।
Picture of হাসান আল ফিরদাউস

হাসান আল ফিরদাউস

সংগঠক এবং সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হাসান আল ফিরদাউস-এর জন্ম টাংগাইল জেলায়।পড়াশুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও ইসলামী সভ্যতা নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি উসূল, ফিকহ এবং রাজনৈতিক দর্শনের উপর বড় শিক্ষকদের সাহচর্যে গবেষণা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক স্কলার ও চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে নানাবিধ গবেষণা ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি নিয়মিত লেখালেখি করছেন।বর্তমানে তিনি ‘ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।একইসাথে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ ত্রৈমাসিক মিহওয়ার-এর সম্পাদকও।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top