উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে যখন উসমানী সালতানাত তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে লিপ্ত ছিলো। পাশ্চাত্য শক্তি একের পর এক মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোতে দখলদারিত্ব কায়েম করছিলো। এদিকে ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের বাতিও প্রায় নিভু নিভু করছিলো। যদিও ১৮৫৭ সালের বিপ্লবের মাধ্যমে মোঘল সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টাটুকু করা হয়। কিন্তু এর ফলাফলও খুবই ভয়ানক ছিলো। শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর গ্রেফতার হোন এবং হাজার হাজার আলেমকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হয়। ফলে মোঘল সাম্রাজ্যের বাতি চিরদিনের জন্য নিভে যায়।
এরপরও ভারতবর্ষের মহান দাঈ, মনিষা এবং মুজাদ্দিদগণ মুসলমানদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। মাওলানা কাসেম নানুতবীর নেতৃত্বে একদল আলেম দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বীনের হেফাজতের দূর্গ গড়ে তোলেন। অপর দিকে স্যার সাইয়্যিদ আহমদ আলীগড় কেন্দ্রিক নতুন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমানদের পুনর্জাগরণের প্রচেষ্টা শুরু করেন। এর দ্বারা একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, আলীগড়ে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ার ফলে মুসলমানরা পাশ্চাত্য জগতের অন্ধ অনুসারী হতে থাকে এবং ইসলামী তাহজীব-তামাদ্দুন ছেড়ে পাশ্চাত্যের কৃষ্টি-কালচারে আকৃষ্ট হতে থাকে। যার ফলে স্যার সাইয়্যিদ আহমদের এই প্রচেষ্টা অনেক আলেম গ্রহণ করতে পারেন নি।
ঠিক এ সময় ভারতবর্ষে এমন এক দূরদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মহান মনিষীর জন্ম হয়, যিনি মনে করতেন, ‘প্রাচীন ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া মুসলিমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে না।’ এই ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব এমন বিপ্লবাত্মক শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করেন যার ঐতিহাসিক অবদান সম্পর্কে পক্ষে বিপক্ষের সবাই একমত। সেই মহান মনিষীর নাম আল্লামা শিবলী নোমানী। আল্লামা শিবলী নোমানী ছিলেন কালজয়ী লেখক-গবেষক, অনন্যসাধারণ জীবনীকার-ঐতিহাসিক, যুগশ্রেষ্ঠ দার্শনিক-চিন্তাবিদ এবং খ্যাতনামা বিদ্বান-শিক্ষক।
আল্লামা শিবলী নোমানীর জন্ম ১৮৫৭ সালের ৪ই জুন (মতান্তরে ৩ই জুন), ভারতের আজমগড়ের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। সিপাহী বিপ্লব ও পরবর্তীতে মুসলমানদের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে শিবলী এমনভাবে বড় হয়ে উঠেছিলেন, যা পরবর্তীতে তাঁর সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাকাঠামো নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পিতা শায়খ হাবীবুল্লাহ ছিলেন একজন খ্যাতিমান ব্যবসায়ী ও উকিল। শিবলী তাঁর ঘরেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। এরপর তিনি জৌনপুরের মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে মৌলভী হেদায়েতুল্লাহ খান রামপুরী ও মাওলানা ফারুক চরিয়াকোটির তত্ত্বাবধানে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীতে ভারতের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মুহাম্মদ ফারুক (মানতিক ও ন্যায়শাস্ত্রের পাণ্ডিত্যের জন্য খ্যাত) ও আরবি সাহিত্যের পণ্ডিত মাওলানা ফয়জুল হাসান সাহারানপুরীর কাছে অধ্যয়ন করেন। এ অবস্থায় তিনি ফিকহ, উসূল, হাদীস, মানতিক, মানকুলাত ইত্যাদি শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
শিক্ষা, জ্ঞানচর্চার সূচনার পূর্বে একাধারে নকলনবিশী, খাদ্য গুদামের রক্ষণাবেক্ষণ, ও ওকালতির প্রতি মনোনিবেশ করেন। কিন্তু কোন পেশায় তার মন বসেনি। অবশেষে ১৮৮৩ সালে তিনি আলীগড় কলেজে ফার্সীর প্রভাষক ও আরবীর সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। আলীগড়ে অবস্থানরত সময়কেই শিবলীর জীবনীকারকগণ তার জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন।
এখানে তিনি পশ্চিমা সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন এবং টি ডব্লিউ আর্নল্ডের মাধ্যমে ফরাসী ভাষা শিখেন। আর্নল্ডকে তিনি আরবী শেখান। সেখান থেকে তাদের মাঝে অনেক ভাবের আদান প্রদান হয়। এবং একে অপরের চিন্তার উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেন। পশ্চিমা সকল জ্ঞানশাস্ত্রকে শিবলী এ সময় সামালোচকের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে পরখ করেন। এসময় তার ব্যাপক অধ্যয়ন তার জ্ঞানান্বেষী মানসকে সমৃদ্ধ করে। আলীগড়ে অবস্থানকালেই তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ সীরাতে নোমান, আল মামুন, আল ফারুকের মতো কাজগুলো শেষ করেন।
আল্লামা শিবলী ১৮৯২ সালে প্রফেসর আর্নল্ডের সঙ্গে তুর্কিস্তান ,মিসর ও সিরিয়া অঞ্চল ভ্রমণ করেন এবং ছয় মাস অবস্থান করেন। তুর্কিস্তানে অবস্থানকালে খেলাফতে উসমানিয়া তার জ্ঞান-পাণ্ডিত্যে অভিভূত হয়ে তাকে ‘তমঘা-ই মজিদিয়া’ পদক প্রদান করে।
আল্লাম শিবলী আলীগড়ে দীর্ঘ ১৬ বছর শিক্ষতা করেন এবং স্যার সাইয়্যিদ আহমদের মৃত্যুর পর ১৮৯৮ সালে আলীগড় ছেড়ে জন্মভূমি আজমগড় চলে আসেন। ১৯০১ সালে তিনি হায়দরাবাদের শিক্ষা বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। সে সময়ের তার উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯০৫ সালে তিনি হায়দারাবাদ ছেড়ে ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান নদওয়াতুল উলামায় চলে আসেন এবং এই নতুন প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। ১৮৯৮ সালে নদওয়া প্রতিষ্ঠিত হয় যা ছিলো আল্লামা শিবলীর হৃদয়ের স্পন্দন,স্বপ্নের অনুরণন। তাই শুরু থেকেই এর জ্ঞান-গবেষণার মানোন্নয়নে রাত-দিন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। পাঁচ বছর অবস্থানের পর তিনি সেখান থেকে বিদায় নেন।
আল্লামা শিবলীর জীবনের উল্লেখযোগ্য অবদান মাদরাসার ‘নেসাবে তা’লিম’ বা শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন করা। কিন্ত আলেমদের একটি দল আল্লামা শিবলীর এই কারিকুলামকে শুধু প্রত্যাখানই করেন নি বরং তাকে নদওয়া ছাড়তে বাধ্যও করেন। যে আল্লামা শিবলী নোমানী আলীগড় ছেড়ে এসেছিলেন এই কারণে যে, সেখানকার পাশ্চাত্যানুকরণ বল্গাহীন ভাবে ছুটে চলায় সেখানে মুসলিম চিন্তার রূহ আর অবশিষ্ট্য থাকছিলনা। তাই সেখান থেকে তিনি বিদায় নিয়ে নদওয়াতুল উলামার শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব কাধে তুলে নেন, সেই আল্লামাকেই নদওয়ার অন্যন্য আলেমগণ অতি আধুনিকতাবাদী বলে ভ্রুকুটি করত!
আল্লামা শিবলী নদওয়ায় ইংরেজি,সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান কে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূত করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেওবন্দ এবং আলীগড়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘আমাদের আলেম সমাজ প্রাচীন এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গমস্থল হবে।’ এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রাথমিক পর্যায়ের ইংরেজি ও বিজ্ঞান আবশ্যক ছিলো। তবে আজ শতবর্ষ পরে আলেমগণ অনুভব করছেন, আল্লাম শিবলীর ‘শিক্ষা কারিকুলাম’ শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তার বিপ্লবাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক ছিলো।
উপমহাদেশের যে সব মাদ্রাসার নেসাব-নেযামে পরিবর্তন এসেছে সব কিছুতেই আল্লাম শিবলীর চিন্তা-চেতনার ছায়া পরিলক্ষিত হয়। নদওয়াতুল ওলামায় তার নেসাবি কারিকুলাম প্রয়োগ করে মাত্র পাঁচ বছরে এমন ফলাফল বের করেন যা তার বিরুদ্ধবাদীরাও বিনাবাক্যে স্বীকার করতেন। নদওয়ার কিছু আলেমদের আল্লামা শিবলীর শিক্ষা কারিকুলামের সাথে কঠিন মতানৈক্য ছিলো। যখন বাতাসের গতি পরিবর্তত হলো এবং নদওয়ার পরিবেশ তার জন্য সংকুচিত হয়ে আসলো তখন এই মহান মনিষী নদওয়া ছেড়ে জন্মভূমি আজমগড় চলে আসেন।
আজমগড় এসেই তিনি তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ‘দারুল মুসান্নিফীন’ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। তার ইন্তেকালের পর তারই প্রিয় শিষ্য এবং ভাতিজা হামিদুদ্দীন ফারাহী এবং সাইয়্যিদ সুলাইমান নদভী যার সফল বাস্তবায়ন সম্পন্ন করেন। শিবলীর প্রতিষ্ঠিত দারুল মুসান্নিফীন এবং নদওয়াতুল উলামায় তার ঐতিহাসিক ভূমিকা ভারতীয় মুসলিমদের গতিপথ নির্ধারণে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখে। বিশেষত নদওয়ার প্রভাবে, সাইয়্যিদ সুলাইমান নদভী, আব্দুস সালাম নদভী, সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী, মাসউদ আলম নদভী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা জাফর আলী খান, মাওলানা মুহাম্মদ আলী, মাওলানা হামীদুদ্দিন ফারাহী, ইকবাল হোসেন সুহাইলীর মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ ও বিদগ্ধজনেরা গড়ে ওঠেন যারা পরবর্তীতে উপমহাদেশের মুসলিমদের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন।
আমরা যদি সংক্ষিপ্তভাবে আল্লামা শিবলী নোমানীর চিন্তাযানে সফর করি তবে দেখতে পাই যে- তিনি ইসলামী ও আধুনিক উভয় শিক্ষা যুগপৎ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। ধর্মীয় ও পার্থিব জ্ঞানের পাশাপাশি দুনিয়ার অগ্রসর চিন্তাস্রোতে মুসলিমদের প্রভাবক হতে বলেন। আধুনিকতাকে তিনি ইসলামের হাত দিয়ে যাচাই করতে চান। বিজ্ঞানের সাথে ইসলামের কোনো দূরত্ব তিনি পাননি। এতে মুসলিমদের বিপুলভাবে এগিয়ে আসা চাই। তিনি দেখেন, আধুনিক দর্শন ইসলামকে উত্ত্যক্ত করছে। এর বিপরীতে ইসলামের দার্শনিক বয়ান কালের ভাষায় হাজির করা চাই। তিনি দেখছিলেন নাস্তিক্যের প্রবল ঢেউ এগিয়ে আসছে। এর মুখে বাঁধের ভূমিকা রাখেন একনিষ্ঠভাবে। আলেমদের তিনি এ বিষয়ে সাবধান করেন, দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
নদওয়াতুল উলামার এক সভায় আলেমদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ভারতের সীমান্তে ধেয়ে আসছে অবিশ্বাস ও নাস্তিক্য। সে আসছে দর্শনের (western phylosophy) নামে। একে জানা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর মোকাবেলা আলেমদের দায়িত্ব। এ আহ্বানে সাড়া আসেনি। খুব কম লোকই একে ভালোভাবে নিতে পেরেছিল। উল্টো বরং তাকে বলা হলো জড়বাদী, প্রকৃতিবাদী। কেউ কেউ তো ধর্মহীন বলতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু পা থেকে মাথা অবধি তিনি ছিলেন মুসলিমদরদি। চারদিক থেকে তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ ছড়ানো হতো, তিনি তার জবাব দিতেন মুখে হাসি ছড়িয়ে। জনতাকে আবেগের স্রোতে সঁপে না দিয়ে তিনি চাইতেন আপন বাণীকে তাদের হৃদয়ঙ্গম করাতে।
মুসলিম মনকে বেপথু হতে দেননি শিবলী। যথার্থ বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ান দিয়ে মুসলিম বিশ্বাসকে তিনি প্রমাণ করেন। তার বয়ানে ইসলামের মূল আকিদাসমূহ জ্ঞান ও যুক্তিবাদের জবানে উপস্থাপিত হয়েছে। যারা এতদিন বাতাসের উপর রেখেছিলেন ধর্মবিশ্বাসের সৌধ এবং কেবলই মনের টানে অটল ছিলেন ধর্মবিশ্বাসে, তাদের জন্য শিবলীর বয়ান ছিল উজ্জ্বল উদ্ধার। ফলে দৃঢ়তা লাভ করে তাদের ধর্মবিশ্বাস। কিন্তু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না শিবলীর বয়ানের ফায়দা। পশ্চিমা দর্শনের কণ্ঠে ইসলামী আকিদার বিরুদ্ধে যে বজ্রনিনাদ ধ্বনিত হচ্ছিল, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে মুসলিম চিন্তকরা শিবলী থেকে সহায়তা নিয়েছিলেন।
শিবলী যখন আধুনিক চিন্তাস্রোতের মুখোমুখি হয়েছেন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মুসলিমরা তখন ছিল মেরুদণ্ডহারা। তাদের ধর্মবিশ্বাসকে বিধ্বস্ত করে দিতে সক্রিয় ছিল পশ্চিমা দর্শন ও সমাজব্যবস্থা। বিশেষত প্রাচ্যবিদদের জবাবি প্রয়াসে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। পালমার, উইলিয়াম ম্যুর, স্প্রেঙ্গার, মারগোলিয়াথ প্রমুখের ইসলাম-ব্যাখ্যা তার চ্যালেঞ্জের কবলে পড়ে। এ চ্যালেঞ্জ সংবলিত তার সিরাতুন্নবী, জিজিয়া, ইসলামী কুতুবখানা, হুকুকুল জিম্মিয়িন, কুতুবখানায়ে ইস্কান্দারিয়া ইত্যাদি রচনা ছিল মুসলিমদের জ্ঞানগত বিজয়ের মতো। এভাবেই শিবলী নোমানী জ্ঞানের বহু দিগন্তে সফর করে ইতিহাসে ডেরা গাড়েন নিবিড়ভাবে। ইতিহাসের ভেতর থেকে তিনি খুঁজে আনেন জাতীয় জাগরণের জ্বালানি।
তার প্রাথমিক জীবনের শিক্ষকগণের মধ্য থেকে কেউ মুতাজিলা ধারার অনুসারী ছিলেন বলে অনেকেই তার দিকে মুতাজিলা হিসেবে আঙ্গুলি প্রদর্শন করতে চাইত। তবে আল্লামা শিবলী নোমানী হানাফি চিন্তাশিবিরের বসিন্দা ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে কেউ যাতে দ্বিধায় না থাকে, সে জন্য ‘সিরাতে নোমান’-এর মতো গ্রন্থ লিখেই থামেননি, নিজের নামে স্থায়ীভাবে খোদাই করে নিয়েছেন ‘নোমানী’।
রচনাবলি :
আল্লামা শিবলী নোমানীর রচনাবলি প্রধানত ৫ ভাগে ভাগ করা যায়।
১। ইতিহাস
সীরাতে নোমান,
আল ফারুক,
আল মামুন,
আল গাযযালী,
আওরঙ্গযেব পার এক নযর, তাঁর ইতিহাস প্রকল্পের অন্তর্গত।
২। কালাম
কালাম শাস্ত্রের উপর তার যুগান্তরী রচনাসমূহ হচ্ছে-
ইলমুল কালাম,
আল-কালাম,
আল-গাযযালী,
সাওয়ানেহে মাওলানা রূম। ইলমুল কালাম ও আল কালাম শিবলীর জীবনশ্রেষ্ঠ কাজগুলোর একটি।
এছাড়া তার “সীরাতে নোমান” ও “আল গাযযালী” গ্রন্থে যথাক্রমে ইমাম আবু হানিফা (র) ও ইমাম গাযযালীর কালামী চিন্তার ব্যাপারে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করেছেন।
৩। গ্রন্থ পর্যালোচনা/সাহিত্য সমালোচনা
এক্ষেত্রে আল্লামা শিবলীর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো
‘মাওয়াজিনা ই আনীস ওয়া দাবীর’, ‘শিরুল আজম’। ফার্সী সাহিত্যের ইতিহাসবিষয়ক গ্রন্থ শিরুল আজম বহির্বিশ্বেও অত্যন্ত সমাদৃত। এগ্রন্থদ্বয়ে আল্লামা শিবলী সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে নতুন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।
৪। সীরাত
শিবলী নোমানীর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বলা হয় ‘সীরাতুন্নবী’-কে। তাঁর ও সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভীর মিলিত লেখনীতে এ গ্রন্থটি ৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এ গ্রন্থে আল্লামা শিবলী মূলত প্রাচ্যবিদদের অভিযোগের শক্তিশালী জবাব দেন। অসাধারণ এ গ্রন্থটি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
৫। বিবিধ
এছাড়া তার বহু প্রবন্ধ ও কবিতা রয়েছে। আল্লামা শিবলী একজন শক্তিমান কবি ছিলেন। ইসলাম, তৎকালীন পরিস্থিতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তার বেশ কিছু কবিতা রয়েছে। শিবলী নোমানী ছিলেন বহুপ্রজ ও বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব । তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী । তার আরবী ও ফার্সীতে লেখালেখিগুলো সমকালে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে প্রচুর জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়া উর্দুতে তার দখল ছিল প্রবাদপ্রতিম। বলা হতো-
“আল্লামা শিবলীর বিরোধিতাকারীরাও তার সমালোচনা করতে গিয়ে তার ভাষারীতি অনুকরণ করতে বাধ্য হয়”।
ইতিহাস ও সীরাত রচনায় তিনি দেখিয়েছিলেন নতুন মাত্রা । তিনি ছিলেন তাঁর সমকালের সবচেয়ে ব্যাপক বুদ্ধিসম্পন্ন, বর্ণাঢ্য ও গতিশীল ব্যক্তিত্ব । তাঁর চিন্তা ও দর্শনের প্রভাবে উপমহাদেশের মুসলিম জ্ঞানকাণ্ড একইসাথে উম্মাহর মানস আলোড়িত ও সমৃদ্ধ হয়। গত শতকের উম্মাহর অন্যতম এ শ্রেষ্ঠ ও মহান চিন্তাবিদ আল্লামা শিবলী নোমানীকে পাঠ করা তাই নিজেদের ভিত্তি নির্মাণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
১৯১৪ সালের ১৮ নভেম্বর এই ক্ষণজন্মা বিদ্বান মনিষী নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।
আজ আল্লামা শিবলী নোমানীর রেখে যাওয়া মিরাসকে অগ্রসর করে পাশ্চাত্যের যাবতীয় জ্ঞানগত ও সংস্কৃতিগত হুমকিকে মোকাবেলা করে যুগ জিজ্ঞাসার জবাব প্রদান করে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ঘটানো আমাদের আশু কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকল বাধা এবং পিছুটানকে মোকাবেলা করে জ্ঞানের রাস্তায় ইস্তেকামাতের উজ্জ্বল ‘মিনার’ হিসেবে আমাদের মত সত্যান্বেষি যুবমননে সর্বদা ভাস্বর থাকবেন আল্লামা শিবলী নোমানীর মত কালজয়ী জ্ঞানের মুজাহিদগণ। আমাদেরকেও তাদের ধারাবাহিকতাকে সামনে অগ্রসর করে প্রমাণ দিতে হবে যে- আমরা পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে সেসকল মহান মনিষীদের যথাযোগ্য উত্তরসূরী ছিলাম।