মুসলিম যুবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

বিসমিল্লাহহির রহমানির রহিম।

আলহামদুলিল্লাহি রাব্বুলালামিন, ওয়াসসালাতাতু ওয়াসসালামু আলা স্যায়িদিনা মুহম্মাদীন ওয়াআলা আলিহি ওয়াসাহাবিহি আজমাইন।

আসসালামু আলাইকুম,

আইআইএফএসওর সাধারণ পরিষদের একাদশ সভার আয়োজনে আপনারা বিভিন্ন মুসলিম দেশের তরুণ প্রতিনিধি হিসাবে ভ্রাতৃপ্রতীম মুসলিম দেশ আলজেরিয়াতে একত্রিত হয়েছেন। এই আয়োজনের জন্য আমি আপনাদের সকলকে অভিনন্দন জানাই এবং সেই সাথে আয়োজক দেশ আলজেরিয়ার প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। এই সভায় অংশ নেওয়া আমাদের সকল ভাইকে আবারও আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

আপনারা সকলে মিলেই আইআইএফএসও তথা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশন অফ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন। সুতরাং এই  অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সভা কার্যকর করার ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব আপনারাই পালন করবেন। প্রকৃতপক্ষে আপনাদের প্রত্যেকটি সভা এবং সম্মেলনই অত্যন্ত জরুরি এবং গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক, আপনাদের এই সভাটি আজকের বিশ্বের পরিস্থিতি সম্পর্কিত হওয়ায় আরো বেশি  গুরুত্ব অর্জন করেছে।

যেমনটি জানা যায়, বিশ্বে হক/সত্য এবং বাতিল/মিথ্যার অবস্থান। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ এই বিশ্বকে পরীক্ষার স্থান হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। হক/সত্য যেমন একমাত্র ইসলাম তেমনি বাতিল/মিথ্যাচারও একক কেন্দ্র থেকে পরিচালিত কিন্তু এর উপস্থাপনা বিভিন্ন রূপে ।কেন্দ্র যেটি নির্দেশ করে তা হল বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদ।

আপনারাছাত্র সংগঠনগুলি- মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জাগ্রত করার মূল চালিকাশক্তি হওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আপনাদের কাজ ইসলামী দুনিয়ার ১৫০ কোটির মধ্যকার যুবসমাজকে সচেতন করা। এই কারণেই, ছাত্র সংগঠনগুলিকে সংগঠিত ও সমন্বিত করা এবং একই সাথে তাদেরকে কার্যকর লক্ষ্যে পরিচালিত করে আমাদের পুরো যুব সমাজকে ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন এবং সচেতনতা প্রদান করা আপনাদের প্রধান কর্তব্য।

সত্যিকারের ইসলামী সচেতনতা কী? আমি মনে করি কিছু শব্দকে বুঝলে এই বিষয়ে মনোনিবেশ করা আপনাদের জন্য সহজ হবে।

বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদ ৪টি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে।

প্রথমত, আমরা উঁচু জাতের। আমরা সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। 

দ্বিতীয়ত, এই উঁচু জাত কেবল তত্ত্বের মধ্যেই থাকবে না বরং এটি উপলব্ধিতে আনতে হবে। 

তৃতীয়ত, বিশ্ব সার্বভৌমত্ব দখল করতে আমাদের তিনটি জিনিস করা দরকার যথা: জেরুজালেমে ইজরাইল জাতিকে একত্রিত করতে হবে যারা বিভিন্ন শতাব্দীতে তাদের  রাষ্ট্রদ্রোহের কারণে নির্বাসিত হয়েছিল; গ্রেট ইসরাঈল প্রতিষ্ঠা এবং সোলায়মানের মন্দিরের (Temple of Suleyman) পুনর্গঠন।

চতুর্থত, আমরা যখন এই সমস্ত কার্য সম্পাদন করে ফেলব তখন আমাদের ত্রাণকর্তা মসীহ কিন্তু ঈসা (আ:) নন (মূলত দাজ্জালের কথা বলা হচ্ছে) তিনি পৃথিবীতে নেমে আসবেন এবং তিনি দাউদের সিংহাসনে ইহুদীদের রাজা হিসেবে আরোহণ করবেন এবং তিনি আমাদের অনন্ত বিশ্ব সার্বভৌমত্বকে আরও শক্তিশালী করবেন।

এই হলো তাদের ধর্মের চারটি স্তম্ভ। এই স্তম্ভগুলি যা ৫৭৬৫ বছর আগে কাব্বালায় (Kabbalh) রচিত হয়েছিল এবং এগুলোই বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদের মূল কথা।

এই গুরুত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে যদি সংক্ষেপে আবারো বলি- :

 

  • আমরা উন্নত জাতি,
  • এটি কেবল তত্ত্বের মধ্যেই থাকবে না বরং এটি উপলব্ধিতে আনতে হবে,
  • অন্যান্য জাতি আমাদের দাস হওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে, কেবল আমরাই মানুষ হিসাবে তৈরি হয়েছি। অন্যদের বানর হিসাবে তৈরি করা হয়েছিল এবং তারা আমাদের মতো বান্দা হওয়ার জন্য পরে মানুষের মধ্যে রূপান্তরিত হয়েছিল। এটি উপলব্ধি করার জন্য আমাদেরকে জেরুজালেমে ইজরাইলের সন্তানদের আহ্বান করতে হবে গ্রেট ইজরাইলের প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সোলাইমানের মন্দিরটি (Temple of Suleyman) পুনর্গঠন করা এবং গ্রেট ইজরাইলের সুরক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে মসীহের আগমনের শর্তসমূহ পূরণ করতে হবে। এখানে মাসীহ বলতে ঈসা (আ:) কে বোঝায় না। বরং তারা তাদের নিজস্ব ত্রাণকর্তাকে বোঝায়। তাদের মতে কেবলমাত্র এই একজনই দাউদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবে এবং তাদের চিরন্তন বিশ্ব সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করবে।

এই সমস্ত পার্থিব বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাদের ধর্মের কাঠামো গঠিত হয়েছে। যদিও মাঝে মাঝে তারা প্রকাশ করে যে তারা মূসা (আ:) এবং তাওরাতের আদেশ অনুসরণ করে। অথচ তারা ৫৭৬৫ বছরের পুরনো কাব্বালাহ অনুসারে তওরাতকে মিথ্যা বলেছিল। এই মিথ্যা তাওরাতেও এই অভিব্যক্তিটি বিদ্যমান: হে ইসরাঈলের সন্তানগণ! আপনারা এমন এক উঁচু জাতি যারা সর্বশক্তিমান আল্লাহকেও পরাস্ত করতে পারেন।

আল্লাহ সর্বশক্তিমান ক্ষমা করুন! কোনও আসমানী কিতাবে এ জাতীয় বাক্য বিদ্যমান থাকা কি সম্ভব? রাব্বীরা কাব্বালাহ থেকে উঠিয়ে এনে তাওরাতে স্থান দিলেন। আবার অন্য একটি বাক্যে বলা হয়েছে: “তোমাদের শত্রু এবং বন্দীদের হাড় ভেঙে ধ্বংস করে ফেল”। এ জাতীয় হীন মানসিকতা ও সভ্যতার কাছ থেকে কি  কল্যাণের আশা করা সম্ভবহক/সত্য এবং বাতিল/মিথ্যাবাদের মধ্যে চিরন্তন সংগ্রামের  কারণেই মূলত আল্লাহ সর্বশক্তিমান এটিকে সৃষ্টি করেছেন।

এর বিপরীতে আলহামদুলিল্লাহ আমাদের ইসলামী বিশ্বাস নিমোক্ত ৬টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে : আমরা মুসলমান হিসাবে:

  • সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বিশ্বাস করা ,
  • তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা,
  • তাঁর আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস করা,
  • তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান ,
  • মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানে বিশ্বাস ,
  • তাক্বদীর/নিয়তি এবং শেষ বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস।

কেননা আমাদের ঈমানের  ভিত্তি আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস। আমরা আখিরাতকে দুবার স্মরণ করি এবং মনের মাঝে দুইবার এই বিশ্বাসকে গেঁথে নিই। আমরা সবাই বলি ওয়াল বাসি বাদাল মাউতএবং ইয়াওমিল আখেরি। এর তাৎপর্য এতই বেশি যে একই বিষয়কে দুইবার পুনরাবৃত্তি করা হয়। 

সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে একমাত্র সত্য ধর্ম হলো ইসলাম । হযরত  আদম (আ:) থেকে শুরু করে সমস্ত বার্তাবাহকগণ একই বিষয়ই প্রচার করেছেন। এক নবী থেকে আরেক নবীর মাঝে ইবাদত করার নিয়মের মাঝেই শুধু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

এ বর্ণবাদীদের মিথ্যা বিশ্বাস কাব্বালাহর উপর নির্ভর করে এবং তারা তাদের বিশ্বাসের বাস্তবায়ন করার জন্য ৫৭৬৫ বছর ধরে চেষ্টা করে চলেছে। 

রোগ নির্ণয় ব্যতিরেকে চিকিৎসা করা অসম্ভব। সবার প্রথমে আমাদেরকে বৈশ্বিক ক্রিয়াকলাপ বিশ্লেষণ করে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থার রোগ শনাক্ত করতে হবে যাতে আমরা সঠিক চিকিৎসা করতে পারি।

এ অসুস্থতার ভিত্তি হল এই বর্ণবাদী বিশ্বাস। এই বিশ্বাস  সেই প্রাচীন কাল থেকে আজও অবধি পৃথিবীকে বিষাক্ত ও বিকৃত করে চলেছে এবং এই কাজে তারা পশ্চিমকে হাত করতে সক্ষম হয়েছে। বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা পশ্চিমা দেশগুলিকে বলে যে “আপনারা কি পৃথিবীতে যীশুর আগমনের অপেক্ষা করেন না? আমরাও তো একই মসীহের অপেক্ষায় আছি”। আসলে তারা ভান করছে । প্রকৃতপক্ষে তারা ঈসা (আ:) এর অপেক্ষায় নেই, তারা অন্য মসীহের অপেক্ষায় রয়েছে। যাইহোক, খ্রিষ্টানদের ঠকানোর জন্য তারা বলে যে “আমরা একই ঈসার জন্য অপেক্ষা করছি। তবে তাঁর আগমনের শর্তগুলি পবিত্র বাইবেলে নির্ধারিত হয়নি বরং এগুলো আমাদের তাওরাতে চিহ্নিত হয়েছে; আসুন এর সদ্ব্যবহার করি, আসুন আমরা সকলে মিলে এগুলো বাস্তবায়ন করি যাতে ঈসা (আ:) পৃথিবীতে আসার পরিবেশ তৈরি হয়। আর এভাবেই তারা বহু শতাব্দী ধরে খ্রিষ্টানদের অপব্যবহার করছে।

তারা খ্রিষ্টানদের সাথে প্রতারণা করেছে এবং তাদেরকে ১৮ তম ক্রুসেড যুদ্ধের আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছিল। তাদের পরিকল্পনা অনুসারে জেরুজালেম জয় হতে চলেছিল, ইজরাঈল প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছিল এবং এই সবকিছুই ঈসার আগমনের জন্য পরিবেশন করা হচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্বাসটি নতুন ইভাঞ্জেলিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে নিয়েছিল। প্রোটেস্ট্যান্টিজমসহ এই সমস্ত মতবাদগুলি যায়নবাদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এইভাবে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। তাদের দার্শনিক ব্রেজিনস্কি তার শেষ বইটিতে কী বলেছেন ?:

আমরা আমাদের ৫৭৬৫ বছরের পুরনো ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী পয়েন্টে আছি। আমরা অতীতে এর আগে কখনও এত শক্তিশালী ছিলাম না কারণ আমেরিকা এবং তার প্রযুক্তি এখন আমাদের হাতের মুঠোয় এবং তারা আমাদের আদেশের অধীনে, আমরা প্রতিটি দেশে হামলা করতে, ধ্বংস করতে এবং দখল করতে পারি। যাই হোক, আমি আপনাকে স্বৈরশাসক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি না। বরং বিশ্বকে শাসন করে এমন ক্লাবটির সভাপতি হওয়ার জন্য আগ্রহী হন। আমাদের আসল লক্ষ্য ইসলামকে ধ্বংস করা। সুতরাং, ইসলামকে ধ্বংস করার সময় ইউরোপ, রাশিয়া ও জাপানকে ইসলামের পক্ষে লাগিয়ে দেবেন না, তাদেরকে জায়নিজমের পক্ষে দাঁড় করান, যেন মনে হয় আপনি তাদের সাথে একসাথে রাজত্ব করছেন এবং তাদের রাষ্ট্রপতি হন এবং এভাবেই পৃথিবীতে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছে যান । 

 

ব্রিজিনস্কির শেষ বইয়ের মধ্যে একটি খুব আকর্ষণীয় বিষয় রয়েছে:

আমরা যখন মুসলিম দেশগুলির কথা বলি, তখন সেখানকার মুসলমানদের দুই প্রকারে বিভক্ত পাই । এর একটি অংশ ধর্মনিরপেক্ষবাদী এবং অন্য অংশটি মৌলবাদী। আমাদের আসল লক্ষ্য মৌলবাদীদের নির্মূল করা কারণ তারা পৃথিবীতে ন্যায়বিচার চায়, তারা সবার সম্মান চায় এবং বলে যে সব মানুষ সমান। কিন্তু, আমরা বলি যে “আপনি আমাদের দাস হবেন”, তাই আমাদের আসল শত্রু মৌলবাদীরা। আসুন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সাথে সমঝোতায় আসি, তাদের সহযোগিতা করি এবং একইভাবে মৌলবাদীদের বিনষ্ট করি “।

এগুলি তারা প্রকাশ্যে তাদের বইয়ে লেখে যেহেতু তারা বিশ্বাস করে যে তারা তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী পয়েন্টে অবস্থান  করছে। আফগানিস্তান দখল করার মাধ্যমে তারা সূচনা করেছিল এবং এরপরে তারা ইরাক আক্রমণ করেছিল এবং এখন ধীরে ধীরে তারা ইরান, সিরিয়া, সৌদি আরব, মিশর এবং তুর্কিকে দখল করবে এবং প্রতিশ্রুত ভূমির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের করার জন্য তাদের ইজরাইলে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং তারা গ্রেট ইসরাঈলের প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং তারা এই সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রও প্রস্তুত করে চলেছে। গ্রেটার মিডলইস্ট প্রজেক্ট নামক এই প্রকল্পটি এই পরিকল্পনার প্রতিচ্ছবি এবং তারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছে। ১৫০ কোটির মুসলিমের ইসলামী দুনিয়া হিসাবে আমরা এই মুহুর্তে কী করব? আমরা কি থেমে থাকব? অপেক্ষা করব? এবং বসে বসে সেগুলি দেখব? আমরা কি অপেক্ষা করব যে তারা আগামীকাল ইরানকে বোমা মারবে, তার পরেরদিন তারা সিরিয়া এবং সৌদি আরবকে নিয়ে যাবে এবং পরের দিন তারা মিশর ও তুরস্ক দখল করবে এবং পৃথিবীকে আজকের প্যালেস্টাইনের মতো রক্তের হ্রদে পরিণত করবে? অবশ্যই, ইসলামী সভ্যতার সদস্যরা যারা সমস্ত মানবতার সুখ এবং সমৃদ্ধি চান তারা এই ধরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দিবে না। সুতরাং মানবতাকে বাঁচানোই সচেতন মুসলমানদের প্রধান কাজ। আমাদের দায়িত্ব যুবকদের এই অনুপ্রেরণা দান করা এবং তাদেকে এই বিষয় জানানো এবং এই কাজটিই আইআইএফএসও তথা আপনার দায়িত্ব। কারণ আজকের  এই কংগ্রেস ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্টে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং এটি অন্য যে কোনও সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে ইসলাম শেখানোর পাশাপাশি  মুসলিম যুবসমাজকে সচেতন মুসলমান করে তুলাও আমাদের দায়িত্ব।

আমি আবারও এই বিষয়ের উপর জোর দিচ্ছি তাদের সচেতন মুসলমান বানিয়ে তুলুন। সচেতন মুসলিম মানে কী? একজন সচেতন মুসলিম হওয়ার অর্থ আমি কার সেবা করছি, হকের না বাতিলের; এই পার্থক্য করা। এই উদ্দেশ্যে, তাকে হক এবং বাতিলের অর্থগুলি জানতে হবে। বিশ্ব জায়োনিজম কীভাবে বিশ্বকে চারদিক থেকে বিষাক্ত করছে তা বুঝতে দয়া করে মনোযোগ দিন। মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ  তাঁর রাসূলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে দুটি জিনিস পৌঁছে দিয়েছেন:

প্রথমটি  হল লা ইলাহা ইল্লাআল্লাহ‘, মুশরিক হয়ো না; কারণ যে সভ্যতা মানবতার প্রতি সম্মান বয়ে আনবে তা কেবল ঐক্য/তাওহীদের উপর নির্ভর করতে পারে। ত্রিতত্ত্বের মধ্য দিয়ে সভ্যতা ও সম্মান পাওয়া অসম্ভব। এই কারণে সমস্ত বার্তাবাহক “তাওহীদ” এর বাণী পৌঁছে দিয়েছিছেন এবং মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছেন যেন তারা পৃথিবীকে বিষাক্ত না করে এবং লুণ্ঠন না করে। সুতরাং, একজন সচেতন মুসলমান মাত্রই এমন একটি সভ্যতা চান যার ভিত্তি লা ইলাহা ইল্লা আল্লাহ যা সমগ্র বিশ্ব মানবতাকে আলোকিত করে তুলবে এবং পৃথিবীকে নিয়ে যাবে উন্নতির চরম শিখরে ।

ভাবুন তো বিষয়টা কেমন হবে? দুর্নীতি ও ক্ষতিসাধন ব্যতিরেকেই  উন্নতি। 

অন্যদিকে আজকে বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদ পৃথিবীকে চারদিক থেকে বিষাক্ত করে তুলেছে।

প্রথমত, হত্যা। আজ আমরা ফিলিস্তিনে খুনের মহোৎসব প্রত্যক্ষ করি। তাদের গণহত্যা চালানো এবং নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করার সুযোগ আছে। এগুলি ছাড়াও তাদের প্রথম কাজই হল অস্ত্রের মাধ্যমে মানবতাকে বিষাক্ত করা। সিক্রেট ওয়ার্ল্ড স্টেটের লেখক, রকফেলারের প্রাক্তন প্রেস উপদেষ্টা, অ্যালেন গ্রে তাঁর বইয়ের প্রবন্ধে বলেছেন যে,

আমি রকফেলার এবং তার বন্ধুদের  প্রেস পরামর্শদাতা হিসেবে ১৫ বছর ছিলাম এবং পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে এই দলটি  আফ্রিকার কিছু রাষ্ট্রপতি হত্যার আয়োজন করছে। আমি নিজেকে বলেছিলাম যে আমি আর এই লোকদের সেবা করতে পারি না এবং এই কারণেই আমি তাদের ছেড়ে চলে এসেছি ।

আমরা এখন এগুলি প্রকাশ করছি কেন? প্রকৃতপক্ষে, এ বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দুটি টাওয়ার সহ সমস্ত সন্ত্রাসী হামলার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানেই যুদ্ধ আছে খুঁজে দেখবেন সেখানেই এ নিকৃষ্ট সংগঠনগুলি যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। এভাবে তারা অস্ত্রের মাধ্যমে মানবতাকে বিষিয়ে তুলছে।

দ্বিতীয়ত, অন্যদিকে তারা তাদের থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানে নতুন ধারণা উদ্ভাবন করছে। তারা মিডিয়ার মাধ্যমে এই ধারণাগুলি মানুষের মাঝে ইচ্ছামতো প্রবর্তন করছে এবং প্রচার করছে এবং মুসলমানদের তাদের নিজস্ব ধর্ম থেকে বিচ্যুত করার জন্য তারা একটি পরিকল্পিত কৌশল সম্পাদন করছে। তারা কেবল মাদক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মাধ্যমেই নয়, তাদের কেন্দ্রগুলিতে উৎপাদিত কিছু নতুন ধারণার মাধ্যমে এটি করছে। উদাহরণস্বরূপ তারা “আধুনিকতাবাদ/মর্ডানিজমধারণাটির আবিষ্কার। আধুনিকতা মানে কী! বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদ একটি শব্দ তৈরি করেছে এবং এখন আমাদেরকে ঠকানোর চেষ্টা করছে এবং এই শব্দের প্রচারের মাধ্যমে আমরা আমাদের ধর্ম থেকে দূরে থাকবো। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাদের থেকে আমাদেরর হেফাজত করুন। তারা চায় যে, আমরা আমাদের আখিরাতের জীবন নষ্ট করি। আল্লাহর ওয়াস্তে এই চক্রান্তের প্রতি একটু লক্ষ্য করুন! তারা কি মনে করে, তারা আধুনিক সময় কি তা জানে কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ কি তা জানেন না? তারা একটি শব্দের মাধ্যমে মানুষকে ঠকানোর চেষ্টা করছে। তারা আবার এও দাবি করছে যে বিশ্বায়ন বন্ধ করা অসম্ভব। তাতে কী হবে ?? আমরা কি আমাদের সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিবো? আমরা কি আমাদের সাজানো দুনিয়াকে ইজরাইলের সন্তানদের এমনি এমনি দিয়ে দিবো? তাদের কথা মতো  উপহার দিবো? তারা চায় যে আমরা তাদের অধীন দাস হয়ে থাকি আর তারা আমাদেরকে শোষণ করতে থাকবে। এই সমস্ত মর্ডানিজমসহ বিভিন্ন ধারণা এই কারণেই উদ্ভাবিত। সুতরাং, চিন্তার দূষণ তাদের ব্যবহৃত অন্যতম হাতিয়ার ।

তৃতীয়ত, তাদের তৈরি করা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পৃথিবীকে বিষাক্ত করে তুলছে। তারা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছে। আর জাতিসংঘ বানি বার্থ নামের জায়নবাদী সংগঠনের কমান্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। যারা এই সংস্থার সদস্য নয় তারা ছোট খাটো বিভাগের প্রধানও হতে পারে না। এ সকল ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পৃথিবী শোষিত হয়। তারা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেছে। এভাবে তারা বিশ্বকে বিষিয়ে তুলছে। অন্যদিকে সুদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা পুরো মানবতাকে শোষণ করছে। তারা কয়েকজন জায়নবাদী ধনী লোক তৈরি করে  কয়েক মিলিয়ন মানুষের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। আফ্রিকার ২০০ মিলিয়ন মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়েছে। প্রতি বছর বিশ্বে দুর্ভিক্ষের কারণে পাঁচ কোটি শিশু মারা যায়। কেন? কারণ জায়নবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সুদের অর্থনৈতিক দাসত্ব । তবুও তারা থেমে নেই, পরিকল্পনা করছে যে কীভাবে এই লোকদের আরও বেশি শোষণ করা যায়। অবশ্যই, মানবতার জন্য এই ধরণের মানসিকতা থেকে কোন কল্যাণ নেই। এই বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার সাথে আমাদের কোনও সম্পর্ক, যোগাযোগ ও বিনিময় নেই। কেন? কারণ  রহমত ও করুণা আমাদের মূল ভিত্তি। আলহামদুলিল্লাহ আমরা মুসলমান এবং আমাদের আসমানী কিতাবের সূচনাই হয় “বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম” দিয়ে। আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রহমতের রসূল। আমরা সমস্ত মানবতাকে মানবিক মর্যাদা দিতে চাই। আমাদের লক্ষ্য ৬০০ কোটি মানুষের শান্তি নিশ্চিত করা। ইসরাঈলের সন্তানদেরকেও মানুষের মর্যাদা দেওয়া আমাদের কর্তব্যগুলির মধ্যে একটি । আমরা মুসলমান এবং হকনিশ্চিত করা আমাদের সর্বপ্রথম কাজ  অথচ এর বিপরীতে ইসরাঈলের সন্তানরা দাবি করে যে তারা শ্রেষ্ঠতম জাতি এবং তারা পৃথিবীর প্রভু আর অন্যান্য লোকেরা তাদের দাস। তারা কেবল দুটি শব্দ সনাক্ত করেছে: “হয় আপনি মারা যাবেন বা আমার দাস হবেন”। এখানেই হক এবং বাতিলের  মধ্যে পার্থক্য ।

চতুর্থত, বিষের আরেকটি উপায় হল প্রক্সি সরকার, প্রক্সি মিডিয়া এবং প্রক্সি ট্রেডম্যান। তারা বিভিন্ন মাধ্যমে এই শ্রেণীগুলোকে প্রতারিত করে তাদের লক্ষ্যের পৌঁছার জন্য অপব্যবহার করে ফায়দা লুটছে। তারা এগুলি শোষণের এবং বৃহত্তর ইসরাঈলের প্রতিষ্ঠার জন্য করছে।

আপনারা যদি তাদের এই সমস্ত নোংরা পদ্ধতিগুলি সমন্ধে অবগত না হন তবে তারা তাদের বিষাক্ততা এবং বিকৃত চিন্তা ও কর্মগুলোকে  সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন না । যার ফলে তারা তাদের নোংরা পরিকল্পনাগুলি পরিবেশন করবে এবং আপনারা তাদের অত্যাচারের অংশীদার হবে এবং তাদের সমর্থনও করে যাবেন। তবে একজন সচেতন মুসলমান এ বিষয়টি খুব ভাল করেই জানেন এবং তিনি মানবতা ও বিশ্বের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য ; এই সমস্ত চক্রান্ত এবং নিপীড়নকে নির্মূল করার জন্য কাজ করেন।

মানবতার কল্যাণে পাঁচটি মূল ভিত্তি রয়েছে:- 

  • শান্তি
  • স্বাধীনতা
  • ন্যায়বিচার
  • সমৃদ্ধি
  • সম্মান।

একজন সচেতন মুসলিম সমগ্র মানবতার সৌভাগ্য ও উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা করে। অন্যদিকে, চিন্তার দূষণের বিরুদ্ধে জনগণকে সত্য ও তথ্য প্রদর্শন করাই মুসলিমের কাজ। এই উদ্দেশ্যে মুসলমানদের মানুষের কাছে সত্যকে  পৌঁছে দিতে হবে। তাদেরকে সত্যের দিকে আহ্বান করতে হবে। তাদেরকে সাথে নিয়ে পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী রাজনীতি আপনাদেরই গঠন করতে হবে। বর্ণবাদী-সম্রাজ্যবাদী শোষণ পদ্ধতির পরিবর্তে একটি “ইনসাফ ভিত্তিক” শাসন ব্যবস্থা ও স্বাধীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানদেরকে নিম্নোক্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে:

১.মুসলিম দেশগুলির জাতিসংঘ,

২. মুসলিম দেশগুলির ন্যাটো,

৩.মুসলিম দেশগুলির সাধারণ মুদ্রা তথা ইসলামিক দিনার

৪. মুসলিম দেশগুলির অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা,

৫. মুসলিম দেশগুলির সাংস্কৃতিক সহযোগিতা সংস্থা,

এই সংস্থাগুলির মাধ্যমে মানুষকে মর্যাদা দিবে এমন একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এগুলি ছাড়াও এমন সরকার অবশ্যই থাকতে হবে, যাদের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে (যেমন মিল্লি গরুশ)যারা ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মানসিকতা রাখে এবং মানবতার কল্যাণ কামনা করে। এই সকল সরকারদেরকে সমর্থন করবে এমন একটি মিডিয়া থাকতে হবে। আবার, অর্থনৈতিক শক্তিগুলো ও ব্যবসায়ীরা মিডিয়াকে সমর্থন করে যাবে। বিশ্বের উন্নতি ও পরিবর্তনের জন্য এবং এই সমস্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা মানে একজন সচেতন মুসলিম হওয়া এবং সমগ্র মানবতার কল্যাণ ও মুক্তির জন্য কাজ করা।

বিশ্বের ৬ বিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১.৫ বিলিয়ন মুসলিম রয়েছে। প্রথমত, নতুন বিশ্বজুড়ে ১.৫ বিলিয়ন মুসলমান এবং সমস্ত নিপীড়িত মানুষকে একত্রিত করা আমাদের কাজ এবং একান্ত কর্তব্য। যারা এই লক্ষ্য অর্জন করবে তারা হলেন সচেতন মুসলমানরা আর এই দ্বীনি প্রচেষ্ঠায় IIFSO হলো ইঞ্জিন স্বরূপ। আমি কি আপনাদের দায়িত্ব কত গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝাতে পেরেছি ?

সমস্ত ছাত্র সংগঠনের জন্য একটি সিরিয়াস সংগঠন থাকা জরুরি যারা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কৌশল প্রণয়ন, এই সমস্ত কাজকে গুরুত্বের সাথে সম্পাদন করা, ফলাফল বিশ্লেষণ করা এবং  সময় নষ্ট না করে ফলপ্রসূ কাজ করবে আর  এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আইআইএফএসওর। মুসলমানদের সচেতন করার জন্য আমরা তাদের এভাবে বলবে,

শুনুন ভাই, দয়া করে প্রতারিত হবেন না এবং বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের এই প্রক্সি পরিবেশনকারী হবেন না। আপনি একজন সম্মানিত মুসলমান। পবিত্র কুরআনের সূরা তাকবিরের (পুনরুত্থান) সেই বার্তাটি কখনও ভুলে যাবেন না। মহান আল্লাহ এই সূরায় কী আদেশ করেন?

যখন সূর্যকে ডেকে ফেলা হবে,

এবং যখন তারাকারাশি আলো হারাবে,

এবং যখন পাহাড় তুলার মতো উড়তে থাকবে,

এবং যখন উটে রশি ফেলে চলে যাবে,

এবং যখন বন্য প্রাণীরা বন থেকে বেরিয়ে আসবে,

এবং যখন সমুদ্রকে আগুনের উপর স্থাপন করা হবে ,

এবং যখন রূহসমূহকে একত্রিত করা হবে,

এবং জীবিত কবর দেওয়া মেয়ে শিশুকে জিজ্ঞাসা করা হবে

কী অপরাধে তোমাকে হত্যা করা হয়েছিল, … “

 

সূরাটির বর্ণনার ধারা এভাবেই চলমান। এই আয়াতগুলোর মানে কী?মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ আমাদের বলেছেন তোমরা মূল্যবান জিনিস হারিয়ে ফেলবে, যদি শয়তানের চক্রান্তের মাধ্যমে পার্থিব বিষয়াদিতে লাগামহীন চলতে থাকো এবং শুধু  দুনিয়ার পিছনে দৌঁড়াতে থাকো, তাহলে কোন ইহকাল কিংবা পরকাল কোনটাই পাবে না। তারা মূলত আপনাকে কিছু লাভ ও মুনাফা দিয়ে ঠকানোর চেষ্টা করতে পারে। এই পার্থিব লাভ দ্বারা বোকা হবেন না কারণ শেষ পর্যন্ত আপনি এইসব ছেড়ে চলে যাবেন এবং এই লাভ করতে গিয়ে  আপননি যেসব  অন্যায়-নিপীড়ন করেছেন সেসম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। এমনকি আপনাকে একটি মেয়ে শিশু  হত্যার বিষয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং বিচারের মুখোমুখি হবেন। এখন আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি: আপনি যদি তাদেরকে সমর্থন করেন যারা বর্ণবাদী সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তা করে থাকেন এবং যদি এই সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতি বছর বিশ্বে  ৫০ মিলিয়ন শিশুকে হত্যা করে আর পরকালে আপনাকে যখন তাদের মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করা হবে, তখন কি কোন জবাব দিতে পারবেন? আপনাদের কাছে এর কোন উত্তর আছে কী? এখান আমাদেরকে বুঝতে হবে, আমাদের প্রচেষ্ঠা, আমাদের কাজগুলোর ফলাফল কার পক্ষে যায়? এগুলো কি অনিষ্টের পক্ষে যায় নাকি উন্নতির পক্ষে যায়? এই কারণে, আইআইএফএসও হিসাবে আপনাদেরকে সকল মুসলিম যুবকদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং সচেতন করার জন্য কাজ করতে হবে।

অন্যভাবে বললে, এটি আপনাদের সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজের অন্তর্ভুক্ত যে, মুসলিম যুবসমাজকে বর্ণবাদী সম্রাজ্যবাদীদের দাস হয়ে তাদের দরবারে ধর্ণা দেওয়ার পরিবর্তে দুনিয়ার সুখ-শান্তি সমৃদ্ধির জন্য কাজ করতে সচেতন করা।  

আজকের সভায় আপনাদের শ্লোগান ছিল বড় পদক্ষেপের জন্য চাই কাজ, আর কাজ করার জন্যই সংগঠন। এই উচ্চমাত্রার সচেতনতার জন্য আমি আপনাদের সকলকে অভিনন্দন জানাই এবং আশা করি আজকের এই সভা এবং কঠোর পরিশ্রম ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রচেষ্টার পরে আরও বড় পদক্ষেপ আসবে। আমি বিশ্বাস করিএই দলটি মুসলিম বিশ্বের যুবসমাজকে সচেতন করার জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ কার্য সম্পাদন করবে।

এই আন্তরিক মোবারকবাদ জানানোর  সাথে  আবারও  আজকের এই প্রোগ্রামে উপস্থিত হওয়ার জন্য, এই সত্য পথে আমার সহচর হওয়ার জন্য আপনাদেরকে অন্তরের অন্ত:স্থল হতে মোবারকবাদ জানাই।

অনুবাদঃ সায়েম মুহাইমিন 

 

 
১৬৫১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

জন্ম
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর তুরস্কের সিনপ শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেহমেদ সাবরি এরবাকান। তিনি ছিলেন তুরস্ক সরকারের একজন বিচারপতি। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হন। ফলে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও বিভিন্ন শহরে পরিবারের সাথে বসবাস করতে হয়।

শিক্ষা জীবন
প্রফেসর এরবাকান কায়সেরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষাও গ্রহণ করতে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ইস্তাম্বুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রখর মেধা ও অসীম প্রতিভা দেখে শিক্ষকগণ তাকে 'দরিয়ায়ে নাজমুদ্দিন' (জ্ঞানের সাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। ভালো ফলাফলধারী ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো প্রকার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো। কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র তুরস্কে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তার পড়াশোনা শুরু করেন। তদানীন্তন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না।
তিনি ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুধুমাত্র PhD. ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেতো না, কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকে ক্লাস নেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষকতাকালীন এ সময়েই তিনি তার PhD'র থিসিস তৈরি করেন। উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালে তিনি জার্মানির Aachen Technical University-তে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানকার প্রখ্যাত জার্মানবিজ্ঞানী স্কিমিদ-এর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজও করেন। মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে ৩টি থিসিস পেপার তৈরি করে PhD ডিগ্রি লাভ করেন। তার থিসিসের বিষয় ছিলো 'কীভাবে কম জ্বালানি ব্যয় সম্পন্ন ইঞ্জিন উদ্ভাবন করা যায়'। তিনি তার গবেষণায় সফল হন। তার থিসিস পেপার কটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয়। জার্মানির বিখ্যাত ইঞ্জিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান DEUTZ-এর ডিরেক্টর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর ফ্ল্যাটস তাকে Leopard Tank-এর গবেষণার জন্য আহ্বান জানান। তিনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে Leopard Tank- কে এক অনন্যসাধারণ Tank-এ পরিণত করেন। জার্মানিতে বিভিন্ন গবেষণা এবং কর্মব্যস্ত সময় পার করে পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন। আবারও তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই তিনি এই পদ লাভের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং লেফটেনেন্ট হিসেবে পরবর্তী ৬ মাস কাজ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত একটি সেনাবাহিনীর কেমন অস্ত্রের প্রয়োজন, এমন একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। আমেরিকার জনৈক ক্যাপ্টেন তালিকাটি দেখে এরবাকানের সাথে দেখা করতে চান। ক্যাপ্টেন তাকে প্রশ্ন করেন, "কেন আপনি এমন অস্ত্র তৈরির কথা ভাবছেন? এসব অস্ত্রের ব্যাপারে তুরস্ক সরকার আমেরিকার সাথে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ।" জবাবে এরবাকান বলেন, "এসব অস্ত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা আমেরিকার থাকলে আমাদের থাকবে না কেন?"
তখন তুরস্কে ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে, এরবাকানের পিতা গৃহশিক্ষক রেখে শিশুকাল থেকেই তাকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে ইস্তাম্বুলের প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকুর সান্নিধ্যে ইসলামী শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরবাকানের বক্তব্য জুড়ে থাকতো কোরআন-হাদীসের জ্ঞান ও ইসলামের সোনালী ইতিহাস।

কর্মজীবন
সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি 'গুমুশ মোটর' নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটিই ছিলো সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি। তার জীবনের বড় একটি সংগ্রাম ছিলো এটি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় তিনি অভ্যন্তরীণ ইহুদী লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। অনেক চড়াই-উত্রাই- এর মধ্যে দিয়ে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কোনো এক প্রোগ্রামে এত বাধা-বিপত্তির কথা শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দরেস আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, "আগে এ সম্পর্কে জানতে পারলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই এটি করে দিতাম।" সে প্রোগ্রামে এরবাকান শিল্পায়নের উপর একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আদনান মেন্দরেস তাঁকে Automobile ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই দেভরিম নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ক'দিন পরই এক সামরিক অভ্যুত্থানে আদনান মেন্দরেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক সরকার তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় এরবাকান দেখতে পান-দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যেন কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য The Union of Chambers and Commodity Exchange of Turkey এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এটি অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেন। ফলে, অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক শক্তির জোরে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৬৯ সালে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান কোনিয়া থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাধারণ এক বক্তা ছিলেন। তার বক্তব্যে সবাই বিমোহিত হতো। অল্প সময়েই তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে সবার মনে জায়গা করে নেন। সমগ্র তুরস্কে 'ইসলাম ও বিজ্ঞান' শিরোনামে তিনি কনফারেন্স করতে শুরু করেন। (তার এ বক্তব্য বাংলা ভাষায় 'ইসলাম ও জ্ঞান' শিরোনামে অনূদিত হয়েছে)। তার শিক্ষক প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকু এবং অন্যান্য যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের পরামর্শে গঠন করেন 'মিল্লি গরুশ'। এর মাধ্যমেই তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের দুর্নিবার যাত্রা শুরু হয়।

মিল্লি গরুশ
তুরস্কে ইসলামের নামে যেকোনো ধরনের সংগঠন করা ছিলো নিষিদ্ধ। এ কারণে তিনি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে ইসলাম বোঝাতেন। 'মিল্লি গরুশ' তেমনিই একটি বাক্যাংশ। 'মিল্লি গরুশ' অর্থ-জাতীয় ভিশন। অবশ্য, তিনি মিল্লি গরুশ দ্বারা মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝিয়েছেন।

মিল্লি গরুশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
• আধ্যাত্মিক উন্নতি। ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান এবং তাদেরকে যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা।
• অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুকরণ না করে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি করে এক নতুন তুরস্ক গঠন। • ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং সব মুসলিমকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত থেকে রক্ষা করা।
'মিল্লি গরুশ' প্রতিষ্ঠার পর তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'মিল্লি নিজাম পার্টি'। কিন্তু এ দলটিকে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়। অতঃপর তিনি গঠন করেন 'মিল্লি সালামেত পার্টি'। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশন করে শর্তভিত্তিক সরকার গঠন করে। এরবাকান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীনির্বাচিত হন (অর্থনীতি বিষয়ক)। এছাড়া তার দল থেকে মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও মনোনীত হয়।
এ কোয়ালিশন সরকারের সময় ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার অপরাধে বন্দি হওয়া ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাইপ্রাসকে গ্রীস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা ও মুসলিমদেরকে জুলুমমুক্ত করা, নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা, হাজার হাজার কোরআন কোর্স চালু করা, মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির রিসালা-ই-নূরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, সেনানিবাসসহ সব সরকারি অফিস-আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা-সহ ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অশ্লীলতা-বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি ২৭০টি ভারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে বিমান তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার সাথে কোয়ালিশনে থাকা অন্য দলকে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে।
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকরা ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। সে সাথে সব রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং গ্রেফতার করে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হয়।
তার ওপর এসব জুলুম-নির্যাতন এবং রাজনীতিতে তাকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পর দলের অন্য নেতৃবৃন্দদের দিয়ে তিনি রেফাহ পার্টি প্রতিষ্ঠা করান। এ পার্টি স্বল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারও রাজনীতিতে আসেন। রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পরই রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায়১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ অনেক সিটি কর্পোরেশনে তার দল বিজয় লাভ করে। এ জয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন উদ্যোমে কাজ করে 'ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা' এই স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ১১ মাস সরকার পরিচালনার পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে D-8 প্রতিষ্ঠা করেন। সুদের হার কমিয়ে আনেন। মাত্র ১১ মাসের শাসনামলে তিনি দেশকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। তুরস্কে শিল্পায়নের গতি ফিরিয়ে এনে ৫ বছরের মধ্যে তুরস্কের শিল্পায়ন জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেন।
মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন। তার উত্তরোত্তর সফলতায় আতঙ্কিত হয়ে ইহুদীরা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালায়। তার পার্টি 'শরীয়ত কায়েম করবে' এই অভিযোগে তাকে অপসারণের জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এ অবস্থায় প্রফেসর এরবাকান এ শর্তে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন যে, তার কোয়ালিশন পার্টির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু ফ্রি ম্যাসন ও ইহুদীদের ধারক-বাহক সোলাইমান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রফেসর এরবাকানকেও রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মিল্লি গরুশের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফজিলত পার্টি গঠন করা হয়। এই পার্টিকেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদেত পার্টি তার যাত্রা শুরু করে। কতিপয় নেতা মিল্লি গরুশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব দাবি করে। তারা মূল আন্দোলনেও লিবারেল সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালায়। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে মিল্লি গরুশকে ভেঙ্গে তারা গঠন করেএকে পার্টি। মিল্লি গরুশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সা'দাত পার্টি রয়ে যায় মূলধারার ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। সাদেত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে প্রফেসর এরবাকানকে পুনরায় সাদেত পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শত প্রতিকূলতার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাদেত পার্টি এখনও তাদের এ কর্মস্পৃহা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে দলটি তুরস্কের ৪র্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি।

মৃত্যু
৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান মহান এ নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছিলো, ইস্তাম্বুলের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে। মিডিয়ার ভাষ্য মতে, তার জানাযায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সরকার যেন তাকে বিশেষ কোনো সম্মানে দাফন না করে।
Picture of প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান

জন্ম
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ১৯২৬ সালের ২৬ অক্টোবর তুরস্কের সিনপ শহরের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মেহমেদ সাবরি এরবাকান। তিনি ছিলেন তুরস্ক সরকারের একজন বিচারপতি। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তিনি বিভিন্ন শহরে বদলি হন। ফলে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকেও বিভিন্ন শহরে পরিবারের সাথে বসবাস করতে হয়।

শিক্ষা জীবন
প্রফেসর এরবাকান কায়সেরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। পাশাপাশি গৃহশিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে ইসলামী শিক্ষাও গ্রহণ করতে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ইস্তাম্বুলে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শুরু করেন। প্রখর মেধা ও অসীম প্রতিভা দেখে শিক্ষকগণ তাকে 'দরিয়ায়ে নাজমুদ্দিন' (জ্ঞানের সাগর) উপাধিতে ভূষিত করেন। ভালো ফলাফলধারী ছাত্র-ছাত্রীরা কোনো প্রকার ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো। কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সমগ্র তুরস্কে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ দ্বিতীয় বর্ষ থেকে তার পড়াশোনা শুরু করেন। তদানীন্তন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য নামাজের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না।
তিনি ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে সেখানে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে তিনি প্রথম স্থান অর্জন করার মধ্যদিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। শুধুমাত্র PhD. ডিগ্রিধারী ব্যতীত অন্য কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেতো না, কিন্তু প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানকে ক্লাস নেয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষকতাকালীন এ সময়েই তিনি তার PhD'র থিসিস তৈরি করেন। উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৫১ সালে তিনি জার্মানির Aachen Technical University-তে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানকার প্রখ্যাত জার্মানবিজ্ঞানী স্কিমিদ-এর সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাজও করেন। মাত্র দু'বছরের ব্যবধানে ৩টি থিসিস পেপার তৈরি করে PhD ডিগ্রি লাভ করেন। তার থিসিসের বিষয় ছিলো 'কীভাবে কম জ্বালানি ব্যয় সম্পন্ন ইঞ্জিন উদ্ভাবন করা যায়'। তিনি তার গবেষণায় সফল হন। তার থিসিস পেপার কটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালে প্রকাশিত হয়। জার্মানির বিখ্যাত ইঞ্জিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান DEUTZ-এর ডিরেক্টর প্রখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ডক্টর ফ্ল্যাটস তাকে Leopard Tank-এর গবেষণার জন্য আহ্বান জানান। তিনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে Leopard Tank- কে এক অনন্যসাধারণ Tank-এ পরিণত করেন। জার্মানিতে বিভিন্ন গবেষণা এবং কর্মব্যস্ত সময় পার করে পুনরায় তুরস্কে ফিরে আসেন। আবারও তিনি ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। মাত্র ২৭ বছর বয়সেই তিনি এই পদ লাভের গৌরব অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে প্রথম ৬ মাস এবং লেফটেনেন্ট হিসেবে পরবর্তী ৬ মাস কাজ করেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত একটি সেনাবাহিনীর কেমন অস্ত্রের প্রয়োজন, এমন একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। আমেরিকার জনৈক ক্যাপ্টেন তালিকাটি দেখে এরবাকানের সাথে দেখা করতে চান। ক্যাপ্টেন তাকে প্রশ্ন করেন, "কেন আপনি এমন অস্ত্র তৈরির কথা ভাবছেন? এসব অস্ত্রের ব্যাপারে তুরস্ক সরকার আমেরিকার সাথে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ।" জবাবে এরবাকান বলেন, "এসব অস্ত্র উৎপাদন করার ক্ষমতা আমেরিকার থাকলে আমাদের থাকবে না কেন?"
তখন তুরস্কে ইসলামী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিলো। ফলে, এরবাকানের পিতা গৃহশিক্ষক রেখে শিশুকাল থেকেই তাকে ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে ইস্তাম্বুলের প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকুর সান্নিধ্যে ইসলামী শিক্ষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। এরবাকানের বক্তব্য জুড়ে থাকতো কোরআন-হাদীসের জ্ঞান ও ইসলামের সোনালী ইতিহাস।

কর্মজীবন
সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি 'গুমুশ মোটর' নামে একটি ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তুরস্কের ইতিহাসে এটিই ছিলো সর্বপ্রথম দেশীয় কোনো ইঞ্জিন কোম্পানি। তার জীবনের বড় একটি সংগ্রাম ছিলো এটি। কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় তিনি অভ্যন্তরীণ ইহুদী লবির ষড়যন্ত্রের শিকার হন। অনেক চড়াই-উত্রাই- এর মধ্যে দিয়ে এ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কোনো এক প্রোগ্রামে এত বাধা-বিপত্তির কথা শুনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দরেস আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, "আগে এ সম্পর্কে জানতে পারলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়ই এটি করে দিতাম।" সে প্রোগ্রামে এরবাকান শিল্পায়নের উপর একটি যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আদনান মেন্দরেস তাঁকে Automobile ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তিনি অল্পদিনের মধ্যেই দেভরিম নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ক'দিন পরই এক সামরিক অভ্যুত্থানে আদনান মেন্দরেসকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সামরিক সরকার তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে।
ইঞ্জিন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করার সময় এরবাকান দেখতে পান-দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তাগণ যেন কোনোভাবেই অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য The Union of Chambers and Commodity Exchange of Turkey এক অদৃশ্য হাতের ইশারায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সাথে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করে যাচ্ছে। এটি অবসানের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নির্বাচিত হন। সভাপতি হওয়ার পরপরই সেখানে সাম্য প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেন। ফলে, অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজনৈতিক শক্তির জোরে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসার ঘোষণা দেন।

রাজনৈতিক জীবন
১৯৬৯ সালে প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান কোনিয়া থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অসাধারণ এক বক্তা ছিলেন। তার বক্তব্যে সবাই বিমোহিত হতো। অল্প সময়েই তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে সবার মনে জায়গা করে নেন। সমগ্র তুরস্কে 'ইসলাম ও বিজ্ঞান' শিরোনামে তিনি কনফারেন্স করতে শুরু করেন। (তার এ বক্তব্য বাংলা ভাষায় 'ইসলাম ও জ্ঞান' শিরোনামে অনূদিত হয়েছে)। তার শিক্ষক প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকু এবং অন্যান্য যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের পরামর্শে গঠন করেন 'মিল্লি গরুশ'। এর মাধ্যমেই তুরস্কে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আন্দোলনের দুর্নিবার যাত্রা শুরু হয়।

মিল্লি গরুশ
তুরস্কে ইসলামের নামে যেকোনো ধরনের সংগঠন করা ছিলো নিষিদ্ধ। এ কারণে তিনি প্রতীকী শব্দ ব্যবহার করে মানুষকে ইসলাম বোঝাতেন। 'মিল্লি গরুশ' তেমনিই একটি বাক্যাংশ। 'মিল্লি গরুশ' অর্থ-জাতীয় ভিশন। অবশ্য, তিনি মিল্লি গরুশ দ্বারা মুসলিম মিল্লাতের ভিশনকেই বুঝিয়েছেন।

মিল্লি গরুশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
• আধ্যাত্মিক উন্নতি। ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া জাতিকে পুনরায় ইসলামের দিকে আহ্বান এবং তাদেরকে যোগ্য মুসলিম রূপে গড়ে তোলা। বিশেষ করে যুবকদের মাঝে ইসলামের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা।
• অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা। আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুকরণ না করে স্বতন্ত্রভাবে শিল্পায়ন ও প্রযুক্তিগত উন্নতি করে এক নতুন তুরস্ক গঠন। • ইসলামী ইউনিয়ন গড়ে তোলা এবং সব মুসলিমকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত থেকে রক্ষা করা।
'মিল্লি গরুশ' প্রতিষ্ঠার পর তার রাজনৈতিক শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন 'মিল্লি নিজাম পার্টি'। কিন্তু এ দলটিকে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়। অতঃপর তিনি গঠন করেন 'মিল্লি সালামেত পার্টি'। এই দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ৪৮টি আসন লাভ করে এবং কোয়ালিশন করে শর্তভিত্তিক সরকার গঠন করে। এরবাকান সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীনির্বাচিত হন (অর্থনীতি বিষয়ক)। এছাড়া তার দল থেকে মন্ত্রীসভায় শিল্পমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও মনোনীত হয়।
এ কোয়ালিশন সরকারের সময় ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার অপরাধে বন্দি হওয়া ৬ হাজার মুসলিমকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। সাইপ্রাসকে গ্রীস থেকে মুক্ত করে তার্কিশ সাইপ্রাস গঠন করা ও মুসলিমদেরকে জুলুমমুক্ত করা, নতুন করে মাদ্রাসা শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করা, হাজার হাজার কোরআন কোর্স চালু করা, মাদ্রাসার ছাত্রদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসির রিসালা-ই-নূরের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা, সেনানিবাসসহ সব সরকারি অফিস-আদালতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা-সহ ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। অশ্লীলতা-বেহায়াপনা দূর করার লক্ষ্যে আইন করা হয়। এছাড়া ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি ২৭০টি ভারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এর মধ্যে বিমান তৈরির কারখানা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার এই উদ্যম দেখে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার সাথে কোয়ালিশনে থাকা অন্য দলকে কোয়ালিশন ছিন্ন করতে বাধ্য করে।
৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে তুরস্কের কোনিয়াতে কুদস দিবসের সমাবেশ পালনের অভিযোগে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ সালে সামরিক শাসকরা ক্যু করে এই পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে। সে সাথে সব রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হয়। এরবাকানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ এবং গ্রেফতার করে জেল-হাজতে প্রেরণ করা হয়।
তার ওপর এসব জুলুম-নির্যাতন এবং রাজনীতিতে তাকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর ১৯৮৩ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। মুক্তিলাভের পর দলের অন্য নেতৃবৃন্দদের দিয়ে তিনি রেফাহ পার্টি প্রতিষ্ঠা করান। এ পার্টি স্বল্প সময়েই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৮৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে ড. নাজমুদ্দিন এরবাকানের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তিনি আবারও রাজনীতিতে আসেন। রেফাহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর পরই রেফাহ পার্টি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরই ধারাবাহিকতায়১৯৯৪ সালের স্থানীয় মেয়র নির্বাচনে ইস্তাম্বুল ও আঙ্কারাসহ অনেক সিটি কর্পোরেশনে তার দল বিজয় লাভ করে। এ জয়ের ধারাবাহিকতায় নতুন উদ্যোমে কাজ করে 'ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা' এই স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেন। কিন্তু ১১ মাস সরকার পরিচালনার পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান তার ১১ মাসের শাসনামলে D-8 প্রতিষ্ঠা করেন। সুদের হার কমিয়ে আনেন। মাত্র ১১ মাসের শাসনামলে তিনি দেশকে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন ১০০ ভাগ বৃদ্ধি করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১৫০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। জনগণের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হন। তুরস্কে শিল্পায়নের গতি ফিরিয়ে এনে ৫ বছরের মধ্যে তুরস্কের শিল্পায়ন জাপান ও জার্মানির শিল্পায়নকে ছাড়িয়ে যাবে বলে ঘোষণা দেন।
মুসলিম দেশগুলোকে নিয়ে কমন মার্কেট চালু করেন। তার উত্তরোত্তর সফলতায় আতঙ্কিত হয়ে ইহুদীরা রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে সব ধরনের প্রোপাগাণ্ডা চালায়। তার পার্টি 'শরীয়ত কায়েম করবে' এই অভিযোগে তাকে অপসারণের জন্য সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। এ অবস্থায় প্রফেসর এরবাকান এ শর্তে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন যে, তার কোয়ালিশন পার্টির নেত্রী তানসুকে প্রধানমন্ত্রী করা হবে। কিন্তু ফ্রি ম্যাসন ও ইহুদীদের ধারক-বাহক সোলাইমান দেমিরেল বিশ্বাসঘাতকতা করে মেসুদ ইলমাজকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেয়। এভাবে রেফাহ পার্টিকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি প্রফেসর এরবাকানকেও রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মিল্লি গরুশের অপর নেতা রেজাই কুতানের মাধ্যমে ফজিলত পার্টি গঠন করা হয়। এই পার্টিকেও খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে নিষিদ্ধ করা হয়।
২০০১ সালের ২০ জুলাই সাদেত পার্টি তার যাত্রা শুরু করে। কতিপয় নেতা মিল্লি গরুশে তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্ব দাবি করে। তারা মূল আন্দোলনেও লিবারেল সেক্যুলারিজম প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালায়। সে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে মিল্লি গরুশকে ভেঙ্গে তারা গঠন করেএকে পার্টি। মিল্লি গরুশ দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সা'দাত পার্টি রয়ে যায় মূলধারার ইসলামী আন্দোলন হিসেবে। সাদেত পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। ৮৪ বছর বয়সে ২০১০ সালে প্রফেসর এরবাকানকে পুনরায় সাদেত পার্টির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শত প্রতিকূলতার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সাদেত পার্টি এখনও তাদের এ কর্মস্পৃহা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। বর্তমানে দলটি তুরস্কের ৪র্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি।

মৃত্যু
৮৫ বছর বয়সে ২০১১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান মহান এ নেতা। তার জানাযায় এত পরিমাণ লোকের সমাগম হয়েছিলো, ইস্তাম্বুলের ৩০০০ বছরের ইতিহাসে এর আগে এত লোকের সমাগম হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকেই মানুষ তার জানাযায় অংশগ্রহণ করে। মিডিয়ার ভাষ্য মতে, তার জানাযায় ৩৫-৪০ লাখ লোকের সমাগম হয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, মৃত্যুর পর সরকার যেন তাকে বিশেষ কোনো সম্মানে দাফন না করে।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top