কালচারেল অনুষ্ঠানের আনন্দোৎসবের মধ্যে দিয়াই জাতির সমবেত মন বিকশিত হয়। মানুষের আনন্দ-পিপাসু অতৃপ্ত মন আনন্দরসের আবেহায়াতের তালাশে অজানা স্বপ্নের দেশে উড়িয়া যায় কল্পনার বোরাকের ডানায় চড়িয়া। মন-পবনের নাওয়ে চড়িয়া মাশুক শাহযাদীর তালাশে সে পার হইয়া যায় সাত সমুদ্দুর তের নদী।
এই মানসিক এ্যাডভেনচারেই মানুষ সাক্ষাৎ পায় নিত্য-নতুন সত্য-সুন্দরের। তাকেই তারা বাঁধিয়া রাখিতে চায় আর্টে-সাহিত্যে। সুরতের সংগে সিরতের, বহিরাকৃতির সাথে অন্তর-প্রকৃতির, ব্যক্তের সাথে সত্যের এপিয়ারেন্সের সাথে রিয়্যালিটির সার্থক সমন্বয় ঘটানই আর্টের কাজ। এই সমন্বয়ের সার্থকতা রসসৃষ্টিতে। তার সাফল্য সত্য ও সুন্দর লাভে। উভয়ের সমন্বয়ে যা, হয় তাই সত্য-সুন্দর। এটাই সুফী ধর্মের সাফল্য। সমস্ত কৃষ্টি-সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষ। কারণ সত্য ছাড়া সুন্দর নাই। সুন্দর ছাড়া সত্য নাই। সত্যহীন সুন্দর নিম্নস্তরের রস মাত্র। আর সুন্দরহীন সত্য অকিঞ্চিৎকর ঘটনা মাত্র। এই সত্য সুন্দরের অস্তিত্ব গোড়াতে থাকে মানুষের কল্পনায়। আজিকার কল্পনাই আগামীকালের বাস্তব। আজ যা সত্য, গতকাল তাই ছিল অসত্য। আজিকার ধর্ম, গতকাল ছিল অধর্ম, দণ্ডনীয় পাপ। সমস্ত ধর্ম-প্রবর্তক ও সত্য-আবিষ্কারকের জীবনই এর প্রমাণ। সত্য ও সুন্দর লাভের চিরন্তন ইতিহাসই এই। বর্তমানে অতৃপ্তিই মানসিক এ্যাডভেনচারের বুনিয়াদ। বাস্তবের বাইরে যাওয়ার নামই কল্পনা। এ যেন শূন্যে আসমানে স্পেসে লাফ দেওয়া। একমাত্র অতৃপ্ত ক্ষিধাই এমন সাংঘাতিক ঝুঁকি নিতে পারে। কাজেই যে জাতির এ ক্ষিধা নাই, সে অসুস্থ। যে জাতির কল্পনা নাই সে মৃত। দুনিয়াকে দিবার কিছু নাই তার।
এই স্বপ্ন কল্পনাকে গণ-জীবনে প্রয়োগ সার্থক ও সফল করার প্রধান, এমন কি প্রায় একমাত্র পথ ধর্মোৎসবের আনন্দোল্লাস। হিন্দুর দুর্গোৎসব জন্মাষ্টমীর, বৌদ্ধের মাঘী-পূর্ণিমার, খৃস্টানের বড়দিনের আনন্দোৎসবের জীবন-প্রাচুর্যে তা সুস্পষ্ট। কিন্তু পাক-বাংলার [১] গণ জীবনে সে আনন্দোল্লাস কই? কোথায় ঈদ? কোথায় মোহররম। এ সব উৎসব-পরবে পাক-বাংলার মনের আকাশে জীবন-প্রাচুর্যের লক্ষ তারকা জ্বলিয়া উঠে কি? আমাদের জীবন-সাগরে কর্ম-চঞ্চল্যের ঝড় উঠে কি? আমাদের দেহের শিরায়-শিরার নবজীবনের দ্যোতনার বিদ্যুৎ-প্রবাহ ছুটে কি? প্রাণ-রসের উচ্ছলতায় আমরা ফাটিয়া পড়ি কি? প্রাণের প্রাচুর্য ত কোথাও দেখি না। যা কিছু প্রাচুর্য সবইত দেখি খানা-পিনায়। শুধু পোলাও-কোর্মা আর সিমাই-যর্দা এই আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি? আমাদের কালচার কি শেষে খানা-পিনায় সীমাবদ্ধ হইয়া পড়িল?
ঈদুল-ফিতরের নযির
ঈদুল-ফিতরের কথাটাই ধরা যাক। এই ঈদ আসে ত্রিশ দিন রোযার পরে। রোযার ত্রিশ দিনকে যদি সংযম কৃচ্ছ্র সাধনার মুদ্দত ধরা যায়, তবে রোযা-শেষের ঈদের দিনে প্রাণ-প্রাচুর্যের বাঁধ-ভাংগা বন্যায় আমাদের জীবনের দুকূল ছাপাইয়া পড়া উচিত।
ঈদ অর্থ আনন্দোৎসব। কিন্তু আমাদের ঈদ আর তা নাই। ধর্মোৎসবের ধর্মটুকু উৎসবের উল্লাসের নিচে চাপা পড়ার নযির আছে দুনিয়ায় অনেক। কিন্তু ধর্মের নিচে উৎসব চাপা পড়ার নযির দুনিয়াতে মাত্র একটি। তা আমাদের ঈদ। আনন্দ-উল্লাসের উন্মত্ততায় আমরা খোদাকে ভুলিয়া না যাই-এই উদ্দেশেই ঈদ উৎসবের শুরুতে দুই রাকাত সুন্নত নামাযের বিধান করা হইয়াছিল।
তার কারণ ছিল। উল্লাসের উন্মত্ততায় সব উৎসবই আখেরে পাপাচারের ভৈরবীচক্রে পরিণত হয়। ইতিহাসের শিক্ষা এই। তাই ঈদে এই সাবধানতা অবলম্বন করা হইয়াছিল। ঈদের সমাবেশকে ইবাদতের জামাতে পরিণত করার উদ্দেশ্য তাতে ছিল না।
সেইজন্যই এতে নমাযের অনেক আহকাম ও আরকান-যথা: অযু, আযান একামত ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয় নাই। হায়েযওয়ালী মেয়েদেরেও ঈদের জমাতে শামিল হওয়ার তাকিদ এই কারণেই করা হইয়াছে। গৌরবের যুগে মুসলমানরা ঈদের উৎসবকে ঈদরূপেই পালন করিয়াছে। স্বাধীন ও প্রগতিশীল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে আজো তাই করা হইতেছে। বাংলা ও ভারতে মুসলিম আমলে আমরাও ঈদকে জাতীয় আনন্দোৎসব হিসাবেই পালন করিতাম।
এই আনন্দোৎসবকে আমরা প্রার্থনা-সভায় পরিণত করিয়াছি আমাদের পতনের যুগে। স্বভাবতই এটা ঘটিয়াছে। সাময়িক বিপদেও মানুষ তার আনন্দোৎসবকে সংক্ষিপ্ত ও সঙ্কুচিত করে। স্থায়ী বিপদে ত কথাই নাই। দুর্দিন দীর্ঘস্থায়ী হইলে মানুষ অদৃষ্টবাদী ও অতিরিক্ত ধার্মিক হইয়া পড়ে আমরাও তাই হইলাম। প্রায় দুই-দুইশ’ বছর কি বিপদটাই না গেল আমাদের উপর দিয়া। জান-মাল, মান-ইযযত কিচ্ছু ছিল না। সর্বাত্মক যুলুমে প্রাণ রাখিতেই আমাদের প্রাণান্ত। আনন্দোৎসব করিব কখন? তাই ঈদের দিনের ধর্মের যে বিধানটুকু না করিলেই নয়, সেইটুকু শুধু করিলাম, পারিলে ময়দানে গিয়া নয় ত মসজিদেই। আর বেশির ভাগ ঘরের কোণে বসিয়া বিপদ-তারণ আল্লাহ দরগায় কান্নাকাটি করিয়া কাটাইলাম দুই-দুইশ’ বছর। এই সময়েই আমাদের জীবন হইতে গেল স্বাচ্ছন্দ্য, সমাজ হইতে গেল উৎসব, ঘর হইতে গেল আনন্দ। সেই সঙ্গে গেল আর্ট ও সাহিত্য। আর্ট-সাহিত্য-সংস্কৃতি কাকে বলে, তা যেন আমরা ভুলিয়াই গেলাম। আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের সর্বাপেক্ষা উর্বর ক্ষেত্র ‘ঈদ-পর্ব’ সৃজনীশক্তির দিক দিয়া হইয়া গেল বন্ধ্যা। আমাদের আর্টে-সাহিত্যে নামিয়া আসিল সন্ধ্যা।
নিরানন্দের পরিণতি
ফলে, আজ আমাদের ঈদে আনন্দ নাই, আছে বেদনা। সংস্কৃতি নাই, আছে বিকৃতি। উল্লাস নাই, আছে আর্তনাদ। আনন্দের ক্ষিধা মানুষের পেটের ক্ষিধা ও যৌন ক্ষিধার মতোই তীব্র। সুস্থ ও স্বাভাবিক পথে নির্মল আনন্দ না পাইলে মানুষ পাপের পথে গিয়াই আনন্দ উপভোগ করে। তার উপর পরবাদিতে মানুষের আনন্দ-ক্ষুধায় আসে জোয়ার। এই সময় সাংস্কৃতিক আনন্দ-অনুষ্ঠানে সে ক্ষুধার তৃপ্তি না ঘটাইলে মানুষ কুপথে গিয়া সে পিপাসা মিটাইবেই। আমাদের জীবনে তাই হইতেছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নির্মল আনন্দের অভাবে ঈদের দিনের প্রাণের জোয়ার থামাইতেছি আমরা সিনেমা দেখিয়া, কুস্থানে গিয়া এবং ক্লাবে ‘ঈদবল’ নাচিয়া। এটা বেদনার ও বিকৃতির নযির।
আর্তনাদের নযিরটা আরও প্রত্যক্ষ। মুসলমানদের মধ্যে কত যে বিকলাংগ, কুষ্ঠরোগী ও বেকার ভিক্ষুক ছেলে-বুড়া, নারী-পুরুষ আছে, তার প্রদর্শনী করি আমরা ঈদের দিনে, সদর রাস্তায় ঈদের ময়দানে। বিকলাংগ, কুষ্ঠরোগী, ভিক্ষাজীবী কমবেশী অপরাপর জাতির মধ্যেও আছে। ধর্মস্থানে দান-খয়রাত উপলক্ষে তাদের ভিড়ও হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু জাতীয় আনন্দোৎসবের অনুষ্ঠানে এদের বিভৎস ভিড় হওয়ার ব্যবস্থা বোধ হয় আর কোনও জাতিতে নাই। সমাজ-দেহে ঘা-পাঁচড়া অল্পবিস্তর সব জাতিতেই আছে। বিশেষত শোষণবাদী ধনতন্ত্রী সমাজ দেহে তা বেশি করিয়াই থাকে। কিন্তু জাতীয় আনন্দোৎসবের দিনে ঘটা করিয়া তার প্রদর্শনী খুলে না কেউ। সভ্য মানুষ শরীরের খোস-পাঁচড়া মলম-পট্টি দিয়া ঢাকিয়াই রাস্তায় বাহির হয়। দেহের ঘা বড় ও বিদকুটে করিয়া, গুপ্তস্থানের ঘা কপালে ছড়াইয়া ক্ষতের ডিমনস্ট্রেশন করে শুধু তারাই, পরের দয়ার উদ্রেক করিয়া ভিক্ষা করিয়া খাওয়া যাদের পেশা। যে জাতি ভিক্ষাকে কালচারে সমুন্নত করিয়াছে, তারা ছাড়া আর কেউ এটা পারে না। আমরা পারি, পারি বলিয়াই আমাদের কচি শিশু ছেলে-মেয়েরা ভিক্ষাকে পেশা করিয়াছে। ঈদের দিনে এইসব বিকলাংগ ভিক্ষুকের যে সমবেত আর্তনাদের জবাবে আমরা দুহাতে ফেরা-যাকাতের পাই-পয়সা বিলাইয়া কড়ির মূল্যে বেহেশত কিনিতেছি, সেটা আসলে ভিখারির আর্তনাদ নয়, আমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতিরই আর্তনাদ।
আমাদের তরুণরা এটা তীব্রভাবে অনুভব করে বলিয়াই তারা সম্প্রতি ঈদ রিইউনিয়নের আয়োজন করিতেছে। এটা শুভ সূচনা। কিন্তু এখনও এ অনুষ্ঠান খানা-পিনাতেই সীমাবদ্ধ। একে সাংস্কৃতিক অলংকার পরাইয়া আমাদের প্রমাণ করিতে হইবে যে, মুসলমানের কালচারের চৌহদ্দি পেট নয়।
মোহররমের জীবন-প্রাচুর্য
একমাত্র মোহররম পর্বেই মুসলমানেরা অন্যান্য কালচার গ্রুপের সাথে খানিকটা প্রতিযোগিতা করিয়াছে। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ঢাকার জন্মাষ্টমী ও কলিকাতার বড়দিনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিত একমাত্র কলিকাতার মোহররম। দশ লক্ষ মুসলমানের এই উৎসব পঞ্চাশ লক্ষ বাশিন্দার কলিকাতা নগরীকে পায়ের বুড়া আংগুলে খাড়া রাখিত দশ-দশটা দিন।
তৎকালে বাংলার শহরে-বন্দরে পাড়াগাঁয়ে দশ দিন ধরিয়া ঢাকঢোল-সানাই ও কাড়া-নাকাড়া-দামামার গুরু-গম্ভীর আওয়ায আসমান-ফাটাইয়া পাতাল কাঁপাইয়া ঘোষণা করিত: এই আসিয়াছে মুসলমানের উৎসব মোহররম। প্রতি গাঁ-মহল্লা হইতে এক বা একাধিক আখড়া বাহির হইত। লাঠি-তলোয়ার, সড়কি-বল্লম ও ছুরি-রামদাও ইত্যাদি খেলার বুক কাঁপানো সাংঘাতিক প্রতিযোগিতা করিত তারা। হাজার-হাজার লোক অবাক-বিস্ময়ে দেখিত সে অস্ত্রের খেল্।
কাতল্-মনযিলেরা দিন যতই ঘনাইয়া আসিত খেলোয়াড় ও দর্শকদের উত্তেজনা-উদ্দীপনা ততই বাড়িয়া যাইত। যেন ‘দিকে দিকে চলে কুচকাওয়াজ’ সত্য-সত্যই। এ যেন ‘শহিদী সেনারা’ সত্য-সত্যই সাজিয়াছে। যেন নিজ কানে শুনিতেছি ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণী তল।’ কাজেই ‘চন্দ্রে চল্’ না বলিয়া যেন উপায় নাই। খেলা-রত চলমান আখড়ার পিছনে পিছনে চলিত উদ্দীপিত জনতা।
আখড়াগুলি ক্রমে জমায়েত হইত শহরে-বন্দরে। কাতলের দিনে সমবেত আখড়াসমূহের বাছাই করা খেলোয়াড়দের মধ্যে হইতে দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রতিযোগিতা। সে কি রোমাঞ্চকর লড়াই! মুগ্ধ বিপুল জনতা দেখিত সে অস্ত্র চালনার উস্তাদি। দর্শকরা চাঁদা করিয়া শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের দিত খেলাত-পুরস্কার।
বড়দের এই প্রাণ-মাতানো সাহসিকতার খেলা দেখিয়া ছোট ছোট ছেলেরাও কাঠের তলোয়ার, তালপাতার ঢাল ও টিনের ঢোল বানাইয়া এযিদ-ইমামের লড়াই করিত। আখড়ার লাঠিখেলা ছাড়াও আগের দিনে বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে পাড়াগাঁয়ে ঘোড়দৌড়, নৌকা-বাইচ, ডন-কুস্তি-কসরত ও হরেক রকম বীরত্বপূর্ণ খেলা হইত। পর্বোপলক্ষ্যেই সমবেতভাবে এইসব খেলা হইত বটে, কিন্তু এ সবের প্রস্তুতি চলিত প্রায় সারা বছরই।
তাতে আমাদের মধ্যে একটা জংগী ঐতিহ্য ও সামরিক কালচারও গড়িয়া উঠিয়াছিল। এইসব অনুষ্ঠানে মুসলিম-বাংলার আকাশ-বাতাস জীবন-প্রাচুর্যে মুখরিত হইয়া উঠিত। শুধু স্বদেশবাসী ভিন্ন সমাজের লোকেরাই নয়, বিদেশী আগন্তুক ও পরিব্রাজকেরাও বুঝিত মুসলিম-বাংলার গণ-জীবনে কৃষ্টির প্রাণ-প্রাচুর্য রহিয়াছে এবং সেটা জীবন্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আজ আর তা নাই।
[‘বাংলাদেশের কালচার’ বই থেকে গৃহীত]
টীকাঃ
১. স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে লেখা হওয়ায় লেখক বাংলাদেশ বুঝাতে পাক-বাংলা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। এর ব্যাখ্যা তিনি ভূমিকাতেও দিয়েছেন। লেখার রূপ অক্ষুণ্ণ রাখতে এখানেও হুবহু পাক-বাংলা রাখা হলো।