[১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা ৫নং ম্যাঙ্গো লেন দৈনিক ‘কৃষক’ পত্রিকার অফিসগৃহে, জন সাহিত্য সংসদের শুভ-উদ্বোধনে সভাপতি কাজী নজরুল ইসলামের প্রদত্ত অভিভাষণ।]
সাহিত্যে সবারই প্রয়োজন আছে, দুনিয়ায় হাতিও আছে, আরশোলাও আছে। তাদের কে বড়! কে ছোট! বলা যায় না। তার কারণ, হাতি খুব বড় কিন্তু আরশোলা উড়তে পারে।
জনসাহিত্যের উদ্দেশ্য হলো জনগণের মতবাদ সৃষ্টি করা এবং তাদের জন্য রসের পরিবেশন করা। আজকাল সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপারটা জনগণের একটা মস্ত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে; এর সমাধানও জনসাহিত্যের একটা দিক। সাময়িক পত্রিকাগুলোর দ্বারা আর তাদের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ দ্বারা কিছুই হবে না। সম্পাদকীয় মত উপর থেকে উপদেশের শিলাবৃষ্টির মতো শোনায়। তাতে জনগণের মনের উপর কোনো ছাপ পড়ে না। জনমতও সৃষ্টি হয় না।
যাঁদের গ্রামের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা সেখান থেকেই তাঁদের সাহিত্য আরম্ভ করুন। স্থায়ী সাহিত্য চাই। বক্তৃতা, প্রবন্ধ তাদের প্রাণে দাগ কাটতে পারে না। তাদের মতো করে তাদের কথা, তাদের গল্প বলুন। তারা তো বুঝতে পারে না। কিন্তু সাবধান, আপনাদের মুরুব্বিয়ানা ভাব প্রকাশ না পায় তার মধ্যে, তা হলে তারা পালিয়ে যাবে। চাষীরাও আয়না রাখে; নিজেদের চেহারা যদি তার মধ্যে দেখতে পায় তবে যত্ন করে রাখবে।
আমিও একবার ভাবছিলাম; জারির গান, গাজির গান ওদের ভাষায় লিখে ওদের জন্য চালাব তা হয়ে উঠে নাই।
এ প্রসঙ্গে আমার নিজের বিষয়ে কিছু বক্তব্য আমার আছে। কাব্যে ও সাহিত্যে আমি কি দিয়েছি, জানি না। আমার আবেগে যা এসেছিল, তাই আমি সহজভাবে বলেছি, আমি যা অনুভব করেছি, তাই আমি বলেছি। ওতে আমার কৃত্রিমতা ছিল না। কিন্তু সঙ্গীতে যা দিয়েছি, সে সম্বন্ধে আজ কোনো আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে, ইতিহাস লেখা হবে, তখন আমার কথা সবাই স্মরণ করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। সাহিত্যে আমার দান কতটুকু তা আমার জানা নেই। তবে এইটুকু মনে আছে সঙ্গীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি। আমি আট বছর গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি। তখন যৌবন ছিল, আর আমিও তার চঞ্চলতা নিয়ে যুবক। কিছুর ভয় করিনি। খেতাম হোটেলে, শুতাম মসজিদে, যুবসমাজকে খুব ভালবাসতাম, কিন্তু বহু মেশার পরেও আমি দেখলাম তাদের সাথে যেন আমার আগের মতো মিশা হয়ে উঠছেনা। আমি নিজেকে দোষ দিয়েছি; আমার নিজের ব্যর্থতায় আমি নিজেকেই দায়ী করেছি। তারপর সে পথ ছেড়ে যে পথে আজ চলেছি সে পথে এসে পড়লাম। আর মনে করলাম, ও পথের যোগ্য আমি নই। ও সাহিত্য সম্বন্ধে আমার আত্মবিশ্বাস নেই। আমার নিজের উপর যে সম্বন্ধে নিজেরই বিশ্বাস নেই, সে সম্বন্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আমার সাজেনা।
আজকাল জনসাধারণের জন্য দরদ জেগেছে সবার মধ্যে, কত রকম ‘ইজম’ মতবাদ এর জন্য সৃষ্টি হয়েছে। যা-ই হোক, তাদের এই দরদ যদি সত্যিকারের প্রাণের দরদ হয়, তবেই মঙ্গলের। বাইর থেকে তাদের দরদ দেখালে তারা বিশ্বাস করে না। তাদেরই একজন হতে হবে। তাদের কাছে টর্চলাইট হাতে নিয়ে গেলে তারা সরে দাঁড়াবে, কেরোসিনের ডিবে হাতে করে গেলে, তার থেকে যত ধোঁয়াই বের হোক না কেন, তাদেরকে আকর্ষণ করবেই। কারণ, টর্চলাইটে তারা অনভ্যস্ত। ওতে তাদের চোখ ঝলসায়। কেরোসিনের ডিবে ওদের নিজেদের জিনিস। অবশ্য যাদের টর্চ-লাইটই সম্বল, তাদের পথ শহরের দিকে; গ্রামের দিকে, জনসাধারণের দিকে গেলে তাদের ঠিক হবে না। যাঁরা জ্ঞান বুদ্ধিসম্পন্ন, তাঁদের আমি জনসাহিত্য গড়ার জন্য আসতে বলি না। কিন্তু এমনও তো সাহিত্যিক আছেন, যাঁদের সম্বল কেরোসিনের ডিবে। এ পথ কিন্তু সোজা নয়; কঠিন। ত্যাগ চাই এর পিছনে; পরে দুঃখ করলে কোনো লাভ হবে না। জনসাধারণের যা সমস্যা, তা সাহিত্যিকরাই সমাধান করতে পারবেন। জনগণের সাথে সম্বন্ধ করতে হলে তাদের আত্মীয় হতে হবে। তারা আত্মীয়ের গালি সহ্য করতে পারে, কিন্তু অনাত্মীয়ের মধুর বুলিকে গ্রাহ্য করে না।
ওদের জন্য যে সাহিত্য, তা ওরা এখনো যেমনভাবে পুঁথি পড়ে, আমির হামজা, সোনাভান, আলেফ লায়লা, কাসাসুল আম্বিয়া পড়ে, তখনো সেইভাবে পড়বে। ওদের সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ওদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। যা বলবার বলতে হবে। কিন্তু যেন কান্ডারী বা অহংকারী ভাব ধরা না পড়ে। সে জন্য তথাকথিত ভদ্র পোশাক পরিহিত ভদ্রলোকদের নেমে আসতে হবে কাঁদার মধ্যে তাদেরকে টেনে তোলার জন্য। নেমে এসে যদি ওদের ওঠানোর চেষ্টা করা যায়, তবে সে-চেষ্টা সফল হবে, নইলে না।
আজকাল আমাদের সাহিত্য বা সমাজনীতি সবই টবের গাছ। মাটির সাথে সংস্পর্শ নেই। কিন্তু জনসাহিত্যের জন্য জনগণের সাথে যোগ থাকা চাই। যাদের সাহিত্য সৃষ্টি করব, তাদের সম্বন্ধে না জানলে কী করে চলে?
নিজের কওমের যদি মঙ্গল করতে চাই, তবে তার জন্য অপর কাউকে গাল দেয়ার দরকার করে না। যারা অপরকে গাল দিয়ে ‘কওম’;‘কওম’ করে চিৎকার করে, তারা ঐ এক পয়সায় মক্কা-মদিনা দেখানেওয়ালাদেরই মতো। তারা কওমের জন্য চিৎকার করতে করতে হয়ে যান মন্ত্রী, আর ত্যাগ করতে করতে জমিদার বনে যান। কওমের খেদমত করতে করতে কওম যাচ্ছে গরিব হয়ে, আর গড়ে উঠেছে নেতাদের দালান ইমারত। হযরত ওমর রা., হযরত আলি রা. এঁরা অর্ধেক পৃথিবী শাসন করেছেন; কিন্তু নিজেরা কুঁড়েঘরে থেকেছেন, ছেঁড়া কাপড় পরেছেন, সেলাই করে, কেতাব লিখে, সেই রোজগারে দিনাতিপাত করেছেন। ক্ষিধেয় পেটে পাথর বেঁধে থেকেছেন; তবু রাজকোষের টাকায় বিলাসিতা করেননি। এমন ত্যাগীদের লোকে বিশ্বাস করবে না কেন?
কওমের সত্যিকার কল্যাণ করতে হলে ত্যাগ করতে হবে হযরত ইব্রাহিমের মতো।
দুদিন বাদে কোরবানির ঈদ আসছে। ঈদের নামাজ আমাদের শিখিয়েছে, সত্যিকার কোরবানি করলেই মিলবে নিত্যানন্দ। আমরা গরু-ছাগল কোরবানি করে খোদাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করছি। তাতে করে আমরা নিজেদেরকেই ফাঁকি দিচ্ছি। আমাদের মনের ভিতর যেসব পাপ, অন্যায়, স্বার্থপরতা ও কুসংস্কারের গরু-ছাগল যা আমাদের সৎবৃত্তির ঘাস খেয়ে আমাদের মনকে মরুভূমি করে ফেলছে-আসলে কোরবানি করতে হবে সেইসব গরু-ছাগলের। হজরত ইব্রাহিম আ. নিজের প্রাণতুল্য পুত্রকে কোরবানি করেছিলেন বলেই তিনি নিত্যানন্দের অধিকারী হয়েছিলেন। আমরা তা করিনি বলে আমরা কোরবানি শেষ করেই চিড়িয়াখানায় যাই তামাসা দেখতে। আমি বলি ঈদ করে যারা চিড়িয়াখানায় যায় তারা চিড়িয়াখানায় থেকে যায় না কেন?
এমনি ত্যাগের ভিতর দিয়ে মানুষকে যারা আপনার করে নিতে পারবে তারাই হবে মানবতার অগ্রপথিক।
নয়া জামানা
১ম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা
ফাল্গুন, ১৩৪৫