কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল। প্রধানত যে তিনজন ব্যক্তি আধুনিক বাংলা সাহিত্য গড়ে তুলেছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। এ তিনজন ব্যক্তির মধ্যে একজন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, অন্যজন হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তৃতীয়জন কাজী নজরুল ইসলাম।
কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের চর্চা করেছেন। তাঁর কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোট গল্প ও গান রয়েছে। তাঁর প্রবন্ধ রয়েছে, অনুবাদও আছে। অনুবাদের মধ্যে আল কুরআনের আমপারা, রুবাইয়াতে ওমর খৈয়াম রয়েছে। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যে নজরুলের ব্যাপক অবদান রয়েছে; কিন্তু তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো কবিতা ও গানের ক্ষেত্রে। তাঁর কবিতার নানা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
একদিকে নজরুল বিপ্লবী কাব্যের রচয়িতা। তিনি তার বিপ্লবী ও সংগ্রামী কবিতার মাধ্যমে তৎকালীন ভারতবর্ষের বাংলাভাষী অঞ্চলের মানুষ শুধু নয়, গোটা ভারতবাসীকে উজ্জীবিত করেছেন। সেই সাথে তিনি আরবি ও ফারসি শব্দের যেগুলো বাংলা ভাষায় কম-বেশি জনগণের মধ্যে প্রচলিত ছিল এবং পুরনো বাংলায় যার ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়, তাকে নতুনভাবে তার কবিতায় নিয়ে আসেন। কাব্যের ক্ষেত্রে এটা নজরুলের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং এ ক্ষেত্রে তিনি যে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছেন তা প্রায় সবাই স্বীকার করে থাকেন। আমরা এমন কাউকে জানি না, যিনি নজরুলের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে অন্যায় বা ভুল বলেছেন কিংবা সঠিক বলেননি, বরং বেশির ভাগ লেখককে বলতে দেখেছি, নজরুল অসম্ভব দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে আরবি-ফারসির যেসব শব্দ মুসলিম জনগণের মুখের ভাষার সাথে ছিল, সেগুলোকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম বিশেষ করে গানের ক্ষেত্রে অসামান্য প্রতিভা দেখিয়েছেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ কথা ও সুরের অসংখ্য গান লিখেছেন। সুন্দর ও কালোত্তীর্ণ গান লিখেছেন। এ গানের মধ্যে আবার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে ইসলামি গান বা ইসলামি সঙ্গীত। ইসলামি সঙ্গীত, বিশেষ করে তার হামদ ও নাতের ক্ষেত্রে এবং অন্য ধরনের গজলের ক্ষেত্রে তিনি যে দক্ষতা দেখিয়েছেন আজো কেউ বাংলা সাহিত্যে তা অতিক্রম করতে পারেনি। এমনকি গোলাম মোস্তফা, ফররুখের মতো বিরাট প্রতিভা যে কাজ করেছেন তাতে হামদ-নাতের ক্ষেত্রে নজরুলের সমকক্ষ হতে পারে না।
নজরুলের সাহিত্য নিয়ে আমাদের দেশে অনেকেই লিখেছেন। গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ তাদের একজন। তিনি একজন বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক। তিনি নজরুলের ওপর অনেক নিবন্ধ ও বই লিখেছেন। তিনি ফররুখসহ অন্য সাহিত্যিকদের ওপরও অনেক সমালোচনা লিখেছেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলামের ওপর। সেখানে তিনি নজরুলের গানের ওপর এবং আরবি-ফারসি শব্দসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দের ব্যবহার ও প্রয়োগের বিষয়েও বলেছেন। সে ব্যাপারে নতুন করে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু এ প্রসঙ্গে যেসব বিষয়কে এ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি, তার মধ্যে কয়েকটি কথা তুলে ধরা দরকার।
প্রথমত একজন বড় সাহিত্যিককে কী মানদণ্ডে বিচার করা হবে বা কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে?
যেমনঃ কিসের ভিত্তিতে আমরা শেক্সপিয়র ও দাম্ভেকে মূল্যায়ন করব? কিংবা কিসের ভিত্তিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলামকে বিচার করতে পারি? কিসের ভিত্তিতে ইকবাল ও গালিবকে বিচার করা হবে? আমার মনে হয়, এ বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বিচারের মানদণ্ড প্রধানত একটি। তা হচ্ছে তাদের সাহিত্যকর্ম। সেটা হলো- কতটুকু সাহিত্য হয়েছে, তার কবিতা কতটুকু সত্যিকার কবিতা হয়েছে, তার গানে কতটুকু সাহিত্য হয়েছে, তার গান কতটুকু গান বা সঙ্গীত হয়েছে এবং সেটা সাহিত্যের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েছে কিনা। আর এটা করাই সঠিক ও ন্যায়নীতিসঙ্গত। আমরা তা করেও থাকি, যদিও তা আমরা অনেক সময় উপলব্ধি করি না। যেমন আমরা যখন শেক্সপিয়রের নাটক মূল্যায়ন করি, তখন এ ভিত্তিতে করি না যে, তিনি খ্রিষ্টান ছিলেন। অর্থাৎ বলা যায়, খ্রিষ্ট ধর্মের আলোকে আমরা শেক্সপিয়রকে বিচার করি না।
অন্য সাহিত্যিকদের মধ্যে টলস্তয়, পুশকিন বা পার্ল এস বাককে আমরা বিচার করি না যে, তিনি কতটা খ্রিষ্টান ছিলেন। বিষয়টি আমরা যদি অন্যদের ক্ষেত্রে করি তাহলে সেটা আমাদের দেশের লেখকদের ক্ষেত্রেও করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখকেও সাহিত্যের সেই মানদণ্ডেই বিচার করতে হবে।
আমি স্বীকার করছি, একজন মুসলিম হিসেবে আমার খুব ভালো লাগে, যদি কোনো কবি ইসলামকে ধারণ করেন; ইসলামের চেতনাকে ধারণ করেন, এটাকে ব্যক্ত করেন এবং তা তুলে ধরেন। এটা সম্পূর্ণভাবে করলে বেশি খুশি লাগবে, আংশিক করলেও খুশি হবো। তারপরও, কোনো সাহিত্যেকের বিচারের মানদণ্ড এটা একথা মনে করতে পারি না। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখা উচিত।
দ্বিতীয়ত যেকোনো কারণেই হোক, যে মানদণ্ডে আমরা শেক্সপিয়রকে বিচার করি না, সেখানে কেন আমরা নজরুল ইসলাম বা রবীন্দ্রনাথকে বিচার করব? রবীন্দ্রনাথের কোনো রাজনৈতিক মত বা বক্তব্য পছন্দ না-ও হতে পারে। তাই তাকে সেই মানদণ্ডে না নিয়ে সাহিত্যের আলোকে বিচার করতে হবে। তেমনিভাবে, কাজী নজরুল ইসলামকেও রাজনৈতিক মতাদর্শের মাধ্যমে বিচার করা সঙ্গত হবে বলে মনে করা যায় না।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি প্রশ্ন এসে যায়। কাজী নজরুল ইসলাম পূজার কিছু গান লিখেছেন, যাকে শ্যামাসঙ্গীত বলা হয়। আমরা এটাকে কিভাবে দেখব? তিনি এসব গান কেন লিখেছেন, এর কারণ তিনিই ভালো জানেন। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই বাদ দেয়া সম্ভব নয়। তবে আমাদের কি এটা প্রমাণ করতেই হবে যে, নজরুল সর্বাংশে ইসলামের অনুসারী ছিলেন। যেহেতু তিনি পূজার অনেক গান লিখেছেন, তাই এটা আমরা পুরো প্রমাণ করতে পারব না। এর প্রয়োজনও নেই। আমি মনে করি, এ বিতর্কও অপ্রয়োজনীয়; বরং কারো সাহিত্যকর্ম থেকে যার যেটুকু বা যেটা ভালো লাগে, আমরা সেটা নেব। এতে আমি কোনো অসুবিধা বা সমস্যা দেখি না।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় আমাদের সমাজে এসে যায় বলেই কথাটি শুধু তুলেছি। আমাদের বাল্যকালে একটি অকারণ তর্ক দেখেছি। হিন্দু ছেলেরা বলত, রবীন্দ্রনাথ অনেক বড়, নজরুল ইসলাম এমন কিছু নয়। আর আমরা এর বিপরীতে বলতাম, নজরুল ইসলাম বড়, রবীন্দ্রনাথ অত বড় নয়। এ বিতর্ক এখনো সরবভাবে না হলেও নীরবভাবে আছে। কিন্তু এর কী প্রয়োজন? আমি মনে করি, কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা তো অন্যান্য কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে আলোচনায় এ রকম তুলনামূলক আলোচনা করি না যে, কে বড়? তাহলে এ দুইজনের ক্ষেত্রে এরকম হবে কেন? এ আলোচনা আসলে একেবারেই নিরর্থক যে, রবীন্দ্রনাথ বড় না নজরুল বড়। আসলে এ ধরনের আলোচনা থেকে দূরে থাকাই আমি সঠিক মনে করি।
কেউ কেউ বলেন, নজরুল ইসলাম সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। এ কথা বলার তাৎপর্য হতে পারে, অন্যরা যেন অসাম্প্রদায়িক নন, কিংবা ইকবাল অসাম্প্রদায়িক নন, ফররুখ বা আমি নিজে অসাম্প্রদায়িক নই। যদিও আমি কবি-সাহিত্যিক কোনোটাই নই, তবুও মনে করি- এটা বলা ভুল। নজরুল ইসলাম তার নিজস্ব পদ্ধতিতে, তার মতো করে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তিনি হয়তো মনে করেছেন, তিনি ইসলামের জন্য লিখবেন। এটিই তার প্রধান ক্ষেত্র; কিন্তু তিনি সমাজের হিন্দুদের জন্যও কিছু লিখবেন। শুধু এ কারণেই অসাম্প্রদায়িক বলা এবং অন্য সম্প্রদায়ের জন্য যদি কিছু লেখা না হয়, তাহলে অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না- এমনটা মনে করা, এটা কেন করা হবে, আমার উপলব্ধিতে আসে না। আমি মনে করি, তিনিও অসাম্প্রদায়িক, যিনি নিজেরটা লিখলেন; কিন্তু অন্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ালেন না; বিদ্বেষ পোষণ করলেন না।
এ দৃষ্টিতে কিছু লোক ছাড়া, যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন যেমন ‘আনন্দ মঠের’ লেখক বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় যিনি স্পষ্ট মুসলিমবিদ্বেষী ভূমিকা পালন করেছেন। এ রকম যদি কেউ করে থাকেন, তবে তার কথা আলাদা। না হলে সবাই মোটামুটি অসাম্প্রদায়িক।
একটা কথা বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ মুসলমানদের সম্পর্কে কিছু লেখেননি; কিন্তু এ কথা তো আরো অনেকের ক্ষেত্রেই বলা যায়। যেমন- শেক্সপিয়র, তিনি তো মুসলমানদের জন্য কিছুই লেখেননি। তাহলে কী করে তাকে ‘গ্রেট’ বলব? ফেরদৌসী, রুমী- এরা তো মুসলিমদের বাইরে কারো জন্য কিছু লেখেননি। তাহলে কি তারা গ্রেট নন? গ্রেট হওয়ার জন্য কি অবশ্যই সবার জন্য লিখতে হবে? তা না লিখলেই কি আমরা তাকে মন্দ বলব?
এ কথা তো বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের একটা বিরাট অংশের সাথে মানুষের গভীর অনুভূতির সম্পর্ক রয়েছে। সেখানে প্রকৃতির উপলব্ধিকে তো কোনো ধর্মের বলে উল্লেখ করা সঠিক হবে না। কেউ কেউ তার অন্তর্নিহিত সুরের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি রয়েছে বলে প্রশ্ন করতে পারেন। তাহলে তো বলা যায় সবারই অন্তর্নিহিত সুরের মধ্যে তার নিজস্ব বিশ্বাসের কথা রয়েছে। দুনিয়ার এমন কোনো ব্যক্তি নেই, যা অন্তর্নিহিত সুরের মধ্যে কিছু না কিছু নিজের বিশ্বাসের প্রতিফলন নেই। তাহলে এ ক্ষেত্রে একজনের জন্য এই যুক্তি আনা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
আমি মনে করি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিকেই শুধু তার রাজনীতি বা বিশ্বাস দ্বারা বিচার করা ঠিক হবে না। তাদেরকে অবশ্যই প্রথমত সাহিত্যের মানদণ্ড দিয়েই বিচার করতে হবে। সবচেয়ে বেশি খুশি হই, যদি কোনো কবি ইসলামকে ধারণ করেন। সেটা তো সাহিত্য বিচারের অন্য একটা দিক। সেটা সাহিত্যিকদের আদর্শিক শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
পরিশেষে বলতে চাই, আমার জীবন গঠনে কাজী নজরুল ইসলাম প্রভাব বিস্তার করেছেন। অল্প বয়সেই তার কবিতা পড়েছি, সেগুলো আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে খুব কম লোকই আছেন, যারা তার হামদ-নাত বা কবিতা দ্বারা প্রভাবিত হননি। অবশ্য আমরা উপলব্ধি করি না; কিন্তু আমাদের গঠনে তা প্রভাব বিস্তার করে আছে। ব্যক্তিগত ও গভীরভাবে আমি তার খুবই অনুরাগী। আমি মনে করি, বাংলাদেশে নজরুলচর্চা খুবই ব্যাপক।