আল্লাহ যেহেতু এক এবং একক, সে কারণে তার সকল আদেশই সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এই বিশ্বজনীনতা কর্তা হিসেবে অর্থাৎ আদেশ পালনকর্তা হিসেবে মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আবার কর্ম হিসেবেও মানুষের বেলায় প্রযোজ্য যাদের মধ্যে আল্লাহর আদেশগুলো পূরণ হয়। এর পূর্বে মানুষ একত্র হয়েছে রেস্ (নরগোষ্ঠী) অথবা সংস্কৃতির ভিত্তিতে কিংবা উভয়ের ভিত্তিতে। ইসলাম মানবিক মিলনের এক অভিনব ভিত্তি স্থাপন করেছে, উম্মাহ হচ্ছে সেই ভিত্তি।

 

ইতিপূর্বে আমরা আলোচনা করেছি দৃষ্টি, ইচ্ছা এবং কর্মের ত্রয়ী ঐকমত্য হচ্ছে উম্মাহ, যাতে কেবল মুসলমানরাই একমত হবে বলে আশা করা হয়। তাওহীদ যে বিশ্বজনীনতা বুঝায় তা একটি নতুন বিন্যাস দাবী করে। যেহেতু মুসলিম উম্মাহ একটি নতুন সমাজ, যার ভিত্তি গোত্র বা রেস নয় বরং ধর্ম, তাই আশা করা হয় অমুসলমানরাও এই নীতিই অনুসরণ করবে, অর্থাৎ তারা গোত্র এবং রেসের বন্ধন অতিক্রম করে ধর্মের ভিত্তিতে নিজেদেরকে সংগঠিত করবে। আধুনিক পাশ্চাত্য প্রচার মাধ্যম ধর্মকে মনে করে পশ্চাতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানব সংহতির অচল বিভেদমূলক ও সংকীর্ণ নীতি। কিন্তু ধর্ম মোটেই তা নয়। এখনো পৃথিবীতে মানবজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ধর্ম। ধর্মেই আমরা পাই মানুষের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সংজ্ঞা। খ্রীষ্টিয়ান চার্চের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য জাতিগুলোর দীর্ঘ এবং তিক্ত সংগ্রাম ধর্মের এই অপখ্যাতির জন্য দায়ী’ [১] যেহেতু চার্চের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করেছে রাজার প্রতি আনুগত্য, নৃতত্ত্বকেন্দ্রীকতা এবং জাতীয়তাবাদের শক্তিসমূহ। [২]

তাই মিলনের ভিত্তি হিসেবে এবং ধর্মের উদ্দিষ্ট বিশ্বজনীন সমাজের বুনিয়াদ হিসেবে ধর্ম পরিত্যক্ত হয়েছে এবং চার্চের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের জন্য নিন্দিত হয়েছে। তাই পাশ্চাত্য মন এনলাইটেনমেন্টের আদর্শে মুখ ফিরিয়েছে। বিশ্বজনীন সম্প্রদায়ের আদর্শের দিকে যেখানে চার্চের একই আদর্শ অনুসৃত হল কেবল যুক্তির ভিত্তিতে, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়। পরে আবার সে আদর্শ পরিত্যক্ত হয়, কারণ বৈপ্লবিক ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী -সাম্রাজ্যবাদীদের মোকাবেলায় পশ্চিমা জগৎ তা সমর্থন করতে গিয়ে স্নায়ুর শক্তি হারিয়ে ফেলে।

ইসলাম পৃথিবীকে দেখতে চেয়েছে বাস্তবতা সম্পর্কে তার নিজের ধারণা, তার নিজের আদর্শ, তার স্বজন ও বংশধরদের ও মানব জাতির চূড়ান্ত গন্তব্য সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে, আর এ সমুদয় নিয়েই গঠিত ইসলাম। ইসলাম অমুসলমানদের কাছ থেকে এ ধরনের একটি সত্যকে প্রত্যাহার করবেনা যা দ্বীনের উপর ভিত্তি করে নিজেদের সংগঠিত করে পালন করে থাকে। পক্ষান্তরে, ইসলাম এ তাগিদ দেয় যে তারা একইরূপ সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করবে অন্য কোন ভিত্তির উপর নিজেদের পরিচয় দিতে বা সমাজ গঠনে অস্বীকৃতি জানিয়ে; বস্তুত এটা ইসলামের জন্য আরো সম্মাজনক যে, যারা ইসলাম অনুসরণ করবেনা তাদের পার্থিব জীবনের সকল গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে প্রতিযোগী হিসেবে দেখে এবং তাদের কেবল এই সব প্রশ্নের জবাবকে কেন্দ্র করে গঠিত সমাজ বলেই গণ্য করে। [৩]

হিযরতের পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদেরকে দ্বীনের ভিত্তিতে একটি সংগঠনরূপে সংগঠিত করেন। তিনি ‘আওস’ এবং ‘খাযরাজ’ গোত্র দুটিকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তাদেরকে সংঘবদ্ধ করেন, কোরাইশের সেই সব গোত্রীয় লোকদের সাথে, যাদেরকে তিনি মদীনায় পাঠাতে শুরু করেছিলেন। তদুপরি তিনি আযাদ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন দাসদের সঙ্গে, প্রভুকে তার প্রজার সঙ্গে, তাদের সকলের জন্য সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে আল্লাহর আইনকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় কায়েম করেছিলেন। সমভাবেই তিনি তাদের উপর নিজেকে স্থাপন করেছিলেন রাজনৈতিক ও বিচার বিষয়ক প্রধান হিসেবে। কিন্তু ৬২২ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসে মদীনায় পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুসলমান ও ইহুদীদের জন্য একটি সনদ ঘোষণা করেন, যে চুক্তিতে মুসলমান ও ইহুদীরা আবদ্ধ হবে এবং তদনুসারে তাদের জীবনকে গঠন করবে। এই সনদটি ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান এবং বিশ্বব্যবস্থার গঠনতন্ত্র, মানবজাতির জন্য যে ব্যবস্থার নির্মাণ হচ্ছে ইসলামের লক্ষ্য। এই সংবিধান বলবৎ করার মানেই ছিল ইসলামী রাষ্ট্রের প্রবর্তন এবং তৎসহ বিশ্ব ইতিহাসে একটি প্রতিযোগী আন্দোলন হিসেবে ইসলামের ঘোষণা। এই শেষোক্ত বিবেচনায় উদ্দীপিত হয়ে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ঘোষণা করেন যে, এই দিবসটি হচ্ছে ইসলামী ইতিহাসের সূচনা, ইসলামের সময়কে হিসেব করার শুরু। মূলত [৪] সংবিধানটি ছিলো একটি সনদ যার বলে সৃষ্টি হল ইসলামী রাষ্ট্র, এই সনদ বা চুক্তি হল রাসূলুল্লাহ (সা.), মুসলিমগণ এবং মদীনার ইহুদী ও বিভিন্ন গোত্রের লোকদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি। এই সনদের গ্যারান্টার হচ্ছেন আল্লাহ নিজে যার নামে তা প্রবর্তিত হল, এই সনদ প্রথমে গোত্রীয় আনুগত্যের পরিচয়ে দল গঠনের পদ্ধতিকে উচ্ছেদ করে এবং কর্তব্য, অধিকার ও দায়িত্বকে গোত্রের প্রতি আনুগত্য হিসেবে প্রকাশ করার নিয়ম রহিত করে। গোত্রবাদের স্থানে এই সনদ দ্বীনকে প্রথম নীতি হিসেবে স্থাপন করে এবং তার অধীনে বিভিন্ন গোত্র সামাজিক মর্যাদার এবং নানা জাতের লোকদের সংঘবদ্ধ করে। তখন থেকে সকল মুসলমান হল একটি মুক্ত, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত উম্মাহর সদস্য, যার সামাজিক ঐক্যবন্ধন হচ্ছে ইসলাম। [৫] মুসলমানদের উম্মাহর পাশাপাশি ছিল আর একটি উম্মাহ-ইহুদী উম্মাহ। মুসলমানদের মত তারাও নিজেদেরকে গঠন করবে একটিমাত্র পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত সত্তায় তাদের গোত্রীয় আনুগত্য উপেক্ষা করে। তাদের উম্মাহ শাসিত হবে ইহুদী (তাওরাত) আইন দ্বারা এবং এর সদস্যদের জীবন পরিচালিত হবে রাব্বিগণ কর্তৃক ব্যাখ্যাত ইহুদী ধর্মের বিধিবিধান দ্বারা। ইসলামে রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে ইহুদী উম্মাহর সুরক্ষা, রাব্বিনিক আদালতের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা, এবং এর কল্যাণ ও বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা, শান্তি ও পরিবেশের ব্যবস্থা করা।

 

ছয় বছর পরে দক্ষিণ আরবের নাজরানের খ্রীষ্টানরা মদীনায় রাসূলুল্লাহর (সা.) সঙ্গে সাক্ষাত করে ইসলামী রাষ্ট্রে তাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করার জন্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে অভিনন্দিত করে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানান, তাদের মধ্যে যারা ইসলাম কবুল করলো, তারা মুসলিম উম্মাহর ভেতর সামিল হয়ে গেল, কিন্তু যারা খ্রীষ্ট ধর্ম ত্যাগ করলনা রাসূলুল্লাহ তাদেরকে ইহুদীদের মত আর একটি উম্মায় সংগঠিত করলেন, তাদের জন্য একই অগ্রাধিকার এবং কর্তব্যের নিশ্চয়তাসহ। পরবর্তীকালে খলিফারা একের পর এক একই মর্যাদা দিয়েছেন জরথুস্ত্রীয়, হিন্দু এবং বৌদ্ধগণকে। ইসলামী রাষ্ট্র সম্প্রসারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে নওমুসলিমরা মুসলিম উম্মাহর পরিসর স্ফীত করে তোলে, এবং যারা ইসলাম কবুল করলোনা তারা ইহুদী, খ্রীষ্টান ও অন্যান্য উম্মাহর সদস্য রয়ে যায়। প্রথমোক্তগণ ইসলামী রাষ্ট্রের পদাংক অনুসরণ করে, ইসলামী রাষ্ট্রের মধ্যে নওমুসলিম লোকদের অন্তর্ভুক্ত ও অঙ্গীভূত করে নেয় এবং নতুন ব্যবস্থার নাগরিক হিসেবে তাদেরকে পুনর্বাসিত করে। প্রথম দিকের কয়েক যুগ পর ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাথমিক আঞ্চলিক সম্প্রসারণের পর ইসলামী রাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণে সংখ্যাগুরু ছিলো অমুসলিমরা। রাষ্ট্রের সেবাযত্নের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের বিষয়বস্তু ছিলো এইসব অমুসলিমের ভবিষ্যত এবং নিশ্চয়তা, তাদের কল্যাণ এবং প্রতিষ্ঠাসমূহ।

আজকের দিনে জাতি অর্থে যাকে ‘স্টেট’ বলা হয়, সেই অর্থে ইসলামী রাষ্ট্র একটি রাষ্ট্র নয়। ইসলামী রাষ্ট্র একটি সমজাতিক সমগ্র নয়, একটি জাতীয়তামূলে সংহত একক নয়। সম্প্রদায় শব্দটির সংজ্ঞাবদ্ধ সদস্যদের একটি সম্প্রদায় নয়, যার একমাত্র যৌক্তিকতা হচ্ছে সকল বিষয়ের মানদণ্ড হিসেবে এর প্রতিরক্ষা ও খিদমত। ইসলামে রাষ্ট্র ছিল একটি সুদৃঢ় কেন্দ্র, যার প্রতিরক্ষার পেছনে ছিলো একটি প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি এবং একটি মুসলিম উম্মাহর সমর্থন ও স্বায়ত্তশাসিত ধর্মীয় সম্প্রদায়সমূহের একটি ফেডারেশনের সহযোগিতা, যে সম্প্রদায়গুলোর প্রত্যেকটিরই ছিলো নিজস্ব ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের সকলের উপর ছিলো ইসলামী রাষ্ট্র, তবে তার ক্ষমতা ছিলো কেবল নির্বাহী ক্ষমতা। রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ছিলোনা। রাষ্ট্র নিজেকে যে আইনের অধীন মনে করতো তা হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত, তার অভিপ্রায়কে কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, পৃথিবীতে রাষ্ট্রের মিশন হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র তার সম্প্রসারণ এবং তাতে করে সকল মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের ভিত্তিতে একত্রীকরণ, কেননা আল্লাহ মানুষকে বিভিন্ন গোত্র, জাতিতে বিভক্ত করেছেন, পরিচয়ের সুবিধা এবং সহযোগিতার জন্য। [৬] ইসলামী রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ব হচ্ছে আইনের, রাষ্ট্র তার সকল প্রতিষ্ঠানসহ এই আইনের নির্বাহী শক্তিমাত্র। এই ঐশী আইন রাষ্ট্রের মিশন হিসেবে বিধান দিয়েছে এই পৃথিবীকে এবং মানবজাতিকে আল্লাহ তাঁর প্রত্যাদেশ মারফত যে নমুনা দিয়েছেন সেই নমুনার আদলে রূপান্তরিত করতে।

ইসলামী রাষ্ট্র খ্রীষ্টান, ইহুদী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রের গঠনকারী উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতেই কেবল বাধ্য নয় বরং সমগ্র মানবজাতিকেই ইসলামী রাষ্ট্রের অন্তর্গত করা তার দায়িত্ব। তাই অপরিহার্য হয়ে পড়ে যে, ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানে এমন একটা জীবন ব্যবস্থার সুযোগ থাকবে যেখানে সকল সম্প্রদায় শান্তিতে বসবাস করবে পুরো ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে এবং একে অপরের সঙ্গে নানা কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সাথে। ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধানে এ সকলেরই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

 

ক. ইসলামে শান্তি

ইসলাম যে নতুন বিশ্বব্যবস্থা পেশ করেছে তা হচ্ছে শান্তির ব্যবস্থা, পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য যুদ্ধ এবং শত্রুতার চির অবসান ঘটাতে হবে। এই শান্তি সকলের জন্য, এবং ব্যক্তি ও গ্রুপ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য এই শান্তির দ্বার অবারিত। আল্লাহ মুসলমানদেরকে আদেশ করেছেন, “হে বিশ্বাসীগণ, তোমরা শান্তিতে প্রবেশ কর সম্পূর্ণভাবে এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা।” [৭] তিনি তাদেরকে আদেশ করেছেন সকল মানুষকে শান্তির দিকে আহ্বান করতে। “যদি তারা (বিরোধীগণ) শান্তির প্রতি আগ্রহশীল হয়, তোমরাও শান্তি অনুসরণ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন কর। [৮]” শান্তির ব্যবস্থা প্রদান করতে হবে সকল মানুষকে এবং প্রত্যশা করা হয় যে, সকলেই তা গ্রহণ করবে এবং সর্বান্তকরণে সকলে শান্তিতে প্রবেশ করবে, শান্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা যাবেনা। যদি কেউ প্রত্যাখ্যান করে তবে বুঝতে হবে সে দল শান্তি চায়না এবং তা যুদ্ধ ঘোষণারই শামিল। নিদেনপক্ষে অবস্থা এই হতে পারে যে, শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান দ্বারা বুঝাতে পারে, যে দল শান্তির প্রস্তাব দিয়েছে বিরোধী দল তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক স্থাপনে অনিচ্ছুক। কিন্তু এ তো ‘আইসোলেশনিজম’ বা অন্যদের থেকে দূরে সরে থাকা; এই বিকল্প কিন্তু যুদ্ধের মতই নিন্দনীয় যদিও তা হিংসাত্মক নয়। কারণ এতে শান্তির দাবির প্রতি তাচ্ছিল্য বুঝায়। যে দাবি উত্থাপিত হয়েছে ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অথবা এর দ্বারা বুঝায় ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আদান প্রদানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জনগণকে নিরাপদ রাখার বাসনা। ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই দুই বিকল্পের জন্যই শান্তি হচ্ছে জবরদস্তিমূলক জবাব; প্রথমত, যে কোন জনের পক্ষ থেকে শান্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা অমানবিক কাজ এবং দ্বিতীয়ত, যে লোকগুলোকে এ ধরনের আদান প্রদানের জন্য আহ্বান করা হয়েছে তাদের মর্যাদার জন্য তা অপমানজনক। বস্তুত নর-নারী নির্বিশেষে কেউ যাতে অন্যদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে কোন মানুষকে একটা নিরেট পর্দার অন্তরালে আড়াল করা তার সততার বিশ্বাসযোগ্যতার উপর আক্রমণ এবং সে কারণে এরূপ কর্ম সেই লোকের বিরুদ্ধে একটি আগ্রাসী কার্য। ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে প্রকল্পিত আদান প্রদান হতে পারে ব্যবসায়িক এবং সামাজিক সম্পর্কের মাধ্যমে, যা অন্য রাষ্ট্র আপত্তিকর মনে করতে পারে, কিন্তু তাতে সম্ভাব্য ভবিষ্যত সম্পর্কগুলোর সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায় না। সকল আর্থক এবং সামাজিক আদান প্রদানের পরও রয়েছে ইসলামের এই আদর্শগত দাবি যে, বিশ্বশন্তির একটি নতুন ব্যবস্থা হচ্ছে মানব জাতির অধিকার, যোগাযোগের এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে মানুষ আদান প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাধীন। অন্যের কথা শুনতে ও অন্যকে তার কথা শোনাতে, অন্যকে সত্যের ব্যাপারে বিশ্বাসী করতে এবং অন্যের দ্বারা নিজে বিশ্বাসী হবার বেলায় সে বাধাহীন, তার সামনে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবেনা। ইসলামী রাষ্ট্র তার সনদ দ্বারা বাধ্য আল্লাহর কালাম ঘোষণা করতে, এর দাবি এই যে, তার কথা শুনতে হবে। বাণীটি গৃহীত হলো কি, না হলো, তা একটি স্বতন্ত্র ব্যাপার, যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও পছন্দের ব্যাপারে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন, কিন্তু অন্যের কথা না শোনার ব্যাপারে মানুষ স্বাধীন নয়। এধরনের প্রত্যাখ্যান যখন দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আসে, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় তাদের নেতাগণ কর্তৃক জনগণের অবমাননা এবং ইসলামের বিচার সম্মত দাবীর প্রতি একটি অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়া।

 

খ. জাতি সম্পর্কিত ইসলামী বিধান

যদি ইসলামী রাষ্ট্রের সনদের শান্তির প্রস্তাবের উত্তরে কোন একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্র ইতিবাচক সাড়া দেয়, তাহলে সেই রাষ্ট্র ইসলামের শান্তিতে বা নতুন বিশ্বব্যবস্থায় প্রবেশ করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে সদস্যপদের জন্য নির্ধারিত সকল অধিকার এবং প্রাধিকার লাভের অধিকারী হয়ে উঠে। এভাবে যে সদস্য নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রবেশ করল তার রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ অক্ষুন্ন থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে, এ এগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের সুরক্ষার দাবিদার। এখন থেকে হিংসা বা বিপ্লবের মাধ্যমে কিংবা সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সম্মতি ছাড়া এগুলো পরিবর্তন করা যাবেনা। এই সব প্রতিষ্ঠানের রায় ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধতা, সর্বোপরি আইন আদালতের রায় ও সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনের পরিণামে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গে বলবৎ হবে। সেই জনগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারসমূহ তাদের নিজেদের আইন দ্বারা শাসিত হবে। জনগণ তাদের নিজেদের ধর্মের নীতিমালার আলোকে তাদের নিজেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কিংবা যথাবিধি গঠিত ও নিযুক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাখ্যার আলোকে তাদের নিজেদের জীবন অবাধে যাপন করবে। সকল মানুষকে আল্লাহর দিকে, তার দ্বীন ইসলামের দিকে আহ্বান করা মুসলমানের কর্তব্য বলে, এইসব নতুন নাগরিকের সঙ্গে মুসলমানরা সম্পর্ক স্থাপনে চেষ্টা করবে তাদের সঙ্গে ইসলামের বিষয়ে আলাপ আলোচনার আহ্বান জানাবে। অবশ্য নতুন নাগরিকদের প্রতি এবং তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আল্লাহ মুসলমানদের আদেশ করেছেন দয়া ও সহানুভূতির সঙ্গে অমুসলমানদের কাছে ইসলামকে পেশ করতেঃ “মানুষকে তোমার প্রভুর দিকে আহ্বান কর হিকমত ও সৎ উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে আলোচনা কর সৎভাবে।[৯] যদি তারা ইসলামের এই দাওয়াত গ্রহণ করে, তারা হবে মুসলমানদের ভ্রাতা ও ভগ্নী। আর যদি গ্রহণ না করে, তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে হবে এবং কোন অবস্থাই তাদের উপর পীড়ন করা যাবেনা। সর্বোপরি তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করার প্রয়াসে জবরদস্তি, প্রতারণা, প্রলোভন বা ঘুষের আশ্রয় নেয়া চলবেনা। আল্লাহর আদেশ সম্পূর্ণই স্পষ্টঃ “দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই।” (কুরআন ২:২৫৬)। কোনো ব্যক্তিকে দ্বীনে দীক্ষিত করার জন্য জবরদস্তি, বা উৎকোচের আশ্রয় নিলে আল্লাহর গযব নেমে আসবে। অধিকন্তু ইসলামী আইনের দৃষ্টিতে এর কোন বাধ্যবাধকতাই নেই। যেখানে ইসলামী রাষ্ট্রের নতুন নাগরিকদের সংঘর্ষ বাধে পুরনো নাগরিকদের সঙ্গে, সেখানে বাদী এবং বিবাদী প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ উম্মাহর আশ্রয় নিতে পারে। আদালত শুনানীর পর এই নীতিকে সম্মান করতে এবং তদনুসারে বিচার করতে বাধ্য হবে। যেখানে বিবাদের কারণটি সুস্পষ্ট নয় সেখানে উভয় পক্ষের সর্বোত্তম স্বার্থের খাতিরে এবং তাদের নিজ নিজ উম্মাহর ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে একই আদালত বা উচ্চতর আদালতে এর মীমাংসা করতে হবে। আইনের প্রক্রিয়ার সুযোগ গ্রহণের জন্য শরীয়াহ প্রত্যেকের অধিকারই স্বীকার করে। ব্যক্তি হোক কিংবা গ্রুপ হোক, নতুন নাগরিকেরা আইনের সাহায্য নিতে পারে। অভিযোগটি অন্য কোনো মুসলিম ব্যক্তি, গ্রুপ, এমনকি খোদ ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হলেও তাতে কিছু আসে যায়না। অমুসলিম উম্মাহর যে কোন সদস্য খলিফা, ইসলামী রাষ্ট্র, মুসলিম উম্মাহ বা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারে। ইসলামী আদালত স্বভাবতই এই অভিযোগ গ্রহণ করতে এবং আইন অনুসারে তা বিচার করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত।

প্রকৃতপক্ষে কোনো ইসলামী আদালতে অভিযোগ পেশ করার জন্য বাদীর ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া মোটেই আবশ্যক নয়। পৃথিবীর সকল মানুষ, মুসলিম এবং অনাগরিকসহ সকলে ইসলামী বিচারালয়ে অভিযোগ পেশ করতে পারে। ইসলামী আন্তর্জাতিক আইনের এটি একটি মহৎ শ্রেষ্ঠত্ব যে, এ আইন কেবল সার্বভৌম জাতিসমূহের অধিকারই স্বীকার করেনা, একইভাবে ব্যক্তিবর্গের অধিকারও স্বীকার করে। এর ব্যাখ্যা এই যে, ইসলামী আইন তার লক্ষ্য হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থে ন্যায়বিচারের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছে, অথচ পাশ্চাত্য আন্তর্জাতিক আইন বিভিন্ন সার্বভৌম গ্রুপের মধ্যে সংগতি বিধানের চেষ্টা করে। গ্রুপের স্বার্থ যে ব্যক্তির স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে, সেকথা বিবেচনা না করেই- একথা প্রায়শই ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দেওয়া হয় প্রবলের স্বার্থে। অসঙ্গত মনে হতে পারে যে, ইসলামী আইন অন্য রাষ্ট্রের কোনো নিঃস্ব নাগরিককে বা রাষ্ট্রপরিচয়হীন একজন নাগরিককেও গোটা ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযুক্ত করার অধিকার দেয় এবং তার খলিফাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। কিন্তু ইসলামে আদালত কর্তৃক নির্দোষ ঘোষিত ব্যক্তির জন্য ন্যায়বিচার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে- আদালতের ব্যয় সব সময় বহন করে অপরাধী। প্রবলপরাক্রান্ত খলিফার সম্মান এবং আরাম আয়েশের চাইতে এই নিঃস্বের সুবিচার আইনের দৃষ্টিতে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। যেমন খলিফার দায়িত্ব গ্রহণের পর আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেছিলেন: “আমি যতক্ষণ না প্রবলের কাছ থেকে দুর্বলের অধিকার ছিনিয়ে আনতে পেরেছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার দৃষ্টিতে শক্তিশালী পক্ষ হবে তুচ্ছ। দুর্বল আমার দৃষ্টিতে হবে শক্তিশালী যতক্ষণ না আমি তাদেরকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে পেরেছি”। [১০]

 

সমভাবে ইসলামী আন্তর্জাতিক আইন আন্তর্জাতিক যুদ্ধে বন্দীদের পুনর্বাসনের জন্য প্রভূত যত্ন নিয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, যুদ্ধোত্তর মীমাংসায় আলোচনার ক্ষেত্রে যুদ্ধবন্দীরা বিভিন্ন গ্রুপের দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তাদের জীবন এবং ভাগ্য নির্ধারিত হয় ইউরোপীয় শক্তিগুলোর গৃহীত স্বেচ্ছাচারী কনভেনশনের আওতায়। ইসলামিক আইনে এটা স্বীকৃত যে যুদ্ধবন্দীদের নিজেকে মুক্ত করার অধিকার আছে।

সে নিজে এবং নিজের উদ্যোগেই মুক্তি অর্জন করতে পারে- তার নিজের আত্মীয়- স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব মুক্তিপণস্বরূপ যা দিতে পারে তার সাহায্যে অথবা বিষয় সম্পদ বা খেদমতের বিনিময়ে সে ব্যক্তিগতভাবে যা উৎপাদন করতে পারে তার বিনিময়ে। ইসলামী রাষ্ট্র যুদ্ধবন্দীর নিজের প্রদত্ত অথবা তার পক্ষে প্রদত্ত উপযুক্ত মুক্তিপণ প্রত্যাখ্যান করতে পারেনা; ইসলামী আদালত এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারে। ইসলামে বিধান রয়েছে সকল মুসলমান ব্যক্তি এবং গ্রুপ নির্বিশেষে তাদের যাকাতের এক সপ্তমাংশ যুদ্ধবন্দীদের মুক্তপণ স্বরূপ ব্যয় করবে, যুদ্ধবন্দীরা মুসলমান হউক বা না হউক। ইসলাম একদিকে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিদান মহাপুণ্যের কর্ম বলে ঘোষণা করেছে, অন্যদিকে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিদানকে মহাপাপের কাফফারা বলে ইসলাম ধর্মীয় নির্দেশ ঘোষণা করেছে। যখন কোনো মহিলা যুদ্ধবন্দী গর্ভবতী হয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে তার বন্দীত্বের অবসান হয় এবং আমৃত্যু সে তার বন্দীকর্তার স্বাধীন স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা ভোগ করে। ব্যক্তির জন্য এই সুবিচারের আগ্রহের ইসলামী আন্তর্জাতিক আইন ইসলামী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়। ইসলামী রাষ্ট্রে ক্রয় বিক্রয়ের অধিকার তার এলাকার ভেতর দিয়ে লোক চলাচল, পণ্য ও তহবিল চলাচলের অধিকার? ইসলামী রাষ্ট্র এবং আগ্রহী পরদেশী ব্যক্তির মধ্যে বিশেষ চুক্তির বিষয় হতে পারে, যাকে বলা হয় আল-ইস্তিমান। এসবের মধ্যেই ইসলামী আন্তর্জাতিক আইনের প্রধান বিবেচনার বিষয়ের ইঙ্গিত মেলে। যেমন, ন্যায়বিচার ও সুবিচার তৎসহ মুসলিম নাগরিক অথবা অনাগরিক নির্বিশেষে প্রত্যেকের নিজের কল্যাণ, নিজের শুভ ও সমৃদ্ধি অনুসন্ধানের স্বাধীনতা- সংক্ষেপে গ্রুপ বা দলের স্বার্থের আগে ব্যক্তি মানুষের স্বার্থের স্থান। কিন্তু পাশ্চাত্য আন্তর্জাতিক আইনে গ্রুপ বা সমষ্টির স্বার্থকেই সম্মান করা হয়। [১১]

 

গ. যুদ্ধ বিগ্রহ

ব্যক্তি এবং গ্রুপের জন্য ইসলামী শান্তিতে প্রবেশের ফলে যে সব সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা হয় সে সমুদয়ের বিপরীতে, নতুন ব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য ছাড়া কেবল বাধ্যবাধকতাই রয়েছে। সেই বাধ্যবাধকতাটি হচ্ছে, বৎসরে একবার করে সকল অমুসলিমের উপর ধার্যকৃত একটি কর পরিশোধের বাধ্যবাধকতা, এ করকে বলা হয় জিজিয়া। এই কর সকল অমুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক, যাকাতের চেয়ে অনেক কম। জিজিয়া সাধারণ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের উপর ধার্য করা হয় এবং কেবলমাত্র এই শর্তে যে, এই লোকগুলো এই কর পরিশোধের জন্য আর্থিক দিক দিয়ে সমর্থ। যাজকমন্ডলী, অপ্রাপ্ত বয়স্ক লোকজন, রমনীগণ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ, এই করের আওতায় পড়েনা। তারা মুসলমান হলে তা পরিশোধ করতে তারা বাধ্য থাকতো। ইসলামী আদালতসমূহ এই আইন ঘোষণা করছে যে, খ্রীষ্টান এবং ইহুদীদের কাছ থেকে একই বৎসরে সংগৃহীত অর্থ ইসলামী রাষ্ট্র অবশ্যই ফেরত দেবে, যদি রাষ্ট্র তাদের সীমান্ত গ্রামগুলোকে বাইজানটাইন শক্তি বা কোন অজ্ঞাত শত্রুর আক্রমণের হয়রানি থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। [১২]

অধিকন্তু, একটি ইসলামী রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে কাজ করার জন্য অমুসলিমদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগ করা যাবেনা। রাষ্ট্র যেহেতু আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত, তাই অমুসলমানরা সামরিক বাহিনীতে যোগ দেবে এবং প্রয়োজনবোধে তার জন্য প্রাণ দেবে, ন্যায়ের দিক থেকে তা প্রত্যাশা করা যায়না। নিশ্চয়ই সে স্বেচ্ছাসেবী হতে পারে এবং যদি সে স্বেচ্ছাসেবী হয়, তাকে মুসলিম বলে গণ্য করা হয় এবং সে মুসলমানদের উপর ধার্যকৃত যাকাত এবং তার সঙ্গে জিজিয়া- এই উভয় কর থেকেই অব্যাহতি পায়। এমন লোককে ইসলামী রাষ্ট্রে নিয়োগ দিতে পারে এবং সে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদে উন্নীত হতে পারে এবং অনেক ইহুদী এবং খ্রীষ্টান প্রধানমন্ত্রী এমনকি

উজিরে আজম পদে নিযুক্ত হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের দরবারে হাসদাই বিন সারপুত এবং উমাইয়াদের আমলে সারজিউদের নিয়োগ উল্লেখ করা যায়। [১৩]

যুদ্ধ ঘোষণা ও পরিচালনার জন্য ইসলামী আইন একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা দিয়েছে। যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার নির্বাহী কর্তৃপক্ষের হস্তে ন্যস্ত হয়, এ অধিকার হচ্ছে আদালতের, যা সাক্ষ্য তলব করবে যখন ইসলামী রাষ্ট্র বা তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বা অবিচার সংগঠিত হয়। নির্বিচারে হত্যা বা সম্পত্তি বিনাশ, যাজক, স্ত্রীলোক ও শিশুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে; অর্থাৎ আদালত এবং আল্লাহ কর্তৃক দণ্ডনীয় বলে ঘোষিত হয়েছে যদি না যাজক, রমনী ও শিশুগণ যুদ্ধক্ষেত্রে সশরীরে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। সবচেয়ে বড় কথা, ইসলাম আগ্রাসনকে নিষিদ্ধ করেছে এবং সে কারণে আত্মসম্প্রসারণ, যুদ্ধলব্ধ মাল অথবা ক্ষমতার জন্য যুদ্ধ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। একই দৃষ্টান্ত দ্বারা ইসলামে মুসলমানদের নিজেদের জান বিনা দ্বিধায় কোরবান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যখন ন্যায়বিচার লংঘিত হয় এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কোরবানী কর্তব্য হয়ে ওঠে। ইসলাম এই শিক্ষা দেয় যে, একটি ন্যায় যুদ্ধে কোনো মুসলমান মারা গেলে সে স্বতঃই একজন শহীদ বলে গণ্য হয়, যার জন্য বেহেশতে স্থান নির্ধারিত। শাহাদাত হচ্ছে সর্বোচ্চ এবং মহত্তম মুকুট, যার দ্বারা কোন মানুষের জীবনকে ভূষিত করা যায়। “আল্লাহর উদ্দেশ্যে যারা জান দেয়, তাদেরকে মৃত বলোনা, তারা জীবিত যদিও তোমরা দেখনা…।” [১৪]

“যারা ঈমান এনেছে এবং মহানবীর সঙ্গে জেহাদ করেছে তাদের জান ও মাল দিয়ে, তাদের জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার এবং তারা মহাভাগ্যবান। আল্লাহ তাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন জান্নাত যার পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদী, ওখানেই তাদের চিরস্থায়ী আবাস।” [১৫]

 

অনুবাদঃ অধ্যাপক শাহেদ আলী

 

টীকাঃ

১. এর প্রধান কারণ হচ্ছে, রোমান ক্যাথলিক চার্চের দূর্নীতি, যাদের যাজক নেতৃত্ব তাদের ইউরোপীয় প্রজাদের শাসন করতো। তাদের কাছ থেকে জবরদস্তি ধন-সম্পদ আদায় করতো এবং তা ব্যয় করতো তাদের নিজেদের স্বার্থে ও রোমের নান্দনিক পুনর্গঠনের জন্য।

২. Reinhold Niebuhr. An Interpretation of Christian Ethics (New York Harper. 1935) c,ov. 91. 235-244

৩. এ হচ্ছে জিম্মি শ্রেণী সম্পর্কে শরীয়াহর বক্তব্যের তাৎপর্য। ইসলাম মানুষের সংজ্ঞা দিয়েছে তাদের ধর্মীয় আনুগত্যের বিচারে, যারা মুসলিম ছিলোনা, তাদেরকে শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছিলো তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে, যে সম্প্রদায়গুলো নিয়ে গঠিত ছিলো যৌথ অস্তিত্ব। ইসলামী আইনের অর্থে পূর্ণ আইনগত ব্যক্তিত্বসহ।

৪. একাজ করে, ইসলাম একটি নতুনত্বের অবতারণা করে যা কিছু পূর্ববর্তী সকল ধর্ম থেকে পৃথক। যে সব ধর্মের জন্য ধর্মপ্রবর্তকের জন্ম অথবা মৃত্যু কিংবা তাঁর নবুয়তের ‘সূচনাকেই, তাদের কালের সূচনা গণ্য করা হতো’ ইহা ইহুদী ধর্ম থেকে ছিলো একইভাবে ভিন্ন, কেননা ইহুদী ধর্ম নির্বিচারে সৃষ্টির একটি তারিখ নির্ধারিত করে এবং সেই বিন্দু থেকে সকল সময়ের হিসাব করে।

৫. এই তোমাদের উম্মাহ এক, ঐক্যবদ্ধ এবং অবিভাজ্য এবং আমি তোমাদের রব রাব্ব, আমার ইবাদত কর (২১:৯২)।

৬. আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো। আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সেই হচ্ছে সবচেয়ে মহৎ যে সবচেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ (৪৯: ১৩)।

৭. যে মুমিনগণ, তোমরা শাস্তিতে প্রবেশ করো পূর্ণভাবে এবং ব্যতিক্রমহীনভাবে শয়তানের আদর্শ অনুসরণ করোনা, সে তোমাদের প্রকাশ শত্রু (২:২০৮)

৮. এবং শত্রু যদি শান্তির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে তোমরাও শান্তি অনুসরণ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস করো, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ (৮:৬১)।

৯. তোমাদের প্রভুর প্রতি আহ্বান করো হিকমত এবং সুন্দর শোভন প্রচারের মাধ্যমে। অবিশ্বাসীদের

সঙ্গে উত্তম যুক্তি তর্কসহ কথা বলো (১৬:১২৫)।

১০. Ibn Hisham. The life of Muhammad Abyt A Guillaume (London Oxford University Press 1955) 687

১১. দ্র: জাতিপুঞ্জ সনদ ১৯৪৫, একই ব্যাপার ঘটেছিলো, জাতিসংঘের ক্ষেত্রে, যা স্থান গ্রহণ করে জাতিপুঞ্জের এবং হেগের আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে, যা আজও টিকে আছে।

১২. দেখুন: T. W. Arnold, The Preaching of Islam (Lahore: Sh Muhammad Asraf Publisher 1961) পৃ. ৬১।

১৩. Phillip K. Hitti. History of the Arabs (London Macmillan Co. 1963) পৃ. 195. 524

১৪. যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে মৃত গণ্য করোনা। তারা আল্লাহর কাছে জীবিত এবং তিনি তাঁদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থা করেন (৩:১৬৯)।

১৫. কিন্তু নবী এবং তাঁর সঙ্গীগণ, তাঁদের অর্থবিত্ত এবং জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেছেন তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট কল্যাণ এবং তারাই সফলকাম (৯:৮৮)।

৭০৩ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।
Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top