তৌহীদ ঘোষণা করে যে, “তোমাদের উম্মাহ্ একটি মাত্র উম্মাহ, যার প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ। তাই তাঁর উপাসনা এবং ইবাদাত কর।” মুমিনগণ যে একটি মাত্র ভ্রাতৃসমাজ, যার সদস্যরা আল্লাহর উপর ঈমান এনে পরস্পরকে ভালবাসবে, যারা একে অপরকে ন্যায়বিচার করতে ও ধৈর্য্যশীল হতে পরামর্শ দেয়, যারা ব্যতিক্রমহীনভাবে সকলে একত্রে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়না। যারা একসঙ্গে বসে পরামর্শ করে, সৎকাজে উৎসাহ দেয় এবং মন্দকার্য নিষেধ করে যার পরিণতিতে আল্লাহ এবং তার রাসুলকে মেনে চলে-এ সমুদয়ই হচ্ছে সমাজের বিষয়ে তৌহীদের প্রাসঙ্গিকতা।

উম্মাহর স্বপ্ন এক, তেমনি এক হচ্ছে অনুভূতি অথবা ইচ্ছা এবং কর্ম, উম্মাহর সদস্যদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মনোভঙ্গিতে, তাদের চরিত্রে ও তাদের বাহুতে, চিন্তার একটা ঐক্যমত রয়েছে। উম্মাহ হচ্ছে এমন একটি মানবিক ব্যবস্থা যা মন, হৃদয় এবং বাহু, এই তিনের ঐক্যমতে ঘটিত। এ একটি বিশ্বজনীন ভ্রাতৃসমাজ, যা বর্ণ যেমন স্বীকার করেনা তেমনি স্বীকার করেনা নৃতাত্বিক পরিচয়। এর দৃষ্টিতে সকল মানুষই এক, কেবলমাত্র সদাচারণ ও ধার্মিকতার মানদন্ড দ্বারা যার পরিমাপ হবে। এর কোন সদস্য যদি জ্ঞান, ক্ষমতা, খাদ্য বা আরাম আয়েশ অর্জন করে, তার কর্তব্য হচ্ছে অন্য সবাইকে তাতে শরীক করা, যদি কোন সদস্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, সাফল্য বা সমৃদ্ধি অর্জন করে, সে অবস্থায় তার কর্তব্য হবে, অন্যেরাও যাতে প্রতিষ্ঠিত, সফল ও সমৃদ্ধশালী হতে পারে, সেজন্য সাহায্য করা। এটি এমন একটি মানবিক ব্যবস্থা, যার সদস্যরা উম্মাহর মূল্যায়ন ও নীতিমালা দ্বারা নিজের জীবন শাসনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, এবং অন্য সকল মানুষের জীবন যাতে অনুরূপ নীতিমালার দ্বারা শাসিত হয় তার জন্য চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা হতে পারে, এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সদস্য হতে পারে; তারা উম্মাহর সদস্য বলে এই সদস্যপদ সমস্ত বৈষম্য ও পার্থক্যের উপর শরীয়াকে দেয় চূড়ান্ত কর্তৃত্ব। উম্মাহর ভিত্তি প্রজাতির (race) উপর নয়, অঞ্চল বা ভাষার উপর নয়, রাজনীতিক এবং সামরিক সার্বভৌমত্বের উপর নয়। অতীত ইতিহাসের উপরও নয়, এর বুনিয়াদ হচ্ছে ইসলামের উপর। নর-নারী নির্বিশেষে যে কেউ ইসলামকে তার ধর্ম বলে গণ্য করে এবং চায় যে, এর আইন কানুন দ্বারা তার জীবন শাসিত হবে, সে বাস্তবে এবং কার্যত উম্মাহর একজন সদস্য, দ্বারা শাহাদার আইনগত চাহিদার এই হচ্ছে অর্থ। তাছাড়া অন্য কোন প্রয়োজনটা আবশ্যক নয়। এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে কোন ব্যক্তিই শরীয়াহ কর্তৃক স্বীকৃত সকল অধিকার সকল সুযোগ সুবিধা ভোগের অধিকারী হয়ে উঠে এবং নিজেকে শরীয়াহর সমস্ত দায়িত্বের অধীনে স্থাপন করে।

ব্যক্তি মুসলমান, পৃথিবীর যে কোন স্থানে বাস করতে পারে এবং সেই দেশের আইনের প্রতি আনুগত্যশীল হতে পারে, যতক্ষণ না সে সব আইন জীবনের সেই সব ক্ষেত্রে শরীয়ার বিরোধিতা করে, যার দ্বারা তার নিজের জীবন প্রভাবিত হয়। যখন যে অঞ্চলে সে বাস করে, তার আইন কানুন যদি ইসলামের বিপরীতে তার জীবনকে প্রভাবিত করে, তখন একটি ইসলামিক অঞ্চলে হিযরত করার বিকল্প তার থাকে। অথবা ইসলামিক কিংবা ভিন্নতর কোন বাহ্য উদ্দেশ্য পূরণের আশায় সে তার নিজের জীবনে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সহ্য করে যেতে পারে। তার পক্ষে উম্মাহ হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য নয়। অবশ্য প্রত্যেক ব্যক্তি মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে অন্য সকলকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত করা, নিজের অঞ্চলে উম্মাহকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। দেশের আইন হিসাবে শরীয়াহর প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে তার কর্তব্য।

 

. তৌহীদ এবং খিলাফত

উপরে যে উম্মাহর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সে উম্মাহ হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা পূরণের জন্য বিশ্ব পুনর্গঠন বা বিশ্ব সংস্কারের বাহন। এ হচ্ছে সৃষ্টিতে আল্লাহর খিলাফত, কেননা মানুষের বিষয়ে সৃষ্টির সূচনা লগ্নে প্রদত্ত এই ভবিষ্যত বাণী অবশ্যই সম্প্রসারিত হবে উম্মাহ পর্যন্ত এবং তার যুক্তি হচ্ছে পূর্ববর্তী অংশে উল্লেখিত যুক্তিসমূহ। সমভাবে উম্মাহ একটি রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্বের অর্থে এবং সার্বভৌম শক্তির জন্য যে সব অঙ্গ ও ক্ষমতা সার্বভৌমত্বকে বলবৎ করার জন্য প্রয়োজন সে সমুদয়ের অর্থে। রাষ্ট্র হিসাবে উম্মাহর উল্লেখ করতে হবে খিলাফত হিসাবে, দাওলাত হিসাবে নয়। ইসলামী ঐতিহ্যের জন্য খিলাফত হচ্ছে নিকটতর এবং তৌহীদের ঘনিষ্ঠতর, যে তৌহীদ একটি সরাসরি এবং কুরআনি সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ‘দাওলাত’ একটি আধুনিক ধারণা যার অবস্থান কুরআনের প্রতিনিধিত্ব বা খিলাফতের ধারণা থেকে সবচাইতে দূরতম ব্যবধানে। আর খিলাফতের এই ধারণাটি হচ্ছে উম্মাহর মূল শর্ত। আমরা যখন খিলাফত উল্লেখ করতে রাষ্ট্রকে বুঝাই তখন উম্মাহ এবং পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রের মৌলিক পার্থক্য আমাদের মনে রাখতে হবে। তাই উম্মাহর সার্বভৌমত্ব বলবৎ করার ক্ষেত্রে খিলাফতই হচ্ছে উম্মাহ। এই সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ সম্পূর্ণভাবে না হলেও উম্মাহর প্রতিনিধিত্ব এর দ্বারাই গঠিত। খিলাফতের বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা রাষ্ট্রতত্বের ক্ষেত্রে তৌহীদের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে চাইছি। খিলাফত হচ্ছে ত্রিমুখী ঐক্মত্য দৃষ্টির ঐকমত্য, ক্ষমতার ঐকমত্য এবং উৎপাদনের ঐকমত্য।

 

. ইজমা আররুইয়াহ্ বা দৃষ্টির ঐকমত্য

ইজমা আর-রুইয়াহ্ বা দৃষ্টির ঐকমত্য হচ্ছে মানসিক ঐক্য বা চৈতন্য এবং এর রয়েছে তিনটি উপাদান। প্রথম হচ্ছে, যে সব মূল্যায়ন নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছা ঘটিত সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান এবং তাদের বাস্তব রূপায়ণ ইতিহাসে যে আন্দোলন সৃষ্টি করেছে, সে বিষয়ে জ্ঞান। স্পষ্টতই ইহা পদ্ধতিবদ্ধ এবং ঐতিহাসিক, দৃষ্টির উপাদানগুলো প্রকৃতিগতভাবেই অপরিসীম, অন্তহীন। তাই সমস্ত কিছু সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টির প্রয়োজন নেই, কেবলমাত্র তার সার নির্যাসেরই প্রয়োজন হতে পারে এবং প্রয়োজন হওয়া উচিত। এটি হচ্ছে একটি কাঠামো, একটি পদ্ধতি, স্তরে স্তরে বিন্যাস এবং সিদ্ধান্তের জন্য আবশ্যক যার পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন, যা একবার আয়ত্ব হলে এক জনের পক্ষে সমন্বিততার মধ্যে যা হারিয়ে গিয়েছিল, তা আবিস্কার করা এবং প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়। মূল্যমানের পদ্ধতিবদ্ধ জ্ঞান সম্পর্কে এ হচ্ছে বিশেষ করে সত্য। আর এই জ্ঞানের উৎস হচ্ছে প্রত্যাদেশ অর্থাৎ কুরআন এবং সুন্নাহ এবং যুক্তি, বুদ্ধি এর নিজস্ব প্রক্রিয়ার উপলদ্ধির মাধ্যমে, ন্যায়শাস্ত্র ও জ্ঞানতত্ত্ব এবং সাধারণভাবে সত্য সম্পর্কে উপলব্ধি (পরাতত্ত্ব) নিসর্গ সম্পর্কে উপলব্ধি (প্রকৃতি বিজ্ঞান), মানুষের সম্পর্কে জ্ঞান (নৃতত্ব, মনস্তত্ব এবং নীতিশাস্ত্র), এবং সমাজ সম্পর্কে জ্ঞান (সমাজ বিজ্ঞানসমূহ)। প্রত্যাদেশের ক্ষেত্রে যেমন নয়, তেমনি বুদ্ধির ক্ষেত্রেও দৃষ্টির একাডেমিক ফল আবশ্যক নয়, যা উপাদানের পদ্ধতিগত ধারণা নিয়ে গঠিত, বরং তা হতে হবে ইনটুইটি স্বজ্ঞালব্ধ, অর্থাৎ এমন একটি উপলব্ধির আলোর অভিজ্ঞতা হতে হবে যা, যে কোন অঞ্চলকে আলোকিত করতে পারে, দৃষ্টির জন্য ইসলামের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এমন একটি ছবি প্রতিষ্ঠিত ক’রে

 

একদিকে ইতিহাসে ইসলামী মূল্যমানসমুহ যে আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল, সেই আন্দোলন এবং ইসলামী মূল্যমানগুলোর বাস্তবায়ন সম্পর্কে জ্ঞান মূখ্যত একটি অভিজ্ঞতার বস্তু১০। এই জন্যই প্রথম দিকের মুসলমানরা মহানবী সম্পর্কে সকল বিবরণ এবং তাঁর সাহাবাদের জীবন থেকে আহরিত ঘটনাবলী জানার জন্য অবিরাম চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই এধরনের চাহিদা দেখা যায়, কারণ অনুসারীদের জন্য তাদের বিশ্বাসের অনুযায়ী ধারণা কি করে একটি কংক্রীট রূপে প্রকাশ পায় তার জ্ঞান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূল্যমান বাস্তবায়নের বিশেষ উপাদানগুলো তাদের ছাত্রদের উপর একটি সার্থক এবং বাঞ্চনীয় শিক্ষকীয় প্রভাব বিস্তার করে। এগুলো তাদের পদ্ধতিগত অধ্যয়নের উপাদানগুলো থেকে সহজে বোঝা এবং স্মরণ রাখা যায়। যাই হোক খিলাফতের জন্য যে দৃষ্টিভঙ্গির উৎপাদন আবশ্যক তার জন্য উভয়টিই সমরূপে আবশ্যক।

মূল্যমানের পদ্ধতিগত উপলব্ধি এবং ইতিহাসে সেগুলোর রূপায়ণ, এ দুটি বিষয় নিয়ে সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমানের জ্ঞানের অভাবে এবং বর্তমান কি করে সেগুলোকে নতুন করে বাস্তবায়িত করতে পারে, সেই জ্ঞান ছাড়া প্রায় এখন অসম্পূর্ণ। যেহেতু খিলাফত পশ্চাৎমুখী হতে পারে এবং বর্তমানের মধ্যে বাস করতে পারে এবং ভবিষ্যতেও কার্যকর হবে, সেজন্য বর্তমানের সঙ্গে মূল্যমানকে সম্পৃক্ত করা আবশ্যক। স্থির করতে হবে বাস্তবে অস্তিত্বশীল কোন উপাদান কোন মূল্যমানকে বাস্তবায়িত করবে, সেগুলো রূপায়ণের বেলায় কেমন করে বর্তমান অবস্থাগুলো মূল্যমানসমুহের শ্রেণীর উপর প্রভাব বিস্তার করে।

এখানে যে ইজমা আর-রুইয়াহর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তাতে ধর্মীয় জ্ঞানের একটি উৎস বলে ধরা হয়েছে। রাসুল্লাহর এই হাদিস, “আমার উম্মাহ অসত্য বা মিথ্যার ব্যাপারে একমত হবেনা”, উম্মাহর জনমতের উপর প্রায় একটি পবিত্রতা আরোপ করেছে। তা সত্ত্বেও এ কোন অনড় মত নয় বরং সব সময়ই উন্মুক্ত১১। এই উম্মুক্ততাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে ইজতিহাদে, যা কেবল সামর্থ নয়, বরং প্রত্যেক বিচার বুদ্ধি সম্পন্ন মুসলমানের কর্তব্য, ইসলামী সত্য ও মূল্যমানের সমগ্র পরিসর বা তার কোন অংশকে নতুন করে আত্মসাৎ করে। প্রকৃতিগতভাবেই ইজতিহাদ গতিশীল এবং সৃজনধর্মী এবং তার স্বগুণেই উপলব্ধিক্ষম মনের কাছে খুবই আবেদনশীল। ইজতিহাদকেও রাসুলুল্লাহ এই হাদীসে অভিনন্দনের যোগ্য বলে গণ্য করেছেন,

“যে কেউ ইজতিহাদ করে একটি ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয় সেও একটা সৎ কাজ করলো। যে কেউ ইজতিহাদ করে সত্যে উপনীত হয়, সে দ্বিগুণ পূণ্য লাভ করে।”

ইজতিহাদ এবং ইজমা সম্মিলিতভাবে সৃষ্টি করে একটি দ্বান্দিক গতি, যা চিন্তার রাজ্যে ইসলামী গতিশীলতা গঠন করে। কারণ ইজমা যেখানে উপলব্ধি লাভের প্রয়াসে চূড়ান্ত বলে গণ্য হয় সেখানে তা ক্রমাগতই লংঘিত হয় ইজতিহাদের সৃজনধর্মী শক্তির বলে। অন্যপক্ষে, যেখানে ইজতিহাদ উপলব্ধির সর্বোচ্চ বাঞ্ছিত লক্ষ্য বলে পবিত্র বলে গণ্য হয় সেখানে তা সকল মুসলমানকে এর বৈধতা সম্পর্কে বিশ্বাসী করার প্রয়োজনে তা হয় নিয়ন্ত্রিত, সংশোধিত এবং সমালোচনা অর্থাৎ সকলের দ্বারা তা (ইজমা) তা সমর্থিত হবার প্রয়োজনে।

 

. ইজমা আল্ইরাদা বা ইচ্ছার ঐকমত্য

ক্ষমতার ঐকমত্য হচ্ছে ইচ্ছার মিল বা ঐক্য এবং এর দুটি উপাদান আছে আল্ আসাবিয়া (সামাজিক সংহতি) যার বলে মুসলমানরা বিভিন্ন ঘটনা এবং পরিস্থিতিতে একইভাবে আল্লাহর আহবানের প্রতি সম্মিলিত আনুগত্যে সাড়া দেবার জন্য নিজেরা অঙ্গীকার করে এবং আন্- নিজাম, সিদ্ধান্তের বাস্তব রূপদানে সামর্থবান, মুসলিমদের কাছে পৌছাতে এবং তাদেরকে সংঘবদ্ধ করতে এবং সাংগঠনিক এবং যৌক্তিক কাঠামো মূল্যমানের ঔচিত্যকে ব্যক্তির গ্রুপ ও তাদের নেতাদের কর্তব্যের রূপদানে পারঙ্গম।

আল আসাবিয়া দৃষ্টিগত ঐক্যের সমান বা ফল নয়। এই ধরনের ঐকমত্যের দ্বারা আসাবিয়াকে সমৃদ্ধ ও তাৎপর্যপূর্ণ করা যেতে পারে। আসলে এই ধরনের ঐকমত্য ছাড়া আসাবিয়ার অস্তিত্ব অসম্ভব, কেননা যেখানে কোনো ব্যাপারে ঐকমত্য নেই, সেখানে কখনো সংহতি অর্জিত হতে পারে না। দৃষ্টিগত ঐকমত্যের চাইতেও আসাবিয়ার চাহিদা আরো বেশী, এর অভিব্যক্তি ঘটে আন্দোলনের সঙ্গে নিজের অভিন্নতা ঘোষণার সিদ্ধান্তে। বলতে গেলে উম্মাহর অর্ণবজানে নিজের ভাগ্য সমর্পণ করতে এবং পরে আহবানে সাড়া দিতে- অর্থাৎ আহবান বা দাওয়াতে ইতিবাচক “হ্যাঁ” বলতে এবং দাওয়াতে যা কিছু চায় তা ইতিবাচকভাবে সম্পাদন করতে।

খোদ্‌ এই সিদ্ধান্তের ভিত্তি নির্মিত হয় একটি দীর্ঘ মনস্তাত্বিক রূপান্তরের প্রক্রিয়ার উপর, যে প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি নিজেকে উম্মাহর সঙ্গে অভিন্ন রূপে দেখতে পায়, যার পরিশেষে তার চৈতন্য হয়ে উঠে বাস্তবায়নমুখী এবং মানুষ নিজেকে উম্মাহর ঐতিহাসিক ঘূর্ণাবর্ত ও সূচীমুখ হিসাবে খিলাফতের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখে। এই মনস্তাত্বিক প্রক্রিয়া শিক্ষা এবং অনুশীলনের বিষয়বস্তু হতে পারে। যেখানে তা হয় সেখানে এই প্রক্রিয়া হয়ে উঠে মার্জিত এবং সমৃদ্ধ। তবে জন্মের মাধ্যমেও প্রকৃতিগতভাবে এর আবির্ভাব হতে পারে এবং গোত্র বা গোষ্ঠীর বদ্ধ পরিবেশে তা লালিত পালিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে বিচার বুদ্ধিহীন। অন্ধ আরেক নিজেকে গোত্র বা জাতের সঙ্গে একাত্ম পণ্য করার এই অর্থে ইবনে খলদুন আসাবিয়াকে সমাজ সংহতির ভিত্তি বলে ঘোষণা করেছিলেন১২। যেহেতু ইসলামে এই বাস্তব উপাদানগুলো অতিক্রান্ত হয়েছে তৌহীদের আদর্শের দ্বারা সে কারণে ইসলামের আসাবিয়া হবে একটি নতুন প্রক্রিয়ার, একটি নতুন সংস্কৃতির ফল (আল্লাহর অভিপ্রেত আদলে  সক্রিয় ও নিরবচ্ছিন্নভাবে নিজের চেহারা বদল করা)। তাই আসাবিয়া হবে ইচ্ছাকৃত লালিত পালিত বিকশিত এবং পরিণত। কেবলমাত্র প্রকৃতিগতভাবে একটি অনৈচ্ছিক বিকাশ নাও হতে পরে, ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের জাতীয়তাবাদী অনুভূতির সঙ্গেও একে এক করে দেখা যাবেনা যা প্রায় বর্ণিত হয় অচেতন, অনৈচ্ছিক, অবর্ণনীয়রূপে অন্তর্গত এবং গূঢ় বলে, প্রকৃতপক্ষে যা গোত্র গোষ্ঠীতন্ত্রের আসাবিয়া। ইসলামী আসাবিয়া ইচ্ছাকৃত, পরিস্কারভাবে বিশ্লেষণযোগ্য একটি নৈতিক ও দায়িত্বপূর্ণ কর্ম। এ আসাবিয়া হচ্ছে তৌহীদের স্বচ্ছ আলোকে, তৌহীদের সকল তাৎপর্যের পূর্ণ প্রভায় উম্মাহর ভাগ্যের সঙ্গে, নিজেকে অভিন্ন গণ্য করার অঙ্গীকার এবং তাতে অংশগ্রহণ। এ দৃষ্টান্ত পাই আমরা এর বিশুদ্ধতমরূপে মক্কায় হজ্জ যাত্রীদের সম্মিলিত ধ্বনিতে যখন তারা কাবা ঘর তাওয়াফ করে অথবা যখন আরাফার দিকে ধাবিত হয়; “লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক”- (তোমার আহ্বানে হে প্রভু এখানে আমরা হাজির, তোমার আহবানে)। আর এ হচ্ছে বহু শতাব্দী ধরে যে ভৌগোলিক বা গোত্র গোষ্ঠী ধর্মী বা সংস্কৃতিগত বৈশেষিকতা খাস পাশ্চাত্য জাতীয়তার চরিত্র শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে তার সম্পূর্ণ বিপরীত১৩

যেহেতু আসাবিয়া ভূমন্ডলের একটি বিস্তৃত অঞ্চলে বিস্তৃত বিশ্বজনীন উম্মাহ্-গঠনকারী একটি উপাদান সে কারণে আল আসাবিয়া মুসলমানের ব্যক্তিগত মূহুর্তের একটি সত্য মাত্র হতে পারেনা। পরিস্থিতি এবং ঘটনায় সাড়া দিতে গিয়ে মুসলমান যখনি সক্রিয় হতে ইচ্ছা করে বা বাধ্য হয় তখন তা একটি অবাধ তরঙ্গোচ্ছাস হিসাবে কাজ করতে পারেনা; এরূপ কাজ হবে জগৎব্যাপী বিশৃংখলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির জনক। আসাবিয়া ইসলাম সম্মত এবং সে কারণে দায়িত্বশীল হতে হলে শৃংখলার অধীন, অবশ্যই হবে নিয়ম গভীরতা ও দিশার দিক দিয়ে এবং অন্য সকল মুসলমানের সঙ্গে সমবায়মূলক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে নিজেকে অভিন্নভাবে যুক্ত করার জন্য শৃংখলার অধীন। এটাই হচ্ছে আন্-নিজামের রূপ, যে বিষয়ে তৌহীদের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ইজমা-প্রথা মুসলমানদের তৈরি করেছে। এই নিজামের দিকে লক্ষ্য করে, আমাদের পিতৃপুরুষেরা ভালভাবেই জানতেন যে প্রত্যেক মুসলমানকে হতে হবে অক্ষরজ্ঞান এবং সাহিত্যের রুচীসম্পন্ন তাকে কুরআনের বৃহৎ অংশ সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান রাখতে হবে, নবী চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে এবং সাহাবাদের জীবনী জানতে হবে, তার গৃহের নিকটবর্তী জামাতে এবং ইবাদতে অংশগ্রহণ করতে হবে- (অর্থাৎ অন্যদের সঙ্গে সহযোগিতা এবং ইবাদত করতে হবে- আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি নিকটবর্তী মসজিদে সালাতের সময় যে মুসলমানদের কাঁধ পরস্পর স্পর্শ করা উচিত, এই তাগিদের মানে এই যে, এতে করে, একের কাছে অপরের অস্তিত্ব জীবন্ত হয়ে উঠবে, একের সঙ্গে অপরের পারস্পরিক সম্পর্ক ও পরিচয় এবং শব্দটির আক্ষরিক অর্থে বৃহত্তর উম্মাহর সঙ্গে সহযোগিতার উপলব্ধি. বাস্তব হয়ে উঠবে, যাতে করে আল্লাহ যে সকলের প্রভু এবং মালিক ইবাদতকারীর চেতনায় তা মুদ্রিত হয়ে যায়। এ সমস্তই পরিকল্পিত হয়েছে খিলাফতের আনুষ্ঠানিক সংগঠনের প্রস্তুতি হিসাবে। সেকালে মসজিদ ছিলো এবং একালেও তা হওয়া উচিত সকল ইসলামী কর্মতৎপরতার কেন্দ্র, ইসলামের আবশ্যিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু, কারণ মসজিদে মুসলমানরা দৈনিক মিলিত হত, তৌহীদের বন্ধনে তার সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে একটি জীবন্ত সম্পর্ক স্থাপন করতো এবং লাভ করতো আধ্যাত্মিক, নৈতিক, রাজনৈতিক জীবনীশক্তির দৈনিক বরাদ্দ। এই খোরাক সরবরাহ করা যায় এবং প্রকৃতই তা সরবরাহ করা হতো যে কোন মুসলিম কর্তৃক, যার অধিকতর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিলো তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার, যাতে খোদ খলিফাকেও বাদ দেওয়া হতোনা। আল্লাহর আদেশ পালন করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার দিকে আহবান কর মানুষকে প্রজ্ঞা এবং অধিকতর সুন্দর যুক্তির মাধ্যমে১৪। এবং রাসুলুল্লাহর (সঃ) নসিহত প্রদানের আদর্শে স্বাধীনভাবে প্রদত্ত পরামর্শ, যে নসিহতের আদর্শকে ইজতিহাদের সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে১৫। সঙ্গী সাথীদের সঙ্গে এই সম্পর্ক ও সংসর্গ রূপ নেবে জুম্মার সালাতে যেখানে ঈমামের খুৎবা হচ্ছে একটি গঠনমূলক স্তম্ভসদৃশ। খুৎবার বিষয়বস্তু হবে বর্তমান পরিস্থিতি, মুসলামান সমাজকে যে সব সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে সেসবের উপরই খুৎবা দেবেন ইমাম। খুৎবাতে যে কুরআন এবং হাদিসের কিছু উল্লেখ থাকে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ইসলামী প্রজ্ঞার বক্তব্য পেশ করা এবং এভাবে তার প্রাসঙ্গিকতা ঘোষণা করা। আমির (শাসক) নিজেই যে জুম্মার সালাতের ইমাম হবেন, এই প্রথার উদ্দেশ্য ছিলো কার্যকর করার জন্য সপ্তাহের আলাপ আলোচনা থেকে যে ঐক্যমতের সৃষ্টি হয় তার সুস্পষ্ট রূপদান কিংবা ঐকমত্য অর্জিত না হলে নেতৃত্বকে ঘিরে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং উপস্থিত প্রশ্নের আবশ্যক বিচার ও প্রতিবাদের ব্যবস্থা করা। ইসলামের এ সমস্ত ইবাদত পৃথিবী এবং মানুষের বাস্তব রূপান্তর, যে উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছে খোদ কুরআন১৬, পৃথিবীস্বরূপ আল্লাহর জমিদারীতে রায়ত এবং কৃষকের বাস্তব খিদমত, মরুভূমিকে খুটি করে উপনিষদীয় গুরুর, তথা সন্যাসীর, শারীরিক কসরত, তথা যোগ সাধন নয়, কোন ধর্মীয় ঐতিহ্যের আত্মনিঃগ্রহ, বিশ্বের অস্বীকৃতি এবং ইতিহাস প্রত্যাখ্যান নয়!

 

. আমলের ইজমা বা কার্যের ঐকমত্য

কার্যক্ষেত্রে পূর্বে উল্লেখিত সমস্ত প্রস্তুতির চূড়ান্ত শীর্ষ হচ্ছে ইজমা আল-আমাল। এ হচ্ছে ইজমা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠা ঔচিত্যের রূপ। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যা ইজমা-ইজতিহাদ দ্বন্দের চিরন্তন গতিশীলতার মতই কখনো নিঃশেষ হতে পারেনা। মানুষকে তার বেহেস্তের অধিকার অর্জনের প্রয়াসে, দেশকালের মধ্যে আল্লাহর ইচ্ছাকে বাস্তাবায়িত করা এমন একটি প্রয়াস কেবল বিচার দিবসই যাতে যতি টানতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে উম্মাহর বৈষয়িক চাহিদাগুলো পুরণের ব্যবস্থা, এর প্রত্যেক সদস্যকে এমন একটি শিক্ষাদান যাতে করে তার পূর্ণ আত্মপরিচয় সম্ভব হবে; আরো রয়েছে উম্মাহর সফল প্রতিরক্ষার জন্য বৈদেশিক শত্রুর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার বৈষয়িক ও নৈতিক উপায়ের ব্যবস্থা করা এবং তৎসহ সারা পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় রূপায়ণের জন্য নৈতিক ও বৈষয়িক উপায়ের ব্যবস্থা।

আল্লাহর অভিপ্রায়ের সার নির্যাস হচ্ছে, উম্মাহর বৈষয়িক চাহিদা পুরণ এবং সে কারণে তা ধর্মেরও মর্মকথা। যেহেতু তার খিদমত করার জন্য আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন১৭ এবং আল্লাহর জমিনে রায়ত-কৃষকের মত এই দায়িত্ব পালন করতে বলেছেন১৮– তাতে করে ইহা অনিবার্য হয়ে পড়ে যে, আল্লাহ চান মানুষ জমি চাষ করবে, প্রকৃতির উপাদান এবং শক্তিগুলোকে ব্যবহার করবে এবং তার খুশীমত সভ্যতার বিকাশ ঘটাবে১৯। এই দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করতে গিয়ে কুরআন দারিদ্রকে শয়তানের অঙ্গীকার বলে বর্ণনা করেছে২০। এবং ধর্মের সঙ্গে ক্ষুধার্তের খাদ্য দান এবং দুর্বলের রক্ষণকে অভিন্ন গণ্য করেছে২১। বিশেষ করে মানুষ যখন আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালন করে২২, তখন মানুষের খিলাফত বা প্রতিনিধিত্বের স্বাভাবিক প্রতিফল এই যে, সে সৃষ্টির মাধুর্য এবং আনন্দ উপভোগ করবে। মেসোপটেমীয় দৃষ্টিতে মানুষের সৃজনের সঙ্গে সঙ্গেই তাকে আল্লাহর জমিনে স্থাপন করা হয়েছে, তাঁর ভৃত্য হিসাবে। কিন্তু মানুষের এই সৃজন কর্মই হচ্ছে সংঘবদ্ধ কৃষিকর্ম, বাঁধ তৈরী, সেচ এবং পানি নিষ্কাশন, খাল খনন, শষ্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য, পিরামিড, মন্দির নির্মাণ, লিখন ও হিসাব রক্ষণ পদ্ধতি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে গ্রাম-সরকার, নগরী, প্রদেশ, জাতি এবং বিশ্ব পর্যায়ে সরকার প্রতিষ্ঠার সূচনা। সংক্ষেপে আল্লাহর এই সৃজন কর্মই হচ্ছে বিশৃংখলা থেকে সৃষ্টিকে শৃংখলার অধীনে আনয়ন এবং শৃংখলাবদ্ধ জগতের সৃষ্টি২৩

সেমিটিক মন কখনো সংসারত্যাগীর সংসার বর্জন বা আত্মনিগ্রহের অর্থ বুঝতে সক্ষম নয়, ইহা কখনো কাম ও প্রজনন, খাদ্য ও আরাম আয়েশকে স্বাভাবিক পাপ বলে গণ্য করেনা। এর দৃষ্টিতে পাপ হচ্ছে এসবের অপব্যবহার, কখনো প্রকৃতির বিষয় হিসাবে এগুলো পাপ নয়। খ্রীষ্টান ধর্ম বস্তুর সকল ভীতিসহ যে গ্নষ্টিক (gnostic) ঐতিহ্যকে উত্তরাধিকারস্বরূপ গ্রহণ করে, তাই খ্রীষ্টান আন্দোলনে সংসার বর্জন ও আত্মনিগ্রহরে বীজ বপন করে। ইসলাম অবশ্যই শ্রম বা উপবাসের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দুটিঃ আত্মসংযমের অনুশীলন এবং অভাবগ্রন্থের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতি। একই আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর খাদ্য, পানীয় এবং আনন্দের মাধ্যমে অবশ্যই ভাঙতে হবে রোজা।

খলিফাকে যদি মানুষের বৈষয়িক চাহিদা অবশ্যই পূরণ করতে হয় যা প্রত্যাশা করা হয় খলিফার কাছ থেকে, তাহলে প্রশ্ন উঠবে মানুষের এই বৈষয়িক চাহিদা কি পরিমাণ হলে যথেষ্ট হবে। ন্যূনতম চাহিদা সহজেই নির্ণয় করা যায়; সে চাহিদা হচ্ছে সকল মানুষের জন্য দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি এবং শিশু মৃত্যুর প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য যা প্রয়োজন তাই হচ্ছে ন্যূনতম চাহিদা, কিন্তু সর্বোচ্চ চাহিদা নির্ণয় করা অসম্ভব, কেননা প্রকৃতির ব্যবহারের সীমা অথবা প্রকৃতির খাদ্য উৎপাদনের ক্ষমতা নির্ণয় করা যায়না। এদুটিই হচ্ছে মানুষের কল্যাণের জন্য, আল্লাহ তায়ালা প্রকৃতি বা তার পদ্ধতির মধ্যে যে নিয়ম প্রবর্তন করেছেন সেগুলোর উপর মানুষের কর্ম প্রসারণশীল কর্তৃত্বের বিষয়২৪। কুরআন আমাদেরকে জানাচ্ছে আসমানে এবং জমিনে যা কিছু আছে সমস্তই আমাদের কল্যাণের জন্য। রাসুল্লাহ (সঃ) বলেছেন,

“যে কেউ রাত্রে গৃহে প্রত্যাবর্তন করে যখন তার একদিনের পথে কোথাও একটি মাত্র মানুষও ক্ষুধার্ত থাকে, সে আল্লাহকে কষ্ট দিয়েছে।”

এবং দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রাঃ) ঘোষণা করেছিলেন

“আমি ভয় করি যে, বিচার দিবসে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদেরকে দায়ী করবেন, প্রত্যেকটি খচ্ছরের জন্য যা হোচট খায় বা পড়ে যায়, খিলাফতের সবচেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের মেরামতহীন ভাঙ্গাচুড়া রাস্তায়২৫।”

নিশ্চয়ই ইসলাম অন্য সকল ধর্মের মতই দান খয়রাতের নির্দেশ দিয়েছে। ইসলাম দান খয়রাতকে বলে সাদাকা (শাব্দিক ভাবে যার অর্থ হচ্ছে সত্যপরায়ণতার একটি খন্ড) যার দ্বারা ইসলাম একে একজনের ঈমানের সত্যতার অভিব্যক্তি এবং সূচক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কিন্তু সকল ধর্মের চাইতে স্বতন্ত্রভাবে ইসলাম ব্যবস্থা করেছে যাকাতের, যা বার্ষিক শতকরা আড়াই ভাগ হিসাবে একটি সম্পদ কর এবং তা আদায় করা হয় রাষ্ট্রীয় আইনের অনুমোদনক্রমে। ইসলাম যে একে যাকাত বলে (মাধুর্য বা মিষ্টতা) এর দ্বারা ইসলাম বোঝাতে চায় যে, আমরা যদি আমাদের সম্পদে আমাদের সঙ্গী সাথীদের অংশীদার না করি, তাহলে বছরে সে সম্পদ হয়ে উঠে তেতো। অধিকন্তু ইসলাম বঞ্চিতদেরকে এই নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, তাদের জন্য ভিক্ষা, দান বা অপমানজনকভাবে ছুঁড়ে মারা কোনো রুটীর টুকরো নয়, বরং এ হচ্ছে বিত্তবানের সম্পদ তাদের হক, তাদের অধিকার২৬। ইসলাম একচেটিয়া ব্যবসা যেমন নিষিদ্ধ করেছে, তেমনি নিষিদ্ধ করেছে মজুতদারী এবং মানুষের উপর মানুষের শোষণের প্রধান হাতিয়ারস্বরূপ সুদকে উচ্ছেদ করেছে২৭। পক্ষান্তরে যেখানে ইচ্ছা এবং সর্বত্র আল্লাহের অনুগ্রহ সন্ধানের জন্য মানুষকে নির্দেশ দিয়েছে২৮। এদেরকে সেই প্রকৃতপক্ষে অনুগ্রহ প্রাচুর্যের সন্ধানে দেশ দেশান্তরে যেতে বলেছে, তলে আল্লাহর নৈতিক বিধানের আওতায়- বিশ্বাসঘাতকতা, প্রবঞ্চনা, চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন বা লুটপাট না করে এবং এভাবে একবার প্রাচুর্য অর্জনের পর সেই বিপুল সম্পদের কোন অংশ কিংবা তার বহুগুণ বৃদ্ধিতে যাকাত প্রদান করে তিক্ততা দূর ক’রে মধুর করে তুলতে হবে। এবং এভাবে সাদাকাত দ্বারা এই বৃত্তির অধিকারীর সত্যবাদিতা প্রমাণ করতে হবে২৯

উম্মাহর প্রত্যেকটি সদস্য যাতে পৃথিবীতে আল্লাহর নিয়ামত অর্জন ও ভোগ করতে পারে তার জন্য সম্ভাব্য সব কিছু করাই অবশ্য খিলাফতের দায়িত্ব। কিন্তু এই লক্ষ্য, মহৎ এবং আবশ্যক হলেও যে মুহুর্তে একে মানব জীবনের একমাত্র বা চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে গণ্য করা হয় তখনই তা পর্যবসিত হয় তাহা পাশবিকতায় এবং অধঃপতনে, যাতে মানুষের ব্যক্তিত্বের ঘটে বিকৃতি এবং গোটা ঐশী অভিপ্রায়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা৩০। মানুষের বৈষয়িক প্রয়োজনগুলো নির্দোষ এবং বস্তুতই উত্তম; সম্ভাব্য উচ্চতম মাত্রায় এগুলোর পরিপূরণ আবশ্যক। কিন্তু জীবনের গোটা বৈষয়িক দিকটি যেগুলো রক্ষা করবে, সেগুলো ব্যক্তি বা সমগ্রভাবে উম্মাহর আধ্যাত্মিক মর্মের উপায় বা বাহন মাত্র। বৈষয়িক অর্জনকে চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে গণ্য করার মানে হচ্ছে আধ্যাত্মিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।

এ হচ্ছে এরূপ দাবীরই নামান্তর যে, আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে একটি শূন্য বিষয়, আচার অনুষ্ঠান ও মনস্তাত্বিক আত্মরূপান্তরের দেহ বিযুক্ত জীবন, যা বস্তুগত জীবন অনুসন্ধানের বিকল্প ইসলামে আধ্যাত্মিক জীবন হচ্ছে তিনটি পর্যায়ের, যা একই সঙ্গে অনুসরণ করতে হবে। এর প্রথম পর্যায়টি হচ্ছে, উম্মাহর সাধারণ বৈষয়িক কাজকর্মে ব্যক্তির অংশগ্রহণ। এর মাধ্যমে মানুষের নিজের বৈষয়িক প্রয়োজনকে উম্মাহর কাজকর্মের প্রয়োজনের অধীনে স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় স্তরটি হচ্ছে দুটি পর্যায়ে নিজের এবং অন্যদের শিক্ষার জন্য প্রয়াস; যেমন প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব মানুষের জন্য প্রকৃতির ব্যবহারকে অধিকতর সম্ভব এবং সহজসাধ্য করে তোলে; এবং ইজমা ইজতিহাদের দ্বান্দ্বিকতা হয়ে উঠতে পারে গতিশীল, সৃজনধর্মী এবং ঐশী অভিপ্রায়ের আরো উঁচু হতে উঁচুতর ক্ষমতার স্তর পর্যন্ত পৌছুতে পারে। তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে নন্দনতাত্বিক সৃষ্টি, যাতে উম্মাহর আকুতি এবং জীবনরূপ পায়- কারণ উম্মাহ মূল্যবান বা ঐশী অভিপ্রায়কে বাস্তব এবং রূপায়িত করে তুলে ইতিহাসের পরিক্রমায়।

ইজমা ইজতিহাদের (উৎপাদনের মতৈক্য) দ্বিতীয় উপাদান হচ্ছে উম্মাহর প্রত্যেক সদস্যের জন্য এমন শিক্ষার ব্যবস্থা করা যার বদৌলতে পূর্ণ আত্মপরিচয় অর্জন সম্ভব হয়৩১। আল্লাহর বান্দা হিসাবে কোনো ব্যক্তি তার পেশাকে উপলদ্ধি করেনা, যদিনা তার ব্যক্তিগত সম্ভাবনা ও ক্ষমতার চূড়ান্ত বিকাশ ও সম্ভাব্য পূর্ণতম ব্যবহার হয়। এধরনের ব্যক্তি নিজেকে অসুখী বলে মনে করবেনা এবং এধরনের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত একটি ব্যর্থ সমাজ হবেনা, কিন্তু মেধার পূর্ণ ব্যবহার না হলে, শক্তি অব্যবহৃত থাকলে এবং উৎসাহ উদ্দীপনা অপূর্ণ থাকলে, উম্মাহর গন্ডীর বাইরে আত্মউপলব্ধির প্রলোভন অথবা খিলাফতকে ক্ষতিগ্রস্থ এবং ব্যর্থ করার প্রবণতা থেকেই যাবে। খিলাফতকে দুটিই করতে হবে: “প্রয়োজন সৃষ্টি করা অর্থাৎ সদস্যদের মধ্যে সত্য সম্ভাবনা জাগ্রত করা এবং সেগুলোর পরিপূরণের উপায়ের ব্যবস্থা করা।” যদি পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয় সে পাবে এমন একটি উম্মাহ যা অজ্ঞ এবং অজাগ্রত ও অর্বাচীন লোকদের নিয়ে গঠিত, যদি দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়, তাহলে তা দেশ ত্যাগের মাধ্যমে নিজেকে শূন্য ও ধ্বংস করার পথ উম্মুক্ত করে দেবে, অথবা অভ্যন্তরীণ নাশকতামূলক কাজের মাধ্যমে এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং বিদেশীদের শোষণের মাধ্যমে আত্মবিনাসের পথ উন্মুক্ত করে দেবে।

উৎপাদনের ঐকমত্য চরিতার্থ করার জন্য খেলাফত অবশ্যই উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করবে, শত্রুর আক্রমণ থেকে উম্মাহর কার্যকর প্রতিরক্ষার জন্য, প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করবে৩২। কোনো সদস্যই স্বেচ্ছাসেবী নয়। বরং সকলেই বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাবদ্ধ সৈনিক, যখন উম্মাহর মূল অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে, অথবা যখন পৃথিবীতে আল্লাহর বাণীকে সবার উপরে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য তাদের সার্ভিস প্রয়োজন।

চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ইজমা আল-আমালের এই দিকটির দ্বারাই উম্মাহর সর্বোচ্চ সাফল্য স্থিরীকৃত হয়, অর্থাৎ পৃথিবীকে ইসলামের জীবন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করায় এর অবদান নির্ণিত হয়। পেশা বা বৃত্তির এই দিকটি উম্মাহকে সেই স্তরে উন্নীত করে যেখানে পৌঁছানোর পর সে মানুষের ইতিহাসের এবং বিশ্ব ইতিহাসের মোকাবেলা করতে পারে। এই পর্যায়ে উম্মাহর সাফল্য হচ্ছে আল্লাহর দৃষ্টিতে উম্মাহর চূড়ান্ত যৌক্তিকতা।

 

 

 

. তৌহীদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা

 

. ইসলাম মুসলিম বিশ্ব: দুঃখজনক কতগুলো বাস্তবতা

মুসলিম বিশ্ব আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহর কালামকে সবার উপরে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি মহাসম্ভাবনাপূর্ণ শক্তি, কেননা এই মুহুর্তে মুসলিম বিশ্বে বাস করছে আটলান্টিক থেকে পূর্ব দিকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে, একশত কোটির বেশী মানুষ এবং তা এখন ইউরোপ এবং আমেরিকাতে শিকড় গাড়তে ও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। তার নিজের জন্য এবং পৃথিবীর জন্য এটি একটি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে আল্লাহর অভিপ্রেত লক্ষ্যে মুসলিম বিশ্ব এখনো তার ক্ষমতার বিকাশ ও ব্যবহার থেকে দূরে। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিশ্ব তার নিজের ক্ষমতা, নিজের বিকাশের জন্য প্রয়োগ, স্বদেশে তার ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যর্থ প্রয়াস ও অমুসলমানদের স্বার্থে গঠনমূলক প্রচেষ্টায় সেই সব শক্তির অপচয়ের মধ্যে একটি অনিশ্চিত ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে।

মুসলিম দেশগুলোর সংবিধানের অধিকসংখ্যকই ঘোষণা করে যে, রাষ্ট্রের ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। কেবলমাত্র একটি দেশই, সৌদি আরব, এই ঘোষণাকে গুরুত্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছে, যার লক্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্রে শরীয়াহর কার্যকরণ। অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো কিছু সংখ্যকের, যেমন- পাকিস্তান ও কুয়েতের স্থান এর পরেই, কারণ এই সব দেশের সংবিধান ঘোষণা করেছে, ইসলাম হচ্ছে রাষ্ট্রের এবং উম্মাহর মূল শর্ত, তবে এর সঙ্গে তারা যোগ করেছে পাশ্চাত্য বর্ণনামূলক এসব ধারণা যে, তারা যে জাতি বা রাষ্ট্র এর কারণ তারা একটি জাতি গোষ্ঠী, একটি অঞ্চল এবং সার্বভৌমত্ব সমবায়ে তাদের জাতি বা রাষ্ট্র গঠিত, এটি এমন একটি বিবেচনা যাতে অপরিহার্য শর্ত হিসাবে ইসলাম অসম্পূর্ণ বলে গণ্য। তৃতীয় শ্রেণীর রাষ্ট্রগুলো যেমন মিশর, মরক্কো এবং সুদান ইত্যাদি। যারা ইসলামকে কেকের উপর বরফের একটি আবশ্যক আস্তর বলে গণ্য করে, যে কেকটির অন্তর্গত কাঠামো এবং বিন্যাস গঠিত পাশ্চাত্যের ধ্যান ধারণার দ্বারা, ইসলামী ধ্যান ধারণার দ্বারা নয়। জাতীয়তাবাদ নামক এক নতুন শুউবীয়া বা গোত্রবাদ পাশ্চাত্য ধরনের (রক্ত এবং মাংসের) রোমান্টিসিজম দ্বারা নির্ধারিত হয় অভিবাসন, এবং ন্যাচারালাইজেসনের আইন কানুন, নেতাদের সক্রিয় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও অন্যান্য শিক্ষিত শ্রেণীর জীবন আচরণের রূপ এবং নিজেদের সামাজিক প্রতিকৃতি যা জনগণের শিক্ষা এবং প্রেরণার জন্য পরিকল্পিত ও প্রচারিত হচ্ছে। এমন কোন মুসলমান দেশই নেই যা মদীনায় রাসুল্লাহর সমগ্র সময়ে মহানবীর সমাজ যে নিরবিচ্ছিন্ন মবিলাইজেশন ও সতর্ক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে সেই মবিলাইজেশন ও সর্তকতার মধ্যে নিজেকে পরিচালিত করেছে। এবং সম্ভবত মুসলিম বিশ্বের সবচাইতে নিকৃষ্ট দিক হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে তার দেউলিয়াপনা। এমন কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কোথাও নেই যা পাঁচ বছর বয়স্ক মুসলিম শিশুর দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তার সম্ভাবনাপূর্ণ বিকাশে তাকে উম্মাহর নিকট প্রত্যর্পণ করে। পৃথিবীকে রূপান্তরিত করার জন্য মুসলিমদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণের কোন সুযোগ সুবিধা আমাদের নেই- সে সুযোগ সুবিধা নেই ঐশী নক্সার আদলে উপাদান উপকরণকে রূপ দেওয়ার এই চেতনায় যে, সেই ঐশী নক্সাই হচ্ছে তার ব্যক্তিগত জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। পি. এইচ. ডি অথবা এম. ডি. গ্রাজুয়েটদের মোট সংখ্যার অনুপাতে শিক্ষিত ইমিগ্রান্ট এবং হতাশ বসবাসকারীদের হার ভয়ংকরভাবে অনেক উচ্চে, এর পরিসরের অন্যপ্রান্তে শিক্ষিতদের সঙ্গে অশিক্ষিতদের সর্বোচ্চ হার আতংকজনক।

মুসলমানরা যে দীর্ঘদিনের নিদ্রা থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছে তাতে বিচলিত হবার কিছু নেই, তাদের সমাজগুলো আর্থিক সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়ে যে দুর্বল অথবা তাদের রাষ্ট্রগুলো যে নিষ্ক্রীয়তা ও আলস্য থেকে পৃথক ধ্বনি তুলে এলোমোলোভাবে পা ফেলে দাঁড়াচ্ছে তাতেও বিচলিত হবার কিছু নেই। বিচলিত হবার বিষয় হচ্ছে উম্মাহর এই মুহূর্তে বর্তমান ও ভবিষ্যতের এই সন্ধিকালে মুসলিম নেতাদের উম্মাহ সম্পর্কে দূরদৃষ্টির অভাব। আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা হচ্ছে এই দূরদৃষ্টির অভাবের ফল এবং ইসলামী নাগরিকদের গড়ে তোলার চেষ্টার সম্পূর্ণ অভাব, যে নাগরিকেরা ইসলামী আদর্শের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কারণ সে একবিংশ শতাব্দীতে নিজের পরিচয় সম্পর্কে সজাগ।

 

. রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিশ্রুতি

কোনো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুসলিমই এই শতাব্দীতে উম্মাহর দুঃখজনক ব্যর্থতাগুলো সম্পর্কে মুসলিম রাজনৈতিক নেতারা সাধারণত যে সব কৈফিয়ত দিয়ে থাকেন, সেগুলো বোঝেনা বা গ্রহণ করেনা এবং কেউ এ যুক্তি গ্রহণ করেনা যে, খিলাফতের নেতাদের উদ্যোগ গ্রহণের পূর্বেই জনতার মধ্যে থেকেই আসতে হবে। যে এলিট শ্রেণীর এ বিষয়ে উৎকৃষ্টতর জ্ঞান আছে নিশ্চয়ই তাদের অস্তিত্ব রয়েছে এবং তারা সংখ্যায় প্রচুর। ইতিহাসের এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন মুসলিম উম্মায় ইচ্ছা-উদ্দীপনা সৃষ্টি করে তাকে গতিশীল করে তোলা। এবং কেবল তখনই তা সম্ভবপর হতে পারে, যখন নেতারা প্রস্ততি গ্রহণ করবেন, কর্তা হিসাবে ইতিহাসের গতিধারায় হস্তক্ষেপের বিপজ্জনক ভূমিকায়, এর বোগী বা কর্ম (object) হিসাবে নয়৩৩

মুসলিম উম্মাহ কর্তৃক ইতিহাসে হস্তক্ষেপের সূচনা হয় গৃহেই, খিলাফতকে নির্মাণ করার ধৈর্য্যপূর্ণ অবিচলিত প্রয়াসের মাধ্যমে যা বর্তমান কোন মুসলিম রাষ্ট্রেই বিদ্যমান রয়েছে বলে মনে হয়না। যেখানে নোঙ্গর ফেলতে হবে তার একটি সাময়িক বুনিয়াদ সম্পর্কে নিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই খিলাফতকে অবশ্যই সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে মবিলাইজ করার জন্য চেষ্টিত হতে হবে, এবং মার্চ করে অগ্রসর হবার জন্য ডাক দিতে হবে। এই উদ্দেশ্য পুরণের জন্য খোদ খিলাফতের বিলুপ্তি ছাড়া আর কোন প্রয়াসই বাহুল্য বলে গণ্য হওয়া উচিত নয়। খিলাফতের কর্মচারী ও পরিচালকদেরকে কোরবান করা যেতে পারে বা কোরবানী করা উচিত, যদি কোরবানী ছাড়া অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে অগ্রগতি সম্ভব না হয়। যে মুহূর্তে উম্মাহ প্রস্তুত হয়ে দাঁড়াবে সেই মুহূর্তে আবু বকরের খিলাফত আবার আয়ত্বে এসে যাবে আর তা হবে সর্বকালের মহত্তম মুহূর্ত।

 

 

টীকা:

১. তোমাদের এই উম্মাহ এক, ঐক্যবদ্ধ এবং অবিভাজ্য এবং আমি তোমাদের রাব্ব, তোমরা আমার বন্দেগী কর (২১: ৯২)।

২. (মানবজাতি ক্ষতিগ্রস্থ) তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, একে অপরকে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে এবং ধৈর্য্যশীল হতে আদেশ করেছে (১০৩: ৩)- যারা আল্লাহতে বিশ্বাসী এবং ধৈর্য্য ও দয়া দাক্ষিণ্যের নির্দেশ দেয় (৯০: ১৭)।

৩. আল্লাহ রজ্জু দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়োনা, স্মরণ কর তার অনুগ্রহের কথা, তোমাদের মিলনের কথা, যখন তোমরা ছিলে একে অপরের শত্রু এবং তোমরা হয়ে উঠলে পরস্পরের ভাই এবং যখন তোমরা ধ্বংসের অতল গহ্বরে কিনারে উপনীত হয়েছিলে এবং তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছিলেন, এভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে দেখান তার নির্দশন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার (৩: ১০৩)।

৪. তোমাদের মধ্য থেকে একটি উম্মাহ্ হউক, যে সৎকাজের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের নির্দেশ দিবে, মন্দ কাজ নিষেধ করবে। প্রকৃতপক্ষে তারাই সফলকাম (৩: ১০৪)।

৫. আল্লাহ এবং তাঁর নবীকে মেনে চল, যদি তোমরা প্রকৃতই মুমিন হও (৮: ১)।

৬. আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই মহত্তম তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে পুণ্যব্রতী, সবচেয়ে সদাচারী (৪৯: ১৩)।

৭. তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা কর সৎকর্মে ও পুণ্যকাজে, মন্দকর্মে ও সীমা লংঘনে নয় (৫: ২)।

৮. খিলাফাহ, খুলাফাহ, খালায়েফ, ইয়াস্তাখলিফুকুম প্রভৃতি শব্দগুলোর দ্বারা কুরআনের আয়াতে এর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

৯. তোমাদের মধ্য থেকে একটি উম্মাহ্ হউক যে সৎকর্মের নির্দেশ দেয় এবং মন্দ কর্ম বারণ করে, প্রকৃতপক্ষে তারাই সফলকাম (৩: ১০৪)।

১০. ইসলামী আইন-কানুনের কংক্রীট রূপদান ও বাস্তবায়নের এই ত্যাগীদের ইসলামে এবং ইউটোপিয়াবাদী ধর্মগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীতে, একটি বাস্তব ধর্ম হিসেবে ইসলাম খ্যাতি অর্জন করে।

১১. ইসলামে জনকণ্ঠ বা জনমতকে কখনো আল্লার কণ্ঠের সমান গণ্য করা হয়নি, বরং জনকণ্ঠ বা জনমত সবসময়ই আল্লাহর নির্দেশের অনুবর্তি ও অধীনে রয়েছে, জনমত যখন আল্লাহর আদেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তখনই তা বাধ্যতামূলক এবং যখন আল্লাহর বাণী থেকে ভিন্নপথ অবলম্বন করে তখনই তা নিন্দনীয় হয়।

১২. Abd al Rahman ibn Khaldun. Al Muqaddimah (Cairo: Matbaut Mustafa. Muhammad n.) pp. 127 if.

১৩. দেখুন এই গ্রন্থকারের (Christion Ethics Chap 1 VII Urubah and Religion pp. ff

১৪. তোমরা রবের পথের দিকে আহ্বান কর, প্রজ্ঞা ও শোভন প্রচারের মাধ্যমে, অবিশ্বাসীদের সঙ্গে সংলাপে সবসময় শ্রেষ্ঠতর এবং শোভনতর যুক্তি উত্থাপন কর (১৬: ১২৫)।

১৫. শাসকের বৈধ সমালোচনাকে উৎসাহিত করার জন্য মহানবী বলেছেন, “যে কেউ শাসকের জবাবদিহি বাধ্য করার প্রয়াসে মারা যায়, সে শহীদের মৃত্যুবরণ করে” এবং কোন জাতি যখন দেখে একটি শাসক জবরদাস্ত স্বৈরশাসন চালাচ্ছে এবং তাকে থামাবার জন্য চেষ্টা করছেনা তখন সে জাতি এমন একটি অপরাধ করে যার জন্য সে আল্লাহর কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হয়ে পড়ে।

১৬. আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তনের চেষ্টা করে (১৩: ১১), তারাই সদাচারী যারা পৃথিবীতে তাদেরকে ক্ষমতা দেওয়া হলে সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয়, সৎকর্মের নির্দেশ দেয় এবং মন্দকর্ম নিষেধ করে, চূড়ান্ত পর্যায়ে সমস্ত কিছুর প্রত্যাবর্তন আল্লাহর নিকট (১২: ৪১)।

১৭. আমি জ্বীন এবং মানবজাতিকে আমার ইবাদত ছাড়া জন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি (৫১: (৫১:৫৬)। ৫৬)।

১৮. হে জনগোষ্ঠী, আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি মাটি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে তোমাদেরকে স্থাপন করেছেন যাতে তোরা পৃথিবীতে বাস করতে পার। অতএব তার ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাঁর নিকট অনতাপ কর, তিনি হচ্ছেন প্রভু, তিনি নিকটেই আছেন এবং তিনি দয়ালু (১১: ৬১)।

১৯. যারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে রাজত্ব দান করবেন যেমন তিনি দিয়েছিলেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে তিনি তাদের নিকট থেকে যা গ্রহণ করেছিলেন তাদের সেই ধর্মকে শক্তিশালী করবার জন্য তিনি কথা দিয়েছিলেন এবং তাদের আতংক ও নিরাপত্তহীনতাকে আত্মবিশ্বাস ও নিরাপত্তায় পরিণত করতে। তদের কাজ হচ্ছে তাঁর ইবাদত করা এবং কোনো কিছুতেই তাঁর শরীক না করা, যারা ঈমান আনেনা তারা অন্যায়চারী (২৪: ৫৫)।

২০. দারিদ্র হচ্ছে শয়তানের প্রতিশ্রুতি, শয়তান তোমাদেরকে অশ্লীল ও পাপকর্ম করতে নির্দেশ দেয়, আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেন, তার দয়া ক্ষমা ও অনুগ্রহের, তিনি সবকিছু জানেন। তিনি প্রাচুর্যময় (২: ২৬৮)।

২১. তুমি কি দ্বীনের অস্বীকারকারীেেদর দেখেছো, সে হচ্ছে ঐ ব্যক্তি সে এতিমকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়, যে মিসকিনকে খাদ্য দানে নির্দেশ দেয়না (১০৭: ১-৩)।

২২. বল হে মোহাম্মদ, আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য যে সব শোভার বস্তু ও বিশুদ্ধ জীবিকা দিয়েছেন, কে তা নিষিদ্ধ করেছে? বল, এই পৃথিবীতে এগুলো মুমিনদেরই জন্য এবং পরকালে তারা এগুলো উপভোগ করবে। এরূপে আল্লাহ জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তাঁর নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন (৭: ৩২)।

২৩. Pritchard. Ancient Near Eastern. Tests 60.

২৪. আসমানে এবং জমিনে যা কিছু আছে সমস্ত কিছুই তোমাদের অধীন করেছেন। যারা চিন্তা করে এবং বিচার করে, তাদের জন্য এতে রয়েছে নিদর্শন (৪৫: ১৩) আল্লাহই তোমাদের জন্য ধরিত্রীকে করেছেন বশীভূত, তোমাদের উদ্দেশ্য সাধন ও কর্মের জন্য তাই পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়, আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে ভক্ষণ কর এবং স্মরণ রাখ যে তার কাছেই তোমাদের ফিরতে হবে (৬৭:১৫)।

২৫. Mohammad Husayn Haykal-Al Faruq Umar (Cairo Matbaat Misr 1364) Vol. 2 p. 200.

২৬. এবং তারা তাদের সম্পদে দরিদ্র ও বঞ্চিতের অধিকার স্বীকার করে (৫১: ১৬)।

২৭. (দুর্ভাগ্য তাদের) যারা সম্পদ পুঞ্জীভূত করে এবং মনে করে যে, তাদের সম্পদ অমরতা দান করবে (১০৪: ২-৩) আল্লাহ ক্রয় বিক্রয় হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন (২০২: ২৭৫) ২৮. যখন সালাত সম্পন্ন হয়, তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান কর এবং

আল্লাহকে বার বার স্মরণ কর যাতে তোমরা প্রকৃতই সফলকাম হতে পার (৬২: ১০)। (হে মোহাম্মদ) তাদের থেকে একটি অংশ গ্রহণ কর অভাবগ্রস্থকে দেবার জন্য। এবং তাতে তাদের অন্তরের সৎকর্মশীলতা দৃঢ় হবে। তাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা কর, তাদের জন্য তোমার প্রার্থনা, তাদের জন্য সৃষ্টি করবে আত্মবিশ্বাস, কারণ আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ (৯: ১০৩)।

২৯. যাকাতের আদেশ বিষয়ক কুরআনের আয়াত অসংখ্য। দেখুন Barakat. Al Murshid… Zakah. বিশেষ করে কুরআন ৯: ১০৩)।

৩০. প্রকৃতপক্ষে অন্য মূল্যগুলোকে বাদ দিয়ে কোনো একটি মূল্যের অনুসরণ হচ্ছে সেই মূল্যের উপর একটি জুলুম। একচ্ছত্র শাসন এই ধরনের কোনো একটি মূল্যের অনুসরণে বাড়াবাড়ি যা মূল্য অনুসরণের প্রয়াস এবং তার উদ্দেশ্য দুটিকেই দুষিত করে এবং সেগুলোকে মূল্যহীন করে তোলে।

৩১. পাঠ কর তোমার রবের নামে যিনি স্রষ্টা (৯৬: ১)… পাঠ কর তোমার প্রভু মহিমান্বিত, তিনি লিখতে শিখিয়েছেন, তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে আগে কখনো জানতনা (৯৬: ৩-৫)। মুমিনগণের একসঙ্গে যুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়, তাদের কিছু সংখ্যকের উচিত ধর্মের অনুসরণের জন্য এবং এর নিয়ম কানুন আদেশ নিষেধের চর্চার জন্য গৃহে অবস্থান করা কারণ তাদের সাথীরা যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তাদেরকে শিক্ষাদানের জন্য তদের প্রয়োজন হবে, যেন তারা পাপ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে (ধর্মের নির্দেশ মত) (১: ১২২)।

৩২. তোমাদের সর্বশক্তি নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবার জন্য তৈরী হও। তোমাদের অশ্বারোহী যোদ্ধাগণকে এভাবে বিন্যস্ত কর, যাতে আল্লাহর শত্রুগণ এবং তোমাদের শত্রুগণ ভীত হয় এবং অন্যেরাও ভীত হ্যা, যাদের তোমরা হয়তো জাননা, কিন্তু আল্লাহ জানেন। তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে যা কিছু ব্যয় কর, সমস্ত কিছুই তোমাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তোমাদের পুরস্কারসহ এবং তোমাদের প্রতি অবিচার করা হবেনা (৮:৬০)।

৩৩. (হে বিশ্বাসীগণ) আল্লাহ যা ইতিহাসেই নির্ধারণ করেছেন তা ছাড়া আর কিছুই তোমাদের উপর আপতিত হবেনা, তিনি আমাদের রব, আমরা মুমিনগণ সবসময়ই তার উপর নির্ভর করবো। বল তোমরা কি আমাদের জন্য দুটি মঙ্গলের একটির প্রতীক্ষা করছো (শাহাদাত এবং জান্নাত, অথবা যুদ্ধে বেঁচে থাকা এবং শত্রুর উপর বিজয়) এবং আমরা প্রতীক্ষা করছি যে, আল্লাহ তোমাদের শান্তি দিবেন সরাসরি নিজ পক্ষ হতে অথবা আমাদের হস্তের দ্বারা (৯: ৫১-৫২)।

 

অনুবাদঃ অধ্যাপক শাহেদ আলী।

৭৬৮ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।
Picture of ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী

ড. ইসমাঈল রাজী আল ফারুকী (১৯২১-১৯৮৬) তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অথরিটি হিসেবে সুপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তার জন্মভূমি ফিলিস্তিনে কলেজ শিক্ষা সমাপনের পর ১৯৪১ সালে তিনি বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক; যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর নেওয়ার পর ১৯৫২ সালে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন । ফারুকী এ সময়ে ইংরেজি, আরবি ও ফরাসি- এ তিনটি ভাষায় গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ এ চার বছর ইসলামের ওপর উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা করে কাটান। পরবর্তীতে মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলাম ধর্ম ও আমেরিকার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্মের ওপর পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইসলাম, খ্রিষ্ট ও ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি শীর্ষস্থানীয় । স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৪৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে ফিলিস্তিন সরকারের গ্যালিলির জেলা গভর্নর নিযুক্ত হন। এভাবে প্রশাসনিক ক্যারিয়ার দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার প্রশাসক জীবনের অবসান ঘটে, যখন ১৯৪৮ সালে জায়নবাদী ইসরাইলী দখলদার বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে নেয়। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে ফিলিস্তিনীরা নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে যান। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলিম পরিবারের মতো ফারুকীর পরিবারও ফিলিস্তিন থেকে বহিষ্কৃত হয়ে লেবাননে আশ্রয় নেন। এ ছিলো ফারুকীর জীবনের সন্ধিক্ষণ মুহূর্ত। শত অনিশ্চয়তা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি নিজের অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গঠনে সফল হন। আবাসিক অধ্যাপক হিসেবে তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচীর ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক রিসার্চ এ অধ্যাপক হিসেবে, ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত নিউইয়র্কের সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমেরিকার টেম্পল ইউনিভার্সিটিতে Islamic and History of Religions এর অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । এছাড়া তিনি বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়ালিজম-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ইসমাইল ফারুকী শুধু আত্মিকভাবে ইসলামের ধারণা ও মূল্যবোধকে তুলে ধরেননি; নিজের কাজকর্ম, গবেষণা, শিক্ষকতা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরেছেন। ড. রাজী বহু আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনে শতাধিক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রকাশিত The Cultural Atlas of Islam, Historical Atlas of the Religions of the World, Trialogue of the Abrahamic Faiths, Christian Ethics, Al Tawhid : Its Implications for Thought and Life. প্রভৃতি গ্রন্থ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ও ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৮৬ সালের ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাসায় আততায়ীর গুলিতে অধ্যাপক ইসমাইল রাজী আল ফারুকী ও তার স্ত্রী লুইস লামিয়া ফারুকী শহীদ হন। এ শাহাদাতের মধ্য দিয়ে এ কালে মুসলিম চিন্তার জগতের এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা খসে পড়ে এবং একজন সৃষ্টিশীল বুদ্ধিজীবীর কর্মঘন জীবন নীরব হয়ে যায়। তথাপি বিশ্বব্যাপী বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামি চিন্তার বিকাশে অগ্রপ্রতীক হিসেবেই বিবেচিত ড. ফারুকী।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top