আমরা যদি পৃথিবীর এই অঞ্চলের তথা কাতারের জমিনের দিকে তাকাই, তবে এই জায়গাটি খুব শুষ্ক, নিষ্ফলা বলে মনে হবে, কিন্তু যদি আমরা এখান থেকে কয়েক মাইল দূরেই সাগরের তলদেশ লক্ষ্য করি তাহলে বিস্ময়করভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ বাস্তুতান্ত্রিক অঞ্চলটি দেখতে পাবো। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর এই অঞ্চলটি বিস্তৃত হয়েছে এখান থেকে হরমুজের বন্দর আব্বাস ও পারস্য উপসাগরের উত্তর পর্যন্ত, যেখান থেকে আমি এসেছি। আমি মনে করি ইসলাম এবং পরিবেশের সংরক্ষণ প্রশ্নে কথা বলার জন্য এটি একটি চমৎকার উপলক্ষ হতে পারে।
১৯৬৬ সালে পরিবেশ সংকট নিয়ে আমিই সর্বপ্রথম কথা বলা শুরু করি। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর প্রস্তাবিত একটি লেকচার সিরিজে আমি পরিবেশ সংকটের সম্ভাব্যতা তুলে ধরি যা পরবর্তীতে ‘ম্যান এন্ড ন্যাচার’ শিরোনামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। সেটা ছিলো এমন এক সময় যখন এই বিষয়টি নিয়ে এই দৃষ্টিকোণ থেকে কেউই ভেবে দেখেনি। পরবর্তীতে নরওয়েজিয়ান ফিলোসফার আর্ন ন্যাস ডীপ ইকোলজির (Deep Ecology) ধারণা নিয়ে আসেন, যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রে কেবল ডীপ ইকোলজিকে আমি যথার্থ মনে করি না। বরং এখন দরকার গভীর থেকে গভীরতর ইকোলজি বা বাস্তুসংস্থান।
আমি জীবনের প্রথমদিকে ইরানের তেহরানে বেড়ে উঠি। শহরটি তখন এক বিশাল বাগানের মতো ছিলো, পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বড় দামাভন্দ পাহাড়ের চূড়ায় সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আর এর পাদদেশে পরিবারের সাথে গ্রীষ্ম কাটিয়ে, প্রকৃতির সৌন্দর্যকে এভাবে খুব কাছ থেকে অনুভব করার পর আমি যখন পদার্থবিদ্যা আর গণিত পড়ার জন্য এমআইটির মতো বাহ্যিকভাবে কুৎসিত একটা জায়গায় এসে পড়ি, তখন ভিন্নরকম একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয় আমার। আমি বুঝতে পারি এখানে কিছু একটা গড়বড় হচ্ছে এবং একটা বড় সংকট তৈরি হতে যাচ্ছে। কেননা তথাকথিত প্রগতিশীল হওয়ার নামে, প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার করতে তারা যাকে প্রকৃতি হিসেবে সাব্যস্ত করছে, বিজ্ঞান বলতে যা কিছু বুঝাচ্ছে এবং আদতে প্রকৃতি যা, তার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এভাবে বিজ্ঞান ও প্রকৃতিকে তাদের মূল সত্তা, পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে আলাদা করার মাধ্যমে আমরা আমাদেরকেই সবার আগে ধ্বংস করতে যাচ্ছি।
আজ আপনাদের উপর প্রভাব বিস্তার করার মতো কিছু যদি বলতে হয়, তবে পরিবেশের এই নিদারুণ সংকটের চেয়ে জরুরী আর কোনো বিষয় নেই। কারণ আমাদের যদি প্রকৃতিই না থাকে তাহলে অর্থনৈতিক বিবেচনা, রাজনৈতিক বিবেচনা কোনো কিছুই কোনো কাজে আসবে না। ন্যূনতম বোধশক্তি থাকলেও যে কেউ বর্তমান বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংকটকে অনুধাবন করতে পারে। কিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক যে যখন আসলেই বিপর্যয়কর কিছু ঘটে তখন সে বিষয়ের মূল আলোচনাটিই ভাগাড়ে ফেলে রাখা হয়। আমাদের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার সাথে সাথে আমরা সাগরের মাছ, আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখিদের জন্য যা কিছু কল্যাণকর- এমন অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলি আর ভাবি যে একবার এ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারলেই আমরা বাস্তুতান্তিক বিপর্যয়ের ব্যপারে আবার মনোযোগ দিবো। অথচ এ সবগুলো বিষয়ই একটা আরেকটার সাথে জড়িত।
আমরা আজ মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা দুনিয়ায় বসবাস করছি। আমরা কে, এই পৃথিবীটা কী এ ব্যপারে এক মিথ্যা ধারণা নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। আমি এ মূহুর্তে মেটাফিজিক্স নিয়ে বক্তৃতা না দিলেও, প্রাকৃতিক পরিবেশের এই বাস্তবতাকে আমি বিবেচনায় রাখতে চাই। সেইসাথে গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই, পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায়, সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান ও বাস্তুতন্ত্রের দিক থেকে কাতার ও এর আশপাশের এলাকাগুলোর পুরো বিশ্বকে রক্ষা করার গুরু দায়িত্ব রয়েছে।
আমরা মনে করি যে, কী হয় যদি অল্প কিছু মাছ হারিয়ে যায় অথবা দূরে কোথাও অস্ট্রেলিয়া, পারস্য উপসাগরের প্রবাল প্রাচীরগুলো শুকিয়ে যায়! অথচ, আমরা যে বাতাস থেকে শ্বাস নিচ্ছি এসকল জীব তার গুণগত মান নির্দেশ করে। আর প্ল্যাংকটন বা সমুদ্রে ভাসমান ক্ষুদ্র জীবগুলো সমগ্র জীবজগতের সাম্যাবস্থা রক্ষা করে। তাই আমাদের সর্বপ্রথম, সবচেয়ে আশঙ্কাজনক এই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করা জরুরী। বুঝা দরকার, এটা এমন কোনো সমস্যা নয় যা কসমেটিক সার্জারির মতো করে সমাধান করা যাবে। যেমনটা আজকাল আমরা হরদম করে থাকি। বিষয়টা তাহলে এমন দাঁড়ালো যে কারো ক্যান্সার হলো, তার শরীর হলদে হয়ে গেলো আর তার উপর আমরা পাউডার মেখে সমাধান বাতলাতে চাইলাম। কিন্তু সমস্যাটা প্রকৃতপক্ষে আরো অনেক গভীর। এর জন্য আমাদের জীবনাচরণের পরিবর্তন করা দরকার– কীভাবে আমরা পৃথিবীকে দেখি, কীভাবে নিজেদের দেখি এবং পরিশেষে বাস্তবতাকে কীভাবে দেখি, এসকল বিষয়ের পুনঃসন্ধান জরুরী। কেননা আমরা কেমনভাবে দুনিয়াতে বসবাস করি, কেমন আচরণ করি, ইলাহী সত্য/বাস্তবতাকে বা হাকীকতকে স্বীকার করি নাকি অবহেলা করি- এসবকিছু নির্ধারিত হয় পরম ইলাহী বাস্তবতার সাথে আমাদের সম্পর্ক কেমন তার উপর ভিত্তি করে। আর একারণেই ইসলামের প্রসঙ্গ এখানে চলে আসে।
এই কাতার অঞ্চলটি বাহ্যিকভাবেই কেবল ইসলামের অংশ নয়; বরং পবিত্র মক্কা ও মদিনা নগরী থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে যার অবস্থান এবং ভৌগোলিকভাবে সেনেগাল থেকে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ ফিলিপাইন এবং উত্তর-দক্ষিণে আরো নানা অঞ্চলের দিকে বিস্তীর্ণ ইসলামী ভূখণ্ডের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। আর তাই আমি আলোচনা করতে চাই, পরিবেশ সংকটের মুখোমুখি হওয়াতে এই অঞ্চলগুলোতে বসবাসরত মানুষদের জন্য কেনো ইসলাম কেবল গুরুত্বপূর্ণই নয়; বরং অত্যাবশ্যকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বিশাল সংখ্যক মুসলিম রয়েছেন যারা তাদের ঈমানে পরিপক্ব। পৃথিবীর মোটামুটি সকল অঞ্চলজুড়েই ইসলাম বিদ্যমান এবং মুসলিমরা সচেতনভাবে বিভিন্ন পবিত্র দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু দৈনন্দিন নামাজ, যাকাত আদায়, শরীয়ার অনুসরণ করার পাশাপাশি যে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রতি তারা কেমন আচরণ করছেন তার সম্পর্ক আছে, সে ব্যপারে অনেক মুসলিমই সচেতন না। এই বিচ্ছিন্নতাটি ইসলামী বিশ্বে ১৯ শতকের দিকে আগমন করে খুব অদ্ভুত কিন্তু শক্তিশালী সায়েন্টিজম বা বিজ্ঞানবাদ নামক একটি ধারা থেকে।
বিজ্ঞানবাদ হলো বাস্তবে যা কিছু হচ্ছে তার সবকিছুর সাথে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে মডার্ন বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিকে সরলীকরণ করে উপস্থাপনের একটি উপায় এবং বাস্তবতাকে বুঝার জন্য বিজ্ঞানকেই নির্ধারক ফ্যাক্টর হিসাবে বিবেচনা করা। এটা আশ্চর্যের বিষয় যে, বিজ্ঞানবাদ ইসলামী জগতে এসেছে পেছনের দরজা দিয়ে এবং এটি বেশিরভাগই এসেছে ইস্তাম্বুল ও কায়রোতে প্রবেশের মধ্য দিয়ে এবং পরে বোম্বে– যেই শহরগুলোতে মুসলমানরা হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ অথবা সংখ্যালঘু। এসব শহর থেকে পারস্য অঞ্চল, আরব বিশ্ব এবং উসমানী খেলাফতের অভ্যন্তরীণ অংশে, অর্থাৎ ইসলামী বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে ছড়িয়ে পড়ে।
নিজেদের খুবই ধর্মানুরাগী মনে করতেন এমন কতিপয় মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রচেষ্টায় ইসলামী বিশ্বে বিজ্ঞানবাদের সূচনা হয়। তারা চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক সময়ে পাশ্চাত্যের কবল থেকে ইসলামী বিশ্বকে রক্ষা করতে, যে পাশ্চাত্য সে সময়ে সামরিকভাবে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো এবং অবশ্যই এখনও আছে। তারা কাজটি করতে চেয়েছেন ইলম বা জ্ঞানের ইসলামী বুঝাপড়াকে মডার্ন বিজ্ঞানের সাথে সমানভাবে দেখা এবং এটা বলার মাধ্যমে যে মূলত ইসলামই পাশ্চাত্যের মডার্ন বিজ্ঞানের জনক তাই সকল মুসলিমকে পশ্চিমা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন করতে হবে আর এর মাধ্যমেই তারা ঔপনিবেশিক শক্তিকে উৎখাত করতে সক্ষম হবে, একটা খুবই সুখী জীবন যাপন করতে পারবে, দারিদ্র্য, খাদ্য সংকট সহ সকল রকম সমস্যা দূরীভূত করতে পারবে। এমনকি এক পর্যায়ে এসে এ নিয়ে কোরআনের তাফসীরও লেখা হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত মিশরীয় স্কলার আল ইস্কান্দার আল আলামির বিশাল বৈজ্ঞানিক তাফসীর ‘তাফসীর ইলমি’, যা পরবর্তীতে এ ধরনের আরো অসংখ্য কাজের একটি পথ তৈরি করে। আর বাস্তবিকভাবেই তথাকথিত মুসলিম চিন্তাবিদ, সংস্কারকরা যারা ইসলামী বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন এবং মনে করতেন যে তারা অন্য সভ্যতার প্রভাব থেকে আমাদের ধর্মকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করছেন তারা প্রত্যেকেই তা গ্রহণ করেছিলেন। আপনি মুহাম্মদ আবদুহুর লেখার দিকে তাকান, সাইয়্যিদ কুতুবের লেখার দিকে তাকান, তুর্কির বিখ্যাত চিন্তাবিদ বদীউজ্জামান সাঈদ নূরসীর কথা বলেন কিংবা তার অনুসারী বর্তমানে পেনসিলভানিয়ায় বসবাসরত ফেতুল্লাহ গুলেন ও তার লাখ লাখ অনুসারী, তারা সকলেই। এই লিস্ট আমি আরো লম্বা করতে পারি।
যদিও আমি তাদের সাধারণত বলে থাকি বিকৃতিকারক (Deformer)। কেননা তারা ইসলামী চিন্তার সামগ্রিক ঐতিহ্য সম্পর্কে না জেনেই বিকৃতি সাধন করেছেন। এরকম আরো অনেকেই আছেন, যারা মনে করতেন যে পশ্চিমা প্রযুক্তির সাথে ইসলামী আখলাককে সংযুক্ত করার মাধ্যমে তারা ইসলামের বড় একটি খেদমত করতে পারেন। এই চিন্তা কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও কিন্তু গড়ে উঠে। ইসলামী বিশ্বে বিংশ শতাব্দীর চরমপন্থী আন্দোলন বা ধারাগুলোর বেশিরভাগ উঠে এসেছে আমাদেরই প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীদের হাত ধরে; দুর্ভাগ্যক্রমে শত্রুরা কিন্তু এটা নিয়ে আসেনি। তারা মানবিকতা অপ্রাসঙ্গিক বলে একপাশে ফেলে দিয়ে একটি বড় শূন্যতার সাথে শরীয়ায় পশ্চিমা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে যুক্ত করেছিলো এবং সেগুলো পড়াতে থাকে। সৌদি আরবের ওয়াহাবি আন্দোলনের মতো এত প্রকটভাবে এই প্রক্রিয়া আর কোথাও পরিলক্ষিত হবে না যদিও ১৯৩০ এর দশকে কিছু সময়ের জন্য আমেরিকা ও ইউরোপীয় প্রযুক্তির প্রতি খোলামেলা সমর্থনে তারা বিরোধীতা করেছিলো। কিন্তু ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ এর মাঝে আমরা পূর্ববর্তী সভ্যতা থেকে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাগুলোতে ব্যপকভাবে প্রযুক্তির বিকাশ ও স্থানান্তর প্রত্যক্ষ করেছি। সৌদি আরবে যা কোনোরকম বুদ্ধিবৃত্তিক বাধা ছাড়াই পশ্চিমা প্রযুক্তির সূচনা হিসেবে প্রবেশ করে। কারণ সবাই মনে করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি নামাজ পড়ছেন এবং অন্যান্য ধর্মীয় কাজকর্ম করছেন, মদ খাচ্ছেন না ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি একজন ভালো মুসলিম। এছাড়া বাদবাকি যা কিছু আসছে সবকিছু খুব স্বাভাবিক হিসেবে ঠেকছে আর এটা সৌদি আরবের জন্য খুব একটা আলাদা কিছু নয়।
আপনি ইসলামী প্রজাতন্ত্রী ইরান থেকে শুরু করে সৌদি রাজ্য, সেক্যুলার তুরস্ক থেকে ধর্মপ্রাণ সুদানসহ আরো যেসকল মুসলিমপ্রধান দেশ রয়েছে, তাদের ইসলামী চিন্তার ক্ষেত্রে সামগ্রিক চিত্র যদি দেখেন, তবে এক ধরনের মডার্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পূজার বৈশিষ্ট্য তাদের সবার মাঝে খুঁজে পাবেন। আমি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেও এ কথা বলার স্বাধীনতা পাচ্ছি যা ইসলামী বিশ্বে বসবাসরত অনেক মুসলিম আলেমরা বলতে ভয় পান। আমি নিজের দেশে বসে সৃষ্টিকর্তার পরিবর্তে এই নতুন বিজ্ঞান উপাসনার কঠোর সমালোচনা করছি।
বেশিরভাগ মুসলিম এখন আল্লাহকে উপাসনা করেও না, করে মডার্ন প্রযুক্তিকে আর দুর্ভাগ্যক্রমে তারা সেটা জানেও না। যদিও তাদের নিয়ত সঠিক আর উদ্দেশ্যও ভালো কিন্তু দিনশেষে তার ফলাফল একই। আর একারণেই আমরা ইসলামী বিশ্বে পশ্চিমা প্রযুক্তির লেটেস্ট গ্যাজেটগুলো খুব দ্রুতই পেয়ে যাই। একারণে কা‘বা চত্ত্বরে তাওয়াফ করার সময় আপনি টেলিফোন বাজতে শুনবেন আর এটা এমনকিছু যা সত্যিই অকল্পনীয়। কিন্তু এই অবস্থা উপরোল্লিখিত পটভূমির কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা আমাদের কাজকে খুব বেশি কঠিন করে তুলেছে।
আল্লাহ আমাকে মাফ করুক, তবে আমার এটা উল্লেখ করা দরকার যে আমি সম্ভবত প্রথম ইসলামী চিন্তক যে এই বিষয়টার বিরোধিতা করেছে, কারণ আমি উল্লিখিত ব্যক্তিদের চেয়ে তুলনামূলক ভালোভাবে পশ্চিমা বিজ্ঞান জানি। আমি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়েছি, ইউরোপে পড়েছি। কেউ আমাকে বলতে পারবে না যে, আরে তুমি এসবের মাঝে ঢুকো না আর পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কোনো কথা বলতে এসো না।
কিন্তু যখন আমি প্রথম কথা বলা শুরু করি তখন আমি একাই ছিলাম এবং আস্তে আস্তে অনেক শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি, অনেক মানুষ পড়েছে এবং আজ ইসলামী বিশ্বে আরো অনেক কণ্ঠস্বর রয়েছে যারা বুঝতে পারছে ইসলামী বিশ্বে পরিবেশ সংকট দাঁড়িয়ে আছে- প্রকৃতির ব্যপারে ইসলামের শিক্ষা, প্রকৃতির বিজ্ঞান, জ্ঞানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং এর বিকল্প হিসেবে ধর্মের নামে সম্পূর্ণ সেক্যুলার বিশ্বদর্শনকে প্রতিস্থাপন করার উপরে, এটা কোনোভাবেই কোনো সমাধান দিতে পারবে না। আমাদের কাঁধে তাই একটি গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে; আর তা হলো সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস নিয়ে আমাদের ভিত্তি পরিষ্কার করা। যদিও তাদের জায়গা থেকে তাদের ভালো উদ্দেশ্য আছে, তারা নিজেদের শক্তিশালী করতে চায়। খারাপ সরকারদের কথা বাদ দিয়ে ভালো সরকারদের কথা যদি বলি, তারা তাদের জনগণের জন্য বেশি বেশি সম্পদ তৈরি করতে চায়। সেটা সামরিকভাবেও হতে পারে কিন্তু তা পশ্চিম থেকে আসা প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে যা আমাদের আক্ষরিকভাবেই হত্যা করছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এরই একটা অংশ মাত্র।
এই একঘন্টা বক্তব্য দেয়াকালীন সময়ের মাঝেই পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কোনো বিজ্ঞানীই আপনাকে বলতে পারবে না সমগ্র বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে ঠিক কতগুলো প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। জ্ঞানের পরিবর্তে কত বেশি পরিমাণে বিষয়গুলো অজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে আছে তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। এ কারণেই প্রতি পাঁচ বছরে বৈজ্ঞানিক স্পষ্ট বক্তব্যগুলোরও ব্যপক পরিবর্তন সাধিত হয়।
বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক হর্তাকর্তাদের পরিবেশ সংকটের প্রতি আগ্রহী হতেও অনেক লম্বা সময় লেগেছে। এরপর আমেরিকা সরকারের আট বছর লেগেছে বিজ্ঞানীদের বিশ্বের যেকোনো জায়গায় বোমা ফেলতে সক্ষম এমন বড় বড় বিমান তৈরির পরিকল্পনার রিপোর্টকে নাকচ করতে। এভাবে পৃথিবীর আয়ুষ্কালের আরো আটটি বছর নষ্ট হয় এবং কোনো জরুরী পদক্ষেপই নেয়া হয় না। আপনারা কিয়োটো প্রটোকলের (১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত শিল্পায়িত দেশগুলোর গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর অঙ্গীকার) সূত্র ধরে তা জেনে থাকবেন।
আমি যে ভাষায় কথা বলি সেইভাবেই আমাকে এই খুব কঠিন পরিস্থিতিতে মোড় নিতে দিন। এই চরম পরিভাষাগুলো কেবল রাজনৈতিক হওয়ার জন্য নয়; বরং আসলে যা ঘটছে তার ব্যপারে আমাদের জাগিয়ে তোলার জন্য আমি ব্যবহার করছি। এরকম পরিস্থিতে ইসলামের উত্তর কী হতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
পরিবেশ শব্দটা নিয়ে শুরু করা যাক। যার আরবী ও ফার্সি অনুবাদ হলো মুহিত যা এসেছে ‘হাতা’ থেকে, অর্থ- পরিবেষ্টন করা। এটি একইসাথে আল্লাহর একটি নাম। কোরআনের আয়াতে আমরা পাই, ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাইয়্যিন মুহিত। মূলত আল্লাহই আমাদের পরিবেশ। মুসলিমদের জন্য, আমরা যা করি, যার মাঝে আমরা জন্ম নেই, যার মাঝে আমরা বসবাস করি, যার মাঝে মৃত্যুবরণ করি সবকিছুর মাঝেই আল্লাহ প্রকৃতার্থে পরিবেশ আকারে হাজির আছেন।
তাই, ইতোমধ্যেই আমরা বুঝতে পেরেছি যে আমাদেরকে খুবই ভিন্ন একটা পাটাতন থেকে কাজ শুরু করতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রত্যেকটা বিষয় আল্লাহর সৃষ্টি, আমরা তা-ই বিশ্বাস করি যেমনটা করে থাকে খ্রিষ্টান, ইহুদি ও অন্য ধর্মাবলম্বীরাও। এমনকি যারা সৃষ্টিতে বিশ্বাস করে না তারাও, যেমন তাও মতবাদের মানুষেরা; তারা তাও বা বিশ্বকে প্রকৃতির মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে। সৃষ্টিকার্য সম্পর্কে তারা বিশ্বাস রাখে না। কিন্তু দিনশেষে ফলাফল আসলে একই। এটা একটা বিশ্বব্যাপী ব্যপার এবং মুসলিমদের কাছে যেভাবেই হোক, অনন্য একটা ব্যপার।
আসলে আমি যা কিছু বলে থাকি তার প্রায় সব কিছুর সাথেই সহস্র বছর ধরে মানুষের জীবনকে প্রভাবিতকারী চিরন্তন জ্ঞানের একটি দিক জড়িত। ইসলাম একটি সৃজনশীল পন্থার ধারক যা পরম সত্তা তথা সৃষ্টিকর্তার মাধ্যমে চলমান রয়েছে; যার বুদ্ধিমত্তা পবিত্র, পবিত্র তাঁর প্রেম ও মমতা। তাকে আমরা ডাকছি আর–রহমান, আল খালিক সহ সকল ঐশ্বরিক নামে। এর অর্থ কী? এর অর্থ হলো, আমাদের হস্তক্ষেপ ছাড়াই প্রতিটি সৃষ্টির খোদার সাথে সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিটি সৃষ্টির নিজস্ব অধিকার রয়েছে, আর একথাটিই সবসময় বলতে চেয়েছেন প্রখ্যাত নরওয়েজিয়ান দার্শনিক ও ডীপ ইকোলজির জনক আর্ন ন্যাস।
এখন আমাদের কাছে কিন্তু এটা নতুন কিছু নয়। ইসলামী চিন্তায় আমরা ‘হক’ শব্দটা ব্যবহার করি, যা বিভিন্ন শব্দে তুলে ধরা যায় যার মাঝে একটা হলো প্রাপ্য, অধিকার। প্রতিটি জিনিসের ন্যায্য প্রাপ্য রয়েছে, অধিকার রয়েছে যেমনটা আমাদেরও আছে। কিন্তু আমরাই পৃথিবীর একমাত্র সৃষ্টি না যাদের কেবল অধিকার রয়েছে। আমরা অন্যের প্রাপ্য, অধিকারের ব্যপারটাকে কেবল আমাদের নিজের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য থেকে দেখতে পারি না। এটা অনৈসলামিক হওয়া সত্ত্বেও খুব কমই আমরা এই পরিভাষাগুলো নিয়ে চিন্তা করি। উদাহরণস্বরূপ- প্রথাগতভাবে আমাদের কোনো প্রাণী জবাই করার অধিকার আছে, তারপর তার মাংস আমাদের জন্য হালাল হয়ে যায় আর আমরা তা খাই। কিন্তু আমাদের এই অধিকার নেই যে, আমরা একটা প্রাণীকে হত্যা করবো, তারপর সেটা কোথাও ছুঁড়ে ফেলে দিবো, অপচয় করবো। এটা ইসলামী আইনের পরিপন্থী। কিছু লোক অবশ্যই এ ধরনের কাজ করে থাকে, মুসলিমদের সবাই সবসময় ইসলামী আইন মেনে চলে না। কিন্তু আমাদের বুঝা উচিত প্রতিটি জিনিসের স্ব স্ব অধিকার ও প্রাপ্য রয়েছে এবং প্রতিটি জিনিসই স্বাধীনভাবে আল্লাহর মুখাপেক্ষী।
ফার্সি, আরবী, উর্দু, তুর্কিসহ সব ইসলামী ভাষায় অনেক চমৎকার চমৎকার কবিতায় এই সত্যটি আলঙ্কারিকভাবে উঠে এসেছে। আমি সেখান থেকে জালালুদ্দিন রুমির একটা ফার্সি কবিতা তুলে ধরছি-
যদি কেবল প্রাণীকূলকে জবান হতো দেওয়া,
সরিয়ে দিতো তারা জগতের সকল পর্দা।
এরকম আরো অনেক কবিতা আছে। প্রকৃতি আল্লাহর সাথে কথা বলে, আল্লাহও তার সৃষ্টির সাথে কথা বলেন। তিনি তাদেরকে এই ক্ষমতা দিয়েছেন, তিনি তাদের জীবন দিয়েছেন। আমরা তাদেরকে জীবন দেইনি। আমরা ল্যাবরেটরিতে তাদের উপর ইনজেকশন প্রয়োগ করতে পারি, এটা সেটা করতে পারি কিন্তু জীবন দান করতে পারি না। এমনকি যে বেচারা ইঁদুরদের উপর বছর বছর ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে, তাদের জীবনও আল্লাহর দেয়া আর প্রতিটা সত্তাই আল্লাহর দিকে রুজু।
দ্বিতীয়ত, আমরা যেমন প্রকৃতিও সে অনুযায়ী আমাদের সামনে নিজেকে তুলে ধরে। এটা মডার্ন বিজ্ঞানের মতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা না। হ্যাঁ, এটা প্রকৃতির একটা বৈশিষ্ট্য। আপনি ভালো মানুষ হন বা খারাপ মানুষ, ধার্মিক বা নাস্তিক, সোডিয়াম বা ক্লোরিন থেকে তৈরি হওয়া লবণের কোনো গঠন (যদিও এটা অস্বীকার করার ক্ষেত্রে আমি হবো সবার শেষ ব্যক্তি, কিন্তু এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণে লবণের বাস্তবতাটা মিথ্যা হয়ে যায় না। প্রকৃতিও তেমনি তার বিশুদ্ধ পরিমাণগত, পরিমাপযোগ্য, বিচ্ছেদযোগ্য, বিশ্লেষণাত্মক দিক থেকে অপরিবর্তনীয়)। আর তা পরিবর্তন করতে চাওয়া হলো প্রকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার মাধ্যমে সে আমাদেরকে একটি বার্তা দিতে চায়, আর তা হলো ধ্বংস।
কিছু নির্দিষ্ট অর্থ বিবেচনায় প্রকৃতি হলো আল-কোরআনের মতো। হাজার বছর ধরে ইসলামী চিন্তাবিদরা কোরআন নিয়ে কথা বলে আসছেন। এই মূহুর্তে কোরআন আমার পকেটেও আছে। একভাবে কোরআন হলো আত তাদওয়ীনি, আল মুদাওয়্যান, যা লিখিত, গ্রন্থাবদ্ধ এবং বহনযোগ্য। অন্যভাবে কোরআন হলো আল তাকওয়ীনি যা নিজেই গোটা সৃষ্টিজগতের সমগ্র। এর প্রতিটি পাতা সত্যকে উন্মোচিত করে, যা কোরআনকে স্বীকার না করলে আমরা বুঝতে পারি না। যারা কোরআনকে বিশ্বাস করে না তাদের পক্ষে কখনো তা হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে কোরআন আমাদের যে বার্তা দিচ্ছে তা বুঝার জন্য সে বার্তার সাথে আমাদের একটা সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ যে একটি ওহী বা প্রত্যাদেশকৃত বই একথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইসলামের কথায় ফিরে আসি। কোরআন আমাদের জন্য পবিত্র। এটা ঐশ্বরিক নয়, শুধুমাত্র আল্লাহই ঐশ্বরিক। এটা আল্লাহর কথামালা, যা পবিত্র। এটা যখন আমরা বহন করি তখন অনেক বেশি সৌজন্যতা ও নম্রতার সাথে করি। আমাদের মাঝে যারা আরো একটু ধার্মিকতার চেষ্টা করি, তারা কোরআন ধরার আগেও অযু করে নেই। কোরআনে এসেছে- লা ইয়ামাসসুহু ইল্লাল মুতুহারুন, কেবলমাত্র পবিত্ররা ছাড়া এটা আর কেউ ধরতে পারবে না। এই আয়াত থেকে আমরা একটা প্রচলন তৈরি করি, বাইরে কোথাও যাওয়ার সময় আমরা কোরআনে চুমু দিয়ে যাই। যখন আমাদের মেয়েদের বিয়ে হয়, তখন তারা তাদের সামনে সূরা ইউসুফ বা অন্য কোনো সূরা খুলে রাখে। আমাদের মুসলিমদের জন্য কোরআনের সবকিছুই পবিত্র। যেখানে কোরআন লেখা হয়েছে, যে বাতাসের মাধ্যমে কোরআনের তিলাওয়াত আমাদের কানে পৌঁছায় এবং এর মাঝে যা কিছু আছে তার সবই পবিত্র।
আমাদের এভাবে ভাবা এবং অন্যান্য গ্রন্থেও এই পবিত্রতার চিন্তাটা ছড়িয়ে দেয়া উচিত। আর ইতোমধ্যে আমরা প্রকৃতিকে পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করার চিন্তাটি ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অনেকটুকু এগিয়ে গিয়েছি।
প্রায়ই আমার অসংখ্য মুসলিম বন্ধুর সাথে আমার বিতর্ক হয়েছে যে, আমি সর্বেশ্বরবাদ বা এ ধরনের কিছুর কথা বলছি কিনা। একেবারেই না! আমি কখনোই প্রকৃতিকে ঐশ্বরিক দাবি করিনি। আমি প্রকৃতিকে বলেছি পবিত্র (Sacred), যা আল্লাহর একটা নামও, আল–কুদ্দুস। প্রকৃতির মধ্য দিয়ে এই বৈশিষ্ট্যটি সৃষ্টিজগতের মাঝে প্রবাহিত হয়। একইভাবে, সৃষ্টিকূলের মাঝে খোদায়ী দয়া ‘আর-রহমাহ’ এমনভাবে প্রবাহিত হয় যে অনেক মুসলিম বিজ্ঞজনেরা আল্লাহর সৃষ্ট প্রকৃতিকে নাফাসুর রহমান বা আর রহমানের স্পন্দন হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। আর রহমান হলেন দয়াময়। পুরো মহাবিশ্বের শিরায় শিরায় তাঁর খোদায়ী মায়া, মমতা প্রবাহমান, একইসাথে তাঁর পবিত্রতাও। প্রতিদিন সাধারণ মুসলিমরা এই পৃথিবীতে বরকতের অস্তিত্ব অনুভব করেন। এমন না যে তারা কোনো দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক বা মেটাফিজিশিয়ান, তবুও। বরকত এমন একটা শব্দ যেটার আসলে সঠিক অনুবাদ করা সম্ভব নয়। কারণ এটার অর্থ করতে গেলে ‘অনুগ্রহ’ করা যায়। কিন্তু আসলে বরকত শব্দে, অনুগ্রহের সাথে এ ধরনের আরো অনেক শব্দের সমষ্টি রয়েছে। এটা আরবীর এমনই একটি শব্দ যা ভাষান্তর অনুপযোগী। কয়েক দশক চিন্তা করেও আমি ইংরেজিতে এর সঠিক অনুবাদ করতে পারিনি। আমার চেয়ে ভালো ইংরেজি জানেন এমন কেউ হয়তো কোনো এক সময় এ কাজটা করে উঠতে পারবেন।
যাইহোক, বরকত শব্দটার অর্থ আমরা বুঝি। মহাবিশ্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই বরকত প্রবাহমান। তাই প্রকৃতি যে পবিত্র, এই ধারণাটা আমাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা আজ কোরআনকে আইনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করছি, প্রেরণার উৎস হিসেবে ব্যবহার করছি, নৈতিকতার উৎস হিসেবে ব্যবহার করছি। এর বাহ্যিক অস্তিত্বকে পবিত্র গণ্য করে ঘরের একটা সম্মানিত জায়গায় এটিকে রাখছি। আগেরকার সময়ে বেশিরভাগ ইসলামী শহরে একটা গেইট থাকতো যার মাঝে কোরআন থাকতো। যে কেউ ঐ শহরে প্রবেশ করতে গেলে কোরআনের নিচ দিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিলো না। একসময়ে ইরানের সিরাজে কাতারিরা অনেকে সুন্দর সুন্দর বাগান কিনেছিলো। এখনো সিরাজ শহরে কোরআন গেইট আছে আর শহরে প্রবেশ করতে হলে তার নিচ দিয়েই প্রবেশ করতে হবে।
এখন আমরা কোরআনকে নানাভাবে ব্যবহার করছি। ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে আরো গভীরভাবে বলতে গেলে ইসলামী স্থাপত্যেও কোরআন ব্যবহৃত হচ্ছে। তেমনিভাবে প্রকৃতিকেও আমরা ব্যবহার করি। প্রকৃতি ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আল্লাহ এটিকে স্থাপন করেছেন এমনকি কোরআনে বলা হয়েছে যে, তা আল্লাহ আমাদের ব্যবহারের জন্যই সৃষ্টি করেছেন তবে সেটা বিচক্ষণভাবে করতে হবে। এমনভাবে না যেন তা ধ্বংস হয়ে যায়।
কোরআন ব্যপারটাকে অসাধারণ একটা আয়াতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে যেখানে বলা হয়েছে, মাটির নিচে যেসকল প্রাণীরা চলাচল করে (দাব্বা), আকাশে যেসকল পাখি উড়ে বেড়ায় (তঈর), তারা তোমাদের মতোই উম্মত। আমরা আমাদের বাগানে, ঘরের দেউড়িতে পাখিদের কিচিরমিচির করে উড়ে বেড়াতে দেখি; তারাও আমাদের মতো আল্লাহর বান্দা। আমরা যেমন উম্মতে মুহাম্মাদী, উম্মতে মূসা, উম্মতে ঈসা এরকম, তেমনি তারাও। প্রতি নবীর নিজ নিজ উম্মত রয়েছে। তেমনিভাবে আল্লাহও তাঁর সৃষ্টির প্রতিটা প্রজাতিকে কোনো না কোনো উম্মতের অংশ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, আমাদেরকে এই বিবেচনা মাথায় রেখে আচরণ করতে হবে।
ইসলামী সবকিছুর ক্ষেত্রে শরীয়ার শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন ইসলামী উপলব্ধির জায়গা থেকে প্রকৃতির পুনরুজ্জীবনের কথা আসে তখন আমাদের অবশ্যই কীভাবে আমরা প্রযুক্তি, স্থাপত্য, সৌরশক্তি ইত্যাদি ব্যবহার করবো তা নিয়ে কাজ করতে হবে। শরীয়াই ইসলামের একমাত্র দিক না এবং এটা উল্লেখ্য যে, আমি এটা নিয়ে আরো ব্যাপক পরিসরে কাজ করতে চাই।
কোরআনের সমপর্যায়ে আর কোনো পবিত্র গ্রন্থই প্রকৃতি নিয়ে এতটা আলোচনা করেনি; ব্যতিক্রম দাও তে চিং- তাওবাদের পবিত্র গ্রন্থ ছাড়া। সেখানে কোরআনের মতো ব্যপকভাবে প্রকৃতি নিয়ে কথা এসেছে। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, কোরআনে কখনো ডালিমের শপথ করা হয়েছে, কখনো জয়তুনের শপথ করা হয়েছে। উদ্ভিদরাজি ইসলামী ওহীর অবিচ্ছেদ্য অংশ। নবীজি যখন আবু বকরের সাথে গুহায় ছিলেন, তখন একটা মাকড়শা তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলো, তা না হলে আজ ইসলাম বলে কিছু থাকতো না।
এভাবে সৃষ্ট বস্তুসমূহের কোরআনী ওহীর অংশ হওয়াটা খুবই গুরুত্বের সাথে আমাদের বুঝতে হবে। এ বিষয়গুলো নিজেই কোরআনের দিকে ধাবিত হয়। আমরা সবসময় চাঁদ, সূর্য, নক্ষত্র, গাছপালা, পানি এসবের কথা বলে থাকি। কোরআন শুধুমাত্র মানুষের জন্য নাযিল হয়নি; বরং এটা সমগ্র মহাবিশ্বের প্রতি নাযিল হয়েছে এবং অবশ্যই ইসলামী মহাবিশ্ব কোরআনী প্রত্যাদেশের অংশ হিসেবে বিরাজমান।
আমার মনে পড়ে, ১৯৬১ সালে সবগুলো গ্রহ মেষরাষির শুরুর দিকে একটা সংযোগে চলে আসছিলো। জ্যোতির্বিদ্যায় বিশ্বাস করে এমন মানুষেরা বিশেষত হিন্দুরা, লেবাননের ইহুদিরা সকলে পাহাড়ের চূড়ায় চলে গিয়েছিলো এই ভেবে যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে এবং হিন্দু সৃষ্টিতত্ত্বে উল্লিখিত শেষ ঐতিহাসিক চক্র যুগ কলিযুগের আরম্ভ হবে। সেদিন রাতে আমি হার্ভাডের সফরকারী শিক্ষক হিসেবে একটা টার্ম শুরু করতে ক্যাম্ব্রিজের ম্যাসাচুসেটস এ এসেছিলাম। সেখানে আমার এক বন্ধু ছিলো যে বেশ মজার মানুষ ছিলো। সে ছিলো ক্যাথলিক ট্রাডিশনালিস্ট। আমি তাকে বলছিলাম যে আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে এই সময়ে আমি ইরান থাকি, কাল কী যে হতে যাচ্ছে! সে আমাকে ঠাট্টাচ্ছলে জিজ্ঞেস করলো তুমি কী চাও, তোমার উপর কোনো মুসলিম পাহাড় পড়ুক নাকি যেকোনো সাধারণ পাহাড়? মুসলিম পাহাড়, আমি মজা করে বললাম। কিন্তু ঐতিহ্যগত মুসলিমদের একপ্রকার সচেতনতা এটা।
ইসলাম সংক্ষেপে কেবল আইন ও কাজীর (বিচারক) মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আকাশ, পৃথিবী, সৃষ্টিরাজি যা চারপাশকে ঘিরে রেখেছে সবকিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে। ইসলাম মডার্ন বিজ্ঞানের কোনো বই নয়। এটা এ ধরনের বৈজ্ঞানিক তাফসীরগুলোর বিরাট একটি ভুল। এমনকি বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ডাক্তার মরিস বুকাইলি, যিনি মুসলিম হয়েছেন এই কারণে যে বাইবেলে বিজ্ঞান সম্পর্কিত যেসব আলাপ রয়েছে সেগুলো মিথ্যা এবং যা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে তা সত্য, তাই। এটা একেবারেই ভুল একটা আলাপ। যদি আমি এটাকে এরিস্টটলীয় সিলোজিজমে নিয়ে আসি তাহলে তা হবে এরকম: কোরআন বিজ্ঞান মেনে চলে তাই কোরআন সত্য। যখন এই সিলোজিস্টিক পরিভাষায় আপনি এটা আনবেন তখন বুঝতে পারবেন এটা কতটা অদ্ভুত!
আমরা বিশ শতকের শুরু এবং উনিশ শতকের শেষের দিকের কোরআনের তাফসীর গুলো পড়ছিলাম যেখানে বলা হচ্ছিলো এই আয়াত ল্যাভয়সিয়ে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন নিয়ে যা বলেছেন তার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, আরেকটি আয়াতের বিষয়বস্তু যেটা নিয়ে লুই পাস্তুর বলেছেন, নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রের কথা বলেছে ইত্যাদি। এসব তো এখন খুবই আজগুবি দেখায়, কারণ এর সবকিছুই এখন পরিবর্তন হয়ে গেছে। অথচ কীভাবে স্থায়ী কোরআনকে পরিবর্তনশীলতার কাতারে নিয়ে আসা হয়েছে! আমি এটা নিয়ে কথা বলছি না। কিন্তু আমি কোরআনকে বিজ্ঞানের স্তরে নামিয়ে আনা এবং এর মাধ্যমে কোরআনকে বড় করে দেখানোর এই ধারণাটার ঘোর বিরোধী। এটা এক বিশ্রি রকম উপাসনা যা নিয়ে আমরা সচেতন না। কিছু মুসলিমকে কি বলতে বা লিখতে শুনেছেন, ইসলাম মহান কারণ এটা রেনেসাঁ বিজ্ঞানে অবদান রেখেছে? পশ্চিমে রেনেসাঁ বিজ্ঞান মডার্ন বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত হয়েছে। তার মানে আমরা এটা মনে করি যে মডার্ন বিজ্ঞান হলো মহান আর এতে যা কিছু অবদান রাখে তাই মহান। ইসলামের ক্ষেত্রেও ব্যপারটা এমন। এটা অদ্ভূত! পুরোপুরি অর্থহীনতা!
বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আত্মহত্যা করার পর কোনো সভ্যতার আর বেঁচে থাকার মানে হয় না। সে আর বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। এটা আমার মনের কথা না; বরং এটা একটা অত্যন্ত গভীর সৃষ্টিতত্ত্ব, যদি আমি কোরআনের সৃষ্টিতত্ত্বের কথা বলি।
মদিনায় রাসূল (স.)-এর হিজরতের পর থেকে শুরু করে ইসলাম তার চৌদ্দশ ত্রিশ বছরের জীবনের অন্তত তেরশ বছরেরও বেশি সময় বিভিন্ন বিজ্ঞানের বিকাশে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে যা যেকোনো সভ্যতার বিবেচনায় অনন্য। ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে ইসলাম পৃথিবীর অন্য যেকোনো সভ্যতার চেয়ে বেশি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, চিকিৎসা, ওষুধবিজ্ঞানসহ অন্যান্য জ্ঞান উৎপাদন করেছে। এমনকি চীনের চেয়েও যারা বেশ পরিশ্রমী ছিলো, রেনেসাঁর আগ পর্যন্ত পশ্চিমের চেয়েও। এটা অনেক দীর্ঘ একটা সময়। রেনেসাঁর পর পশ্চিম মাত্র চারশো বছর ধরে প্রভাবশালী হয়ে আছে। দেখা যাক সামনের চারশো বছরে কী হয়!
আমি তাদের ছোট করতে চাচ্ছি না। কিন্তু বিজ্ঞানের এই ইসলামী ধারাগুলো এরকম ছিলো না। সেখানে পারস্পরিক বিতর্ক ছিলো। ক্লাসিক্যাল ইসলামী সভ্যতায় ব্যাপকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ছিলো। মানুষ কার্যকারণতা, পদার্থের গঠন সহ অসংখ্য অসংখ্য বিষয় নিয়ে একে অপরের বিরোধীতা করেছে। আপনি বিতর্ক পাবেন আল-বিরুনী ও ইবনে সিনার মতো বিজ্ঞানের ইতিহাসের বড় ব্যক্তিত্বদের মাঝে। কিন্তু জ্ঞানের এই শাখাগুলোর সবগুলো কোনো না কোনোভাবে কোরআন থেকে উদ্ভূত বিশ্বতত্ত্বের সাথে সম্পর্কিত ছিলো। এটা কোনো দৈব ঘটনা না– ইতিহাসে একজনও মুসলিম বিজ্ঞানী নেই যিনি নাস্তিক ছিলেন। তারা কি রিচার্ড ডকিন্সের চেয়েও বোকা না যারা তার মতোই মনে করে “নাস্তিক মাত্রই আলোকিত, খুব স্মার্ট? আর আমার মতো যারা খোদায় বিশ্বাস করে তারা হলো বোকা।” সে অনুযায়ী হলে তো, আজকের যুগে ইবনে সিনার কিতাবুশ শিফা বইটা কেউ পড়তে পারে না, তাহলে তো তিনি অবশ্যই রিচার্ড ডকিন্সের চেয়েও মূর্খ কেউ হবেন! আসলেই কি তাই? যেখানে এই মহান ব্যক্তিত্ব এমন এক মহাবিশ্বতত্ত্বের মাঝে থেকে কাজ করেছেন, যার কেন্দ্রে ছিলো সৃষ্টিকর্তা।
কোরআন বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞানের বিকাশকে অনুমোদন দিয়েছে। ইসলামী সভ্যতায় কসমোলজি বা সৃষ্টিতত্ত্বের মাঝে থেকে বিজ্ঞান চর্চা করা বেশ সমৃদ্ধ একটি ঐতিহ্য। তবে সেক্ষেত্রে সৃষ্টিজগৎ থেকে মানুষকে আলাদা করা যাবে না। নিশ্চিতভাবে মডার্ন বিজ্ঞান এই পৃথকীকরণই করেছে। তারা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে সবার প্রথমে একটা কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করার অনুমতি দিয়ে, যেখানে আল্লাহকে সহজেই ভুলে যাওয়া যায়। আগের সময়ের জ্ঞানের যে ধারা, তাতে এরকমটা ঘটা অসম্ভব ছিলো। সে সময়কার বড় বড় শহরগুলোতে আপনি দুই থেকে তিন ব্লক হাঁটার পরেই গ্রামে এসে পড়বেন। নাস্তিক্যবাদের জন্ম হয়েছে শহর এলাকায়। কোনো মানুষই নাস্তিক হয়ে জন্ম নেয় না। কিন্তু বিশ্বের কাছে এটা আমরাই ছড়িয়েছি, এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছি যেখানে প্রকৃতির মাঝে থেকেও মানুষ সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে না।
প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে অবস্থান করে কারো পক্ষে নাস্তিক হওয়া খুব কঠিন। খুবই কঠিন। তাই কোরআনই আমাদের জন্য দেওয়া প্রাথমিক উৎস যদি না তারা ভুলভাবে তা বুঝে, যারা মনে করে তারা ইসলামের খুব খেদমত করে যাচ্ছে মডার্ন সাইন্স সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে না জেনে, এর পরিণতি সম্পর্কে না জেনে এবং সত্যিকার অর্থেই এটা না জেনে যে ইসলাম সকল কার্যকারণের মূল- ‘আল্লাহ’র সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে এমন কোনো বিজ্ঞানকেই স্বীকৃতি দেয় না। আপনি যত ইবাদতই করেন না কেনো এটি বিজ্ঞানের কাছে গুরুত্বহীন এবং অবশ্যই বিজ্ঞানের প্রয়োগ হিসেবে যেসকল প্রযুক্তি তৈরি হচ্ছে তা আমাদের জন্য ব্যাপক ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কোরআনের সাথে হাদীস ও নবীজির সুন্নতও আমাদের সামনে আছে, তাঁর মারহামাতের দৃষ্টান্ত আছে। আমরা খুব ভালোভাবে জানি যে, নবীজি পশুপাখি বেশ পছন্দ করতেন, বিশেষ করে বিড়াল। যেহেতু আমি নিজেও খুব বিড়ালপ্রেমী, আপনাদের সামনে এটা নিয়ে খুব খুব চমৎকার একটা চিঠি পুনর্পাঠ করবো। এটা আমি বিংশ শতাব্দীর ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত ব্রিটিশ মহিলা কবি ক্যাথেরিন রেইন এর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তিনি কয়েকবছর আগে মারা গেছেন। তিনি ও তাঁর বন্ধুরাও বিড়াল ভালোবাসতেন। আমি লন্ডনের একটা একাডেমিতে প্রকৃতি নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেখানে তিনি আমাকে লিখেছেন, “ডক্টর নাসর, আপনার বক্তব্য খুবই চমৎকার ছিলো। হ্যাঁ, আপনি সত্য বলেছেন, প্রকৃতি হারিয়ে গেছে কিন্তু এটা ভুলে যাবেন না যে বিড়াল হারিয়ে যায়নি। এটা সৃষ্টিকর্তা যেভাবে তৈরি করেছেন ঠিক সেই অবস্থাতেই আছে।”
আমরা জানি, নবীজি কী পরিমাণ বিড়াল ভালোবাসতেন। অন্যান্য প্রাণীদের প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল ছিলেন তিনি। কীভাবে তাদের সাথে সদয় আচরণ করেছেন। ইসলাম-ই প্রথম সভ্যতা যা প্রাণীদের জন্য হাসপাতাল তৈরি করেছে, আর এ কাজটি রাসূলের সম্পূর্ণ সুন্নতের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমরা প্রাচীন গ্রীসে ছিলাম না কিন্তু যতদূর জানি সেখানে ব্যক্তিবিশেষ ছিলেন যারা প্রাণীদের ভালোবাসতো, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কায়রো, মিশর, পারস্যের শহরগুলোতে প্রাণীদের জন্য যে গোটা হাসপাতালগুলোই রয়েছে সেগুলো শরীয়ার বহিঃপ্রকাশ। যেমন কীভাবে পশুপাখির সাথে আচরণ করতে হবে, কীভাবে সদয় হতে হবে, কীভাবে তাদের সাথে বাড়াবাড়ি করা যাবে না ইত্যাদি বিষয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক মুসলিম এতে কর্ণপাত করেন না। কিন্তু হাদীসের অংশবিশেষে সরাসরি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কীভাবে কেবল স্ত্রী, কন্যা, ভাইদের সাথে না; বরং প্রাণীদের সাথেও সদয় আচরণ করতে হবে। নবীজি এটা নিয়ে খুব সচেতন ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, নবীজি প্রকৃতি ভালোবাসতেন। ভুলে যাওয়া যাবে না, প্রথম ওহী তাঁর কাছে কোনো কক্ষে নাযিল হয়নি, হয়েছে গুহায়। মক্কার মধ্যখানে অবস্থিত কাবা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে জাবালে নূর পাহাড়ের চূড়ায়। এখানেই প্রথম ওহী ‘ইক্বরা’ নাযিল হয়েছে। তিনি মরুভূমিতে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন তারকারাজির নিচে থাকতে, খোদায়ী নামের মতো মৃদুমন্দ বয়ে যাওয়া বাতাসকে অনুভব করতে। আপনি যদি মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়ান, আপনার মাঝ দিয়ে একটা বাতাস বয়ে যাবে। নবীজি তাঁর জীবনে নিজেই একজন প্রকৃতিপ্রেমী ছিলেন। অনেক হাদীস রয়েছে, আদব এর উপর, কীভাবে খাওয়া উচিত, কীভাবে কাউকে অভিবাদন জানানো উচিত, এসব সহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে যা আমরা তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী করতে চেষ্টা করি। একইভাবে তিনি বলেছেন, প্রকৃতির বাকি বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের কেমন আচরণ করা উচিত। তিনি অবশ্যই একটা অক্টোপাসের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হবে তা নিয়ে বলেননি কারণ এটা মক্কা– মদীনার তৎকালীন প্রাকৃতিক পরিবেশের অংশ ছিলো না। কিন্তু প্রকৃতির যত্ন নেওয়ার যে মূলনীতি, সেগুলো উল্লেখ করেছেন।
এখন আমরা আসবো এই শিক্ষার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সহজলভ্য উৎস কী ছিলো? যত ভালোই কেউ আরবী পড়তে পারুক না কেনো, কোনো ঐতিহ্য ছাড়া কোরআন পড়ে তার সমগ্র অর্থ বুঝে নেয়ার মতো এতোটা সাধারণ বিষয় কোরআন নয়। মিশরে একটা আন্দোলন তৈরি হয়েছে, যাকে কোরআনি আন্দোলন বলা হচ্ছে। গত কিছুদিন আগে তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জেলে ঢোকানো হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক, জানি না কেনো তারা এমনটা করছে, কিন্তু তারা যা বলছে তা ভুল। তাদের ভাষ্য হলো আমি ইংরেজি জানি, তাই আমি নৃবিজ্ঞানের উপর একটা বই লিখে ফেলতে পারি। কারণ নৃবিজ্ঞানের উপর সব বই ইংরেজিতে লেখা। এই হাস্যকর যুক্তি দিয়ে তো আর কোরআন অনুধাবন সম্ভব নয়। সুতরাং বুঝা গেল, কেবল আরবী জানাটাই যথেষ্ট নয়।
কোরআনের প্রথম তাফসীর হলো হাদীস; এ কথাটি আমাদের মনে রাখতে হবে। কোরআনের অন্যান্য তাফসীরগুলোও প্রবীণ ধারাগুলোর উপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। জ্ঞানের বিভিন্ন ধারার বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডারগুলোও ইসলামের বিভিন্ন ধর্মতাত্ত্বিক ও শরয়ী চিন্তার ধারা সুন্নি, শিয়া, মুতাজিলা, আশয়ারী, সূফি, হাম্বলিসহ এমনকি ইবনে তাইমিয়্যাসহ আরো অন্যান্যদের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। কেবলমাত্র মডার্ন ওয়াহাবিবাদ ছাড়া। কারণ এরা ইসলামী শিক্ষার এই সিলসিলাগত দিকটার প্রতি পুরোপুরি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে। তারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- এর সত্যতাকে গুরুত্ব দিয়েছে কিন্তু এর উপস্থিতিকে নয়। আর তাই মক্কা খুব দ্রুত ম্যানহাটনে পরিণত হওয়া থেকে কোনোভাবে বেঁচে আছে। ইসলামী স্থাপত্যকে তারা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করেছে কারণ ইসলামের সাথে এ বিষয়টা তাদের অযৌক্তিক বলে মনে হয়েছে। তারা তো ইসলামী চিন্তার মূলধারার কোনো অংশও কোনোদিন ছিলো না। এখানে যদি কোনো ওয়াহাবি থেকে থাকেন, তারা আমাকে মাফ করবেন কিন্তু আমি ব্যপারটাকে এভাবে দেখে থাকি এবং বিনয়ী হওয়ার মতো সময় জীবনে আসলে আর নেই।
তবে ইসলামের মূল চিন্তাগত ধারাগুলোর ঐতিহ্য ছিলো বেশ বৈচিত্র্যময়। সেখানে ছিলেন ইবনে সিনা থেকে আল-গাজ্জালী, যিনি ইবনে সিনার বিরোধী ছিলেন; ইবনে আরাবি থেকে ফখরুদ্দিন রাজী, যারা একে অপরের বিপক্ষে লিখেছেন, এমনই আরো অনেকে। ইসলামী বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান চিন্তাগত ধারাগুলো ওতপ্রোতভাবে প্রকৃতির দর্শন বা প্রকৃতির ধর্মতত্ত্বে পরিপূর্ণ ছিলো এবং এসব কিছু দাঁড়িয়ে ছিলো কোরআনের উপর ভিত্তি করে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর উপর ভিত্তি করে। তাই সেসকল ধারার উন্নত একটি মূল্যবোধ ছিলো। এর কিছু লিখিত হয়েছে স্মরণীয় বিজ্ঞানীদের দ্বারা। এইমাত্র আমি ফখরুদ্দিন রাজীর কথা বলেছি, যিনি একজন মহান সুন্নি ধর্মতাত্ত্বিক, সেইসাথে খ্যাতনামা চিকিৎসক, স্মরণীয় বিজ্ঞানী। এছাড়া আরো অনেকে রয়েছেন যারা বিজ্ঞানী না হলেও চিন্তক, দার্শনিক; তাদের কাছাকাছি ছিলেন বিখ্যাত কবিরা।
প্রকৃতির প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার ক্ষেত্রে কিছু উৎকৃষ্ট উৎস হলো কবিতা। এক্ষেত্রে কবিতার মানের পাশাপাশি এর ক্ষমতা আমাদেরকে বাস্তবতাতে রেখেই সাধারণ চেতনার জগৎ থেকে সত্যের সাথে অন্য একটি জগতে নিয়ে যায়। আবার অনেক উপদেশমূলক কবিতাও রয়েছে। আমি কিছুক্ষণ আগে মসনভী থেকে একটি আবৃত্তি করলাম এরকম আরো আবৃত্তি করা যায় কিন্তু আমি আপনাদের যন্ত্রণা দিতে চাচ্ছি না। তবে এটিও সমসাময়িক ইসলামী ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন শিখা ও উদ্ভাবনের একটা সমৃদ্ধ উৎস।
এবার শরীয়ার কথায় আসি। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শরীয়া চরম গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রকৃতি দর্শনের ক্ষেত্রে এটি একমাত্র উৎস হতে পারে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে বেশ কিছু মুসলিম দেশ এদিকেই মনোযোগী হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মক্কা ও মদীনাজুড়ে রাসূল নিজে হেরেম বা সংরক্ষিত এলাকা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ধর্মীয় হেরেমর কথা বলছি না, কেবল যেখানে অমুসলিমরা প্রবেশ করতে পারবে না; বরং এটা একইসাথে এক প্রকার জাতীয় উদ্যানের মতো- যেখানে সৃষ্টিসমূহ সংরক্ষিত আছে। আপনি সেখানে তাদের শিকার করা, হত্যা করা, পুড়িয়ে ফেলা বা এরকম কাজ করতে পারবেন না। জাতীয় উদ্যানের এই ধারণাটা নবীজি এবং শরীয়ার শিক্ষা থেকে এসেছে। যেমন যুদ্ধের সময় হলেও গাছপালা পুড়িয়ে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। আপনি বাগান ধ্বংস করতে পারবেন না। তবে ফিলিস্তিনে সবকিছু অগ্রাহ্য করে, ইসলামী আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে এমনটা করা হয়েছে। এটা শিশু ও নারী হত্যার মতো একই সূত্রে গাঁথা। আপনার অবশ্যই কোনো জীবন ধ্বংস করা উচিত না। আপনাকে অবশ্যই পানি বিশুদ্ধ রাখতে হবে। কী অদ্ভুত ব্যপার এটা যে, পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা পানি দেখা যায় ইসলামী শহরগুলোতে।
এগুলো ইসলামী শিক্ষার ফল নয়। এগুলো শরীয়ার শিক্ষা অনুসরণ না করার এবং গ্রাম থেকে খুব দ্রুত মানুষের শহরের স্থানান্তরের ফল। তারা যখন বড় বড় শহরে আসে তখন সে শহরকে আর নিজের অনুভব করতে পারে না। আপনি ইরান বা কায়রোর গ্রামগুলোতে কখনো বাচ্চাদেরকে দেখবেন না যে তারা তাদের নিজ গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর গাছ থেকে একটা ডাল নিয়ে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে তেহরান বা কায়রোতে শহরের মেয়র দুটো গাছ লাগানোর দুই মিনিটের মধ্যে কিছু ছোট বাচ্চা এসে তার ডাল ধরে টানাটানি করতে থাকবে। এর কারণ হলো তাদের মাঝে একাত্মতার বোধ কাজ করে না। এটা একটা ভিন্ন আলাপ, সমাজবিজ্ঞানের আলাপ।
কিন্তু প্রবহমান পানিকে দূষিত করা ইসলামী আইনের পরিপন্থী। যখন সমাজের জন্য কেবল একটা পানির উৎস থাকে তখন সেটি করায়ত্ত করে রাখা ইসলামের আইনের পরিপন্থী। আপনার ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে আপনি মরুভূমির মাঝখানে একটি ব্যক্তিগত কূপ তৈরি করতে পারেন যেমনটা ইসলামের উত্থানের আগেও আরবরা করতো এবং পরবর্তীতেও তারা তা চলমান রেখেছে। কিন্তু শহরগুলো বড় এবং এখানে মানুষ পানি থেকে উপকৃত হয়। আপনি এখানে ব্যক্তিগত পানির কোম্পানি তৈরি করতে পারেন না। এমন কোনো কুয়া তৈরি করতে পারেন না যেখান থেকে মানুষ এসে পানি নিয়ে যাবে। এটা অনেক মুসলিম দেশে বিদ্যমান ইসলামী আইনের পরিপন্থী। ধরুন, কুয়া খনন করার তিন মাসের মাথায় এসে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন আমি এখানে কিছু আর্সেনিক ঢেলে দিবো যেহেতু এটা আমার কুয়া। আমি এখানে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি। এ ধরনের আজগুবি কারবার প্রতিহত করতেই এই বিষয়টি ইসলামী আইনের বিরুদ্ধ।
ইসলামী শিল্প ও শরীয়া হতে উদ্ভুত মূলনীতির আলোকেই কোনো স্থানের সুরক্ষা ও গোপনীয়তার প্রশ্ন থেকে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী নগর পরিকল্পনার উদ্ভব ঘটে। আপনি পরিবেশের বায়ু দূষণের দিকে তাকান। যদি একটা ছোটো রাস্তায় বা বড় সড়কে বায়ু দূষণের পরিমাণের দিকে তাকান, কেবল দুইবার বড় শ্বাস নিলেই আপনি বুঝতে পারবেন আমি কিসের কথা বলছি। শরীয়ার অনেক কিছুই বলার আছে কিন্তু শরীয়া নির্ণায়ক ফ্যাক্টর না। শরীয়া এসেছে আমাদের কাজের সীমারেখা তৈরি করে দেয়ার জন্য। ভালো কাজের জন্য, খারাপ কাজের জন্য, আল্লাহর বিধানসমূহের জন্য। তবে প্রাকৃতিক দুনিয়ার প্রতি শরীয়ার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা প্রজ্ঞা সাহিত্যের অন্তর্গত, আবশ্যিকভাবে এ থেকেই শতাব্দী ধরে প্রকৃতি দর্শনের উৎস ও প্রেরণা তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে, ইসলামী বিশ্ব বড় দুটি কঠিন অবস্থার সম্মুখীন। অবস্থাটা কঠিন হওয়ার কারণ বেশিরভাগ মুসলিম, মূলত মডার্নাইজড মুসলিমরা মন থেকে ভাবে যে পশ্চিম ও পশ্চিমা প্রযুক্তি সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। এটা কেবল ইসলামী বিশ্বের ক্ষেত্রেই নয়, এশিয়ার বাদবাকি সব জায়গার জন্যই সত্য। বর্তমান বিশ্বে মডার্নিজমের সবচেয়ে গোঁড়া সমর্থক হলো এই মডার্নাইজড প্রাচ্য।
আপনি যদি বেশিরভাগ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলেন, সেখানের অনেকেই সন্দিহান যে আসলে আধুনিক প্রযুক্তি পরিবেশ সমস্যার সমাধান করতে পারবে কিনা। তবে সরকার না, কারণ তারা এসকল প্রযুক্তির ভিত্তিতে ক্ষমতায় এসে থাকে। কিন্তু যেসব ব্যক্তি পড়াশোনা করে থাকেন, তারা জানেন যে কী চলছে। তাদের অধিকাংশই জানেন কেবলমাত্র প্রযুক্তির পরিবর্তন সমস্যার সমাধান করবে না। হয়তো আমাদের একটু সময় লাগতে পারে কিন্তু সমাধান নিহিত আছে জীবন যাপনের ভিন্ন পন্থায় এবং আমরা কে, পৃথিবীতে কীভাবে বসবাস করবো তা নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করায়। কিন্তু ইসলামী বিশ্বে আপনার দ্বৈত সমস্যা রয়েছে। আমি মনে করি পশ্চিমা প্রযুক্তিবিদরা নিজেরা জানে যে তারা কী করছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের ভুলের মাধ্যমে শহরগুলো দূষিত করে আর আমরা তাদের থেকে দেখে শিখি আর এখন আমাদের শহরগুলো পশ্চিমা শহরগুলো থেকে অনেক বেশি পরিমাণে দূষিত। কেননা এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের ব্যবহৃত পশ্চিমা প্রযুক্তিসমূহের আবর্জনায় পূর্ণ। অবশ্যই কায়রো লন্ডনের চেয়ে অনেক বেশি দূষিত, তেহরান ওয়াশিংটনের চেয়ে বেশি দূষিত। কিন্তু আপনি মনে করছেন যে কোনো না কোনোভাবে তারা এই সমস্যার সমাধান করে দিবে। কিন্তু তারা এসব সমস্যা সমাধান করবে না। আমাদেরকে এর সমাধান করতে হবে। তবে এটা এত সহজে সম্ভব নয়; কেননা পশ্চিমের উচ্ছিষ্টগুলো গ্রহণ করার ফলে এবং বাজারে যা আসছে তাই কেনার ফলে ইসলামী বিশ্ব মারাত্মক রকমের অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসবের জন্য মুসলিম নাগরিকরা খুব নগণ্যই প্রতিবাদ করতে পারে।
কিন্তু আমি এটা চাই না যে, আমরা পরিবেশ সংকট সমাধানের জন্য পশ্চিমের জন্য বসে থাকবো আর বলবো, ওহ! আমি একটা গাড়ি রপ্তানী করছি যেটা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন করবে না, বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। ইসলামী বিশ্বসহ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেরও একটা বড় সমস্যা হলো লেজুড়বৃত্তি। আমাদের মাঝে এখনো এই দৃশ্য বিদ্যমান যে চীনের সকল মানুষ রেফ্রিজারেটর চায়, সকলে নিজস্ব গাড়ি চালাতে চায়, ভারত যার জনসংখ্যা আড়াই বিলিয়ন, তারা সকলে লস এঞ্জেলসের মানুষদের মতো জীবন যাপন করতে চায়। এভাবে চললে পৃথিবীর কোনো কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না।
আমাদের নিজেদের কিছু করতে হবে। আবার আমাদের সমস্যা দ্বিগুণ। প্রথমত, আমাদের সংস্কার ও পুনর্গঠন দরকার সেইসাথে একটি সমসাময়িক ভাষা। যে ভাষায় শতাব্দী ধরে আমরা যে প্রকৃতি দর্শন নিয়ে বেঁচে ছিলাম সেটা। এই দর্শন কেবল প্রত্নতত্ত্ব বা সাদামাটা ইতিহাসজ্ঞান নয়; বরং বাস্তবতাকে তুলে ধরে। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন প্রচণ্ড বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা, জ্ঞান, ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা সম্পর্কে জানা এবং একইসাথে পশ্চিমে কী হচ্ছে তা জানা। আর দরকার এ বিষয়গুলো মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও বোধগম্য একটি ভাষায় তুলে ধরার মতো সৃজনশীল গুণ। এটা জেনেই আমাদের কাজ করতে হবে যে এটা এক কঠিন যুদ্ধ। ইসলামী বিশ্বের কোনো সরকারই বড় পরিসরে এসব কথা শুনতে চাইবে না। খণ্ড খণ্ড ভাবে এদিকে কিছু সেদিকে কিছু হয়তো হবে। কিন্তু কেউই শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করতে আগ্রহী না। ফলশ্রুতিতে স্কুলের শিশুরা যা পড়ে আর যা দেখে তার মাঝে বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করতে শুরু করে।
এক্ষেত্রে যেখানে পরিবেশ সংকট সবচেয়ে তীব্র ও বিশ্রীভাবে শুরু হয়েছিলো, সেখানে এই প্রভাবটা খুব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। আমি শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়া ইংল্যান্ডের গ্রামীণ উপত্যকার কথা বলছি না, যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী প্রযুক্তিগত সমাজ যেটি। আপনি এখানে দেখবেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিশুরা তাদের মা-বাবা থেকে ভিন্ন। জীবজন্তুর প্রতি, গাছপালার প্রতি, পানির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি ভিন্ন। অবশ্য অর্থনৈতিক চাপ, সামাজিক চাপের কারণে তাদের অনেকে আজ বা কাল ওয়াল স্ট্রীটের নেশায় ডুবতে বাধ্য হয়। তবে অনেকে সেটা করছে না আর স্পষ্টত এটা মানবতার জন্য একটি বড় আশা এই যে একটা পরিবর্তন আসছে। এটা আমেরিকান শিক্ষকদের ছোট একটা অংশের কাজের ফল। তারা শিশুদেরকে ছোটবেলা থেকে একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা দেয়ার চিন্তা করেছিলেন যা গত ৪০-৫০ বছর আগে কেউ করেনি। আর মানুষ বিদ্যালয়গুলোতে সেই অবস্থাতেই বড় হয়ে উঠেছে। তাই বলা যায়, এটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু আমাদের এটা শুরু করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যে কাজটা তা আরো বেশি কঠিন। আমরা প্রকৃতির দর্শন প্রতিষ্ঠা করলাম, ধর্মতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করলাম, বিশ্বদর্শন প্রতিষ্ঠা করলাম কিন্তু কীভাবে সেগুলো প্রয়োগ করবো? আমরা অন্ধ আদর্শবাদী হতে পারবো না। ব্যপারটা এমন হবে না যে হুট করে একজন সরকার আসবে আর সে উপর থেকে বসে এসব কিছু সম্পাদন করবে। আমি যেরকমটা বলছিলাম, আমার দেশ ইরানে ইসলামের নামে একটা বড় বিপ্লব হয়েছিলো। মানুষ ভেবেছিলো সবকিছুর উপর ইসলামী চিন্তাভাবনা কর্তৃত্ব করবে কিন্তু তা হয়নি। ক্ষমতার প্রয়োজনে কেবল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের উপর এর কর্তৃত্ব ছিলো। ক্ষমতা বলতে নির্বাচনী ও সামরিক ক্ষমতা উভয়ই। আগের চেয়ে ইরান এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত। প্রায় ত্রিশ বছর আগে ইরানের যে প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন যেটা একটা আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো, এখনো মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এটা।
আমি জানি ঠিক কী ঘটছে আর চেষ্টা করছি এই প্রকৌশলীদের মধ্যে কিছু অংশকে কেবল পশ্চিমের মডেলগুলোর দিকে চেয়ে থাকা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে কিছুটা মানবিকতা তৈরির। এক মাস আগেই আমি সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, প্রবীণ শিক্ষকের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। তিনি বলছিলেন, আজ পঁয়ত্রিশ বছর পর আপনার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমরা ইরানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাণকেন্দ্রে ফিলোসফি অফ ন্যাচার বা প্রকৃতি দর্শনের উপর পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করেছি। এখানে কেবল পশ্চিমা বিজ্ঞান দর্শন থেকে না; বরং ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠদান করানো হবে। কিন্তু এটা ব্যাপকতা পেতে আরো কত যে সময় লাগবে আমি জানি না তবে আমার জীবদ্দশায় নিশ্চিতভাবে না। যদিও এই দিকটাতে আমাদের একটা বিপ্লব সাধন হয়েছে তার মানে এই না যে হুট করেই প্রস্তাবিত পরিবেশ নীতিগুলো অনুসরণ করা হবে। উত্তর ইরানের সুন্দর বাগানগুলো সব হারিয়ে গেছে। অনেকসময় মানুষের লোভ প্রজ্ঞার উপর জয়ী হয়। এটা শুধু ওয়াল স্ট্রীটে না অন্যান্য জায়গায়ও হয়। এই শহরে (দোহা) কী হচ্ছে আমি জানি না। কিন্তু গোটা পৃথিবীজুড়ে আপনি এই অবস্থা দেখতে পাবেন। আমি অন্যান্য ইসলামী দেশগুলোর কথা বলবো না, আমার নিজের দেশের কথাই বলবো। এটা প্রয়োগ করা খুব কঠিন। কীভাবে আমরা এটা প্রয়োগ করবো তার উত্তর নিহিত আছে কোথায় আমরা সেটা প্রয়োগ করতে পারি তার উপর।
আমি মনে করি, এখন এর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। যেমন শক্তির ব্যবহার করে শহরের নকশা পরিবর্তন করা, বায়ু দূষণের দিক থেকে পরিবেশগতভাবে খুবই জরুরী। আমেরিকানদের তৈরিকৃত এবং আবিষ্কারকৃত গাড়ির উপর ভিত্তি উপরে গড়া ইমারতের পরিবর্তে ওয়াশিংটনের সব জায়গায় এখন মানুষ ভিত্তিক অনেক স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। গাড়ি কেন্দ্রিক শহর মডেলে গাড়িগুলো শহর চিরে চলতে থাকে আর শহরগুলোও গাড়ির জন্য তৈরি করা হয়, মানুষের জন্য নয়। সেখানে রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করার জন্য এ পার্কিং লট এবং রাস্তা দরকার, আর এসব ছাড়া বাদবাকি সব কিছু তৃতীয় বিবেচনায় চলে আসে। ইতোমধ্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি দুনিয়াব্যাপী এই মডেলের আলোকে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, সবচেয়ে বিশাল স্থাপনা- ঐতিহ্য, নগর পরিকল্পনা সমৃদ্ধ ইসলামী বিশ্বের এখানে কোনো আপত্তিই নেই।
আমাদের লক্ষাধিক জনসংখ্যার একটি বিশাল শহর ছিলো নিশাপুর। ইতিহাসে মধ্যযুগে লক্ষাধিক জনসংখ্যার প্রথম শহর এটি। এটি অনেক বড় নগরকেন্দ্র হিসেবে বিরাজমান ছিলো এবং সেখানে মানবিক সংযোগ ছিলো ব্যপকভাবে। যন্ত্রের ব্যবহার ছিলো কম। শহর নকশা ও স্থাপত্য এমন কিছু বিষয় যা না করার জন্য আমাদের কোনো অজুহাত দেখাতে পারি। আমার খুবই কষ্ট লাগে, যখন পারস্য উপসাগরের পাড়ে একটি ৮০ তলার দানবাকৃতির ভবন উঠতে দেখি। এই ভবনগুলো পরিচালনা করতে কী পরিমাণ শক্তি ব্যয় হয়! গ্রীষ্ম বা শীতে এসব ভবনের জানালাগুলো কখনো খোলা হয় না, তারপর স্বাভাবিক ঠান্ডা বা গরম বাইরে থেকে আনা হয়। আমি কোনো মন্তব্য করবো না, আপনারা বসে চিন্তা করুন পৃথিবীর জন্য এর অর্থ কী? আর এই প্রক্রিয়াই সাও পাউলো থেকে কেনোপ টাউন এবং এর মাঝে পৃথিবীর আর সকল শহরে শতবার হুবুহু নকল করা হচ্ছে। ইসলামী বিশ্বও এর ব্যতিক্রম না। কিন্তু আমরা সারা পৃথিবীর জন্য বসে থাকতে পারি না যে কবে তারা সমস্যাটা সমাধান করবে। আমাদের নিজেদেরকেই তা করতে হবে, সেটা আমাদের জন্য হোক বা তাদের জন্য। শহর পরিকল্পনা ও স্থাপনা নিয়ে কাজ করা এক্ষেত্রে একটি বড় কাজ হতে পারে।
কৃষিপ্রযুক্তিসহ অনেক মডার্ন প্রযুক্তি আছে, যার প্রয়োগ ধ্বংস ডেকে আনছে। এগুলো জমির ফসল কমিয়ে দিচ্ছে। গবেষণায় এসেছে এ প্রযুক্তিগুলোর ব্যবহার কোনো জিনিসকে খুব দ্রুতই ধ্বংস করে ফেলছে, কর্ষনীয় জমি নষ্ট করে ফেলছে, বিভিন্ন রকম গাছ ধ্বংস করে ফেলছে এবং আরো অনেক কিছু। কেনো আমরা আত্মহত্যা করবো? কেনো? তারচেয়ে শতাব্দী ধরে আমরা যা শিখেছি চলুন সেটা করি। অন্তত কৃষিতো আমাদের যুগ যুগ ধরে আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ ও সবচেয়ে বিস্তৃত পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞান। খুবই মজার ব্যপার হলো, ১৯৬০ এর দশকে আমরা ইরানী শহরগুলোর সেচ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য আমেরিকান বিশেষজ্ঞদের এনেছিলাম, তাদেরকে তো সবকিছুতেই বিশেষজ্ঞ মনে করা হয়ে থাকে। আমি সেসময় মাত্র ক্যামব্রিজ থেকে এসেছি, সেখানে আমার বন্ধুও ছিলো। তারা সবগুলো শহরে যায় এবং বলে, আমরা কোনোকিছুরই উন্নয়ন করতে পারবো না। ইসফাহান এবং ইয়াজদ এর মতো শহরগুলোর সেচ ব্যবস্থা নকশার দিক থেকে অনবদ্য বরং আপনারা যা করছেন তাই করতে থাকুন। তারা আসলেই সৎ ছিলো। অবশ্যই এই পরিবর্তন করার জন্য তারা বিশাল অংকের পারিশ্রমিক পেতো কিন্তু তারা সত্যটা বলার মতো পর্যাপ্ত সৎ ছিলো।
আমাদের এরকম আরো অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেমন হস্তশিল্প। কাতারের জনসংখ্যা যেমন অল্প, সব মুসলিম সমাজ সেরকম না। আমাদের এমন সমাজও আছে যার দশ শত, লক্ষ জনসংখ্যা আছে। আমরা অনেক হস্তশিল্প ফিরিয়ে আনতে পারি যা দূষণের দিক থেকে পরিবেশের উপর অনেক কম প্রভাব ফেলে। এরকম আরো অনেক কিছু করা যায়। শেষত, যেটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো সামনে যে প্রযুক্তিই আসে তাই গ্রহণ না করা, পরিণামের কথা চিন্তা করা। পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব ধরনের কিছু প্রযুক্তি তৈরি করা। ইরানের শ্রেষ্ঠ স্থপতিদের একজনকে আমি বছরের পর বছর ইসলামী স্থাপত্য সম্পর্কে শিখানোর পর সে একটা বিল্ডিং তৈরি করে যা পুরোপুরি এলুমিনিয়ামে ভর্তি! এটা কি! আমি তাকে জিজ্ঞেস করি তুমি এটা কেনো করেছো? সে এই কারণ সেই কারণ বলতে লাগলো। আমি তাকে উত্তর দিলাম এটা সাশ্রয়ীও না, কিছুই না, এটা স্রেফ ইগো বা অহম। সে তেমন কিছু বলতে পারছিলো না। কারণ সত্যিই এ বিষয়টি ওখানে বিদ্যমান। আমাদের আশেপাশে অনেক কিছুই আছে কিন্তু এর অন্ধ ব্যবহার আমরা করি আমাদের নিজেদের দুর্বলতার কারণে। অবশ্যই আমরা অর্থ উপার্জন করতে চাই। লোভ মানুষের স্বভাবের একটা অংশ। আমি বলছি না এই মূহুর্তেই লোভ দূর করে ফেলতে হবে। কিন্তু আমরা যে ব্যাপক বিলুপ্তি ও মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছি, যে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি যা আমরা কল্পনা করার দুঃসাহসও করিনি, এসময়ে এই সচেতনতা সবার আসলেই থাকতে হবে যে, হয় করো, না হয় মরো।
ইসলামী বিশ্বের জন্য আমি এই বলে শেষ করছি যে পরিবেশ সমস্যায়, পরিবেশের প্রতি ইসলামী দৃষ্টিকোণের পুনর্জাগরণ ছাড়া পরিবেশের কোনো সুরক্ষা দেয়া সম্ভব না। কেবল কিছু আইন তৈরি করলেই যে মানুষ তা অনুসরণ করবে এমন নয়। আমাদেরকে আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু আমরা সেটা করিনি আর তার ফল আমরা ইসলামী বিশ্বে দেখতেই পাচ্ছি, আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। আমি আমার ছোট বক্তব্যের শেষে আশা রাখছি এবং দোয়া করছি, যাই ঘটুক না কেনো, পারস্য উপসাগরের উপরভাগে অবস্থিত পৃথিবীর এই ছোট অংশে যেখানে আল্লাহ মাটির নিচে সবচেয়ে অসাধারণ বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি করে রেখেছেন, আমরা কুয়েতকে না জ্বালিয়ে, পারস্য উপসাগরে তেল না ফেলে; বরং সবাই একত্রিত হতে পারি এবং কীভাবে বেঁচে থাকা যায় ও বাঁচানো যায় তার একটি আদর্শ হিসেবে এই জায়গাটি সংরক্ষণ করার চেষ্টা করতে পারি, আর আমরা যদি বাঁচতে এবং বাঁচাতে না শিখি তাহলে একটা সময় আমাদের জন্য প্রাণের কোনো অস্তিত্বই থাকা সম্ভব না।
অনুবাদ: রাফিয়া জান্নাত।