গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ– ইসলামী ডেক্লারেশন পুনর্পাঠ
এক
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে, আমরা সম্পূর্ণ নতুন একটা সময়ে এসে হাজির হয়েছি। ইতিহাসকে কেন্দ্রে রেখে আলাপ করতে চাইলে, আমাদের জন্য এটা একটা নতুন স্বাধীনতা। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট রেজিম এমন একটা অবস্থা তৈরি করেছিলো, যার ফলে একটা নির্দিষ্ট রেজিমের পতন, পুরা দেশের জন্য একটা স্বাধীনতার মত অর্থ বহন করছে।
এখন, অভ্যুত্থানের পর এসে আমাদের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হলো, ভবিষ্যত কী? আমাদের কোন কোন জায়গাগুলোকে সমাধান করতে হবে? পাশাপাশি, ইসলামকে কেন্দ্র করে নতুন প্রস্তাবনা হাজির করার ক্ষেত্রে কী ধরণের আলাপ সামনে আসতে পারে?
এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত চারটা আলাপ আমরা দেখেছি-
- কিতালীপন্থী বয়ান। যেটা মূলত সমাজবাস্তবতা বিবর্জিত একটা আলাপ এই অর্থে যে, এর কোন নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নাই, নির্দিষ্ট ভাষা নাই, এবং সত্যিকারার্থে এই দেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাথে এর কোন যোগ নাই।
- কল্যাণরাষ্ট্র। আদতে যেটা ফেইল করেছে, এবং পশ্চিমারাই একে সমালোচনা করছে। এই মডেলের কার্যকরিতা নিয়ে পশ্চিমের তাত্ত্বিকদের সমালোচনা ও সন্দেহ, একইসাথে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোতে এর টিকে থাকার ব্যর্থতা এই মডেলকে মেয়াদোত্তীর্ণ করে ফেলেছে। যেমনঃ মিল্টন ফ্রেডম্যান এই তত্ত্বের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার সত্তরের দশকে The Fallacy of Welfare State শীর্ষক বক্তব্যে তিনি এই মডেলকে অকার্যকর বলেছেন। তার ভাষ্যে, পাশ্চাত্যে কল্যাণরাষ্ট্র টিকে আছে শুধুমাত্র শোষণের কারণে, নইলে এটা কখনোই টিকতে পারতো না। তবুও, ইউরেশিয়ার বিভিন্ন লিবারেল সেক্যুলার মুসলিম রাষ্ট্রগুলাকে অনেকে এক্ষেত্রে সমাধান মনে করছেন। যেটা আসলে লিবারেল সেক্যুলারিজম এবং কল্যাণরাষ্ট্রের মিশেল অনেকটা।
- খেলাফত। যার কোন নির্দিষ্ট ভাষ্য আসলে স্পষ্ট না। খেলাফতের মাধ্যমে কী বুঝানো হচ্ছে, বা এই জাতিরাষ্ট্রিক কাঠামোতে খেলাফতের প্রয়োগযোগ্যতা কোথায়, এটা নিয়েও কোন ক্লিয়ার আলাপ আমরা পাচ্ছিনা।
- জাতীয়তাবাদ। যদিও মুসলিম জাতীয়তাবাদকে কোন কাঠামোতে বাংলাদেশে হাজির করা হবে, তা আসলে পরিষ্কার না।
এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে, আমরা যদি ইসলামকে কেন্দ্রে রেখে, একটা জাতীয় সংহতির কথা চিন্তা করি, একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ময়দান তৈরি করতে চাই, এবং ইসলামের অনন্য জায়গাগুলোকে সকলের সামনে যৌক্তিক মাপকাঠিতে হাজির করতে চাই, জ্ঞানসম্রাট আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচের ‘ইসলামী ডেক্লারেশন’ আমাদের জন্য একটা ভালো সূত্র হতে পারে।
দুই
সমগ্র মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন সংকটে জর্জরিত পরিস্থিতিকে সামনে রেখে আলীয়া ৭০ এর দশকে ডেক্লারেশন রচনা করেছিলেন। আলীয়া উম্মতের বিভিন্ন প্রবণতা, ধারা-উপধারাগুলোকে বুঝার চেষ্টা করেছেন, এবং মূল্যায়ন করেছেন, যেটা একটা মুসলিমপ্রধান দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সাথে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এ কারণে আলীয়ার এই সামগ্রিক আলাপের জায়গাটার অনেককিছুই নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সহায় হতে পারে।
আলীয়ার আলাপের ধারাবাহিকতা যদি আমরা বোঝার চেষ্টা করি, প্রথমেই দেখবো, আলীয়ার দৃষ্টিতে একমাত্র সমাধান হচ্ছে ‘ইসলাম’।১ মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের মধ্যে যারাই ইসলামকে কেন্দ্র করে একটা সমাধান হাজির করতে চান, সবাই ই এ ব্যাপারটাই বলেন। তাইলে আলীয়ার বিশেষত্ব কী? বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি ইসলাম বলে কোন বিমূর্ত স্লোগান হাজির করতে চান না। তিনি ইসলামকে সমাধান হিসেবে বিশ্বাস করেন, এবং আধুনিকতা পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষিতে এর উপযোগিতার জায়গাগুলো তিনি সফলভাবেই নির্ণয় করতে পেরেছেন।
যদি আমরা আজাদীর আলাপে আসি, আলীয়ার দৃষ্টিতে আজাদী কী? আলীয়ার দৃষ্টিতে সত্যিকার স্বাধীনতা হচ্ছে আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা। আধ্যাত্মিকভাবে যদি কেউ স্বাধীন না হয়, তাহলে বাহ্যিকভাবে স্বাধীন হলেও সে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরাধীন। এজন্য কার্যকর স্বাধীনতা হলো যা আধ্যাত্মিক ও আদর্শিক আজাদীর মধ্য দিয়ে আসবে।
আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা বলতে আলীয়ার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের চিন্তাজগত, মনস্তত্ত্ব আর রূহের স্বাধীনতা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে যেই মাফিয়াতন্ত্রের মধ্যে আমাদের বসবাস করতে হয়েছে, সেটার ভিত্তিগত প্রকল্প কী? পাশ্চাত্যের সেক্যুলারিজম, কম্যুনিজম আর ভারতের উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদ। যদি, সরকার পরিবর্তন হওয়ার পরও, আমাদের মনোজগত এই আদর্শগুলা থেকে মুক্ত না হয়, তাহলে আমাদের সত্যিকার আজাদী বহুদূর, এবং যার আলামত হয়ে উঠবে স্বাধীনতাকে শুধুমাত্র পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীতে আটকে ফেলা, যা কীনা স্বাধীনতার প্রতীকী অংশমাত্র।২
তিন
এখন ইসলামকে কেন্দ্রে রেখে আলীয়ার প্রস্তাবনা কী? বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েই আমরা দেখছি, সংখ্যালঘু ইস্যু, নারী ইস্যু নতুনভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, বা শিক্ষিত এলিটশ্রেণির আশঙ্কা হচ্ছে, ইসলাম আসলে সবাইকে জোর করে বোরকা পড়াবে কীনা, বা হিন্দুদের কী জিযিয়া দেয়া লাগবে কীনা। এখন, প্রশ্ন হচ্ছে, এই প্রশ্নগুলা এখন এসে উঠছে কেন?
বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামপন্থীরা এ সমস্যাগুলাকে সত্যিকারার্থে মোকাবেলা করতে সক্ষম হননাই। নারী অধিকার নিয়ে কোন আলাপ উঠলেই ফেমিনিস্ট আখ্যা দিচ্ছে, আবার সংখ্যালঘু সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টা করছেন কিতালী ধারার ‘ওয়ালা ওয়াল বারা’র ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে। কিন্তু আজকের দুনিয়ায় এই ইস্যুগুলাতে ইসলামকে সামগ্রিক সমাধান আকারে কীভাবে হাজির করা যায়?
নারী ইস্যুতে আলীয়ার ভাষ্য হলো, একদল অশিক্ষিত, অবহেলিত ও অসুখী মায়ের পক্ষে, একটা যোগ্য প্রজন্ম তৈরি করা সম্ভব না।৩ আলীয়ার শব্দচয়ন এখানে খুবই জরুরি। এখানে একইসাথে তিনি নারীদের শিক্ষার অধিকার, তাদেরকে সমাজের কিনারায় ফেলে রাখার প্রতিবাদ, এবং তাদের মনস্তাত্ত্বিক সুখের জায়গাটা এড্রেস করেছেন। আলীয়ার ভাষ্য হলো, নারীদের অধিকার ক্ষুন্ন করার জন্য ইসলামকে রেফারেন্স হিসাবে হাজির করার কোন সুযোগ নেই।৪
আলীয়া ইসলামের বিবাহ আইন নিয়ে নতুনকরে ভাববার কথা বলেছেন, বহুবিবাহ সীমাবদ্ধ করার কথা বলেছেন, যা নতুন ভাবনার খোরাক হতে পারে।৫
এখানে আমাদের শেখার জায়গাটা কী? সেটা হচ্ছে, ইসলামকে এভাবে সামগ্রিক জায়গায় রেখে, নারী ইস্যুকে সমাধান করা গেলে, বাংলাদেশে এই আলাপ উঠতো না যে, নারীদেরকে পর্দার জন্য জবরদস্তি করা হবে কীনা, আর এই সুযোগে ইসলামোফোব সেক্যুলার গোষ্ঠী বাংলাদেশ পাকিস্তান কিংবা আফগান হয়ে যাচ্ছে, এই অপ্রাসঙ্গিক আলাপ তুলে ধরারো কোন সুযোগ পেতো না।
সংখ্যালঘু ইস্যুর ক্ষেত্রেও একই কথা। ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’র চরমপন্থী ব্যাখার দরুণ সামাজিক বাস্তবতা বিসর্জন দিয়ে, ভিন্নধর্মের মানুষদের সাথে স্বাভাবিক আচরণকেও কিছুক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে হাজির করা হয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে আশার জায়গাটা হচ্ছে, গণমানুষের চিন্তার জায়গাটা অনেক স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। তারা নির্বিবাদেই ভ্রাতৃত্বের জায়গা থেকে মিলেমিশে থেকেছেন, থাকছেন, যার অনন্য নজির এই বিপ্লবে আমরা দেখেছি। কিন্তু তাত্ত্বিক ময়দানে সংখ্যালঘু প্রশ্নের কোন ভারসাম্যপূর্ণ উত্তর আমরা হাজির করতে পারিনাই।
এক্ষেত্রে যদি আলীয়ার কথা হচ্ছে, এখানে মূল ভিত্তি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য। রাষ্ট্র হচ্ছে সেই একক প্লাটফর্ম যেখানে আমরা সকলেই একতাবদ্ধ হইতে পারি, তাহলে তার সকল অধিকার রাষ্ট্র সংরক্ষণ করবে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ইস্যুতে ইসলাম প্রশ্নের তাত্ত্বিক জায়গাটা যদি আমরা পষ্ট করতে পারতাম, তাইলে এই ভুল বোঝাবুঝির জায়গাটা অনেকটাই কমে যেত।
চার
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় একটা ভারসাম্যপূর্ণ জায়গা কী হতে পারে? ইসলামকে যদি আমরা কেন্দ্রে রাখি, তাহলে প্রশ্নটা হচ্ছে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যবস্থা কেমন হবে?
আলীয়ার দৃষ্টিতে ইসলামী ব্যবস্থা সকল বাস্তবতার বিচারে অন্তর্গতভাবে গণতান্ত্রিক চরিত্রসম্পন্ন। এবং এ ধরণের গণতন্ত্র তখনি সম্ভব, যখন সরকারের আরাধ্য কাজ আর জনগণের ইচ্ছা-অনুভূতি একইখাতে প্রবাহিত হবে।৬ এবং জনগণ এবং সরকার যাতে একইসাথে একটি সুনির্দিষ্ট ভিশন যা কীনা জাতিকে উন্নত ও সম্মানিত করবে, সেরকম অবস্থা তৈরিতে শিক্ষাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন।৭
আলীয়ার দৃষ্টিতে এই গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন এমন হবে যা সাধারণ মানুষের হৃদয়ের স্পন্দনের বাস্তব প্রতিফলন। এখানে আলীয়া জনতার এজেন্সিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তিনি এখানে নির্দিষ্ট ঘরানার বুদ্ধিজীবী আর পুঁজিপতিদেরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে রাজি নন। কেননা জনগণ এখানে গণতন্ত্রের মূলনীতি বা ঘোষণা নয়, বরং সত্যিকারের প্রতিফলন দেখতে চায়।৮
আলীয়া ধর্মীয় স্বাধীনতা ও বৈচিত্র্যকে অপরিহার্য গণ্য করেছেন ও বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি একক কোন ধারার হাতে ইসলাম ব্যাখ্যার কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতী নন, কেননা তা জন্ম দিবে আধ্যাত্মিক স্বৈরাচারের। অর্থাৎ, মানুষের বিবেকের স্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করে জোরপূর্বক আচরণ কিংবা চাপিয়ে দেয়ার ধারণাকে আলীয়া নাকচ করেছেন। এ কারণে, আমাদের (ইসলামপন্থীদের) পথ হবে মানুষকে লজিক্যালী কনভিন্স করার চেষ্টা করা, নির্বিচার ফতোয়া কিংবা চাপিয়ে দেয়া নয়, যা কীনা আধ্যাত্মিক সন্ত্রাসের জন্ম দিবে।৯
আলীয়া খোলাফায়ে রাশেদা ও ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজাতান্ত্রিক মূলনীতি হিসেবে তিনটি বিষয়কে হাইলাইট করেছেন, যা কীনা এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ববহ।
- নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান
- জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়
- সামাজিক বিষয়ের ক্ষেত্রে সামষ্টিক সমাধানের বাধ্যবাধকতা।১০
এক্ষেত্রে এটাও হয়ে উঠতে পারে সত্যিকার অন্তর্ভুক্তীমূলক অবস্থান, যা কীনা আমাদের দেশ ও জাতির জন্য একটা সামগ্রিক সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি, তার দৃষ্টিতে শিক্ষাব্যবস্থায় ভিনদেশী আধিপত্য থেকে মুক্ত না হয়ে, নিজদের দ্বীন ও সমাজের ভিত্তিতে নতুন কারিকুলাম রচনা করতে না পারলে, সেটা কখনোই স্থায়ী সমাধান হয়ে উঠবে না।
পাঁচ
সর্বশেষ, আলীয়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে পাকিস্তানকে মূল্যায়ন করেছেন। এখানের বিষয়গুলা আমাদেরও মাথায় রাখা জরুরি, কারণ বাংলাদেশকে একটি ন্যায়ভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আমরা যদি ইসলামকে কেন্দ্রে রেখে কোন মডেল হাজির করতে চাই, সেইম সমস্যাগুলোই আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।
আলীয়ার দৃষ্টিতে যে ভিশনকে সামনে রেখে পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো, দুটি কারণে সেই ভিশন তারা ধরে রাখতে পারেনি।
প্রথমত হচ্ছে– ঐক্য ও সাংগঠনিক মজবুতি না থাকা। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা নেয়ার জায়গাটা পষ্ট। ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময়, সকলের অভিন্ন লক্ষ্য ও অভিন্ন শত্রু থাকার জন্য ঐক্যের জায়গাটা শক্তিশালী ছিল, যেটা পাকিস্তান আন্দোলনের ক্ষেত্রেও একই। সে সময় মুসলমানেরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভিন্নভাবে লড়াই করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর সময়ে প্রত্যেকটা গ্রুপ নিজ নিজ স্বার্থের জন্য বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঐক্য ও সাংগঠিনক ভিত্তিটা জরুরি। নয়তো, প্রতিটি রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি, ধারা যদি আলাদা হয়ে আগের মত অপরায়নের রাজনীতি শুরু করে, তাহলে নতুন একটা স্বৈরাচার আসতে খুব বেশি সময় লাগবেনা।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ইসলামের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক তর্ক ও বাহ্যিকতাকে প্রাধান্য দেয়া। পাকিস্তান আন্দোলনেও একইভাবে শিক্ষাকে উপেক্ষা করে চোরের হাত কাটা আর বিয়ের বিধান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলীয়ার ভাষায় বলতে গেলে-
“তারা যখন চোরের হাত কাটতে হবে নাকি জেলে ঢুকাতে হবে এই তর্কে ব্যস্ত, তখন চুরির আরেক বিশেষ রূপ (দুর্নীতি) অভূতপূর্ব লুটতরাজ চালিয়ে রাষ্ট্রের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলো”।১১
বাংলাদেশেও আমরা একই চিত্র দেখতে পাচ্ছি। মৌলিক প্রশ্নে কথা না বলে, ইসলামের খুটিনাটি বিষয় নিয়ে নানামুখী অপ্রাসঙ্গিক তর্ক করা হচ্ছে যা কীনা মৌলিক জায়গাগুলোকে অন্তসারশূন্য করে দিতে পারে। কিতালী গ্রুপগুলোর চরমপন্থী বয়ান যার একটা সুস্পষ্ট উদাহরণ। অবশ্যই সকলেই গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করবেন, নিজস্ব মত প্রকাশ করবেন, কিন্তু অগ্রাধিকার না বুঝলে, বিপ্লোবোত্তর দেশ ও জাতি বিনির্মাণের ভাবনাকে প্রাধান্য না দিলে, এ বিভক্তির ভেতর দিয়েই পুনরায় স্বৈরাচারের পুনর্বাসন ঘটবে।
এজন্য আলীয়ার মতে পূর্বের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আমাদের করণীয়র জায়গাগুলো হলো-
১. ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে একটি সামগ্রিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা, যা কোনভাবেই পাশ্চাত্যের পকেট মুভমেন্ট হতে পারবেনা। এমন আন্দোলন, যা আখলাকী-চিন্তাগত-আদর্শিক সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত।
২. ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মর্মার্থ হলো, জীবনে ইসলামের শিক্ষা বাস্তবায়ন এবং সকল ক্ষেত্রে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা।
৩. ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মানুষের সমতা আর ভ্রাতৃত্বের স্লোগান নয়, বরং তাৎক্ষণিকভাবে এই মূলনীতি বাস্তবয়ানে উদ্যোগ নেয়া। সব ধরণের অজ্ঞতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করা। এ ব্যাপারে আপোষহীন থাকা।
যদি এ বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হয়, আলীয়া সতর্কবার্তা জানাচ্ছেন–
“এই কাজগুলো করতে ব্যর্থ হলে এ সংগ্রামের পতাকা চলে যাবে বক্তৃতাবাগীশ নেতা আর সমাজের ভুয়া ত্রাণকর্তাদের হাতে, এবং সে বিপ্লব তখন তাদের স্বার্থোদ্ধারের হাতিয়ারে পরিণত হবে।১২
যে আলামত আমরা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি।
ছয়
অভ্যুত্থানোত্তর পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে একটা বড় সুযোগ সত্যিকার একটি ন্যায়ভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের। এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ হিসেবে ইতিমধ্যেই ব্যর্থ।। তাদের ধার করা, কমিউনিজম কিংবা সেক্যুলারিজম বাংলাদেশে যেকোন সমাধান দিতে অপারগ প্রমাণিত হয়েছে ইতিমধ্যেই।
এজন্য, আমাদের সামনে ইসলামকে কেন্দ্রে রেখে একটি নতুন প্রস্তাবনা হাজির করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আমাদের নতুনভাবে ভাবনার জায়গাটা জরুরি। এবং ইসলামকে কেন্দ্রীয় অবস্থানে রেখে যুগোপযোগী কার্যকর সমাধান হাজিরের ক্ষেত্রে ইসলামী ডেক্লারেশন আমাদের জন্য যে একটা মূল্যবান উৎস হয়ে উঠতে পারে, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই।
হদিস
১. ইসলামী ডেক্লারেশন, আলীয়া ইজ্জেতবেগভিচ, অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন, মক্তব প্রকাশন, জুন’২২ পৃঃ ১৯-২০।
২. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৮-২৯। (এর মাধ্যমে কোনভাবেই জাতীয় সঙ্গীত বা পতাকার গুরুত্ব ক্ষুন্ন করা হচ্ছেনা। কিন্তু, সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জিত না হলে, এগুলো নিছক আত্মতৃপ্তির উপকরণ ছাড়া কিছুনা।)
৩. প্রাগুক্ত, পৃ-৬৪
৪. প্রাগুক্ত।
৫. প্রাগুক্ত, পৃ-৬৫
৬. প্রাগুক্ত, পৃ-৬১
৭. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৭-৫৯
৮. প্রাগুক্ত, পৃ-৬১
৯. প্রাগুক্ত, পৃ-৬০
১০. প্রাগুক্ত, পৃ-৫৬
১১. প্রাগুক্ত, পৃ-৮০
১২. প্রাগুক্ত, পৃ-৮১