আফ্রিকার ঐতিহাসিক চার্লস সেইফার্টের ভাষ্য মতে,
“নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতির জ্ঞান যে জাতির মাঝে নেই, সে জাতির অবস্থা শিকড়হীন গাছের সাথে তুলনীয়।”
এ কথার আলোকে বিশ্লেষণ করলে আমরা খেয়াল করি যে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগত ও চিন্তার ক্ষেত্রে নিজস্ব ইতিহাসের বয়ান, পতনের কারণ বিশ্লেষণ, বর্তমান অবস্থায় উপনীত হওয়ার কারণ পর্যালোচনা ও বর্তমান অবস্থায় উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় কার্যকারণগুলো নির্ণয় এবং ইতিহাস ও সংস্কৃতির বয়ানে বিকল্প প্রস্তাবনা প্রদানের বিষয়টি অনুপস্থিত। কোনো ঘরানাতেই এ বিষয়ে কোনো আলাপ কিংবা চিন্তা চর্চা নেই, যার ফলে বৃটিশ ব্রাহ্মণ্যবাদী ও তাদের আজ্ঞাবহ সেক্যুলার ঐতিহাসিকদের ইতিহাস বয়ান সর্বমহলে প্রভাবশালী। আমাদের চিন্তা, জ্ঞান, ভাবনাগুলো তাই আজ কেন্দ্র থেকে বিচ্যুত হয়ে পল্লবগ্রাহী! আজ আমাদের ৭০০ বছরের ইতিহাসের যোগসূত্রও গরহাজির!
উপমহাদেশে ইসলামী সভ্যতার পতন পরবর্তী সময়ের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত মুসলিম সমাজের ইতিহাসের বাঁক-প্রতিবাঁকগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম মুসলিম সমাজকে বিধ্বস্ত করে দেয়ার জন্য দুটি মৌলিক উদ্যোগ গ্রহণ করে।
প্রথমত, তারা ভাষা বদলে দেয়, যার ফলে চিন্তা জগত ও ভাবনা কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, তারা বিকল্প ইতিহাসের বয়ান তৈরি করে এবং সে আলোকে সাহিত্যিক, সমাজ চিন্তক, লেখকদের গড়ে তোলে, যার ফলে আমরা আমাদের ইতিহাস জানি না, নিজেদের ব্যক্তিত্বদের চিনি না, আমাদের সংগ্রামগুলোর সাথেই আমরা পরিচিত নই। আধুনিককালে সিনেমা, ডকুমেন্টারিও এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে কিংবা ওইসকল চিন্তা দিয়েই প্রভাবিত।
এ অবস্থায় আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের যোগসূত্র, আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিক বিবরণী আর বর্তমান অবস্থার সামগ্রিক বিশ্লেষণ সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।
মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী লেখক ও চিন্তক শ্রদ্ধেয় ফাহমিদ-উর-রহমান স্যার “বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালী” গ্রন্থে তাঁর নিজস্ব দীর্ঘ অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ ও চিন্তার বিশিষ্ট বয়ান তুলে ধরেছেন অসাধারণভাবে। বাংলা অঞ্চলের ঐতিহাসিক আত্মপরিচয়ের শিকড় সন্ধানে এটি যে একটি অসাধারণ প্রয়াস, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এটিকে গ্রন্থ না বলে দীর্ঘ নিবন্ধ বলাই সঙ্গত। বাংলা অঞ্চলের ইতিহাসগত সুলুক সন্ধান ও তার নিজস্ব সত্তার বয়ান তুলে আনতে শ্রদ্ধেয় ফাহমিদ-উর-রহমান ধারাবাহিকভাবে আলোকপাত করেছেন। একইসাথে তাঁর বয়ানে বাংলার বিকাশের পর্ব ও কালান্তর উঠে এসেছে নতুন চিন্তাভঙ্গিতে।
ইসলামী সভ্যতার পতন ও বৃটিশ শোষণ পরবর্তী সময়ের চিন্তাকালগুলো পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টি আমাদের নজরে আসে যে, হিন্দুত্ববাদী ঐতিহাসিগণ ও কলকাতাভিত্তিক সেক্যুলার/বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণের বয়ান অনেকটা এক সূত্রে গাঁথা। একইসাথে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বয়ানও যে হিন্দুত্ববাদের পরিমার্জিত সংস্করণ ও তার শিকড় যে এ সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার জমিনেই গ্রোথিত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকল্প বয়ান দাঁড় করাতে হলে যে ইসলামী সভ্যতার ইতিহাসভিত্তিক মূল্যবোধের আশ্রয় নিতে হবে, তাও আমাদের সামনে স্পষ্ট। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ফাহমিদ-উর-রহমান তাঁর লেখাতে মূলত মুসলিমদের ইতিহাসের পর্যালোচনামূলক আলাপ তুলে ধরে মুসলিম চিন্তা অঙ্গন থেকে একটি বিকল্প বয়ানের প্রস্তাবনা দিয়েছেন, যা গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
প্রথমত, তিনি বাংলা অঞ্চলের উৎপত্তি ও উত্থানের সময়কাল নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছেন। এ দেশের বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা যে চিরকালই একপাক্ষিক ও এককেন্দ্রিকভাবে তাদের লেখালেখি ও চিন্তা চর্চা করে গিয়েছেন এবং তা যে চিরকালই হিন্দুত্ববাদের ছত্রছায়ায় প্রশ্রয় পেয়েছে তা তিনি তুলে ধরেছেন। একইসাথে তারা বাংলার মুসলিমদেরকে বহিরাগত হিসেবে গণ্য করে কীভাবে বিকল্প ইতিহাস বয়ান নির্মাণ করতে চেয়েছেন, লেখক এ আলাপে সে বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন।
দ্বিতীয়ত, তিনি এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যে, একটি সুগঠিত আঞ্চলিক কাঠামো ও ভাষা হিসেবে বাংলার সত্যিকার বিকাশ মুসলিম আমলের আগে সংঘটিত হয়নি। হিন্দুত্ববাদী ও তাদের আজ্ঞাবহ সেক্যুলার ঐতিহাসিকগণ যদিও এ বিষয়ে যথেষ্টই মিথ্যাচার চালিয়ে ভিন্ন বয়ান তৈরি করেছেন, তবু বাস্তবতা হলো এ অঞ্চলের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে মুসলিম আমলের ইতিহাস, ইসলামী সভ্যতার ইতিহাস। এ কারণেই শ্রদ্ধেয় লেখকের ভাষায়, “বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিভূমি ও সূচনাকাল হিসেবে ধরতে হবে মধ্যযুগের স্বাধীন সুলতানদের সময়কালকে।”
তৃতীয়ত, তিনি বলেছেন, বাংলা অঞ্চলে সমাজতত্ত্ব, মনোগঠন ও সাহিত্যিক ভাবধারা এবং সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সূচনাও মুসলিম সালতানাতের সময়ে হয়েছিলো, কারণ এ অঞ্চলে নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ ও উত্থান মুসলিমদের হাতেই সুসম্পন্ন হয়েছিলো। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এনামুল হকদের মতো বিদগ্ধ পণ্ডিতেরা এ কথাই বলেছেন। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতাকে সুকুমার সেনের মতো পণ্ডিতরাও উৎরে যেতে পারেননি, ফলে তারা মুসলিম আমলকে বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ বললেও তা ইতিহাসের নিরিখে বাস্তব নয়, বরং তা সাম্প্রদায়িক ও একপেশে ইতিহাসভিত্তিক।
চতুর্থত, একালে সেক্যুলার ঐতিহাসিকদের দ্বারা তৈরিকৃত একটি প্রভাবশালী বয়ান হলো “বাঙালিত্ব ও ইসলাম পরস্পর দ্বন্দ্বমুখী”। শ্রদ্ধেয় লেখক এখানে যৌক্তিকভাবে এ বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং সম্পূরক হিসেবে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের ফলে তা কীভাবে মুসলিম সমাজে আত্মপরিচয় সংকটের সূচনা করেছে তা অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন। সেই সাথে প্রাসঙ্গিক হিসেবে বৃটিশদের ভাষার রাজনীতি, বাংলা ভাষার ইসলামী শেকড় বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া ও সংস্কৃতায়িত বাংলার মাধ্যমে লাল সাম্প্রদায়িক রাজনীতির খোলস নিয়েও তিনি অসাধারণ আলোচনা করেছেন।
সবশেষ বলা যায়, পুরো গ্রন্থের প্রতিটি প্রাসঙ্গিক স্থলেই লেখক পর্যালোচনামূলক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন যে, “আমাদের চিন্তাজগতে এ একপেশে বয়ান প্রভাবশালী হওয়ার কারণ কী?” একইসাথে ইতিহাসের পাতা উল্টে এর পেছনে সক্রিয় কার্যকারণগুলো তিনি বিশ্লেষণ করেছেন।
দুই শতাব্দীব্যাপী বৃটিশ শোষণ, ঔপনিবেশিক বাস্তবতা, পশ্চিমবঙ্গীয় চিন্তাঙ্গনের আধিপত্যবাদী এ বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে শ্রদ্ধেয় লেখক তাঁর “বঙ্গ বাঙ্গালা বাঙ্গালী”-তে বিকল্প বয়ানের প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছেন,
“বঙ্গ, বাঙ্গালা বাঙ্গালী” শব্দত্রয় উচ্চারণ করতে হলে ইসলাম, মুসলিম, মুসলমানী সমাজও সমভাবেই প্রাসঙ্গিক।”
বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস পাঠ করতে হলে ইসলামী সালতানাতের ইতিহাসকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠিত একপেশে বয়ানের বিপরীতে বিকল্প বয়ানের প্রস্তাবনা দেয়াটাই এ গ্রন্থের সফলতা। এ গ্রন্থের স্বার্থকতাও এখানেই।
অসাধারণ এ গ্রন্থের জন্য শ্রদ্ধেয় লেখক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। মক্তব প্রকাশনের আব্দুস সালাম ভাইকে এ অসাধারণ কাজের জন্য আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন।