বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে তার ধারাক্রম অনুসরণ করা যেমন কর্তব্য তেমনি বিভিন্ন কালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত নির্ণয় করাও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সাহিত্যের যুগ বিভাগ গুলো প্রধানত ঐতিহাসিক যুগ বিভাগকে অনুসরণ করে। ঐতিহাসিক যুগ বিভাগের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা থাকে, জীবন ব্যবস্থাপনার কথা থাকে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও থাকে। এ সমস্ত কিছুই সাহিত্যকে লালন করে এবং সাহিত্যের মৌল প্রকৃতি নির্ধারণ করে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মূল বিভাজন করা হয়েছে তিনটি- প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। প্রাচীন যুগের সূত্রপাত পাল রাজত্বের আরম্ভ থেকে এবং শেষ সেন রাজত্বের পতনকাল পর্যন্ত। এ সময় ছিল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত। এ কালের ধর্ম ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম। বৌদ্ধরা এদেশের মানুষ ছিলেন। তাদের ধর্মীয় চিন্তায় জাতি-বিভেদ ছিল না। বৌদ্ধদের শাসন এদেশে ছিল চারশত বছরের কিছু বেশি। হিন্দু সেনরা ছিলেন বহিরাগত। তারা এসেছিলেন কর্ণাটক থেকে। তারা ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং তারা এদেশে প্রকটভাবে জাতিভেদ প্রবর্তন করেন। বৌদ্ধ আমলে ভাষা ছিল পালি, প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ। অবশ্য কিছু বৌদ্ধ শাস্ত্র সংস্কৃতেও তখন লিখিত হয়েছিল। সেনদের সময়কার ভাষা ছিল সংস্কৃত এবং সেনরা যে সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সে সংস্কৃতি ছিল রাজন্যবর্গের সংস্কৃতি, সাধারণ মানুষের নয়। বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগটি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। মোটামুটি ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত। একালে প্রাচীন যুগের চিন্তাধারা, ধর্মীয় বোধ, শিল্প চিন্তা এবং সাহিত্য চিন্তার পরিবর্তন ঘটেছে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর আগমন কাল থেকে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের সূচনা আমরা ধরে নিয়ে থাকি।
এভাবে বাংলা সাহিত্য ধারার পটভূমিতে প্রথমে আমরা বৌদ্ধ প্রবৃত্তিকে পেয়েছি, পরে এসেছে হিন্দু সংস্কার এবং অবশেষে এসেছে ইসলামের বিশ্বাস। মধ্যযুগের সাহিত্য অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত। এর গতিপ্রকৃতিও বিচিত্র ধরনের। এই বিরাট যুগের মধ্যে বহু বিচিত্র ধর্মবিশ্বাস কাজ করেছে। ইসলাম তো ছিলই, হিন্দু ধর্মের মধ্যে শক্ত মতবাদ, বৈষ্ণব মতবাদ এগুলো গড়ে উঠে এবং এগুলোকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের গতিপ্রকৃতিও নির্মিত হতে থাকে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা মোঘল আমলের শাসন পাই, স্বাধীন নবাবী আমলের শাসন পাই এবং মোঘলদের অধিকার প্রতিষ্ঠাকেও দেখি।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূত্রপাত অষ্টাদশ শতকে এই অঞ্চলে ইংরেজদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। মোঘল আমলেই ভারতীয় উপমহাদেশে বিদেশী বণিকরা আসতে আরম্ভ করে। সপ্তদশ শতকে প্রধানত ইউরোপের অনেক জাতি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে আসতে থাকে। এভাবে পর্তুগীজরা এসেছে, ওলন্দাজরা এসেছিল, ইংরেজরা এসেছিল, দিনেমার ও জার্মানরাও এসেছে। আমাদের বাংলা ভূখণ্ডের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই যে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বাণিজ্যে নিজেদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় এ সমস্ত জাতির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা আরম্ভ হয়। এদেশের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে তখন দুর্বলতা ছিল। শাসন ব্যবস্থার সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ইংরেজরা এদেশে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। পলাশীতে সিরাজউদ্দৌলার পতন এদেশের ইতিহাসে দীর্ঘকালীন অতীত সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবন পদ্ধতির একটি পরিবর্তন সূচনা করল। সিরাজউদ্দৌলাকে যুদ্ধে হারিয়ে ক্লাইভ মীর জাফরকে নামে-মাত্র নবাব রেখে দেশের রাজস্ব আদায়ের ভার নিজেদের হাতে নিয়ে নেন। তখন মীর কাসিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে কয়েকবার সংঘর্ষে লিপ্ত হন। কিন্তু মীর কাসিম শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের সাথে পেরে উঠেননি। মীর কাসিমের পতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাসনভার নিজেদের হাতে গ্রহণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে ইংরেজদের লক্ষ্য ছিল এদেশকে শোষণ করা। এত বড় একটি ঐশ্বর্যশালী দেশ হাতে পেয়ে কোম্পানির লোকেরা অসম্ভব অর্থলোলুপ হয়ে উঠে এবং তাদের শোষণের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। নিন্দিত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এই শোষণেরই ফল। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র এর কিছুটা আভাস দিয়েছেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশের শাসনভার গ্রহণ করার পরেই এ দেশের রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের দিকে মন দেয়। ১৭৮৮ থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত রাজস্ব ব্যবস্থার যে সব সংস্কারের চেষ্টা হয় তার চরম পরিণতি দেখা যায় ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে। এতেও রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কারকদের শান্তি হয়নি। বাংলাদেশের মোট জমির তুলনায় সে আমলে নিষ্কর জমির পরিমাণও কম ছিল না; তার আয়ের পরিমাণও ছিল মোটা।
১৭৯৭ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস একটি আদেশনামা ঘোষণা করলেন যে, কোনো ব্যক্তি বিশেষের জন্য অথবা গোষ্ঠীর জন্য নিষ্কর কোনো জমি থাকবে না। এই নিষ্কর জমিতে সরকারের স্বাভাবিক স্বত্ব রয়েছে। এই স্বত্ব প্রতিষ্ঠার পর নিষ্কর জমিতেও করারোপিত হয়। অবশ্য অনেকদিন পর্যন্ত ইংরেজ শাসকরা এই কর আদায় করতে পারেননি। অবশেষে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে নানা ধরনের মিথ্যা মামলা মোকদ্দমা সাজিয়ে শেষ পর্যন্ত নিষ্কর জমিতে করারোপ সম্ভবপর হয়। এভাবে মুসলমানদের হাত থেকে নিষ্কর বা লাখেরাজ জমি ইংরেজদের হাতে চলে যায় এবং এসব জমির কর মুসলমানরা দিতে বাধ্য হয়। একমাত্র মুসলমানরাই এদেশে নিষ্কর জমি ভোগ করত। তার ফলে ক্ষতি হয় মুসলমানদেরই। মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়ল এবং শেষ পর্যন্ত জমির আয়ের সিংহভাগ থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল।
এ যাবৎ এ দেশের রাজভাষা ছিল ‘ফার্সি’। লর্ড বেন্টিংয়ের শাসনকালে লর্ড মেকলের সুপারিশক্রমে ফার্সির স্থানে রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হলো- ইংরেজি। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে এর ফল হলো সুদূরপ্রসারী। ভাষা ও সাহিত্যের দিক থেকে এ যে কত বড়ো বৈপ্লবিক ঘটনা তা সাহিত্যের ইতিহাসের যথাযথ আলোচনার সাহায্যেই বোঝা যাবে।
ইংরেজরা মুসলমানের হাত থেকে এ দেশের রাজশক্তি ছিনিয়ে নেয়। সেজন্য শতাব্দীকালেরও অধিক সময় ধরে মুসলমানেরা যেমন ইংরেজদের সুনজরে দেখতে পারেনি, ইংরেজরাও মুসলমানদের তেমনি দেখেছে সংশয় ও সন্দেহের চোখে। অথচ একথাও সত্য যে, কোন রাষ্ট্রশক্তি তা যত বড়ই হোক না কেন, শাসিত দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন ছাড়া দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে না। মুসলমানদের সঙ্গে ইংরেজদের যখন দ্বন্দ্ব-সংশয়ের সম্পর্ক বিরাজমান, তখন এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে হাত করার এবং তাদের চিত্ত জয় করার সাধনা চললো ইংরেজদের।
এদিকে মুসলমানেরা হারালো রাজশক্তি। তদুপরি এ দেশের শাসন-ব্যবস্থা হাতে পাওয়ার পরপরই এদেশে নিজেদের আসন দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত এবং হোমের (ইংল্যান্ডের) আর্থিক অবস্থা উন্নত করার জন্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা যে কয়টি বৈপ্লবিক সংস্কার সাধন করলো তার সব কয়টিই গেল মুসলমানদের স্বার্থের প্রতিকূলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন ও নিষ্কর জমির বাজেয়াপ্তির পর দেখা গেল জমির মালিক মুসলমানেরা হলো নিঃস্ব এবং প্রজা ও মুসলমান ভূম্যাধিকারীর মধ্যবর্তী তহশিলদার, নায়েব, মুহুরি ও গোমস্তা প্রমুখ হিন্দু কর্মচারী ইংরেজদের অনুগ্রহে অত্যন্ত অল্পকালের মধ্যে ভূস্বামী হয়ে উঠলো। এর উপরে রাষ্ট্রভাষা ফার্সি সরিয়ে তার স্থানে ইংরেজি গ্রহণ করায়, চাকরি নির্ভর অগণিত মুসলমানদের জীবিকার পথ বন্ধ হলো। বাংলাদেশের আর্থিক জীবনের প্রধান ভিত্তি জমি ও আনুষঙ্গিক অবলম্বন চাকরি, পর পর এ দুটো থেকেই বঞ্চিত হয়ে মুসলমানদের আর্থিক দুর্গতির আর অবধি রইলো না।
মুসলমান আমলে বাংলাদেশের রাজভাষা ছিল ফার্সি। একই সঙ্গে এটা ছিল সাংস্কৃতিক ভাষাও। কোর্টের কাজকর্ম, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সব কিছুই ফার্সিতে হতো। তাছাড়া হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেরই ফার্সির মাধ্যমে শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো। হিন্দুদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য অবশ্য টোল ছিল, যেমন মুসলমানদের আরবী শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা ছিল। ফার্সি ধর্মীয় ভাষা হিসাবে এদেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল না। তার ফলে পার্থিব জীবনে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে ফার্সির একটি ব্যাপক প্রসার ছিল। এক কথায় বলতে গেলে আমাদের জীবন ব্যবস্থার পরিপূর্ণতার জন্য ফার্সির প্রয়োজন ছিল। ইংরেজরা এটা বুঝতে পেরে ফার্সিকে পুরোপুরি এদেশ থেকে তুলে দেন এবং ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করেন। যারা চাকরিনির্ভর ছিল এবং যারা ইংরেজি জানত না ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হওয়ায় তাদের জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে এদেশের হিন্দুরা নিজেদেরকে ইংরেজদের আনুকূল্যে নিয়ে আসে যে কাজটা মুসলমানরা কখনোই করতে পারেনি। ক্ষমতার অধিকার ইংরেজদের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিমান হিন্দুরা বুঝতে পারে যে এখন থেকে ইংরেজি ভাষাকে পার্থিব জীবনের প্রয়োজনীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা তাদের কর্তব্য। তারা তাই ইংরেজীকে গ্রহণ করে। রাজা রামমোহনের মতো প্রাজ্ঞ মনীষী হিন্দুদের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে হিন্দুরা তার সাহায্যে বুঝতে পেরেছিল যে জীবনের কর্মক্ষেত্রে কোন পথ তাদের অবলম্বন করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে স্বীকার করে নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করার জন্য রাজা রামমোহন রায় হিন্দুদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, যথার্থভাবে বলতে গেলে সেসময় তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং উদার মননশীলতার এবং সংস্কার মুক্ততার যে পরিচয় রাজা রামমোহন রায় দিয়েছিলেন তার তুলনা হিন্দু সমাজে খুব বেশি নেই। এদেশে ইংরেজি ভাষা সহসা আসেনি। এ অঞ্চল শোষণের অন্যতম হাতিয়ার ছিল এই ভাষা। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের এদেশের রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য এবং দেশীয় ভাষা বাংলা শিক্ষা দেবার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এটি প্রেসিডেন্সি কলেজ। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে কিছু বাঙালি হিন্দু পণ্ডিত ইংরেজদের গভীর সংস্পর্শে আসেন। এরা বাংলা গদ্যের সূত্রপাত ঘটান। তারপর হিন্দু কলেজে বাঙালি হিন্দুরা পড়াশুনা করতে থাকেন এবং ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হন। এভাবে দেখা যাচ্ছে মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষায় এগিয়ে আসেনি এবং তার ফলে জীবনযুদ্ধে পরাজিত এবং প্রতারিত হয়েছে। হিন্দুরা প্রথম থেকেই ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলো। এ দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইংরেজদের কাঁচামাল বিলেতে রপ্তানি করে ইংল্যান্ডের ডান্ডি, বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার প্রভৃতি শহরগুলোর দ্রুত প্রসার এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি সাধিত হতে থাকে। যেমন ইংরেজদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হতে থাকে তেমনি হিন্দুদেরও হয়। নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী এদেশে সৃষ্টি হয় এবং অনেক হিন্দু গ্রাম ছেড়ে কলকাতা অভিমুখী হন। মুসলমানদের দুর্দশার আরেকটি কারণ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিবর্তন। মুর্শিদাবাদ ছিল নবাবী আমলে বাংলাদেশের রাজধানী এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র। কলকাতা যখন থেকে রাজধানী হলো তখন থেকে কলকাতাই নতুন সাংস্কৃতিক জীবনের ভিত্তি হলো। কলকাতার নতুন সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলমানরা স্থান করে নিতে পারল না। মুর্শিদাবাদে যেখানে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অধিকার ছিল পুরোপুরি, কলকাতায় সে অধিকার আর রইলো না। কলকাতায় মুসলমানদের সাংস্কৃতিক অধিকার হলো শূন্য। নতুন রাজনৈতিক এবং আর্থিক ব্যবস্থায় ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা করে হিন্দুরা যখন অগ্রসর হতে লাগল তখন মুসলমানগণ ইংরেজদের সঙ্গে অসহযোগিতা করে পুরোপুরি পিছিয়ে রইলো।
পলাশীর যুদ্ধের পরে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এ অসহযোগ বৃহত্তর বাংলার মীর কাসিমের এবং মহীশুরে হায়দার আলী ও টিপু সুলতানের হাতে হিংস্র সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। স্বাধীনতাকামী টিপু সুলতানের পরাজয়ের পর বাংলা তথা এ উপমহাদেশের মুসলমানেরা কিছুদিনের জন্য হতভম্ব ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ মানসিকতা থেকেই ধর্মের আকর্ষণ তাদের মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে। ধর্মকে যথাযথভাবে আঁকড়ে না ধরা এবং ধর্ম পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্যেই ভারতে তাদের এ দুর্গতি-এ ধারণা তদানীন্তন উপমহাদেশের মুসলমানের মনে দানা বাঁধতে থাকে।
উপমহাদেশের অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায়, আর্য বিজয়ের কাল থেকে শক, হুন ও গ্রীক প্রভৃতি যে সব জাতি উপমহাদেশের এসেছে, নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ তাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে। উপমহাদেশের ইতিহাসে বহিরাগত ইসলামই এ নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম। মুসলমানেরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে চিহ্নিত হয়ে রইলো, কিছুটা মিশ্রণ ঘটলেও পুরোপুরি হিন্দু ইতিহাস ও সংস্কৃতির মধ্যে তারা হারিয়ে গেল না। ইসলাম এ দেশের সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবনে নতুনত্ব নিয়ে এসেছিল। তবে ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মুসলমানের উপর প্রভাবও বিস্তার করেছিল।
বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামে ও মুসলিম সমাজে এ ধরনের হিন্দু প্রভাব মুসলিম আমল থেকেই অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছিল। মুসলমানদের হাত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা খসে গেলে শিক্ষা ও তবলিগের অব্যবস্থার ফলে তাদের মধ্যে এ অন্ধ মানসিকতা ও কুসংস্কার দ্রুত বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ কুসংস্কারপ্রীতি যে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল আল্লামা মুহম্মদ ইকবালের এ উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে:
Surely we have out-Hindued the Hindu himself: we are suffering from a double caste system, sectarianism and the social caste system. which we have either learned or inherited from the Hindus. This is one of the quiet ways in which the conquered nations revenge themselves of their conquerors. (Quoted from the Hindustan Review in census of India report, 1911, XIV, Punjab, pt. I.p. 165).
সমাজ ও জাতীয় জীবনে এহেন ‘অ-ইসলাম’ বা হিন্দু প্রভাব প্রশ্রয় পাওয়াকেই মুসলমানেরা তাদের সমস্ত ভাগ্যহীনতার কারণ বলে নির্দেশ করে। তাদের হৃত-গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে হযরত মুহম্মদ (সঃ) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের সর্ববিধ বিদায়াত ও শিরকমুক্ত আদিম ও অকৃত্রিম ইসলামের পুনঃপ্রবর্তনই যে তার একমাত্র উপায় এ বিশ্বাস থেকেই তখন বাংলার মুসলমানেরা তাদের ধর্ম সংস্কারের দিকে মন দেয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ফরায়েজী ও সর্বভারতীয় ওহাবী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে আবদুল ওহাব নজদি আরব-ভূমিতে হযরত মুহাম্মদ সঃ এর অকৃত্রিম আদর্শ ইসলামী সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য যে সংগ্রাম পরিচালিত করেন, তাই ইসলামের ইতিহাসে ওহাবী আন্দোলন নামে পরিচিত। আবদুল ওহাবের পর তার ছেলে মুহম্মদ এ আন্দোলন পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা ওহাবীদের হাতে আসে এবং ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে মক্কা তাদের হস্তগত হয়। উসমানীয়রা যুদ্ধ করে ওহাবীদের ক্ষমতাচ্যুত করে এবং মক্কা পুনর্দখল করে নেয়, কিন্তু ওহাবীদের ধর্ম সংস্কার তাতে থেমে যায়নি। তখনকার সময়ের প্রখ্যাত ধর্মভীরু সৈয়দ আহমদ, ফরায়েজী আন্দোলনের অগ্রপথিক হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং হাজী নাসির আলী (তিতুমীর) হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় ওহাবীদের সংস্পর্শে আসেন। দেশে প্রত্যাবর্তন করার পর ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের সংস্কার আন্দোলনে এরা প্রবল প্রত্যয়ে নেমে পড়েন।
বাংলা অঞ্চলে ফারায়েজী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি ফরিদপুর জেলার বন্দরখোলার অধিবাসী। তিনি অল্প বয়সে মক্কা যান এবং ১৮২৮ সালের দিকে পরিণত বয়সে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি খ্রিস্টান ইংরেজ শাসিত তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশকে ‘দারুল হারব’ মনে করতেন। দারুল হারবে মুসলমানদের ঈদ ও জুমার নামাজ সম্ভব নয়, শরীয়তুল্লাহ এ মতবাদ প্রচার করেন এবং হিন্দুদের দূর্গা পূজার মতো করে মুহররম পর্বানুষ্ঠানও তিনি ঘোর শরীয়ত বিরোধী মনে করেন; পীর পূজার বিরোধিতা করে ওস্তাদ ও শাস্ত্রীদের সম্পর্কের ভিত্তিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পীর মুরীদের সম্বন্ধ নিরূপণ করেন। শরীয়তুল্লার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে এ আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার পড়ে তাঁর ছেলে মুহম্মদ মোহসীন ওরফে দুদু মিয়ার ওপর। দুদু মিয়ার আমলে এ আন্দোলন মাত্র ধর্ম সংস্কারে নিঃশেষিত হয়নি, অবস্থাচক্রে এ অঞ্চলের হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে ব্যাপক আর্থিক সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করে। এ অঞ্চলের ফরিদপুর ও বরিশাল জেলাগুলোকে কয়েকটি আঞ্চলিক ভাগে ভাগ করে দুদু মিয়া তার প্রতিনিধি বা খলীফা নিযুক্ত করেন। এ অঞ্চলে তাঁর প্রভাব স্থায়ী হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চম দশক পর্যন্ত।
পূর্ববঙ্গের ফরায়েজীদের এ সংস্কার আন্দোলন কালে পশ্চিমবঙ্গেও ফারায়েজী আন্দোলন চলছিল অপ্রতিহত গতিতে। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা ও নদীয়া জেলাকে কেন্দ্র করে এ আন্দোলন চালাচ্ছিলেন নিসার আলী তিতুমীর। তিনি চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার লোক ছিলেন। ১৮২৭ সালের দিকে হজ্জ্ব করে ফিরে আসার পর বঙ্গীয় ইসলামের বিরুদ্ধবাদীদের সাথে তিনি এক রকম জেহাদ শুরু করেন। শরীয়তুল্লাহর মতো তিনিও পীর পূজার বিরোধী ছিলেন। হিন্দুর তুলনায় মুসলমানের স্বাতন্ত্র্য যেন বজায় থাকে সেজন্য মুসলমানদের দাড়ি রাখা এবং ইসলামের বিধিবিধান অবশ্য কর্তব্য বলে তিনি মনে করতেন।
এসব সংস্কার আন্দোলনে হাত দিয়ে তিতুমীরকে হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়। এ সংঘর্ষ ক্রমেই ব্যাপক আকার ধারণ করে। যে-সব মুসলমান তার মতামত বরদাশত করতে পারেনি তাদের সঙ্গেও তার মতানুসারীদের সংঘর্ষ হয়।
এ আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে, তিতুমীরকে স্থানীয় সরকারের কর্তৃত্ব অবহেলা করে নারিকেল বাড়িয়ায় একটা স্বাধীন সরকারের প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তদানীন্তন ইংরেজ সরকার এতে বিচলিত হয়ে ওঠে। বারাসাতের সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডার বিপ্লবী তিতুমীরকে দমন করতে গিয়ে তিতুমীরের হাতে বিপর্যস্ত হন। চব্বিশ পরগনা ও কৃষ্ণনগরের জেলা কর্তৃপক্ষ তিতুমীরকে দমন করতে ব্যর্থকাম হলে তাদের সহায়তার জন্যে কলকাতা থেকে একটা পদাতিক বাহিনীসহ আসেন মেজর স্কট। তিতুমীর বাঁশের কেল্লা তৈরি করে সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে ১৮৩১ সালের ২২শে নভেম্বর শাহাদত লাভ করেন। তার সঙ্গে শাহাদত প্রাপ্ত হন তার সঙ্গীদের পঞ্চাশজন। অবস্থাচক্রে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ফারায়েজীরা শাসন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলেও সে সংঘর্ষ ব্যাপক কোন রাজনৈতিক আন্দোলনপ্রসূত ছিল না। ধর্ম সংস্কারই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু ফরায়েজীদের এ আন্দোলনে বাঙালি মুসলমানের মনে সংগ্রামের নামে সেদিন যে প্রেরণা দেখা দিল তা-ই বাংলাদেশে সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের বৃহত্তর সর্বভারতীয় ওহাবী আন্দোলনের মানসক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে।
আদর্শবাদের দিক থেকে ফারায়েজীরা সরাসরি ওহাবীদের অন্তর্ভুক্ত না হলেও তাদেরই সমগোত্রী ফরায়েজী ও ওহাবীদের লক্ষ্য এক তা ধর্মসংস্কার এবং আদি ইসলামের পুনর্জাগরণ। তাদের মধ্যে যে পার্থক্যটুকু দেখা যায়, তা পদ্ধতির। ওহাবীরা লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্যে অন্তর এবং বাইরে জেহাদে বিশ্বাসী। জেহাদ যেমন একদিকে চিত্তশুদ্ধি ঘটায় অন্য দিকে সর্ববিধ সংগ্রামের জন্যে চিত্তকে করে রাখে সদাজাগ্রত। জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধের ব্যাপারে ওহাবীরা জীবনসর্বস্ব ত্যাগী এবং অনমনীয়। জীবনব্যাপী জেহাদ পরিচালনার প্রয়োজনবোধে তারা হিজরতেরও সমর্থক। জেহাদের প্রশ্নে ওহাবীদের একরকম অত্যাধুনিক ফরায়েজী বলতে হয়; নইলে ভারতীয় ইসলামে শিরক বিদায়াতের সংস্কার প্রশ্নে ফরায়েজী এবং ওহাবীরা একই মনোভাবাপন্ন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন দিল্লীর শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৭০২-৬০ খ্রিঃ)। যিনি ইমাম গাজ্জালীর মতো দার্শনিকতার ভিত্তিতে সামগ্রিকভাবে ইসলামের ব্যাখ্যা করতেন। শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দেহলভীর মত আদর্শ প্রচার করেন তার ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুল আজিজ। ইসলাম প্রতিষ্ঠার অন্তর্ভেদী জ্বালা অনুভব করেন শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ দেহলভী প্রশিষ্য বিখ্যাত ওহাবী নেতা সৈয়দ আহমদ। তিনি ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৪শে অক্টোবর তারিখে রায়বেরিলিতে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা অন্তর্জীবনের ধ্রুব বিশ্বাসের বাস্তব রূপায়ণে সৈয়দ আহম্মদ ছিলেন নিষ্করুণ এবং নির্মম। সৈয়দ আহমদের চিন্তার সঙ্গে একান্তভাবে মিশেছিল তার তীক্ষ্ণ বাস্তববুদ্ধি, জাগ্রত চিন্তাশীল মন, অসাধারণ কর্মক্ষমতা, অদম্য উদ্যম এবং অফুরন্ত সাহস।
পাঞ্জাব তখন শিখদের করায়ত্ত। পাঞ্জাবাধিপতি রণজিৎ সিং নামাজ পড়া, গরু জবেহ করা এবং প্রকাশ্যে আজান দেওয়া প্রভৃতি ধর্মাধিকার থেকে মুসলমানদের বঞ্চিত করেছিলেন। এ কারণে সৈয়দ আহমদ শিখদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন (১৮২৬- ২৭ খ্রিস্টাব্দে)। আবদুল আজিজের দুজন নিকট আত্মীয় ইসমাঈল এবং আবদুল হাই সৈয়দ আহমদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার চিন্তাধারা প্রচার এবং জেহাদে সহায়তা করেন। সৈয়দ আহমদ ভারতীয় উপমহাদেশ ও আফগানিস্তানে তার চিন্তাধারা প্রচারের জন্যে সফর করে বেড়ান। ভারত-আফগান মুসলমান সমাজে সেকালে তার নিষ্ঠা ও সততার জন্যে তাকে ইমাম রূপে আখ্যায়িত করা হয়। উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তিনি একটা স্বাধীন সরকারও গড়ে তোলেন এবং পাঞ্জাবের রণজিৎ সিং-এর সঙ্গে বহু যুদ্ধ করে ১৮৩১ সালের মে মাসে বালাকোটের যুদ্ধে তার ভক্ত শিষ্য ইসমাঈল এবং আরও অনেকের সঙ্গে শাহাদাত লাভ করেন।
সৈয়দ আহমদের জীবদ্দশায় ওহাবী আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী রূপ পরিগ্রহ করে নি। ইসলামের প্রতিষ্ঠা সৈয়দ আহমদের স্বপ্ন হলেও একই সঙ্গে শিখ এবং পরাক্রান্ত ইংরেজদের সঙ্গে তিনি সংঘর্ষে লিপ্ত হননি। এতে তার বাস্তব বুদ্ধিরই পরিচয় পাওয়া যায়। ইংরেজদের দ্বারা পাঞ্জাব বিজিত হওয়ার পরই সৈয়দ আহমদের অনুবর্তী ওহাবীরা ইংরেজের সঙ্গে কলহে অবতীর্ণ হয় এবং তাদের এ আন্দোলনের ব্রিটিশ বিরোধী রূপ সিপাহী বিদ্রোহের পরও বছর দশেক স্থায়ী হয়।
ওহাবী বিপ্লব যে কত সংঘবদ্ধ এবং দীর্ঘস্থায়ী হয় তার ইতিহাস বিস্ময়কর। এ বিপ্লবের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ‘সীতানা’, প্রচার এবং প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল। বিহারে ‘পাটনা’ আর বাংলাদেশে ছিল ধন জন সংগ্রহের প্রশস্ত ক্ষেত্র। ঢাকা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালী, নদীয়া, চব্বিশ পরগণা, পাবনা, বগুড়া এবং রাজশাহী-বাংলাদেশের এ জেলাগুলোই এত দীর্ঘকাল ধরে এ আন্দোলনে অপরিমেয় অর্থ সাহায্য করে ও হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক জুগিয়ে ব্রিটিশ বিরোধিতায় আদর্শ স্থাপন করেছে। বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগ যে কি তীব্র এবং বেগবান হয় ওহাবী আন্দোলনের ইতিহাস থেকে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে। উইলিয়াম হান্টার সাহেবের Our Indian Mussalmans, are they bound to owe allegiance to the Queen? গ্রন্থে (১১০ পৃষ্ঠায়) এর কৌতুকাবহ বিবরণ পাওয়া যায়:
“পূর্ববঙ্গের প্রায় প্রত্যেক জেলা থেকে ওহাবী প্রচারকেরা সাধারণত বিশ বছরের কম বয়সের শত শত সরলমতি যুবককে, অনেক সময়ে তাদের পিতামাতার অজ্ঞাতে, নিশ্চিতপ্রায় মৃত্যুর পথে সঁপে দিয়েছে। শত সহস্র কৃষক পরিবারে তারা দারিদ্র্য ও বেদনা প্রবেশ করিয়েছে, আর আশা ভরসাস্থল যুবকদের সম্বন্ধে পরিজনের অন্তরে একটা স্থায়ী দুর্ভাবনা এনে দিয়েছে। যে ওহাবী পিতার বিশেষ গুণবান অথবা বিশেষ ধর্মপ্রবণ পুত্র বিদ্যমান, তিনি জানেন না কোন সময়ে তাঁর পুত্র গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যাবে। এই ভাবে যে সব যুবককে উধাও করা হয়েছে তাদের অনেকেই ব্যাধি, অনাহার অথবা তরবারির আঘাতে বিনষ্ট হয়েছে।”
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম থেকে শিরক-বিদায়াত অপসারণ করে বিশুদ্ধ ইসলাম প্রতিষ্ঠা প্রথম দিকে এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু সময় ও অবস্থার পরিবর্তনে এ বিপ্লব এমনভাবে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপ নেয় যে, ওহাবীরাই ইংরেজদের সঙ্গে মরণপণ অসহযোগিতা করে। এরাই মুসলমানকে ইংরেজদের সাহচর্য বর্জন করতে প্রেরণা যুগিয়েছে, ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করিয়েছে, ইংরেজ নীলকরদের নীলচাষের দাদন নিতে দেয়নি, ওহাবী কৃষকরা ছলছুতোয় নীলকর জমিদারদের কাজ ফেলে সরে পড়েছে এবং হেলায় করেছে মৃত্যুকে আলিঙ্গন। এ বিপ্লবের ইতিহাস এখনও লিখিত হয় নি; কিন্তু এ কথা সত্য যে, বিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য আলোকপ্রাপ্ত লোকদের দ্বারা পরিচালিত ও উদ্বুদ্ধ অসহযোগ আন্দোলন এবং সন্ত্রাসবাদও যেন এর কাছে হার মেনে নেয়।
ওহাবীদের চরিত্রবল, ধর্মযুদ্ধের নামে জীবনপণ, সততা, শীতাতপ ও ক্ষুধাতৃষ্ণা জয় এবং বাংলাদেশ থেকে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত দীর্ঘ হাজার মাইলেরও অধিক ব্যবধান দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে অতিক্রম করা যে কি সাধনা ও আরাধনার পরিচয় বহন করে, ইতিহাসে তার নজীর শুধু বাংলার ওহাবীরাই। নিজের জাতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মকে বাঁচানোর জন্যে, দারুল হারবে দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে তাদের এ আত্মত্যাগ সত্যিই তুলনাহীন।
সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মিলিত হিন্দু ও মুসলমানের প্রথম গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন-কর্তৃপক্ষের কতকগুলো ভুলই এ বিদ্রোহকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। এ বিদ্রোহ ছিল সাময়িক, সেজন্য অল্পদিনের মধ্যে তা দমন করা সম্ভব হয়েছিল। এর পেছনে বহুদিনের পরিকল্পনা এবং দীর্ঘকালের কোন সাধনা ছিল না। সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে ওহাবী আন্দোলনের কোন যোগ না থাকলেও এ বিপ্লবে সৈয়দ আহমদের হাতেগড়া বহু মুজাহিদও যোগ দিয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহ শান্ত হবার পরেও শাসনকতৃপক্ষকে আরও বছর দশেক ওহাবীদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহে সতর্ক ও সচকিত হয়েই ইংরেজ সরকার ওহাবীদের ওপর খড়্গহস্ত হয় এবং ১৮৬৪-৬৫ সালের ‘ওহাবী বিচারে’ শেষবারের মতো ওহাবীদের দমন করে।
ওহাবীদের আবেগ ও আন্তরিকতা সমালোচনার অতীত; তবে অশিক্ষা এবং আবেগপ্রবণতার জন্যই যে তারা ইংরেজ শোষণের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন হয়ে অনিবার্য ঐতিহাসিক ঘটনাকে মেনে নিতে পারে নি, এও সত্য। মুসলমানদের দিক থেকে এ আন্দোলন ছিল প্রতিক্রিয়াশীল। রাজশক্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে কয়েক দশক ব্যবধানে বাংলার মুসলমানেরা হারিয়েছিলেন তাদের অর্থনৈতিক প্রাধান্য, সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছিলেন তাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রাধান্য; ফলে তাদের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে অন্ধ আবেগ ও অজ্ঞতা। এ আবেগের বশেই তারা ইংরেজদের সঙ্গে তীব্র বিরোধে লিপ্ত হয়েছিল। বাংলাদেশে দু-একটি পরিবার ছাড়া মোটামুটি সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে বাংলার মুসলমানেরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেনি। সিপাহী বিদ্রোহ এবং ওহাবী বিপ্লবের পরপরই উত্তর ভারতে স্যার সৈয়দ আহম্মদ ইংরেজদের প্রতি আপোষমূলক মনোভাব পোষণ করেন এবং মুসলমানদেরকে ইংরেজী শিক্ষায় উৎসাহিত করেন। স্যার সৈয়দের এ আন্দোলন ‘আলীগড় আন্দোলন’ নামে খ্যাতি লাভ করে এবং এর ফলেই আলীগড় অ্যাংলো মোহামেডান কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কলেজই বর্তমানে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশে স্যার সৈয়দের আলীগড় আন্দোলন এবং আলীগড় কলেজের প্রতিষ্ঠা উত্তরপশ্চিম ভারতের মুসলমানদের অগ্রগতির ইতিহাসে যেমন বিস্ময়কর তেমনি উল্লেখযোগ্য।
ইংরেজিতে সৈয়দ আমীর আলী এবং সালাহউদ্দীন খোদাবশের ইসলামী সংস্কৃতি ব্যাখ্যা, আর নবাব আবদুল লতিফের সহানুভূতি ও প্রেরণায় বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানদের কিছুটা আত্মস্থ হবার সুযোগ হলেও, সেকালে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদের মতো কোনো বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা একজন ও জন্মগ্রহণ করেননি। ইংরেজ ও মুসলমানের পারস্পরিক সংশয় ও সন্দেহের ভেতর দিয়ে শাসক ইংরেজ ও শাসিত মুসলমানদের মধ্যে ক্রমেই সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এ সুযোগে ভেদবুদ্ধির প্রবর্তক ইংরেজ হিন্দুকে করেছে কৃপা ও অনুগ্রহ বিতরণ। এ শতাব্দীর শুরুতেই হিন্দু সমাজ ক্ষণজন্মা ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা রামমোহনের মতো নেতা পেয়েছিল। নিজেদের সুবিধায় এবং রামমোহনের মতো নেতার বুদ্ধি- বিবেচনার সুযোগ নিয়ে হিন্দুরা ইংরেজদের সঙ্গে যে সহযোগিতার সূত্রপাত করে, ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পরেও সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী ধরেই সে সহযোগিতা ছিল সক্রিয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্যে হিন্দুরা যে আন্দোলন পরিচালনা করে তাতেই ইংরেজদের সঙ্গে হিন্দুদের প্রত্যক্ষ বিরোধিতার সূত্রপাত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদও হয়ে যায়; কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য সে সময় থেকে হিন্দুরা যে আন্দোলনের সূচনা করে, তা গান্ধীজীর অসহযোগ, খিলাফত আন্দোলন, বাংলার হিন্দু যুবকদের সন্ত্রাসবাদ এবং কংগ্রেসের আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত নানা ধারায় প্রবাহিত হয়ে এসেছে।
হিন্দুরা ইংরেজদের সঙ্গে যে সহযোগিতা আরম্ভ করেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে, মুসলমানেরা তা আরম্ভ করল দীর্ঘ এক শতাব্দী পর বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে (১৯০৬) মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে। নির্জীব মুসলমানদের প্রতি ইংরেজরা যে অবিচার করেছিল, ১৯০৯ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত পরপর কতকগুলো আইন প্রণয়ন করে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের মাধ্যমে তারা যখন তার কিছুটা প্রতিকার করতে উদ্যত হলো তখন থেকেই হিন্দুরা মুসলমানদের ভুল বুঝেছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যৎসামান্য ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের ফলে চাকুরিতে হিন্দুদের কিছু অসুবিধা হওয়ায় বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রেষারেষির ভাবও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু ও মুসলমানের চিন্তাধারা পদ্ধতি ও স্বাধীনতা সংগ্রাম বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত ও পরিচালিত হয়েছে। অবশেষে এ বিরোধিতার পরিণতিতেই ভারত বিভক্তি ঘটলো। ইংরেজরা ভারতীয় উপমহাদেশ জয় করে তাদের শাসনব্যবস্থা যেমন ধীরে ধীরে দৃঢ় করেছে তেমনি সে শাসন ব্যবস্থাকে দীর্ঘকাল অক্ষুণ্ন রাখার জন্যেও এ দেশে নানা ভাবে চালিয়েছে শোষণ, সাম্রাজ্যবাদ এবং cultural conquest বা সাংস্কৃতিক বিজয়ের অভিযান; প্রথমতঃ এদেশবাসীকে ইংরেজী ভাষা শিখিয়ে। দ্বিতীয়তঃ ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই ইংরেজী মিশনারিদের সাহায্যে এ দেশের লোককে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার প্রয়াসে। এদেশে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে। তারা যেমন ভাষাগত দিক দিয়ে আমাদের শোষণ করে তেমনি সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ও আমাদের ধ্বংস করে দেয়। সুফল ইংরেজদের এ সাংস্কৃতিক বিজয় এ দেশের লোকের জন্যে মোটেও সুখকর নয়।
এতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে, জীবনের মূল্যও হয়েছে নতুন করে নিরূপিত, আর হয়েছে বাংলার শিল্প-সাহিত্যের নবতম জন্ম। ধর্মের দিক থেকে কিছু সংখ্যক লোক খ্রিস্টান হয়নি তা নয়, কিন্তু এ উপমহাদেশের মাটিতে বিশেষ করে বাংলাদেশে খ্রিস্টধর্মকে রোধ করতে গিয়ে তাদেরকে নিজেদের সমাজ ও ধর্মের যে ভাবে সংস্কার করতে হয়েছে, তার স্থবিরত্বে যে ঝাঁকুনি দিতে হয়েছে, তা থেকেই হিন্দু ও মুসলিম বাংলায় জন্মলাভ করেছে। তার নবতর ধর্মবোধ এবং আপন ঐতিহ্য সচেতন সম্প্রদায়ের হাতে এ শতাব্দীর নতুন সাহিত্য। খ্রিস্টধর্মকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রামমোহনের প্রচেষ্টায় জন্মলাভ করেছে ব্রাহ্মধর্ম, রামকৃষ্ণ পরমহংসের হিন্দু ধর্মের নব ব্যাখ্যা এবং বিবেকানন্দের হিন্দু ধর্ম প্রচার। খ্রিস্টধর্মের আকর্ষণে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় ঊনিবংশ শতাব্দীতে যতটা মুগ্ধ হয়েছে এবং সাড়া দিয়েছে, মুসলমানেরা ততোটা দেয়নি। তার কারণ বাংলার ফারায়েজী ও ওহাবী আন্দোলনের ইতিহাসের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এ আন্দোলনের পরে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের মন হওয়ার প্রবল আকর্ষণ দেখা যায়। এ বিপদ থেকে বাংলার মুসলমানকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন মুন্সী মেহেরুল্লাহ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ কয় দশকে এবং বিংশ শতকের শুরুতে তিনিই ছিলেন মুসলিম বাংলার অন্যতম অগ্রপথিক। এ অল্পশিক্ষিত মহাপ্রাণ মানুষটি সেদিন বাংলার গ্রামে গ্রামে মুসলমানদের আত্মসচেতন করার জন্য বক্তৃতা ও সমাজসেবার যে প্রবল ঝড় বইয়ে ছিলেন তার যথাযথ মূল্য আজও নিরূপিত হয়নি। তার সান্নিধ্যে এসে সেদিনের পাদ্রী জমিরুদ্দীন ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মুনশী জমিরুদ্দীন নাম নিয়ে তার শিষ্যরূপে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। ত্যাগীপুরুষ বাগ্মীপ্রবর মুনশী মেহেরুল্লাহই মুসলমানদের জাতীয় চেতনামূলক, ইসলামের নিজস্ব ছাপ ও পরিচয় বহনকারী সাহিত্যসেবায় মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। মীর মোশারফ হোসেন মেহেরুল্লার কিছু পূর্ববর্তী হলেও তাঁরা সমসাময়িক কালের। সাহিত্যিক ও শিল্পীমানসিকতার দিক থেকে তিনি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিষয়বস্তু নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু মেহেরুল্লাহ প্রমুখ সংস্কারকের মানসিকতার মাপকাঠিতে ইসলামী সাহিত্য রচনা করেননি। তার জন্যে প্রয়োজন হয়েছিল কায়কোবাদ থেকে শুরু করে শেখ আবদুর রহিম, মুনশী রেয়াজুদ্দীন, মোজাম্মেল হক প্রমুখ মত সাহিত্যিকের। এরা ইসলামী সাহিত্যের যে ইঙ্গিত নির্মাণ করলেন তা ই এযুগের বাংলার মুসলমানের নিজস্ব সাহিত্য হিসাবে স্বতন্ত্র মত ও পথের দিগদর্শন হলো। ঊনবিংশ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের পটভূমিতে মুসলমানেরা মহৎ ও উন্নত সাহিত্য সৃষ্টি করেনি, তাদের পক্ষে তা সম্ভবও ছিল না। ওহাবী আন্দোলনের মানসিকতাবশত তারা তাদের দৃষ্টিকে করে রেখেছিল অতীতমুখী। মুসলমানদের অতীত এবং বাংলাদেশের কোনও ছাপই পাওয়া যায় না।
ইংরেজী জ্ঞানবর্জিত অর্ধশিক্ষিত কবিরা এ যুগে সারা শতাব্দীকাল ধরেই দোভাষী পুঁথি সাহিত্য রচনা করেছে। একদিকে ইংরেজ বিদ্বেষ এবং অন্যদিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা এ দুইয়ের মাঝখানে এ শতাব্দীতে রচিত পুঁথি সাহিত্য। যে ওহাব আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ ফল তার পরিচয় পাওয়া যায় এ সাহিত্যের রচয়িতাদের দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের মানসিকতা এবং তাদের ভাষা ব্যবহার থেকে। অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বেই এ সাহিত্যের সূত্রপাত হয় কিন্তু এক উনবিংশ শতাব্দীতে সারা বাংলাদেশ জুড়ে এ সাহিত্যের বিস্ময়কর ব্যাপকতা থেকে তখনকার দিনের বাঙালী মুসলমান সাধারণের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির অদ্ভুত পরিচয় পাওয়া যায়। সমগ্র দেশের মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগ স্থাপনের জন্য যেভাবে এ গণসাহিত্য রচিত হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোন দেশের সাহিত্যের ইতিহাসে তার নজীর বড় বেশি পাওয়া যায় না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভদ্র বাংলা সাহিত্যের বদৌলতে এ সাহিত্য অপাংক্তেয় হয়ে বটতলায় আশ্রয় নিলেও আজও বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে লেখা অসংখ্য পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায়। এ সাহিত্যে ধর্মশাস্ত্র, উপদেশ, ইতিহাস, জীবনী, কাব্য ও রোমান্টিক উপাখ্যান বিষয়ক বহু গ্রন্থই রচিত হয়েছে। পুঁথি লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গি অতীতাশ্রয়ী এবং আত্মকেন্দ্রিক। সম্ভবত দেশের রাজনৈতিক শক্তি হস্তান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বহির্জগতের ব্যাপার উপেক্ষা করে এতে আত্মতৃপ্তি এবং মিথ্যা সান্ত্বনা তারা পেয়েছিলো। এ উক্তির প্রচ্ছন্ন সমর্থন মিলবে এ সাহিত্যের ভাষা ব্যবহার থেকে। এতে প্রধানত আরবী-ফারসি শব্দই, এমন কি উর্দু সর্বনাম এবং ক্রিয়াপদও বাংলা হরফে ডান দিক থেকে বাংলার পোশাক পরিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন আছে উক্ত শতাব্দীর হিন্দু-সৃষ্ট সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা, অন্য দিকে তেমনি একটি কৃত্রিম ভাষাকে জগতের সামনে তুলে ধরে তৃপ্তি পাবার প্রয়াস। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, উনবিংশ শতাব্দী বলতে এক পুঁথি এবং মীর মোশারফ হোসেন ও কায়কোবাদের রচনা ছাড়া বাঙালি মুসলমানের পক্ষে তেমন উল্লেখযোগ্য কোন সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হয়নি।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে মীর মোশাররফ হোসেন ও কায়কোবাদ প্রমুখ মুসলমান সাহিত্যিক আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির পথ তৈরি করেছেন মাত্র। এদের পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দু’দশকে নিজেদের কৃষ্টি-সচেতন শেখ আব্দুর রহিম, পণ্ডিত রিয়াজুদ্দীন মাশহাদী এবং আরও যে কয়জন মুসলিম সাহিত্যিক জন্ম নিয়েছেন, বলতে গেলে একালে তারাই আমাদের সচেতন করে দিয়ে গেছেন। ইংরেজ এবং ইংরেজী ভাষার প্রতি শতাব্দী কালের বিরূপতায় আর তাদের সঙ্গে নানা সংঘর্ষে মুসলমানেরা হলো বিপর্যস্ত, কিন্তু ইংরেজী শিক্ষিত ও ইংরেজদের অনুগ্রহকামী হিন্দুদের মধ্যেই আধুনিক ইউরোপের মানবতাবাদে দীক্ষিত নব মানবতার বার্তাবাহী এমন কতকগুলো সৃষ্টিধর্মী মানুষের জন্ম হল, যারাই ইংরেজ সরকারের আবদান এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলনজাত সৃষ্টি ব্রিটিশ হিন্দুয়ানি বাংলা সাহিত্য। মীর মোশাররফ হোসেন এবং নজরুল ইসলামসহ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট, মানুষের চৈতন্য কল্পনার যা অপরূপ ব্যগ্রয় প্রকাশ তার সবটুকুই নিয়েই চেষ্টা করেছেন, ইহাই একমাত্র আশার দিক।।
দিগদর্শিকা-
১. Hunter, W. W.-Our Indian Mussalmans.
২. Malick. A. R.-British policy and Muslims in Bengal (1757–1856). Darca, 1961.
৩. কাজী আবদুল ওদুদ-শাশ্বত বঙ্গ (প্রথম সংস্করণ ১৩৫৮)