আমরা প্রায়ই প্রশ্ন করি যে, আমরা (বাংলা অঞ্চল) কোন বিশ্বজনীন শক্তি ছিলাম না, বড় কোন অঞ্চল শাসন করিনি; যুগের পর যুগ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বড় বড় গোষ্ঠীগুলো আমাদের শাসন করেছে, গত দুইশো বছর যাবত আমাদের কোন নেতৃত্বও গড়ে উঠেনি, এমনকি পূর্বে আদৌ কোন যোগ্য নেতৃত্ব ছিল কিনা সেটাও জানা নেই, তাহলে আমাদের দ্বারা কিভাবে সভ্যতার পুনর্জাগরণ সম্ভব? এমন অবস্থা থেকে আদৌ কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? আবার ইসলামী রাষ্ট্র বা সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করলেও তা কি টিকিয়ে রাখতে পারব?
আমরা সবাই জানি যে, বর্তমানে বিশ্বের প্রভাবশালী শক্তি বা বিশ্বব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তির অন্যতম উদাহরণ ইউরোপ। কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা কী? তারা আশা ও স্বপ্নের জায়গায় যে বিষয়টিকে শক্তিশালী বয়ান আকারে হাজির করেছে তা হল “ইউরোপীয় রেনেসাঁ”। রেনেসাঁ বলতে কী বোঝায়? রেনেসাঁ বলতে বোঝায় যা পূর্বে ছিল, আবার নতুন করে জাগ্রত হয়েছে; অর্থাৎ পুনর্জাগরণ হয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করা যাক-
- তাদের রেনেসাঁর প্রেক্ষাপট নিয়ে যদি প্রশ্ন করি, ১৮শ শতাব্দীর পূর্বে জার্মানিদের কী এমন ছিল যার উপর ভিত্তি করে তারা রেনেসাঁর সৃষ্টি করেছিল? ব্রিটিশদের ইতিহাসই-বা এমন কী ছিল? ১৭শ শতাব্দীর আগে তাদের এমন কী ছিল যেটার পুনর্জাগরণের কথা তারা বলছে!
১৭শ শতাব্দীর আগে ফ্রান্সের এমন কোন ইতিহাস বা সভ্যতা কি ছিল, যার কারণে তারা বিশ্বব্যাপী তাদের পুনর্জাগরণের দাবী করছে?
আদতে এমন কিছু তাদের ছিল না। তাহলে এ রেনেসাঁর দাবী কতটা যৌক্তিক? তাহলে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যায় যে এটা তাদের তৈরিকৃত বয়ান, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু সেটি তাহলে কিভাবে?
সেটিও তাদের দর্শন এবং চিন্তাগত ভিত্তির দিকে তাকালেই বুঝা যায়। তারা হাকীকতকে মানে না বা তাদের ভাষ্যমতে তারা নিজেরাই হাকীকত তৈরি করতে পারে, অতীতকে সৃষ্টি করতে পারে। আর সে আলোকেই তারা একটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ বানোয়াট ইতিহাসের সাথেই আজকের বিশ্ববাসী পরিচিত।
কেননা রেনেসাঁ বলার মতো তো তাদের নিজস্ব কিছুই ছিল না; বাস্তবিকভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে তারা মূলত গ্রীক সভ্যতার সাথে নিজেদের একীভূত করে একটি রেনেসাঁর কথা বলে আসছে।
উপরন্তু ১৬শ শতকের দিকে পাশ্চাত্য দর্শনের দার্শনিকগণ একটি বিষয় লক্ষ্য করেন– তৎকালীন ইতিহাসে ইউরোপের কোন ঠাঁই নেই, কেননা তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থায় আধুনিক যুগের শুরু ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে, অর্থাৎ রাসূলের (সাঃ) জন্মসাল থেকে। আর এ ব্যাপারটি পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের ব্যাপক পীড়া দিত। তাই তারা ইমানুয়েল কান্টের ‘Critique of Pure Reason’ এবং তার পূর্বের বিখ্যাত দার্শনিক দেকার্তের কার্তেসিয়ান তত্ত্বের আলোকে এক নতুন থিওরী দাঁড় করান (যদিও তাদের তত্ত্বগত অনেক পার্থক্য রয়েছে), তা হল ‘আমরা সময়ও সৃষ্টি করতে পারি, আমরা ইতিহাসও সৃষ্টি করতে পারি’। তাদের অনুসরণে পরবর্তী দার্শনিকরাও এ জাতীয় কথা-ই বলেছেন!
তারপর-ই ইতিহাস থেকে মুসলিমদের মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা ইতিহাস দর্শনকে নতুনভাবে দাঁড় করায়।
তারা ১৪ শতকের পর থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত ও ১৬শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত সময়ের নাম দেয় রেনেসাঁর যুগ ও এনলাইটেনমেন্টের যুগ। ১৪ শতক পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ এবং ১৮ শতকের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়কে আধুনিক যুগ হিসেবে নামকরণ করে।
জন্ম দেয় ‘ইউরোপীয় রেনেসাঁ’ শব্দের, যেখানে ব্রিটেন, জার্মানি বা ফ্রান্সের ছিল না কোন নিজস্ব ইতিহাস, সভ্যতা (এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইতালি এ দাবী করতে পারে, কারণ রোমান সভ্যতার সবকিছু ইতালিতে ছিল, সে অনুযায়ী তারা বলতে পারে ‘আমরা পুনর্জীবিত করবো’)।
গোটা পাশ্চাত্য চতুর্দশ, পঞ্চদশ এবং ষষ্ঠদশ শতাব্দীকে রেনেসাঁ পিরিয়ড হিসেবে দাবী করলেও অষ্টাদশ শতকের আগে মূলত রেনেসাঁ বলতে কিছু ছিল না। শেক্সপিয়ার, দেকার্তেরা যখন কাজ করেছেন, তারা কখনোই কি বলেছেন, “রেনেসাঁ করব”? কেনই-বা বলবেন! পূর্বে তো কিছু ছিল না! হাজারো রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল ইউরোপ। সভ্যতার নিকৃষ্ট রূপ ছিল তারা। ইতিহাস সাক্ষী, স্পেনের মুসলমানদের সালতানাত ও উসমানীদের বদৌলতে তারা সভ্যতার ছোঁয়া পেয়েছিল। শেক্সপিয়ার, দেকার্তেরা মূলত কাজ করে গিয়েছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন। পরবর্তীতে তাদের কাজের বদৌলতে বড় একটি পরিবর্তন এসেছিল ইউরোপে। সেই পরিবর্তনকেই ১৮ শতকের পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা বলতে শুরু করলেন রেনেসাঁ।
এর ধারাবাহিতায় ইমানুয়েল কান্টরা তাদের সেই কথার ব্যাপক প্রচলন করলো, “আমরা সময়ও সৃষ্টি করতে পারি, আমরা ইতিহাসও সৃষ্টি করতে পারি। তাই আমরা অতীতও সৃষ্টি করতে পারি, আমরা ভবিষ্যত সৃষ্টি করতে পারি।”
একই সাথে আরেকটি থিওরী তারা দাঁড় করালো, তা হল ‘হাকীকত’ তথা নিশ্চিত সত্য বলতে আসলেই কিছু আছে কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে তারা নতুন বয়ান দাঁড় করায়। তথা সত্যিকারার্থে হাকীকত বলতে কিছু নেই। আমাদের জ্ঞানের বাইরে হাকীকত বলে কিছু নেই। আমরা যতটুকু বুঝতে পারি, ধারণ করতে পারি সেটিই হাকীকত।’
তাদের উদাহরণগুলো ছিল এ ধরণের– আমি লিখছি, আপনারা পড়ছেন, আমি কিন্তু বাস্তবে নেই, তবে আপনি আমাকে বুঝতে পারছেন বা আপনার মাথায় বিষয়টা ধারণ করতে পারছেন, তাই আপনি আমাকেই বুঝতে পারছেন।
এ অনুযায়ী ততটুকুরই অস্তিত্ব আছে, যতটুকু আমরা ধারণ করতে পারি বা বুঝতে পারি। সুতরাং হাকীকত বলতে কিছুই নেই। আর যেখানে হাকীকতের মূল্য নেই, সুতরাং ইতিহাস সৃষ্টি করা যায়। [এই থিওরীর প্রভাব পাশ্চাত্যে এত বিস্তার লাভ করেছিল যে গীর্জার পোপরাও এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। তবে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা হাকীকতবিহীন চিন্তার দৌড়ের এক পর্যায়ে এসে খেই হারিয়ে ফেলেন। তাদেরই বিখ্যাত থিওরী ‘God is dead’ দাঁড় করালেও তারাই আবার বলেছিল, “গড/ঈশ্বর যদি নাও থাকে, তবু গড/ঈশ্বরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যেভাবেই হোক। নতুবা প্রয়োজনের আলোকে একটি গড/ঈশ্বর বানিয়ে নিতে হবে। এটি আমাদের ব্যবসার কাজে লাগবে (এখানে সাধারণ বাণিজ্য বুঝাচ্ছে না)। এর উপরে ভিত্তি করে বহু ফায়দা আনা যায়।” (এটা সম্ভবত ম্যাক্স ওয়েবারের কথা)
আর এভাবেই ‘আমরা অতীতও সৃষ্টি করতে পারি। আমরা ভবিষ্যতও সৃষ্টি করতে পারি’ বয়ানটি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হল। এ দার্শনিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই তারা মুসলমানদের ১২০০ বছরের ইতিহাসকে অস্বীকার করে! তারপরেই বয়ান আকারে হাজির করে কথিত ‘ইউরোপীয় রেনেসাঁ’-কে।
এবার যদি আমাদের ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করি,
- গোটা মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা হল ইসলামী সভ্যতা। মারওয়া-উন-নাহার থেকে শুরু করে আফগানিস্তান পর্যন্ত, ভারতীয় উপমহাদেশসহ এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে এ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এ ইসলামী সভ্যতার গর্বিত সন্তান আমরা।
কোন ভিত্তি, ইতিহাস, স্বর্ণালী সভ্যতা না থাকা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য কাল্পনিক রেনেসাঁ তৈরি করে নতুন ইউরোপ দাঁড় করিয়েছে; সে জায়গায় আমাদের আছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস, শক্তিশালী স্বর্ণালী সভ্যতা, একটি বিশাল সালতানাত, তাহলে আমরা কেন একীভূত হয়ে অতীত আঁকড়ে ধরে সভ্যতার পুনর্জাগরণ করতে পারছি না? কেন উল্টো হীনম্মন্যতা, হতাশার প্রশ্ন তুলছি? এটা কি আমাদের চিন্তাগত দৈন্যতা নয়?
অথচ আমাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল মুসলমানদের মধ্যে গ্রীক, জার্মানি, ফরাসি ইত্যাদি জাতিগত পার্থক্য নেই। কোন বিদ্বেষ, বৈষম্য নেই। আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণই আমাদের শিখিয়েছে আমরা এক জাতি, এক প্রাণ; আমরা মুসলিম উম্মাহ। এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। যেখানে আমাদের জাতি-গোত্র বিভেদ নেই, সেই পূর্বের বিশাল সালতানাত, সভ্যতার ইতিহাসকে একত্রিত করে গ্রহণ করতে এবং পুনর্জাগরণ ঘটাতে কেন আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগবো?
এজন্য প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান বলতেন, “আমাদের যে স্বর্ণালী ইতিহাস, সে ইতিহাস যদি ইউরোপের, বৃটিশ জায়োনিস্টদের থাকতো, তাহলে তারা আমাদেরকে কথাই বলতে দিতো না।” কিন্তু উল্টো আমরাই হীনম্মন্য হয়ে বসে আছি !
আবার আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হল নবীদের সংগ্রাম। তাদের রেখে যাওয়া সেই সভ্যতা, সিলসিলা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, আখলাককে ধারণ করে আমরা এখনো পথ চলছি। নবীদের সংগ্রাম ও রেখে যাওয়া সভ্যতা থেকে কি আমরা নিজেদের ইতিহাসকে গ্রহণ করতে পারি না?
এক্ষেত্রে যদি আমরা মিলিয়ে দেখি তবে বুঝতে পারবো– গ্রীক সভ্যতা, ইউরোপীয় সভ্যতা প্রভৃতি মূলত ফিরাউনী সভ্যতার অংশ। ফিরাউন, গ্রিকদের থেকে যদি ইউরোপ নিতে পারে, আমরা কেন নবীদের রেখে যাওয়া ন্যায়ভিত্তিক সভ্যতার মডেলকে গ্রহণ করতে হীনম্মন্য বোধ করবো?
- ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সালতানাতের পূর্বে একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল। সেই সভ্যতা গণিতের ধারণা দিয়েছে, দর্শনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, আরো অনেক ক্ষেত্রে তাদের পদচারণা ছিল। এক কথায় তারা ছিল সমৃদ্ধ। পরবর্তীতে সেই সমৃদ্ধতার জায়গা থেকে প্রতিটি বিষয়কে আরো বেশি উন্নত করেছে মুসলিম সালতানাত। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি, কৃষি, ধর্মীয় সম্প্রীতি, শিক্ষাব্যবস্থা– সব ক্ষেত্রেই অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল উপমহাদেশের মুসলিম সালতানাতগুলো। সেখান থেকে কি আমরা লাভবান হতে পারি না ? সেটাকে কি আমাদের সামনে বয়ান আকারে হাজির করতে পারি না ?
- কিন্তু আমরা সবচেয়ে বড় যে ভুলটি করি, নিজস্ব সমৃদ্ধ ইতিহাস বাদ দিয়ে বৃটিশ একাডেমিয়া, ওরিয়েন্টালিস্টদের তৈরি করা ইতিহাসের বয়ানকে সামনে রেখে সবকিছু পাঠ করি এবং বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই তা গ্রহণ করি। দ্বিতীয়ত, যতটুকু গ্রহণ করি, ততটুকুই আবার ভারতীয় সংস্কৃতি আর সভ্যতার অংশ হিসেবে গ্রহণ করি (যেটা মূলত একটা ব্রিটিশ-ব্রাক্ষ্মণ্যবাদীদের যৌথ প্রজেক্ট, উপমহাদের ইসলামী সভ্যতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে পুরোপরি সরিয়ে ফেলার জন্য)। কখনোই এটা ভাবি না যে, এই ভারতীয় সভ্যতার ভিত্তির অধিকাংশই গড়েছিল মুসলিম সালতানাত, যাকে আমরা গ্রহণ করতে পারছি না বা পর্যালোচনাও করছি না।
আমরা এ ভুল কেন করছি ? আমাদের পূর্ববর্তী ইতিহাস তো আমাদের এটা শেখায় না!
আব্বাসীয় খেলাফতের সময় যখন সারা দুনিয়ার বিভিন্ন সভ্যতার মৌলিক গ্রন্থ, জ্ঞানসমূহ অনুবাদ করা হচ্ছিল, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সারা দুনিয়ার জ্ঞানকে একত্রিত করা হচ্ছিল, তখন কিন্তু মুসলমানরা সবকিছু একদম ঢালাও ভাবে অনুবাদ করে ফেলেনি কিংবা সবকিছুকে গ্রহণও করেনি। তাহলে আমরা কেন চোখ বুঁজে বৃটিশ একাডেমীয়ার বয়ানকে মেনে নিচ্ছি?
এটাও সত্য যে, সেই সময় যদি মুসলমানরা অনুবাদ না করত, তবে আজকের গ্রীক, ইউরোপীয় সভ্যতার দার্শনিক, বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল, প্লেটোকে খুঁজেও পাওয়া যেত না। ইউরোপ পরবর্তীতে এরিস্টটল, প্লেটোকে গ্রহণ করেছে আরবী অনুবাদ থেকে, উসমানীয় ভাষার অনুবাদ থেকে।
অনুবাদ করা, জ্ঞানগুলো সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে মুসলমানরা জানতো কোনটা গ্রহণ করা দরকার আর কোনটা সংশোধন করা দরকার। যেগুলো গ্রহণ করা দরকার করেছে, যেগুলো সংশোধন করা দরকার করেছে। যেগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, সেগুলোকে নতুন রূপ দিয়ে সভ্যতাকে নতুনভাবে, নতুন দিকে জাগরিত করেছে। আর যেগুলো মানব সভ্যতার জন্য বিধ্বংসী, সেগুলোকে বাদ দিয়েছে।
তাহলে আমরা আমাদের ইতিহাস, অন্যান্য ইতিহাস, ওরিয়েন্টালিস্টদের ইতিহাস, ইউরোপীয় বয়ান, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বয়ানকে কেন সেভাবে পর্যালোচনা করতে পারছি না? কতটুকু গ্রহণ বা বাদ দেওয়া দরকার সেটা আমরা কেন বুঝতে পারছি না?
- ঠিক একইভাবে যদি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে লক্ষ্য করি তবে দেখবো, আহমেদ ছফা সাহেব তার ‘বাঙালী মুসলমানের মন’ বইটিতে লিখছেন এ অঞ্চলের মুসলমানদের আসলে কিছুই ছিল না, তারা হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনীর বিপরীতে পুঁথি লিখতো, উপন্যাস লিখতো; এখানে কোন জ্ঞানগত ভিত্তি, দার্শনিক ভিত্তি, শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ভিত্তি গড়ে উঠেনি।
তার এ কথা বর্তমানে বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠিত বয়ানে পরিণত হয়েছে বলা যায়।
এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। মুঘল সালতানাত ছিল অর্থনীতিতে সমৃদ্ধশালী, প্রতিরক্ষায় ছিল শক্তিশালী, এ সালতানাতের ছিল সুন্দর ধর্মীয় সম্প্রিতি, অসংখ্য প্রতিষ্ঠান, সুন্দর নগর ও যুগসেরা স্থাপনা। এ সবগুলোকেই আমরা বলতে পারি একটি রাষ্ট্রের ধোঁয়ার মতো, যে রাষ্ট্রের আগুন হল চিন্তার স্বাধীনতা, জ্ঞানগত ভিত্তি, সে রাষ্ট্রের জ্ঞানীরা আর যোগ্য নেতৃত্ব।
তাহলে এখানে কোন জ্ঞানগত ভিত্তি, দার্শনিক ভিত্তি, শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ভিত্তি গড়ে উঠেনি বলার মাধ্যমে সে আগুনকে অস্বীকার করা হল না?
আমরা যদি মানতিকের মূলনীতি অনুসারে এটাকে পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখবো কোথাও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আমরা বলছি এখানে কোন আগুন ছিল না। অর্থাৎ উপমহাদেশের সব ধোঁয়াগুলোকে আমরা স্বীকার করছি, কিন্তু বলছি উপমহাদেশে কোন আগুন কখনো জ্বলেনি। এ কেমন পর্যালোচনা? এটা আদালতপূর্ণ কোন চিন্তা হতে পারে না, ক্রিটিক্যাল থিংকিংয়ের পর্যায়েই পড়ে না। সুতরাং একে আমরা কেন গ্রহণ করবো?
ঠিক একইভাবে এ বিষয়কে যৌক্তিকভাবে না খণ্ডিয়ে আমরা যতগুলো জবাব দিয়েছি, তার সবগুলোই ছিল ডিফেন্সিভ, যা আমাদের আরো বেশি হীনম্মন্য করেছে।
- এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমরা আমাদের স্বর্ণালী অতীত জানি না। না জানার পেছনেও রয়েছে একটি বড় কারণ।
মানবতার ইতিহাসের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক জাতি বৃটিশরা প্রায় দুইশো বছরের আমাদের শাসন করেছে। তারা লক্ষ লক্ষ আলেমকে হত্যা করেছে, উপমহাদেশে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত শোষণ করে যাচ্ছে, আমাদের কৃষিকে ধ্বংস করেছে, দারসবাড়ি থেকে শুরু করে মুসলমানদের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোকে ধ্বংস করেছে, স্থাপনাগুলো ধ্বংস করেছে, যে অঞ্চল সরাসরি ধ্বংস করতে পারেনি, ফতোয়া দিয়ে সেগুলোকে মুসলমানদের হাতেই ধ্বংস করিয়েছে।
সুতরাং তারা আমাদের সঠিক ইতিহাসকে অক্ষত রাখবে বা আমাদের জ্ঞান ভাণ্ডারকে জীবিত রাখবে– এটি একটি অসম্ভব চিন্তা।
ব্রিটিশরা অন্যান্য খাতের সাথে সাথে আমাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গাগুলোকেও ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। শুধু ধ্বংস করেই তারা বসে থাকেনি, আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে বিকল্প সংস্কৃতি এনেছে, শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা এনেছে, একইভাবে আমাদের ইতিহাসের গ্রন্থগুলো থেকে শুরু করে ইতিহাসের সমস্ত বয়ান ধ্বংস করে নতুন ইতিহাসের বয়ান এবং গ্রন্থ সৃষ্টি করেছে।
অর্থাৎ ভিত্তি মানে আগুন অবশ্যই ছিল, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হতে পারে না। সমস্যা হল এই আগুনকে আমরা জানি না।
পরিতাপের বিষয় হল, উপমহাদেশের মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস তৈরীর ক্ষেত্রে, বয়ান তৈরীর ক্ষেত্রে স্বাধীন জ্ঞান চর্চা নেই, পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অভাবে আমাদের আত্মবিশ্বাস ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা আমরা কখনো ভেবে দেখেছি?
যোগ্য, প্রজ্ঞাবান নেতা যদি জাতির মধ্যে তৈরী না হয়, আত্মবিশ্বাসের জায়গাটাও তৈরী হবে না। ফলস্বরূপ বৃটিশ পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের বয়ানও তৈরী হয়নি।
উপরন্তু নানাবিধ ফেরকাবাজি, ব্রিটিশ ইসলাম বা বৃটিশ সালাফিজম (ইতিহাস, দর্শনকে বাদ দিয়ে মূল টেক্সট বা ইলমুন নস কে একমাত্র ইসলাম দাবী করে, দিনশেষে যা একটি ধর্মীয় বয়ান ছাড়া কিছুই না) জাতীয় নতুন বয়ান হাজির করা হয়েছে, যার দ্বারা গোটা জাতি এবং প্রত্যেকটি ধারা প্রভাবিত। এ অবস্থায় আমরা কিভাবে চিন্তা করি যে একটি বয়ান দিলে তা সকলেই গ্রহণ করবে?
আমাদের কোন একটি ধারা, পন্থা, কোন একটি আন্দোলন এখনো পর্যন্ত সামগ্রিক হতে পারেনি, বহুমুখী হতে পারেনি। তাই এ কথা ভাবা একেবারেই অসম্ভব যে আমাদের আত্মবিশ্বাস অটোমেটিক ফিরে আসবে।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল ইসলামী সভ্যতার যে শ্রেষ্ঠত্ব, ন্যায়ভিত্তিক শাসন, যে রাজনীতি– এসবের উপর আজ অবধি কোন গ্রন্থ, পিএইচডি, থিসিস, পর্যালোচনামূলক আলোচনা, কোন প্রস্তাবনা সৃষ্টি হয়নি। এসব না থাকার কারণে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব আর পাশ্চাত্যের অসারতা বুঝা কষ্টকর হয়ে পড়েছে, যার ফলে হীনম্মন্যতা আসাটা খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু আমরা যদি সেই সত্যিকার দৃষ্টিকোণ, হাকীকতে পৌঁছানোর মহান রাস্তা অর্থাৎ ইসলামী জ্ঞানদর্শনের যে মূল লক্ষ্য, সেই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হওয়ার জন্য স্বয়ং হাকীকতের দৃষ্টিকোণ থেকেই যদি এ বিষয়গুলোকে পর্যালোচনা করি, তাহলে অবশ্যই দেখতে পাব, পাশ্চাত্যের কয়েকজন দার্শনিক ও কবি ছাড়া আর কিছুই নেই।
অপরদিকে আমাদের (মুসলমানদের) আছে স্বতন্ত্র, শক্তিশালী দর্শন ‘ইসলামী দর্শন’, জ্ঞানভান্ডার। আমাদের রয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআন, পয়গম্বরগণ, রাসূল (সাঃ) এর মূলনীতিসমূহ ও ইলমুল ফিকহ। এর কোনটাই পাশ্চাত্যের নেই। অতএব আমাদের এ সবকিছুর সাথে পূর্বের সেই মহান ইসলামী সভ্যতার আলোকে নতুনভাবে জাগ্রত হওয়া, পুনর্জাগরণ ঘটানো, সে আলোকে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং শক্তিশালী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা অবশ্যই সম্ভব। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর যদি সন্দেহ জাগে, তবে এ ঘাটতি ইসলামী সভ্যতা বা ইতিহাসের নয়, এ ঘাটতি আমাদের জ্ঞানের।
একই সাথে ভুলে গেলে চলবে না, পাশ্চাত্য চায় মুসলমানদেরকে, অন্যান্য সভ্যতাকে একটি ইতিহাসবিহীন জাতিতে পরিণত করতে! আর এক্ষেত্রে তারা আফ্রিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশীয় মুসলমানদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে সফলও হয়েছে।
তাই আমরা যদি আমাদের জ্ঞান, চিন্তা ও পর্যালোচনার জায়গায় শক্তিশালী হই, তবে অবশ্যই সত্যকে খুঁজে পাব। আর এ সত্য হল ইসলামী সভ্যতার নিশ্চিত বিজয়, নতুন দুনিয়া গড়া ও ইসলামী সভ্যতার পুনর্জাগরণ অবশ্যই সম্ভব এবং এটা ততটাই সত্যি, যতটা সত্যি আগামীকালের সূর্যোদয়।
(বিঃদ্রঃ ছবিটি বাংলা সালতানাতের সর্বশেষ শিক্ষা ইন্সটিটিউট এর চিহ্ন। যাকে আমরা দারসবাড়ি মাদ্রাসা নামে জেনে থাকি। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত।)