সমাজ ব্যক্তি সমষ্টির বিমূর্ত ধারণামাত্র নহে। ব্যক্তি-দেহের ন্যায় সমাজেরও দেহ আছে এবং এই দেহ প্রাণবান। কোটি কোটি জীব-কোষ লইয়া ব্যক্তি-দেহ গঠিত। এই কোটি কোটি জীব-কোষ তাহাদের দ্বারাই গঠিত প্রাণবান ব্যক্তি-দেহের পৃথক সত্তার ধারণা করিতে পারে না। এইভাবে হাজার হাজার ব্যক্তি দ্বারা সমাজের পৃথক সত্তা কোন এক ব্যক্তি প্রত্যক্ষ করিতে পারে না। ব্যক্তির ন্যায় সমাজেরও জন্ম আছে, বৃদ্ধি আছে, ক্ষয় ও মৃত্যু আছে এবং সমাজ-দেহের জন্ম-মৃত্যু, ক্ষয় ও লয় ব্যক্তি-দেহের মতই জীব-বিজ্ঞানের নিয়মাধীন। জীব-বিজ্ঞানের যে সমস্ত নিয়ম বিশেষভাবে সমাজ-জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে, তাই সমাজ-বিজ্ঞান। সুতরাং সমাজ-জীবনের উত্থান ও পতনের প্রাকৃতিক রহস্যই সমাজ-বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়।

ব্যক্তি যতই ক্ষুদ্র হউক অথবা যতই বিরাট হউক না কেন, তার মৃত্যু অনিবার্য। সমাজ-দেহেরও এই একই কথা। পৃথিবীতে কোটি কোটি এমন মানুষ জন্মিয়াছে ও মরিয়াছে, যাহাদের ক্ষদ্র জীবনের সুখ ও দুঃখের কাহিনী কালের গভীরে বিলীন হইয়া গিয়াছে। এই জন্ম-মৃত্যুর কাল স্রোতে এমন মানুষও হাজার হাজার জন্মিয়াছেন ও মরিয়াছেন, যাহারা নিজ গুণ ও কর্মে মরিয়াও অমর হইয়াছেন। লক্ষ লক্ষ এমন সমাজও জন্মিয়াছে, যাহাদের স্মৃতি ইতিহাস বহন করে নাই; আবার শত শত এমন সমাজও জন্মিয়াছে ও মরিয়াছে, তাহাদের স্মৃতি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রহিয়াছে। মনীষী সক্রেটিস ও মহর্ষি কপিল মরিয়াছেন এবং তাঁহাদের গ্রীস ও আর্য-ভারতও মরিয়াছে; কিন্তু বিশ্ব-মানবের চিন্তা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভাণ্ডারে তাঁহাদের বিরাট অবদান তাঁহাদিগকে আজও বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। সক্রেটিস মরিয়াছেন এবং তাঁহাদের গ্রীসও মরিয়াছে বটে, কিন্তু তাঁহাদের জীবনাদর্শ ও জ্ঞান-বিজ্ঞান আজও দেশ-কাল নির্বিশেষে সত্যানুসন্ধানীদের দিশারী। সক্রেটিস ও তাঁহার গ্রীস আজ ইউরোপের একান্ত সম্পদ নহেন, আজ তাহারা সারা বিশ্বের আপনজন। কোন একটি জীবনাদর্শ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি যে ব্যক্তি বা সমাজকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ করে, সেই ব্যক্তি বা সমাজের মৃত্যু তাহার জীবনাদর্শের মৃত্যু নহে এবং এই মৃত্যুহীন জীবনাদর্শই তাহার বিরাটত্বের অনুপাতে তাহার প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তি ও সমাজকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে।

সমাজবিজ্ঞান পক্ষপাতিত্ব করে না কারণ, প্রাকৃতিক নিয়ম সমভাবে ক্ষুদ্র বিরাট সকলকে শাসন করিয়া থাকে; তাই জন্মমৃত্যুর এই প্রাকৃতিক নিয়মে হযরত মুহাম্মদ (সা) ইনতিকাল করিয়াছেন এবং তাঁহার প্রচারিত জীবনাদর্শে যে মুসলিম আরবসমাজ ইতিহাসপ্রসিদ্ধ হইয়াছে তাহারও মৃত্যু হইয়াছে এই মুসলিম আরব-সমাজের জন্ম হইয়াছিল মক্কায়, বৃদ্ধি ও প্রসার ঘটে মদীনায়, দামেস্কে হইয়াছিল ইহার ক্ষয় এবং বিখ্যাত আব্বাসী সাম্রাজ্যের রাজধানী বাগদাদে হয় ইহার অবসান। মুসলিম আরব- সমাজের এই মৃত্যুকে অনেকে হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা) প্রচারিত জীবনাদর্শ অর্থাৎ ইসলামের মৃত্যু বলিয়া ভুল করিয়া থাকেন।

সনাতন গ্রীকসমাজের মৃত্যু তাহার জীবনাদর্শের মৃত্যু নহে। ভারতের সনাতন আর্য সমাজের মৃত্যুও মানুষের মৃত্যু নহে। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জীবনাদর্শ মহাকালকে উপেক্ষা করিয়া যুগে যুগে বহু নতুন সমাজের সৃষ্টি করিবে সেই সমস্ত সমাজ যত বিরাট এবং মহান হোক না কেন, অতীতের শত শত মহাসমাজের ন্যায় তাহাদের প্রত্যেকেরই মৃত্যু হইবে কিন্তু সেই জীবনাদর্শ চিরকালই বিশ্বমানবের দিশারী থাকিবে

সমাজ-বিজ্ঞানের জনক ইবনে খালদুনের মতে সমাজ প্রাণশীল এবং সমাজ- সংহতিই সমাজের প্রাণ। যতদিন এই সমাজ বাঁচিয়া থাকে এবং সমাজ-সংহতি বিনষ্ট না হয়, ততদিন, সমাজ বাঁচিয়া থাকে এবং সমাজ-সংহতি বিনষ্ট হইলে সমাজের মৃত্যু ঘটে। তাঁহার মতে সমাজ-সংহতির সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের ইতিহাসই সমাজ-জীবনের জন্ম-মৃত্যুর ইতিহাস। ইবনে খালদুনের মতে সাধারণত সমাজের আয়ুষ্কাল ছয় পুরুষ প্রথম দুই পুরুষ জন্ম প্রতিষ্ঠার আর দ্বিতীয় দুই পুরুষ বৃদ্ধি প্রসারের যুগ এবং শেষ দুই পুরুষ সমাজজীবনের ক্ষয় লয়ের মূল ভারতের মুঘল সমাজ ইবনে খালদুনের এই অভিমতের এক অতি চমৎকার দৃষ্টান্ত। বাবর ও হুমায়ুন মুঘল সমাজের স্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা, আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে হয় ইহার বৃদ্ধি ও প্রসার এবং এই ইতিহাসবিখ্যাত ভারতীয় মুঘল সমাজের পতন হয় শাহজাহান ও আলমগীরের জীবনকালে। ব্যক্তির ন্যায় কোন কোন সমাজ-স্বল্পায়ু ও কোন কোন সমাজ দীর্ঘায়ু হয় এবং ব্যক্তির ন্যায় কোন কোন বলিষ্ঠ সমাজেরও আকস্মিক মৃত্যু ঘটে; সমাজ-দেহের আকস্মিক ও অপঘাত মৃত্যুর আধুনিক দৃষ্টান্ত হিটলারের ফ্যাসিবাদী জার্মান সমাজ।

ইবনে খালদুনের আর একটি মৌলিক তত্ত্ব এই যে, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে এবং বাস্তব সম্পদে প্রবল, কিন্তু সমাজ-সংহতিতে বলিষ্ঠ সমাজ তুলনাতীতভাবে সভ্যতা-সংস্কৃতি ও বাস্তব সম্পদে ধনী, কিন্তু সমাজ-সংহতিতে দুর্বল সমাজকে পরাভূত করিয়া থাকে। মহেঞ্জোদারো বা হরপ্পার মত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে যে, যে যুগে ভারতবিজয়ী আর্যসমাজ পশুপালক পর্যায়ে ছিল, সেই যুগে বিজিত অনার্য-ভারত সত্যতা, সংস্কৃতি, পার্থিব সম্পদ ও জনসংখ্যায় কল্পনাতীতভাবে ঐশ্বর্যবান ছিল; কিন্তু তাহাদের সমাজ-সংহতি ছিল সে যুগে অত্যন্ত দুর্বল। এই একই কারণে মুসলিম বেদুঈন আরবের নিকটে পরাভব স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিল সুসভ্য পারস্য ও পূর্ব রোমক সাম্রাজ্য। সমাজ-বিজ্ঞানের এই গূঢ় রহস্যকে ইংগিত করিয়া আল-কুরআন ঘোষণা করিয়াছেন যে, “আল্লাহর অনুমতিক্রমে বহুবার সংখ্যার দিক হইতে ক্ষুদ্র বাহিনী বড় বড় বাহিনীকে বিধ্বস্ত করিয়াছে।” তালুত ও জালুতের উপাখ্যানে আল-কুরআনের সূরা বাকারার মাঝে এই তত্ত্বের আলোচনা দেখিতে পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক শ্রেণী- সংগ্রাম সমাজের জরা ও মৃত্যুর কারণ হইতে পারে; কিন্তু ইহা সমাজের জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয় ও লয়ের নিয়ন্তা নহে।

কোন একটি সমাজের রূপান্তর নতুন সমাজের জন্ম নহে। ব্যক্তি জীবনে প্রতিমুহূর্তে যে পরিবর্তন ঘটে, সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনগুলো সাধারণ চোখে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে না। কিন্তু বহু অলক্ষিত পরিবর্তনের মধ্য দিয়াই ব্যক্তি-জীবনের কয়েকটি বিশেষ পরিবর্তন স্পষ্টভাবে দেখা দেয়। এই বিশেষ পরিবর্তনগুলো ব্যক্তি জীবনের এক একটি রূপান্তর। ইহারা একই ব্যক্তি হইতে উদ্ভূত-ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির জন্ম নহে। ব্যক্তি জীবনের এই রূপান্তরগুলো হইতেছে তাহার শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্য। নবজাত শিশুর সহিত ব্যক্তি-জীবনের এই রূপান্তরগুলোর যাহা প্রভেদ, নবজাত সমাজের সহিত সমাজ-জীবনের রূপান্তরগুলোর তাহাই প্রভেদ। সমাজের জন্মের নিয়ম জীবন- কোষের সংখ্যাবৃদ্ধির নিয়মের মত। একটি জীব-কোষের এক অংশ তাহার মূল দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আর একটি নতুন জীব-কোষের জন্ম দেয়। এইভাবে কোন একটি সমাজ-দেহ হইতে তাহারই এক অংশ যখন বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, তখন এই বচ্ছিন্ন অংশ এক নতুন সমাজ-জীবন লাভ করে। ইংরেজ সমাজ-দেহের যে অংশগুলো মূলদেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে, তাহাদের প্রত্যেকটি এক একটি নবজাত সমাজ। কিন্তু ইংলণ্ডীয় বর্তমান ধনতান্ত্রিক ইংরেজ সমাজ একটি নতুন সমাজ নহে। ইহা সামন্ততান্ত্রিক ইংরেজ সমাজ-জীবনের রূপান্তর। ব্যক্তি-দেহের ন্যায় সমাজ-দেহেরও জন্ম এবং রূপান্তরের কারণ এক নহে; সুতরাং সমাজ দেহের রূপান্তরের কারণগুলিকে। তাহার জন্মের কারণ মনে করিলে মারাত্মক ভুল করা হইবে। অতীত যুগে আর্যদিগের আদি বাসভূমি মধ্য এশিয়ায় যে আদি আর্য-সমাজ ছিল, তাহারই এক এক অংশ তাহার মূল দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে বাসা বাঁধিয়াছিল এবং এইভাবে প্রাচীন গ্রীক ও সনাতন আর্য-ভারত জন্মলাভ করে।

কোন একটি সমাজ-দেহের এক অংশ মূল দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইবার অর্থাৎ কোন এক নতুন সমাজ জন্মলাভ করিবার কোন নির্দিষ্ট কারণ নাই। নতুন সমাজদেহ সৃষ্টির মূলত তিনটি কারণ দেখিতে পাওয়া যায় একটি অর্থনৈতিক, দ্বিতীয়টি প্রাকৃতিক দুর্যোগ তৃতীয়টি আদর্শ জীবনমাত্রেরই কেবল জীবনধারনের জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্থানের প্রয়োজন। যে জীব যে পরিমাণ স্থান হইতে তাহার জীবনধারনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণাদি সংগ্রহ করিতে পারে, তাহাই সেই জীবের জীবনধারণের পরিমিত স্থান। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের সংগে সংগে তাহার জীবনধারণের স্থান পরিমাণে সংকুচিত হয় বটে, কিন্তু কোন এক নির্দিষ্ট কালে অন্যান্য জীবের মত তাহারও জীবনধারণের একটি নির্দিষ্ট স্থান-পরিমাণ থাকে। কোন একটি স্থানে যতগুলি মানুষ কোনক্রমে বাঁচিয়া থাকিতে পারে, সেই স্থানের জনসংখ্যা তাহা অপেক্ষা অধিক হইলে সেই স্থানে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে বরদাস্ত করিতে পারে না। ফলে অতিরিক্ত জনসংখ্যা মূল দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইতে বাধ্য হয়। এই বিচ্ছিন্ন অতিরিক্ত জনসংখ্যা বহির্জগতে স্থান করিয়া লইতে পারিলে নতুন সমাজের জন্ম হয়; আর বহির্জগতে স্থান না পাইলে ধ্বংস হইয়া যায়। সমাজ দুর্বল হইলে এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে ধ্বংস হয়; আর সমাজ বলিষ্ঠ হইলে ধ্বংস হয় যুদ্ধ- বিগ্রহে। ইহাই সমাজ-বিজ্ঞানের অমোঘ নিয়ম; এবং এই নিয়মেই কয়েক বৎসর পূর্বে দুর্বল বাংলাদেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যা দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে এবং বলিষ্ঠ জার্মানীর অতিরিক্ত জনসংখ্যা যুদ্ধ-বিগ্রহে ধ্বংস হইয়াছে। নতুন সমাজ সৃষ্টির ইহাই অর্থনৈতিক কারণ। অর্থনৈতিক শ্রেণীসংগ্রাম সমাজ-দেহের রূপান্তরের অর্থনৈতিক কারণ হইতে নতুন সমাজের জন্মের কারণ নহে।

ভূ-তত্ত্ববিদেরা বলেন, আবহমানকাল পৃথিবীর রূপ একই প্রকার নহে, যুগে যুগে ইহার রূপান্তর ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রধানত ভূমিকম্প, এই বিপর্যয়ের কারণ। বহু সমৃদ্ধশালী জনপদ নিশ্চিহ্ন হইয়াছে। বহু আকাশভেদী পর্বতে ভূতত্ত্ববিদেরা সামুদ্রিক জীব-জন্তুর কংকাল আবিষ্কার করিয়াছেন। আজ যেখানে পর্বত দেখা যাইতেছে, অতীতে কোন এক যুগে সেখানে ছিল সমুদ্রের অতল জলরাশি। এইভাবে আজ যাহা একটি পৃথক ভূখণ্ড, অতীতে কোন এক যুগে তাহা ছিল অপর কোন ভূখণ্ডের সহিত সংযুক্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে যখন এক সমাজের কোন এক অংশ তাহার মূল দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, তখন ঐ বিচ্ছিন্ন অংশ এক নতুন সমাজ-দেহ ও সমাজ-প্রাণ লাভ করে। ঐতিহাসিক যুগে এই প্রকার সমাজ সৃষ্টির দৃষ্টান্ত না পাওয়া গেলেও ভূ-তত্ত্ববিদ ও নৃ-তত্ত্ববিদগণের গবেষণা ও আবিষ্কার হইতে ইহা সংকোচে অনুমান করা যাইতে পারে।

নতুন সমাজ সৃষ্টির আর একটি কারণ হচ্ছে আদর্শ। জনসংখ্যাধিক্যের অর্থনৈতিক কারণে অথবা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কোন এক সমাজের এক অংশ মূল দেহ হইতে যেভাবে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, এইভাবে আদর্শ ও সমাজের এক অংশকে তাহার মূল দেহ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নতুন সমাজ সৃষ্টি করে। বেদুঈন আরবসমাজের এক অংশ হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা)-এর নেতৃত্বে ইসলামের জীবনাদর্শে উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত হইয়া উহার মূলদেহ বেদুঈন আরবসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে কয়েকজন সদস্যবিশিষ্ট আরবসমাজের এই বিচ্ছিন্ন অংশটাই অতীতের নবজাত ইসলামী সমাজশিশু অতীতে ভারতের বৌদ্ধ-সমাজ এইভাবে জন্মলাভ করিয়াছিল এবং এইভাবেই বর্তমান যুগে রাশিয়া ও চীনের মার্কসবাদী সমাজ জন্মলাভ করিয়াছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় অথবা অর্থনৈতিক কারণের মত আদর্শ জড়জাত কারণ নহে। যে আদর্শ একটি মহাসমাজ সৃষ্টি করে, সে আদর্শ ঐতিহাসিক অর্থাৎ মহাকালের কালোপযোগী সৃষ্টি হইলেও জড়-পরিবেশের ফল নহে। যে আদর্শ বিশ্ব-মানবের ইতিহাসের পরিবর্তন ঘটায়, সে আদর্শের উপকরণ ক্ষেত্রবিশেষে জড়জাত হইলেও তাহা বুদ্ধির অবদান নহে; উহা একান্তভাবে বোধির অবদান। জীবনের নিত্য পরিবর্তনশীল আদর্শ ও ন্যায়-নীতি-জ্ঞান জড়-পরিবেশের সৃষ্টি, একথা অনস্বীকার্য, কিন্তু যে আদর্শ যুগে যুগে মানুষের জড়-পরিবেশ ও তাহার সৃষ্ট আদর্শ ও ন্যায়-নীতির মহাপ্রলয় ঘটাইয়া অভিনব ও যুগান্তকারী পরিবেশ, চিন্তা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সৃষ্টি করে, সে আদর্শ জড়- পরিবেশের সৃষ্টি নহে। তাহার উৎপত্তি অতীন্দ্রিয়তায়। রাজকুমার সিদ্ধার্থ একদিন নগর পরিভ্রমণে বাহির হইলেন। তিনি পথে হঠাৎ একটি শবদেহ, একজন জ্বরাক্লিষ্ট ও এক বৃদ্ধ সন্যাসীকে দেখিলেন। এই বাস্তব দৃশ্য সিদ্ধার্থের জীবনে এক যুগান্তকারী ভাব সৃষ্টি করিল। তাহার মনে হইল, এই সংসার কেবলই দুঃখময় এবং জন্ম-মৃত্যুর এই সংসারচক্র হইতে মুক্ত হইতে না পারিলে জীবের দুঃখের অবসান নাই। সিদ্ধার্থের চিত্তে তাহার বাস্তব পরিবেশের এই প্রতিক্রিয়া উত্তরকালে ভারতে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস- প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ-সমাজ সৃষ্টি করিল। গৌতম বুদ্ধই এই সর্বপ্রথম শবদেহ ও জ্বরাক্লিষ্ট বৃদ্ধ দেখিলেন না, আবহমানকাল হইতে মানুষ নিত্যই ইহা দেখিতেছে; এমন কি গৌতম বুদ্ধ তাহার নিজের জীবনেও বহুবার এই দৃশ্য দেখিয়াছেন। প্রশ্ন হইতেছে, এই দৃশ্য ইতিপূর্বে সাধারণভাবে সকলের চিত্তে এবং বিশেষভাবে বুদ্ধের চিত্তে এই প্রতিক্রিয়া করিল না কেন এবং হঠাৎ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে বুদ্ধের এই চেতনা সৃষ্টি হইল কেন? জড়-পরিবেশ মানুষের ধারণা ও চেতনার স্রষ্টা- ইহাই যদি জড়-পরিবেশের পরম ধর্ম হয়, তবে জড়-পরিবেশ ব্যক্তি ও কাল নির্বিশেষে সমভাবে সকল চিত্তেই একই চেতনা সৃষ্টি করিত। কারণ, প্রকৃতি সমভাবেই সকলকে শাসন করিয়া থাকে। অগ্নির দাহিকাশক্তি আছে; ইহাই অগ্নি ধর্ম। রাণী এলিজাবেথ এবং কারখানার একজন শ্রমিক অগ্নি স্পর্শ করিলে অগ্নি উভয় দেহেই সমভাবে প্রতিক্রিয়া করিবে। ইহা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করিতেছে যে, জড়-পরিবেশ উপলক্ষ মাত্র। ব্যক্তি-চিত্তে বিশেষ একটি চেতনা সৃষ্টির জন্য বিশেষ ব্যক্তির অন্তর্জগতে বিশেষ একটি বৈচিত্র্যের প্রয়োজন এবং এই বৈচিত্র্যই চেতনার তথা ইতিহাসের স্রষ্টা, জড়-পরিবেশ নহে। কোন মহাপুরুষের চিত্তে কোন মুহূর্তে এই বৈচিত্র্য সৃষ্টি হইলে কোন এক শবদেহ বা জ্বরাক্লিষ্ট ব্যক্তি নহে, ইহাদের বিপরীত রাজপ্রাসাদের ভোগ-বিলাসের একটি দৃশ্যও এই একই ভাব সৃষ্টি করিতে পারে। মানবের অন্তর্জগতের এই আকস্মিক বৈচিত্র্যই আদর্শের স্রষ্টা এবং এই বৈচিত্র্য জড়-পরিবেশের প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া নহে, ইহা সর্বতোভাবে অতিলৌকিক।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, সমাজ-সংহতিই সমাজের প্রাণ। এই সমাজসংহতি মূলত তিন প্রকাররক্তভিত্তিক, স্বার্থভিত্তিক আদর্শভিত্তিক যে সমাজের সংহতি রক্তভিত্তিক, সে সমাজ রক্তভিত্তিক, স্বার্থভিত্তিক সমাজ-সংহতিসম্পন্ন সমাজ স্বার্থভিত্তিক এবং আদর্শ যে সমাজের প্রাণ, সে সমাজ আদর্শভিত্তিক। ভারতের সনাতন আর্য-সমাজ, প্রাচীন গ্রীক ও রোমক সমাজ এবং বর্তমান যুগে ইংরেজ ফরাসী প্রভৃতি সমাজ রক্তভিত্তিক সমাজের দৃষ্টান্ত। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পর আমেরিকার স্বর্ণখণির আকর্ষণে পৃথিবীর বহু দেশ হইতে দলে দলে মানুষ আসিয়া আমেরিকায় বসতি স্থাপন করে। বিশ্বের বহু জাতিসম্বলিত ভাগ্যান্বেষী এই মার্কিন সমাজ স্বার্থভিত্তিক সমাজের একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। ভারতের বৌদ্ধ-সমাজ, আরবের মুসলিম-সমাজ ও বর্তমান যুগে রাশিয়া ও চীনের মার্কসবাদী সমাজ আদর্শভিত্তিক সমাজ।

রক্তভিত্তিক সমাজের সংগতি কোন একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিলেও বিশ্ব- মানবের বিবর্তনে ইতিহাসে ইহাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রক্তভিত্তিক সমাজ বিশ্বের বহু সমৃদ্ধশালী সমাজকে নিজ গোষ্ঠী-স্বার্থে ধ্বংস করিয়াছে এবং যুগে যুগে বহু দুর্বল সমাজ-সংহতিসম্পন্ন সমাজকে শাসন ও নির্মমভাবে শোষণ করিয়া নিজ দেহ পুষ্ট করিয়াছে, ইহা সত্য, কিন্তু ইহাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা কেবল শাসন-শোষণ প্রভৃতি ধ্বংসাত্মক কার্যের অবদান বিশ্বমানবের সুখ-সমৃদ্ধিও বৃদ্ধি করিয়াছে। রক্তভিত্তিক সমাজ অত্যন্ত দীর্ঘায়ু এবং জীবন অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। কিন্তু একটি মারাত্মক দোষে ইহা দুষ্ট। রক্তভিত্তিক সমাজের কোন সার্বিক আবেদন নাই; নিজ সমাজ-জীবনের সর্বাংগীন উন্নতির ও মংগলসাধনপ্রবৃত্তি ইহার চিন্তা ও কর্ম-অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস। রক্তভিত্তিক সমাজের এই প্রবৃত্তি আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-বিগ্রহ, দুর্বলকে শোষণ ও শাসন প্রভৃতি সর্বপ্রকার বিশ্ব- অশান্তির কারণ। এই প্রবৃত্তির প্রাধান্যের জন্যই রক্তভিত্তিক সমাজকে নিজ সমাজের বহির্জগতে জালিমের ভূমিকায় দেখিতে পাওয়া যায়। স্বার্থভিত্তিক সমাজের ঐতিহাসিক দিক প্রধানত ধ্বংসাত্মক। আধুনিক মার্কিন সমাজের উৎপত্তি স্বার্থভিত্তিক হইলেও কালে এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতির রক্তসংমিশ্রণের ফলে বর্তমানে ইহাকে রক্তভিত্তিক বলা যাইতে পারে। এই বিবর্তনের ফলেই মার্কিন জাতি সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছে; কিন্তু তাহার স্বার্থভিত্তিক চরিত্রের প্রভাব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় নাই। মার্কিন সমাজের এই স্বার্থভিত্তিক সমাজ-চরিত্রের জন্যই বিশ্ব-সমাজে ইহাকে (ইহার জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রচুর অবদান থাকা সত্ত্বেও) প্রধানত বেনিয়ার ভূমিকায় দেখিতে পাওয়া যায় এবং এই কারণেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এই জাতি আণবিক শক্তি প্রয়োগে যুদ্ধ জয়ের কলংক অর্জন করিতে কোন প্রকার দ্বিধা বা লজ্জা বোধ করে নাই। হিটলারের মত উগ্র মানুষও আণবিক শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন আশংকা করিয়া আল্লাহ্ তা’আলার ক্ষমা ভিক্ষা করিয়াছিলেন। এই নৃশংস মারণাস্ত্র ব্যবহারে উগ্র ফ্যাসীবাদী জার্মান সমাজের চিত্তে ও বিবেকে যে চিন্তা, দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব দেখা দিয়াছিল, সেই মানবোচিত দ্বিধা ও দ্বন্দ্ব মার্কিন সমাজসমূহে কোন স্থান পায় নাই। ইহার কারণ, এই সমাজের উৎপত্তি স্বার্থভিত্তিক। বিশ্ব-মানবের বিবর্তনের ইতিহাসে ধ্বংসেরও প্রয়োজন আছে। এই স্বার্থভিত্তিক সমাজগুলোকে প্রকৃতি তাহার ধ্বংসাত্মক কার্যে ব্যবহার করিয়া থাকে।

হালাকুর স্বার্থভিত্তিক সমাজ মুসলিম আরব-সমাজের সমাজ-সংহতির শেষ স্পট ইতিহাসবিখ্যাত আব্বাসী সাম্রাজ্যের অবসান ঘটায়। ধ্বংসের এই ঐতিহাসিক প্রয়োজনকে উদ্দেশ্য করিয়া আল-কুরআন ঘোষণা করিয়াছে- “আল্লাহ যদি এক সম্প্রদায় দ্বারা অপর সম্প্রদায়কে ধ্বংস না করিতেন, তবে পৃথিবী কেবল ফ্যাসাদেই পূর্ণ থাকিত।”

বিশুদ্ধ আদর্শভিত্তিক সমাজ-সংহতি ও সমাজ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষ কল্যাণকর। ইহার আবেদন কোন এক গোষ্ঠী অথবা কোন এক স্বার্থচক্রের মধে সীমাবদ্ধ নয়। ইহার আবেদন সার্বিক। বিশুদ্ধ আদর্শভিত্তিক সমাজ কেবল মানুষের জৈবিক সত্তার সুখ-সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে এমন নহে; ইহা মানুষের অন্তর্জগতের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি ও উন্নততর মূল্যবোধ সৃষ্টি করিয়া মানুষের দেহ, মন ও মস্তিষ্কের সর্ববিধ কল্যাণ সাধন করে। আদর্শ এক প্রকার নহে এবং আদর্শভিত্তিক সমাজও এক প্রকার নহে। মার্ক্সবাদী আদর্শ মানুষের অন্তর্জগতে বহির্জগতের বস্তুনিরপেক্ষ ঐশ্বর্যবাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এই আদর্শের মতে মানুষের অন্তর্জগত তাহার বহির্জগতের বাস্তব পরিবেশে প্রতিক্রিয়ামাত্র। এই আদর্শ মানুষের নশ্বর জৈবিক সত্তাকে স্বীকার করে; কিন্তু মানুষের অবিনশ্বর সত্তাকে অলস মনের অজ্ঞানতাপ্রসূত আকাশকুসুম বিলাস-কল্পনা বলিয়া উপহাস করে। ইহা ছাড়াও ইহার আবেদন এক বিশেষ অর্থনৈতিক শ্রেণীচক্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই এই আদর্শ আপাতদৃষ্টিতে যতই মধুর বলিয়া মনে হউক না কেন, পরিণামে ইহা বিশ্বমানবের গভীর পরিতাপের কারণ হইবে। যে আদর্শ জীবের জৈবিক ও আত্মিক উভয় সত্তাকে স্বীকার করিয়া জাতি, গোত্র, শ্রেণী নির্বিশেষে বিশ্বমানবের এই উভয়বিধ সত্তার নিঃস্বার্থ কল্যাণ সাধনের প্রবৃত্তি জাগ্রত ও সক্রিয় করে, সেই আদর্শ-সৃষ্ট সমাজ ও সমাজ-সংহতি সারা বিশ্বজগতের জন্য নিরংকুশ আশীর্বাদ। মুসলিম আরবসমাজ এই প্রকার সমাজের একটি গৌরবোজ্জল ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত এই প্রকার আদর্শভিত্তিক সমাজকেই আলকুরআন বিশ্বজগতের জন্য আশীর্বাদ অর্থাৎ রাহমাতুল্লিল আলামীন বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন সূর্যের কিরণ, আসমানের পানি, প্রাণভরা বায়ু শস্যশ্যামলা রত্নগর্ভা ধরিত্রীর মত এই প্রকার আদর্শভিত্তিক সমাজ আল্লাহ তাআলার রহমত বা করুণার দান; ইহা অর্থনৈতিক শ্রেণীসংগ্রামের ফল নহে

 

(সমাজবিজ্ঞান ও ইসলাম গ্রন্থ থেকে সংকলিত)

৪৫১ বার পঠিত

শেয়ার করুন

Picture of আবুল হাশিম

আবুল হাশিম

আবুল হাশিম ছিলেন একাধারে রাজনীতিক ও দার্শনিক। তার রাজনীতি ও সমাজচিন্তা ছিল দার্শনিকতামন্ডিত। একই সাথে আদর্শবাদী রাজনীতিক, রাষ্ট্রচিন্তানায়ক, বুদ্ধিজীবী শুধু বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে নয়, সেকালের ভারতীয় মুসলিম সমাজেও দু একজনের বেশি জন্মাননি। এদিক দিয়ে বিচার করলে সর্বভারতীয় পর্যায়ে তৎকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষার তিনি অন্যতম ছিলেন।১৯৪০ এর দশকে আবুল হাশিম বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর একজন প্রগতিশীল ও চিন্তাবিদ লীগ নেতা হিসেবে তিনি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রধানত তার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে মুসলিম লীগ একটি গণসংগঠনে পরিণত হয় এবং বিকাশমান বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি স্থানীয় সংগঠন হয়ে ওঠে। তৎকালীন উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা মুসলিম জনঅধ্যুষিত প্রদেশ ছিল বাংলাদেশ এবং অত্র অঞ্চলের মুসলমানরাই ছিল সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত। আবুল হাশিম মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে এই নিপীড়িত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতেন। আবুল হাশিম রাজনীতিক হলেও তার রাষ্ট্রচিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক এবং তিনি চিন্তা ও দর্শনকে বাদ দিয়ে রাজনীতি খুব একটা করেননি। তার দার্শনিক তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইসলাম এবং তিনি মনে করতেন ইসলামী আদর্শ ও দর্শন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিকভাবে প্রয়োগ করে মানবতার মুক্তি অর্জন সম্ভব। এ ব্যাপারে রব্বানী দর্শনের প্রবক্তা আল্লামা আজাদ সুবহানীর বন্ধুত্ব ও বুদ্ধিবাদী প্রেরণা আবুল হাশিমকে উজ্জীবিত করেছিল।
Picture of আবুল হাশিম

আবুল হাশিম

আবুল হাশিম ছিলেন একাধারে রাজনীতিক ও দার্শনিক। তার রাজনীতি ও সমাজচিন্তা ছিল দার্শনিকতামন্ডিত। একই সাথে আদর্শবাদী রাজনীতিক, রাষ্ট্রচিন্তানায়ক, বুদ্ধিজীবী শুধু বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে নয়, সেকালের ভারতীয় মুসলিম সমাজেও দু একজনের বেশি জন্মাননি। এদিক দিয়ে বিচার করলে সর্বভারতীয় পর্যায়ে তৎকালের শ্রেষ্ঠ মুসলিম মনীষার তিনি অন্যতম ছিলেন।১৯৪০ এর দশকে আবুল হাশিম বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর একজন প্রগতিশীল ও চিন্তাবিদ লীগ নেতা হিসেবে তিনি বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রধানত তার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে মুসলিম লীগ একটি গণসংগঠনে পরিণত হয় এবং বিকাশমান বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি স্থানীয় সংগঠন হয়ে ওঠে। তৎকালীন উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা মুসলিম জনঅধ্যুষিত প্রদেশ ছিল বাংলাদেশ এবং অত্র অঞ্চলের মুসলমানরাই ছিল সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত। আবুল হাশিম মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে এই নিপীড়িত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করতেন। আবুল হাশিম রাজনীতিক হলেও তার রাষ্ট্রচিন্তা ছিল সার্বক্ষণিক এবং তিনি চিন্তা ও দর্শনকে বাদ দিয়ে রাজনীতি খুব একটা করেননি। তার দার্শনিক তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ইসলাম এবং তিনি মনে করতেন ইসলামী আদর্শ ও দর্শন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিকভাবে প্রয়োগ করে মানবতার মুক্তি অর্জন সম্ভব। এ ব্যাপারে রব্বানী দর্শনের প্রবক্তা আল্লামা আজাদ সুবহানীর বন্ধুত্ব ও বুদ্ধিবাদী প্রেরণা আবুল হাশিমকে উজ্জীবিত করেছিল।

মতামত প্রকাশ করুন

Scroll to Top