‘Every Native of Hindustan, I verily believe, is corrupt’- ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল, লর্ড কর্নওয়ালিশের এই উক্তি এদেশীয় জনতার প্রতি এক বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রভাব। যার মধ্যে দিয়ে ১৯০ বছরের ঔপনিবেশিক ইতিহাসে ব্রিটিশরা উপমহাদেশীয় জনগণকে এক নতুন আইডেন্টিটি প্রদান করার চেষ্টা করে; এবং এই পরিচয় ও সংজ্ঞায়ন থেকে বেরিয়ে যেতেই ভারতবাসী দীর্ঘ দুইশ বছর সংগ্রাম করে নিজেদের আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উনিশ শতকে জাতীয়তাবাদের ঢেউ ভারতবাসীকে উদ্বেলিত করে, এবং তার উপর ভিত্তি করেই তারা আত্মপরিচয় বিনির্মাণে নিবিষ্ট হয়। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’র ঘটনায়।
এই প্রবন্ধে আমরা দেখার চেষ্টা করব,
- ১. ঠিক কেন এবং কীভাবে বৃটিশরা উপমহাদেশের মানুষকে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণের আলোকে এক নতুন আইডেন্টিটি দিতে চেয়েছিল।
- ২. ঐতিহাসিকভাবে সেই আরোপিত আইডেন্টিটির গণ্ডি পেরিয়ে এদেশের জনতা কীভাবে তাদের আত্মপরিচয়ের সোপান গড়েছিল।
- ৩. ভাওয়াল সন্ন্যাসীর চাঞ্চল্যকর কাহিনীর আলোকে বিশ শতকের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ কীভাবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে।
বৃটিশরা কীভাবে ভারতীয় উপমহাদেশকে দেখেছিলঃ
অর্থনৈতিক লালসায় প্রবুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশরা যে মুহূর্তে বাংলায় এসেছিল, সে সময়টাতে ইউরোপে নতুন এক ধরনের জ্ঞান এবং চিন্তার উৎপাদন হচ্ছিল। নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল। এই নতুন জ্ঞান ইউরোপিয়ানদের মাঝে ‘আমরা’ বনাম ‘তারা’ এই পরিচয়ের জন্ম দেয়। Orientalism গ্রন্থের প্রখ্যাত লেখক এডওয়ার্ড সাঈদ এই নতুন জ্ঞানের বিকাশকে কয়েকটি ভাগে দেখান-
প্রথমেই ইউরোপীয়ানরা দুনিয়াকে ধারণা প্রসূত বর্ডারের মাধ্যমে দুই ভাবে ভাগ করে – প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য, তারা যেহেতু পাশ্চাত্যের অধিবাসী ছিল, তাই প্রাচ্য সম্পর্কে তাদের জানাশোনা ছিল বেশিরভাগ ধারণা প্রসূত এবং কিছুটা পৌরাণিক বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে। সেখান থেকেই জন্ম নেয় ‘আমরা’ এবং ‘অন্য’ ধারণাটির। যেখানে ইউরোপের ককেশিয়ান শ্বেতাঙ্গরা ‘আমরা’র অন্তর্ভুক্ত, বাকি সমগ্র দুনিয়া ‘অন্য’দের কাতারে পড়ে।
দ্বিতীয়ত- তারা তাদের ধারণার উপর ভিত্তি করে এক ধরনের জ্ঞান উৎপাদন করে যাকে ওরিয়েন্টাল জ্ঞান বলে অভিহিত করা হয়। এই ওরিয়েন্টালিস্ট জ্ঞান অনেকটা বদ্ধমূল ধারণা প্রসূত এবং যথেষ্ট সমস্যাগ্রস্ত ছিল। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, এই জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ইউরোপীয়ানরা ‘অন্য’দের নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। কেননা এই অর্জিত জ্ঞানকে তারা ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করত।
ওরিয়েন্টালিস্ট জ্ঞানের পরবর্তী ধাপে সাঈদ দেখান, স্যাসী- আর্নেস্ট রেনানদের হাত ধরে ওরিয়েন্টালিস্ট জ্ঞান কীভাবে পৌরাণিক জানাশোনার গণ্ডির বাইরে এসে একটা সিস্টেমেটিক অধ্যয়নের জায়গায় চলে আসছে। কিন্তু এখানেও বাধে বিপত্তি। স্যাসির নৃবিজ্ঞানগত দৃষ্টিকোণ প্রাচ্যের নানা মাত্রিক সমাজ ও সভ্যতার কাঠামোর গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম ছিলোনা। আবার রেনানও ভাষা তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাচ্যকে বোঝার যে পদ্ধতি প্রয়োগ করে, সেটাও যথার্থ ছিল না। কেননা তার অনুসৃত পদ্ধতি শুধুমাত্র ভাষার আক্ষরিক অনুবাদ করতে সক্ষম ছিল, এর গূঢ়ত্ব উপলব্ধিতে সক্ষম ছিল না।
যেহেতু এই ওরিয়েন্টাল জ্ঞান উপনিবেশবাদীদের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছিল। সেক্ষেত্রে এ সমস্যাযুক্ত জ্ঞান-চিন্তা, ঔপনিবেশিক চিন্তা কাঠামো ও উপনিবেশিতদের প্রতি তাদের মনোভাবকে প্রচণ্ড মাত্রায় বর্ণবাদী, শোষণমূলক ও তুচ্ছার্থকভাবে গড়ে দেয়৷
সেখান থেকেই পাশ্চাত্যের ডিসকোর্স দাঁড়ায় যে, প্রাচ্য পাশ্চাত্যের থেকে কম অগ্রসর। আর পাশ্চাত্যের ‘দায়িত্ব’ হচ্ছে এই অনগ্রসর জনসমুদ্রকে ‘সভ্য’ করা। এমনকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ব সময় পর্যন্তও এই ধারণায় দুনিয়াতে ব্যাপক প্রভাবশালী ছিল যে, প্রাচ্যে পাশ্চাত্যের আধিপত্য অলঙ্ঘনীয়ভাবে জরুরি।
সুতরাং এই ধরনের চিন্তা কাঠামো নিয়ে যখন তারা ভারতবর্ষে আসে, তখন দেখে যে এখানকার বর্নিল সমাজ-সভ্যতাকে তারা পাঠ করতে পারছেনা। বিশেষত সেনাপতি হিসেবে ব্রিটেনের সাথে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করা হতাশায় নিমজ্জিত, রগচটা লর্ড কর্নওয়ালিশ যখন ভারতবর্ষে আসেন, তখন তার মুখ দিয়ে ভারতীয়দের নিয়ে এ ধরনের তুচ্ছার্থক স্টেটমেন্ট এবং পরবর্তী কার্যক্রমে ঔপনিবেশিক ভাবধারা প্রকাশ পাওয়াই স্বাভাবিক। এখানে যদি আমরা তার উক্তিটি ‘Every Native of Hindustan, I verily believe, is corrupt’ পর্যালোচনা করি তাহলে দুইটি আইডেন্টিটি সামনে চলে আসে। এক, নেটিভ বা দেশীয়; দুই, কোরাপ্ট বা দুর্নীতিগ্রস্ত। দুটি পরিচয়ই তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত। যেখানে ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে ছোট করে দেখানো হচ্ছে।
কীভাবে ব্রিটিশরা ভারতীয়দের নতুন আইডেন্টিটি দেবার চেষ্টা করলঃ
The Dominion of strangers বইয়ের লেখক Jon E Wilson তার বইয়ে দেখাচ্ছেন, ব্রিটিশদের কলোনিয়াল শাসন ছিল সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত একটি নতুন শাসনব্যবস্থা। কেননা বৃটিশরা ভারতীয়দের বুঝতে সক্ষম ছিল না। তাই তাদের গৃহীত পলিসি, বা আইন কখনোই জনবান্ধব হতো না। বরং তারা তাদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যেই যাবতীয় বিধ্বংসী পলিসি বা আইন জারি করত।
ব্রিটিশরা যেহেতু এইখানকার ভূমিপুত্রদের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি। তাদের ভাষা ও তার গভীরতা বুঝতে সক্ষম ছিলোনা, তাই তারা এদেশের মানুষের কি প্রয়োজন, সেদিকে লক্ষ্য না করে এমন কিছু সিস্টেমের প্রচলন করে, যা তৎকালীন ইংল্যান্ডেও প্রচলিত ছিল না। যেমন- নৈর্ব্যক্তিক শাসনব্যবস্থা। সিভিল সার্ভিস ইত্যাদি। ফলে দেখা যায়, উপমহাদেশ ব্রিটিশদের নতুন নতুন পন্থা ও পদ্ধতির টেস্টিং গ্রাউন্ডে পরিণত হয়।
যেভাবেই হোক, ব্রিটিশদের সরকার এদেশে টিকে ছিল। কিন্তু এই শাসন পরিচালনায় তাদের জনবিচ্ছিন্নতার দরুন সীমাহীন অস্বস্তি এবং অসীম হতাশায় ভুগতে হতো। একটা সময় দেখা গেল, জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক একটা যান্ত্রিক সম্পর্কে রূপ নিল। এই বিচ্ছিন্নতাকে কাটাতে বৃটিশদের গৃহীত সকল পদ্ধতিই ব্যর্থ হলো। যেমন ১৭৯৩ সালে কর্নওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
এখান থেকে ভারতীয় অধিবাসীদের প্রতি ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার পেছনে ওরিয়ান্টাল জ্ঞানের ভূমিকা এবং উইলসনের ব্যাখ্যার আলোকে আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাই, পলাশী যুদ্ধোত্তর সময়ে বৃটিশরা ভয়াবহ লুটতরাজ চালায় এবং ১৭৬৭ পরবর্তী সময়ে গোটা অঞ্চলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ভয়াবহ দুর্নীতি, অরাজকতা ও সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যা হবার তাই হয়, ১৭৬৯-৭০ এর দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায় এবং মাত্র এক যুগের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রদেশটি এমন নিদারুণ বিপর্যয়ের শিকার হয়, যেখান থেকে সেরে উঠতে পরবর্তী চল্লিশটি বছর লেগে গিয়েছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জীর ভাষায় – “The foundation of the British rule in this country had been associated with so much scandal, immorality and inhumanity that nothing could purify it”
ব্রিটিশরা যখন এ দেশে শাসন কায়েম করল, তখন তারা এখানকার ভাষা, কালচারের কিছুই বুঝতো না। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে প্রথম গভর্নর জেনারেল নিয়োগ দেয়। গভর্নর হয়ে আসে ওয়ারেন হেস্টিংস, যে ভারতীয় কোন ভাষাই জানতো না। সে যেহেতু ওরিয়েন্টালিস্ট মাইন্ডসেটের ফসল, তাই তার এই সংক্রান্ত কিছু পদক্ষেপ উল্লেখ করতেই হবে, যা ক্রমান্বয়ে ভারতীয় আইডেন্টিটি তৈরির ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে বিবেচিত হবে।
ওয়ারেন হেস্টিংস এর নির্দেশনা এবং পৃষ্ঠপোষকতায় ১৭৭৬ সালে নাথানিয়াল ব্রাশি হ্যালহেড, স্বতন্ত্র দুটি হিন্দু-মুসলিম পরিচিতি সংকলন করেন। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলিমকে আলাদা হিসেবে দেখছে বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আসছে; যেখান থেকে ভারতীয় ইতিহাসে প্রথম বারের মত দাপ্তরিকভাবে হিন্দু- মুসলিম বিভাজনের শুরু। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড প্রণয়ন করে প্রথম বাংলা ব্যাকরণ , একই সময়ে চার্লস উইলকিংস এর মাধ্যমে শুরু হয় ভারতে প্রথম প্রিন্টিং প্রেস। এ দুইয়ের মাধ্যমে ভারতে বৃটিশরা প্রিন্ট-ক্যাপিটালিজমের শুরু করে। ১৮৮১ সালে হেস্টিংস নিজ খরচে শুরু করে কোলকাতা আলিয়া মাদরাসা; যা তৈরী করা হয় ব্রিটিশদের এদেশের ভাষা, বিশেষত ফারসী ও আরবী শেখানোর জন্য। যাতে তারা এদেশে সমাজ এবং সংস্কৃতিকে পাঠ করে আরো ভালোভাবে শোষণ করতে পারে।
এরপরে যখন লর্ড কর্নওয়ালিশ গভর্নর হয়ে আসে, তখন প্রথম পদক্ষেপেই কোম্পানির অভ্যন্তরে রিফর্ম নিয়ে আসে, যেখানে ভারতীয় কর্মচারীদের নেটিভ এবং কোরাপ্ট আখ্যা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়, এবং ব্রিটেন থেকে সম্পূর্ণ পিওর ব্রিটিশ কর্মচারী নিয়ে আসা হয়। এবং একই সাথে কর্নওয়ালিশ ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের সূচনা করে, যা অনেক পরে এক সময় গিয়ে ভারতীয়দের নতুন একটা আইডেন্টিটি দেয় ব্রিটিশদের প্রশিক্ষিত কেরানি হিসেবে। কিছুকাল পরে কর্নওয়ালিশ আরো ভালোভাবে খাজনা আদায়ের স্বার্থে নিয়ে আসে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। যেখানে সাবেক মুঘল অভিজাতদের পরিবর্তে নতুন এক ধরনের জমিদার শ্রেণি উঠে আসে, যাদের বেশিরভাগই উচ্চবর্গীয় হিন্দু। এই পলিসিটি ভারতীয় কলোনিয়াল ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে বিবেচিত। কেননা এর মধ্যে এক ধরনের মধ্যস্বত্ত্বভোগী অত্যাচারী বৃটিশদের সহায়ক হিসেবে একটা শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা পরবর্তী দুইশ বছর এদেশের সাধারণ কৃষক-প্রজাকে ভয়াবহ শোষণ ও অত্যাচারের মাধ্যমে ব্রিটিশদের গোলামীর জিঞ্জির পরিয়ে রাখে।
১৮৩৫ সালে ফারসীর পরিবর্তে রাজভাষা ইংরেজি করার মধ্য দিয়ে মুসলমানগন ভারতীয় রাজনৈতিক পরিসরে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। চাকরি হারিয়ে, শাসন হারিয়ে একেবারে দলিত শ্রেণির সমপর্যায়ে চলে যায়।
ভূমি সংস্কার আইনের মাধ্যমে ক্রোক করা হয়ে এদেশের শিক্ষা, সমাজ কল্যাণের জয় ওয়াক্ফ হিসেবে বরাদ্দকৃত লাখেরাজ বা খাজনা বিহীন জমি। মুসলিমদের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো এই তিনটি দুটি ধাক্কার পরে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে, এবং এই ধরনের বিধ্বংসী পলিসিগুলো পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলিম আইডেন্টিটি এবং উপনিবেশ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে পরিচালিত স্বতন্ত্র আন্দোলন সংগ্রামে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য যোগ করে।
ভারতে উপনিবেশের শুরুটা ওরিয়েন্টালিস্ট অপর তথা ভারতীয় নেটিভ এই পরিচয়ের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও ব্রিটিশদের গৃহীত পলিসির মাধ্যমে তা হিন্দু-মুসলিম স্বতন্ত্র আইডেন্টিটিতে রূপ নেয়। The Concise History of Modern India পাঠে ১৮০০ সাল পরবর্তী ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, সমগ্র ভারতবর্ষে সাবেক ক্ষমতাসীন মুসলিমদের পশ্চাৎপদ করে দিয়ে উচ্চবর্গীয় ব্রাহ্মণদের একটি ভদ্রলোক সমাজে রুপান্তর করা হচ্ছে। তাদের সাথে আবার নিম্নবর্গীয় সকল সনাতন ধর্মাবলম্বিকে একত্রিত করে হিন্দু আইডেন্টিটি দাঁড় করানো হচ্ছে। ইতিহাসের কিছু নোকতা এখানে প্রাসঙ্গিক, যেহেতু ভারত ইংল্যান্ডের প্রশাসনিক সংস্কারের টেস্টিং গ্রাউন্ড ছিল, শিক্ষা খাত ও এর ব্যতিক্রম ছিলোনা। যেই সময়ে ইংল্যান্ডে সরকারি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না, ধর্মীয় গোষ্ঠীর অধীনে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হতো, সেই সময়ে ভারতে সরকারি প্রণোদনায় কেরানি তৈরীর উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় পাটনা কলেজ ; যা মূলত ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত হতো।
তবে তার ও আগে, প্রথমবারের মত ১৮১৭ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ যেখানে শুধুমাত্র হিন্দুরাই পড়াশোনা করার সুযোগ পেত, ১৮৩০ এর দশকে দেখা গেল, শুধু কলকাতা শহরের হাজার হাজার ছাত্র এখানে ইংরেজ শিক্ষা নিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসনে অংশগ্রহণ করছে।
ব্রিটিশ শিক্ষা প্রাপ্ত এমনই একজন গ্র্যাজুয়েট রাম মোহন রায় ১৮২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সমাজ, যা মূলত উচ্চবর্গীয় হিন্দু পুনর্জাগরণের প্রথম দিককার একটি প্রতিষ্ঠান, উপনিষদের বানী পুনরুদ্ধার এবং আদি হিন্দুত্ববাদী স্পিরিটের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে রাম মোহন প্রকৃত হিন্দু হয়ে উঠতে চাইতেন, এবং তার এই চিন্তাভাবনাকে ছড়িয়ে দিতেই ব্রাহ্ম সমাজের উৎপত্তি ঘটান। আবার সতীদাহ প্রথা সংস্কারের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদ সংস্কারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
এই ধারাটিকে বৃটিশরা ইতিহাসের ওরিয়েন্টালিস্ট পাঠ গ্রহণ করাতে সক্ষম হয়, যেখানে মূল কথা হলো- ভারত তার পুরোনো ঐতিহ্য ও মহিমা হারিয়েছে। আর এখানে মূল দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয় মুসলিম শাসনকে। এখান থেকে ব্রিটিশদের প্ররোচনা এবং হিন্দুত্ববাদীদের একগুয়েমির দরুন হিন্দু-মুসলিম বিভাজন আরো প্রকট আকার ধারণ করে।
রাজা রাম মোহন রায়ের লিগ্যাসি পরবর্তীতে ধারণ করে কলকাতার ঠাকুর পরিবার, যাদের প্রথম পুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ভারতের ইতিহাসে প্রথম ব্রিটিশ কোলাবরেটর বা জমিদার হিসেবে পুঁজিবাদের উদ্যোক্তা। দ্বিতীয় পুরুষ দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন রাম মোহনের মৃত্যু পরবর্তী ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারক। তাদের উত্তরপুরুষ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। এই পরিবারটি কলকাতার ভদ্রলোক সমাজের নেতৃত্ব দিত। এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু পুনর্জাগরণে বিভিন্ন পদক্ষেপে এদের সরাসরি নেতৃত্ব রয়েছে।
এই ভদ্রলোক সমাজ ব্রিটিশদেরই প্রদত্ত একটি বিশেষায়িত ভারতীয় আইডেন্টিটি, যেখানে সাবেক ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হিন্দু সংস্কারক স্বামী বিবেকানন্দ, নাইটহুড প্রাপ্ত কবি রবীন্দ্রনাথ ; এরা সামনের সারিতে থেকে হিন্দু পুনর্জাগরণের নেতৃত্ব দেয় তৎকালীন সাহিত্য বিপ্লব ও প্রিন্ট কালচারের মাধ্যমে।
অপরদিকে ব্রিটিশদের এক চোখা নীতির ফলে ক্ষমতা ও সামাজিক অবস্থান হারিয়ে ধুঁকতে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ১৮শ শতকের বিখ্যাত সংস্কারক ও আলেম, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির সংস্কার আন্দোলন। তিনি ক্ষয়িষ্ণু মুঘল সাম্রাজ্যের ভেঙ্গে পড়া নিজের চোখে দেখেছিলেন, এবং মুসলিমদের অনগ্রসরতা ও দুর্বলতার কারণ হিসেবে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়াকে সাব্যস্ত করেন। মুসলিমরা যাতে যথাযথ ইসলামের শিক্ষাকে ধারণ করতে পারে তাই তিনি শত শত দিক নির্দেশনামূলক গ্রন্থ প্রণয়ন ছাড়াও ফারসী ভাষায় প্রথমবারের মত কোরআন অনুবাদ করেন। এবং পরবর্তীতে তার ছেলে শাহ আব্দুল আযীয উর্দু ভাষায় একই কাজ করেন এবং সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিসরে স্থিতি নিয়ে আসার অভিপ্রায়ে কোরআন, হাদীসকে উপজীব্য করে সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেন।
তাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই উত্তর ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন রায়বেরেলীর শহীদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভি। যিনি পরবর্তীতে বৃটিশদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং তার সঙ্গী সাথী সহ শাহাদাত বরণ করেন।
অন্যদিকে বাংলায় মীর নিসার আলী তিতুমীরের হাত ধরে প্রথমে অত্যাচারী জমিদার সম্প্রদায় এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ নীল কুঠির বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে এদেশের কৃষক। বৃটিশ শাসনের ভীতে কাঁপন ধরিয়ে দেয়া এ বিদ্রোহের অনল নিভে যায় ১৮৩১ সালে তিতুমীরের নারকেলবাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লার পতনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু তার লিগ্যাসী রয়ে যায় বাংলার অপর সংস্কারক, হাজী শরিয়াতুল্লাহ, এবং তার ছেলে দুদু মিয়ার ফরায়েজী আন্দোলনের মধ্যে। যেখানে স্বতন্ত্র মুসলিম আইডেন্টিটি প্রকট হয়ে ওঠে ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলির সুষ্ঠু প্রতিপালনের মাধ্যমে, পোষাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে।
এভাবেই ব্রিটিশদের গৃহীত পলিসি, আরোপিত নেটিভ আইডেন্টিটি এবং তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকার মাধ্যমে এক ধরনের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। সময়ের আবর্তনে যা স্বতন্ত্রভাবে হিন্দু এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদে রূপ লাভ করে।
ভারতীয়রা যেভাবে ব্রিটিশ আইডেন্টিটি থেকে বের হয়ে নিজেদের আইডেন্টিটি তৈরী করতে চেষ্টা করলঃ
১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ার পরে মুঘল সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন এবং সরাসরি ব্রিটিশ রাজ শুরু হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পালাবদল ঘটে যায় পরবর্তী একশ বছরে। সংক্ষেপে বলতে গেলে হিন্দু-মুসলিম স্বতন্ত্র পরিচয় চিরদিনের জন্য বিভাজিত হবার দ্বার খুলে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে হিন্দুত্ববাদ তখন উচ্চবর্গ এবং ব্রিটিশ শাসনের সহযোগী এবং মুসলিম মেজরিটি নিম্নবর্গ হিসেবে নিজেদের আইডেন্টিফাই করে এবং সে আলোকেই পরবর্তীতে নিজ নিজ রাজনৈতিক এজেন্ডা প্রণয়ণ করে। এখানে দুটি সম্প্রদায়ের ক্রনোলজিক্যাল ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে আসা যায়।
হিন্দু- হিন্দুত্ববাদী পুনর্জাগরণের বয়ান রাজা রাম মোহন রায়, বঙ্কিম চন্দ্রদের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদের নেতৃত্ব বিংশ শতাব্দীতে এসে পৌঁছায়। যেখানে আর্য সমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ, হিন্দু রোমান্টিসজমের যুগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে ১৯০০ সাল পরবর্তী সময়ে স্বদেশী আন্দোলন, সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের হিন্দুত্বায়ন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ।
মুসলিম- ক্ষমতা ও শাসনের দর্প হারিয়ে কৃষক প্রজা সম্প্রদায়ে পরিণত হওয়া মুসলিমদের বাংলায় নেতৃত্ব দেয়ার মত তেমন কোন অভিজাত ছিলেন না। ১৮৬৬ সালে ভারতের দেওবন্দে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির অনুসারীদের একটা অংশ প্রতিষ্ঠা করেন দেওবন্দ মাদরাসা, যা ক্লাসিক্যাল ইসলামি জ্ঞান ও চিন্তার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। এদিকে উত্তর ভারতের কিছু অভিজাতদের কর্মকাণ্ড বাংলা সহ সমগ্র ভারত বর্ষের মুসলিমদের প্রভাবিত করে। যেখানে ওরিয়েন্টালিজমকে অনুসরণ করে গড়ে উঠা ১৮৭৫ এর আলীগড় আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। স্যার সাইয়েদ আহমদ খান, সৈয়দ আমীর আলীরা এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন। ১৯০০ সাল পরবরতী সময়ে বঙ্গভঙ্গ, বঙ্গভঙ্গ রদ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র মুখপাত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, ফলে বাংলার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর তত্ত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় অল ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগ।
এভাবেই ভারতের দুটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী কলোনিয়াল ‘নেটিভ’ বা দাসের পরিচয় ছিন্ন করে নাগরিক হয়ে ওঠার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। তবে ইতোপূর্বে বৃটিশ পলিসির কারণে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক বিভাজন ভারতীয়রা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ১৯২০ এর দশকে খেলাফত আন্দোলন-অসহযোগ আন্দোলনের মত, বাংলায় বেঙ্গল প্যাক্টের মত সমন্বিত গুটিকয়েক ঘটনা থাকলেও তা এদেশীয় নেটিভদের সিটিজেন হয়ে ওঠার যাত্রায় বিভাজনকে রুখতে পারেনি এবং দিনে দিনে তা আরো জটিল ও জোরালো হয়েছে।
ভারতীয়দের বি-উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত অন্তর্নিহিত বিষয়গুলোকে পার্থ চ্যাটার্জি তার গ্রন্থ Nation and its fragments এ খুব অসাধারণভাবে তুলে ধরেন।
প্রথমত, ভারতীয়রা জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ব্রিটিশদের আরোপিত পরিচয়কে ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছে। আবার এই জাতীয়তাবাদ, পাশ্চাত্যের মত Imagined Community-র মত নয়, বরং আরও অনেক সুগঠিত ও স্বতন্ত্র। যেখানে বাহ্যিকতার বাইরে আধ্যাত্মিক বন্ধন, কালচার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ কলোনাইজারদের দ্বারা শোষিত হলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিজ নিজ প্রাধান্যকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। অর্থাৎ বস্তুগতভাবে পাশ্চাত্যের কাছে হেরে গেলেও আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রাচ্য এখানে বিজয়ী। শিক্ষা, সাহিত্য, পরিবার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমরা প্রাচ্যের যত বন্ধ কপাট দেখতে পাই, যেখানে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ প্রবেশ করতে পারেনি, তা এই নিজস্ব প্রাধান্যেরই প্রভাব।
তৃতীয়ত, ভারতীয়দেরকে বৃটিশরা তাদের ওরিয়েন্টাল জ্ঞান ও কলোনিয়াল মাইন্ডসেটের কারণে যেভাবে inferior বা other হিসেবে দেখতে চেয়েছে, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে ভারতীয়রা ব্রিটিশদের সাথে একটা সময় তাল মিলিয়ে জাগতিক উন্নয়ন সাধন করে, নিজেদের আধ্যাত্মিক বলয়কে সুরক্ষিত রেখেই।
চতুর্থত, ভারতীয়রা কলোনিয়াল মাইন্ডসেট থেকে মুক্ত হতে গেলেও যেই জায়গায় সবচেয়ে বড় কলোনিয়াল চিন্তাধারার শিকার হয়, সেটা হচ্ছে ইতিহাস। ওরিয়েন্টালিস্টরা যেভাবে নিজেদের একটা পৌরাণিক ইতিহাস তৈরীর কথা বলে, হিন্দুত্ববাদীরাও ঠিক একইভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করতে হিন্দু মিথলজির পুনঃ আমদানি করে এমন এক ইতিহাস তৈরী করে, যেখানে মুসলিমদের খারিজ করে দেয়া হয়। বরং তাদের ভারতের শত্রু অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখানো হয়।
আরো একধাপ আগে বেড়ে অনেকেই ব্রিটিশদের ভারতীয়দের পরিত্রাতা বলেও স্বীকার করে!