ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছে তাঁর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর উসূল বর্ণনা করেছেন। ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’ শব্দদ্বয় একটি আয়াত থেকে নেয়া হয়েছে।
এটি এমন একটি গ্রন্থ যার পূর্বে এমন আর কোনো গ্রন্থ রচিত হয়নি। এই গ্রন্থটি সকল কিছুর মধ্যে সমন্বয় ও সংযোজন ঘটায়। প্রথমত, আকল ও নাকলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। দ্বিতীয়ত, তাসাউফ ও শরীয়তের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। তৃতীয়ত, উসূল এবং আখলাককে মিশ্রিত করে তুলে ধরে। আমি মনে করি এই বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার কিছু বৈশিষ্ট্য
১/ জ্ঞানকে তিনি ‘শরীয়তী জ্ঞান’ ও ‘মাসলাহাতী জ্ঞান’ নামে দুই ভাগে ভাগ করেন এবং তিনি মাসলাহাতকে আহকামের মূল হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, আহকামে শরীয়া শুধুমাত্র ইখতিবারের জন্য নয়। অর্থাৎ, হুকুমসমূহ কেবলমাত্র কৃতকার্যদেরকে জান্নাতে এবং অকৃতকার্যদেরকে জাহান্নামে পাঠানোর জন্য আসেনি। প্রতিটি হুকুমেরই একটি ‘ইল্লত’ রয়েছে আর সেই ইল্লত হলো ‘মাসলাহাত’। শাহ ওয়ালীউল্লাহর মতে, হুকুমের উদ্দেশ্য হলো- মাসলাহতের প্রতিষ্ঠা ও মাফসাদাতের অপসারণ।
হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার কিছু কিছু অধ্যায়ে আকলের উপর জোর দেওয়ার কারণে তাকে ‘মু’তাযিলা’ অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। অথচ তিনি এই গ্রন্থেরই এক স্থানে বলেছেন, আকল হালাল ও হারামকে নির্ণয় করতে পারবে না এবং হুসুন ও কুবুহকে নির্ণয় করতে হলে ওহীর প্রয়োজন। এই কথা বলার পরও আকলের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান তাকে মু’তাযিলা বলে অভিযুক্ত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আকলের উপর জোর দানকারী সকল আলেমদেরকে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীকেও এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
২/ ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী তার হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন।
ক) القواعد الكلية التي تنتظم بها المصالح المرئية في الشرائع
এই অধ্যায়ে তিনি ইমাম গাজালীর ‘ইহইয়া উলূমুদ্দীন’ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন, এমন কয়েকটি বিষয়কে উসূলের মধ্যে সন্নিবেশিত করে উল্লেখ করেন। যেমন, أسرار الشرائع- অর্থাৎ শরীয়তের অন্তর্নিহিত অর্থসমূহকে দুটি মূলনীতির উপর দাঁড় করান। একটি হলো, مبحث البر و الاثم অর্থাৎ কল্যাণ ও অকল্যাণ বিষয়ক অধ্যায়। খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করুন এটি উসূলের একটি গ্রন্থ। এমন একটি গ্রন্থে مبحث البر و الاثم নামক একটি শিরোনাম রয়েছে। অপর একটি অধ্যায়ের নাম হলো, مَبْحَث السِّياسات المِلِّيَّة অর্থাৎ জাতীয় রাজনীতির অধ্যায়। এখানে মিল্লাত শব্দটি তিনি উম্মত অর্থে ব্যবহার করেছেন।
ইসলামী সাহিত্যে তিনি নতুন একটি পরিভাষা যুক্ত করেন সেটা হলো الارتفقات ‘ (আল-ইরতিফাকাত)। এ পরিভাষাটি আরব ভাইগণও ভারত থেকে শিখেছেন। ‘الارتفقات ’ কে الإنتفعات العامة (সর্বসাধারণের জন্য সুবিধা, Public Benefit) হিসেবে অনুবাদ করা হয়। তবে এর সামগ্রিকতার দিকে তাকালে দেখা যায় যে তিনি ‘الارتفقات ’ দ্বারা সমগ্র মানবতার কল্যাণকে বুঝিয়েছেন। ‘الارتفقات ’ নামক পরিভাষাকে তিনি মাকাসিদের মধ্যে স্থাপন করেন।
অন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা শাহ ওয়ালীউল্লাহ ব্যবহার করেছেন। সেটা হলো, تدبير منزل । এই পরিভাষাটিকে সর্বপ্রথম আল ফারাবী ব্যবহার করেন। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ تدبير منزل কে ‘الارتفقات ’এর মধ্যে স্থাপন করে উসূলের মধ্যে সন্নিবেশ করার চেষ্টা করেন।
খ) في بيان ما جاء عن النبي صلى الله عليه وسلم تفصيلا এই অধ্যায়ে তিনি রিসালাত নামক পরিভাষাকে কোরআন ও সুন্নতকে একত্রিতকারী একটি দলীল হিসেবে বিশ্লেষণ করেন। এই কারণে তিনি সুন্নতকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। একটি হলো রিসালাতের অংশ হিসেবে সুন্নত, অপরটি হলো অন্যান্য সুন্নত। এই রিসালাতের অংশ হিসেবে পরিগণিত হওয়া সুন্নতের সাথে অন্যান্য সুন্নতকে তিনি আলাদা করেন এবং তিনি বলেন, যে সুন্নতটি রিসালাতের অংশ সে সুন্নতকে কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের অনুসরণ করতে হবে।
এই গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ একটি বাক্য রয়েছে যেটি নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। সেই বাক্যটি হলো “আমাদের ফিকহ রূহবিহীন একটি শরীরের মতো আমাদের মধ্যে তার অস্তিত্বকে রক্ষা করে চলেছে এবং ফিকহের রূহ হলো আহকামের আসরারসমূহ”। অর্থাৎ ইবাদতের উদ্দেশ্য হলো ফিকহের রূহ। নামাজের হিকমত, রোজার হিকমত বা আসরারসমূহকে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার মতো একটি উসূলের গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই। তিনি আরও বলেন ‘ফিকহের সবচেয়ে বড় রূহ হলো ইজতিহাদ’। ফিকহ যখন ইজতিহাদকে হারিয়ে ফেলে তখন তা রূহবিহীন একটি শরীরের মতো হয়ে যায়।
৩। এই গ্রন্থে তিনি জ্ঞানকে নিম্নোক্তভাবে বিন্যাস করেন :
ক) ইলমুল হাদীস
খ) ইলমুল লুগাত
গ) ইলমুল ইসতিনবাত
ঘ) ইলমুল ইসতিদলাল
ঙ) ইলমুল আসরার
ইলমুল আসরার নামক অধ্যায়ে শরীয়তের সাথে তাসাউফ এবং উসূলের সাথে আখলাককে একত্রিত করার চেষ্টা করেন।
একইভাবে তার ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষাসমূহের মধ্যে একটি হলো, ‘সা’দাত’ (سعادة) বা কল্যাণ , এই পরিভাষাটিকে তিনি মাকাসিদ ও উসূলের মধ্যে উল্লেখ করেন। আপনারা জানেন যে, সা’দাত (কল্যাণ) একইসাথে আখলাকের প্রকারভেদের মধ্যে একটি। অর্থাৎ, আনুগত্যের আখলাক রয়েছে, ফজিলতের আখলাক রয়েছে এবং সাদাতের আখলাক রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকে যে সা’দাতের আখলাক মুসলমানগণ গ্রীকদের কাছ থেকে নিয়েছে। এই কথার কোনো ভিত্তি নেই। এটা এখান থেকে, ওটা ওখান থেকে এইভাবে বলে তারা আমাদের চিন্তা ও দর্শনকে, গ্রীক দর্শনের অংশ বলে চালিয়ে দিতে চায়। এসব ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
ইমাম শাহ ওয়ালীউল্লাহ, আখলাকের সাথে উসূল এবং আখলাকের সাথে ফিকহকে মিশ্রিত করার সময় ‘সা’দাত’ নামক পরিভাষাটিকে কেন্দ্রে স্থাপন করেন। তিনি বলেন, সা’দাতকে অর্জন করতে হলে চারটি বিষয় প্রয়োজন।
১। ত্বাহারাত (পবিত্রতা)। এখানে শুধুমাত্র শারীরিক পরিচ্ছন্নতা নয়; বরং বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক পরিচ্ছন্নতা এর অন্তর্ভুক্ত।
২। আল্লাহর সামনে বিনীতভাবে নত হওয়া।
৩। ঔদার্য, মহানুভবতা, উদারতা, বদান্যতা ও দয়া। একজন মানুষের সাথে অন্য মানুষের সম্পর্ক স্থাপনের মূলভিত্তি হিসেবে এই পরিভাষাটিকে ব্যবহার করেন।
৪। আদালত।
এই বিষয়গুলোকে তিনি মাকাসিদ বা বড় উদ্দেশ্য হিসেবে নির্ধারণ করেন। আমরা যদি এই সকল বিষয়কে অর্জন করতে পারি তাহলে সা’দাতে দারাইনে (ইহকালীন ও পরকালীণ কল্যাণ) উপনীত হতে সক্ষম হব।
অনুবাদঃ বুরহান উদ্দিন আজাদ